- বইয়ের নামঃ ভুলে গেলে চলবে না
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
ভুলে গেলে চলবে না
যদিও কবির মহৎ অনুভূতিতে উচ্চারিত হয়েছে–জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি সে জাতির নাম মানুষ জাতি। আর একথাও জানা আছে কালো আর সাদা বাহিরে কিন্তু ভিতরে সবাই সমান।
তবু সেই মানুষ জাতটার মধ্যেই কত জাতি, কত সমাজ, কত বৈচিত্র্যময় বিকাশ। আহারে বিহারে আচরণে আভরণে একের সঙ্গে অপরের আকাশ পাতাল পার্থক্য। ভাষা তো সংখ্যাতীত। আর আমাদের ভারতবর্ষ তো বলতে হয় একটি মিনি পৃথিবী, কত ভাষা কত ধর্ম, কত বর্ণ বৈচিত্র্য।
তথাপি যে কোনও ধরণেরই সমাজ হোক, তা সে আদিবাসী, উপজাতি একেবারে অনুন্নত হলেও, প্রত্যেকটি সমাজের মধ্যেই আছে নিজস্ব কিছু ধ্যান-ধারণা বিশ্বাস সংস্কার আর মূল্যবোধ, সেই প্রবহমান ধারার কাছে সে একান্ত দায়বদ্ধ। সংস্কার যদি কুসংস্কারের জালে আচ্ছন্ন হয়েও যায়, তবু তার সম্পর্কে নিষ্ঠাই তার মধ্যে মেরুদণ্ডের কাজ করে।
বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ জাতটি কোনও পরিবেশেই জীবনচিন্তা সম্পর্কে উদাসীন নয়। তাই সেই গুহামানবের যুগ থেকেই সমাজ নিয়ে মানুষ অবিরতই ভাঙা গড়া করে চলেছে। কারণ মানুষ সহজাত ভাবেই চায় উৎকর্ষ আর উত্তরণ। সেই চাওয়াই তাকে কখনও স্থির থাকতে দেয় না। তাই জীবন আর সমাজ নিয়ে মানবসমাজে পরীক্ষানিরীক্ষার আর অন্ত নেই।
তবে একথা মানতেই হবে যে ধরণেরই সমাজ হোক, সমাজ গঠনে নারীর ভূমিকাই প্রধান। সমাজ ব্যবস্থা রক্ষায় নারীর দায়িত্বই সমধিক। এ প্রাধান্য আর কেউ না, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তাকে দিয়ে রেখেছেন। কারণ নারীই তার সৃষ্টিলীলা অব্যাহত রাখার প্রধান সহায়িকা। আর নারীই সেই লীলাকে করে তুলতে পারে সুষমামণ্ডিত মহিমান্বিত। নারী জননী, নারী জগতের ধাত্রী। সৃষ্টিকর্তা তাই নারীহৃদয়ে মজুত রেখেছেন অফুরন্ত স্নেহ আর রেখেছেন সহিষ্ণুতা ধৈর্য সহনশক্তি। রেখেছেন আত্ম-বিলোপী উদারতা।
যেখানে নারীহৃদয়ে এই গুণগুলির অভাব, সেখানেই সে সমাজ খণ্ড বিচ্ছিন্ন অসুন্দর। সংসারের একটি পুরুষ স্বেচ্ছাচারী বা বিপথগামী হলে, সে নিজেই ধ্বংস হয় মাত্র। কিন্তু একটি নারী স্বেচ্ছাচারিণী বিপথগামিনী হলে সমগ্র সংসারটাই ধ্বংস হয়। ধ্বংস হয় কুল বংশমর্যাদা সম্ভ্রম।
সমাজ তরণীটিকে ঠিকপথে দরিয়া পার করতে নারীই হচ্ছে তার হাল বৈঠা। সমাজ যানটিকে অভ্রান্ত পথে চালাতে চাইলে নারীই সে গাড়ির স্টিয়ারিং।
দূরকালে প্রাচীন ভারত একদা এই পরম সত্যটি অনুধাবন করেছিল বলেই নারীর আদর্শ বা আদর্শ নারীর রচনায় মনোনিয়োগ করেছে বেশি। একথা তো সত্য পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে যখন (হয়তো আজকের অতি উন্নত প্রগতিশীল সমাজেও) মানুষ অরণ্যচারী বল্কলধারী তখন ভারতবর্ষের তপোবনে ধ্বনিত হয়েছে সামগান। রচিত হয়েছে বেদ। বলা হয়েছে মানুষ অমৃতের পুত্র। জ্ঞান আর কর্মের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে গঠিত হয়ে চলেছে তার ধ্যানধারণা বিশ্বাস মূল্যবোধ আর সংস্কৃতি। ভারতেই সভ্যতার প্রথম প্রভাত।
ভারতীয় মনীষীরা প্রথম অনুভব করেছেন নারীচরিত্রের উন্নতি সাধনেই সমাজের প্রকৃত উন্নতি। আদর্শ নারীই গড়ে তুলতে পারে আদর্শ সন্তান। তাই আদর্শ নারীর রূপ কল্পনায় যেমন নম্রতা, বাধ্যতা, মমতা, সেবাপরায়ণতা, সহিষ্ণুতা, স্নেহ, দয়া, ক্ষমা, লজ্জা, আচার-নিষ্ঠা, সংস্কার নিষ্ঠা, শুচিতাবোধ, সত্যবোধ, পবিত্রতাবোধ, মাতৃত্ব, তেমনি তার সঙ্গে তেজদীপ্তি এবং জ্যোতির্ময়ী শক্তি।
ভারতীয় সভ্যতা তার ধ্যানধারণার পরমা শক্তিকে কল্পনা করেছে পুরুষমূর্তিতে নয়, নারী মূর্তিতেই। নারীর মধ্যে যেমন কোমলতা আর সুষমা, কমনীয়তা আর নমনীয়তা থাকা একান্ত দরকার তেমনি দরকার তার মধ্যে পুরুষোচিত গুণগুলিও। যেমন কর্মোদ্যম, বিদ্যা, বিষয়জ্ঞান, দূরদৃষ্টি, আত্মস্থতা। প্রাচীন ভারতে এমন সবগুণান্বিতা আদর্শ নারীর দেখা মিলেছে। প্রাচীন ভারতের সেসব নারী আজও সমাজজীবনে দৃষ্টান্তস্থল হয়ে আছেন। বহু ব্যবহারে চির পরিচিত সেই সব নামগুলি ব্যবহার না করেও বলছি ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনের ইতিহাসে সেই সব নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই আজও দেদীপ্যমান।
কালক্রমে নারীর সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের উপর একদিন কেমন করে যেন নেমে এসেছিল কুয়াশার যবনিকা। বারে বারে বহিঃশত্রুর আক্রমণে উৎপীড়িত ভারত। নিরাপত্তার তাগিদে আর নারীর সম্মান রক্ষার্থে তাকে করে ফেলতে বাধ্য হল গৃহবন্দিনী। অতএব ধুয়ে গেল ভারতীয় নারীর শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ। ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগল সে অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারের অতলে। আলো অন্তর্হিত হলে অন্ধকার তো গ্রাস করবেই।
নারী অনন্ত শক্তির আধার। প্রেরণাদায়িনী নারী বিশ্বজয় করতে পারে তার অনন্ত শক্তির বলে। এই নারী কত রূপেই না নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়–কখনও দুহিতা, কখনও জায়া, কখনও ভগিনী, কখনও জননী। কিন্তু সর্বত্রই সে নারী বিবিধ গুণে ভূষিতা সকলের পূজ্যা ও মহনীয়া। ভারত যে ভারত নামটি নিয়ে বেঁচে আছে তার পিছনে ভারতীয় নারীর অবদান বিদ্যমান। সে তার অন্ধকার অবরোধের মধ্যে বসেও মঙ্গলদীপটি জ্বালিয়ে রেখে এসেছে একান্ত নিষ্ঠায়। ভারতীয় নারী জ্ঞানের চর্চার অধিকার হারালেও, অধ্যাত্মজ্ঞানের উপলব্ধির জগৎ থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে দেয় নি।
আপন অন্তঃপুরে বসে ভারতের চিরন্তন ধর্মচেতনাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে ঘরোয়া পূজাপাঠ ব্রতপার্বণ ছোট ছোট মেয়েলি শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বালিকা বয়স থেকেই ভারতীয় মেয়েরা ব্রত নিয়মের মধ্যে থেকে অধ্যাত্মজগতের আভাস অনুভব করতে শিখেছে। সেই সব পূজা অর্চনার নীতি নিয়ম মন্ত্রট যেমনই ছেলেমানুষী হোক তার থেকেই সেই বাল্যচিত্তেই শিক্ষা হয়েছে নিয়মনিষ্ঠার, শিক্ষা হয়েছে সংযমের, কৃচ্ছসাধনের। সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করেছে, কল্যাণী নারীরূপে। আবার কবির ভাষাতেই বলি– কুলদেবতার গৃহদেবতার গ্রামদেবতার বাহিয়া সিঁড়ি জগৎ সবিতা বিশ্বপিতার চরণে পরাণ যেত যে ভিড়ি। হ্যাঁ, ওই মেয়েলি ব্রত নিয়ম পূজা আর্চার মধ্য দিয়েই ভারতীয় মেয়ের হৃদয়ে ঈশ্বরের আসন পাতা হয়ে যেতো। কিন্তু ক্রমেও সে সব লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
আজকের ভারত তো তার চিরকালীন বিশ্বাস মূল্যবোধ সংস্কার সব কিছুকেই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়ে আর ঝেড়ে ফেলে বিশ্বের দরবারে প্রায় নিঃস্বমূর্তিতে দাঁড়িয়ে তবু আজও এই হৃতসর্বস্ব চিত্তবিত্ত হারিয়ে ফেলা অনুকরণপ্রিয় ভারতের দিকেই সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে দেখে সসম্ভ্রম সমীহে অগাধ কৌতূহলে। ভারতীয় জীবনদর্শন প্রাচীন ভারতের গভীর চিন্তার ফসল তার ধ্যানের মন্ত্র তার দেবদেবীর রূপকল্পনা, বিশ্বের অনুসন্ধানী জনেদের কাছে এখনও একটি রুদ্ধদ্বার রহস্যলোক। তাই ভারত যখন আপন ঐতিহ্যকে কুসংস্কার বলে ছেঁড়া কাঁথার মত পরিত্যাগ করে পরমপুলকে অপরের পুরনো জামা গায়ে চড়াতে চাইছে, তখনই সমগ্র বিশ্বে ক্রমশই বেড়ে চলেছে ভারত-সন্ধানীর সংখ্যা।
তাদের কৌতূহলের কারণ তারা অনুভব করছে, ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে এক আশ্চর্য উচ্চস্তরের জীবনদর্শনের ধারা প্রবহমান। নিতান্ত নিরক্ষর চাষীবাসীর মধ্যেও রয়েছে উপলব্ধির একটি অমৃতলোক।
ভারতবর্ষের চিরকালীন আদর্শ ত্যাগ। বহিরঙ্গের ঐশ্বর্যের প্রতি দৃকপাতহীন ত্যাগী জীবনকে ভারতীয় মন চিরদিনই সমগ্র দৃষ্টিতে দেখে এসেছে, কিন্তু শুধুই কী ভারতবর্ষই, আজকের অতি ভোগবাদী পশ্চিমীদুনিয়াও কী একটি সত্যকার ত্যাগী জীবনকে সমীহের চোখে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখেন না; এটিই সকল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্য। মজ্জায় মজ্জায় ভোগবাদ যাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে–আরও প্রাপ্তি আরও আহরণের নেশায়, সেও একটি ত্যাগী জীবনকে দেখলে মাথা নত করে। খোঁজ করতে চেষ্টা করে কোথায় নিহিত রয়েছে এই ত্যাগের শক্তি।
ভারতীয় নারী চিরদিনই ত্যাগের প্রতীক। অপরের জন্য আত্মবিলোপই তার ধর্ম। ক্রমশই সমাজমানসে পরিবর্তন ঘটছে। ভোগবন্দী পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে, আর বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সাফল্যে প্রযুক্তিবিদ্যার দান সুবিধাগুলির মোহে আজকের ভারতীয় নারী ভোগবাদের শিকার হয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের এই মোহময়ী প্রভাব বড় প্রবল। দুর্নিবার তার গতি। আজকের ভারতে নারী আর অবরোধের মধ্যে নেই।
আজকের ভারতীয় সমাজ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার দিয়েছে। এবং অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছে বইকি। এখন আর মেয়েদের সামনে কোনও দরজাই বন্ধ নেই। নারী সমাজও অতি দ্রুতই বিদ্যায় পাণ্ডিত্যে কর্মক্ষমতায় এবং সর্ববিধ দক্ষতায়ই পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠে সমান তালে পা ফেলে চলেছে।
অবশ্য সংখ্যা হিসেবে মেয়েদের ওই অগ্রসরতার হিসাব মুষ্টিমেয়ই। সমাজের কোটি কোটি মেয়েই তো এখনও পিছনে পড়ে আছে অশিক্ষা কুশিক্ষা আর কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে। তবু যারা সুযোগ পেয়েছে এগিয়ে যাবার, তারা হেরে যায় নি। মাত্র একটি প্রজন্মেই যে কতটা এগনো সম্ভব, তা আজকের মেয়েরা দেখিয়ে দিচ্ছে।
এই তো সেদিনও একথা শোনা গেছে মেয়েরা বেশি লেখাপড়া শিখে করবে কী? তারা কী জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে? না অফিসে চাকরি করতে যাবে? এখন সেকথা হাস্যকর। যাক ওকথা তো এখন বাসী হয়ে গেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে কেবলমাত্র পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারাই কী নারীজীবনের একমাত্র সার্থকতা? কেবলমাত্র বহিরঙ্গে আপন কেরিয়ার গড়ে তোলাটাই হবে তার শেষ লক্ষ্য?
মেয়েদের আজ একথা ভাববার দিন এসেছে। ভাবা দরকার তার সমস্ত প্রয়াস কি কেবল মাত্র পুরুষের মত হয়ে ওঠার জন্য?
দেশের প্রত্যাশা ছিল, দেশের মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষার সম্যক সুযোগ পেলে অধঃপতিত সমাজকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলবে। প্রাচীন ভারতের জ্ঞান আর আধুনিক জগতের বিজ্ঞান এই উভয় শক্তির সমন্বয়ে ভারতনারী উজ্জ্বল মহিমায় বিকশিত হয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে পথ দেখাবে। কিন্তু কোথায় সেই সমন্বয় সাধনের চেষ্টা, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানের শিক্ষাকে কুসংস্কার বলে ধুলোয় ফেলে দিয়ে আলোকপ্রাপ্তা মেয়েরা তো অন্ধের মত সেই আধুনিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সাফল্য অবিরত যযাগান দিয়ে চলেছে বিলাসিতা আর আড়ম্বরের। তাই আধুনিক জীবনে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে চাহিদা আর চাহিদা। ন্যায্য পথেই হোক আর অন্যায্য পথেই হোক সে চাহিদা মেটানোই চাই। কিন্তু এ চাহিদার কী শেষ আছে? শুধু ওই চাহিদার হাঁ-টি বোজাতে বেড়ে চলে অন্যায়, অসততা, দুর্নীতি। বেড়ে চলেছে। সর্বশুভগ্রাসী দুরন্ত লোভ। অথচ আধুনিকতা যে কুসংস্কারমুক্তই হয়েছে তাই বা বলা যায় কই? আজকের আধুনিক জীবন তো এখনও চিরকালীন গ্রাম্য কুসংস্কারের বেড়াজালেই বন্দী।
একথা সত্য যে জ্ঞানকে ত্যাগ করে অপজ্ঞানের পিছনে ছুটলে এই রকমই হয়। শুভ অশুভর পার্থক্য বোঝবার ক্ষমতা থাকে না। তা না হলে যে প্রথা বোধ হয় পৃথিবীর কোনো দেশে নেই সেই অতি ঘৃণ্য আর অতি লজ্জাকর প্রথা পণপ্রথার জমজমাটি কারবারে নিত্য শত শত মেয়ে সে প্রথার বলি হয়ে চলেছে।
আজকের শিক্ষায় দীক্ষায় অগ্রসর মেয়েরা এ বিষয়ে সচেতন কই? বললে ভুল হবে না প্রত্যক্ষে না হলেও পরোক্ষে তারাও এই জঘন্য প্রথাকে সমর্থনই করে আসছেন। মেয়েরাই যে মেয়েদের শত্রু এই নিষ্ঠুর সত্যটি কার অজানা? তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মেয়েরাও অনায়াসে পণের দাবিতে সোচ্চার হয়।
প্রাচীন ভারতে কী পণপ্রথা ছিল? মেয়েরাই কী এমন মেয়েদের অনিষ্টকারী ছিল? গবেষণাকারীরা হয়তো আবিষ্কার করবেন কবে থেকে এদেশে এমন অশুভ প্রথার সৃষ্টি হয়েছে। পণপ্রথা নিয়ে এতটি বলার কারণ মনে হয় নারীজীবনের সব থেকে অপমানকর এই প্রথা। অথচ নারীসমাজ সে সম্বন্ধে সচেতন নয়।
শিক্ষার কথায় আসি, শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু বিদ্যালাভই হয়। অবশ্য ইহ-পৃথিবীতে ওই করে খেতে শেখাটাই সব থেকে জরুরি নারী পুরুষ নির্বিশেষেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিহীন স্বাধীনতা তো সোনার পাথর বাটি। করে খাওয়ার বিদ্যাটি শেখা আগে দরকার। জগৎসংসারে টিকে থাকতে ওইটিই পায়ের তলার মাটি। কিন্তু সেইটিই কী শেষ কথা? তা হলে আর পশুপাখী কীটপতঙ্গের সঙ্গে মানুষ নামক প্রাণীটার তফাৎ কোথায়? এই খাওয়া পরা থাকায় গড়া জাগতিক জীবনটির ঊর্ধ্বে অদৃশ্য যে আর একটি জীবন আছে তার সন্ধান কে দেবে? সে সন্ধান দিতে পারে ওই উচ্চ বিদ্যা নয়। উচ্চ শিক্ষা যে শিক্ষা যথার্থই উচ্চ, এবং যথার্থই শিক্ষা।
কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তো আর সেই সত্যকার শিক্ষা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সেখানে কর্মশিক্ষার আয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে আছে, মর্মশিক্ষার কোনো আয়োজন নেই। নেই ছেলেমেয়েদের চরিত্রগঠনের শিক্ষা। তাদেরকে মানুষ করে তোলার শিক্ষা।
আগে একটি শিশু অন্ততঃ পাঁচ বছর বয়েস পর্যন্তও পরিবারপালিত হবার সুযোগ পেত। তাতে মানসিক উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে সহজাত ভাবেই তার জীবনে কিছুটা শিক্ষালাভের অবকাশ হত। কিন্তু এখন দুআড়াই বছরের শিশুটিকেই ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্কুলে। আর তার জীবন তখন থেকেই বইখাতার ভারে ভারাক্রান্ত।
দেশে শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন দরকার। যদিও শিক্ষাদপ্তর ফালতু লোকের কথায় কান দেবে এমন আশার হেতু নেই। তবু অরণ্যেরোদন করতে ইচ্ছে হয়, দেশের এই লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়েগুলোকে এক একটি কমপিউটার বানিয়ে তোলবার চেষ্টা না করে তাদেরকে এক একটি পূর্ণ মানুষ করে তোলবার সাধনা করাটাই বোধ হয় দেশের দশের সমাজের এবং তার নিজের পক্ষেও হিতকারী। তাছাড়া অন্তত আমাদের দেশে মেয়ে এবং ছেলের মধ্যে শিক্ষাদানের ব্যবস্থায় কিছুটা পার্থক্য থাকা উচিত। সৃষ্টিকর্তা তো দুজনকে দুরকম করেই গড়েছেন। সংসারজীবনে শান্তি শৃঙ্খলা আর স্থিতাবস্থা রাখতে হলে মেয়েদেরকে অবশ্যই পেতে হবে কিছুটা ধৈর্য, সহ্য, ত্যাগ আর উদারতার শিক্ষা। এক একটি সংসার নিয়েই তো সমাজ।
দেশের বর্তমান শিক্ষা যদি দেশকে কেবলমাত্র কিছু করিৎকর্মা পুরুষ উপহার দেয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎটি নিয়ে ভাবতে হতে পারে। প্রাচীন ভারতের শিক্ষাতেও নারীর মধ্যে পুরুষোচিত গুণগুলির বিকাশের চিন্তা ছিল। আবার তার সঙ্গে সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ নারীর গুণগুলির বিকাশের চেষ্টা ছিল সমধিক। তেমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তার দরকার আছে।
সত্যকার শিক্ষা কখনোই সেকেলে হয়ে বাতিল হবার নয়। মহাভারতের চরিত্র মহাভারতের শিক্ষা আজও সমান কার্যকরী। সত্যশিক্ষা যুগে যুগে কালে কালে যুগোপযোগী চেহারা নিয়ে সমাজজীবনের কাজে লাগে। সত্যকার শিক্ষা সত্যকার জ্ঞান খাঁটি সোনার মতই চির মূল্যবান। পিতামহীর সেকেলে অলঙ্কারের নক্সা ভেঙে নতুন নক্সায় অলঙ্কার গড়িয়ে নিলেও, সোনা তার মূল্য হারায় না।
আজকের যুগের মেয়েরা যদি প্রাচীন ভারতের জ্ঞান আর আধুনিক জগতের বিজ্ঞানকে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আত্মস্থ করতে পেরে ওঠে, এই দেশই হয়ে উঠবে জগতের পথপ্রদর্শক। সেই পরম জ্ঞান এখানে মজুত আছে। যদিও প্রাচীন জ্ঞান আর আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষার আকাশ পাতাল তফাৎ। জ্ঞানের শিক্ষা যখন বলে ঈশ্বরই সকল কিছুর কারক, সর্ব নিয়ন্তা–আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষা যে কথা এক খুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলে ঈশ্বর টিশ্বর বলে কিছু নেই। ওসব কবিকল্পনা। আসলে সব কিছুই নিজে নিজেই হয়ে চলেছে। নেচারই সব কিছুর কারক। বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সাফল্য শুভ আর অশুভ দুটো প্রচণ্ড শক্তিই মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে। আরও দিয়ে চলেছে। প্রতি মুহূর্তেই তো নতুন নতুন আবিষ্কার। এখন মানুষের বিচার্য সে কোন শক্তিটিকে গ্রহণ করবে। শুভকে না অশুভকে। শ্রেয়কে না প্রেয়কে।
অথচ এই ভারতেরই পরম বাণী যা থেকে আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারবো না, তা নিয়ে কী করবো? কিন্তু সত্যিই কী ভারতের আত্মা থেকে সেই পরম বাণী চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে? . হয়তো তা নয়। তা হতে পারে না। ভারতের আত্মা অবিনাশী। আজকের যে দৃশ্য দেখে আমরা বিচলিত হচ্ছি, আতঙ্কিত হচ্ছি সে দৃশ্য নিশ্চয়ই সাময়িক বিভ্রান্তির। পৃথিবী জুড়ে ভোগবাদের হাতছানি। যন্ত্রদানবের অসুর শক্তি এ বিভ্রান্তি এনে দিচ্ছে। অশুভ শক্তি শুভ শক্তিকে চিরতরে গ্রাস করতে পারে না। জগতে বিভ্রান্তি আসে বলেই সম্ভবামি যুগে যুগের প্রতিশ্রুতি মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে।
তবে একথা ঠিক, আজ একবার আমাদের মেয়েদের থমকে দাঁড়ানো দরকার। ভাবা দরকার আমরা যে পথে চলেছি, তা ঠিক পথ কিনা। সে পথে কী শান্তি আছে, কল্যাণ আছে? আজকের যে আধুনিক জীবনের দিকে আমরা অন্ধের মত ছুটে চলেছি তার শেষ প্রান্তটি তো দেখতেই পাচ্ছি। যে ছাঁচে নিজেদেরকে ঢালাই করতে চলেছি, সে ছাঁচের মূর্তিটি তো সামনে দেদীপ্যমান। সেই জীবন সেই ছাঁচের মূর্তিরা তো আধুনিক জীবনের জীবনযন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাদের পারিবারিক জীবন বিঘ্নে জর্জরিত। সমাজ খণ্ড, ছিন্ন, বিধ্বস্ত। সেখানে মানুষ ক্রমশই নিঃসঙ্গী হয়ে পড়ছে। স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা, বিশ্বাস এসবে আর আস্থা নেই তাদের। তবু তারা সেই আধুনিকতার নেশায় আক্রান্ত হয়ে লক্ষ্যহীন ভাবে ছুটে চলেছে।
এ জন্য তো আজ জগতের সামনেই বিধৃত। তবু আমরা জেনে বুঝে সেই আত্মনাশা পথে পা বাড়াবো, একবার দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবা দরকার। সেই দেখার মধ্য দিয়েই ধরা পড়বে আমাদের নিজেদের ভাঁড়ারে লক্ষ্মীর কৌটোয় অনন্ত ঐশ্বর্য।
নারীজীবনের পরম আদর্শ আমাদের ঘরের মধ্যেই মজুত। আমাদের ঘরে পরমাশক্তি স্বরূপিণী মা সারদাদেবী অভয় আশ্রয় নিয়ে বসে আছেন। যিনি একাধারে সংসারজীবনে অলৌকিক আদর্শ আবার ত্যাগী জীবনের পরমাশ্চর্য আদর্শ। তিনি রান্না করেন, কুটনো কোটেন, পান সাজেন, ব্যস্ত হাতে ভক্ত সন্তানদের জলখাবার গোছান। আবার অতি অনায়াসেই চরণ বাড়িয়ে মহাসন্ন্যাসী সন্তানদের পূজো গ্রহণ করেন ভগবতী মূর্তি নিয়ে।
মা সারদা কী কম আধুনিকা? কম সংস্কারমুক্ত? সেই শতাধিক বছর আগের একটি ঘোরতর সংস্কারবদ্ধ গ্রাম বাংলার মেয়ে হয়েও কী অনায়াসে বিদেশিনী মেয়ে নিবেদিতাকে গ্রহণ করেছিলেন। আমজাদের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করেছিলেন। অবশ্য এ তার শক্তির একটি স্ফুলিঙ্গের দৃষ্টান্ত মাত্র। অতি সাধারণ একখানি ছদ্ম আবরণের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে লোকশিক্ষা দিয়ে গেছেন। গেছেন বলাটি ভুল, তিনি তো আছেন, পরিব্যাপ্ত হয়ে দিয়ে চলেছেন। শুধু নিতে পারলেই হল।
ছদ্মবেশ না হলে চলবে কেন? আগুনকে যখন আলোর কাজে লাগানো হয়, তখন তাতে একটি কাঁচের আবরণ দিতে হয়। ভোলা আগুন সহ্য করবে কী করে মানুষ?
যেমন মাঠের মাঝখানে এক একটি বৃহৎ বিশাল বৃক্ষ থাকে ছায়া বিছিয়ে! রোদের মাঠে চলা তাপদগ্ধ পথিক এক একবার সেই ছায়ার নীচে বসে শরীর মন জুড়িয়ে নেয়। তেমনি এই জগৎসংসারে যুগদেবতারা যুগে যুগে মাঝে মাঝেই ছায়া বিছিয়ে বসে থাকেন। সংসার-তাপদগ্ধ মানুষ তার তলায় গিয়ে বসে স্নিগ্ধ হয়ে নেবে বলে।
দেহের বিলোপ ঘটে, আদর্শের বিলোপ ঘটে না। সেই আদর্শের রূপটিই যেন শরীরিণীমূর্তি হয়ে তাপিত পৃথিবীকে শীতল ছায়া দেবার জন্য চির অপেক্ষমাণ। মা সারদা একাল সেকাল চিরকাল আর প্রাচীন আধুনিক সকল আদর্শের মূর্তিমতীরূপ।
আজকের দুরন্ত আর অশান্ত মেয়েদের বোধ হয় একবার থমকে দাঁড়িয়ে এই শাস্তিস্বরূপার মূর্তিটিকে অনুধাবন করে দেখা দরকার।
আর রয়েছেন পুরুষোচিত বলবীর্য আর প্রচণ্ড শক্তির মূর্তি মহাসাধিকা শ্রীশ্রীগৌরীপুরী মাতা। তার তীব্র অধ্যাত্মপিপাসা অতি শৈশব থেকে কীভাবে তাকে অসম সাহসিনী করে পথে প্রান্তরে পাহাড়ে অরণ্যে নির্ভয়ে ঘুরিয়েছে, সে ইতিহাস যাঁদের জানা তারাই অনুভব করবেন নারীশক্তি কোথায় পৌঁছতে পারে। অদম্য মনোবল কী ভাবে একেবারে সহায়সম্বলহীনা একটি মেয়েকে পরম লক্ষ্যের পথে নিয়ে যেতে পারে।
শ্রীশ্রীগৌরীপুরী মাতার অত্যাশ্চর্য অলৌকিক জীবনবেদখানি অনুধাবন করে দেখতে পারলে আজকের পথভ্রান্ত মেয়েরা হয়তো পথের দিশা খুঁজে পাবে।
ভারতবর্ষে আদর্শ জীবনের জীবন গ্রন্থের অভাব নেই, অভাব শুধু সে আদর্শ গ্রহণ করবার মানসিকতা। মহৎকে মহৎ বলে আমরা বিগলিত হই, কিন্তু নিজেকে তার ধারে কাছেও নিয়ে যেতে চেষ্টা থাকে না। এই তো হাতের কাছে চোখের সামনে মূর্তিমতী সেবা মা টেরেসা। কজন মেয়ে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে আসে?
আসলে আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করবার প্রেরণার মনটি তৈরি করার মতও শিক্ষার দরকার। স্কুল কলেজের তথাকথিত উচ্চশিক্ষার অবকাশে এক একবার ছুটে চলে আসতে হবে মন তৈরির পাঠশালায়। যে পাঠশালা খোলা রয়েছে দিকে দিকে, ভর্তি হতে ফী লাগে না, মাইনেও গুনতে হয় না, শুধু একবার বেড়া ঠেলে ঢুকে পড়তে পারলেই হল। আসতে পারলেই শান্তির সন্ধান মিলবে।
বহিরঙ্গে কেবলমাত্র জড়বস্তুর ভার জমিয়ে তোলার নেশায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলতে চলতে, একটি বারের জন্যেও থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে পারলে ভালো হয়–অন্তরের অঙ্গনখানি ভরে তোলার মত কোথাও কিছু মেলে কিনা দেখি। আর এও মনে রাখা দরকার নারীশক্তি এক মহাশক্তি। নারী যেমন কল্যাণরূপিণী তেমনি আবার প্রলয়ঙ্করীও। আমার নিজের মধ্যেই এই উভয় শক্তিই বিদ্যমান; কোনটিকে জীবন রচনায় বেছে নেবো? আমি আমার প্রভু হব না দাস হব?
ভুলে গেলে চলবে না আমরা ভারতের নারী। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের কাছে। রয়েছে আমাদের দায়বদ্ধতা।