- বইয়ের নামঃ গাছের পাতা নীল
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. অধ্যাপক মৈত্র
গাছের পাতা নীল – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
কোনও দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন অধ্যাপক মৈত্র। যেমন মাথা নিচু করে চলে যায় সাহায্যপ্রার্থী গরিব তার ধনী আত্মীয়ের দরজা থেকে অবহেলার দান কুড়িয়ে নিয়ে।
অবহেলাই। অবহেলা করেই ছেড়ে দিল ওরা শেষটায় ওদের আসামিকে। বোধ করি বা একটু করুণাও হয়েছিল ওদের কারও কারও, অধ্যাপকের গম্ভীর হতাশা-আঁকা অসহায় মুখ দেখে। বলল, যাক গে, চলে যান।
অবিশ্যি গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দলের মধ্যে থেকে দু-একটা শেয়াল ডাক উঠল বইকী, ওদের এতদিনকার প্রিয় আর সম্মাননীয় অধ্যাপকের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা লক্ষ করে। উঠল দু-একটা তীব্র অসভ্য সিটি। কিন্তু সে তো হবেই। ওইটুকুর ওপর দিয়েই যে গেছে, প্রৌঢ় লোকটাকে যে হাসপাতালে পাঠায়নি ওরা এই ঢের। ইচ্ছে করলেই নাকি ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে পারত, অথবা মুখে ঘুসি মেরে দাঁত খসিয়ে নিতে পারত। তা করেনি ওরা।
অতএব বলতেই হবে রীতিমত ভদ্রই ওরা। ওরা শুধু সিটি মেরে দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, আর পিছনে হুক্কা হুয়া ডেকেছে।
হুক্কা হুক্কা, হুক্কা হুয়া।
শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলেন অধ্যাপক।
না, কানে হাত চাপা দিলেন না, অথবা ওদের সম্পর্কে কোনও অভিশাপবাণীও উচ্চারণ করলেন না। অনুভূতির যন্ত্রটা কেমন অসাড় অসাড় লাগছে, শুধু বুকের মধ্যে কীসের যেন একটা পাষাণভার। এ কি হৃদ্যন্ত্রে কোনও কঠিন ব্যাধি আক্রমণের পূর্বলক্ষণ? না শুধু ভয়ংকর একটা উত্তেজনার ভার?
এই ভারটা প্রথম অনুভব করেছিলেন অধ্যাপক যখন তাঁর ক্লাসে লেকচারের সময় ছেলেরা রাজনীতি নিয়ে তুমুল তর্ক তুলেছিল এবং বেশ কয়েকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তর্ক তো থামায়ইনি, বরং বলে উঠেছিল, এই আছেন এক পেঁতি বুর্জোয়া, সত্যিকথা শোনবার সাহসটুকুও নেই।
তখন। হঠাৎ ওই ভারটা অনুভব করেছিলেন অধ্যাপক মৈত্র। আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।
চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, গেট আউট। যারা গোলমাল করছ, বেরিয়ে যাও আমার ক্লাস থেকে।
অধ্যাপক মৈত্রের দীর্ঘ অধ্যাপনার ইতিহাসে এমন ঘটনা বোধ করি এই প্রথম। তাঁর স্বরনালী থেকে এমন রূঢ়স্বর বেরোনো সম্ভব একথা আর কেউ দূরে থাক, তিনি নিজেও বুঝি কখনও জানতেন না।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও–এমন কথা জীবনে কখনও মনে মনেও বলেছেন কি মৈত্র? বোধ করি বলেননি। কারণ অতীতে এমন পরিস্থিতি আসেওনি। পড়ানোর গুণে তিনি সকলের প্রিয়, চরিত্রের গুণে সকলের শ্রদ্ধেয়।
তবে তিরস্কার কি আর করতে হয় না কখনও? কলেজের কিছু ছাত্র তো সর্বদাই থাকে যারা ছাত্র নামের অযোগ্য, যারা অসভ্য অভব্য দুর্বিনীত।
করতে হয় তিরস্কার, কিন্তু অধ্যাপক মৈত্র বরাবরই সেটা করেছেন তাঁর নিজস্ব মৃদু অথচ দৃঢ়ভঙ্গিতে। যেটা অনেক সময় ধমকের চেয়ে কার্যকরী। যার সামনে অবিনয় অভব্যতা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে।
কিন্তু আজ অন্য ঘটনা ঘটে গেল। যার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে অধ্যাপক মৈত্রেরই মাথা হেঁট করে প্রস্থান।
মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সুদীর্ঘ সাধনা-অর্জিত সম্মানের আসনটি হারালেন অধ্যাপক মৈত্র।
মুহূর্তের মধ্যে যেন কী হয়ে গেল।
রূপান্তর ঘটে গেল অধ্যাপক মৈত্রের সামনের ওই ভদ্র চেহারার আর সভ্য পোশাকের ছেলেগুলোর। হঠাৎ দেখতে পেলেন অধ্যাপক, তিনি একদল গুণ্ডার দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, তাই দেখলেন অধ্যাপক সরোজাক্ষ মৈত্র। মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগেকার এমনি এক অবস্থার কথা– কোনও এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বেশি রাত্রে ফিরছিলেন। ট্রাম রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয় সে বাড়ি থেকে। রাস্তার লোকসমাগম কমে গেছে। কিন্তু সরোজাক্ষ সেটাকে বিপজ্জনক মনে না করে বরং শান্তির কারণ মনে করে নানা কথা ভাবতে ভাবতে আসছিলেন। ভাবছিলেন নসুমামা এমন কিছু বড়লোক নন, অথচ মেয়ের বিয়েতে যা দানসামগ্রী দিয়েছেন, তা বড়লোকের মতো। কষ্ট করেই দিয়েছেন। তবে না দিলে নাকি বিয়েটা ঘটত না। এমন ভাল জামাইটি হাতছাড়া হয়ে যেত। তাই বহু টাকা ঋণ করে নসুমামা ভাল জামাইয়ের উপযুক্ত দক্ষিণা সংগ্রহ করেছেন।
ভাল জামাই!
ভালর সংজ্ঞাটা কী?
ভাবতে ভাবতে আসছিলেন সরোজাক্ষ, হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে পাঁচ-সাতটা লোক উঠে দাঁড়িয়ে ঘিরে ধরল সরোজাক্ষকে। আর কবলিত শত্রুকে ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিতে ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠল, সঙ্গে যা আছে চটপট বার করে দাও তো জাদু!
ঠিক যে ভঙ্গিতে একটু আগেই সরোজাক্ষর ছাত্ররা বলে উঠেছিল, তাঅ্যাপলজিটা একবার চেয়েই নিন না স্যার চটপট।
হ্যাঁ, ওটাই দাবি ছিল ওদের। এই দাবিতেই ঘেরাও করেছিল তাঁকে। ক্ষমা চাইতে হবে অধ্যাপককে তাঁর উদ্ধত বচনের জন্যে।
.
সেদিনের সেই গুণ্ডাগুলোর দাবি এক কথাতেই মিটিয়ে দিয়েছিলেন সরোজাক্ষ। টাকা-পয়সা বেশি ছিল না সঙ্গে, কিন্তু দামি ঘড়িটা হাতে ছিল, ছিল সোনার আংটি সোনার বোতাম। নিজের বিয়েটা তখনও খুব পুরনো হয়ে যায়নি তাই বিবাহলব্ধ ওই জিনিসগুলো ছিল। সরোজাক্ষর শ্বশুর অবস্থাপন্ন ছিলেন, জামাইকে দামি দামি জিনিসই দিয়েছিলেন।