বিস্ময় বিরক্তি, লাঞ্ছনা গঞ্জনা, উপদেশ আক্ষেপ বহুবিধ আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে সরোজাকে। সব আক্রমণের সার কথা–চাকরিটা ছাড়া উচিত হয়নি। অতএব এখন সরোজাক্ষর মনের মধ্যে আর সেই পুরনো ভুলটা বসে নেই। সরোজা জেনে নিয়েছেন তিনি চাকরি করছিলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
কেন?
মেজাজের দোষে।
মেজাজ দেখিয়েছিলেন সেখানে, অতএব শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে তারা, সরোজাক্ষ সে জায়গায় সমঝে না গিয়ে আরও মেজাজ দেখিয়ে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন।
কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য এককথায় সরোজাক্ষর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি, সরোজাক্ষকে ভাবতে সময় দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষ সে সময় নেননি। সবিনয়ে বলে এসেছেন, নতুন করে আর কী ভাবব? ভেবেই তো দিয়েছি
তার মানে সরোজাক্ষ কেবলমাত্র নিজের মান-অপমানের কথাই ভেবেছেন, আর কিছু ভাবেননি। ভাবেননি–তাঁর স্ত্রী আছে, নাবালক পুত্র আছে, অবিবাহিতা কন্যা আছে এবং সারদাপ্রসাদ নামে একটা অর্থহীন অবান্তর পোষ্য আছে। ভাবেননি, তাঁর উপার্জনশীল সাবালক ছেলেটা একটা অমানুষ এবং নিজে তিনি এ যাবৎকাল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন।
তবে?
তবে তোমায় কে সহানুভূতির চক্ষে দেখবে?
সংসারী মানুষ তুমি, একটা সংসারের (কর্তা বলে কেউ না মানলেও দায়িত্বের আইনে) কর্তা, তুমি অমনি কোথায় একটু মানের কানা খসে গেল বলে দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিলে? কর্তব্য নেই তোমার? দায়িত্ব নেই? মায়া মমতা বিবেচনা কিছু নেই।
তা এ সবই যদি না থাকে, শুনতেই হবে কটুকথা। যাদের সঙ্গে তোমার এই ব্যাপারের কোনও লাভ লোকসানের প্রশ্ন নেই, তারাও শুনিয়ে যাবে দুটো ধিক্কারের কথা। আর যাদের সঙ্গে ঘোরর সম্পর্ক, তারা তো
হ্যাঁ, একা বিজয়াই নয়, বাড়ির লোকে জনে জনে লাঞ্ছিত করেছে সরোজাক্ষকে (যদি সেই লাঞ্ছনায় মতি ফেরে), তবে বিজয়াই অগ্রণী। বিজয়া তাঁর কাঁচা কাপড়ের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর ভেঙে এ-ঘরে বিছানার ধারে এসে বসে পড়ে বলেছেন, ব্যাঙ্কে তোমার কত টাকা আছে?
সরোজাক্ষ চোখ তুলে তাকিয়েছেন বোধ হয় একটু অবাক-অবাক দৃষ্টিতে। কারণ তখনও সরোজাক্ষ ভেবেছিলেন, বিজয়া খামোক একটা বোকার মতো প্রশ্ন করল কেন।
কিন্তু বিজয়া সব ক্ষেত্রে বোকা নয়।
বিজয়া সেই সদ্য-বিবাহের কাল থেকেই ক্ষেত্রবিশেষে চালাক। বিজয়া যখন নেহাত নতুন বউ, তখনই সরোজাক্ষর অনুপস্থিতিতে সরোজাক্ষর আলমারি দেরাজ বুকশেলফ এমনকী মোটা মোেটা বইয়ের পাতাগুলি পর্যন্ত উলটে উলটে চতুর দৃষ্টিনিক্ষেপ করে দেখত। কোনওখান থেকে কোনও দলিল সংগ্রহ করে ফেলতে পারে কি না সরোজাক্ষর, কোনও দুর্বলতার সাক্ষ্য জোগাড় করে ফেলতে পারে কিনা।
আছে অপরাধ, আছে দুর্বলতা, এ বিষয়ে সেই সদ্য কৈশোরপার তরুণীটি নিঃসন্দেহ ছিল। নইলে বিজয়ার মতো অমন একটা লোভনীয় বস্তুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও লোকটা দিনে রাত্রে সকালে সন্ধ্যায় তার সদ্ব্যবহার করে না? তাকে কী নিধি পেলাম বলে সর্বদা গলায় ঝুলিয়ে রাখে না?
করে না। রাখে না।
অতএব নির্ঘাত অন্য ব্যাপার।
অন্য ব্যাপার না থাকলে, এক্ষেত্রে রক্তমাংসের শরীরওলা যুবক বর স্রেফ হ্যাংলা বনে যেত।
সেই প্রত্যাশিত হ্যাংলামি তো করেই না বিজয়ার বর, বরং নেহাতই রক্তমাংসের দাবি মেটাতে একটু দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেললেই যেন মরমে মরে যায়। যেন ঘৃণায় লজ্জায় মুষড়ে পড়ে। তাকিয়ে দেখে না, তার সেই রূপবতী এবং স্বাস্থ্যবতী যুবতী বউ তাতে কী পরিমাণ অপমান বোধ করে।
করত অপমান বোধ বিজয়া।
আর সেই অপমান বোধ থেকেই আক্রোশ উঠত ধুইয়ে। সেই আক্রোশে অধিকতর আকর্ষণময়ী হবার জন্যে লজ্জা শরমের বালাই রাখত না এবং সরোজাক্ষকে একদিন কাঠগড়াতে দাঁড় করাবার জন্যে খুঁজে খুঁজে বেড়াত তার অপরাধের দলিল।
হয়তো ঠিক এ পথে চিন্তাকে প্রবাহিত না করলে বিজয়া সরোজাক্ষর চিত্তজগতে স্থান করে নিতে পারত। দেহকে সম্বল করেও মনের দরজায় টোকা দিতে পারত। কিন্তু বিজয়া নিজের ভুল চিন্তাতেই নিমজ্জিত থেকেছিল, বিজয়া তার স্বামীর মনটাকে হাত ফসকে পালিয়ে যেতে দিয়েছিল। ভালবাসার বদলে ঘৃণা সংগ্রহ করেছিল।
সেই ঘৃণাটা প্রথম উপচে উঠেছিল সেই একদিন দুপুরে। যে দুপুরে সরোজাক্ষ হঠাৎ জ্বর হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।
এসে দেখলেন সরোজাক্ষর তিনতলার ঘরটা একেবারে তছনছ। দেরাজ খোলা, ট্রাঙ্ক খোলা, আলমারি খোলা, বিছানা ওলটানো, র্যাকের বইগুলো ছড়ানো, যেন পুলিশে খানাতল্লাশি করে গেছে। আর দেখলেন কাকার দেওয়া সেই চন্দনকাঠের বাক্সটাকে নিয়ে বিজয়া
হ্যাঁ, সারা ঘর তছনছ করেও বিজয়া সেই পাতলা গড়নের ছোট চন্দনকাঠের বাক্সটার চাবি সংগ্রহ করতে পারেনি। বিজয়া স্থিরনিশ্চিত ছিল, ওই চাবিটা খুলে ফেলতে পারলেই সরোজাক্ষর সেই গোপন ঘরটা খুলে পড়বে, যে ঘরে লুকোনো আছে সরোজাক্ষর অপরাধের প্রমাণপত্র অবৈধ প্রেমপত্র। প্রেম বস্তুটাকে অবৈধই ভাবত বিজয়া।
ওই বাক্সটাকে দেখেছে বিজয়া ইতিপূর্বে, নেড়েছে চেড়েছে, আর ভেবেছে অবসরমতো এটাকে নিয়ে পড়তে হবে। আজকে পড়েছিল তাই। ভেবেছিল চিঠি তো পাবই, ফটো-টটোও কোনও না পাব। কিন্তু নেই, কোথাও নেই চাবি।
তার মানে এমন কোনও গোপন জায়গায় রেখে দেয়, যা বিজয়ার চোখকেও ফাঁকি দিতে পারে। তার মানে দেখতে যেমন আলাভোলা বরটি তার, ভিতরে তেমন নয়। কে জানে ঘরের সিলিঙে কড়ি-বরগার মধ্যেই কোথাও খাঁজ কেটে রেখেছে কিনা।