তা রাগ ছাড়া আর কী! আমার সঙ্গে বেরোতেই চাও না। মেহেরা সাহেব কত দুঃখ করছিলেন। বলছিলেন, মদের ঝোঁকে কখন কী আবোল-তাবোল বলে ফেলেছিলাম, তার জন্যে মিসেস এত রেগে গেলেন যে–
বলেছেন বুঝি সাহেব? সুনন্দা মৃদু হেসে বলে, কোনটা কোন ঝোঁকে বলেছেন, সেটাই অবশ্য গোলমেলে রয়ে গেল। কিন্তু তোমার আজ ব্যাপার কী?চাঁচাছোলা কণ্ঠস্বর, পদক্ষেপ সঠিক, আজ বুঝি ড্রাই ডে?
নীলাক্ষ আর একবার মনের দাঁতটা কড়মড়িয়ে, মুখের দাঁতে হেসে ওঠে, তুমি কেবলই আমাকে মাতাল হতে দেখো। অথচ ক্লাবে আমায় সবাই বলে, এই মিস্টার মৈত্র হচ্ছেন একটি লোক, যাকে কোনওদিন টেনে তুলে নিয়ে যেতে হয় না, নিজের পায়ে বাড়ি ফেরেন।
সত্যি? সুনন্দা চোখে হাসির ঝিলিক মেরে বলে ওঠে, এ যে দেখছি দারুণ সার্টিফিকেট। বেশ! বেশ।
নীলাক্ষ ওই ঝিলিকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, আমার জন্যে ওইটুকুর বাজে খরচা কেন? আমি কি ওতে কাত হব?
কিন্তু মুখে নীলাক্ষকে অভিমানী স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়, ভাবছি–আর বেশ থাকব না। বেহেড হব! রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাব–
বাঃ বাঃ, চমৎকার! সাধু সংকল্প! সুনন্দা হাততালি দিয়ে ওঠে,উঃ দি আইডিয়া!
তা তুমি যদি আমার সঙ্গ ত্যাগ করো, উচ্ছন্ন যাওয়া ছাড়া গতি কি আমার?
সুনন্দা মনের দৃষ্টিটাকে শ্যেন করে। ওর শেষ চাল! নিজে উচ্ছন্ন যাবার ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে সেই পথে ঠেলে দেবার সাধু চেষ্টা। কিন্তু প্রভু, তোমার ইচ্ছের পুতুল হয়ে আমার স্বর্গে নরকে কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই। যাই যদি তো নিজের ইচ্ছেতেই যাব। নরকে হলে নরকেও।
কিন্তু সুনন্দাও মনের ছায়া বাইরে ফেলে না। সুনন্দা কৌতুকের গলায় বলে, তা সেটাই বা কম কী? উচ্ছন্ন নামক জায়গাটা তো পৃথিবীর সেরা জায়গা। যদি আমার কল্যাণে তুমি সেই সেরা জায়গার টিকিটটা সংগ্রহ করে ফেলতে পারো, নিজেকে আমি ক্রেডিট দেব।
আচ্ছা সেটা না হয় পরে দিও। আজ চলো না একটু আমার সঙ্গে।
(সুনন্দা মনে মনে) হুঁ বুঝেছি, নতুন কোনও রুই কাতলার সন্ধান পেয়েছ, খেলিয়ে তুলতে ভাল টোপ-এর দরকার। কিন্তু আমি আর তোমার টোপ হচ্ছি না। না, সতীধর্মের পরাকাষ্ঠা দেখাতে নয়, পবিত্রতার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতেও নয়, স্রেফ তোমার উদ্দেশ্য-সিদ্ধির হাতিয়ার না হবার জন্যে। তুমি যে হরদম তোমার সুন্দরী স্ত্রীটিকে ভাঙিয়ে খাবে, তা আর হতে দিচ্ছি না। ভেবো না তোমার থেকে আমি বোকা।
মুখে—
আজ তো হতেই পারে না। আজ আমার বিশেষ একটু কাজ আছে।
কাজ! তোমার আবার কাজ কী?
কেন, আমার কোনও কাজ থাকতে পারে না?
আঃ পারবে না কেন? তবে আমি জানি না, অথচ বিশেষ কাজ–
তাতে চোখ কপালে তোলবার কী আছে? আমি জানি না, অথচ তোমার বিশেষ, এমন কাজ তো ঝাঁকে ঝাঁকে আছে তোমার।
তা অবশ্য আছে—
নীলাক্ষ গৌরবের গলায় বলে, পুরুষের একটা আলাদা কর্মজীবন থাকে—
মেয়েদেরও সেটা থাকতে পারে।
কী ব্যাপার, তলে তলে কিছু আয় উপায় করা হচ্ছে নাকি?
সুনন্দা এবার মুখের সেই ব্যঙ্গহাসির খোলসটা খুলে ফেলে বলে, যদি হয়, সেটা কি ভুল করা হবে? সংসারের অবস্থা তুমি জানো তো?
সংসারের?
নীলাক্ষ সহসা উদ্দীপ্ত গলায় বলে ওঠে, আমি সংসারের অবস্থা জানতে যাব কী জন্যে? সংসার আমার অবস্থা জানতে চেয়েছে কোনওদিন? আজই আমি দুপয়সা করে খাচ্ছি, কিন্তু এমন দিনও গেছে আমার যে, একটা সিগারেট কেনবার পয়সা জোটেনি, বন্ধুদের কাছে ধার করে করে বন্ধু হারিয়েছি। একটা ভিন্ন দুটো গরম স্যুট ছিল না। দেখেছে সেদিকে তাকিয়ে সংসার? না না, সংসার যেন আমার কাছে কিছু আশা করে না।
করছেও না।
সুনন্দা জানলার কাছে সরে গিয়ে বলে, করছেও না সে আশা।
কিন্তু তুমি? তুমি আমার স্ত্রী, তুমিই বা সে আশা দেখাতে যাবে কেন? বহুবার তোমায় বলেছি– আমরা এখান থেকে সরে পড়ি ।
অথচ আগে যখন আমি বলেছি ওকথা, তুমিই বলেছ, চলে গেলে বাড়ির ভাগ পাব না।
বলেছিলাম! মানছি সেকথা! কিন্তু কর্তার যা মতিগতি দেখা যাচ্ছে, তাতে আর এ বাড়ির একখানা ইটও উত্তরপুরুষদের জন্যে থাকবে বলে মনে হয় না। স্রেফ তো জরদগব হয়ে বসে আছেন। কোনওদিন শুনব বাড়ি মর্টগেজ আছে। হ্যাঁ, হঠাৎ কোনওদিন এ কথা শুনলে আশ্চর্য হব না। তারপর? বাড়ির কর্তাটির যদি হঠাৎ এদিক-ওদিক হয়ে যায়, তখন? ভেবেছ তখন গলায় কী কী পড়বে? বিধবা মা, আইবুড়ো বোন, অপোগণ্ড ভাই, ওই এক আগাছা, আর নিজের স্ত্রী-পুত্র তো আছেই। বুঝছ অবস্থা?
বুঝেছি বইকী! সুনন্দা বলে,আহা, ভেবে এখন থেকেই তোমার জন্যে করুণা হচ্ছে। এই বঙ্গভূমিতে কার কার ভাগ্যে এহেন গন্ধমাদন চেপেছে!
নীলাক্ষ ট্রাউজার ছেড়ে পায়ে একটা পায়জামা গলাতে গলাতে বলে, জানি তুমি ব্যঙ্গ করবে। জানি আমার জন্যে সহানুভূতির কানাকড়িও নেই। কেন যে এখনও ও আমার দু চক্ষের বিষ– বলে ডিভোর্স স্যুট আনছ না তাই ভাবি। আনছ না বোধ হয় তোমার এই সাধের শ্বশুরবাড়ি, পরম পূজনীয় শ্বশুরঠাকুর, আদরের ঠাকুরপো ঠাকুরঝিদের হারাতে হবে ভেবে।
সুনন্দা খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, এই সেরেছে, কারণটা ধরে ফেলেছ? সত্যি তুমি কী চালাক।
নীলাক্ষ একথার উত্তর দেয় না।
নীলাক্ষ হঠাৎ বলে ওঠে, আচ্ছা, মীনার কী হয়েছে বলতে পারো?