- বইয়ের নামঃ ভুলে গেলে চলবে না
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
ভুলে গেলে চলবে না
যদিও কবির মহৎ অনুভূতিতে উচ্চারিত হয়েছে–জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি সে জাতির নাম মানুষ জাতি। আর একথাও জানা আছে কালো আর সাদা বাহিরে কিন্তু ভিতরে সবাই সমান।
তবু সেই মানুষ জাতটার মধ্যেই কত জাতি, কত সমাজ, কত বৈচিত্র্যময় বিকাশ। আহারে বিহারে আচরণে আভরণে একের সঙ্গে অপরের আকাশ পাতাল পার্থক্য। ভাষা তো সংখ্যাতীত। আর আমাদের ভারতবর্ষ তো বলতে হয় একটি মিনি পৃথিবী, কত ভাষা কত ধর্ম, কত বর্ণ বৈচিত্র্য।
তথাপি যে কোনও ধরণেরই সমাজ হোক, তা সে আদিবাসী, উপজাতি একেবারে অনুন্নত হলেও, প্রত্যেকটি সমাজের মধ্যেই আছে নিজস্ব কিছু ধ্যান-ধারণা বিশ্বাস সংস্কার আর মূল্যবোধ, সেই প্রবহমান ধারার কাছে সে একান্ত দায়বদ্ধ। সংস্কার যদি কুসংস্কারের জালে আচ্ছন্ন হয়েও যায়, তবু তার সম্পর্কে নিষ্ঠাই তার মধ্যে মেরুদণ্ডের কাজ করে।
বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ জাতটি কোনও পরিবেশেই জীবনচিন্তা সম্পর্কে উদাসীন নয়। তাই সেই গুহামানবের যুগ থেকেই সমাজ নিয়ে মানুষ অবিরতই ভাঙা গড়া করে চলেছে। কারণ মানুষ সহজাত ভাবেই চায় উৎকর্ষ আর উত্তরণ। সেই চাওয়াই তাকে কখনও স্থির থাকতে দেয় না। তাই জীবন আর সমাজ নিয়ে মানবসমাজে পরীক্ষানিরীক্ষার আর অন্ত নেই।
তবে একথা মানতেই হবে যে ধরণেরই সমাজ হোক, সমাজ গঠনে নারীর ভূমিকাই প্রধান। সমাজ ব্যবস্থা রক্ষায় নারীর দায়িত্বই সমধিক। এ প্রাধান্য আর কেউ না, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তাকে দিয়ে রেখেছেন। কারণ নারীই তার সৃষ্টিলীলা অব্যাহত রাখার প্রধান সহায়িকা। আর নারীই সেই লীলাকে করে তুলতে পারে সুষমামণ্ডিত মহিমান্বিত। নারী জননী, নারী জগতের ধাত্রী। সৃষ্টিকর্তা তাই নারীহৃদয়ে মজুত রেখেছেন অফুরন্ত স্নেহ আর রেখেছেন সহিষ্ণুতা ধৈর্য সহনশক্তি। রেখেছেন আত্ম-বিলোপী উদারতা।
যেখানে নারীহৃদয়ে এই গুণগুলির অভাব, সেখানেই সে সমাজ খণ্ড বিচ্ছিন্ন অসুন্দর। সংসারের একটি পুরুষ স্বেচ্ছাচারী বা বিপথগামী হলে, সে নিজেই ধ্বংস হয় মাত্র। কিন্তু একটি নারী স্বেচ্ছাচারিণী বিপথগামিনী হলে সমগ্র সংসারটাই ধ্বংস হয়। ধ্বংস হয় কুল বংশমর্যাদা সম্ভ্রম।
সমাজ তরণীটিকে ঠিকপথে দরিয়া পার করতে নারীই হচ্ছে তার হাল বৈঠা। সমাজ যানটিকে অভ্রান্ত পথে চালাতে চাইলে নারীই সে গাড়ির স্টিয়ারিং।
দূরকালে প্রাচীন ভারত একদা এই পরম সত্যটি অনুধাবন করেছিল বলেই নারীর আদর্শ বা আদর্শ নারীর রচনায় মনোনিয়োগ করেছে বেশি। একথা তো সত্য পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে যখন (হয়তো আজকের অতি উন্নত প্রগতিশীল সমাজেও) মানুষ অরণ্যচারী বল্কলধারী তখন ভারতবর্ষের তপোবনে ধ্বনিত হয়েছে সামগান। রচিত হয়েছে বেদ। বলা হয়েছে মানুষ অমৃতের পুত্র। জ্ঞান আর কর্মের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে গঠিত হয়ে চলেছে তার ধ্যানধারণা বিশ্বাস মূল্যবোধ আর সংস্কৃতি। ভারতেই সভ্যতার প্রথম প্রভাত।
ভারতীয় মনীষীরা প্রথম অনুভব করেছেন নারীচরিত্রের উন্নতি সাধনেই সমাজের প্রকৃত উন্নতি। আদর্শ নারীই গড়ে তুলতে পারে আদর্শ সন্তান। তাই আদর্শ নারীর রূপ কল্পনায় যেমন নম্রতা, বাধ্যতা, মমতা, সেবাপরায়ণতা, সহিষ্ণুতা, স্নেহ, দয়া, ক্ষমা, লজ্জা, আচার-নিষ্ঠা, সংস্কার নিষ্ঠা, শুচিতাবোধ, সত্যবোধ, পবিত্রতাবোধ, মাতৃত্ব, তেমনি তার সঙ্গে তেজদীপ্তি এবং জ্যোতির্ময়ী শক্তি।
ভারতীয় সভ্যতা তার ধ্যানধারণার পরমা শক্তিকে কল্পনা করেছে পুরুষমূর্তিতে নয়, নারী মূর্তিতেই। নারীর মধ্যে যেমন কোমলতা আর সুষমা, কমনীয়তা আর নমনীয়তা থাকা একান্ত দরকার তেমনি দরকার তার মধ্যে পুরুষোচিত গুণগুলিও। যেমন কর্মোদ্যম, বিদ্যা, বিষয়জ্ঞান, দূরদৃষ্টি, আত্মস্থতা। প্রাচীন ভারতে এমন সবগুণান্বিতা আদর্শ নারীর দেখা মিলেছে। প্রাচীন ভারতের সেসব নারী আজও সমাজজীবনে দৃষ্টান্তস্থল হয়ে আছেন। বহু ব্যবহারে চির পরিচিত সেই সব নামগুলি ব্যবহার না করেও বলছি ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনের ইতিহাসে সেই সব নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই আজও দেদীপ্যমান।
কালক্রমে নারীর সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের উপর একদিন কেমন করে যেন নেমে এসেছিল কুয়াশার যবনিকা। বারে বারে বহিঃশত্রুর আক্রমণে উৎপীড়িত ভারত। নিরাপত্তার তাগিদে আর নারীর সম্মান রক্ষার্থে তাকে করে ফেলতে বাধ্য হল গৃহবন্দিনী। অতএব ধুয়ে গেল ভারতীয় নারীর শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ। ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগল সে অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারের অতলে। আলো অন্তর্হিত হলে অন্ধকার তো গ্রাস করবেই।
নারী অনন্ত শক্তির আধার। প্রেরণাদায়িনী নারী বিশ্বজয় করতে পারে তার অনন্ত শক্তির বলে। এই নারী কত রূপেই না নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়–কখনও দুহিতা, কখনও জায়া, কখনও ভগিনী, কখনও জননী। কিন্তু সর্বত্রই সে নারী বিবিধ গুণে ভূষিতা সকলের পূজ্যা ও মহনীয়া। ভারত যে ভারত নামটি নিয়ে বেঁচে আছে তার পিছনে ভারতীয় নারীর অবদান বিদ্যমান। সে তার অন্ধকার অবরোধের মধ্যে বসেও মঙ্গলদীপটি জ্বালিয়ে রেখে এসেছে একান্ত নিষ্ঠায়। ভারতীয় নারী জ্ঞানের চর্চার অধিকার হারালেও, অধ্যাত্মজ্ঞানের উপলব্ধির জগৎ থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে দেয় নি।