তেইশ নম্বর তৈলচিত্র – আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রথম লেখা একটি বিখ্যাত উপন্যাস। তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসটি প্রথমে ১৯৬০ সালে পদক্ষেপ নামে একটি পত্রিকাই ছাপা হয়। পরবর্তিতে তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসটি বিভিন্ন প্রকাশক কর্তৃক বহুবার মুদ্রিত হয়েছে।
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসটির বিবরণঃ
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র – উপন্যাস – আলাউদ্দিন আল আজাদ
উৎসর্গ – শিল্পীবন্ধু আমিনুল ইসলামকে মালিবাগের দিনগুলোর স্মরণে
সবিনয় নিবেদন
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র আমার প্রথম উপন্যাস। যে কোনো লেখক-শিল্পীর প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে তার যে অনুরাগ ও দুর্বলতা, এই লেখাটিও আমার হৃদয়ে তেমনি মিঠেকড়া, কাঁটাগুল্মময়, কখনো বা স্বপ্নের মায়াবৃক্ষ। লিখন সময়ই ছিল জীবনের গভীরে নিমজ্জন ও বিচ্ছিন্নতা, যা তখন আমার জানা ছিলো না- আজ বহুদিন পরে কাব্যতত্ত্বের এই উপাদান আবিষ্কার করে আমি বিস্মিত হই। জাহেদ চরিত্রে লেখকের আত্মাবিলুপ্তি ঘটেছে, জিনিসটা তখন বুঝতে পারিনি।
‘পদক্ষেপ’ নামের একটি অনিয়মিত কাগজের ঈদ সংখ্যায় গল্পটি প্রথম ছাপা হয়েছিল (১৯৬০)। একে বই আকারে প্রথম প্রকাশ করেন নওরোজ কিতাবিস্তান, প্রচ্ছদে ছিল মোহাম্মদ ইদ্রিস আঁকা মাতৃমূর্তি। সে সময়কার নওরোজের মোহাম্মদ নাসির আলি সাহেবকে ভুলতে পারি না। তার স্মিতহাস্য ও সহানুভূতি অতুলনীয় ছিল। মুক্তধারা, সাতবার ছেপেছে। সেজন্য অগ্রজপ্রতিম চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তৈলচিত্রের দশম মুদ্রণ, নতুন মুদ্রণ প্রযুক্তিতে প্রকাশ করছেন আহমদ পাবলিশিং হাউস। পরম সুহৃদ মেছবাহউদ্দীন আহমদকে সেজন্য অজস্র ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
আলাউদ্দিন আল আজাদ
মাঘ ১৯, ১৪০০ ফেব্রুয়ারি ০১, ১৯৯৪
রত্নদ্বীপ, উত্তরা, ঢাকা।
.
০১.
রংবেরং গাউন শাড়ি ওড়নার খসখস্, পালিশ করা কালো চচ্চকে জুতোর মচমচ, বিচিত্র কণ্ঠনিঃসৃত সংলাপের ঐকতান, এখন আর নেই। রাত দশটা, একজিবিশন হলের ভারি দরোজা প্রথম দিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল।
প্রথম দিনেই পুরস্কার ঘোষণা। বিদেশি কূটনীতিবিদ, উচ্চ সরকারি কর্মচারী, গণ্যমান্য নাগরিক, সাংবাদিক ও দর্শক নারী-পুরুষে ঘরটা জমজমাট। জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী, হয়তো তাই এতো ভিড়। উদ্বোধনী ভাষণ দেওয়ার জন্য স্যুটপরা গাট্টাগোট্টা মন্ত্রী মহোদয় উঠে দাঁড়ালেন। ললিতকলার ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তৈরি করা কথাগুলো শেষ করবার পর বললেন, রিয়্যালি ইট ইজ মাচ এনকারেজিং দ্যাট নিউ ট্যালেন্ট আর কামিং ফরওয়ার্ড টু এনরি দিস্ ফিল্ড অব ন্যাশনাল গ্লোরি। অ্যান্ড আই এ্যাম্ রিয়্যালি হ্যাপি টু এনাউন্স দ্যাট দি পোর্ট্রেট, হুইচ স্টুড় ফার্স্ট ইন দিস একজিবিশন, সো ফার আই রিমেম্বার অয়েল পোর্ট্রেট নাম্বার টুয়েন্টি থ্রি, ইজ নট অনলি এ গুড পিস অব আর্ট, বাট অলসো ভেরি নিয়ার টু এ মাস্টারপিস।
তখন সকলের মধ্যে গুঞ্জন পড়ে গিয়েছিল। বক্তৃতা শেষ হওয়া মাত্র ছবিটা দেখবার জন্য সে কি ঠেলাঠেলি। বেশির ভাগ দর্শক ভিড় জমালো গিয়ে সেখানেই। এই সঙ্গে শিল্পীর খোঁজ নিতেও ছাড়ল না।
ভেরি গ্ল্যাড টু মিটু ইউ। প্রসাধন-করা মুখ, একজন প্রৌঢ়া মহিলা বললেন, স্যার উইল ইউ হ্যাভ এ কাপ অব টি উইথ মি অ্যাট মাই হোম?
মহিলা একজন বিশেষ পরিচিত শিল্প সমঝদার। সময় পাব কিনা জানিনে, তবু বলে ফেললাম, ও সাট্যেলি; ইট উইল বি এ প্লেজার টু মি!
কলেজের দুতিনটে ছোকরা ও একটি মেয়ে আমার অটোগ্রাফও নিয়ে গেল। তাজ্জব এই এক মুহূর্তেই বিখ্যাত হয়ে গেলাম নাকি?
দেহমনে ক্লান্তি নেমে এসেছিল। চারটে বড়ি খেয়েও মাথা ধরাটা ছাড়ল না। কিন্তু তবু এখন গিয়ে যে শুয়ে পড়ব, সে ভরসা নেই। তিন রত্নের জোট। রাস্তায় বেরিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ঘোরাফেরা করবে, সঙ্গে না গেলে বলবে প্রাইজ পেয়ে পায়াভারী হয়েছে, মাটিতে পা পড়তে চায় না। আমি ভীরু নই, তবু এই অপবাদ স্বীকার করে নেব না বলেই হোটেলে ফিরে গেলাম না।
আমার তিন বন্ধু, তিনজনেই গুণী ছেলে, আর্ট স্কুলের কৃতী ছাত্র ছিল, বিদেশ ঘুরে এসেছে। চিত্রকলার তীর্থভূমি ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ডের গ্যালারি রেস্তোরাঁ গলিঘুজি ওদের নখদর্পণে, কোনো প্রসঙ্গে কথা উঠলেই চিৎকার করে ওঠে একেকবার। লন্ডনের কোন্ বাইলেনের কোন্ ঘুপচি আধো অন্ধকার কফিঘরে রাগী ছোকরাদের আড্ডা নোট বইয়ে তার ঠিকানা লেখা আছে; বুনিয়াদের ওপর নিজেদের ঘর তোলার জন্যই বুনিয়াদের বিরুদ্ধে যাদের অভিযোগ।
এরাও বিদ্রোহী। আর সে শুধু ভেতরে নয় বাইরেও। পোশাক-আশাক কেমন খাপছাড়া, তেরপালের মতো মোটা নীলচে কাপড়ের আটসাঁটো প্যান্ট আর গায়ে হালকা সবুজ রঙের জ্যাকেট। জুতোগুলো অর্ডার দিয়ে তৈরি করা অদ্ভুত সাইজ, বাজারে যার প্রচলন নেই। মাথার চুল কাটে না কখনো, চুলে তেল দেয় না তাই কুঁকড়ে কুঁকড়ে ফুলে। ফুলে থাকে। ছ’মাস দাড়ি রাখে, আর ছ’মাস গোঁফ। দাড়ি যতদিন থাকে গোঁফ প্রায় প্রতিদিন পালিশ করে কামায় এবং গোঁফের কালে দাড়িরও সেই অবস্থা। ওদের অলিখিত রীতিতে গালে চড় দেওয়া মানে ভালোবাসা, হাউমাউ করে কেঁদে ওঠা মানে হাসা। কোনো কারণে কেউ হাসলে অন্যজনে মুখ চেপে ধরে তার-এ নাকি কান্না এবং কান্না জিনিসটা সহ্যের অতীত। নারীর সঙ্গে পুরুষের কি ধরনের সম্পর্ক হবে, সে সম্পর্কে তাদের মতামত অদ্ভুত বটে কিন্তু নিঃসন্দেহে অভিনব।