- বইয়ের নামঃ শ্রীশ্রীমার আধুনিকতা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
শ্রীশ্রীমার আধুনিকতা
শ্রীশ্রীমা সারদামণির লীলাকথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে হয় কোন কথাটি নিয়ে আলোচনা করবো? সেই লীলাসমুদ্র তো বহুবিচিত্র ভাবতরঙ্গে উদ্বেল নয়, নয় বহুকর্মের আবর্তে আলোড়িত। সে যেন এক ধীর স্থির প্রশান্ত মহাসাগর। তাই মনে হয় সেই মহাসাগরের কোন তট থেকে ঘট ভরবো? আর ঘট ভরে জল তুলে সমুদ্রের বিশালতার দিশা পাবো কেমন করে?
বস্তুত ঘট ভরে নিয়ে যেমন সমুদ্রের স্বরূপ বোঝা যায় না, তেমনি দুচারটি ঘটনা, দুচারটি অলৌকিক মহিমার উদঘাটন উদ্ধৃত করে মহজীবনের বিরাটত্ব উপলব্ধি করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন আলাদা দৃষ্টির, আলাদা অনুভূতির।
সে অনুভূতি আমাদের কোথায়? কোথায় সেই দৃষ্টি?
তাই প্রায়শই আমরা শ্রীশ্রীমার লীলাপ্রসঙ্গে হয় তাঁকে সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ের কারণ-স্বরূপিণী মহালক্ষ্মী মহাজগদম্বা ইত্যাদি কল্পনা করে স্তবস্তুতির ভারে ভাষাকে ভারাক্রান্ত করে তুলি, না হয় তার জীবনের দৃশ্যমান এমন কয়েকটি ঘটনা নিয়ে বারবার নাড়াচাড়া করে থাকি, যেগুলি তার মহিমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। এর কোনওটাই মূলভাবের দিশা এনে দিতে পারে না। ভাব নেই, তাইতো আমাদের সর্বদাই অভাব। ভাবকে স্বভাবে আনতে শিখলাম কই?
তবু মায়ের কথা আলোচনা করবার সাধ হয় বইকি। আপন অযোগ্যতা জেনেও হয়। আর হয়তো তার প্রয়োজনও আছে। প্রয়োজন আমাদের নিজেদেরই জন্য। দেবতার যে পূজা সে তো দেবতার ভোগের জন্য নয়। মানুষের নিজেরই চরিতার্থতার জন্য।
পূজা, সেবা, স্তব-স্তুতি, জপ, আরাধন, নামকীর্তন ইত্যাদির দ্বারা শুধু যে মনঃশুদ্ধি হয় তা নয়, দেহও বিশুদ্ধ হয়। মাতৃনামে তো আরোই।
তাই মায়ের কথা আলোচনা করার প্রয়োজন মাতৃজাতিমাত্রেরই আছে। অবশ্য প্রয়োজন হিসেবেই আছে।
শ্রীশ্রীমা সারদামণির প্রকটলীলা বহুকর্মের আবর্তে আলোড়িত নয় সত্য, কিন্তু সেই স্থির সমুদ্রের অন্তরালে যে প্রচ্ছন্ন কর্মপ্রবাহ ছিল, তা আজও প্রবহমান।
সমগ্র ভারতের, তথা সমগ্র বিশ্বের নারীশক্তির চেতনার মধ্যে সেই কর্মধারা আজও অব্যাহত। অত্যুক্তি করা হবে না, যদি বলি শ্রীশ্রীমার জীবনাদর্শই আজ সমগ্র ভারতের নারীশক্তিকে জাগ্রত করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে সমগ্র বিশ্বের নারীশক্তিকে। আমরা কিছু পরিমাণে অবতারবাদে বিশ্বাসী হলেও বলবো, সারদামণির মধ্যে যে শক্তি কাজ করেছে সে শক্তি দৈবীশক্তি নয়, নারীশক্তিই।
শ্রীশ্রীমার বহিমূর্তিটি ছিল প্রাচীন আদর্শের প্রতীক, কিন্তু অন্তরমূর্তিটি ছিল আশ্চর্য আধুনিক।
আধুনিক শব্দটি আমি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম, কারণ গতানুগতিক সংস্কারের বন্ধনমুক্ত যে মন, সেই মনকেই আমরা আধুনিক মন বলে থাকি।
সারদামণিকে আমরা দেখতে পাই শতাব্দীকাল পূর্বের বাংলার রক্ষণশীল গ্রাম্যসমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। তাও আবার গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজের। যেখানে উনবিংশ শতাব্দীর শহুরে আবহাওয়ার লেশমাত্র গিয়ে পৌঁছয়নি।
তার মধ্যে–সেই নিতান্ত সাধারণ নিতান্ত গণ্ডিবদ্ধ পরিবেশের মধ্যে গঠিত হয়েও, শ্রীশ্রীমা যে আশ্চর্য সুন্দর একটি আধুনিক মনের অধিকারিণী হয়েছিলেন, তার তুলনা দুর্লভ।
অবশ্য বলা যেতে পারে, আমরা যদি অবতারবাদে বিশ্বাসী, তবে আর এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? যিনি ঈশ্বরের অবতার, তার পক্ষে তো সবই সম্ভব।
কিন্তু ঈশ্বর যখন মানবদেহ নিয়ে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি সাধারণ মানুষের মতই আচার আচরণ করতে ভালবাসেন। তখন তিনি মানুষের মতই সুখে দুঃখে উদ্বেলিত হন, নিন্দা প্রশংসায় বিচলিত হন, আনন্দে হাসেন, বেদনায় কাঁদেন। এই নিজেকে ঢেকে রাখা, অবতার লীলার একটি বিশেষ লক্ষণ।
এ নইলে যে, অবতীর্ণ হওয়াই ব্যর্থ। ঈশ্বরের করুণার স্পর্শ তো মানুষ নিয়তই পাচ্ছে, তবু সে পথভ্রষ্ট হয়। তাই ঈশ্বরকে নেমে আসতে হয় প্রত্যক্ষ স্পর্শের মূর্তিতে। বলতে হয় ওগো আমি তোমাদেরই একজন, বলতে হয় এই যে এসো, এইতো পথ। সত্যের পথ, নির্ভয়ের পথ, নির্ভরের পথ!
স্থূলবুদ্ধি মানুষকে হাত ধরে পথ চিনিয়ে দিতে স্থূলস্পর্শের প্রয়োজন হয় বলেই ভগবানকে যুগে যুগে অবতীর্ণ হতে হয়। অবতীর্ণ হয়ে দেখাতে হয় মানুষীলীলা।
তাই শ্রীরামচন্দ্রকেও সীতাকে হারিয়ে উন্মত্ত শোকে বিলাপ করতে হয়েছিল, আবার লোকনিন্দার ভয়ে সেই সীতাকে দেওয়াতে হয়েছিল অগ্নিশুদ্ধির পরীক্ষা, দিতে হয়েছিল তাকে বনবাস।
মানুষের ভূমিকা নিখুঁতভাবে অভিনয় করবার খাতিরেই রামচন্দ্র প্রচলিত সংস্কারের বন্ধনকে মেনে নিয়েছিলেন, নিরুপায়ের ভঙ্গিতে।
শ্রীশ্রীমাও এই নিয়মের অধীন হয়েই ভাইঝি রাধুর প্রতি অন্ধ আসক্তির খেলা দেখিয়েছেন, পাগলী ভ্রাতৃজায়ার নির্যাতনে কাতরতার ভান দেখিয়েছেন, শতাব্দীকাল পূর্বের সমাজবদ্ধ অবগুণ্ঠিতা বধূর ভূমিকা পালন করেছেন।
শুধু ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কারের আবরণ ভেদ করে বিদ্যুৎদীপ্তির মতই ঝলসে উঠেছে মুক্ত মহিমা। তথাপি একশ বছর আগের গ্রাম বাংলার সেই রক্ষণশীল সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে তিনি কী ভাবে মেনে চলেছেন, কী ভাবে চিরদিন নিজেকে আবৃত রেখেছেন অবগুণ্ঠিতা গৃহস্থবধূর আবরণের অন্তরালে, তা ভাবলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।