নীলেন্দু কিন্তু তা করছে না। মহীদারা যেমন খুশি থাকুক, যা ভাল লাগে করুক–তাতে তার কোনও আগ্রহ নেই। বুলবুলকে পাঠানোর মধ্যে নীলেন্দুর কোনও উদ্দেশ্য সত্যিই নেই, স্বার্থও নেই, নেহাতই দায়ে পড়ে পাঠাতে চাইছে।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে মন এলোমেলো হয়ে গেল নীলেন্দুর। নানা ধরনের বিক্ষিপ্ত চিন্তাই তাকে ক্রমশ অস্থির করে তুলল। এসব ক্ষেত্রে নিজের কথা ভেবে পারা যায় না। এবং ভাবতে গেলে মনে হয়ে কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি যেন নীলেন্দুকে দেখছে।
কোনও সন্দেহ নেই, আজকাল নীলেন্দুর মধ্যে প্রচুর হতাশা এসে জুটেছে; বেশ বুঝতে পারছে কিছু হল না, কিছুই করা গেল না। হয়তো তার পক্ষে কোনও কালেই কিছু করা সম্ভব ছিল না, সে নিজেকে যা ভাবত প্রকৃতপক্ষে সে তা নয়। এমন একটা সংসারে নীলেন্দু জন্মেছিল যে-সংসারে তার অনাদর হয়নি, কেউ তাকে উপেক্ষা করেনি; বরং বাল্যকাল থেকেই সে এই সরল বিরাট পরিবারের স্নেহ ও যত্ন পেয়ে এসেছে। তার অভিযোগ করার, ক্রুদ্ধ হবার, ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার বাস্তবিক কোনও কারণ ছিল না। সে চিরকালই মোটামুটি ধরনের ছেলে, মাথা এমন কিছু সাফ নয়, একটু বেশি উচ্ছ্বাসপ্রবণ। ছেলেবেলা থেকেই তার শরীর স্বাস্থ্য স্বাভাবিক ও মজবুত ছিল। পাড়ার হাবুদার চেলা হয়ে সে লাহাবাড়ির পোড়ো জমিতে ফুটবল খেলতে শুরু করে। বছরের পাঁচ-সাতটা মাস এই করেই কেটে যেত। স্কুলে নীলেন্দুর নাম হয়ে গেল, স্কুল টিমে খেলতে খেলতেই তার ওপর নজর পড়ে গেল পাশাপাশি পাড়ার এক বড়দের ক্লাবের। তারা নীলেন্দুকে ডেকে নিল। এখন এসব কথা ভাবলে কেমন যেন লাগে, হাসি পায়। তখন যে ছেলের একমাত্র সাধ ছিল খেলোয়াড় হবার, সে পরে খেলার মাঠ বরাবরের জন্যে ছেড়ে দিল। শুধু খেলা নয়, নীলেন্দুর সামনে ধরাবাঁধা জীবনের যে ছকটা ছিল সেটাও এড়িয়ে গেল। বড় হবার পর তার সামনে বাবার ব্যবসা, ছোটকাকার ওকালতি, দাদা আর শুভেন্দুর মতন চাকরি বা ছোটখাটো কনট্রাকটারি খালি পড়ে ছিল। সে সবই হতে পারত। বাবার সঙ্গে ব্যবসায় গিয়ে বসলে বাবার অশান্তি দুর হত, মেজোকাকা বেঁচে যেত, ছোটকাকা খুশি হত। শুধু তাই নয়, এই পরিবারের প্রায় প্রত্যেকেই একটা দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচত। ওই ছকে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলে আজ নীলেন্দুর দিব্যি জীবন কেটে যেত। এতদিনে বিয়েথা করে ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে বসাও বিচিত্র ছিল না। কিন্তু যেটা হওয়া উচিত ছিল সেটা হল না। অন্যরকম হয়ে গেল।
কেমন করে হল সেটা অন্য প্রশ্ন, কিন্তু এর জন্যে নীলেন্দু কাউকেই দায়ি করে না। কলেজে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল মুকুল। মুকুল এত ভদ্র, শান্ত বিনীত ছেলে ছিল যে তাকে ভাল না বেসে পারা যায় না। লেখাপড়াতেও ভাল ছিল। সেই মুকুল একদিন কলেজ ইউনিয়নের ছেলেদের হাতে রাস্তার মধ্যে মার খেল। কারণ সে ইউনিয়নের ছেলেদের কী একটা মিছিলের মধ্যে থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কেন মুকুল মিছিলে যাবে না–এই অপরাধে কটা ছেলে তাকে মেরে মুখচোখ ফুলিয়ে দিল। নীলেন্দু ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। তোমরা জোর করে মিছিলে ধরে নিয়ে যাবে, না গেলে মারবে! আচ্ছা শালা দেখি। ইউনিয়নের তখন বেজায় শক্তি; কলেজ বলতে ইউনিয়ন, প্রায়ই মারপিট বোমা মারামারি আর স্ট্রাইক চলছে। একদিন একটা ছেলে কলেজের সামনে রাস্তার কোনও মেয়েকে টিটকিরি দিতে গিয়ে মার খেল। সঙ্গে সঙ্গে ইউনিয়নের যত ছেলে কলেজ বন্ধ করে পাড়ার লোকের সঙ্গে মারপিট করতে বেরুল। পুলিশ এসে কয়েকজনকে ধরল, ছেলেরা চলল থানা পর্যন্ত মিছিল করে। মুকুল গেল না, নীলেন্দুকে বলল, চল,আমার বাড়িতে চল, আড্ডা মারব।
এই মুকুলই সেদিন বলল, নীলু, এসব আর বেশিদিন চলবে না; এই মোড়ল মার্কা ছেলেগুলো অসহ্য।
মুকুল যে তলায় তলায় অশান্ত, অধীর, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে নীলেন্দু প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে যখন বুঝল তখন আর সে কোথাও কোনও দোষ দেখতে পেল না।
মুকুল, রবি, কৃষ্ণকমল–এদের দলে ক্রমশই ভিড়ে পড়তে লাগল নীলেন্দু। ভিড়ে পড়ার পর সে ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারল, যে-জগৎ সম্পর্কে তার কেমন একটা নিশ্চিন্ত ধারণা ছিল সে-জগৎ অত সাদামাটা নয়। নীলেন্দুর মনে খটকা লাগলেও সে সরাসরি কোনও কিছুতে মেতে ওঠেনি। তবু মুকুলদের তার ভাল লাগত। বিএ পরীক্ষার বছরে নীলেন্দু পরীক্ষা দিতে পারল না, টাইফয়েডে পড়ল। পরের বছর পরীক্ষা দিল। মুকুলরা তখন ইউনিভার্সিটিতে। কৃষ্ণকমল চাকরি করছে।
নীলেন্দু ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছিল। কিন্তু পড়াশোনায় আর মন পাচ্ছিল না। রবি হুট করে বাস অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল। মুকুল আশ্চর্য রকমে পালটে গিয়েছিল। তার চারদিকে কেমন যেন এক রহস্য, তার কিছু নতুন বন্ধুবান্ধব হয়েছে, মুখচোরা, লাজুক, নম্র ভাব আর নেই। ইউনিভার্সিটির মধ্যে এক হামলার পর মুকুল হঠাৎ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে গেল।
নীলেন্দুর আর ভাল লাগছিল না। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ত অথচ ইউনিভার্সিটি যেত না। দেবীদির চোখে ধরা পড়ল। বলল, আমার ভাল লাগে না, কী হবে এই লেখাপড়া শিখে।
এই সময় নীলেন্দু মহীতোষের কাছে আসাযাওয়া শুরু করেছিল। মুকুলই একবার টেনে নিয়ে গিয়েছিল নীলেন্দুকে মহীদার কাছে।