২. ললিতার স্বপ্ন
০৬.
ললিতার স্বপ্ন দেখছিল অবনী।
দেখছিল: ওরা বিছানায় শুয়ে আছে; ললিতা ছাদের দিকে মুখ তুলে সোজা হয়ে শুয়ে; ললিতার দিকে পাশ ফিরে তার বালিশে কনুই রেখে সামান্য উঁচু হয়ে অবনী। ললিতার চোখ খোলা, ঠোঁট ফাঁক, দুটি সাদা চকচকে দাঁত বেরিয়ে রয়েছে, গলায় তুলসীমঞ্জরীর মতন হার। অবনী ডান হাত আস্তে করে ললিতার মুখের কাছে আনল, গালে ঠোঁটে আঙুলের ডগা বুলোলো, তারপর চোখের পাতা শেষে ডান হাতের পাঁচটি আঙুল ও তালু দিয়ে ললিতার মুখ ঢেকে দিয়ে অবনী ললিতার বুকের ওপর মুখ নামাল। ললিতার হাত অবনীর মাথার চুলে এসে পড়েছে। নিরাচ্ছাদিত বুক ললিতার; অবনী পরিপূর্ণ যুবতীদেহে চুম্বন ও দংশন করল। ললিতা তাকে উৎফুল্ল করছিল, পীড়ন করছিল। তারপর সহসা সে অবনীর আলিঙ্গন থেকে মুক্তির জন্যে বসল। পরমুহূর্তে ললিতাকে আর বিছানায় দেখা গেল না; অবনী অতি দ্রুত তাকে অন্বেষণ করতে ঘরের বাইরে এল। ঘর থেকে অন্য ঘর, বাদুড়বাগানের বাড়ির শোবার ঘরে, ললিতা যেন এইমাত্র এই ঘর থেকে চলে গেছে–তার খোলা জামা কাপড় বিছানায় ও মেঝেতে লুটোচ্ছিল; অবনী চকিতে অন্য ঘরে চলে গেল। স্নানের ঘরে অবিরল জল পড়ছে, পড়ছে… জানলায় জালের পরদা, দরজায় জালের পরদা, দেওয়ালে কোথাও একটু আলো। ললিতা মাথার ওপর শাওয়ার খুলে দাঁড়িয়ে আছে, নগ্ন, পালকের মতন বঙ্কিম নরম পিঠ, কোমর সামান্য ভারী, সদ্যসিক্ত কুম্ভের মতন পিছন, জলের ধারায় জঘা, পায়ের ডিম অস্পষ্ট হয়ে আছে। অবনী এগিয়ে গেল, ললিতার পিছনে; কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি করল। এবং সহসা অনুভব করল সেও নগ্ন। মাথার ওপর কলঘরের ফোয়ারা; জলধারার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে দেখল, জলজ প্রাণীর মতন তাদের গায়ে শ্যাওলা ধরে যাচ্ছে, পানা জমে গিয়ে সবুজ কালো হয়ে গেল সব। ললিতা ধাক্কা মেরে তাকে ঠেলে ফেলে দিতে গেল, পারল না; অবনী হাত বাড়িয়ে ললিতাকে সরিয়ে দিতে গেল, পারল না। অবশেষে মাথার ওপরকার ফোয়ারার জলের ধারা হঠাৎ কেমন সুতোর মতন হয়ে মস্ত একটা জাল বোনা হয়ে গেল। শক্ত কালো জাল। কোনও জেলে বিশাল এক জাল ফেলে তাদের যেন ধরে ফেলেছে; সেই জালের মধ্যে শ্যাওলাধরা পানামাখা দুই জলজ প্রাণীর মতন তারা বন্দি। অবনী পাগলের মতন এই জাল কেটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, ললিতাও দাঁত দিয়ে জাল কাটার চেষ্টা করছে। তারপর দুজনের আপ্রাণ জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা…
ঘুম ভেঙে গেল অবনীর। ভেঙে যাবার পরই তার মনে হল সে জাল ছিঁড়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখের পাতা খুলল, পাতা খুলতেই বিছানার মশারির জাল দেখল, বাতাসে কাঁপছিল সামান্য; অবনী ভীত ও ত্রস্ত হয়ে ছুটে পালাবার জন্যে উঠে বসে টান মেরে মুখের সামনে থেকে মশারি সরিয়ে ফেলল। এত জোরে সে হাত দিয়ে মশারি টেনে সরাল যে মশারির খানিকটা ছিঁড়ে গেল। ততক্ষণে তার ঘুমের আচ্ছন্ন ভাব এবং ভ্রম ভেঙে গেছে। তবু একবার অবনী বিছানার মধ্যে তাকাল, না–কেউ নেই।
মুখের সামনে থেকে মশারি সরিয়ে অবনী কিছুক্ষণ বসে থাকল, তার শরীরের খানিকটা মশারির মধ্যে, বাকিটা বাইরে। গলায় মুখে ঘাম জমে গেছে। দুঃস্বপ্ন দেখার পর যেভাবে মানুষ তার ভীত, বিমর্ষ ভাবটা ক্রমশ সইয়ে নেয়, অবনী সেইভাবে তার আতঙ্ক ও বিহ্বলতা কাটিয়ে নিচ্ছিল।
শেষে উঠল, বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে বাতি জ্বালল। তৃষ্ণায় ঠোঁট গলা শুকিয়ে আছে। অবনী জল খেল, খেয়ে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে ঘড়ি দেখল, শেষরাত, চারটে বেজে গেছে। সিগারেট ধরাল। কী মনে করে বাতি নিবিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
এখন সমস্তই নিঃসাড়। বাইরে অন্ধকার। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে দমকে দমকে। অন্ধকারে বাগানের গাছপালা ঘন ছায়ার মতন দেখায়, আকাশ কালো, কয়েকটি তারা এখনও চোখে পড়ে।
সিগারেটের ধোঁয়া অবনীর স্নায়ুকে শান্ত ও স্বাভাবিক করছিল। স্বপ্নের উত্তেজনা অবসিত। অথচ তার অন্যমনস্কতা ও বিমর্ষতা বাড়ছিল।
কিছুক্ষণ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অবনী, সিগারেট শেষ করল, তারপর বিছানায় ফিরে এসে শুয়ে পড়ল।
এই রকম স্বপ্ন সে আর দেখেনি। ললিতাকে কখনও কখনও সে এখনও স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কোনওদিন এভাবে দেখেনি। এই স্বপ্ন, অবনীর মনে হল, অদ্ভুত, ভীতিকর। স্বপ্নে ললিতাকে সাহচর্য সুখ অথবা রমণক্রিয়া হেতু যে হর্ষোৎফুল্লভাব তা সে অনুভব করেছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হয়। নির্দিষ্ট ও স্থায়ী ছবির মতন অবনী শুধু সেই বীভৎস জালটি দেখতে পাচ্ছিল: কালো, শক্ত, কঠিন; সেই জালের মধ্যে আদিম কোনও জলজ জীবের মতন নগ্ন দুটি নরনারীর সর্বাঙ্গে শ্যাওলা ও পানা। কেন যেন এই স্বপ্নের কোথাও অবনী তার অতীতকে খুঁজছিল।
ললিতার বিষয়ে অবনী আজকাল সাধারণত কিছু ভাবতে চায় না, ভাল লাগে না ভাবতে। তার মনে। হয় না, এখন আর ও-বিষয়ে কিছু ভাববার থাকতে পারে। অকারণে মনে মনে পুরনো বিরক্তিকর একটি স্মৃতিকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে দেখে লাভ কী! এখনও যে অবনী ললিতার কথা ভাবতে চাইছিল তা নয়, অথচ এই অদ্ভুত স্বপ্নটির রহস্যে ও বিচিত্রতায় সে এতই বিহ্বল ও তন্ময় হয়েছিল যে ললিতার কথা না
ললিতার সঙ্গে আলাপ সাধারণ ভাবেই। কমলেশ আলাপ করিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। একসময় কমলেশ অবনীর সহপাঠী বন্ধু ছিল। মাঝে মাঝে অবনীর কাছে আড্ডা মারতে গল্প-সল্প করতে আসত। কমলেশ হাসিখুশি মেজাজের ছেলে, চাকরি করত মোটামুটি ভাল জায়গায়, চৌরঙ্গি পাড়ায় কোনও কোনওদিন বিয়ার-টিয়ার খেতে আসত। একদিন অবনীর সঙ্গে লিন্ডসে স্ট্রিটের কাছে দেখা কমলেশের, সঙ্গে ললিতা। পরিচয় করিয়ে দিল কমলেশ।
অবনী প্রথম দর্শনেই আকৃষ্ট হয়েছিল। ললিতার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা যে-কোনও পুরুষের পক্ষেই স্বাভাবিক ছিল। দেহজ সৌন্দর্য প্রথমেই পুরুষের চোখকে নিষ্পলক ও কাতর করে– ললিতার শরীরে সে সৌন্দর্য অতিমাত্রায় ছিল। প্রখর ও প্রলুব্ধক সেই রূপে অনী আকৃষ্ট হল। ললিতার মুখ ছিল ভাসন্ত, সামান্য হোট:কপাল চওড়া, গালের চামড়া পাতলা, ফোলানাক একটু মোটা, ঠোঁট পুরু। ঠোঁটের ডগায় ডিমের কুসুমের মতন টলটলে, আঠালো ভাব ছিল। ললিতার চোখ ছিল বড় বড়; ঘন, মোটা ভুরু, পাতা মোটা। দৃষ্টিতে কটাক্ষ ও কামভাব ছিল। ওর মুখ চোখের মধ্যে কোথাও এক ধরনের মাদকতা থাকায় ললিতা চোখ জড়িয়ে বিলোল করে কথাবার্তা বলত, বাদামের দানার মতন দাঁত দেখিয়ে হাসত। ওর কাঁধ, গলা সুন্দর ছিল; পিঠ ভরা; স্তন পরিপূর্ণ ও দৃঢ়; গুরু নিতম্ব, সুডৌল জঙ্ঘা।
অবনী প্রথম দর্শনেই ললিতাকে তার চিত্ত চঞ্চলতা বুঝতে দিয়েছিল। ললিতাও বুঝেছিল।
পরিচয় খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতায় দাঁড়াল। অনী সেসময় যেরকম ব্যবহার করেছিল তাতে মনে হবে, তার মন ও দৃষ্টিকে সে একই জায়গায় নিবদ্ধ রেখেছিল। একটি মাত্র বস্তু কামনা করলে যেভাবে মানুষ অন্য আর সব কিছু ভুলে যায়–অবনী সেই ভাবে অন্য কোনও বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ না করে একমাত্র ললিতাতেই তার মনঃসংযোগ করেছিল।
কমলেশ একদিন বলল: কীরে, তুই যে একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিস।
জ্ঞান হারাবার মতনই দেখাচ্ছিল তখন। অবনীকে একমাত্র অফিসে ছাড়া কোথাও কখনও বড় একা দেখা যেত না। সে সর্বদাই ললিতাকে সঙ্গে রাখত, বা ললিতাকে সঙ্গদান করত। কমলেশ ঠাট্টা করে যাই বলুক, অবনী দিশেহারা অথবা উন্মাদ হয়নি, সে ললিতাকে একটি কলয়ের মতন চতুর্দিক থেকে আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছিল। চতুরের মতন সে এ কাজ করেনি, আবেগ ও বাসনার দ্বারা করেছিল। ললিতার প্রতি তার আকর্ষণ অতি তীব্র ও আন্তরিক হওয়ায় সে সতর্ক, সংযত হয়নি, হবার চেষ্টাও করেনি। প্রয়োজন ছিল না। কমলেশ পরে আবার একদিন বলল:
একটু সাবধান হ
কেন?
আমি যতদূর জানি, ওর আরও কিছু বন্ধুবান্ধব আছে।
তাতে আমার কী?
অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।
এক সন্ন্যাসীর গাজনটাই তুই দেখ, বাদবাকির কথা ভাবিস না।
তুই ভীষণ সিরিয়াস। প্রেমে পড়েছিস নাকি!
ওসব প্রেমটেম বুঝি না, ভাই; ভাল লাগে, দ্যাটস অল।
বিয়ে করবি?
লোকে তো তাই করে।
ললিতার সঙ্গে পরিচয়ের বছর দেড়েকের মধ্যেই অবনী তাকে বিয়ে করে ফেলল। ললিতা ভাল করে কিছু হুঁশ করতে পেরেছিল কি না কে জানে। অবনী সে সুযোগ সম্ভবত দেয়নি। যদি এমন ধরে নেওয়া হয় যে, ললিতা অবনীর মৃগয়ার বস্তু ছিল তবে অবনী তার শিকারকে দ্বিধা করতে, সরে যেতে অথবা পালিয়ে যেতে দেয়নি; নিশানার বিন্দুমাত্র ভুলচুক না করে স্থির দৃষ্টি রেখে সে লক্ষ্যভেদ করেছিল। অবনীর এই সাফল্যের মূলে তার বাসনার তীব্রতা ছিল সবচেয়ে বেশি, তার অনমনীয় দৃঢ় পৌরুষ, তার দ্বিধাহীন আকাঙ্ক্ষা এবং স্পর্ধিত আক্রমণের সামনে ললিতা অসহায় হয়ে পড়েছিল।
ললিতা বোকা বা অনভিজ্ঞ ছিল এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। নিজের দাম সে জানত। সাংসারিক লাভ লোকসানের হিসেবটা সে মনে মনে ভালভাবেই কষে রেখেছিল। ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তার মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। কিন্তু ললিতা কোনও কোনও জায়গায় তার হিসেবের ভুল করে ফেলেছিল। অবনীকে সে যথার্থভাবে বোঝেনি। ভেবেছিল তার লাভ বই লোকসান হবে না। অবশ্য অবনীকে আপাতদৃষ্টিতে অপছন্দ করার কিছু ছিল না–এমন কোনও স্থূল কারণ ললিতা খুঁজে পায়নি যাতে অবনীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অন্য কোনওদিকে, যা স্থূল নয়যা সূক্ষ্ম এবং ভিতরের দিক-সেদিকে তাকাবে এমন সুযোগ ললিতা পায়নি, অবনী তাকে সে অবসর দেয়নি। সম্ভবত, ললিতা তার শারীরিক লক্ষণগুলির জন্যে মনে মনে যে দাম স্থির করে রেখেছিল অবনী প্রথম থেকেই তার বেশি ললিতাকে দিয়েছে; অনন্য এতটা দেবে কি দেবে না ললিতা জানত না; প্রাপ্তির আধিক্যে সে সন্তুষ্ট ও লোভী হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া, ললিতা অবনীর প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাছে আত্মরক্ষা করতে পারেনি, তার প্রয়োজনও সে অনুভব করেনি তখন। এসব সত্ত্বেও ললিতা অবনীকে সঙ্গী হিসেবে, পুরুষ হিসেবে পছন্দই করেছিল।
বিয়ের পর বাদুড়বাগনের বাড়িতে ওরা কয়েক মাস যেন হাওয়ায় ভেসে ছিল। চার-পাশে তখন খুশি ঠিকরে উঠছে; সুখ, সুখ আর সুখ। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে মনে হত ওদের হাতে কেউ যেন সুখের একটা বড়সড় নোট ধরিয়ে দিয়েছে, দিয়ে বলেছে: যাও, খরচ করো। ওরা দুজনে সারা দিন ভরে সেই নোটের ভাঙানি খরচ করে রাত্রে বিছানায় শুয়ে দেখেছে তখনও অনেক অবশিষ্ট থেকে গেছে। অবশিষ্ট যা থেকে যেত তা খরচ করার জন্যে ওরা কৃপণতা করেনি; কারণ সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলেই আবার একটি সুখের নোট পাওয়া যাবে। এত সুখ-শুতে, বসতে, কথা বলতে, বেড়াতে কোথায় যে ছিল তা যেন তারা জানত না। অবনীরও মনে হত, সে আশাতীত তৃপ্তির মধ্যে রয়েছে; হয়তো এতটা সে প্রত্যাশাও করেনি।
বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনের প্রথম কয়েকটা মাস তারা যেন এক ঘূর্ণির মধ্যে ছিল, কোথাও স্থিরতা বা শান্তভাব ছিল না। কিছু বিচার করেনি, ধীরে-সুস্থে পরস্পরকে দেখেনি। ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে পাক খেয়েছে। হয়ত এটা স্বাভাবিক। সদ্যপ্রাপ্ত নতুন খেলনা হাতে পেয়ে ছেলেমানুষে যেমন সব কিছু ভুলে গিয়ে খেলায় মন দেয়–এও অনেকটা সেই রকম। এমনকী নতুন খেলনা পেলে শিশুরাও যেমন অনেক সময় মনে মনে বোঝাপড়া করে পরস্পরকে খেলনাটা নিয়ে খেলতে সুযোগ দেয়, অবনী ও ললিতাও সেই রকম পরস্পরকে সুযোগ দিত।
বছর খানেক পরেই দেখা গেল সুখের স্বাদ ফিকে হয়ে আসছে। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বসলেই আর হাতের মুঠোয় সুখের নোট কেউ গুঁজে দিয়ে যায় না। দুঃখেরও নয় অবশ্য।
কুমকুম তখনও হয়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হচ্ছে। কুমকুমের ভারে ললিতা ভারাক্রান্ত। ওর ইচ্ছে ছিল না–এত তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়ে হোক। অবনীর মনে হয়েছিল, যদি হয়ে থাকে তবে তা নিয়ে ললিতার এই অশান্তি মনে মনে পুষে রাখা অনুচিত। প্রথম সন্তানের জন্যে অবনীর কেমন ঔৎসুক্য ও কৌতূহল ছিল। ললিতার তেমন কিছু ছিল না। তবে এ নিয়ে সামান্য কথাকাটাকাটি হলেও বড় রকমের কোনও ঝগড়াঝাটি হয়নি। যেটুকু অশান্তি তা ভুলে যাওয়া যায়।
কুমকুম হল। কুমকুমের জন্মের পর ললিতার সেই ক্ষুব্ধভাবটা কমল। কেমন করে যেন সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিল। বরং অবনী ও ললিতার মধ্যে সম্পর্কের যেটুকু চিড় ধরেছিল তা সাময়িকভাবে মেরামত হয়ে গেল।
তারপর ক্রমশ, বাদুড়বাগানের বাড়িতে অশান্তি দেখা দিতে লাগল। স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যেত না প্রথমে, ধার পড়ত না; কিন্তু ধোঁয়া ধুলো নোংরা উড়ে এসে এসে যেভাবে ঘরের কোণে, দেওয়ালে ময়লা জড়ো হয়, ঝুল জমে–সেইভাবে সংসারে মালিন্য জমতে লাগল। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ত।
অবনী চেষ্টা করত ওই সব মালিন্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার। চোখ ফিরিয়ে সে ললিতার দিকে তাকাত। ললিতার দেহের প্রতি তার তখনও প্রবল আসক্তি। কুমকুম হওয়ার পর ললিতার শরীর ভেঙে যায়নি, যৎসামান্য যা পরিবর্তন তাতে ললিতার প্রতি বিতৃষ্ণা জাগার কোনও কারণ ছিল না। বরং অবনীর চোখে এই পরিবর্তন ভালই লাগত।
স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ককে সে আর কোথাও যখন তেমন করে ধরে রাখতে পারছিল না, তখনও শয্যায় সে এই সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। ললিতা এক্ষেত্রে কেমন উৎসাহহীন, নিশ্চেষ্ট হয়ে আসতে লাগল। তারপর এক সময় সে অবনীর কাছ থেকে যেন সরে গেল।
এক সময় যে বাড়িতে দিবারাত্র দুরন্ত শিশুর সাড়ার মতন সুখকে অনুভব করা যেত এখন সেখানে সুখ মৃত, তার সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, সে চলে গেছে এটা বোঝা যায়, বোঝা যায় বলেই মনে হয় সব যেন ফাঁকা। দুঃখ, এখন দুঃখকেই শুধু অনুভব করা যায়।
চোখ সরিয়ে রেখে রেখে অবনী যা দেখেনি, দেখতে চায়নি–এখন তা দেখতে সে বাধ্য হতে লাগল। দেওয়ালে, কোণে, ছাদে, ফাঁকে ফোকরে এত মালিন্য জমে গেছে যে এখন সব অস্বাভাবিক বিবর্ণ দেখায়। পুরু ধুলো, ময়লা ন্যাকড়ার মতন ঝুল, মরা কীটপতঙ্গ জমে গিয়ে যেমন দেখায় অনেকটা সেই রকম। ললিতাও এই নোংরামি দেখতে পাচ্ছিল।
সাংসারিক কলহ, অশান্তি, বিতৃষ্ণা তখন থেকেই ওদের চারপাশে ফেটে পড়ল।
ললিতার শরীরের মতন তার চরিত্রেরও কিছু স্থূলতা ছিল। অবনী যথার্থভাবে সেই স্থূলতার সঙ্গে আগে পরিচিত হতে পারেনি; এখন হচ্ছিল। নিজের চরিত্রেও অবনীর যে রুক্ষতা ও অসহিষ্ণুতা ছিল তাও প্রকাশ পেতে লাগল।
ললিতা বলত: অবনী তাকে মাংসের দরে কিনেছে।
অবনী জবাব দিত: ফুলের বাজারে বিকোবার মতন ললিতার কিছুই নেই।
ওরা পরস্পরকে বিরক্তি বিতৃষ্ণার মধ্যে নতুন করে চিনতে পারল। অবনী বুঝতে পারল, ললিতার স্বভাব অত্যন্ত নোংরা, সে হীন, স্বার্থপর, হিসেবি, দায়িত্বহীন, বিলাসী। ললিতাও বুঝতে পারল, অবনী হৃদয়হীন, অহংকারী, রুক্ষ, কামুক, উদ্ধত। উভয়ে উভয়ের সহস্র রকম ত্রুটি আবিষ্কার করতে পেরে যেন সুখী হচ্ছিল; অথবা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারছিল।
পরস্পরকে নোখ দিয়ে আঁচড়াবার প্রবৃত্তি এবং হিংসা তাদের বেড়েই যাচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোনওনা-কোনও তুচ্ছতম বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হত। তারপর সেই ধোঁয়া থেকে আগুন দেখা দিত।
হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠে অবনী চায়ের পেয়ালায় মুখ দিয়ে দেখল চায়ের স্বাদ অত্যন্ত তেতো জুড়িয়ে জলের মতন হয়ে গেছে। বিরক্ত মুখে অবনী বলল, কী হয়েছে এটা? চা না চেরতার জল?
ললিতা জবাব দিল, যা হয়েছে তাইওর বেশি হবে না।
হবে না মানে– এক পেয়ালা চা দিয়ে আমার মাথা কিনে রেখেছ নাকি?
তুমি কি আমায় দুবেলা দুটো ভাত দিয়ে কিনে রেখেছ নাকি?
দুবেলা দুমুঠো ভাত দিয়ে যাদের কেনা যায় তুমি তাদের দলে নও। তাদের মতন হলে তবু লজ্জা থাকত।
তোমারই কত লজ্জা! …গলা ভর্তি মদ খেয়ে রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে কুকুরের মতন গা চাটতে আস, আর ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলে চোখ রাঙাও।
অবনী রাগের মাথায় চায়ের পেয়ালাটা প্রাণপণে ছুঁড়ে মারল দরজার দিকে, ভেঙে চুরমার হয়ে গেল কাপ। কুমকুম পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে বাবা এবং মাকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।
অকারণে, অল্প কারণে, কখনও বা ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঝগড়া করত ললিতা। অবনী অন্তত তাই ভাবত। আবার ললিতা ভাবত অবনীই সব দোষে দোষী। অবনী ললিতার মধ্যে শিক্ষা রুচি শালীনতা কর্তব্যজ্ঞান সংসারের প্রতি টান খুঁজে পেত না। মেয়েটাকে ও ছোটবেলা থেকেই নষ্ট করেছে, তার স্বভাব খারাপ করে দিচ্ছে।
ললিতা ভাবত, অবনী তাকে ঠকিয়েছে; চাতুরি করে–কৌশলে ললিতাকে তার সংসারে এনে আটকে ফেলেছে। তার স্বাধীনতা, পছন্দ বলে এখন আর কিছু নেই।
ললিতার স্থির ধারণা হয়ে গিয়েছিল, অবনী তাকে প্রবঞ্চনা করেছে। কী ধরনের প্রবঞ্চনা তা সে তেমন বুঝত না; তবে মনে হত–এ-রকম জীবন সে চায়নি, আর পাঁচজন মেয়ের মতন ঘরদোর, স্বামী, মেয়ে এইসব নিয়ে তাকে দিন কাটাতে হবে, ভাবতেই তার বিশ্রী লাগত, ঘৃণা হত। অবনী তাকে সেই একঘেয়েমির মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছে। তা ছাড়া অবনী, ললিতার মনে হত, তাকে ভালবাসে না, তার প্রতি মমতা নেই, মর্যাদাও দেয় না। শুধুমাত্র বিছানায় নিয়ে শোবার জন্যে তাকে বিয়ে করেছিল। লোকটা চতুর এবং কামুক।
তোমার টান তো শুধু এক জায়গাতেই। ফুর্তির জন্যে যখন দরকার, যেটুকু দরকার। ললিতা বলত।
তোমার কত জায়গায় টান-অবনী বিদ্রূপ করে জবাব দিত।
নেই। কেন থাকবে। আমি কি এইসব চেয়েছিলাম?
চাওনি। তুমি কী চেয়েছিলে আমি এখন তা বুঝতে পারি।
কী শুনি?
এখানে দুদিন সেখানে দুদিন করে কাটাতে; মজা লুটতে। যার কাছে যতদিন লোটা যায়।
কত মজাই তোমার কাছে পেলাম। ললিতা উপহাস করে বলত।
আসলে অবনী ও ললিতার মধ্যে স্বভাবের পার্থক্য ছিল প্রচুর। তারা নিজেদের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে চিন্তা করে একে অন্যের কতটা নিকট হতে পারবে তা ভাবেনি। একমাত্র শয্যাই তাদের মিলনক্ষেত্র ছিল, অন্যত্র তারা বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র থাকত। যে অনুভব, বোঝাপড়া, সহিষ্ণুতা এবং স্বার্থত্যাগ থাকলে তারা পরস্পরের বিপরীত স্বভাবকেও সহ্য করে নিতে পারত, সহ্য করে পরস্পরকে ক্রমশ পরিবর্তিত ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং একাত্ম করতে পারত–তেমন বোঝাপড়া, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি তাদের কিছুই ছিল না।
অবনী অবসাদ বোধ করতে লাগল। ললিতাও যেন পালাতে পারলে বাঁচে। অবনী লক্ষ করত, ললিতা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, তার পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা সেরে অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে, অবনীর দিকে চোখ ফেরায় না। সংসার খরচের টাকা মুড়িমিছরির মতন খরচ করে, নষ্ট করে, আবার চায়। কুঠা নেই, লজ্জা নেই।
অবনীর একটিমাত্র দুর্বলতা ছিল। কুমকুম। কুমকুমকে তার মার হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা অবনী করেছিল। ললিতা তা দিল না। বরং সে কুমকুমকে অবনীর বিপক্ষে দাঁড় করাল। বাবাকে ঘৃণা করতে, অপছন্দ করতে, অবজ্ঞা করতে কেমন করে শেখাল ললিতা কে জানে, কিন্তু কুমকুম তার মার দলে চলে গেল। ওইটুকু মেয়ের চোখে অবনী যে বিষাক্ত দৃষ্টি দেখেছে তাতে মনে হয়েছে, সংসারে তার মতন পাকা শয়তান যেন আর নেই।
ললিতা মেয়েটাকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছিল। তাকে শত রকমের ইতরতা শেখাচ্ছিল। অবনীর মনে হয়েছিল, ললিতা তাকে দুর্বল স্থানে আঘাত করে আনন্দ পেতে চাইছে।
একদিন ললিতা বলল, এভাবে আমি থাকব না।
কী ভাবে?
তোমার সঙ্গে কোনও মেয়ে থাকতে পারে না।
আর কেউ তোমায় পুষতে চাইছে নাকি?
ভদ্রলোক হবার শিক্ষা যে পাওনি তা তো আমার জানা আছে।
তোমার পরিবারের লোকজন কি ভদ্র?
তোমার চেয়ে ভদ্র।
দেখতেই পাচ্ছি। …বাপ কুকুর-ব্রিড করিয়ে পয়সা নেয়, ছেলে নাচের দলে মেয়ে সাপ্লাই করে, এক বোন তো…
তোমার মা বাবাও দেবতার অংশ নয়। ওসব কথা থাক, নিজের গায়ের গন্ধ যখন লুকোতে পারবে না তখন অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ কী! ..আমি ঠিক করেছি–তোমার এখানে আমি থাকব না।
কার সঙ্গে থাকবে?
দরকার হলে কারুর সঙ্গে থাকব।
আজকাল মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকছ নাকি?
আমি ডিভোর্স চাইব।
চাও।
তুমি রাজি?
আপত্তি নেই। …পরে ভেবে দেখব।
মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
না। মেয়ে আ
মার। তোমার কাছে আমি তাকে থাকতে দেব না।
পারিবারিক জীবনে যেমন, বাইরেও অবনী সেই রকম অসুখী অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। অফিসে তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধব সহকর্মীর মনোমালিন্য ঘটছিল। ওপরঅলার সঙ্গে বিরোধ। তার আর কিছু ভাল লাগত না, সহ্য হত না। সব বিষয়েই তার অসীম ক্লান্তি জমছিল, অনাগ্রহ বাড়ছিল। মনে হত সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অবসন্ন ও ক্লান্ত বোধ করছে। কেমন যেন এক একঘেয়েমি, অর্থহীনতার মধ্যে সে বেঁচে আছে, উদ্দেশ্যবিহীন জীবন, কোথাও কোনও স্বাদ নেই সুখ নেই।
একদিন মদ খেতে খেতে কমলেশ বলল, তুই খুব সিক হয়ে পড়েছিল।
শরীর দেখে বলছিস?
না, তোর চোখ মুখ দেখে, কথাবার্তা শুনে।
কিছুই ভাল লাগে না…
সাফারিং ফ্রম বোরডোম।
জানি না। … আমি মাঝে মাঝে ভাবি: আগুনটা এবার নিবে আসছে।
আগুন? কিসের আগুন?
উনুনের। …চল্লিশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, বুঝলি। আজকের দিনে চলিশ বছর বেঁচে থাকা খুব ডিফিকাল্ট। …আমার মতন ব্যাসটার্ডের ধুনি কতকাল জ্বলবে।
বুঝতে পারছি, এই বেলা কেটে পড়।
শেষ পর্যন্ত অবনী সত্যিই চলে এল। ললিতাকেও ছেড়ে দিল, মেয়েকেও। কিন্তু অবনী বুঝতে পারছিল না, জালের বাইরে এসেও সে এ-স্বপ্ন কেন দেখল?
.
০৭.
নদীর দিকে আজ বেড়াতে বেরিয়েছিল হৈমন্তী। সঙ্গে মালিনী। নদীতে এখনও বর্ষার জল রয়েছে। এখানে ওখানে পাথর। স্রোতের কোথাও তাই সামান্য আবর্ত; জলে টান আছে, মৃদু শব্দ রয়েছে, নয়তো এই পাথর আর নুড়িভরা শীর্ণ জলধারাকে নদী বলা যায় না। মাঝে মাঝে মালিনীকে নিয়ে হৈমন্তী এদিকে বেড়াতে আসে। এই নদী যে তার ভাল লাগে তা নয়, তবু আসে। আশ্রম থেকে বেরুলে যাবার রাস্তা মাত্র দুটোই, হয় উত্তরে যাওনয় দক্ষিণে; উত্তরে কাঁচা রাস্তা ধরে গেলে সোজা বাস-রাস্তার মোড় লাটুঠা; দক্ষিণে হাঁটলে অল্প পথ এগিয়ে এই নদী,নদী পেরুলেই গুরুডিয়ার গ্রাম। আশ্রমের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে, বা প্রত্যহ কাঁচা সড়ক ধরে উত্তরে এগুতে ভাল লাগে না বলেই নদীর দিকে আসা। নদীর দিকে আসতেও রোজ ইচ্ছে করে না। তবু, এপাশে এলে, নদীর পাড়ে পাথরে গিয়ে বসলে মনে হয়– এখানে একটু চঞ্চলতা রয়েছে, মৃদু হলেও শব্দ বলে কিছু আছে; উত্তরের দিকে কিছু যেন আর নড়ে, সেই পথ, সেই মাঠ, গাছ, আকাশসমস্তই স্থির; কাল যেমন ছিল আজও সেইরকম আছে, আগামীকালও থাকবে।
এপাশে, নদীর দিকে বেলাবেলি বেড়াতে এলে দুপাঁচজন মানুষও দেখা যায়। গ্রামের মানুষ:নদীর এপারে সবজি অথবা শস্যক্ষেত্রে কাজকর্ম সেরে নদী পেরিয়ে বাড়ি ফিরছে, সাইকেলের পেছনে শূন্য টুকরি বাঁধা ব্যাপারিও দু-একজন গ্রামে ফেরে। নদীর শীর্ণতম স্থানটি দিয়ে পাথরে পা ফেলে ফেলে বালি আর গোড়ালিডোবা জল পেরিয়ে তারা যখন চলে যায় তখন মালিনী বলে, জল আরও কমে যাক, আপনাকে একদিন গাঁয়ে বেড়াতে নিয়ে যাব, হেমদি; ওখানে একটা মেয়ে আছে, একেবারে বাচ্চা কী ফুটফুটে গোবলাগাবলা, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করবে। বেচারি একেবারে অন্ধ। আমাদের এখানে আগে অনেকবার এসেছে। ওর নাকি চোখ আর সারবে না। এত কষ্ট হয়। ..মালিনী ওই গ্রামের আরও পাঁচরকম খবর রাখে: কোথায় একটা মহাদেবের মন্দির আছে, কোন সময়ে ছট পরব হয়, এমনকী একটা অদ্ভুত কুলগাছ আছে, সাদা কুল হয় শুধু–এইরকম অজস্র খবর।
মালিনী এখানে এলে সবসময় পাথরে বসবে, যতক্ষণ বসে থাকবে নদীর জলে পা ডোবাবে। বলে, ওর হাতে পায়ে নাকি খুব জ্বালা। হৈমন্তী কাছাকাছি একটা বড় পাথর বেছে বসে অবশ্য; কিন্তু জলে কখনও পা ডোবায় না, হাতও দেয় না। ইচ্ছে হয় হয়তো, কিন্তু মালিনীর সামনে চাঞ্চল্য প্রকাশ করতে তার সঙ্কোচ হয়, যেন তার বয়সে এবং মর্যাদায় এই ধরনের ছেলেমানুষি করতে বাধে।
সাধাসিধে সরল বলেই মালিনী কথা একটু বেশি বলে। তার কথাবার্তা কখনও কখনও একেবারে বোকার মতন শোনায়, কখনও কখনও মনে হয় সে হৈমন্তীর বন্ধুর মতন হয়ে উঠছে, কী তার বলা উচিত কিবা উচিত নয় তা বুঝতে পারে না। হৈমন্তীর পরিবার সম্পর্কে সে নানান কথা জিজ্ঞেস করে, এই আগ্রহ মেয়েলি কৌতূহল; কলকাতার গল্প, হৈমন্তীর ডাক্তারি লেখাপড়ার গল্প শুনতেও তার ছেলেমানুষের মতন আগ্রহ রয়েছে। ইদানীং হৈমন্তী লক্ষ করছিল, মালিনীর আরও একটি বিষয়ে অস্বাভাবিক কৌতূহল দেখা দিয়েছে, স্পষ্ট করে বা সাহস সঞ্চয় করে কখনও কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারে না, কিন্তু অনেক সময় তার সেই কৌতূহল চাপা ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, ওর দৃষ্টি বহু সময়ে তা ব্যক্ত করে। সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর সম্পর্কের মধ্যে একটি রহস্যের গন্ধ মালিনী পেয়েছে।
মেয়েটিকে হৈমন্তী পছন্দই করে; তবু মালিনীকে সে সমমর্যাদার মানুষ বলে মনে করতে পারে না। বরং মালিনীর বয়স ও অন্যান্য বিষয়ের কথা ভাবলে মনে হয়, ওকে এতটা মেলামেশা করার সুযোগ দেওয়া হয়তো প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আবার, হৈমন্তী কখনও কখনও ভাবে, মালিনীর সঙ্গে তার এমন কিছু তফাত নেই; সে লেখাপড়া শিখেছে, ডাক্তার হয়েছে, মালিনী লেখাপড়া বিশেষ কিছু শেখেনি, বয়সে সে বড়, মালিনী কিছুটা ছোট, হৈমন্তীর শহুরে শিক্ষাদীক্ষা, মালিনীর তা নয়; এ আর কী এমন তফাত। মালিনী তার দাসী নয়, সে ভদ্র পরিবারের মেয়ে, আর্থিক সঙ্গতি আজ তাদের নেই; হৈমন্তীদের কি এক সময়ে খুব একটা আর্থিক সঙ্গতি ছিল! হৈমন্তীর অসুখের সময় সুরেশ্বরের অর্থ সাহায্য কি তাদের প্রয়োজন হয়নি? তবে! ..দরিদ্র বলে মালিনীকে অবহেলার চোখে বা ছোট চোখে দেখতে হৈমন্তী কুণ্ঠিত হত। তার মতন ডাক্তার নয় বলে, বা মালিনী শহুরে নয় বলেও তাকে নিচু করে ভাবতে তার খারাপ লাগত। তবু পুরোপুরি মালিনীকে নিজের সমান সে মনে করতে পারত না।
সঙ্গী হিসেবে, আর অনেকটা যেন দূর আত্মীয়ের মতন হৈমন্তী মালিনীকে গ্রহণ করেছিল। দুটো কথা বলতে, গল্প করতে, মন হালকা করে হাসতে মালিনী ছাড়া তার সঙ্গী নেই। তা ছাড়া, মেয়ে বলেই হয়তো, স্বভাববশে তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, হৈমন্তী তেমন স্বতন্ত্র ও পৃথক থাকতে পারছিল না। হৈমন্তীর এই ধরনের মনোভাবকেই মাঝে মাঝে তার প্রশ্রয় দেওয়া বলে মনে হত। মনে হলেই সে বিরক্ত হত। আবার সময়ে সময়ে তার বিরক্তি নষ্ট হয়ে কেমন কুণ্ঠা জাগত।
নদীর পাড়ে পাথরে বসে কথা বলতে বলতে বিকেল পড়ে গেল। বর্ষা বিগত, শরৎকাল এসে পড়েছে। হৈমন্তী তেমন করে কখনও শরৎকাল কলকাতায় দেখতে পায়নি কিন্তু অসুখের সময় সে বীরভূমের মাঠেঘাটে শরৎকাল দেখেছে, স্মৃতি হয়ে এখনও তা বেঁচে আছে। এখানে সেই শরৎ নেই; কাশফুল চোখে পড়ে না-ধানের ক্ষেতে বাতাসের লুটোপুটি খাওয়া নেই, হাসিকান্নার মতন রোদ বৃষ্টিতে ভেজা তরুলতা কোথায়! তবু এখানেও শরৎকাল এসেছে। আকাশে, মেঘে, রোদে, বন্য প্রান্তরে এমনকী শস্যক্ষেত্রেও তা চোখে পড়ে। এই শরৎ সজল স্নিগ্ধ নয়, শুষ্ক স্নিগ্ধ। বড় তাড়াতাড়ি এখানে সব শুকিয়ে যায়। দীর্ঘ বর্ষার সমস্ত চিহ্ন এখানে অতি দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছিল, যেন নতুন পালা শুরু হওয়ার আগে কেউ দক্ষ হাতে তাড়াতাড়ি পুরনো পালার সব কিছু মুছে নতুনের জন্যে রঙ্গমঞ্চ সাজিয়ে দিচ্ছিল।
বেলা পড়ে আসছিল। এক ঝাঁক পাখি নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেল। গোধূলির মতন আকাশ কোথাও কোথাও রক্তাভ।
হৈমন্তী উঠল। মালিনীর ইচ্ছে ছিল আরও একটু বসে। আজ সে হৈমন্তীর কাছে নানারকম মজার গল্প শুনছিল। গল্পে গল্পে হৈমন্তীর ডাক্তারি পড়ার গল্প উঠেছিল: প্রথম প্রথম মড়ার গন্ধ কেমন লাগত হৈমন্তীর, কী কী করতে হত।
জল থেকে পা উঠিয়ে নিয়েছিল মালিনী অনেক আগেই, ওঠার সময় নদীর জলে মুখ ধুলো, কুলকুচো করল, তারপর আঁচলে হাত মুছে উঠে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে মালিনী বলল, মানুষ মরে যাবার পর তার আত্মা কী করে স্বর্গে যায়, হেমদি?
হৈমন্তীর পঠিত বিদ্যার মধ্যে আত্মার স্বর্গগমনের কোনও সংবাদ ছিল না, হৈমন্তী সকৌতুক চোখে এই সরল মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, হাসির মুখ করল। তা তো জানি না।
মালিনী বোধ হয় জবাবটায় খুশি হল না; তার মনঃপূত জবাব এটা নয়। বলল, এখানে স্টেশনের কাছে একবার একটা বায়স্কোপ এসেছিল, সাবিত্রী সত্যবান পালা আমি দেখেছি। হিন্দি। সত্যবান মারা যাবার পর যমরাজ তার আত্মা নিল জানেন হেমদি। ইস্..কী কষ্ট যে হচ্ছিল, কিন্তু খুব ভাল দেখিয়ে ছিল। যমরাজ তার গদার মতো জিনিসটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সত্যবানের বুকের কাছে ধরল আর সঙ্গে সঙ্গে সত্যবানের শরীর থেকে আর-একটা ছায়ার মতন সত্যবান বেরিয়ে এল; যমরাজ যত তার দণ্ডটা তুলছে, সেই ছায়ার মতন সত্যবানের শরীরটা ছোট হয়ে হয়ে জ্যোতির মতন হয়ে গেল, অবিকল একটা বলের মতন। যমরাজ তার দণ্ড কাঁধে তোলর পর জ্যোতিটা মিলিয়ে গেল, দেখা গেল না। ..
হৈমন্তী বুঝতে পারল না কী বলবে। চুপ করে থাকল।
মালিনী বলল, আত্মা ওই রকম ভাবে চলে যায়। না?
সিনেমায় ওই ভাবে দেখায়।
না হেমদি– মালিনী মাথা নেড়ে প্রতিবাদ জানাল। আমার বাবা যখন মারা গেল আমি বাবার মাথার দিকে দেওয়ালে গোল মতন আলো দেখেছিলাম, ঠিক যেন কেউ আলো ফেলেছে দেওয়ালে। তারপর কান্নাকাটি করছিলাম তো, আর কিছু দেখিনি।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল, বলে, ওটা তোমার চোখের ভুল, মনের ভুল; কিন্তু বলতে কষ্ট হল। মালিনী যদি তার বাবার আত্মাকে আলোর মতন হয়ে মিলিয়ে যেতে দেখে থাকে তবে দেখুক–এখন এই মুহূর্তে তার ভ্রম ভাঙানোর চেষ্টা করলে সে ব্যথিত হবে।
হৈমন্তী চুপচাপ হাঁটতে লাগল। পাশে মালিনী।
মালিনী বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারে না। আবার বলল, আমাদের আত্মাটা কোথায় থাকে, হেমদি? বুকের মাঝখানে?
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে মালিনীকে দেখল। বলল, আমি জানি না। বলেই কী যেন ভেবে আবার বলল, এসব কথা তোমাদের দাদাকে জিজ্ঞেস কোরো।
সুরেশ্বরকে আত্মার কথা জিজ্ঞেস করার মতন সাহস মালিনীর নেই। মালিনী বলল, না বাবা, দাদাকে কে জিজ্ঞেস করবে।
ভয় করে?
ভয় করবে না…উনি কত রকম জানেন, আমি কোথাকার কী একটা, এসব কথা জিজ্ঞেস করতে পারি নাকি!
করেই দেখোনা, খেয়ে ফেলবে না তো আর।
মালিনী বিন্দুমাত্র উৎসাহ পেল না। আপনিই করবেন, করে আমায় বলবেন।
হৈমন্তী হাসল। আচ্ছা, করব।
সামান্য সময় চুপচাপ। মালিনী আবার বলল, হেমদি, অনেকে বলে–দাদা পুজোআচা করে না, দাদা হিন্দু নয়, খেস্টান-হিন্দু।
হৈমন্তী যত অবাক হল তত মজা পেল। খেস্টান-হিন্দু আবার কী?
কে জানে! আমি ওসব বুঝি না। তবে আছে।
কোথায়?
মালিনীর তাও জানা নেই। আমি দেখিনি। তা দাদা হিন্দু না হবে কেন বলুন, হেমদি। দাদা গীতা পড়েন, কী সুন্দর পড়েন–আমি শুনেছি। দাদার ঘরের বাইরে ওই যে বেদিটা আছে ওখানে বসে তিনি ধ্যান করেন, আমি দেখেছি। …দাদার ঘরে রামায়ণ মহাভারত-টারতও আছে।
হৈমন্তীর হাসি পাচ্ছিল, হাসলে মালিনী অপ্রস্তুত হবে, হাসছিল না তাই। তবে সুরেশ্বর তার ঘরের সামনে বেদিতে বসে ধ্যান করে এটা জানা ছিল না। বলল, তোমাদের দাদা কখন ধ্যান করেন? খুব সকালে?
কাক-ভোরেও আমি ওঁকে দেখেছি, সন্ধেতেও।
মন্ত্র পড়েন?
না, চুপচাপ থাকেন। ..আমি কোনওদিন কাছে যাইনি, যাওয়া উচিত না।
হৈমন্তী হঠাৎ বলল, তবে হয়তো চুপচাপ বসেই থাকেন।
না–না, মালিনী জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ওভাবে কেউ বসে থাকে না।
হৈমন্তী আর কিছু বলল না।
কথা বলতে বলতে আশ্রমের কাছাকাছি পৌঁছে মালিনী হঠাৎ শুধোল, আপনি যেন কিছু বিশ্বাস করেন না, হেমদি। ঠাকুর দেবতা মানেন না?
হৈমন্তী জবাব দিতে গিয়ে কেমন দ্বিধায় পড়ল। বলতে পারত, না করি না। কিন্তু সেটা মিথ্যে হত। যদি বলে হ্যাঁ, সেটাও সত্য হয় না। ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করে সে পুজোপাঠ, উপোস করে না; আবার দুর্গাপুজোয় সে প্রতিমা দর্শন করে, প্রণাম করে, মন্দিরে গেলেও মাথা নোয়ায়, প্রসাদ খায়। বিপদে ও দুঃখে ভগবানকে স্মরণ করে। কলেজে পড়ার সময়ে কত বন্ধুবান্ধবকেই দেখেছে ঠিক এই রকম, দেবমন্দির দেখে প্রণাম করতে, অঞ্জলি দিতে। এমনকী তাদের কলেজের দুজন বাঘা সার্জনকেও সে ছুরি ধরার আগে একবার নীরবে পলকের জন্যে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বর স্মরণ করতে দেখেছে। হয়তো এটা সংস্কার; ছেলেবেলা থেকে দেখে দেখে শুনে শুনে এরকম হয়েছে। আচার পালন বা সংস্কার মানা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবু হৈমন্তী অন্তত বলতে পারে না, আমি মানি না। তার জীবনের চরম বিপদের সময় সে কি ভগবানের কথা ভাবত না? প্রার্থনা করত না? অসুখের সময় তার কাছে সর্বক্ষণ আর তো ভগবানের কেউ ছিল না; যা বলার ভগবানের কাছেই বলত।
হৈমন্তীর কেন যেন মনে হল, সে বেশির ভাগ মানুষের মতন আচার ও সংস্কারের বশে ঠাকুর দেবতা মানে, আবার অনেকের মতন সে জানে এর সবই মিথ্যে। নিজের সমাজ, পরিবার, আত্মীয়স্বজন তাকে কিছু কিছু জিনিস বিশ্বাস করতে, ভক্তি করতে শিখিয়েছে; বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা তাকে অনেক বিষয়ে অবিশ্বাসী হতে শিক্ষা দিয়েছে। মালিনী যখন তাকে আত্মার কথা বলল, দেহ থেকে জ্যোতির মতন আত্মা বেরিয়ে যায়, তখন হৈমন্তী অনায়াসে হাসতে পারল। কেন না সে জানে, এরকম হয় না, হওয়া অসম্ভব। অথচ সে কেন হেসে বলতে পারছে না ঠাকুর দেবতা আবার কী! ও-সব লোকে দেখায়, বোঝায়। আমি মানি না। কোথায় যেন একটা দুর্বোধ্য বিশ্বাস তার থেকে গেছে।
নিজের দুর্বলতা এবং দ্বিধা হৈমন্তী লুকোতে চাইল না। বলল, আমরা হিন্দু, মালিনী; আমাদের ধর্মে ঠাকুর দেবতা লোকে বিশ্বাস করে। আমিও করি! .. তা ছাড়া এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। সত্যি মিথ্যে জানি না।
মালিনী কেন যেন খুশি হল। বলল, হেমদি, আমার বাবা বলত: ঘুমন্ত মানুষের ঘরেই চোরে সিদ দেয়, ভাবন্ত মানুষের ঘরেই ভগবান দেখা দেয়। বলে মালিনী কেমন ভাবের ঘোরে গুনগুন করে হিন্দি ভজনের একটা কলি গাইল।
.
আশ্রমের কাছে আসতেই চোখে পড়ল সামান্য দূরে একটা জিপগাড়ি দাঁড় করানো। আশেপাশে কেউ নেই।
হৈমন্তী কিছু অনুমান করার আগেই মালিনী বলল, কে এল?
অনেকটা দূর থেকেও হৈমন্তীর মনে হল সে গাড়িটা চিনতে পেয়েছে। অনুমান করল, অবনীবাবু এসেছেন।
মালিনী তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল, কে এসেছে জানতে সে ছেলেমানুষের মতন ব্যগ্র। হৈমন্তী পিছিয়ে পড়ল।
অবনীর কথা মনে আসতেই মালিনীর সেই কথাগুলো মনে পড়ল: খুব মদটদ খায়, একলা থাকে। মালিনী একেবারে একটি গেজেট। হৈমন্তীর হাসি পেল! ..তা হঠাৎ ভদ্রলোক আজ এখানে এলেন? বেড়াতে? সুরেশ্বর ওঁকে আসতে বলেছিল, তাই নাকি? হৈমন্তীও তো আমন্ত্রণ করেছিল।
জিপগাড়ি দেখে মালিনী ফিরে আসছিল। রোগীদের ঘরের দিকে বারান্দায় এক চোখে ব্যান্ডেজ বেঁধে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে, পাশে পিছন ফিরে আর একজন কে দাঁড়িয়ে। অন্ধকুটিরের দিকে কয়েকজন মাঠে গোল হয়ে হয়ে বসে। চাকরবাকরও দেখা যাচ্ছিল। ফিরে আসার সময় মালিনী চেঁচিয়ে কাকে কী জিজ্ঞেস করল। ফিরে এসে বলল, কে এক বাবু এসেছে।
অবনীবাবু বোধহয়– হৈমন্তী বলল।
মালিনী চোখ তুলে হৈমন্তীর মুখ দেখল, দুপলক, তারপর নিজের বোকামির জন্যে যেন আফসোস করে বলল, ওমা তাই তো! ঠিক ধরেছেন হেমদি, এ গাড়ি আমি দেখেছি আমাদের ওখানে।
নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়াল হৈমন্তী; মালিনীও হাঁটতে লাগল।
হেমদি–
একটা কথা বলব, রাগ করবেন না?
কী কথা? হৈমন্তীর সন্দেহ হল মালিনী আরও কোনও নতুন খবর শোনাতে চায়।
মালিনী বলল, আপনার সঙ্গে তো চেনা আছে– ওঁকে একটু আমার ভাইয়ের কথা বলবেন। আমার ভাইটা একেবারে গোবাগাবলা; কিছু মুরোদ নেই। ধরলে করলে চাকরিটা আর একটু ভাল হতে পারত, মাইনেও বাড়ত।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। মালিনীর কথায় এমন এক কাতর অনুরোধ ছিল যে, হৈমন্তীর দুঃখই হল। সেদিন মালিনীর কথা শুনে শুনে মনে হয়েছিল–যে মদ খায়, অত বড় বাড়িতে একলা থাকে তার সম্পর্কে মালিনীর যেমন ভয় তেমনি বিতৃষ্ণা, হয়তো ঘেন্নাও। এখন মালিনীর কথা শুনে মনে হবে, ভদ্রলোক মদই খান আর একলাই থাকুন মালিনীর তাতে আসে যায় না; তার যত বিতৃষ্ণা, ভয়, ঘৃণাই থাকুক তবু সে জানে ওই ভদ্রলোক ইচ্ছে করলেই মালিনীর ভাইকে তরিয়ে দিতে পারেন। এই বিশ্বাসও, হৈমন্তীর হঠাৎ যেন মনে হল অদ্ভুত, প্রয়োজনে বিশ্বাস।
মালিনী অপেক্ষা করছে দেখে হৈমন্তী বলল, আমার সঙ্গে আর কতটুকু চেনা? হুট করে কি ও-সব কথা বলা যায়। বরং তুমি ওঁকে বলতে বলো।
কাকে?
তোমাদের দাদাকে। ..ওঁর সঙ্গেই বেশি চেনা।
মালিনী মাথা নাড়ল, নানা, দাদাকে এসব কথা বলা যায় নাকি! আপনি যেন কী হেমদি!
মালিনীর জন্যে কেমন সহানুভূতি বোধ করল হৈমন্তী, বলল, আচ্ছা দেখি।
দরজার মাথায় শেকল খুলে হৈমন্তী নিজের ঘরে ঢুকল, মালিনী গেল তার ঘরে।
অন্ধকারে কয়েক দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকল হৈমন্তী। মালিনী হাত মুখ ধোবে, সন্ধে দেবে, লণ্ঠন জ্বালবে; ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে হৈমন্তীকে।
অবনীবাবু এসে সুরেশ্বরের কাছে বসে রয়েছেন নিশ্চয়, গল্পগুজব করছেন। সেখানে যাওয়া কি তার উচিত? ভদ্রতা রক্ষা করতে হলে একবার যাওয়া দরকার। সেদিন এই অবস্থায় পৌঁছে দিলেন, আবার পথে যেদিন দেখা হল দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বললেন, এগিয়ে দিলেন খানিকটা, হৈমন্তী ওঁকে আশ্রমে আসতে অনুরোধ করল। এর পর, ভদ্রলোক আজ যখন আশ্রমে এসেছেন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা না করাটা কি ভাল দেখাবে! না দেখা করাটা সৌজন্য হয় না। আবার সুরেশ্বরের ওখানে গিয়ে দেখা করাটাও কেমন যেন!
সুরেশ্বরের সঙ্গে ভদ্রলোক কী গল্প করছেন তাও জানার কৌতূহল হল হৈমন্তীর; প্রথম দিনই, জিপগাড়িতে আসার সময় পরস্পরের কথাবার্তা শুনে হৈমন্তী বুঝতে পেরেছিল, দুটি মানুষই দুরকম, কোথাও কোনও মিল আছে বলে মনে হয় না। এই আশ্রম সম্পর্কে যে অবনীর কোনও আস্থা নেই, বরং সুরেশ্বর ও এই আশ্রম সম্পর্কে তার মনোভাব উপহাসের তা বোঝা যায়। হৈমন্তীর কানে অবনীর সেই বিদ্রূপ ধরা পড়েছে। ..দুই বিপরীত প্রকৃতির মানুষ মুখোমুখি বসে কী গল্প যে করছে তা শোনার কেমন এক অদ্ভুত বাসনা হল হৈমন্তীর।
মালিনী বাতি দিয়ে গেল।
হৈমন্তী কলঘরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে বলল, আমায় একটু জল খাওয়াও মালিনী, আমি আসছি।
মুখ হাত ধুয়ে ফিরে এসে হৈমন্তী শাড়িটা একটু গোছগাছ করে নিল, মুখ মুছল পরিষ্কার করে, হালকা করে পাউডার বুলিয়ে নিল, চুলে একটু চিরুনি ছোঁয়াল, জল খেল। তারপর ঘরের বাইরে এসে শেকল তুলে দিল।
মালিনী বাইরে এসেছিল, শুধোল, কোথায় যাচ্ছেন, হেমদি?
ওবাড়িতে যাই, একবার দেখা করে আসি।
হৈমন্তী মাঠে নামল। ততক্ষণে অন্ধকার হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই বোঝা গেল চাঁদ উঠছে।
.
০৮.
সুরেশ্বরের বাড়ির বারান্দায় ওরা বসে, লণ্ঠন জ্বলছে, ছোট মতন জলচৌকির ওপর চায়ের কাপ। হৈমন্তীকে দেখে অবনী সৌজন্য প্রকাশ করে তার চেয়ার ঠেলে সামান্য উঠে দাঁড়াল, বলল, আসুন।
হৈমন্তী ঠিক নমস্কার করল না, মাথা নিচু করে যেন তার তরফ থেকে ভদ্রতা প্রকাশ করল; পরিচয়ের স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলল, আপনি বসুন।
সুরেশ্বর আশেপাশে তাকিয়ে হৈমন্তীর বসার জায়গা খুঁজছিল, হৈমন্তী একটা কাঠের চেয়ার টেনে নিল। বসল। অবনীও বসেছে।
সুরেশ্বর বলল, কোন দিকে বেড়াতে গিয়েছিলে?
নদীর দিকে, হৈমন্তী মৃদু গলায় জবাব দিল।
চুপচাপ। সুরেশ্বর অবনী কোনও বিষয়ে কথা বলছিল, হৈমন্তী ওদের গলার শব্দ শুনেছে, এখন হৈমন্তী আসায় ওরা থেমে গেছে। অবনীর দিকে তাকাল হৈমন্তী, কতক্ষণ এসেছেন?
অনেকক্ষণ। ঘন্টা খানেকেরও বেশি।
দেখলেন সব… হৈমন্তী মুখে হাসি মাখিয়ে বলল।
মোটামুটি।
কেমন লাগল?
অবনী কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে সুরেশ্বরের দিকে তাকাল। সুরেশ্বর যেন হাসছিল।
সুরেশ্বর বলল, উনি তেমন করে কিছু দেখেননি, হেম। আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় একটু পায়চারি করলেন।
অবনী সঙ্কোচ অনুভব করে বলল, না, ঠিক তা নয়; এখন আর কী দেখব! পরে আবার একদিন আসা যাবে।
হৈমন্তীর মনে হল, আশ্রম দেখার উৎসাহ অবনীর নেই। কী বা দেখবে সে? কটা বাড়ি, কয়েকজন অন্ধ, আর হাসপাতাল? এসব দেখার আগ্রহ কারই বা থাকে।
নিজের কুণ্ঠা ও অপ্রস্তুত ভাব কাটবার জন্যে অবনী ঠাট্টার গলায় এবার বলল, আমরা মিস্ত্রি-মজুর মানুষ, এসব বুঝি না। …কথাটা হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েই প্রায় বলল অবনী, তারপর সুরেশ্বরের দিকে তাকাল, তবে আপনি মশাই, কাজের লোক। আমাদের বিজলীবাবু বলেন, কর্মযোগী ব্যক্তি। বলে জোরে জোরে হাসল।
সুরেশ্বরের নীরবে হাসল। হৈমন্তীর ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল।
অবনী পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। এক গলা ধোঁয়া টেনে নিয়ে ঢোঁক গিলল। পরে সুরেশ্বরকে লক্ষ করে বলল, আপনি বেশ সুখে-শান্তিতে আছেন দেখছি। …আজকাল সুখটুখ পাওয়া একটা ভাগ্য।
অবনী ঠাট্টা করল নাকি বাস্তবিকই কোনও ক্ষোভ জানাল বোঝা গেল না। হৈমন্তী আড়চোখে অবনীর মুখ দেখল। সুরেশ্বরকে যদি অবনী ঠাট্টাই করে থাকে তবে ভালই করেছে। হৈমন্তী কোথায় যেন তৃপ্তি বোধ করল। ইচ্ছে হল অবনীকে বলে–ওঁর মতন হয়ে যেতে পারলে কোনও আঁচই গায়ে লাগে না, লাগলেও ফোঁসকা পড়ে না–নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
সুরেশ্বর শান্ত গলায় হাসিহাসি মুখেই বলল, তা একরকম আছি; সুখের চেষ্টায়… সুখের চেষ্টা কথাটায় ঝোঁক ছিল।
কথাটা অবনী খেয়াল করে না শুনলেও তার কানে গিয়েছিল। হৈমন্তীও শুনেছে। অবনী কোনও কিছু না ভেবেই ঠাট্টাচ্ছলে বলল, বেশ তো রয়েছেন, আবার চেষ্টায় আছি বলছেন কেন!
সুরেশ্বর বলল, আপনি বোধহয় সেই পাখির গল্পটা শোনেননি?
পাখির গল্প শোনার মতন ছেলেমানুষ অবনী নয়। অনাগ্রহের গলায় বলল, না।
এ সংসারে একটা গাছ আছে, তাতে দুটো পাখি থাকে… সুরেশ্বর বলল, একটা পাখি থাকে গাছের মাথায়, অন্যটা নীচে-গাছের ডালে বসে ফল খায়। …আমার যতটুকু সুখ তা নীচের ডালে বসে, ওপরে উঠতে পারি না।
অবনী সুরেশ্বরকে দেখল। হৈমন্তীও লক্ষ করছিল। সুরেশ্বর হেঁয়ালি করলেও করতে পারে, কিন্তু অবনীর মনে হল সে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে।
এ যে মশাই তত্ত্বকথা, অবনী হেসে বলল, আমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।
সুরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। হঠাৎ যেন সে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। সামান্য পরে হৈমন্তীর দিকে তাকাল একবার, তারপর অবনীকে বলল, হেম সেদিন বলছিল সংসারে সবাই সুখ চায়। মিথ্যে বলেনি। আমরা সবাই সুখ চাই, দুঃখ পাবার জন্যে কে আর জগতে বাঁচতে চায়। তবু দুঃখের জগতে দুঃখ আছে। সুখও আছে। কিন্তু সুখের কথা ভাবলে কোথায় যেন সন্দেহ থাকে। আমি দেখি সুখ ওই রকম: একই গাছে দুই পাখি, একটা ওপরে, অন্যটা নীচে। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের সুখ নীচের ডালে…
নীচে যে কিছু পাওয়া যায়, ওপরে কিছু না। অবনী অক্লেশে বলল।
আমার তা মনে হয় না, সুরেশ্বর জবাব দিল, ওপরে উঠলে হয়তো আরও বড় কিছু পাওয়া যায়।
কী পাওয়া যায়? ভগবান?
আনন্দ।
কেমন আনন্দ? অবনী শ্লেষের মতন করে হাসল।
তা তো জানি না। যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা বলছেন সমস্ত সংকীর্ণ বেদনা থেকে মুক্ত এ-আনন্দ।
কারা কী বলেছে তাতে কী আসে যায়। তারা মিথ্যে বলতে পারে, ধাপ্পা মারতে পারে। অবনী উপহাস করে বলল। কী পাচ্ছি তার হিসেব না করে কী পাব তার হিসেব করা মূর্খতা। ওসব সুন্দর সুন্দর কথা আমি বিশ্বাস করি না।
সুরেশ্বর উত্তেজিত হল না। স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি কি মনে করেন আজকের হিসেবটাই সব?
না মনে করার কারণ নেই।
সুরেশ্বর আর কিছু বলল না। যেন এ বিষয় নিয়ে তর্ক করার অভিরুচি বা ইচ্ছা তার নেই, প্রয়োজনও নয়। সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।
হৈমন্তীও বাগানের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। জ্যোৎস্না আরও পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে, লতায়পাতায় চাঁদের আলো মাখানো। অথচ হৈমন্তী তেমন সুখ পাচ্ছিল না। কোথায় যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা রয়েছে।
অবনী হাতের সিগারেট ফেলে দিল। সুরেশ্বরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করার পরই সহসা তার ললিতার কথা মনে পড়ল। কেন? ললিতার কাছে সে যা পেয়েছিল তা স্থায়ী হয়নি বলে, নাকি সেদিন তার হিসেবে গোলমাল হয়েছিল, ভুল হয়েছিল।
ভাল লাগল না অবনীর। এসব চিন্তা তার ভাল লাগে না। তেমন করে দেখলে মানুষ, এই মুহূর্তে যা পায় তার অনেক কিছুর হিসেবই তবে করতে পারবে না। সুখেরও নয়, দুঃখেরও নয়। হীরালাল মারা যাচ্ছে এই সংবাদে সে সেদিন যতটা বিচলিত হয়েছিল আজ আর ততটা নয়। তা হলে তার দুঃখ ক্ষোভ কি জলের হিসেবে মাপা হবে।
সুরেশ্বর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আপনাদের কাজ কতদূর এগুল?
চলছে, অবনী অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল।
কে যেন সেদিন বলেছিল, এ দিককার কাজ প্রায় শেষ।
কোথায় শেষ, এখনও অনেক বাকি। অবনী বলল, তারপর কী মনে পড়ায় হেসে বলল, যে কাজ এরা হাতে নিয়েছে তা অশেষ।
সুরেশ্বর হাসল। হৈমন্তী হাসল না, মুখ ফেরাল।
অবনী পরিহাস করে বলল, কাজ শেষ হয়ে গেলে আমায় বেকার হতে হবে। তখন আপনাদের শরণাপন্ন হব। বলে হৈমন্তীর দিকে তাকাল।
হৈমন্তী সহাস্য সকৌতুক মুখ দেখল অবনীর। যে-কোনও কারণেই হোক সামান্য আগে আবহাওয়া কেমন গম্ভীর হয়ে এসেছিল, এখন বেশ হালকা হয়ে আসছে। হাসির মুখ করল হৈমন্তী।
সুরেশ্বর হেসে বলল, আমাদের এখানে অন্ধরা আসে, আপনি তো অন্ধ নন।
না; তবে হতে কতক্ষণ?
কথাটা বলার পর অবনী কোথাও যেন কিঞ্চিৎ সন্দেহ অনুভব করল। সুরেশ্বরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হৈমন্তীর দিকে তাকাল। কয়েক পলক যেন তার কেমন এক রহস্যময় অনুভূতির মধ্যে কাটল।
এদিকে কি অন্ধটন্ধ বেশি? অবনী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
পুরোপুরি যাকে অন্ধ বলে তা হয়তো তেমন নেই, তবে চোখের রোগটা বেশি।
কেন?
অযত্ন, দারিদ্র্য, অবহেলা…। আপনি এদের গাঁয়েটায়ে গেছেন কখনও?
না।
যে ভাবে থাকে সেটা স্বাস্থ্যকর নয়। …
সুরেশ্বর অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার সাধারণ এক উদাহরণ বোঝাতে গিয়ে জানাল, এদিকের সকলেই জ্বালানির জন্যে কাঠকুটো ব্যবহার করে। কাঠের বিশ্রি ধোঁয়া পাখির খোপের মতন খাপরার ছোট্ট ঘরে কত ঢুকছে তা ওরা দেখে না। চার ছ মাসের বাচ্চা থেকে ছেলেমেয়ে বউ সবাই সেই ধোঁয়া খাচ্ছে রোজ। চোখের পক্ষে এটা খারাপ। …এদের বাচ্চাকাচ্চাগুলো সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখে জল পর্যন্ত দেয় না। …এ সবই কিছুটা সাধারণ স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপার। ওরা জানে না, গা করে না। চোখে সামান্য কিছু হলে সেটাকে হাতুড়ে-বিদ্যে করে আরও বাড়িয়ে ফেলে। …
অবনী অন্যমনস্কভাবে শুনল খানিকটা; কোনও উৎসাহ বোধ করল না।
সামান্য সময় নীরবতার মধ্যে কাটাল। অবনী সিগারেটের টুকরোটা নিবিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। দেখতে দেখতে জ্যোৎস্না এ পাশে বারান্দার গায়ে এসে পড়েছে।
সুরেশ্বর বলল, একটু বসুন, আমি আসছি।
সুরেশ্বর ঘরে গেল। হৈমন্তী জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বসে, অবনীও সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল।
কিছু সময় কেউ কোনও কথা বলল না। শেষে অবনীই কথা বলল। সহাস্য গলায় শুধোল, আপনার আবাস কোনটা?
ভেতরে ঢুকেই ডান দিকে; ছোট মতন বাড়িটা।
যাবার সময় দেখব। ..ও, আচ্ছা…আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি–ডকটরস ওপিনিয়ান আমার আজকাল মাঝে মাঝেই মাথা ধরে। চোখ খারাপ হচ্ছে নাকি?
হৈমন্তী অবনীর চোখে চোখে তাকাল। মুখ দেখে বোঝা যায় না ঠাট্টা-তামাশা করছে না সত্যি সত্যিই কিছু জানতে চাইছে। হৈমন্তী প্রায় পেশাদারি গলায় বলল, আপনার চোখ কি খারাপ?
না; দেখতে কোনও অসুবিধা হয় না।
পড়তে? পড়াশোনার কাজকর্ম করতে?
না।
তা হলে কিছুনয়, হৈমন্তী বলল। বলেই ভাবল: বেশি মদটদ খাওয়ার জন্যেও হতে পারে হয়তো। অবনী সম্পর্কে সে কেন যেন সামান্য বিরক্তি বোধ করল এখন।
না হলেই ভাল অবনী হাসল, চারদিকে এত রকমের অন্ধ দেখে ভয় হয়।
কথাটা শুনতে সাদামাটা; কিন্তু অবনী এমনভাবে বলল যে হৈমন্তীর সন্দেহ হল কথাটার মধ্যে দ্বিতীয় অর্থ আছে, খোঁচা আছে। ঠিক কী বোঝাতে চায় অবনী হৈমন্তী জানতে চাইল, এবং জানার আশায় অবনীকে লক্ষ করল।
অবনী নিষ্পলকে হৈমন্তীকে দেখছিল। দৃষ্টি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল অবনী যেন হৈমন্তীর মধ্যে কিছু খুঁজছে, কিছু বা বলছে। হৈমন্তী চোখ সরিয়ে নিল।
অবনী গলার স্বর নামিয়ে বলল, আপনারা দুজনেই খুব ডিভোটেড?
হৈমন্তীর মনে হল, অবনী দুজনে শব্দটা ইচ্ছাকৃত জোর দিয়ে বলল, বিশেষার্থে যেন। কী বোঝাতে চাইল? সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর একটা যুগ্মসম্পর্ক কী সে গড়ে নিয়েছে। কেন যেন অবনীর এই ধারণা তার ভাল লাগল না।
হৈমন্তী বলল, আমি নয়; উনি।
আপনি?
..ভেবে দেখিনি।
সুরেশ্বর ফিরে এল।
সুরেশ্বর ফিরে এসে বসতে না বসতে যুগলবাবুকে দেখা গেল। বাগানের মধ্য দিয়ে এলেন। হাতে কিছু খাতাপত্র। সিঁড়িতে পা দিলেন।
হৈমন্তী অবাক। যুগলবাবু কি আজ বাড়ি ফেরেননি। বলেছিলেন অবশ্য, আজ অনেক কাজ আছে, আশ্রমের অফিসের কাজ, হিসেবপত্রের ঝঞ্জাট। হৈমন্তী বুঝতে পারল, কাজের চাপে আজ ওঁর বাড়ি ফেরা হয়ে ওঠেনি, এখানেই থেকে গেছেন।
যুগলবাবু বারান্দায় উঠে অবনীকে দু পলক দেখলেন। সুরেশ্বরের সঙ্গে তাঁর কাজ, অথচ এখন খাতাপত্র খুলে বসা যাবে কি না সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হল যেন।
সুরেশ্বরও সামান্য বিব্রত বোধ করে অবনীর দিকে তাকাল।
যুগলবাবু বললেন, তিনি কি আর একটু পরে ঘুরে আসবেন?
সুরেশ্বর কিছু বলার আগেই অবনী বলল, আপনারা বোধহয় কাজে বসবেন?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ কিছু অফিস সংক্রান্ত জরুরি কাজ। …আপনি…
আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। কাজের মানুষকে অকাজে আটকে রাখব না। আমি আজ উঠি। উঠবেন!
এখনও তেমন রাত হয়নি। সন্ধে…
আপনাদের আশ্রমে একটু বেড়াই। …উনি তো রয়েছেন। হৈমন্তীকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল অবনী।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল। হেম, তোমার তো সন্ধে কাটে না। ওঁর সঙ্গে গল্পটল্প করো, আমি কাজটা শেষ করে ফেলি।
অবনী উঠে পড়ল।
সুরেশ্বরও উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি দু-একদিনের মধ্যেই আপনাদের দিকে যাব, দেখা করব। আপনি আর-একদিন আসুন। এখানেই দুটো খাবেন… আসবেন। আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করা যাবে। …তত্ত্বকথা ছাড়াও গল্প হয়। আমি নিজেও খুব একটা তত্ত্বের ভক্ত নয়। সুরেশ্বর সুন্দর করে হাসল।
অবনীও হাসল, বলল, আসব।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল, হৈমন্তী উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, হেম, অবনীবাবুকে আর-একবার চা-টা খাইয়ো। আমার এখানে অনেকক্ষণ আগে খেয়েছেন।
অবনী সিঁড়ি নামতে লাগল পেছনে সুরেশ্বর, শেষে হৈমন্তী।
সিঁড়ি নেমে অবনী বলল, আপনার এই বাড়ি বেশিদিন টিকবে না।
কেন?
ড্যাম্প…।
সবে বর্ষা গেল।
মাটির সঙ্গে কিছু মিশিয়ে নিতে পারতেন।
কয়েকটা বছর যাক তারপর দেখব।
সুরেশ্বর খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে বিদায় নিল।
জ্যোৎস্নাভরা মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবনী বলল, ভদ্রলোক এখানে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছেন।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। নীরবে নতমুখে হাঁটতে লাগল।
অবনী আবার বলল, আমার কয়েকটা জিনিস জানতে কৌতূহল হয়। যদি কিছু মনে না করেন জিজ্ঞেস করি।
হৈমন্তী মুখ তুলে তাকাল। কী বিষয়ে কৌতূহল অবনীর? সুরেশ্বর সম্পর্কে কিছু জানতে চান, না তার বিষয়ে?
অবনী বলল, আমি ওঁর মুখে শুনেছি, এক সময়ে উনি কলকাতায় থাকতেন।
হৈমন্তী আস্তে করে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, থাকতেন।
কী করতেন? অবনী শুধোল।
তেমন কিছু না। হৈমন্তী বলল।
পয়সাকড়ি ছিল বোধহয়।
কিছু ছিল।
আত্মীয়স্বজন নেই?
না। মা মারা যান আগে, পরে বাবা।
আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে ভদ্রলোকের মিল হল না। আমার মা পরে মারা যায়। কথাটা অবনী কেমন অকরুণ ভাবে বলল। হৈমন্তী কিছু বুঝতে পারল না।
অল্প কয়েক পা হেঁটে অবনী এবার বলল, উনি কি আপনাদের আত্মীয়?
চোখ তুলে পলকের জন্যে দেখল হৈমন্তী, চোখ নামাল। আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আমার মার সঙ্গে ওঁর মার দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তা ছিল।
অবনী ঘাড় ফিরিয়ে হৈমন্তীকে দেখছিল। আপনার মা…
আছেন। বাবা মারা গেছেন আমার ছেলেবেলায়। দাদা আছেন, চা বাগানে চাকরি করেন, ছোট ভাই আছে, চাকরি-বাকরি করে। এক মামা আছেন। হৈমন্তীর কেন যেন এই পারিবারিক কথা বলতে ভাল লাগছিল।
অবনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হৈমন্তী বলল, এ-পাশে হাঁটুন–ওই যে–ওই বাড়িটা আমার।
বাড়ির কাছাকাছি এসে দ্বিধা বোধ করল হৈমন্তী। তার একটিমাত্র ঘর, বিছানা কাপড়-চোপড় বইপত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় যা কিছু ওই ঘরে, ওই স্থানটুকুর মধ্যেই তার শোওয়া বসা বিশ্রাম-বিলাস। নিজের নিভৃতি এবং গোপনীয়তা বলতে যা কিছু সবই ওখানে। সামান্য পরিচিত এই পুরুষমানুষটিকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাতে হৈমন্তীর সঙ্কোচ এবং কুণ্ঠা জাগল। তা ছাড়া এই আশ্রমের স্বাভাবিক দীনতার স্পর্শ তার ঘরেও রয়েছে। অবনী নিজের চোখে তার নিভৃত জীবনযাপনটুকু দেখে যাবে হৈমন্তীর তাতে আপত্তি আছে। অথচ ভদ্রলোককে বসাবে কোথায়? বাইরে? সরু বারান্দাটুকুতে? অবনী যদি কিছু মনে করে? যদি ভাবে, এ কেমন ভদ্রতা? বাইরে বসিয়ে রাখা? সুরেশ্বরের ওপর রাগ হল। যুগলবাবুকে একটু ঘুরে আসতে বললে ক্ষতি ছিল না, কিংবা সুরেশ্বর যুগলবাবুকে নিয়ে ঘরে গিয়ে কাজ করতে পারত। তোমার তো ঘরের অভাব নেই, দুটো ঘর, আমার মাত্র একটাই।
মালিনী নিত্যকার মতন বারান্দায় বসে। চাঁদের আলোয় বারান্দা ভরে আছে। হৈমন্তীদের আসতে দেখে মালিনী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।
কাছাকাছি এসে হৈমন্তী বলল, বারান্দায় বসি, চমৎকার জ্যোৎস্না..বাতাসও রয়েছে। বারান্দায় উঠে মালিনীকে বসার জন্যে কিছু আনতে বলল, তারপর নিজেও শেকল খুলে কিছু আনতে ঘরে ঢুকল।
হৈমন্তী বেতের একটা চেয়ার পেল নিজের ঘরে, মালিনী একটা মোড়া এনে দিল। অবনীকে বেতের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে হৈমন্তী বলল, বসুন। …মালিনী, একটু চা করো ভাল করে।
অবনী বসতে বসতে হেসে বলল, এই মেয়েটি আপনার অ্যাসিসটেন্ট নাকি?
না; এখানে ও বছর খানেকের বেশি আছে। এমনি কিছু কাজকর্ম করে, আর রুগিদের দেখাশোনা করে খানিক।
নার্স?
না, নার্স নয়; তবে হাতে হাতে খানিকটা শিখেছে। হৈমন্তী বেতের মোড়ায় বসল। ওর ভাই আপনার অফিসে চাকরি করে।
শুনেছি। বিজলীবাবু সেদিন বলছিলেন।
হৈমন্তী ভাবল, মালিনীর আবেদনটা এখন জানাবে কি না। উচিত হবে কি? বরং মালিনী চা নিয়ে আসুক, মালিনীকে দিয়েই বলবে।
কয়েক মুহূর্তে কেউ আর কথা বলল না। অবনী একটা সিগারেট ধরাল।
হৈমন্তী নীরবে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।
অবনী শেষে বলল, এখানে আপনার সময় কাটে কী করে?
হৈমন্তী সামান্য সময় কোনও জবাব দিল না, যেন তার অজস্র সময় যে কী বিশ্রী, নিরিবিলি ও শূন্যতার মধ্যে কাটে তা আবার মনে মনে অনুভব করে চাপা নিশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, সময় কাটানোই মুশকিল। …সকালে রুগি, বেলা বারোটা পর্যন্ত বড়জোর; তারপর আর করার কিছু নেই। একলা। ওই মালিনীই আমার কথা বলার সঙ্গী।
অবনীর ইচ্ছে হল বলে, কেন-সুরেশ্বর? সুরেশ্বর আপনার সঙ্গী নয়? মুখে বলল, সুরেশ্বরবাবু তো রয়েছেন। ..
হৈমন্তী চোখের পাশ দিয়ে অবনীকে দেখল। বলল, উনি কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন– বলে থামল কয়েক মুহূর্ত, তারপর হাসির মুখ করে বলল, ওঁর কাছে বসে থাকলে আশ্রমের কথা বড় বেশি শুনতে হয়।
অবনী মুখ ফিরিয়ে হৈমন্তীকে লক্ষ করল, বলল, এই আশ্রমের ওপর আপনার অচলা ভক্তি দেখছি না তো। বলে হাসল অবনী।
কেন! আছে তো৷
না। তেমন টান কই!
হৈমন্তী চুপ। মনে হল বলে, না–আমার বিন্দুমাত্র টান নেই, আমি এসব গ্রাহ্য করি না, আমার ভাল লাগে না। এ আশ্রম আমার নয়।
আশ্রমের প্রসঙ্গে হৈমন্তীর আর ভালও লাগে না। এর বাইরে কি কিছু নেই। সাধারণ মানুষ আমি, সাধারণ কথাই আমার কাছে ভাল। অন্য গল্প, আর পাঁচটা অন্য কথা বলতে পারলে সে খুশি হবে।
হৈমন্তী বলল, আপনাকে এখানে কী করতে হয়? কাজের কথা বলছি।
কিছুই না, অবনী হেসে জবাব দিল। তারপর সে তাদের কাজকর্মের কথা বুঝিয়ে বলল।
মালিনী চা নিয়ে এল।
অবনীর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে হৈমন্তী বলল, আপনি মালিনীকে চেনেন না? …মালিনী বড় ভাল মেয়ে। …ওর কী একটা কাজ ছিল আপনার কাছে। বলো না মালিনী।
মালিনী বোকা ও বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হেমদি তাকে অপ্রস্তুতের একশেষ করল। মুখ তুলতে পারল না।
হৈমন্তী নিজের চায়ের পেয়ালা নিয়েছে। মালিনীর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল, দুঃখও হল। অবনীও দেখছিল মালিনীকে।
শেষ পর্যন্ত হৈমন্তীই মালিনীর আবেদনটুকু জানাল। মালিনী আর দাঁড়াতে পারল না, পালিয়ে গেল।
অবনী সংক্ষেপে বলল, দেখি কী করা যায়।
চা খেতে খেতে টুকরো আরও কিছু কথা হল, সাধারণ আলাপ। হৈমন্তী হালকা মনে পারিবারিক কথা, কলকাতার গল্প করছিল। তার ভাল লাগছিল। তারপর কী কথায় যেন তার এখানে আসার প্রথম দিনটির কথা উঠল। বলল, সেদিন যখন এই জঙ্গলে এসে রাস্তায় বাস খারাপ হয়ে গেল, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। কপাল ভাল, আপনার সঙ্গে দেখা হল।
অবনী বলল, তার খানিকটা আগে আমিও ভয় পেয়েছিলাম।
আপনি…! কেন?
কী জানি। …হয়তো মৃত্যুভয়; হয়তো অন্য কিছু…
আমার মনে হয়েছিল আপনি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন।
হয়েছিলাম। …হীরালাল বড় ভাল ছিল, চমৎকার ছেলে। ..সে বিয়ে করেছিল, বাচ্চা আছে। অথচ বেচারির জীবনটা কীভাবে নষ্ট হল। …মিনিংলেস।
হৈমন্তী তার পাশের মানুষটির মুখ দেখল। সংসারের সাধারণ বেদনায় এ মানুষ ব্যথা পায়, দুঃখ বোধ করে, চঞ্চল হয়। এর মধ্যে রক্তমাংস অনুভব করা যায়। সুরেশ্বর এরকম নয়; তার চঞ্চলতা নেই। নিরুত্তাপ। সমস্তই যেন বাইরের।
কী মনে হওয়ায় হৈমন্তী হঠাৎ বলল, আপনার স্বভাব দেখছি খুব নরম।
অবনী নীরব থাকল।
সামান্য পরে হৈমন্তী আবার বলল, আমি চোখের ডাক্তার, তবু ডাক্তার তো, একটা ডাক্তারি উপদেশ দি। মৃত্যুভয় বড় খারাপ, ওসব ভাববেন না, মন দুর্বল হয়। আন্তরিকভাবে গাঢ় সুন্দর গলায় হৈমন্তী বলল, মুখে সামান্য হাসি।
অবনী অল্প সময় চুপ করে থেকে বলল, সুরেশ্বরবাবু হলে অন্য কথা বলতেন..চন্দ্র সূর্য তারা..কত কথা। বড় বড় কথা শুনতে বেশ। আমার ভাল লাগে না। সমস্ত ব্যাপারে এত তত্ত্বের কী আছে!
উনি খানিকটা অন্যরকম। হৈমন্তী বলল।
কী জানি লোকে বলে। ..আগে তো দেখিনি।
উনি অন্ধ আশ্রম করতে এলেন কেন?
জানি না।
অবনী সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। হৈমন্তী কি তাকে কথাটা বলতে চায় না? অথচ মুখ দেখে মনে হয় না সে কিছু গোপন করছে। বরং অবনীর মনে হল, প্রশ্নটা হৈমন্তীকেও কেমন অন্যমনস্ক, বিমর্ষ করেছে।
অবনী চুপ করে থাকল, হৈমন্তীও নীরব। অবনী চোখ ফিরিয়ে নিল, মাঠে ঘাসের ওপর জ্যোৎস্নার কেমন পালিশ ধরে আছে। দুরে তার জিপগাড়ি। মানুষের গলা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না, নিস্তব্ধ।
কিছুক্ষণ মাঠের দিকে তাকিয়ে পরে অবনী চোখ ফেরাল, হৈমন্তীর দিকে তাকাল। হৈমন্তী কখন যেন একটু পাশ ফিরে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্নার মধ্যে ডুবে আছে হৈমন্তী। হঠাৎ দেখলে মূর্তির মতো মনে হয়। স্থির, নিঃসম্পর্ক, যেন মায়া অথবা ভ্রম। অবনী অপলকে দেখছিল: হৈমন্তীর মুখের গড়নটি ডিমের মতন, ছোট কপাল, গড়ানো মসৃণ গাল, টোল তোলা নরম থুতনি, নাক সোজা লম্বা। চোখ দুটি বড়, তবে অস্বাভাবিক নয়, টানাটানা চোখের পাতা, পাতলা ভুরু। হয়তো বয়সে, হয়তো কোনও রকম গাম্ভীর্যে ওর চোখ দুটি শান্ত। ঘাড় হাত পা কোথাও কোনও রকম বিকৃতি নেই, স্বাভাবিক, সুসমঞ্জস। হৈমন্তী সুশ্রী, লাবণ্যপূর্ণ। তার ফরসা গায়ের রং, প্রায়-সাদা শাড়ি, সাধারণ একটি এলো খোঁপা–এমন কিছু নয় যার দিকে অবনী নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকতে পারে।
অথচ অবনী সম্মোহিতের মতন তাকিয়েছিল। সে কী যেন অনুভব করছিল। ললিতাকে দেখার পর সে এরকম কিছু অনুভব করেনি, তার শরীর চঞ্চল ও ইন্দ্রিয়গুলি ক্ষুধার্ত হয়েছিল। হৈমন্তীকে দেখে ইন্দ্রিয়ের কোথাও তড়িৎ-উত্তেজনা অথবা জ্বালা অনুভব করছে না। সে কেমন বিক্ষিপ্তমন হয়ে পড়েছে, কোনও বেদনা বোধ করছে, যে-বেদনা বুঝি অগোচরে থাকে। হঠাৎ কেমন দুঃখী ও দীন মনে হল। অবনী অস্পষ্টভাবে অনুভব করল, তার হৃদয় সহসা শিশুর মতন অভিমানী ও কাতর হয়ে উঠে কিছু চাইছে।
হৈমন্তী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মুখ ফেরাতেই অবনীর সম্মোহিত বেদনাপূর্ণ চক্ষু দুটি দেখতে পেল।
.
০৯.
আচমকা একদিন মাঝরাতে ঝড় বৃষ্টি নামল। পরের দিন সারাটা সকাল কখনও ঝড়, কখনও বৃষ্টি, আকাশ জুড়ে শুধু মেঘ ভেসে চলেছে, যেন একপাশ থেকে কেউ মেঘের ফিতে খুলে দিচ্ছে, অন্য পাশে আর-কেউ গুটিয়ে নিচ্ছে, বিকেলে শাল-গরগলের বনে আবার বুঝি নতুন করে বাদলার পালা নামল, বৃষ্টির ঝাঁপটা দেওয়া বাতাস আসছিল ক্ষণে ক্ষণে; সারা রাত ধরে মেঘ ডাকল গুরুগুরু, বিদ্যুৎ চমকাল আর বৃষ্টি পড়ল। মনে হচ্ছিল, আশ্বিনের শেষে শ্রাবণের ধারা নামল। পরের দিন সকালে আকাশ পরিষ্কার,নভোমণ্ডল নীলের সমুদ্র, কোথাও যেন মেঘের আঁশ নেই, ঝকঝক করছে রোদ, রোদের মধ্যে কোথাও একটু আমেজ পাওয়া গেল শীতের।
আশ্রমের কয়েকটা পলকা গাছ এই ঝড়ে বৃষ্টিতে ছন্নছাড়া চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকল, লতাপাতা ফুল দলিত মথিত, জল, জলের ওপর মাথা উঠিয়ে ঘাসের শিস বাতাসে কাঁপছিল।
কেমন করে যেন এই দুর্যোগে হাতের খানিকটা কেটে গিয়েছিল সুরেশ্বরের, শার্সির কাঁচ ভেঙে বিছানায় ছড়িয়ে পড়েছিল; তার ওপর ডান পায়ের গোড়ালি মচকে গিয়ে হাঁটাচলাও কষ্টকর করে তুলেছিল। দু-তিনটে দিন সামান্য অসুস্থ থাকল সুরেশ্বর।
সেদিন সন্ধেবেলায় ঘরে ক্যাম্বিসের চেয়ারে সুরেশ্বর শুয়ে, মালিনী অন্ধকুটিরের সামনের ডাল-ভাঙা গাছ থেকে একরাশ শিউলি ফুল এনে কাচের প্লেটে রেখে দিল, বলল: একটু চুনহলুদ গরম করে দেব, লাগাবেন?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল, বলল, না। তারপর কী মনে করে বলল, চুনহলুদ নয়, একটু গরম চা করে খাওয়া তো মালিনী, সর্দি সর্দি লাগছে। মালিনীকে কখনও কখনও আদর করে সুরেশ্বর তুই টুই বলে।
একটু পরেই হৈমন্তী এল। মালিনী চা দিয়ে চলে গেল।
এসো হেম, তোমার কথাই ভাবছিলাম। সুরেশ্বর বলল হালকা গলায়, চা খেতে খেতে।
হৈমন্তী সামনাসামনি বসল। মালিনী তাকেও চা দিয়ে গেছে।
তুমি নাকি কলকাতায় যাচ্ছ? সুরেশ্বর শুধোল।
হৈমন্তী তাকাল, মুখ দেখল সুরেশ্বরের। মা কি সুরেশ্বরকেও চিঠি লিখেছে? বলল, মা যেতে লিখেছে।
আর মাত্র সাতটা দিন পরে পুজো। কলকাতা থেকে মা যেতে লিখেছে। না লিখলেও যাবার কথা ভেবেছিল হৈমন্তী। এখানে সে মন বসাতে পারছে না, ভাল লাগছে না। কলকাতাতে কটা দিন কাটিয়ে আসতে পারলে ভাল হত। নিজের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মনটা হালকা হত খানিক। অথচ কী করে যে যাবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সুরেশ্বর কি হাসপাতাল বন্ধ রাখতে রাজি হবে? নিজেও যে হাত কেটে পা মচকে বসে আছে। কথাটা মনে মনেই রেখেছিল হেম, ভেবেছিল পরে বলবে। হয়তো আজও বলত। সুরেশ্বর তার বলার আগেই জেনে গেছে। মা কি সুরেশ্বরকে লিখেছে কিছু!
মা চিঠি লিখেছে? হৈমন্তী জানতে চাইল।
না, মালিনী বলছিল।
ও!
মালিনীর ওপর ঈষৎ বিরক্তি অনুভব করল হৈমন্তী। মালিনীর বলার কী ছিল! মাতব্বরি!
ভাবছিলাম যাব, হৈমন্তী বলল।
সুরেশ্বর কিছু ভাবছিল, বলল, কবে যাবে?
দেখি, এখনও কিছু ঠিক করিনি; ষষ্ঠীর দিন যাব ভাবছি।
চিঠি দিয়েছ মাসিমাকে?
না, দেব।
হাসপাতাল একেবারে বন্ধ রাখবে?
সুরেশ্বর এমনভাবে বলল যেন হাসপাতালটা হৈমন্তীর। ভাল লাগল না শুনতে। কার হাসপাতাল, কে যে বন্ধ রাখছে! হৈমন্তী অপ্রসন্ন হয়ে মনে মনে বলল: তোমার হাসপাতাল, তুমিই জানো।
আর-একটু ভেবে সুরেশ্বর বলল, এ-সময় এদিকে ওরা মেলা-টেলায় যায়, দশহরা-টরা করে, হাসপাতালে বড় কেউ আসে না। তা বেশ তো, তুমি যাও।
হৈমন্তীর মনে হল, সুরেশ্বর যেন তার ছুটি মঞ্জুর করল। অবশ্য ছুটি দেবার আগে নিজের প্রয়োজনটা হিসেব করে দেখে নিল। সে কলকাতায় যেতে চাইছে এটা বিবেচনার বিষয় নয়, রুগিটুগি আসতে পারে কি না সেটাই সুরেশ্বরের বিবেচনার বিষয়।
হৈমন্তী এখানে চাকরি করতে আসেনি, তার পরিশ্রমের মূল্য সে নেয় না। স্বেচ্ছায় সে এসেছে, যা করছে তা নিঃস্বার্থে, নিতান্ত দয়াপরবশে। তার ইচ্ছেতেই সে যেতে পারে, অন্য কারও ইচ্ছার ওপর তার আসা-যাওয়া নির্ভর করে না। রোগীরা আসবে কি আসবেনা তার ওপর হৈমন্তীর কলকাতা যাওয়া স্থির হবে! আশ্চর্য!
মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও হৈমন্তী মুখে কিছু বলল না।
সুরেশ্বর বলল, যাবার আগে তোমার এখানের রুগিদের ছেড়ে দিয়ে যেতে পারবে না?
আবার সেই তোমার রুগি! সুরেশ্বরের এই তোমার হাসপাতাল, তোমার রুগি কথাগুলো ভাল লাগে না হৈমন্তীর। এরা বাস্তবিকই তার কিছু নয়। সুরেশ্বর যেন ইচ্ছে করে বার বার তাকে হাসপাতাল, রোগী, আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চায়। এখানে আমার কিছু নেই, ওরা কেউ আমার নয়–হৈমন্তীর এই সরল মনোভাবটা কি সুরেশ্বর বোঝে না; অথবা বোঝে বলেই ধীরে ধীরে বুদ্ধিমানের মতন হৈমন্তীকে এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। হয়তো সে ভাবছে, হৈমন্তীকে এই ভাবে দুর্বল করা যায়, মোহের মধ্যে জড়িয়ে ফেলা যায়। সংসারে বহু মানুষ এইভাবে মজে, এই ফাঁদে পা দেয়।
হৈমন্তী হঠাৎ এক ধরনের জেদ অনুভব করল। সুরেশ্বর তাকে যেখানে ঠেলে দিতে চাইছে সেখানে সে যাবে না, বাধা দেবে। বলল, কারা আছে আমার মনে নেই। তার সবই মনে ছিল। যারা আছে তাদের ছেড়ে দিতেও কোনও বাধা নেই। অনেক সময় এরা অনেকটা দূর থেকে খুব কষ্ট করে আসে। দু-চার দিন পরে আবার কাটাকুটি দেখাতে আসা সম্ভব নয় বলেই কয়েকদিন রেখে দেওয়া হয়, নয়তো রাখার অর্থ নেই।
সুরেশ্বর বেশ অবাক হয়ে হৈমন্তীকে দেখল। বলল, যাদের রাখো তাদের কথা তোমার মনে থাকে না!
তিরস্কার নয়, ভর্ৎসনা নয়, তবু বেশ বোঝা গেল সুরেশ্বর হৈমন্তীর দায়িত্বহীনতার জন্যে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।
হৈমন্তী যতটা জেদ প্রকাশ করতে চাইছিল, পারল না; বরং সামান্য অস্বস্তি অনুভব করল।
সুরেশ্বর বলল, কবে ফিরবে?
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে, ফিরব না; কেন ফিরব? এখানে কী আছে?
হৈমন্তী নীরব। সুরেশ্বর নিজেই বলল, যাবার আগে রুগিদের যাদের পার ছেড়ে দিয়ে যেও। নতুন আর নিও না এ কদিন। ফিরে এসে…
হৈমন্তী বলল, আমি কদিন পরে ফিরব।
দেরি করবে?
না, তবে মা যদি দেরি করায়
এখানে খুব অসুবিধেয় পড়তে হবে। …আগে যিনি আসতেন তাঁকে তো এখন আর পাব না। রুগি এসে ফিরে যাবে।
রোগী এসে ফিরে গেলেই সুরেশ্বরের দুঃখ, আর কেউ ফিরে গেলে তার গায়ে লাগে না।
বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা বোধ করে হৈমন্তী বলল, তা হলে যাব না।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর গলার স্বর শুনে তার মুখভাব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল। হেসে বলল, তুমি রাগ করছ হেম!
হৈমন্তী কথা বলল না, ইচ্ছে হল না।
সামান্য সময় সুরেশ্বরও কথা বলল না, তারপর আস্তে করে বলল, আমি দেখছি এখানে তোমার তেমন ভাল লাগছে না। তুমি এখনও মন বসাতে পারলে না। ভেবেছিলাম, আস্তে আস্তে বসে যাবে।
যাবে হয়তো–, হৈমন্তী আচমকা বলে ফেলল, বলার মধ্যে দুঃখ ছিল, শ্লেষও ছিল।
সুরেশ্বর প্রথমে হৈমন্তী পরে জানলার দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকল। হৈমন্তী ঘরের অন্ধকার দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। সুরেশ্বরের এই ঘর ছোট, আসবাবপত্র সামান্য কিছু তার লেখাপড়া কাজকর্ম করার ঘর এটা, বইপত্র, কাগজ, দু-একটা দরকারি জিনিসে ভরা। টেবিলের ওপর কাচের প্লেটে শিউলিফুল, বাতাসে গন্ধ এল হালকা।
সুরেশ্বর বলল, হেম, তুমি কেমন হয়ে গেছ।
এই প্রথম, এখানে আসার পর সুরেশ্বর সরাসরি হৈমন্তীকে এমন কিছু বলল যা তাদের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরের দিকে পলকের জন্য তাকাল, তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল, বদলে গিয়েছি?
বোধহয়।
তুমিও।
গিয়েছি। আমার বদলের কথা তুমি জানতে না?
না।
না?
কী করে জানব!
আমি তো তোমায় অনেক আগেই জানিয়েছিলাম।
আমি বুঝিনি। …তোমার সব কথা বুঝব এমন বিদ্যেবুদ্ধি আমার নেই।
সুরেশ্বর অনেকক্ষণ যেন হৈমন্তীর দিকে মুখ ফিরিয়ে একদৃষ্টে কিছু দেখল। তারপর মৃদু গলায় বলল, আমি হয়তো তোমায় বোঝাতে পারিনি। থামল একটু, তারপর আবার বলল, আমি তোমায় এখানে দুঃখ দিতে আনিনি, হেম।
তোমার সুখ দুঃখ বোধ আলাদা।
কারও দুঃখে আমার সুখ নেই।
কথাটা হৈমন্তী শুনল, অর্থটাও বুঝতে পারল। সুরেশ্বরের সুখ-বোধ সে বোঝ না। প্রসঙ্গটা তর্ক করার মতন নয়, হৈমন্তীর তেমন কোনও ইচ্ছেও হল না।
সুরেশ্বর অনেকক্ষণ আর কথা বলল না। নীরব। হৈমন্তীও স্থির নিশ্চল হয়ে বসে। বাইরে কোথাও একটা পোকা ডাকছিল-চিপ চিপ। ঘরের অন্ধকার কোণে একটা জোনাকি এসেছে, জ্বলছে, নিবছে। দুজনের নীরবতার মধ্যে কেমন এক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়ে ক্রমশ তা এক দুস্তর ব্যবধানের মতন হয়ে উঠেছিল।
শেষে সুরেশ্বরই কথা বলল। এখানে তোমার ভাল লাগছে না।
না।
কলকাতায় ফিরে যেতে চাও?
ফিরে যাবার কথা বলিনি।
এখানে ভাল না লাগলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে?
হৈমন্তী এবার মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখল। টেবিল বাতির ম্লান আলোয় যে-মুখটি হৈমন্তীর দৃষ্টিগোচর হল তার প্রতি সে আজ আর মমতা অনুভব করল না। ওই নিস্পৃহ মুখকে তার অত্যন্ত স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর মনে হল।
ফিরে যাবার কথা এখনও ভাবিনি—
হৈমন্তী বলল, অগোছালো ভাবে।
কিন্তু তোমার যদি ভাল না লাগে—
ভাল লাগা না লাগার প্রশ্নটা অবান্তর। হৈমন্তী সংক্ষেপে বলল, রোজই তো রুগি দেখছি।
দেখছ, তবে মন পাচ্ছ না হয়তো।
আমার সাধ্যমতো যত্ন করে আমি রুগি দেখি।
ভালবেসে দেখ না?
ডাক্তারদের কাছে যত্নটা বড়, ভালবাসা নয়।
তুমি কর্তব্যের কথা বলছ।
তার বেশি আমার প্রয়োজন নেই। …আমার কাজ আমি বুঝি।
সুরেশ্বর আর কথা বলল না। বলা নিরর্থক।
দুজনেই আবার নীরব হয়ে বসে থাকল। অন্ধকার দেওয়ালের কোণ থেকে জোনাকিটা হৈমন্তীর পায়ের দিকে উড়ে এসেছিল, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
বসে থেকে থেকে হৈমন্তী উঠল। বলল, হাত কেমন আছে?
ভাল।
কাল দেখব। …যাই। হৈমন্তী চলে যাচ্ছিল।
সুরেশ্বর বলল, মাসিমাকে চিঠি লিখে দিয়ো৷ কবে যাচ্ছ জানিয়ো
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। চলে গেল।
.
হৈমন্তী চলে গেলে সুরেশ্বর বসে থাকল, একই ভাবে, শান্ত স্থির হয়ে। কিছু সময় এইভাবে কাটল; ভরতু ঘরে এসেছিল, তার পায়ের শব্দ শুনল সুরেশ্বর; কাজ সেরে ভরতু চলে গেল। সর্দির জন্যে চোখ এবং কপাল সামান্য ভারী লাগছিল সুরেশ্বরের।
মন খানিকটা বিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আস্তে আস্তে তা শান্ত ও সংযত করে ফেলেছে সুরেশ্বর, এখন অনেকটা শান্ত ভাবেই ভাবার চেষ্টা করছিল, হৈমন্তীকে এখানে আনা তার উচিত হয়েছে কি না!
হেম এখানে সুখী নয়, সন্তুষ্ট নয়। আসার পর পর প্রথম দিকে ওর চোখে মুখে কিছু বিস্ময় ছিল, কলকাতা শহর থেকে হঠাৎ এই নির্জনে এসে পড়ার বিস্ময় হয়তো, হয়তো এই আশ্রমের পরিবেশ, এখানকার জীবনযাপন তার কাছে অপরিচিত ও অনভ্যস্ত বলে সাধারণভাবে সে অবাক বোধ করত। কয়েক দিনের মধ্যে সে বিস্ময় কেটে গেল। তারপর থেকে হৈমন্তী আর প্রসন্ন নয়। এখন তার কথাবার্তা থেকে বেশ বোঝা যায়, হেম অসন্তুষ্ট, ক্ষুণ্ণ, মনোভারে পীড়িত। এখানে সে নিঃসঙ্গ ও একাকী।
এরকম হতে পারে সুরেশ্বর পূর্বে যে ভাবেনি তা নয়; তবে সে এতটা ভাবেনি। সে আশা করেছিল, হৈমন্তীর পক্ষে ক্রমশ এটা মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
আজ বেশ কয়েক বছর হৈমন্তীর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। চিঠিপত্রেই বেশি, কদাচিত কলকাতায় গেলে দেখাসাক্ষাত ঘটত। হেমদের বাড়িতেই সে উঠত অবশ্য, কিন্তু সেই সাময়িক সাক্ষাতের মধ্যে সুরেশ্বর স্পষ্ট করে কিছু বোঝেনি। বোঝেনি যে, হেমের স্বভাবও বদলে যাচ্ছে। ডাক্তারি পড়াশোনা নিয়ে হেম তখন ব্যস্ত, বয়সের একটা পরিবর্তনও সাধারণত থাকে। হেমের বয়সোচিত পরিবর্তন ঘটেছে এটা বোঝা যেত। বোঝা যেত, হেম আগের তুলনায় অনেক গম্ভীর, আত্মমগ্ন স্বল্পবাক হয়ে উঠেছ। সুরেশ্বর অন্য পরিবর্তন দেখতে পায়নি, বুঝতে পারেনি। হেম কখনও স্পষ্ট করে চিঠিপত্রেও বোঝায়নি।
এখানে আসার পর থেকে হেমকে সুরেশ্বর যেন অল্পে অল্পে নতুন করে চিনছে। যে-হেম সুরেশ্বরের খুব বেশি চেনা ছিল, সেই হেম আর আজকের হেমে অনেক তফাত। অল্প বয়সের বা তরুণী হেমকেই সুরেশ্বর নিবিড় করে চিনত। সেই আঠারো উনিশ কি কুড়ি বছর বয়সের হেমের সঙ্গে আজকের পরিণত হেমের পার্থক্য অনেক।
সুরেশ্বর এখনও সেই হেমকে স্পষ্ট করে দেখতে পায় যেন। তাকে বুঝি অনুভব করা যায়। কুঁড়ি ফেটে ফুল ফোঁটার মতন হেম তখন ফুটে উঠছে, জীবনের চতুর্দিকে চঞ্চল বাতাস, তার সবটুকু যেন দুলত, সে সতত অধীর ছিল, উজ্জ্বল, নির্মল, বিভোর ছিল। সুরেশ্বরের তখন মনে হত তার চোখের মণিতে হেমের মুখ স্থির হয়ে আছে। হেমের কথা ভেবে দিনের কতটা সময় যে কাটত তাও সুরেশ্বর হিসেব করে দেখত না। হঠাৎ ওই বয়সে হেমকে তার ভাগ্য এক গভীর দুঃখ ও নৈরাশ্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। আজ বোঝা যায় না কিন্তু সেদিন সুরেশ্বর বুঝেছিল কী দুঃসহ সে যন্ত্রণা হেমের, মস্ত এক অন্ধকার কুয়োর মধ্যে কেউ যেন তাকে ফেলে দিয়েছে। সুরেশ্বরও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, বিষাদে দুশ্চিন্তায় দুঃখে তার অবস্থা হয়েছিল উদভ্রান্তের মতন। কিন্তু সুরেশ্বর এই উৎক্ষিপ্ত ভাবটা সামলে নিয়েছিল। দুঃখের সঙ্গে তার পরিচয় আগেই ঘটেছিল বলে হয়তো বিহ্বলতা কাটাতে তার সময় লাগেনি। হেমকে সুস্থ করার জন্যে সে ব্যাকুল।
এই সময় সুরেশ্বর নিঃসন্দেহে জেনেছিল, হেমকে সে ভালবাসে। জেনেছিল, হেমকে না বাঁচাতে পারলে তার চারপাশে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা সহ্যাতীত। স্বপ্ন দেখতো: মস্ত এক শূন্য মাঠে আটচালা ঘরে লোহার বিছানায় হেম একাকী শুয়ে আছে, তার চারপাশে ন ভন মাছি উড়ছে, মাটিতে মাছিতে হেমকে আর দেখা যায় না, বিছানার তলায় কলাইয়ের নোংরা গামলায় সুরেশ্বরের নাম লেখা ছোট ঘোট রুমাল, দোমড়ানো মোচড়ানো, যেন হেম হাতের মুঠো খুলে সেগুলো একে একে ফেলে দিয়েছে। সুরেশ্বর হেমের বিছানার সামনে গিয়ে দুহাতে মাছি তাড়াবার চেষ্টা করতে করতে অসহায় হয়ে কেঁদে ফেলত।
সুরেশ্বর এই একই স্বপ্ন কয়েক বারই দেখেছিল, কখনও সে সবটা দেখত, কখনও টুকরো করে দেখত। একবার সে স্বপ্নটার কথা পুরোপুরি না বললেও হেমকে বলেছিল সে আজেবাজে বিশ্রী স্বপ্ন দেখে।
কী স্বপ্ন? হেম জিজ্ঞেস করেছিল, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।
বাজে স্বপ্ন, বিশ্রী!
আমি মরে গিয়েছি?
যাঃ, তুমি মরে যাবে কি?
তবে।
আমি মরে গিয়েছি।
মিথ্যে কথা।
বিশ্বাস হচ্ছে না…! সত্যি।
কথাটা অবিশ্বাস্য বলে সেদিন সুরেশ্বরের মনে হত না। হেম মরে গেলে সুরেশ্বর মৃত হয়েই থাকত। হেমকে বাঁচার আশা দেবার সময় সুরেশ্বর নিজেকেও যেন আশা দিত। হেমকে যখন ভরসা দিত, সাহস দিত–তখন নিজেও ভরসা ও সাহস পেত।
হেম ক্রমে ক্রমে রোগমুক্ত হয়ে উঠতে লাগল। এই সময় সুরেশ্বর দেখল, ওই নরম বয়সে হঠাৎ গভীর দুঃখের ও নৈরাশ্যের মধ্যে পড়ে হেম এমন কিছুর স্পর্শ পেয়েছে যা, তার বয়সে সচরাচর পাবার কথা নয়। সংসারের যেটা বিষাদের দিক–যেখানে অকারণে শোক, নির্বিচারে আঘাত পেতে হয়– হেম সেই বিষাদের জগৎ দেখেছিল। সুরেশ্বর নিজের জীবনে এই জগৎ আরও আগে দেখেছে, প্রায় বাল্যকাল থেকেই দেখে আসছিল। তার মা বাবা, মা বাবার সম্পর্ক, মার ভয়, মার মস্তিষ্ক বিকৃতি, বাবার চরিত্রহীনতা, নিষ্ঠুরতা, মার আত্মহত্যা–এসমস্তই তার সেই বিষাদের জগতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমন কী, বাবার উপপত্নী ও সেই উপপত্নীর গর্ভজাত পুত্র যখন সম্পত্তির দাবি তুলে মামলার ভয় দেখিয়েছিল সুরেশ্বর তখনও এই বিষণ্ণ জগতেরই আরও একটি পরিচয় পেয়েছিল। সম্পত্তি অথবা অর্থের জন্যে সে কাতরতা অনুভব করেনি, করেছিল গ্লানি অনুভব করে, শ্রদ্ধাহীনতায়। বাবা স্ত্রীকে অশ্রদ্ধা করেছে সন্তানকেও শ্রদ্ধাহীন করে তুলেছে। অপর স্ত্রী এবং সন্তানকেও বাবা মর্যাদা দেয়নি, মালিন্য দিয়েছে শুধু। একথা কাউকে সে বলেনি যে, বাবার দ্বিতীয় পুত্রটির জন্যে সে সহানুভূতি ও বেদনা বোধ করেছিল।
কেমন করে যেন সুরেশ্বর অনুভব করল তার ব্যক্তিগত বিষাদের জগৎ আর হেমের বিষাদের জগতের মধ্যে কোথাও যেন এক ধরনের সমগোত্রীয় ভাব আছে। তারা পরস্পরকে সহানুভূতি দেখাতে পারে। সুরেশ্বর নিজের জীবনে সহিষ্ণুতা ও সহানুভূতিকে প্রসারিত করতে চাইছিল; তার মনে হয়েছিল হেমও মমতা ও ভালবাসায় পূর্ণ হতে চায়।
হেমদের হাসপাতালে হেমের চেয়ে কিছু ছোট প্রায় সমবয়সী বলা যায়–একটি মেয়ের সঙ্গে হেমের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মেয়েটি নেকড়ার পুতুল তৈরি করত, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে প্রায় দীনের মতন সকলের কাছে ঘেঁড়া টুকরো টাকরা নেকড়া চাইত, উঁচ সুতো চাইত, রংটং আনতে বলত। হাসপাতালের প্রতিটি বিছানায় তার হাতের বিচিত্র নেকড়ার পুতুল দেখা যেত। ওর আত্মীয়স্বজন ছিল না বুঝি, কেউ আসত না। একদিন মাঝরাতে মেয়েটি মারা গেল, সকালবেলায় দেখে গেল তার বিছানায় মস্ত একটা নেকড়ার পুতুল, ধড় আছে, মাথা আছে হাত পা নেই।
এই মেয়েটির মৃত্যুতে হেম কেঁদে আকুল, দুঃখে মুহ্যমান। সুরেশ্বর সেবার যখন হেমের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে গেল, হেম শুধু তার বন্ধুর কথা বলেছে আর কেঁদেছে।
হেম বলেছিল: ও বলত সেরে উঠলে ও পরিষ্কার নেকড়া দিয়ে পুতুল করবে।
কেন, পরিষ্কার নেকড়া কেন?
এখানে সব রোগ-টোগের ছোঁয়া, এসব পুতুল তো বাইরে যেতে দেয় না।
ও!
পরিষ্কার নেকড়া দিয়ে পুতুল করলে সবাই নেবে।
পুতুল বেচবে?
ওর কেউ ছিল না; একমাত্র দিদি; খুব গরিব। …পুতুলের দোকান করলে বিক্রি হত।
ও!
হেম চুপ করে থেকে তারপর হঠাৎ বলল, যাদের কেউ কোথাও নেই তাদের কী কষ্ট! ভগবান যদি ওর জন্যে কাউকে রাখত…
সুরেশ্বর মাথা নিচু করে ফেলেছিল, নয়তো কেঁদে ফেলত সেদিন।
হেম হাসপাতালে থাকার সময় মমতা ও ভালবাসা জেনেছিল।
তারপর হেম সুস্থ হয়ে ফিরে এল। সুরেশ্বর হঠাৎ কেমন এক মুক্তি অনুভব করল, আনন্দ। এ আনন্দ অবর্ণনীয়। যেন সে নিজেই পুনর্জন্ম লাভ করেছে। হেমকে নিয়ে ঘাটশিলায়, সঙ্গে মাসিমা। সারাটা সকাল, দুপুর, সন্ধে, রাত আট নটা পর্যন্ত তার পাশে হেম থাকত। বেড়াতে বেরিয়ে কোনও কোনওদিন হেম গুনগুন করে সুখের গান গেয়ে উঠত। কোনও কোনওদিন বা বলত, আমার এখন সব ভাল লাগে, ধুলো বালি রাস্তা, সকাল বিকেল…
আমাকে কেমন লাগে?
হেম আড়চোখে চোখে দেখত, তারপর বলত, লাগে না।
লাগে না! সে কী! ভালমন্দ একটা কিছু না লাগলে হয়!
কী জানি! নিজেকে আবার কেমন লাগবে মানুষের– বলে মুখ টিপে হাসত।
সুরেশ্বর অনুভব করত হেম সুরেশ্বরকে নিজের অঙ্গীভূত করে নিয়েছে, নিজের অন্তরে মিশিয়ে নিয়েছে, সে আর আলাদা কিছু নয়, হেমের মধ্যেই সে আছে।
হেমের নরম গালে গাল রেখে সুরেশ্বর একদিন বলেছিল, হেম, অসুখের পর তুমি আরও সুন্দর হয়ে গেছ। …
তারপর কলকাতায় ফিরে এসে সুরেশ্বরের হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল। যা তার কাছে অবধারিত ও সত্য ছিল, ভালবাসা ছিল, সুন্দর ছিল–অকস্মাৎ যেন সেখানে দ্বিধা এল; মনে হল এই ভালবাসা বড় কষ্টদায়ক। এ-রকম কেন হল? সুরেশ্বর যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, কেন?
আচমকা সে গাড়ির হর্ন শুনতে পেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝল অবনী এসেছে। অবনী এর মধ্যে আরও কয়েকবার এসেছে, কিন্তু এতটা রাত করে কখনও নয়। আজ এতটা রাত করে অবনী এল কেন? সুরেশ্বর কিছু বুঝতে বা অনুমান করতে পারল না।
.
১০.
কলকাতার গাড়ি এইমাত্র ছেড়ে গেল। হৈমন্তীকে উঠিয়ে দিতে এসেছিল সুরেশ্বর, ট্রেন ছেড়ে গেলে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ফিরতে লাগল। পাশে বিজলীবাবু।
বিজলীবাবুর সঙ্গে বাস-স্ট্যান্ডে দেখা হয়েছিল, গাড়ির আর সময় নেই তখন, সুরেশ্বরদের মালপত্র সমেত স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে বিজলীবাবু বুকিং অফিসে ঢুকে টিকিট কেটে একেবারে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গেই প্ল্যাটফর্মে হাজির হলেন।
ফেরার পথে রেলের দু-একজন বাবু-টাবু–প্ল্যাটফর্মে যারা ছিল তাদের সঙ্গে সুরেশ্বর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলল; সকলেই তার চেনা-জানা, দেখা হলে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলতেই হয়, খোঁজখবরও করতে হয় এর ওর। সুরেশ্বর সম্পর্কে এদের সকলেরই কেমন একটা শ্রদ্ধার ভাব আছে, কৌতূহলও আছে হয়তো। বিশেষত, আজ হৈমন্তীকে তুলে দিতে এসে সুরেশ্বর সেটা অনুভব করতে পারল।
ওভারব্রিজ দিয়ে না উঠে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত দিয়ে নামল, লাইন পেরিয়ে ঢালু মতন জায়গাটা দিয়ে রাস্তায় উঠল সুরেশ্বর। গোড়ালির ব্যথাটা এখনও পুরোপুরি সারেনি। আসার সময় ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠে ব্যথাটা আবার বোঝা যাচ্ছিল; ফেরার সময় তাই আর সিঁড়ি ভাঙল না।
রাস্তায় উঠে বিজলীবাবু বললেন, দুর্গাবাড়ির দিকটা একবার ঘুরে যাবেন নাকি?
দুর্গাবাড়ি খানিকটা দূর, জোরে জোরে হাঁটলেও মিনিট কুড়ির রাস্তা। যেতে আসতে খানিকটা সময় যাবে, এতটা হাঁটাহাঁটিতে আবার গোড়ালি ব্যথা করবে কিনা তা-ও সুরেশ্বর বুঝতে পারল না। পোস্ট অফিসেও একবার যাবার দরকার। সুরেশ্বর বলল, আমায় যে একবার পোস্ট অফিসে যেতে হবে। টাকা তুলব।
ফেরার পথে যাবেন–, বিজলীবাবু বললেন, এখনও নটা বাজেনি। দশটার মধ্যে গেলেই চলে। বিজলীবাবু সময়ের ব্যাপারটা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না।
সুরেশ্বর বলল, এতটা হাঁটব কী না ভাবছি।
বেশ ব্যথা?
না, খুব একটা নয়। ব্যথা তো ছিলই না প্রায়, সিঁড়ি উঠতে গিয়ে হয়তো ঠিক মতন পা পড়েনি কোথাও, খচখচ করছে।
হাড়-টাড় ভেঙেছেন নাকি
? না, সুরেশ্বর হাসল, হাড় ভাঙলে কি এত অল্পে রেহাই দিত। …হেম তো বলল, স্প্রেইন।
বিজলীবাবু সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকালেন, উনি কি এসবও বোঝেন?
সুরেশ্বর হাসল, তা অল্পস্বল্প বোঝে বইকি! ডাক্তারিটা তো পাশ করতে হয়েছে। বিজলীবাবু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না, পরে বললেন, তবে থাক, দুর্গাবাড়ি আর না গেলেন, পোস্ট অফিসেই যাওয়া যাক। ওখান থেকে যদি বৈজুর রিকশাটা পাওয়া যায়, তবে না-হয় দুর্গাবাড়ি যাওয়া যাবে।
বেলা এমন কিছু নয়, তবু শরতের রোদ এত ঝকঝকে যে চোখে লাগছিল, তাত ফুটে উঠেছে। গাছের ছায়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিজলীবাবু সিগারেট ধরালেন।
সুরেশ্বর শুধোল, এবার লোকজন কেমন আসছে, বিজলীবাবু।
আজ বিকেল থেকে বোঝা যাবে। কাল কিছু এসেছে। তা মন্দ না।
উমেশবাবু এসেছেন?
না; কাল আসবেন বোধ হয়।
আপনাদের পুজো কেমন হচ্ছে?
নতুন আর কী হবে–যেমন হয় বরাবর বলে বিজলীবাবু একটু থেমে সুরেশ্বরের মুখের দিকে চেয়ে কিছু দেখলেন, বললেন, আপনি তো জানেন মশাই, আমি লোকটা মদ্যটদ্য খাই, উপসর্গ এক-আধটু আছে, তবে ড্যাং ড্যাং করে বাজনা বাজিয়ে, কলকাতার বড়লোক বাবুদের বাড়িতে এক থালা করে প্রসাদ, দুকাঁসি করে সরু চালের খিচুড়ি ভোগ পাঠিয়ে অর্থ অপব্যয় করতে রাজি না। বিজলীবাবু ঠোঁটে চেপে সিগারেটে টান দিলেন বার কয়েক, আবার বললেন, নবমীর দিন ভিখিরি-টিখিরি খাওয়ানো হয় এখানে নিজেই দেখেছেন–সেটা হোক, বরাবর হয়ে আসছে, আমি তাতে কথা তুলছি না। কিন্তু বড়লোক বাবুদের বাড়ি বাড়ি একরাশ করে ফল-মিষ্টি আর ভোগ পাঠানোর দরকারটা কী? …এই নিয়ে সেদিন ঝগড়া, হরিহরের সঙ্গে। বলে, কলকাতার ওই বড়লোক মশাইদের কাছ থেকে পঁচিশ, পঞ্চাশ, একশো করে চাঁদা পাই, খাতির না করলে হবে কেন? .. চুলোয় যাক তোর খাতির…
বিজলীবাবু যে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট এবং উত্তেজিত সুরেশ্বর বুঝতে পারল। বলল, ওঁরা অবশ্য মোটা চাঁদা দেন। না এলেও বছরের চাঁদা ঠিক পাঠিয়ে দেন বলে শুনেছি।
তাতে কার কী, টাকা দাও বলে ঠাকুরের ভোগ তুমি শালা তোমার কুকুরকেও খাওয়াবে। …বিশ্বাস করুন মহারাজ, স্বচক্ষে দেখেছি। কলকাতার এক ইংলিশবাবুচারবেলা ডিম, মুর্গির ঠ্যাঙ, মাছ কলা ফল খাচ্ছে, ভোগ গেল ঠাকুরের, মেয়েরা একটু আধটু ঠোঁটে ছোঁয়াল কি ছোঁয়াল না, বাড়ির কুকুরকে খাইয়ে দিল। … রাগের চোটে বিজলীবাবু সামনাসামনি মহারাজ বলে সম্বোধন করে ফেললেন। এটা তিনি সাধারণত করেন না। সুরেশ্বর অবশ্য জানে বিজলীবাবু তাকে মহারাজ-টহারাজ বলেন।
কী বলবে সুরেশ্বর, চুপচাপ থাকল।
বিজলীবাবু শার্টের পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করলেন। ঠাকুরফাকুর কাঁধে করে নাচানাচি আমার নেই। হিন্দুর ঘরে জন্মেছি দুর্গা কালী লক্ষ্মী দেখলে বড় জোর একটা পেন্নাম ঠুকি, ব্যাস। কথা হল, আজ সতেরো আঠারো বছর ধরে এখানে বাঙালিরা দুর্গাপুজো করছে সেটা তো আর আমরা তুলে দেব না। আমি না হয় অষ্টমীর দিন পাঁঠার মাংস চিবিয়ে বোতল-ঠাকুর সামনে বসিয়ে অষ্টমী করলাম, কিন্তু আমার বউ দুটো তো অষ্টমীর উপোস করবে, অঞ্জলি দেবে, সন্ধিপুজো দেখবে…। বলুন আপনি, আমাদের বাড়ির বউ-টউ, ছেলেমেয়ে, বুড়ো বাপ-মা-এদের কাছে তো পুজোর একটা মূল্য আছে। ভক্তি-টক্তি তারাই করে; তাদেরই আনন্দ। তা ছাড়া আমি না হয় ঠাকুরফাকুর না মানলুম, অন্য লোক তো মানে। …আমার তাই সাফ কথা, পুজো আলবত করব, তবে বড়লোককে তোয়াজ করার জন্যে পুজো নয়।
সুরেশ্বর বলল, হরিবাবুদের সঙ্গে আপনার ঝগড়াঝাঁটি হল।
হল। ওই হরি আর বেঁটে কার্তিক–ওই দুটোই হচ্ছে হারামজাদা। দল গড়েছে, দল গড়ে কলকাতার কেষ্টবিন্ধুদের ভজিয়ে এখানে একটা আখড়া করার মতলব ফেঁদেছে, বোষ্টমদের আখড়া। খোল করতাল বাজাবে, বাতাসা খাবে। আমি বলেছি পুজো কমিটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওসব করো। …আমার নাম বিজলীবরণ চক্রবর্তী, পঁয়ত্রিশ বচ্ছর এখানে আছি, তোমরা ভেবো না, দুদিনের যোগী এসে আমার ওপর টেক্কা মারবে।
ঝগড়াঝাটি করতে গেলেন কেন? সুরেশ্বর একটু হেসেই যেন বলল।
কেন করব না ঝগড়া! ওরা পুজোর টাকা চুরি করে, পাবলিক মানি নিয়ে বিজনেস করে… হরি-বেটা বাজারে একটা কাপড়ের দোকান দিয়েছে। কোথ থেকে দেয়?
সুরেশ্বর এই অপ্রিয় প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চাইল। বলল, যেতে দিন। এসব কথা থাক।
বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে আবার টানতে শুরু করলেন। ডান দিকে রেললাইন, একটা ট্রলি চলে যাচ্ছে, সাদা ছাতার তলায় হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরে অচিন্ত্যবাবু বসে আছেন, কুলি দুটো পায়ের কাছে, মোটরের ফটফট শব্দ হচ্ছে। দেখতে দেখতে ট্রলিটা কেবিন ছাড়িয়ে চলে গেল।
বাঁ দিকের পথ ধরল সুরেশ্বর, পোস্ট অফিস যেতে হলে এই পথটাই সুবিধের।
সামান্য এগিয়ে বিজলীবাবু বললেন, একটা কথা তা হলে স্পষ্ট করে বলেই ফেলি। মতলব ছিল, এবারে পুজো থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আপনার হাতে তুলে দেব।
সুরেশ্বর যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বিজলীবাবুর দিকে তাকাল। আমার হাতে?
বিজলীবাবু এমন করে চশমার আড়ালে চোখ উজ্জ্বল করে হাসলেন, মনে হবে যেন এই বিষয়ে তাঁর উদ্দেশ্যটি পূর্ব পরিকল্পিত। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, সৎ কর্মে দু পয়সা গেলে গায়ে লাগে না। …তা ছাড়া এরা দুএকশো টাকা দেবে নাই বা কেন। এখান থেকে চোখ দেখাতে তো কম লোক যায় না।
সুরেশ্বর কেমন অস্বস্তি বোধ করল, প্রথম প্রথম এখানের সকলেই যার যা সাধ্য আমায় সাহায্য করেছে, বিজলীবাবু।
জানি, বিজলীবাবু মাথাটা কাত করে বললেন, সবই জানি। দু-একটা টাকা সবাই দিয়েছে, সে আপনার মন রাখতে মান বাঁচাতে। …যা দিয়েছে তার পাঁচ গুণ আদায়ও করে নিয়েছে।
তা হলেও!
আপনার টাকার আর দরকার নেই, মহারাজ?
সুরেশ্বর বিজলীবাবুর মুখের দিকে তাকাল, তাকিয়ে চুপ করে থাকল। শেষে বলল, আছে। কত কী করার আছে অর্থাভাবে পারছি না।
ঠিক এই মুহূর্তে সুরেশ্বর যেসব অভাব বোধ করছে বা করতে পারলে লোকের সুবিধে হয় তার কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগল। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন চশমা দেবার একটা ব্যবস্থা করা। সেই শহর ছাড়া এই অঞ্চলের কোথাও চশমার দোকান নেই, শহরেও মাত্র একটি দোকান, অত্যধিক দাম নেয়, গরিব মানুষের পক্ষে শহরে আসা যাওয়া করা, চশমা কেনার টাকা জোটানো খুবই কষ্টকর। যদি সুরেশ্বর চশমাও দিতে পারত সুবিধে হত। অল্প খরচে, তেমন ক্ষেত্রে বিনা খরচেই অনেকে চশমা নিতে পারত। …অন্ধদের থাকার ঘরবাড়িও বাড়ানো দরকার, আরও কিছু অন্ধজনকে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হয়। ওদের হাতে জিনিস দিলে আরও কত কাজ করতে পারে, অর্থাভাবে মালপত্র দেওয়া যায় না তেমন।
কথা বলতে বলতে পোস্ট অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেল সুরেশ্বর।
বিজলীবাবু বললেন, ময়দা বেশি মাখবেন না, শেষকালে লুচি বেলারও লোক পাবেন না, ভেজে উঠতেও পারবেন না। যা করবেন–এসব জায়গায় অল্প করেই করবেন।
সুরেশ্বর হাসল। একে একে সবই হবে। আপনারা পাঁচজন তো রয়েছেন।
বিজলীবাবু মাথা নাড়লেন, মজা করে করে বললেন, আপনার মতন বিজ্ঞ লোক কী করে এই কথাটা বললেন? পাঁচজনে একসঙ্গে বসে তাসপাশা খেলতে পারে, আফিং মদ গাঁজা পঞ্চরং চড়াতে পারে; কিন্তু পাঁচজনে কোনও সৎ কর্ম হয় না।
অসৎ কর্ম হয়…? সুরেশ্বর লঘু স্বরে, হাসিমুখে বলল।
তা তো হয়ই। ..বিদ্যেটা আপনার ঠিক জানা নেই কি না, জানা থাকলে বুঝতেন কথাটা যা বলেছি। খাঁটি কথা।
সুরেশ্বর কেমন পরিহাস করেই শুধোল, বিদ্যেটা আপনারই কি জানা আছে?
তা খানিকটা আছে, বিজলীবাবুও হাসিমুখে জবাব দিলেন; তারপর বললেন, দেখুন মহারাজ, আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট–বেশ ছোট, তবে বিদ্যে বুদ্ধিতে অনেক বড়, মানুষও বড়। কিন্তু এই জগতের হালচাল আমি যত জানি, আপনি জানেন না।
কী রকম হালচাল?
বিজলীবাবু সুরেশ্বরের হাসিহাসি মুখের দিকে তাকালেন। যেন ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই বলতে পারেন। অবশ্য কিছু বললেন না তেমন, শুধু বললেন, জগতে যখন রয়েছেন, এর হালচাল কিছুটা আপনিও বোঝেন, পরে আরও বুঝবেন।
পোস্ট অফিসের সামনে পৌঁছে গেল ওরা। সিঁড়িতে ডাক পিওন।
বিজলীবাবু দাঁড়ালেন, কিছু আছে নাকি, রামেশ্বর?
রামেশ্বর মাথা নেড়ে না বলে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়াল, হাতে কিছু চিঠি, বাকি থলিতে। হাতের চিঠি থেকে একটা খাম বার করে নিয়ে বলল, ইয়ে দেখিয়ে তো থোড়া।
বিজলীবাবু খামটা হাতে নিয়ে দেখলেন। জল পড়ে খামের ওপরে লেখা কাঁচা হাতের ঠিকানা ধুয়ে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, বোঝা যায় না। লক্ষ করে দেখে বিজলীবাবু বললেন, বিজলি অফিসের সাহেবের বলেই তো মনে হচ্ছে–মিত্তিরসাহেবের।
মিত্তির সাহাব! … হামারা ভি ওইসি মালুম হোথা থা। …সাহেব কো এক রসিদ ভি হ্যায়।
কীসের রসিদ?
মানিঅর্ডারকা।
বিজলীবাবু রামেশ্বর-পিয়নের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন। চিঠিটা তার হাতে ফেরতও দিলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, দেখি তো, হাতের লেখা যদি মেলে…।
রামেশ্বর কিছু বুঝল না, রসিদ বের করে এগিয়ে দিল। মনিঅর্ডার পৌঁছে তার রসিদটা ফিরে এসেছে। বিজলীবাবুনামসইটা দেখলেন। ললিতা মিত্র। কলকাতার স্ট্যাম্প তো বটেই। টাকার অঙ্কটাও দেখে নিলেন।
রসিদটা ফেরত দিয়ে বিজলীবাবু বললেন, না, আলাদা লেখা। ও চিঠি মিত্তির সাহেবেরই হবে। তবে সাহেবকে এখন অফিসে পাবে না, ভোরবেলায় কাজে বেরিয়ে গেছেন, বাড়িতে দিয়ে দিয়ো চিঠি।
রামেশ্বর চলে গেল। সুরেশ্বর পোস্ট অফিসের মধ্যে ঢুকে গেছে।
বিজলীবাবু ডাকঘরের বারান্দায় সামান্য সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। বেশ যেন চিন্তায় পড়েছেন। ললিতা মিত্র! ললিতা মিত্র কে? মিত্তিরসাহেবের মা নেই, বোন নেই; বউ আছে বলেও তো তিনি শোনেননি। বিয়ের কথায় মিত্তিরসাহেব বরাবর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে হেসে বলেছেন: চেষ্টা করেছিলাম; কপাল মন্দ! এ ধরনের কথা থেকে কিছু বোঝা যায় না, যাও বা যায়–তাতে মনে হয়, বিয়ে করব ভেবেছিলেন হয়তো, কিন্তু বিয়ে করেননি।
পাকানো সিগারেট, বারে বারে নিবে যায়; বিজলীবাবু আবার সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। খামের চিঠিটা যে মিত্তিরসাহেবের তাতে খুব বেশি সন্দেহ হচ্ছে না। অফিসের নামটা (ভুল নাম এবং বানান সত্ত্বেও) মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল। এই অফিসে এ এন মিত্র (মিত্র যদিও পড়া যায়নি; এ এন গিয়েছিল) আর কেউ নেই। কাঁচা হাতের ঠিকানা, একেবারে বাচ্চা ছেলেমেয়ের যেমন হয়। ললিতা মিত্রর নাম সই আর এই খামের ঠিকানা একই হাতের লেখা নয়। চিঠিটাই বা কে লিখল? মিত্তিরসাহেব তো কখনও বলেননি তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ আছে সংসারে। বন্ধুবান্ধবের কথা অবশ্য বলেছেন। ওই চিঠি কি তবে বন্ধুদের কারও বাড়ির কেউ লিখেছে? কিন্তু টাকাটা?
মিত্তিরসাহেব বেশ রহস্যময় পুরুষ। বিজলীবাবু আপন মনেই মাথা নাড়লেন, আচ্ছা, আজ রাত্রে দেখা যাবে।
সুরেশ্বর টাকা তোলার ফর্ম লিখে দিয়ে বসে বসে শর্মাজির সঙ্গে গল্প করছিল। বিজলীবাবু পাশে এসে দাঁড়ালেন।
.
পোস্ট অফিসের কাজ সেরে সুরেশ্বর গেল বাজারে। কাছেই বাজার। বাজারে ছেদিলালের দোকানে টাকা পয়সা মেটাল। তারপর বিজলীবাবুর সঙ্গে বাস অফিস। বাস অফিসে বিজলীবাবুর ঘরে বসে জল খেল, চা খেল। বাস ছাড়তে এখনও কিছু দেরি, মিনিট কুড়ি। দশটা বেজে গেছে।
বিজলীবাবু বললেন, পুজোর মধ্যে একদিন আসুন। কবে আসবেন?
সুরেশ্বর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল। ওপাশে রাস্তার ও-দিকটায়–গাছের ছায়ায় বাজার বসে গেছে, শাকসবজি, মাছ ডিম। এ সময় এখানে বাজার একটু বড় হয়েই বসে, পুজোর মুখে কলকাতা পাটনা থেকে তোকজন আসে, বাবুদের জন্যে গাঁ গ্রাম থেকে ব্যাপারিরা মাথায় সওদা নিয়ে ছুটে আসে ভোরবেলায়, দুপুর নাগাদ ফিরে যায়। আজকের বাজার তেমন বড় নয়, কাল থেকে আরও আসবে অনেকে, সকালের দিকটা বেশ ভিড় হবে। কিছু ছেলেমেয়ে, প্রবীণপ্রবীণাকে সুরেশ্বর দেখতে পেল, বাজার করছে ঘুরে ঘুরে। কারও কারও মাথায় ছাতা।
বিজলীবাবু পান চিবোতে চিবোতে বললেন, কবে আসছেন তা হলে?
সুরেশ্বর বিজলীবাবুর দিকে তাকাল, হাসল, নেমন্তন্ন করছেন?
গরিবের ঘরে দুমুঠো খাবেন এতে আর কথা কী!
আসব একদিন।
কবে?
সুরেশ্বর আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আসব।
অষ্টমীর দিন এলে-সকালে; বিকেলে বিজলীবরণ সন্ধিপুজোয় বসবে। বলে বিজলীবাবু আপন রসিকতায় জোরে জোরে হাসলেন।
সুরেশ্বর বলল, অভ্যেসটা এবার ছাড়ার চেষ্টা করুন না। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো।
বিজলীবাবু কৃত্রিম বিস্ময়ে সুরেশ্বরের মুখ দেখতে দেখতে বললেন, এটা আপনি কী বলছেন মহারাজ? কাকে ছাড়ব? … বিজলীবাবু এমনভাবে কাকে ছাড়ব বললেন যে সুরেশ্বর হেসে ফেলল।
বিজলীবাবু সামান্য পরেই বললেন, আমরা কি ছাড়ার লোক, মহারাজ! সে হলেন আপনারা ছাড়ার লোক। সবই ছাড়ছেন। সংসার ছাড়লেন, সুখ আহ্লাদ ছাড়লেন, ফুর্তি-টুর্তি তাও ছাড়লেন। আরও কত কী ছাড়ছেনছাড়বেন–কে বলতে পারে!
সুরেশ্বর বিজলীবাবুর চোখে এমন এক ধরনের হাসি দেখল যা কেমন ধূর্তের মতন। বিজলীবাবু যে ঠিক কী বলতে চাইলেন সুরেশ্বর বুঝল না।
আপনারা সব ছাড়েন, আমরা ধরি। ছাড়ার মজা কী জানেন, একবার ছাড়তে শুরু করলে ছাড়ার মজা ধরে যায়, নেশা ধরে যায়। আজ মদ ছাড়ব, কাল চাকরি ছাড়ব, পরশু বউ ছাড়ব… ছাড়তে ছাড়তে একেবারে বুদ্ধদেব হয়ে যাব। …ওই জন্যেই তো ওপথে যাইনি।
সুরেশ্বর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল, বলল, যাই, আর বোধহয় সময় নেই।
বিজলীবাবু তাঁর টেবিল থেকে কিছু কাগজপত্র উঠিয়ে ড্রয়ারে রাখলেন, বললেন, চলুন, আপনাকে তুলে দিয়ে আমি একবার দুর্গাবাড়ি যাব।
বাইরে এসে বিজলীবাবু তাঁর সাইকেল নিলেন, হ্যাঁন্ডেলে একটা শোলার হ্যাট ঝুলছে। বর্ষায় ছাতা ঝোলে, রোদে তিনি শোলার হ্যাট চাপিয়ে নেন মাথায়।
রাস্তায় নেমে বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেবের একটা বড় প্রমোশন হচ্ছে, শুনেছেন?
না।
মিত্তিরসাহেবের ওপরঅলা চলে যাচ্ছে পাটনা, সেই জায়গায় মিত্তিরসাহেবকে কাজ করতে হবে।
এ তো সুখবর।
আমাদের কাছে সুখবর, তবে যাঁর খবর তিনি তো খাদ্ধা হয়ে উঠেছেন।
কেন?
তা জানি না। মিত্তিরসাহেব এ জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি না। ওপরঅলার জায়গায় কাজ করতে হলে অন্য জায়গায় যেতে হবে।
সুরেশ্বর কোনও কথা বলল না। হাঁটতে লাগল, সামনেই বাস।
বিজলীবাবুই কথা বললেন। মিত্তিরসাহেব মানুষটি, বুঝলেন মহারাজ, অদ্ভুত! কী বলে যে, মিস্টিরিয়াস–তাই। জীবনে উন্নতি করার সুযোগ এলে মানুষ খাদ্ধা হয় এমন আর দেখেছেন?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল অন্যমনস্কভাবে।
বাসের কাছে এসে বিজলীবাবু ড্রাইভারকে কী যেন বললেন। তারপর সুরেশ্বরকে ফার্স্ট ক্লাসে উঠিয়ে দিলেন। আপনি রোদে লাঠটা থেকে হাঁটবেন না, বাস আপনাকে গুরুডিয়ায় পৌঁছে দেবে।
সুরেশ্বর আপত্তি করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার সেই আপত্তি গায়ে না মেখে বিজলীবাবু সাইকেলে উঠে চলে গেলেন। সাইকেলে ওঠার আগে শোলার হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে নিয়েছেন।
বাস ছাড়ল। সুরেশ্বরের পাশে জনা তিনেক শহরের প্যাসেঞ্জার। তার মধ্যে জানলার ধার ঘেঁষে বিবাহিতা একটি মেয়ে বসে আছে। অবাঙালি। স্বামী-স্ত্রীতে কথা বলছিল, তৃতীয় ব্যক্তিটি ওদেরই আত্মীয়, সেও কথা বলছে।
যেতে যেতে সুরেশ্বরের কেন যেন অবনীর কথাই মনে পড়ছিল। ভদ্রলোক যে কিছুটা অন্য ধরনের এই ধারণা সুরেশ্বরের পূর্বেই হয়েছিল। ইদানীং অবনীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং তার আচরণ দেখেও সুরেশ্বরের সে-ধারা ভাঙেনি,বরং তার মনে হচ্ছিল: অবনী ঠিক যতটা তিক্ততা ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে ততটা তিক্ত ও বিতৃষ্ণ মানুষ সে নয়। ওর অনেক আচরণ এখনও অপরিণতের মন, কথাবার্তায় অনেক সময় আবেগের তাপ থাকে। সেদিন অতটা রাতে সে নিতান্ত তুচ্ছ কারণে গুরুডিয়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিল। কারণটা যে তুচ্ছ সে নিজেও জানত, এবং তা গোপন করার চেষ্টাও তেমন করেনি। বড় একটা দুর্যোগ ঝড়বৃষ্টি গেল মাথার ওপর দিয়ে তাই নাকি খবর নিতে গিয়েছিল: খোঁজ নিতে এলাম কেমন আছেন? …আমি তো ভেবেছিলাম আপনাদের আশ্রমের চালাফালা উড়ে গেছে। কিছুই তো হয়নি দেখছি।
অবনী চতুর নয়, ঠিক যতটা বুদ্ধিমান হলে তার উদ্দেশ্য ধরা মুশকিল হয়ে পড়বে–ততটা বুদ্ধিমানও নয়। সুরেশ্বর অন্তত বেশ বুঝতে পারছে, অবনীর আকর্ষণের পাত্র হেম।
বাস থানা পেরিয়ে গেল। সুরেশ্বর অন্যমনস্ক।
চাকরিতে উন্নতি চায় না এমন মানুষ বড় চোখে পড়ে না-সুরেশ্বর ভাবছিল–অবনী সেই উন্নতি উপেক্ষা করতে চাইছে। কেন? এ জায়গা ছেড়ে সে যেতে চায় না, বিজলীবাবু বললেন। কিন্তু কেন?
হেম। হেমের জন্যেই কি অবনী এ জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি না?
কিন্তু আজ হেম কলকাতায় যাচ্ছে বলে সে তো স্টেশনে এল না। বিজলীবাবুর কথা মতন, দরকারি কাজে ভোরবেলাতেই বেরিয়ে গেছে অবনী। যে মানুষ এতটা কাজ বোঝে, দায়িত্ব বোঝে, সে আরও বড় দায়িত্ব নিতে অরাজি কেন?
সুরেশ্বর রোদভরা মাঠের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে যেন মৃদু হাসল।
৩. বিজলীবাবুর বাড়ি
১১.
বিজলীবাবুর বাড়ির সামনে এসে হর্ন দিল অবনী। আজ হাটবার, বিজলীবাবুর বাড়ির পেছন দিকে মস্ত মাঠ, ওই মাঠে হাট বসে; মাঠের পশ্চিম দিয়ে রেললাইন চলে গেছে। দশারা গেছে পরশু, তবু হাটের কাছাকাছি বলে দশারার মেলাটা হাটের ওপর এখনও ছড়ানো-ছিটোনো রয়েছে, পেট্রম্যাক্স আর কার্বাইডের আলো চোখে পড়ে, নাকে ভেসে আসে শুকনো শালপাতার আর রেড়ি কিংবা তিল তেলের গন্ধ, কলরব এখনও কানে আসে।
অবনী আরও একবার হর্ন দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। বিজলীবাবুর বাড়ির কুয়ালার কাছে বাগান দিয়ে একটা বউ অন্দরে চলে গেল। অবনী তাকে দেখতে পেল, চিনতেও পারল; বিজলীবাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী, ছোট বউ।
বিজলীবাবুর প্রথম স্ত্রী অন্তঃপুরবাসিনী, কদাচিৎ তাঁকে বাইরে দেখা যায়; দ্বিতীয় অতটা নয়, অবনী তাঁকে অনেকবার দেখেছে। বড় থাকেন সংসার আর ধর্মকর্ম নিয়ে, ছোট থাকেন সংসার আর স্বামী নিয়ে। বাইরে থেকে মনে হয় বিজলীবাবুর সংসার ছোট–তিনজন মাত্র লোক, আসলে সংসার আরও বড়; বাস-অফিসের জনা দুই এই সংসারেরই অন্ন খায়, একটি ছেলেকে বিজলীবাবু নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, বাঙালির ছেলে, স্কুলে পড়ে; এর ওপরেও প্রায়ই শহর থেকে বিজলীবাবুর চেনাজানা কেউ না কেউ কাজেকর্মে এসে তাঁর বাড়িতে ওঠে। বাস-অফিসের ম্যানেজারিতে এত বড় সংসার চলে না, বাবা বেঁচে থাকতেই কিছু জমি জায়গা করেছিলেন, সেই জমি জায়গা বিজলীবাবু বেশ কিছু বাড়িয়েছেন, বাজারের দিকে গোটা দুই ভাড়া বাড়ি আছে, সব মিলিয়ে মিশিয়ে সচ্ছল ভাবেই চলে যায়।
কাঠের ফটক, সামান্য কটা গাছপালা, সিঁড়ি কয়েক ধাপ-তারপরই ঢাকা বারান্দা। খোলা দরজা দিয়ে বিজলীবাবু বাইরে এলেন,হাত তুলে বললেন, আসছিদুমিনিট। বিজলীবাবুআবার ভেতরে ঢুকে গেলেন।
অবনী সামনেটায় পায়চারি করতে করতে সিগারেট ধরাল। সন্ধে হয়ে এল, হাটের দিক থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে, কোথাও কে যেন ঢোল পিটছে, বোধহয় ধোপপট্টিতে। রেল লাইনের দিক থেকে গুরুগুরু শব্দ উঠেছে, মালগাড়ি আসছে হয়তো। অবনী বারান্দার দিকে তাকাল, পুবের ঘরে বাতি জ্বালল, শাঁখ বাজছে, জানলায় বিজলীবাবুর ছোট বউ।
বিজলীবাবুর মুখেই অবনী শুনেছে, তাঁর দুই স্ত্রী সহোদরা ভগিনী। বড় এবং ঘোটর মধ্যে বয়সের তফাত বছর পাঁচেকের। দুজনেরই মুখের আদল গড়ন-টড়ন একই রকমের প্রায়, তবে ছোট যেন বড়োর চেয়ে সুশ্রী, গায়ের রংও মাজা। অবনী নিজে যেটুকু দেখেছে তাতে তার মনে হয়েছে, হোটর সমস্ত মুখের মধ্যে চমৎকার একটি প্রসন্ন ভাব আছে, বেশ হাসিখুশি, বিজলীবাবুর যোগ্য স্ত্রী। বড় একেবারে বর্ষীয়সী গৃহিণী শান্ত, গম্ভীর। বিজলীবাবু, অবনীর ধারণা, বড়কে খাতির করেন বেশি, ভালবাসেন ছোটকে বেশি। বড়র জীবনে স্বামী এখন সঙ্গী নয়, গৃহকর্তা বা অভিভাবক। বিজলীবাবুর কাছে শোনা, বড় আলাদা ঘরে থাকেন, পুজোআচা করেন, সংসারের দায় বয়ে বেড়ান। ছোটও সংসার নিয়ে থাকেন, তবু তাঁর সঙ্গে স্বামীর শোয়াবসা হাসিঠাট্টার সম্পর্কটা আছে। বিজলীবাবু বলেন, মিত্তিরসাহেব, আমার দুদিকে দুই কলাগাছ আমি শালা মহারাজ। আমার বড়টি হল গিয়ে নারায়ণের লক্ষ্মী, আর ছোটটি হল আমার মেনকা-টেনকা। …আমি ভাগ্যবান পুরুষ।
অবনী সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে মনে মনে হাসল। ততক্ষণে বিজলীবাবু বেরিয়ে এসেছেন।
বিজলীবাবুর হাতে একটা টিফিন কেরিয়ার, কাঁধে বড় সাইজের ফ্লাস্ক।
অবনী অবাক হয়ে বলল, এসব কী?
টিফিন কেরিয়ারটা হাতে করে তুলে দেখিয়ে বিজলীবাবু বললেন, এটা সুরেশ মহারাজের। বাড়ি থেকে দিয়ে দিল। বলে হাতটা নামালেন বিজলীবাবু, মিষ্টি-ফিষ্টি পায়েস আছে। …আর এইটে– বিজলীবাবু ফ্লাস্ক দেখিয়ে এক চোখ টিপে হাসলেন, আমাদের। পথে তেষ্টা-টেষ্ঠা পাবে তো৷
অবনী জোরে হেসে উঠল। ওটাও কি বাড়ি থেকে দিয়েছে?
তাই কি দেয়, মিত্তিরসাহেব। …এর জন্যেই দেরি হয়ে গেল। কত হাইড অ্যান্ড সিক করে তবে মিশিয়ে-ফিশিয়ে আনলুম।
আপনার হাইড অ্যান্ড সিক আছে নাকি? অবনী হাসছিল।
না, তা নেই। তবে দেবতা বুঝে প্রণামী। যাচ্ছি সুরেশ-মহারাজার কাছে–এ-জিনিস তো নিয়ে যাওয়া যায় না, তার ওপর গাড়ি করে রাত্তির বেলায় আসা-যাওয়া–মদ্য নিয়ে যাচ্ছি জানলে বউ কি আর আস্ত রাখত।
গাড়িতে এসে বসল দুজনে। বিজলীবাবু পিছনের সিটে টিফিন কেরিয়ারটা ঠিক করে রাখলেন, সাবধানে; ফ্লাস্কটা তাঁর পাশেই থাকল।
জিপগাড়িতে স্টার্ট দিল অবনী। ঠাট্টা করে বলল, একজনকে না হয় লুকোলেন, অন্যজন? তিনি কী বললেন?
তিনিও খুশি নন। বললাম, এক পোয়া জিনিসের সঙ্গে পাঁচ পো জল মিশিয়েছি গো, এই খেয়ে নেশা হবে না; কোনও ভয় নেই–অপঘাতে মরব না।
অবনী হাসতে লাগল। গাড়ি চলতে শুরু করেছিল।
বিজলীবাবু পান চিবোচ্ছিলেন। অবনীর আজ অন্য পোশাক। ধুতি পাঞ্জাবি। দশমীর দিন ভেঙেছিল। পাঞ্জাবি পাজামা অবশ্য বাড়িতে পরে, ধুতি আর পরা হয়ে ওঠে না। কলকাতায় থাকতে তবু মাঝে মাঝে পরা হত, এখানে এসে একেবারেই হয় না। নিতান্ত বিজয়ার দিন লোকজন আসে বাড়িতে, দু-এক জায়গায় তাকেও যেতে হয় তাই এই ধুতি।
ম্যালেরিয়া কনট্রোলের অফিস পেরিয়ে গাড়ি টাউনের রাস্তা ধরল। বিজলীবাবু সিগারেট বের করলেন, আসুন, মিত্তিরসাহেব।
পরে; আপনি নিন।
বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে নিলেন।
বাড়ি প্রায় শেষ হয়ে এল, মাঠের কোলে সন্ধের আবছা ভাবটা গাঢ় হয়ে এসেছে। তারই গায়ে গায়ে জ্যোৎস্না ধরছে। শুকনো ঠাণ্ডা বাতাস, দুপাশে গাছের মাথায় এখনও পাখির ঝাঁক উড়ে উড়ে বসছিল, কলরব ভাসছে। বিজলীবাবু পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে টিফিন কেরিয়ারটা ঠিক করতে লাগলেন। গাড়ির ঝাঁকুনিতে নড়ছিল, উলটে যেতে পারে।
অবনী বলল, আপনার স্ত্রী সুরেশমহারাজের খুব ভক্ত, না বিজলীবাবু?
তা খাতির-টাতির করে বই কি! মেয়েদের দুটো রোগ আকচার থাকে, মিত্তির সাহেব; এক, হিস্টিরিয়া আর দুই হল গিয়ে ওই আইবুড়ো সাধু-সন্নেসী মহারাজ-টহারাজের ওপর ভক্তি।
অবনী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, টিফিন কেরিয়ার দেখে তাই মনে হচ্ছে।
বিজলীবাবু জবাব দিলেন, এ যা দেখছেন সমস্তই আমার বড় গিন্নির। ছোটও দলে আছে, তবে অতটা নয়। …বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, সুরেশ-মহারাজ যখন এদিকে থাকতেন তখন মাঝে মধ্যে আমার বাড়িতে আসতেন, এক-আধদিন তুলসী রামায়ণও গেয়ে শুনিয়েছেন অল্পস্বল্প। বড় গিন্নির তখন থেকেই সুরেশ-মহারাজের ওপর একটু টান।
আপনার নিজেরও বেশ টান…।
আমার! ..আমার কী টান থাকবে। উনি হলেন নিরামিষ মানুষ, আমরা হলুম আমিষ ব্যক্তি। চরিত্তই আলাদা। বিজলীবাবু হেসে হেসে বললেন।
অবনী গাড়ি চালাতে চালাতে ঘাড় বেঁকিয়ে বিজলীবাবুকে একবার দেখল। তারপর বলল, আপনি সুরেশ-মহারাজকে পাঁচশো টাকা দিয়েছিলেন?
বিজলীবাবু যেন হঠাৎ কেমন হয়ে গেলেন, চোখের পাতা পড়ল না, মুখ ফিরিয়ে অবনীকে বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছিলেন।
শেষে বললেন, কে বলল?
আপনার সুরেশ-মহারাজ।
বিজলীবাবু যেন সামান্য বিব্রত এবং অপ্রস্তুত বোধ করছিলেন। কথাটা স্বীকার করতে তাঁর অদ্ভুত কুণ্ঠা জাগছিল। সরাসরি কোনও জবাব না দিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, কবে বললেন?
বলছিলেন একদিন কথায় কথায়।
কথাটা ঠিক নয়– বিজলীবাবু জবাব দিলেন, তারপর সামান্য চুপচাপ থেকে যেন অবনীকে বোঝাচ্ছেন এইভাবে বললেন, টাকাটা আমি ঠিক দিইনি, আর পাঁচশো টাকা আমি পাবই বা কোথায়, গরিব মানুষ। উনি ভুল বলেছেন।
ভুল অবনী কৌতুক করে বলল।
বিজলীবাবু যেন রীতিমতো অকুলে পড়ে গেছেন। বললেন, ব্যাপারটা কী জানেন মিত্তিরসাহেব, একবার সুরেশ-মহারাজ যখন আশ্রমের কাজে হাত দিয়েছেন তখন তাঁর হঠাৎ একদিন টাকার খুব দরকার হয়ে পড়ে। দেশের দিকে বোধহয় ওঁর কিছু সম্পত্তিটম্পত্তি বেচা-কেনার কথা চলছিল, টাকাটা সময় মতন পাননি। এখানে এসেছিলেন টাকা হাওলাত করতে। আমার সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল, আমাকে বলেছিলেন কোনও মাড়োয়াড়ি মহাজনের কাছে নিয়ে যেতে। তা আমি দেখলাম, মাড়োয়ারি মহাজনের কাছে টাকা হাওলাত করাটা ওঁর পক্ষে ভাল দেখায় না। তা ছাড়া আমি থাকব সঙ্গে, মাড়োয়ারিগুলোই বা বলবে কী। ভাববে আমি বাঙালি হয়েও নিজের মুলুকের আদমি-কে পাঁচশোটা টাকা জোগাড় করে দিতে পারলাম না। ইজ্জতে লাগল…। তা ছাড়া এখানকার মাড়োয়ারিদের সঙ্গে আমার এমনি যে খুব দহরম-মহরম, সে মুখে, ভেতরে ভেতরে রেষারেষি। সে অনেক পুরনো ব্যাপার মিত্তিরসাহেব, বাস-টাস, বাজারের বাড়ি-নানারকম ব্যাপার আছে। …তা আমি পড়ে গেলাম প্যাঁচে। কী করি! তখন আমি সুরেশ-মহারাজকে তিনশো টাকা ধার দি৷ আর বাকি দুশো টাকা দিয়েছিল আমার বড় পরিবার। আমার মুখে শুনেছিল, শুনে দিয়েছিল। ওটা তার ব্যাপার।
অবনী কোনও কথা বলল না। উলটো দিক থেকে একটা লরি আসছে বোধহয়, এত জোরালো আলো যে অবনীর চোখে লাগছিল, নিজের গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে সরিয়ে নিল।
বিজলীবাবু নিজের থেকেই বললেন, সুরেশ-মহারাজ কিন্তু তার পরই টাকাটা শোধ করে দিতে চেয়েছিলেন, হাতে টাকা এসে গিয়েছিল। তা আমি তখন টাকাটা নিইনি। বলেছিলাম, এখন থাক; পরে দরকার পড়লে নেব। …তারপরও উনি অনেকবার বলেছেন, আমি নিইনি। এক সময় নিলেই হবে।
লরিটা একেবারে সামনাসামনি, অবনী সাবধানে পাশ কাটিয়ে নিল। সামনে ফাঁকা রাস্তা, দুপাশে ক্ষেতি, দ্বাদশীর চাঁদের আলো বেশ ফুটতে শুরু করেছে।
অবনী এবার একটা সিগারেট ধরাল। বলল, আপনি যতই বলুন, সুরেশ-মহারাজের ওপর আপনার বেশ টান আছে। হেসে হেসেই বলল।
বিজলীবাবুও হেসে বললেন, টান বলবেন না, বলুন খাতির। তা মহারাজ মানুষ, একটু খাতির যত্ন করলে চলে! ..আমার সঙ্গে ওঁর দেখাসাক্ষাতই বা আজকাল কতটুকু হয় যে মেলামেশা থাকবে।
লোকটিকে আপনি পছন্দ করেন।
পছন্দ! ..তা করি। …ব্যাপারটা কী জানেন মিত্তিরসাহেব, আমি তত বেশি কিছু বুঝি না, মুখ মানুষ, কিন্তু একটা জিনিস বেশ বুঝি। সংসারে আমরা আমাদের মতন মানুষ যারা–তারা যে যার নিজের তল্পি নিয়ে আছি। নিজের ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আমাদের চোখ বুজতে হয়। সুরেশ মহারাজার-টহারাজের মতন লোক তবু দুটো কাজ করেন। আমরা কিছুই করি না।
অবনী শুনল। সামনে একটা ঢাল, গিয়ার বদলে নিল গাড়ির। হেসে বলল, এ-সব লোক সম্পর্কে আপনার ওমর খৈয়াম কী বলেন?
বিজলীবাবু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না, পরে বললেন, জানি না মিত্তিরসাহেব, তবে আমার মনে হয় ওঁরা হলেন অন্য ধরনের মানুষ–কেউ তো তারা ছোঁয় না সুরা, যেমন তেমন লোকের সাথে; সুযোগ পেলেই সব আসরে, পাত্র তাঁরা নেন না হাতে।
সামান্য চুপ থেকে অবনী পরিহাস করে বলল, তা আমাদের সঙ্গে পাত্র না নিন, পাত্র তো হাতে তুলে ধরেন। কোন আসরে ধরেন?
সে ওঁদের আলাদা আসর– বিজলীবাবুও হেসে বললেন, তবে পাত্র ওঁরা ধরেন। নেশায় না ডুবলে কেউ কাজ করতে পারে না, মিত্তিরসাহেব। মাতাল হতে হয়, সাধারণ জ্ঞানগম্যি নয়তো হারানো যায় না।
অবনী চুপ। আর অল্প মাত্র পথ, লাইটার মোড় এসে গেছে।
লাঠটার মোড় পৌঁছে গাড়ি ঘুরিয়ে গুরুডিয়ার কাঁচা পথ ধরল অবনী।
বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব, আমার তেমন কোনও সিকরেট নেই। যা বুঝি বলে ফেললাম।
অবনী জবাব দিল না। কোথায় যেন তার সামান্য ঈর্ষার মতন লাগছিল, অধম মনে হচ্ছিল নিজেকে। বিজলীবাবুর সঙ্গে তার পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা কম নয়, দিনে দিনে সেটা বাড়ছিল, বিজলীবাবু হয়তো এই ঘনিষ্ঠতাকে সাধারণ পর্যায়ের মনে করেন। অবনী সম্পর্কে তাঁর কোনও শ্রদ্ধা নেই, অনুরাগও হয়তো নেই। অবনীর মনে হল, তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে বিজলীবাবুর যে ধারণা তা সম্ভবত মদ্যপানের সঙ্গী হিসেবেই যতটুকু হতে পারে ততটা তার বেশি কিছু নয়।
সুরেশ্বরের সঙ্গে নিজেকে এভাবে তুলনা করেও তার বিরক্তি লাগছিল। বিজলীবাবু তাকে উত্তম অথবা অধম যাই ভাবুন না কেন কী আসে যায়! চিন্তাটা মন থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল অবনী, এবং ঈষৎ অপ্রসন্নতা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করল না। বরং যথাসম্ভব হালকা গলায় বলল, আপনার সিকরেট নেই বলছেন, কিন্তু একে একে এই সব সিকরেট যে বেরিয়ে পড়ছে, বিজলীবাবু!
বিজলীবাবু বোধহয় লজ্জিত হলেন, মাথা নেড়ে বললেন, না না, এ আর এমনকী সিকরেট।
গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তায় গাড়িটা মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছিল। বিজলীবাবু পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে টিফিন কেরিয়ারটা দেখলেন, কাত হয়ে পড়ে গেছে, জিবের একটা শব্দ করে হাত বাড়িয়ে টিফিন কেরিয়ারটা সামনে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। সুরেশ-মহারাজা পুজোর মধ্যে আসব বলেও আসেননি। কী হল কে জানে। হয়তো পায়ের ব্যথা বেড়েছে। পুজোমণ্ডপে মালিনীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিজলীবাবুর, সে সপ্তমীর দিন সকালে বাড়ি এসেছে, সুরেশ-মহারাজের কথা বলতে পারল না। অপেক্ষায় থেকে থেকে আজ তাঁরা যাচ্ছেন, বিজয়ার দেখা সাক্ষাৎ সেরে আসবেন। বড় বউ কিছু মিষ্টি-টিষ্টি দিয়ে দিয়েছে।
গুরুডিয়ার এই কাঁচা রাস্তায় নেমে দ্বাদশীর জ্যোৎস্না আরও পরিচ্ছন্ন করে দেখা যাচ্ছিল। আদিগন্ত মাঠে নিঃসাড়ে যেন জ্যোৎস্নার স্রোত ভাসছে, হেমন্তের খুব হালকা একটু হিমের অস্পষ্টতা আছে কোথাও, শীতের সামান্য আমেজ লাগছে, চারদিক নিস্তব্ধ; মাঠে পলাশ আর আমলকি ঝোপে জোনাকি জ্বলছে।
বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব, একটা কথা তা হলে বলি। আমার সিকরেট আর জানলার পরদা একই জিনিস; বাতাস দিলেই উড়ে যায়, দেখতে কষ্ট হয় না। কিন্তু আপনি হলেন মিস্টিরিয়াস ম্যান। …কদিন ধরেই আপনাকে জিজ্ঞেস করব ভাবছি, কেমন লজ্জা লজ্জা করছে। ..সেদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম না, একটা চিঠি পেয়েছেন কি না–ঠিকানা পড়া যায় না। আপনি বললেন পেয়েছি।
অবনী মুখ ফিরিয়ে বিজলীবাবুকে দেখল।
বিজলীবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ললিতা মিত্র কে?
অবনী অসতর্ক হয়ে ব্রেক টিপতে যাচ্ছিল, গাড়িটা কেমন ঝাঁকুনি খেল সামান্য, আবার চলতে লাগল।
চুপচাপ। অবনী কোনও জবাব দিচ্ছে না, বিজলীবাবু অপেক্ষা করে আছেন। আড়ষ্ট সময় পলে পলে বয়ে যাচ্ছে।
কিছু সময় পরে অবনী বলল, আপনি জানলেন কী করে?
মানি অর্ডারের রসিদ দেখলাম।
ও।
পোস্ট অফিসে গিয়েছিলাম সুরেশ-মহারাজের সঙ্গে; রামেশ্বর আমায় চিঠিটা দেখাচ্ছিল, তখনই রসিদটা দেখলাম।
অবনী গাড়ি থামিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর হাসবার চেষ্টা করে বলল, আপনার সুরেশ-মহারাজও কি জানেন নাকি?
না, তিনি পোস্ট অফিসের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন।
গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। সামান্য এগিয়ে অবনী বলল, ললিতা এক সময়ে আমার স্ত্রী ছিল।
এক সময়ে?
বছর কয়েক।
বিজলীবাবু বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বোধহয় বুঝতে পারছিলেন না, এক সময়ে যে স্ত্রী থাকে পরে সে কী হয়। বিব্রত গলায় শুধোলেন, এখন তিনি আপনার স্ত্রী নন?
না।
কী রকম? তাঁকে টাকা পাঠাচ্ছেন…
ওটা একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট। খোরপোষ দিচ্ছি।
ও! আপনি স্ত্রী ত্যাগ করেছেন?
দুজনেই দুজনকে করেছি; পরে একটা ডিভোর্স নিয়ে নেব।
বিজলীবাবু যেন নিশ্বাস বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকলেন। অবনীর চরিত্রটি যেন তিনি দেখবার বা বোঝবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ঈষৎ আলে পর অন্ধকার যেমন দৃষ্টিকে দিশেহারা করে তেমনি তিনি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন।
ব্যাপারটা পুরনো, আমার আর কোনও ইন্টারেস্ট নেই, অবনী গলা পরিষ্কার করতে করতে বলল। টাকাটা পাঠাতে হয় পাঠাই।
চিঠিটা কার? বিজলীবাবু শুধোলেন।
অবনী নীরব। তার সামনে, পাশে হেমন্তের সাদাটে জ্যোৎস্না; গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া শব্দ নেই, মাঠ-ঘাট জুড়ে বুঝি ঝিঁঝি ডাকছে, কানে হঠাৎ এই শব্দটা লাগল। অল্প দূরে আশ্রম, ছায়ার মতন দেখাচ্ছে।
অবনী মৃদু গলায় বলল, আমার মেয়ের।
বিজলীবাবু চমকে উঠলেন, স্ত্রীর কথা শুনে এতটা চমকাননি। আপনার মেয়ে?
অবনী আর কোনও কথা বলল না।
.
বিজলীবাবুর হাঁকডাকের আগেই সুরেশ্বর বেরিয়ে এসেছিল। আরে, আসুন–আসুন! কী সৌভাগ্য।
সৌভাগ্য তো আমাদের মশাই, আপনারা হলেন মহম্মদ, আমরা হলাম পর্বত। আপনি নড়লেন না, তাই আমরা এলাম। বিজলীবাবু সরল রসিকতা করে বললেন, আসুন কোলাকুলিটা সেরে নিই আগে।
কোলাকুলি সারা হল। অবনী হঠাৎ কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে, অন্যমনস্ক, তেমন কোনও কথাবার্তাও বলল না। বিজলীবাবু টিফিন কেরিয়ারটা সুরেশ্বরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরও পাঁচটা হাসিঠাট্টা করলেন।
সুরেশ্বরের বাড়ির ছোট বারান্দাটুকুতেই বসল ওরা। সুরেশ্বর ভরতুকে ডাকতে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে বসল।
পায়ের ব্যথার জন্যে নয়, অন্য কারণে সুরেশ্বর যেতে পারেনি। গোড়ালির ব্যথাটা দু-একদিনের মধ্যেই সেরে গিয়েছিল, কিন্তু অষ্টমীর দিন শেষ রাতে অন্ধকুটিরের এক-পাশের অনেকখানি চাল হঠাৎ কেমন করে যেন ধসে গেল। না, জখম-টখম হয়নি কেউ। পরের দিন ওপাশের সমস্ত খাপরা সরিয়ে, নতুন করে চাল বেঁধে খাপরা-টাপরা বসিয়ে তবে স্বস্তি। দুটো দিন এই সব করতেই কাটল। বোধহয় বর্ষার মধ্যে, এবং সেদিন ওই রকম ঝড় বৃষ্টিতে চালের কাঠকুটোয় কিছু হয়েছিল, ঘুণ ধরেছিল আগেই, ভেঙে পড়ল আচমকা। তা ছাড়া আশ্রমে দেখাশোনা করার লোকজনও কেউ ছিল না তেমন। পুজোয় মালিনী বাড়ি গিয়েছিল কাল সকালে ফিরেছে, হৈমন্তী কলকাতায়, এখনও ফেরেনি, চিঠি দিয়েছে। পূর্ণিমার পরের দিন ফিরবে, যুগলবাবু গিয়েছিলেন গয়া, ফিরেছেন কাল, শিবনন্দজি নিয়মিত আসতেন, তাঁর চেষ্টাতেই লোকজন মালপত্র জোগাড় করে রাতারাতি সব মেরামত করানো গেল। গতকাল সুরেশ্বর অন্ধ আশ্রমের অন্ধজনদের নিয়ে গিয়েছিল বিশাইয়া, দশারার মেলায়।
অবনী মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছিল না; কানে আসছিল, কিছু খেয়াল করছিল কিছু করছিল না। ভরতু চা দিয়ে গেল, বিজলীবাবুর আনা মিষ্টি থেকে কিছু মিষ্টি, কয়েকটা পেঁড়া। বিজলীবাবু প্রতিবাদ করছিলেন–করছেন কী, আপনার ভাগ আমরা লুটেপুটে খাচ্ছি জানলে বড় বউ খেপে যাবে, মশাই…; সুরেশ্বর শুনেও শুনল না যেন।
কিছুক্ষণ বসে থাকল অবনী। সুরেশ্বর আর বিজলীবাবুর মধ্যেই গল্পগুজব হচ্ছে, দু-একটা কথা কখনও বলছিল অবনী, পর পর কয়েকটা সিগারেট খেয়ে মুখ বিস্বাদ লাগছে। ভাল লাগছিল না বসে থাকতে। এক সময় সে উঠে পড়ল, বলল, আপনারা গল্পগুজব করুন, আমি মাঠে একটু পায়চারি করি, মাথাটা ধরা ধরা লাগছে।
উঠে এসে মাঠে দাঁড়াল অবনী। আকাশের দিকে মুখ তুলে হাঁ করে নিশ্বাস নিল বার কয়েক। দ্বাদশীর চাঁদ অনেকখানি ভরে এসেছে, একপাশে এক টুকরো মেঘ, ঘেঁড়াখোঁড়া, নিচু দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। অবনী আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।
বিজলীবাবু ধূর্ত নন, তার পেছনে গোয়েন্দাগিরিও করেননি, তবু তিনি ললিতা আর কুমকুমের কথা জেনেছেন। ললিতার কথা লুকোবার চেষ্টা অবনী কি সত্যি সত্যিই তেমন কিছু করেছিল? না, করেনি। প্রতি মাসে ললিতার নামে মানিঅর্ডারের টাকা যায়, রসিদ ফিরে আসে। অফিসের চাকর, পোস্ট অফিসের কেরানি, রামেশ্বর পিয়ন এদের কাছে অন্তত মানিঅর্ডারের কথাটা জানা, উৎসাহ প্রকাশ করলে যে-কোনও লোকই এটা জানতে পারত। কিন্তু লুকোবার চেষ্টা না করেও অবনী ললিতার প্রসঙ্গটা কখনও কারও কাছে উল্লেখ করেনি। করার ইচ্ছে হত না, কারণও ছিল না। বিজলীবাবু হয়তো ভাবছেন, অবনী চালাকি করে নিজের স্ত্রীর কথা গোপন করেছে। তা কিন্তু নয়, অবনী ভাবছিল, সে ঠিক গোপন করার মন নিয়ে কিছু করেনি, যার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই, থাকবে না, যার প্রসঙ্গ বলা অথবা না বলায় কিছু আসে যায় না–অবনী সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করবে কেন! কোনও কারণ ছিল না করার। কথাটা আগে জানলেই বা কী লাভ হত বিজলীবাবুর! কৌতূহল নিবৃত্ত হত মাত্র, কিংবা আরও বাড়ত, তার বেশি কিছুনয়। ব্যক্তিগত ব্যাপার, বিশেষ করে যা তিক্ত স্মৃতি, যার সঙ্গে অবনীর জীবনের কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই আর, তা বলার উৎসাহ তার হয়নি।
অবনী হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে চলে এসেছিল। দাঁড়াল।
ললিতার জন্যে নয়, কুমকুমের জন্যেই অবনীর ভাল লাগছিল না। কুমকুম আগে কখনও চিঠি লেখেনি, এই প্রথম। সে, খুব সম্ভব, লুকিয়ে অবনীর ঠিকানা কোথাও দেখেছে। ঠিকানা দেখে চিঠি লিখেছে। ছেলেমানুষ বলেই, টাইফয়েডের পর, দুর্বল অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে তার বাবার কথা মনে পড়েছে। বোধহয় ললিতা মেয়ের ওপর তেমন যত্ন নেয় না এবং পুরো টাকাটা নিজের সুখ-সুবিধের জন্যে ব্যয় করছে। কুমকুমের চিঠি থেকে মনে হয়, মার ওপর ভীষণ অভিমান করে এবং নিজের চার পাশে একান্তভাবে তার নিজের কাউকে না দেখে মেয়েটার মনে খুব লেগেছে। নয়তো কুমকুম চিঠি লিখত না। ললিতা মেয়েকে কখনওই এমন কিছু শেখায়নি যাতে বাবার ওপর তার মন টানে। আগাগোড়া ললিতা মেয়েকে বাবার ওপর অশ্রদ্ধা প্রকাশ করতে শিখিয়েছিল, ঘৃণার শিক্ষাটা মেয়েকে সে দিয়েছিল, যেন অবনী পাশের বাড়ির বা পাড়ার কোনও একটা শয়তান গোছর মানুষ। কুমকুমের স্বভাব নোংরা, ইতর হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সেই মেয়ে আজ বাবাকে ওভাবে চিঠি লিখল কেন?
অবনী অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে কী মনে পড়ায় সিগারেট ধরাল না। হাত বাড়িয়ে গাড়ির সিট থেকে বিজলীবাবুর ফ্লাস্কটা নিল।
কুমকুম সাদা খাতার পাতার আড়াই তিন পাতা চিঠি লিখেছে। বড় বড় হাতের লেখা, পেনসিলে লিখেছে, হাতের লেখা কাঁচা, অপরিষ্কার। তাড়াতাড়িতে লেখার জন্যেই হোক, কিংবা লুকিয়ে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে লেখার জন্যই হোক, লেখা খুব খারাপ হয়েছে, ভুলও হয়েছে অনেক। হয়তো মেয়েটা শরীরেও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বাবা, আমার টাইফয়েড হয়েছিল। একশো পাঁচ জ্বর হয়েছিল। …বাবা, আমার খুব খিদে পায়, মা দুটো কমলালেবু দেয়। খুব টক। ..পুজোর জামাটা বিচ্ছিরি হয়েছে। আমার ভাল ফ্রক নেই, জুতো নেই। …বাবা, মাসি আমায় বলেছে, আমি মরে যাব। …আমার ভাল ফ্রক, জুতো কিনে পাঠিয়ে দিয়ো। ক্যাডবেরি দিয়ো। বাবা, আমি দুটো ক্লিপ পেয়েছি, জগুদা দিয়েছে। তুমি আমায় দেখতে আসবো…
অবনী অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। জ্বর আসার মতন তার শরীরে কেমন শীত ধরছিল, চোখ জ্বালা করছে, কোনও কিছু দেখছিল না। ক্রমশ তার চোয়ালে চাপ লাগছিল। দাঁত যেন কিছু কামড়ে ধরতে চাইছিল। হিংস্রভাবে অবনী কী যেন একটা বলল।
তারপর হঠাৎ সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক পলক তার শূন্য দৃষ্টির মধ্যে কোনও কিছুই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল না, পরে চোখ সামান্য পরিষ্কার হলে দেখতে পেল সামনে মালিনী। মালিনী কেমন সকুণ্ঠ এবং বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অবনী হৈমন্তীর ঘরের বারান্দার সামনে।
মালিনী আস্তে করে বলল, হেমদি কলকাতায় গেছেন, এখনও ফেরেননি।
অবনী কথা বলল না, মালিনীকে দেখতে লাগল। বারান্দার নীচে মালিনী দাঁড়িয়ে, নির্মল জ্যোৎস্নায় তার মিলের সাদা শাড়ি, গায়ের ময়লা রং, গোলগাল সাধারণ চেহারা, টলটলে মুখ কেমন নতুন দেখাচ্ছিল।
অবনী অস্পষ্টভাবে কিছু বলতে গেল, গলায় স্বর ফুটল না।
.
১২.
কুমকুমের চিঠি পাবার পর অবনী বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ও অপ্রসন্ন হয়েছিল। মেয়ের ওপর যতটুকু বিরক্ত হয়েছিল তার শতগুণ বেশি ললিতার ওপর। অবনী যা ফেলে এসেছে, যার সঙ্গে ওর আর কোনও সম্পর্ক নেই, যার সবটাই তিক্ত, কুমকুমের চিঠি আবার তা জোর করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কুমকুম তাকে পুরনো তিক্ততার মধ্যে টেনে নিয়ে যাক অবনীর তা পছন্দ হয়নি। মেয়ের ওপর এক চাপা অভিমানও তার ছিল। মার দেখাদেখি এবং মার শিক্ষায় সে বাবাকে অনাত্মীয় ভাবতে শিখেছিল, ললিতার মুখে শুনে শুনে চার বছরের মেয়েও এক সময়ে তাকে পাজি বজ্জাত বলেছে। তার মুখের অর্ধেক কথা তখনও স্পষ্ট হয়নি। আরও কত কী বলত। আজ সেই মেয়ের হঠাৎ বাবার ওপর টান উথলে উঠল কেন?
কুমকুমের ওপর এই বিরক্তিটা অবশ্য সাময়িক, অবনী যথাসময়ে ভুলে যেতে পারল। ভুলতে পারল না ললিতাকে। চিঠিটা অহরহ তাকে খোঁচা দিচ্ছিল, এবং ললিতার ওপর ঘৃণা ও আক্রোশ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। ললিতার সুখ-সুবিধে ফুর্তির জন্যে সে মাসে মাসে অতগুলো করে টাকা পাঠায় না। মেয়েকে ললিতা উপযুক্তভাবে প্রতিপালন করবে এটা তাদের শর্ত ছিল। ললিতা মেয়েকে অবনীর কাছে দিতে পারত, দেয়নি স্বার্থের জন্যে। তার ভয় ছিল, অবনী মেয়ে পেয়ে গেলে, যে-কোনও সময়ে ললিতাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিতে পারে; বা সে ভেবেছিল, অবনী যা পাঠাবে তা এত সামান্য যে ললিতার নামমাত্র ভরণ-পোষণ হতে পারে। মেয়েকে নিজের অধিকারে রেখে ললিতা আর্থিক উদ্বেগের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল মাত্র, যেন কুমকুমকে সে জামিন হিসেবে রেখে নিয়েছিল।
অবনী প্রাথমিক উত্তেজনায় ললিতাকেই চিঠি লিখতে গিয়েছিল। পরে মনে হল, ললিতাকে চিঠি লেখাটা বোকামি হবে, কুমকুম লুকিয়ে বাবাকে চিঠি লিখেছে এটা জেনে ললিতা মেয়ের ওপর প্রসন্ন হবে না। কুমকুমকে সরাসরি চিঠি লেখা বা কিছু টাকা পাঠানোও উচিত নয়, ললিতা জানতে পারবে, কুমকুম ধরা পড়ে যাবে। ললিতা এখন তার বাবার কাছে থাকে, সেখানে তার বাবা, ভাই বোন এদের দৃষ্টি এড়িয়ে কুমকুমকে কিছু করা যাবে না–একটা চিঠি লেখাও অসম্ভব। ললিতা মেয়ের ওপর আক্রোশবশে যে-কোনও রকম নির্যাতন করতে পারে, তার পক্ষে সবই সম্ভব।
অনেক ভেবে অবনীর মনে হয়েছিল, কমলেশকে একটা চিঠি লেখাই সবচেয়ে ভাল। কিংবা ধ্রুবকে। ধ্রুব কোনওদিনই ললিতাকে পছন্দ করেনি। তার স্বভাবটাও গোঁয়ারের মতন। ললিতাদের বাড়ি গিয়ে একটা গণ্ডগোল বাধাতে পারে, তাতে লাভ হবে না। তার চেয়ে কমলেশকে লেখাই ভাল। কমলেশের সঙ্গে ললিতার পরিচয় পুরনো, অবনীর সঙ্গে ললিতার পরিচয় করিয়ে দেবার আগেও ললিতাদের বাড়িতে তার আসা-যাওয়া ছিল। কমলেশের স্বভাব ঠাণ্ডা, ভেবেচিন্তে গুছিয়ে কাজ করতেও পারে। তা ছাড়া কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে অবশিষ্ট যেটুকু সম্পর্ক তা এখনও কমলেশের সঙ্গেই আছে। মাঝে মাঝে কমলেশের চিঠি পাওয়া যায়। ধ্রুবর সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগও আর নেই।
কমলেশকেই চিঠি লিখেছিল অবনী। লিখেছিল, কমলেশ যেন একবার ললিতাদের বাড়ি যায়, ললিতা এবং কুমকুমের সঙ্গে দেখা করে; দেখা করে আড়ালে কুমকুমকে বলতে বলেছিল যে, অবনী তার চিঠি পেয়েছে, কিন্তু চিঠি লিখলে পাছে তার মা-মাসিমা জানতে পারে তাই লিখল না। কুমকুম যেন তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে, মন খারাপ না করে। কমলেশকে কুমকুমের জন্যে দু-চারটে ভাল জামা কিনে নিয়ে যেতেও লিখেছিল অবনী, জামা, টফি, জুতো। অবনী বিশেষ করে সাবধান করে দিয়েছিল, ললিতা যেন কুমকুমের চিঠি লেখার কথা জানতে না পারে। কমলেশকে একথাও অবনী খোলাখুলি লিখেছিল যে, ললিতা যদি মেয়ের প্রতি যত্ন না নেয়, তবে সে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়ে ললিতাকে শিক্ষা দেবে। আর কুমকুম? দরকার হলে কুমকুমকে কোনও হোস্টেলে রেখে দেবে অবনী।
চিঠিটা পুজোর মধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছিল অবনী, টাকাও পাঠিয়েছিল। অবশ্য কমলেশকে টাকা না পাঠালেও চলত, বলা যায় না সে হয়তো একটু অসন্তুষ্টই হবে। ললিতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সময় কমলেশ অনেক করে বলেছিল, মেয়ে ছাড়িস না–মেয়েটাকে একেবারে নষ্ট করে দেবে। তোরই মেয়ে
কমলেশের কাছ থেকে চিঠির জবাব আসবার আগেই বিজলীবাবুর কাছে অবনীকে স্বীকার করে নিতে হল কলকাতায় তার মেয়ে আছে, স্ত্রীও আছে-যদিও তাদের সঙ্গে তার আর কোনও সম্পর্ক নেই।
বিজলীবাবু যে কী বুঝেছিলেন কে জানে, স্ত্রী অথবা মেয়ের সম্পর্কে আর কোনও প্রশ্ন করেননি। অথচ অবনী বেশ বুঝতে পারছিল, বিজলীবাবু যেন কোথায় একটা অপ্রত্যাশিত বিস্ময়-বোধ নিয়ে রয়েছেন, হয়তো নিজে সন্তানহীন বলে অবনীর সন্তানের প্রতি এই উপেক্ষা তাঁর কাছে নির্মম মনে হচ্ছিল। অবনীর একসময়ে মনে হয়েছিল, বিজলীবাবু হয়তো অনুমান করছেন, স্ত্রীর চরিত্র এবং সন্তানের জন্ম রহস্য সম্পর্কে অবনীর কোনও সন্দেহ আছে, সেই সন্দেহবশে অবনী স্ত্রী কন্যা ত্যাগ করেছে। বিজলীবাবু অন্য আর কী ভাবছেন, ভাবতে পারেন অবনী জানে না। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, বিজলীবাবুর কাছে অবনী ইদানীং কেমন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছিল। যেন তিনি অবনীর অত্যন্ত গোপন কিছু জেনে ফেলেছেন যা সে জানাতে চায়নি। ভদ্রলোক তার ভেতরে কোন অবনীকে দেখছে, মাঝে মাঝে এই বিরক্তিকর চিন্তা এসে অবনীকে অন্যমনস্ক ও কুণ্ঠিত করছিল। অন্তত, বিজলীবাবু যদি ভাবেন, কুমকুম জারজ–এই ভয় ও আশংকা অবনীকে কেমন পীড়িত ও লজ্জিত করছিল। আত্মসম্মান ও কুমকুমের মর্যাদার জন্যে অবনীর কী করণীয় সে বুঝে উঠতে পারছিল না।
নিজের শৈশবের দিকে তাকালে অবনী যাদের দেখতে পায় তাদের কেউই তার কাছে সম্মানীয় নয়। বাবা এবং মার মধ্যে যথার্থ সম্পর্ক কী ছিল অবনী অনেক দিন তা বুঝতে পারেনি। পরে বুঝেছিল। বুঝে তার ঘৃণা হয়েছিল, মার ওপর, বাবার ওপর, নিজের ওপর। বাবার মতন অপদার্থ মানুষ হয়তো সংসারে কিছু কিছু থাকে, কিন্তু তার বাবা ছিল সমস্ত রকমে অপদার্থ। নিজের মেরুদণ্ডকে কখনও সোজা করেনি, করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল; কখনও সখনও হয়তো অসহ্য হলে বাবা ভেবেছে একটু নড়েচড়ে উঠবে, কিন্তু এরকম কিছু হবার উপক্রম হলেই যেন মা জানতে পারত, এবং খুব সহজেই মা বাবার সেই অসাড় রুগণ মেরুদণ্ডকে আবার বেঁকিয়ে দিত। মার কাছে বাবার কোনও অস্তিত্ব ছিল না; কখনও সখনও মনে হত, সার্কাসের তাঁবুর মধ্যে বাবাকে নেশাখোর নির্জীব বাঘের মতন এনে দাঁড় করিয়ে মা চাবুক হাতে খেলা দেখাচ্ছে। মা কখনও সেই চাবুক ছুড়ত না, এমনকী তার শব্দও শোনা যেত না, অথচ বাবা মার খেলার কৌতূহলটুকু জোগান দিত, প্রয়োজনে মার ইঙ্গিতে বাবা হুঙ্কারও করত। দর্শকের কাছে যেন মার কৃতিত্বের জন্যে এই হুঙ্কার প্রয়োজন ছিল। মাকে এসব দিক থেকে অসামান্য মনে হত, মনে হত মার অসাধ্য কিছু নেই। মার স্বভাব যে কত প্রখর ছিল এবং ব্যক্তিত্ব কী উগ্র তা বাবার পাশে মাকে দেখলে বোঝা যেত। অবনী ছেলেবেলায় মাকে ভাল বুঝত না, পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছে মা সমস্ত কিছু গ্রাস করে আছে। মার ব্যক্তিত্বের কাছে বাবা নিষ্প্রভ। সংসারে যে কোনও জিনিস মা নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে দাবিয়ে রেখে দিতে পারত। অবনীও ঘাড় তুলতে সাহস করেনি, কোনও সংশয় প্রকাশ করতে ভরসা পায়নি। বাবার নির্জীবতা সম্পর্কে তার ঘৃণা ধরে গিয়েছিল, এবং কখনও নিজের ভাল মন্দে বাবাকে ডাকেনি, সে অভ্যাস তার হয়নি, মা করতে দেয়নি।
বাবার বিকৃত যৌনাচারে আসক্তি ছিল, এবং অবলম্বন ছিল নেশা। বাবা নানারকম নেশা করত। নেশা এবং নোংরামির জন্যে মা বাবাকে পয়সা দিত। বাবা হাত পেতে নিত। বাবার নিজস্ব কোনও উপার্জন ছিল না। একদা পৈতৃক ধনে বাবা যত না ধনী ছিল, তত অভিজাত ছিল। মা বাবার এই ধন এবং আভিজাত্য নিজের কুক্ষিগত করে। বাবা থিয়েটারের মেয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর মা নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎকে বোকামি করে পায়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি, বুদ্ধিমতীর মতো গ্রহণ করেছিল। পরে অবশ্য মা থিয়েটার ছেড়ে দেয়, কিন্তু মা পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট করেনি। তাদের পরামর্শ যে সব সময় মা নিত তা নয়, তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে মা অর্থের ও আভিজাত্যের সদ্ব্যবহার করত। এই অর্থে তারা প্রতিপালিত হয়েছে। মা চরিত্র-বিলাসী ছিল, জনৈক যুবকের প্রতি মার অনুরাগের বাহুল্যও ছিল। মৃত্যুর আগে বাবা মার ওপর অবিশ্বাস ও আক্রোশবশে একবার মাত্র হঠাৎ নিজের সমস্ত নির্জীবত্ব ভুলে মাথা তুলে দাঁড়াতে গিয়েছিল, পারেনি, বরং এমন আঘাত পেয়েছিল যে বাবা সেই আঘাত সামলাতে পারেনি। বাবা মারা গেল। মা তারপরও আপন জ্যোতিতে জ্বলেছে। শেষ পর্যন্ত মার এই জ্যোতির অকস্মাৎ অবসান ঘটল। মামলায় মকদ্দমায় জড়িয়ে, ব্যর্থতায়, দুশ্চিন্তায় মা মারা যায়; মার তখন নিঃস্ব অবস্থা। অবনী ততদিনে বড় হয়ে গেছে, যুবক; ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াও শেষ করে এনেছে। মার মৃত্যুতে সে দুঃখিত হয়নি, বাবার মৃত্যুর সময় কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল, কারণ তখন সে ছেলেমানুষ ছিল, এবং মা সমারোহ করে বাবার সৎকার করিয়েছিল। সমারোহের প্রভাবে বাবার মৃত্যু এত বড় দেখিয়েছিল যে অবনী চোখের জল না ফেলে পারেনি। বাবার শেষ অবস্থায় অবনী প্রায় নিঃসন্দেহে জানতে পারে, মার সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক থাকলেও বাবার সঙ্গে নেই। অবশ্য মা সেই সাজানোবাবার শ্রাদ্ধশান্তি অবনীকে দিয়েই পুরোপুরি করিয়েছিল। ওই বয়সে, কথাটা জানা অথবা সন্দেহ করার পরও অবনীর কিছু করার ছিল না। মার চোখের সামনে সে এত তুচ্ছ ছিল যে তার সাধ্য ছিল না চোখ তুলে মার দিকে তাকায়। কাজেই ইতর-বিশেষ কিছু হয়নি, যেভাবে সে বেড়ে উঠেছিল, মাকে যে অবস্থায় দেখত তাতে সব কিছুই তার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
মার স্বভাব, চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, অহংকার–এসব যেমনই হোক, একটা বিষয়ে মার কোনও কার্পণ্য ছিল না। শেষ দিন পর্যন্ত মা অবনীকে কোনও রকম আর্থিক অভাব বা দুঃখ কষ্ট সাধ্যমতো বুঝতে দেয়নি, ছেলেকে মা সচ্ছলতার মধ্যে মানুষ করেছে, লেখাপড়া শেখানোতেও ত্রুটি রাখেনি।
মার মৃত্যুর পর অবনী এক অদ্ভুত রকমের মুক্তি পেল। পায়ে শেকল পরানো পাখি দীর্ঘকাল বন্দী থাকলে তার পা যেমন অসাড় হয়ে আসে, অবনীও সেই রকম প্রথম দিকটায় তার মুক্তিকে ভয়ে ভয়ে দেখেছে, সে সাহস পায়নি পা বাড়াবার। তারপর সংশয় দুর হলে সে পা বাড়িয়েছে, কিন্তু বেশি দূর নয়। কেমন করে যেন মার প্রভাব তার রক্তে মিশে গিয়েছিল, মনের কিছু যেন কুঁকড়ে রেখেছিল, অবনী তা অগ্রাহ্য করতে পারত না। শেষ পর্যন্ত সে বেপরোয়া মরিয়া হয়ে নিজের স্বাধীনতার জন্যে লাফিয়ে পড়ল, কিন্তু সে যেখানে পা রাখল সেটা খানিকটা তার সাজানোবাবার জায়গা, খানিকটা মার। একদিকে সে একা, নিঃসঙ্গ, নিগৃহীত, ক্লান্ত, বিরক্ত; অন্য দিকে সে তীব্র, নির্দয়, সুখান্বেষী, ভোগবিলাসী। নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা করতে গিয়ে সম্ভবত সে সামঞ্জস্য ভুলে গিয়েছিল, এবং এমনভাবে তার মেরুদণ্ড সোজা করল যেটা স্বাভাবিক নয়, ফলে সেই কৃত্রিম অনভ্যাস-দৃঢ় মেরুদণ্ড হল তার ঔদ্ধত্য।
নিজের শৈশবের এই স্মৃতি সুখের নয়, কাম্যও নয়। অবনী চায়নি, কুমকুমের শৈশবও তার বাবার মতন সিসের চৌবাচ্চার মধ্যে কাটে। নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্যে খানিকটা বাতাস সেখানে আসার মতন ব্যবস্থা থাকবে হয়তো, কিন্তু আর কিছু না। নোংরামি, কদর্যতা, গ্লানি, ইতরতা ছাড়া কুমকুম আর কিছু পাবে না। স্নেহ, ভালবাসা, কোমলতা–এসব কিছু নয়। অথচ ললিতা কুমকুমকে ছাড়ল না। অবনীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। যে-কোনও মূল্যে সে বুঝি তখন মুক্তি চায়। ললিতাই শেষ পর্যন্ত জিতে গেলে।
.
কমলেশের জবাব আসতে সামান্য দেরি হল।
কমলেশ লিখেছে, সে কলকাতায় ছিল না, দিন তিনেকের জন্যে পুরী গিয়েছিল, ফিরে এসে অবনীর চিঠি পেয়েছে। পেয়ে ললিতাদের বাড়ি গিয়েছিল। প্রথম দিন ললিতার দেখা পায়নি, পরে আবার গিয়ে দেখা করেছে।
অনেক দিন পর ললিতাকে দেখলাম,কমলেশ লিখেছে, পাঁচ ছ মাস পরে। আগে পথে ঘাটে মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হত, আজকাল হয় না, আমি যে বাড়ি বদলেছি তা তো তুই জানিস। কুমকুমের কথা আগে বলি। এখন সে ভাল আছে, তবু শরীর খুব রুণ। তাকে আড়ালে যতটুকু বলার বলেছি, বেশি বলা উচিত হত না। জামা-টামা কিনে দিয়েছি, কিন্তু ললিতার কাছে একথা শুকোনো যায়নি যে, তোর কথা মতন আমি কিনে নিয়ে গিয়েছি। কুমকুমের ওপর ললিতা সন্দেহ করেনি, ভেবেছে তোর খেয়াল হওয়ায় তুই কিনে দিতে বলেছিস। ব্যাপারটা এর বেশি কিছু গড়ায়নি। ..ললিতার বিষয়ে কয়েকটা কথা জানাচ্ছি, তোর ইন্টারেস্ট থাক না থাক কথাটা জেনে রাখা উচিত। ললিতা আজকাল অবাঙালি এক সেলস ম্যানেজারের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় থাকে, সেখানে একটা চাকরিও করে শুনলাম। আমার খুবই সন্দেহ; ললিতা রীতিমতো মদটদ খেতে শুরু করেছে। তার চোখ মুখ দেখলে সেরকম মনে হয়, কথাবার্তা শুনলেও। শরীর ভেতরে ভেতরে নষ্ট হয়ে গেছে, ওপরে তা ঢাকা দিয়ে এ-সমস্ত ক্ষেত্রে মেয়েরা যা করে বেড়ায় তাই করে বেড়াচ্ছে। মেয়ের সম্পর্কে তার তেমন কোনও উৎসাহ নেই, দায়-দায়িত্বও দেখলাম না। মেয়ের ওপর যত্ন নিতে বলায় বলল, এর বেশি যত্ন নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেবার কথা আমি বলিনি–আমার পক্ষে সেটা বলা ভাল দেখাত না। …আমার মনে হয়, এ-বিষয়ে তোর নিজের কিছু লেখাই ভাল। তবে, ললিতার কাছে মেয়ে রাখা যে একেবারেই উচিত নয় তা আমি বলতে পারি। …এ ব্যাপারে যা ভাল হয় করিস।
কমলেশের চিঠি পড়ে অবনী বুঝতে পারল না, সে কী করবে, কী তার করা উচিত।
ললিতাকে চিঠি লিখতে তার আগ্রহ হল না। কমলেশের কাছে খবর পেয়েই যেন সে লিখছে এভাবে লেখা যেত, (কুমকুম আড়ালেই থাকত) কিন্তু অবনীর তেমন কোনও ইচ্ছাই হল না। ললিতার ওপর তার ঘৃণা আর নতুন করে বাড়ার কিছু নেই, সে মদ খাক, আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে শোয়া বসা করুক তাকে অবনীর কিছু আসে যায় না। এটা সে আগে করত, পরে করবে। ললিতার স্বভাব বদলাবে এমন প্রত্যাশা সে কখনও করবে না। ললিতার জন্যে তার মাথাব্যথা অনাবশ্যক। কিন্তু কুমকুম? কুমকুমের কী হবে?
হয় কুমকুমকে তার মার হাতে ছেড়ে দিতে হয়, যেভাবে ললিতা তাকে মানুষ করবে সেইভাবেই সে মানুষ হবে, (অবনী যেমন হয়েছিল। তবে, অবনীর মার সঙ্গে ললিতার তুলনা চলে না, অন্তত সন্তান পালন সম্পর্কে নয়) আর না হয়, কুমকুমকে ললিতার কাছ থেকে নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু কোথায় আনবে? এখানে? এখানে আনা কি সম্ভব? কে দেখবে তাকে? হঠাৎ তার মেয়ে এল কোথা থেকে এই রহস্য এখানের মানুষগুলোকে চঞ্চল ও উত্তেজিত করবে। কুমকুমকে পাঁচ রকম প্রশ্ন করবে লোকে। তা ছাড়া কুমকুম যে তার কাছে আসতে চাইবে এরই বা স্থিরতা কী! ললিতা নিশ্চয় সহজে মেয়েকে ছাড়তে চাইবে না।
অনেক ভেবে অবনী স্থির করল, এখন যেমন আছে কুমকুম তেমনই থাক। কমলেশ ললিতার সঙ্গে দেখা করার পর হয়তো ললিতা কিছু আঁচ করতে পারছে। সে যথেষ্ট চালাক। মেয়ে হারানোর অর্থ ললিতার মাসে মাসে বাঁধা রোজগার হারান। হয়তো সেটা সে অনুমান করে কুমকুমের ওপর কিছুটা নজর দেবে।
আরও কয়েক মাস দেখা যাক। যদি ললিতা না শুধরোয় তবে কুমকুমকে কোনও ভাল মিশনারি মেয়েদের হোস্টেলে রেখে দিতে হবে।
পরের চিঠিতে, অবনী স্থির করে নিল, কমলেশকে লিখতে হবে কলকাতার কোনও উকিলের কাছে গিয়ে ডিভোর্স সম্পর্কে পরামর্শ নিতে।
.
১৩.
সেদিন, রবিবারের বিকেলের দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে সুরেশ্বর ও হৈমন্তী এসে হাজির। সঙ্গে বিজলীবাবু। অবনী বারান্দায় বসে অফিসের কাগজ দেখছিল। ফটক খোলার শব্দে সামনে তাকিয়ে ওদের দেখল। উঠে গিয়ে অভ্যর্থনা করল, আসুন।
বিজলীবাবুই কথা বললেন প্রথম, মিত্তিরসাহেব কি অফিস নিয়ে বসেছিলেন নাকি?
না, না, একটা কাগজ দেখছিলাম।
সিঁড়িতে সুরেশ্বর আর বিজলীবাবু, সামান্য পেছনে হৈমন্তী। হৈমন্তী আশপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, গাছপালা, বাগান, বাড়ি। এর আগে সে কখনও এই বাড়িতে আসেনি।
বসার ঘরে এনে বসাতে চাইছিল অবনী, সুরেশ্বর বলল, এখন আর বেশিক্ষণ বসব না, আমার একটা কাজ সারার আছে; উমেশবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব; উনি কাল পাটনায় ফিরে যাচ্ছেন।
উমেশবাবুর পরিচয়টা এখানকার সকলে জানে, অবনীও জানে। ভদ্রলোক পাটনা হাইকোর্টে জজিয়তি করেছেন এক সময়, এখন অবসর-জীবন যাপন করেন। পাটনা শহরের দু পুরুষের বাস, ভাইবোন ছেলে সবাই কৃতিপুরুষ, সকলেই প্রায় পাটনায় থাকে। অভিজাত পরিবার, পাটনার গণ্যমান্য ব্যক্তি। শোনা যায়, দেবতুল্য মানুষ উমেশবাবু। পুজোর সময় এখানে আসেন, বাড়ি আছে, সপ্তাহ দুই থাকেন, তারপর আবার ফিরে যান। এই সময়টুকুর মধ্যে উচ্চনীচ ভেদে সকলের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় রক্ষা করেন, পাঁচজনের অনুরোধ-উপরোধ শোনেন, সাধ্যমতো উপকারও করেন। প্রবাসী বাঙালি বলেই বোধহয় বাঙালিপ্রীতি কিছুটা বেশি।
অবনীর সঙ্গে উমেশবাবুর পরিচয় নেই, সে কখনও পরিচিত হতে যায়নি, তার তেমন কোনও ইচ্ছেও হয়নি। সুরেশ্বর কেন উমেশবাবুর কাছে যাবে অবনী তা অনুমান করতে পারল। উমেশবাবু সুরেশ্বরের বিশেষ অনুরাগী বলে সে শুনেছে, তা ছাড়া উমেশবাবু পাটনার সরকারি মহলে বলে কয়ে সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রমের জন্যে কোনও কোনও বিষয়ে সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
মহিন্দরকে ডেকে অবনী বাইরে আরও চেয়ার দিতে বলল।
বিজলীবাবু বললেন, আমি বলি কি, উঠব উঠব মন নিয়ে বসার চেয়ে কাজটা সেরে এসে হাত পা ছড়িয়ে বসাই ভাল। বিকেলও তো যাই-যাই করছে। বলে তিনি সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকালেন।
মনে হল সুরেশ্বরেরও সেই রকম ইচ্ছে। অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল, বিকেলের বাসে এসেছি, বিজলীবাবুর বাড়িতে না বসে এলে উনি আমাদের দিকের বাস বন্ধ করে দেবেন বলে শাসিয়েছিলেন–
সুরেশ্বর হাসল। হাতে খুব একটা সময়ও নেই, সন্ধের বাসে ফিরব। আমরা বরং দেখা করেই আসি। হেম বসুক।
অবনী বলল, বসুন, ফেরার জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না।
সুরেশ্বর অনুমান করতে পারল অবনী কী বলতে চায়।
না, আমাদের পৌঁছে দিতে আবার আপনি গাড়ি নিয়ে যাবেন, তা হয় না; অকারণ কষ্ট…
কষ্টর কিছুনা। আমিও হয়তো যেতাম আজ। বলে অসতর্কভাবে হৈমন্তীর দিকে তাকাল পলকের জন্যে।
বিজলীবাবু বললেন, আপনি এমন করেন মহারাজ, যেন জলে পড়েছেন। আমরা তো রয়েছি, সন্ধের বাস ধরার জন্যে অত উতলা হচ্ছেন কেন!
সুরেশ্বর একটু ভাবল, বলল, তা হলে কাজটা সেরে এসে বসি। উমেশবাবু কাল চলে যাবেন, বাড়িতে লোকজনের ভিড় থাকতে পারে।
সামান্য বসে সুরেশ্বর ও বিজলীবাবু চলে গেলেন।
হৈমন্তীর সঙ্গে বিশেষ কোনও কথাবার্তা এতক্ষণ হয়নি, এবার অবনী বেতের চেয়ারটা একটু পিছন দিকে সরিয়ে হৈমন্তীর মুখোমুখি হয়ে হেসে বলল, বলুন, তারপর আপনার খবর কী? কেমন বেড়ানো হল?
বেড়ানো কোথায়, বাড়ি ঘুরে এলাম, হৈমন্তীও হাসিমুখে জবাব দিল।
আপনি ফিরেছেন শুনেছি, কিন্তু গত সপ্তাহটা অফিসের কাজে নিশ্বাস ফেলার সময় পাইনি। গাধার মতন খাঁটিয়ে নিয়েছে। নতুন একটা কনস্ট্রাকশানের কথা চলছে, দুবেলা বিশ বাইশ মাইল ছুটোছুটি। …চাকরি জিনিসটা বড় হিউমেলেটিং। ..যাকগে, আপনার খবরাখবর বলুন। একদিন আপনাদের ওখানে গিয়েছিলাম।
শুনেছি, মালিনী বলেছে।
কিছুই নয়, তবু মালিনীর নামে অবনী কেমন অপ্রস্তুত বোধ করল। সেদিন ঠিক কী মানসিক অবস্থায়, কতটা হুঁশ হারিয়ে হৈমন্তীর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মালিনী জানে না। সে অবনীকে কী ভাবে দেখেছে, কী মনে করেছে কে জানে! অবনী বুঝতে পারল না, মালিনী হৈমন্তীকে আরও কিছু বলেছে কিনা।
অবনী সামান্য চুপ করে থেকে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলল, কেমন লাগল কলকাতা?
কেমন আর লাগবে, যেমন লাগে হৈমন্তী ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল।
এই জঙ্গল থেকে হঠাৎ কলকাতায় গিয়ে খানিকটা অন্য রকম লাগার কথা।
তা লেগেছে; ভালই লেগেছে।
এখানে ফিরে এসে এখন কেমন লাগছে? অবনী ঠাট্টা করেই বলল।
আগের মতনই।
আপনাকে কিন্তু এবারে একটু অন্য রকম দেখাচ্ছে।
তাই নাকি? কী রকম? হৈমন্তী চোখের পাতা তুলে বলল।
কী রকম…! মানে…বেশ খানিকটা রিফ্রেশড দেখাচ্ছে।
ও। হৈমন্তী অল্প একটু হেসে থেমে গেল।
চাকরে চায়ের ট্রে দিয়ে গেল, বিস্কিট, ডিম, মিষ্টি। হৈমন্তী তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে না না করল। খাবার না, বিজলীবাবুর বাড়িতে ওঁর স্ত্রী এমন করে পেড়াপেড়ি করলেন…সত্যি, আমি কিছু আর খেতে পারব না।
বিজয়ার পর মিষ্টিমুখ করতে হয়, করাতেও হয়। হয় না? অবনী সরলভাবে হেসে হেসে বলল, ছেলেমানুষের মতন অনেকটা।
এখন আর বিজয়া নেই; পূর্ণিমা পর্যন্ত থাকে– হৈমন্তীও সরল মধুর স্বরে বলল। কালীপুজো এসে পড়ল, তা জানেন?
কিছু একটা হাতে নিন, আতিথ্যে বদনাম হবে।
তবে একটা বিস্কিট নিলাম—
তাই নিন অবনী সম্মতি দিল। সে চা ঢালতে যাচ্ছিল, হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে দিল।
আমায় দিন, আমি ঢালছি। হৈমন্তী চেয়ারটা সামান্য এগিয়ে নিল।
চায়ে দুধ চিনি মেশাতে মেশাতে হৈমন্তী বলল, আপনার বাড়িটা বেশ, আমার খুব ভাল লাগছে।
আমার বাড়ি কোথায়? ভাড়া বাড়ি। অবনী কৌতুক করে বলল।
কলকাতায় আমাদের বাড়িতে এখানের নানান রকম গল্প হত– হৈমন্তী যেন অবনীর কথাটা কানেই তুলল না, বলল, আমার ছোট ভাই বলেছে সে দেওয়ালির সময় সপ্তাহ খানেকের ছুটি নিয়ে বেড়াতে আসবে। তার ধারণা, আপনার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললে বনে জঙ্গলে বেড়িয়ে শিকারটিকার করা যাবে। আপনি কি শিকার-টিকার করেন নাকি?
শিকার! না।
আমি কিন্তু বলিনি আপনি শিকারি… হৈমন্তী চায়ের পেয়ালায় অল্প করে চুমুক দিয়ে হেসে বলল।
ছেলেবেলায় এয়ারগান ছাড়া আমি জীবনে বন্দুক ধরিনি, অবনী চায়ের পেয়ালা নেবার আগে সিগারেট ধরাল।
হৈমন্তী হাসছিল। অবনীর চোখে চোখ রেখে কেমন যেন স্বচ্ছ অথচ ঈষৎ চাপা হাসি। এই হাসির অর্থ কী? অবনী কেমন অস্বস্তি বোধ করল।
আমাকে কি শিকারির মতন দেখায়? অবনী হৈমন্তীর দৃষ্টি এবং হাসি লক্ষ করতে করতে বলল।
হৈমন্তী চোখের পাতা নামাল, মুখ নিচু করে পেয়ালার ওপর ঠোঁট ছুঁইয়ে মাথা নাড়ল, এত আস্তে যেন হ্যাঁ বা না বোঝা গেল না। তারপর যখন মুখ তুলল তখন তার সারা মুখে পরিষ্কার ঝকঝকে হাসি, নম্র, সুন্দর, শালীন, ও আন্তরিক সহাস্য দৃষ্টি।
অবনী এই দৃষ্টি থেকে অনুভব করতে পারল, হৈমন্তীর মধ্যে কোনও চাতুরি ছিল না। সে বাস্তবিকই কিছু মনে করে কথাটা বলেনি। অবনীর সঙ্গে যেন সহজ প্রীতিপূর্ণ আলাপেই তার আকাঙ্ক্ষা ছিল, এখনও রয়েছে।
চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়ে চা খেতে খেতে অনী হেসে বলল, আপনার ভাই এলে আমি পাখি শিকারের ব্যবস্থা করে দিতে পারি; সেরকম লোক পাওয়া যাবে।
হৈমন্তী আর ও-প্রসঙ্গে গেল না। বলল, ভাল কথা, আপনার কাছে বই-টই আছে? গল্পটল্পের বই?
দুচারখানা থাকতে পারে। …তবে একরাশ ক্রাইম ফিকশান আছে।
ক্রাইম…আপনি বুঝি ক্রাইমের খুব ভক্ত? হৈমন্তী দাঁত ঠোঁট টিপে রহস্য করে বলল।
অবনী দেখল, কী ভাবল, হেসে বলল, আমাকে কি ক্রিমিন্যাল মনে হচ্ছে?
হৈমন্তী তাড়াতাড়িতে ছেলেমানুষের মতন জিব কেটে ফেলল, ছি! সে কী! তারপর হাসিমুখে বলল, আমি ক্রাইম বেশি পড়িনি। একটু আধটু। তবে এবার পড়তে হবে। সময় কাটানোর একটা কিছু চাই তো। ..জানেন, আমি একটা রেডিয়ো এনেছি, ব্যাটারি সেট… বলে বুঝি হৈমন্তীর মনে পড়ল শেষ কথাটা বলা বাহুল্য হল; হেসে ফেলল।
অবনী কিছুটা বিস্ময়ে কিছুটা প্রসন্ন মনে হৈমন্তীকে দেখছিল। কলকাতা থেকে ফিরে হৈমন্তী যেন কোনও এক আড়ষ্টতা বা বাধা ঘুচিয়ে ফেলেছে। সেই গাম্ভীর্য দূর-দূর ভাবটা তেমন নজরে পড়ছে না। সম্ভবত, হৈমন্তী এতদিন স্পষ্ট করে কোনও সাহচর্যের প্রয়োজন অনুভব করেনি, এখন সময় কাটাবার জন্যে, কথা বলার জন্যে, কারও সামনে দু দণ্ড বসে থাকার জন্যে তার কিছু চাই। রেডিয়ো, বই ইত্যাদির মতন বা এর অতিরিক্ত কিছু, কোনও সঙ্গী, বন্ধু।
অবনী হেসে বলল, আপনাকে আগে দেখলে আমার সব সময় ডাক্তার ডাক্তার মনে হত। এখন
হৈমন্তী চোখের তারায় ঈষৎ গাম্ভীর্য মিশিয়ে শুধোল, এখন কী মনে হয়?
কী বলবে না বলবে ভাবতে ভাবতে অবনী বলল, ঠিক ডাক্তার মনে হয় না। তারপর কেমন যেন বিব্রত হল, শেষে বলল, এখন চেনাজানা বন্ধুর মতন লাগে।
হৈমন্তী সরল শান্ত হাসিমুখে অবনীর মুখ দেখছিল।
হৈমন্তীরা যখন এসেছিল, তখন কদমগাছের মাথায় ফিকে রোদ ছিল, সেই রোদ এখন অদৃশ্য। আকাশতলায় নদীর জলের মতন মলিন আলোর একটি স্রোত বইছে, কার্তিকের প্রায় শেষ, হেমন্তের কেমন গন্ধ ফুটেছে বৃক্ষলতায়, শূন্যে ক্রমশ ধূসরতা জমে আসছিল। দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে যাবে।
চা খাওয়া কখন শেষ হয়েছে হৈমন্তীর। বাগানের দিকে মুখ করে বসে ছিল। কদমগাছের ডালে পাখির ঝাঁক এসে বসেছিল, উড়ে গেল কিছু কিছু থেকে গেল।
অবনী চুপচাপ হয়ে গেছে। হৈমন্তীকে দেখছিল মাঝে মাঝে। হৈমন্তী আজ হালকা রঙের শাড়ি পরে এসেছে, ফিকে কমলা; গায়ের জামাটিও কমলা রঙের, একটু গাঢ়। মাথায় এলো খোঁপা। তার গলা, ঘাড়ের সামান্য দেখা যাচ্ছিল, গলায় সরু হার, কানে দুটি নীল পাথর। হৈমন্তীর সমস্ত সজ্জা পরিচ্ছন্ন, পরিমিত।
বাগানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাবার সময় অবনীর সঙ্গে চোখাচুখি হল হৈমন্তীর, একটু থেমে বলল, এখানে এসে বোঝা যাচ্ছে, শীত আসছে।
কালীপুজোর সময় থেকেই শীত পড়ে যায়– অবনী বলল, নভেম্বরের শেষে বেশ শীত।
শীত আমার ভালই লাগে।
কলকাতার শীত-বাবু-শীত। অবনী হেসে বলল।
কলকাতার শীত কেন, আমি শীতের সময় বাইরেও থেকেছি। হৈমন্তী কথাটা বলে ফেলে বুঝল, সে একথাটি না বললেও পারত; সতর্ক হল।
কোথায়?
সামান্য ইতস্তত করল হৈমন্তী, তারপর বলল, ছিলাম। …কলকাতার কাছাকাছি।
অবনী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
হৈমন্তী হাতঘড়ি দেখল। ছটা বাজতে চলল, ওঁরা তো আসছেন না।
উমেশবাবুর বাড়ি খানিকটা দুর। দেখা করতে গিয়ে হয়তো কথাবার্তা বলছেন।
আপনি ভদ্রলোককে চেনেন?
দেখেছি, আলাপ নেই।
হৈমন্তী কয়েক মুহূর্ত কী যেন দেখল অবনীর, তারপর কৌতূহল প্রকাশ করল, আপনার সঙ্গে এখানকার লোকজনদের তেমন মেলামেশা নেই, না?
অবনী কোনও জবাব দিতে পারল না, পরে বলল, কিছু কিছু আছে।
আপনি বোধহয় তেমন আলাপি নন হৈমন্তী হেসেই বলল, আপনার খুব বদনাম।
অবনী চমকে উঠল না, কিন্তু বিস্ময় বোধ করল।
হৈমন্তী বলল, লোকে আপনাকে ভয় পায়। অহঙ্কারি মনে করে। করে না?
মালিনী বলেছে?
শুনি তো সে রকম, হৈমন্তী সরল গলায় বলল। কী মনে পড়ায় আবার বলল, মালিনী আপনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ। তার ভাইকে আপনি কী যেন করে দিয়েছেন, মাইনে বেশ কিছু বেড়ে গেছে।
ছেলেটি বোকা, কিন্তু ভাল।
ভাল কথা, শুনলুম, আপনি বদলি হয়ে যাচ্ছেন নাকি?
এ-খবরও নিশ্চয় মালিনীর?
একা সে-বেচারিকে দোষ দিচ্ছেন কেন?
অবনী অনুমান করে নিল, বিজলীবাবু মারফত কথাটা সুরেশ্বরের কানে উঠেছে। হয়তো সুরেশ্বরও বলেছে হৈমন্তীকে। সুরেশ্বরের আশ্রমে সে কী আজকাল আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে? বিজলীবাবু কী অবনী সম্পর্কে আরও কোনও সংবাদ দিয়েছেন। বিজলীবাবুর ওপর অবনী অসীম বিরক্তি অনুভব করল।
বদলির কথা ঠিক নয়–অবনী বলল, অন্য একটা কথা হচ্ছিল; সেটা হলে আমায় অন্য জায়গায় যেতে হবে।
শুনেছি। হায়ার পোস্ট।
তবে তো সবই শুনেছেন। …আমায় নিয়ে এত আলোচনা হয় নাকি?
না, কথা উঠলে ওঠে।
অবনী আর কিছু বলল না। তার ভাল লাগছিল না।
উভয়ে আবার নীরব হল। দেখতে দেখতে ধূসরতা গাঢ় হয়ে সিস-পেনসিলের দাগের মতন অন্ধকার জমছে। আলো মুছে এল। রাস্তা দিয়ে কারা যেন বকবক করতে করতে চলে গেছে। বারান্দা অন্ধকার হয়ে এল।
আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অবনী বলল, বাতিটা জ্বেলে দিই।
অবনী উঠে গিয়ে বাতি জ্বালল বারান্দার।
হৈমন্তী আলোর মধ্যে দুদণ্ড বসে থাকল। যেন সহসা এই ধূসরতা ও অস্পষ্টতা ঘুচে যাবার পর সে নিজেকে আলোর মধ্যে সইয়ে নিচ্ছে। আশ্রমের মিটমিটে আলোর তুলনায় এই আলো যেন অনেক সুন্দর, পরিষ্কার করে সব চোখে পড়ে। কলকাতার বাড়ির আলোও আবার এরকম নয়, সেখানে পথঘাট পাশের বাড়ি সর্বত্র থেকে আলো এসে নিজের বাড়ির আলোকে ভাসিয়ে দেয়, মনে হয় না নিভৃতে নিজের মতন করে একটু আলো জ্বালোম। এখানে, এই মুহূর্তে হৈমন্তীর এই আলোটুকু ভাল লাগল; ক্ষীণ নয়, অতি উজ্জ্বলও নয়; অতি অস্পষ্ট নয় আবার প্রকাশ্য নয়, নিভৃত অথচ আপন।
.
১৪.
দেখতে দেখতে দেওয়ালি পেরিয়ে শীত পড়ে গেল। শীতের এই শুরু এখানে অত্যন্ত মনোরম। আর্দ্রতার লেশমাত্র কোথাও নেই; আকাশ জুড়ে নীলের আভা, বাতাস শুকনো, সারারাত হিম আর শিশির ঝরে তৃণলতা বৃক্ষ যেটুকু সিক্ত হয় সকালের উজ্জ্বল রোদে তা শুকিয়ে গেলে সতেজ পরিচ্ছন্ন এক সবুজের দীপ্তি ফুটে ওঠে। এখনও উত্তরের বাতাস তেমন করে হানা দেয়নি, তবু শীতের দমকা এলোমেলো বাতাস বনের দিক থেকে মাঝে মাঝে ছুটে আসে, এনে শনশন শব্দ তুলে গাছ লতাপাতা বিশৃঙ্খল ও শিহরিত করে চলে যায়। গুরুডিয়ার শালবন এতদিন যেন ঘুমিয়ে ছিল, সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না। এখন প্রায় রোজই সকালে দু-চারটে বয়েলগাড়ি কাঁচা পথ উঁচু-নিচু মাঠ দিয়ে শালের জঙ্গলে চলে যায়, চাকার নিরবচ্ছিন্ন চিকন শব্দের সঙ্গে বয়েলের গলার ঘণ্টা বাজে ঠুং ঠুং তারপর সারা দুপুর বাতাসে কাঠুরেদের কাঠ কাটার শব্দ; কখনও কখনও সেই শব্দ স্তব্ধ দুপুরে অন্ধ আশ্রমেও ভেসে আসে। বিকেল পড়ে আসার আগে আগেই গাড়িগুলো ফিরে যায়। দু-তিন দিন ধরে ওরা শুধু গাছ কাটে, তারপর একদিন গাড়ি বোঝাই করে ফেরে। লুটোনো শালের শাখা-প্রশাখার পাতায় পথের ধুলো ওড়ে অল্প, মাটিতে আঁচড় লেগে থাকে।
বিকেল যেন দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়, গাঢ় রোদ ফিকে হয়ে আসার আগেই কেমন এক অবসন্ন ভাব। নরম আলো গায়ে মেখে পাখিরা বনের দিক থেকে ফিরতে শুরু করে, ছায়া জমতে থাকে আড়ালে; আমলকীর চারা, আতাগাছের ঝোপ দিয়ে জঙ্গলা ফড়িং, দু-চারটি প্রজাপতি তখনও বুঝি নাচানাচি করে; তারপর শীতের দমকা বাতাস এসে গাছ লতাপাতা সরসর শব্দ তুলে বয়ে গেলে মাঠ থেকে, গাছগাছালি থেকে শেষ আলোটুকু পালিয়ে যায়, অন্ধ-আশ্রমের সবজিবাগানের গন্ধ ভেসে আসে, সারের গন্ধ, মাটির গন্ধ এবং শীতের গন্ধ। গোধূলিটুকুও ফুটতে পারে না, ছায়া এবং অন্ধকার এসে সমস্ত কিছু ঢেকে ফেলে।
শীতের শুরুতেই অন্ধ আশ্রমের নতুন কয়েকটা কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। একটা নতুন কুয়ো খোঁড়ানো হচ্ছিল, কুয়ো খোঁড়ানো শেষ হলে সেটা বাঁধানো হল। নতুন একটা চালা তৈরি হচ্ছে একপাশে, আর-একটা তাঁত ঘর বসবে। রাঁচি থেকে তাঁত আসছে। সুরেশ্বর আর শিবনন্দনজি মিস্ত্রি মজুর, ইট কাঠ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত।
হৈমন্তীর এ-সব বিষয়ে কোনও আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না। তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা তফাতে আশ্রমের এই নতুন কাজগুলি দেখা যায়; হৈমন্তী দেখেছে অবশ্য, কিন্তু কোনও রকম উৎসাহ অনুভব করেনি। বরং কৌতুক অনুভব করেছে কেমন, মালিনীকে বলেছে, তাঁতের কাজটা তুমিও শিখে নিও, মালিনী।
মালিনী বুঝতে পারত হেমদি তাকে ঠাট্টা করছে। তার মনে হত, হেমদি আজকাল অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।
অবনী চোখে খুব একটা ভুল দেখেনি। কলকাতা যাবার আগে হৈমন্তী যা ছিল কলকাতা থেকে ফিরে ঠিক সেরকম ছিল না। তার কোথাও যেন কিছু হয়েছিল। সেটা কী–তা স্পষ্ট করে বোঝা যেত না। তবে হৈমন্তীর ব্যবহারের মধ্যে এই পরিবর্তনটা লক্ষ করা যেত। স্বভাবে সে প্রগলভা ছিল না, এখনও তার আচরণে বা কথাবার্তায় আতিশয্য ও চটুলতা নেই, তার সেই গাম্ভীর্য অটুট ছিল, নিজের কর্তব্য সম্পর্কে তার অবহেলা বা উদাসীনতাও দেখা যায়নি। তবু হৈমন্তী কোথাও যেন একটু বদলে গিয়েছিল। মালিনী যেন স্পষ্ট দেখত, হেমদি একটু অন্য রকম হয়ে গেছে। এতে তার সুবিধে বই অসুবিধে হয়নি। দুজনের মধ্যে সম্পর্কের একটা আড়াল আগে ছিল, মালিনী কখনও সেই বেড়া টপকাতে সাহস করেনি। এখন তার মনে হয়, সে সাহস তার হয়ে যাচ্ছে, চেষ্টা করলে সে বেড়া টপকাতে পারে। হয়তো হেমদি পছন্দ করবে না, কিন্তু কিছু বলবেও না।
আগের চেয়ে হেমদিকে এখন ভালই লাগছিল মালিনীর। আগে যেসব কথাবার্তা না বুঝে বলতে গিয়ে সে হেমদির কাছে চোখের ধমক খেয়েছে বা যেসব তুচ্ছ কথা ভাল লাগে বলে বলতে এসে হেমদির তরফ থেকে কোনও সাড়া পায়নি–এখন ভুল করে সেসব কথা বলে ফেললেও হেমদি দু-চারটে কথা বলে বা হাসে। মালিনী কোথাও যেন খানিকটা প্রশ্রয় পাচ্ছিল।
সেদিন হৈমন্তীর ঘরে বসে মালিনী নাটক শুনছিল। বাইরে দেখতে দেখতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। বিছানায় আধ-শোওয়া হয়ে হৈমন্তী ইংরাজি গল্পের বই পড়ছিল, মাথার কাছে সুন্দর একটা শেড দেওয়া বাতি জ্বলছে। হৈমন্তী এবার কলকাতা থেকে এটা এনেছে, লণ্ঠনের সেই মেটেমেটে আলোতে ঘরটা এ-রকম দেখাত না, কাচের সাদা শেড পরানো এই নতুন বাতিতে অনেক সুন্দর পরিষ্কার দেখাচ্ছে।
মালিনী রেডিয়োর সামনে ছোট একটি টুলে বসে। কোলে পশম, হাতে কাঁটা। নাটক শুনতে শুনতে তার পশম বোনা থেমে গিয়েছিল। হৈমন্তী তাকে কলকাতা থেকে উল এনে দিয়েছে, মালিনী বলেনি, নিজেই এনেছে হৈমন্তী, এনে নিজের হাতে নতুন একটা বোনা শিখিয়ে দিয়ে বলেছে, শীতের আগে শেষ করে ফেলল। গায়ে দেবে।
বোনা প্রায় শেষ, এতদিনে শেষ হয়েও যেত, কোথায় একটা গোলমাল হয়ে যাওয়ায় অনেকটা খুলে ফেলতে হয়েছিল, আবার বুনতে হচ্ছে। দু-একদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
নাটক যখন হচ্ছিল হৈমন্তী মাঝে মাঝে বই বন্ধ করে শুনছিল, আবার পড়ছিল। নাটক শেষ হয়ে যাবার মুখে বইটা বন্ধ করে বালিশের পাশে রেখে হৈমন্তী সোজা হয়ে বসল। তার পা ছড়ানো, হাঁটু গুটোনো, পিঠ সামান্য নোয়ানো, দুটি হাত দুপাশ থেকে হাঁটুর কাছে এসে আঙুলে আঙুলে জড়ানো। রেডিয়োর দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে শেষটা শুনছিল। মালিনীও শুনছে।
সামান্য পরেই নাটক শেষ হল। মালিনী এতক্ষণ যে নিশ্বাস চেপে রেখেছিল এবার শব্দ করে সেই নিশ্বাস ফেলল, মুখটি কয়েক মুহূর্ত কেমন অন্যমনস্ক দেখাল।
নাটকের পর কী যেন একটা শুরু হয়েছিল, হৈমন্তী রেডিয়ো বন্ধ করে দিতে বলল। মালিনী বন্ধ করে দিল। তাকে রেডিয়ো খুলতে বা বন্ধ করতে বললে মালিনী ছেলেমানুষের মতন এক সুখ পায়। হৈমন্তীর কাছে দেখে দেখে এ দুটো জিনিস সে শিখেছে।
হৈমন্তা ছোট করে হাই তুলল, তুলে আলস্য ভেঙে বিছানা থেকে নামল। তার গায়ে মেয়েলি, সাধারণ একটা শাল জড়ানো, শালের রংটি ঘন কালো। গায়ের সাদা শাড়ির ওপর কালোটি আরও প্রখর হয়ে ফুটছিল। হৈমন্তী আজ চুল বাঁধেনি, এলো করে ঘাড়ের কাছে জড়িয়ে রেখেছিল।
মালিনী কী যেন বলব বলব করছিল, কিন্তু চটিটা পায়ে গলিয়ে টর্চটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে হেমদি কলঘরে যাচ্ছে বলে এখন কিছু বলল না।
একটু পরেই হৈমন্তী ফিরে এল। ফিরে এসে বলল, বাইরে বেশ শীত পড়েছে।
মালিনী মাথা নাড়ল, যেন সে জানে বাইরে বেশ শীত
পড়েছে। হৈমন্তী আবার বিছানায় উঠে বসল।
মালিনী বলল, শেষটায় যে কী ছাই হল বুঝলাম না।
হৈমন্তী কথার জবাব না দিয়ে বালিশের ওপর থেকে বইটা আবার তুলে নিল।
মালিনী হৈমন্তীর জবাবের প্রত্যাশায় থেকে শেষে বলল, লোকটা কি পালিয়ে গেল?
পালিয়ে যাবে কেন, মরে গেল, গাড়ি চাপা পড়ে…
ও! ..কী জানি, আমি ভাবলাম পালিয়ে গেল।
তুমি ওই রকমই ভাব।
মালিনী অপ্রস্তুত হল না, লজ্জাও পেল না। বরং হেসে বলল, অত গাড়ির শব্দ চেঁচামেচিতে কি কিছু বোঝা যায়। তার ওপর খালি ইংরাজি বলছে।
হৈমন্তী বইয়ের পাতা হারিয়ে ফেলেছিল, খুঁজতে লাগল।
কথা বলার লোক সামনে থাকলে মালিনী বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। বলল, হেমদি, আমি এই রকম একজনের কথা জানি৷
হৈমন্তী তার হারানো পাতা খুঁজে পেল। রহস্যটা এখনও মাঝামাঝি অবস্থায়।
শ্রোতার মনোযোগর ওপর মালিনীর লক্ষ ছিল না, সে ঘটনাটা বলতে লাগল। অনেক দিন আগে, বুঝলেন হেমদি, আমরা তখন ছোট, এদিকে এত বাড়ি-টাড়িও হয়নি; তখনও লোকে পুজোর পর শীতের দিকে এখানে শরীর সারাতে আসত। একবার একজনরা এল–স্বামী স্ত্রী। দুজনেই দেখতে বেশ সুন্দর। খুব ঘুরত বেড়াত, হাটবাজার করত, কলের গান বাজাত; বউটা কত রকম করে যে সাজত! ওরা বলত শরীর সারাতে এসেছে। বেশ ছিল দুটিতে। হঠাৎ একদিন হই হই, ওদের বাড়ির সামনে কী ভিড়, পুলিশ-টুলিশ পর্যন্ত এসে পড়ল। ওমা, শেষে শুনলাম, ওই বউটা অন্য লোকের বউ, এর সঙ্গে চলে এসেছে; যার বউ সে খোঁজ পেয়ে হঠাৎ এসে হাজির। বাব্বা, সে কী কাণ্ড!
হৈমন্তী বইয়ের পাতা থেকে চোখ ওঠাল, মালিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, তার সঙ্গে এর কী?
একই তো, মালিনী অবাক হয়ে বলল, এও তো অন্য লোকের বউকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবার ফন্দি আঁটছিল।
হৈমন্তী বিরক্ত বোধ করলেও না হেসে পারল না। বলল, তুমি কিছু বুঝতে পারোনি। ভুলিয়ে নিয়ে যাবার ফন্দি কেউ আঁটেনি।
বারে, অতবার করে বলছিল।
বলেনি, লোকটা ভাবছিল। মনে মনে কী ভাবছে তা আমরা জানব কী করে, তাই মুখে বলছিল, ওটা ওর মনের ভাবনা।
মালিনী এবার যেন বুঝতে পারল, যদিও তাতে তার লাভ কিছু হল না। বলল, মনেই ভাবুক আর যাই করুক লোকটা খারাপ।
হৈমন্তী কৌতুক অনুভব করল। খারাপ তো সে কিছু করেনি।
খারাপ নয়! মালিনী চোখ বড় বড় করে তাকাল, তারপর বলল সব জেনেশুনে একজনের বউকে ঠকাচ্ছে, খারাপ নয়?
হৈমন্তী বুঝতে পারল মালিনীকে এই বিষয়টা তার পক্ষে বোঝানো মুশকিল। অনেক বকবক করতে হবে। বললেও মালিনী যে বুঝবে তা নয়। কতক সাদামাটা সরল ধারণা ও সংস্কার নিয়ে সে মানুষ হয়েছে, তাকে এত সহজে ভাল-মন্দের জটিলতা বোঝানো যাবে না। হৈমন্তী সে-চেষ্টা করল না, শুধু হেসে বলল, তুমি এসব বুঝবে না। নাও, চুপ করো। বইটা শেষ করি।
মালিনী চুপ করল। হৈমন্তী আবার বইয়ের পাতায় চোখ নামাল।
কয়েকটা লাইন পড়ল হৈমন্তী, কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও অস্বস্তি বোধ করছিল; যেন তার কিছু বলা উচিত ছিল মালিনীকে, সে বলেনি। বার বার এই উচিত বোধটা তাকে পীড়ন করছিল। হৈমন্তী অন্যমনস্ক হল, কী ভাবল সামান্য, আবার বইয়ের পাতায় মন বসাবার চেষ্টা করল। পারল না। কোথায় যেন খুঁত খুঁত করছিল। বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে মুখ তুলে হৈমন্তী প্রথমে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর মুখ ফিরিয়ে মালিনীকে দেখল। সে যা বলতে চায় তা মালিনীর কাছে বলতে বা আলোচনা করতে তার মর্যাদায় বাধছিল। মুখে আটকাচ্ছিল। আসলে নাটকের দ্বন্দ্বটা ভালবাসার। লোভ দুর্বলতা সত্ত্বেও যা ভালবাসাই।
মালিনী পশম-বোনা থেকে মুখ ওঠাতেই হৈমন্তীর সঙ্গে চোখাচুখি হল। হেমদি তার দিকে তাকিয়ে কী দেখছে বুঝতে না পেরে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
হৈমন্তী কেমন বিব্রত হল। চোখ সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হল না; বরং নিজের বিব্রত ভাবটা যাতে মালিনী ধরতে না পারে, জোর করে মুখে সামান্য হাসি টেনে হৈমন্তী কিছু চাপা দেবার জন্যে তাড়াতাড়ি বলল, তুমি আর কদিন লাগাবে ওটা শেষ করতে?
মালিনী পশমের বোনাটা তুলে দেখাল। হয়ে গেছে, গলার কাছটায় একটু বাকি। হাতও সেরে ফেলেছি।
শীতে পরতে পারলে হয়।
মালিনী এমন মুখ করে হাসল যেন মনে হল, হেমদি যে কী বলে! কতটুকু আর বাকি, দু-তিন দিনের মধ্যেই সব হয়ে যাবে। মালিনী কী ভেবে বলল, একটা কথা বলব, হেমদি?
না করলে কী তুমি বলবে না? হৈমন্তী কৌতুক করে হাসল।
এটা শেষ হয়ে গেলে প্রথমে আপনি পরবেন।
আমি?
পরবেন এক বেলা! …আমার খুব ভাল লাগবে।
তুমি পরলে যে আমার আরও ভাল লাগবে।
তা তো লাগবেই। আপনি আমার জন্যে এনেছেন। …আপনি একটু গায়ে দিলে আমার খুব আনন্দ হবে, হেমদি। আমি তো আপনাকে কখনও কিছু দিতে পারব না।
হৈমন্তী দুর্বলতা অনুভব করছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল। তুমি আজকাল বড় কথা বলতে শিখেছ।
মালিনীর চোখ দুটি স্নিগ্ধ সরল অথচ কত যেন কৃতজ্ঞের মতন দেখাল। মালিনী বলল, আমি কিছুই বলি না, হেমদি। আপনি রাগ করবেন ভেবে কিছু বলি না। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে। …একটা কথা বলব?
বলো।
এবারে কলকাতা থেকে এসে আপনি কেমন একটু হয়ে গেছেন। কেমন? হৈমন্তী মুখ টিপে হাসল।
আগে আমার মনে হত আপনি আমাদের এখানে বেশি দিন থাকবেন না, চলে যাবেন। এখন মনে হয় আপনি থাকবেন।
হৈমন্তী বুঝতে পারল না মালিনীর এ ধারণা কী করে হল। এমনকী সে স্পষ্ট বুঝতে পারল না, মালিনীর আগের কথার সঙ্গে পরের কথার সম্পর্ক কী!
হৈমন্তী বলল, কলকাতা থেকে এসে আমি কী হয়েছি তাই বলো।
মালিনী যেন কী বলবে বুঝতে পারল না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একমুখ হাসি নিয়ে বলল, আপনি আরও ভাল হয়েছেন। …আগে আপনাকে আমার ভয় ভয় করত, এখন তেমন করে না।
হৈমন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল, কেন?
বা রে, আপনি যে আমাদের–আমাকে ভালবাসেন।
হৈমন্তী মালিনীর চোখের দিকে তাকাল।
.
রাত্রে বিছানায় শুয়ে হৈমন্তী ভাবছিল; ভাবছিল কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর সকলেই তার পরিবর্তন দেখছে। এই পরিবর্তন যে স্পষ্ট কী তা তারা জানে না, হৈমন্তী জানে। এই পরিবর্তনের অনেকটা তার ইচ্ছাকৃত, কখনও কখনও জোর করে সে কিছু প্রমাণ করতে চায়। হয়তো দেওয়ালির সময় গগন এলে হৈমন্তীকে আরও কিছু করতে হত, তাতে ইতরবিশেষ তারতম্য কী ঘটত সে জানে না। দেওয়ালির সময় গগন আসতে পারল না। মার শরীর খারাপ হয়েছিল, জ্বরজ্বালা; মামার শরীরও ইদানীং তেমন ভাল যায় না। দুজনেরই বয়স হয়ে গেছে, দুশ্চিন্তা উদ্বেগ এমনিতেই থাকে, অসুখ-বিসুখ করলে ভাবনা বাড়ে। গগন আসতে পারেনি। লিখেছে ক্রিসমাসের সময় আসবে। সেই সময়টা আরও ভাল হবে বেড়াবার পক্ষে।
গগন এখানে ঠিক যে বেড়াতেই আসছে তা নয়। মার তরফ থেকে সে কিছু বোঝাপড়া সারতে আসছে সুরেশ্বরের সঙ্গে। এই বোঝাপড়া যে কী হতে পারে হৈমন্তী তা অনুমান করতে পারে। কিন্তু মাকে সে এসব কথা বলতে চায়নি, বলেনি। বলে লাভ হত না। মা ভাবত, হেম বরাবর যা করেছে এখনও তাই করতে চাইছে, নিজের ভালমন্দ, সংসারের উদ্বেগ দুশ্চিন্তার কথা না ভেবে নিজের জেদ আর ঝোঁক নিয়ে পড়ে আছে।
তা কিন্তু নয়। হৈমন্তী বরাবর জেদ ধরে কিছু করেনি। আজ সাত আট কী তারও বেশি–এতগুলো বছর জেদ ধরে বসে থাকা যায় না। জেদের কথা এটা নয়; সুরেশ্বরকে সুখী করার সব রকম চেষ্টা বরং। সুরেশ্বরের সাধ পূরণ করতে, তাকে তৃপ্ত করতে, তার প্রতি হেমের ভালবাসার জন্যে যা করার সে করেছে। তার অপেক্ষা যদি অকারণ হত অর্থহীন হত তবে সে এই অপেক্ষা করতে পারত না।
গুরুডিয়ায় এসে হৈমন্তী বুঝতে পেরেছে সুরেশ্বর তাকে অকারণে অপেক্ষা করিয়েছে। সুরেশ্বর এখন পূর্বের দুর্বলতা থেকে মুক্ত। কিন্তু সে দুর্বলতা না থাকলে সুরেশ্বর কোন অধিকারে তাকে এখানে টেনে আনল?
কলকাতায় গিয়ে হৈমন্তী তার মন স্থির করে ফেলেছিল। সুরেশ্বরের আশ্রম সে এখনই ছেড়ে আসবে না। মা বা মামার কাছে সে দেখাতে চায় না, হৈমন্তীর এতদিনের বিশ্বাস ও প্রেম ব্যর্থ হয়েছে। তা ছাড়া সুরেশ্বরের সঙ্গে তার মর্যাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সে হেরে যেতে চায় না। সে উপকৃত এবং কৃতজ্ঞ শুধুমাত্র এই বোধেই সে সুরেশ্বরকে কিছু প্রাপ্য দিচ্ছে এ যেন সুরেশ্বর অনুভব করতে পারে।
হৈমন্তী মনে মনে ভেবে নিয়েছিল; তার এই দীর্ঘ অপেক্ষা, বিশ্বাস ও ভালবাসার মূল্য যেমন সুরেশ্বরের কাছে নেই, তেমনই সুরেশ্বরের অন্ধসেবার কোনও মূল্য তার কাছে থাকতে পারে না। এই সেবা, দয়া, ধর্ম, পুণ্য–যাই হোক, তার জন্যে সুরেশ্বরের যত দুর্বলতাই থাক হৈমন্তীর থাকবে না। সুরেশ্বরের এই অতীব দুর্বলস্থানে হৈমন্তীর পরম অবহেলা ও উপেক্ষা থাকবে।
গুরুডিয়ায় ফিরে এসে হৈমন্তী তার বিমর্ষ ভাব আর প্রকাশ করছে না। যেন তার বিমর্ষতার কোনও কারণ থাকতে পারে না। সে নিস্পৃহ, আশ্রম তার কিছু নয়, তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই আশ্রমে, রোগী এলে দেখবে, তার কাজ হাসপাতালেই শেষ, তার বাইরে নয়–এই মনোভাবে তার ভাল লাগছিল। নিজের নিঃসঙ্গতার মধ্যে সে ডুবে থাকবে না। হয়তো হৈমন্তী তাও স্থির করে নিয়েছিল। একটি-দুটি নিজস্ব সঙ্গীও তার প্রয়োজন।
.
১৫.
অন্ধ হাসপাতালের কাজের বাঁধাধরা সময় বলে এতদিন কিছু ছিল না। থাকা সম্ভবও নয়। তবু ওরই মধ্যে মোটামুটি যে সময়টা ছিল সেটা সকালের দিকে, বেলা পর্যন্ত। দেহাত, গাঁ গ্রাম, আশেপাশের পঁচিশ-ত্রিশ মাইল এলাকা থেকে একে একে রোগী এসে জুটতে জুটতে বেলা হয়ে যেত। সকালের প্রথম বাসটা গুরুডিয়ায় আসে সাতটা নাগাদ, তারপর যেটা আসে সেটা এসে পৌঁছতে সাড়ে দশ, কোনও কোনওদিন এগারোটা। যেমন করেই আসুক, যাতেই আসুক, যারা চোখ দেখাতে আসত তারা নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে এসে পৌঁছতে পারত না, হেরফের হত। হাটের দিন ইদানীং যে রকম অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তাতে দুপুরেও রুগি আসত, দুপুরের পরও, হাটের পথেই যেন কাজটা সেরে যেত।
শীত পড়ে যাওয়ায় নানা রকম অসুবিধে হচ্ছিল। সকালের বাসে বড় কেউ এসে পৌঁছতে পারত, বাসের ভরসায় যারা বসে থাকত তাদের আসতে বড় বেলা হয়ে যেত। অন্য যারা-গোরুর গাড়িতে কিংবা লাঠটা থেকে হেঁটে আসত তারাও সব একে একে আসছে, যার যেমন সুবিধে। শীতের বেলা, দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে আসত। তার ওপর মোটামুটি কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন রোগী হলেও একটা কথা ছিল; এক একটি রোগীর পিছনে হৈমন্তীকে যে সময় ব্যয় করতে হত তাতে কলকাতার হাসপাতালে তিনটে রোগীর চোখ দেখা হয়ে যায়। দেহাতের মানুষ, যত সরল তত বোকা, আর অসম্ভব ভিতু। চোখের ওপর আলো ফেলার আগেই তাদের কী আতঙ্ক!
সাধারণত হাসপাতালের কাজ সেরে ফিরতে হৈমন্তীর দুপুর হয়ে যেতে লাগল। হাটের দিন দুপুরটাও তার হাসপাতালে কাটাতে হত। এক আধ দিন এমন হয়েছে–দুপুরের পর হৈমন্তী ফিরেছে, হঠাৎ হাটফেরত গরুর গাড়ি করে কেউ এল, ঠিক যেমন করে হাটের পর তারা বেচা-কেনার পয়সা নিয়ে স্টেশনের দোকানে সওদা করতে যায়।
স্বভাবতই, এই সব কারণে, হৈমন্তীর নানা রকম অসুবিধে হতে লাগল। স্নান খাওয়া, বিশ্রামের মোটামুটি একটা নিয়ম সে মানতে পারছিল না। অথচ দীর্ঘদিন সে এই অভ্যাস পালন করে আসছে। অসুখের পর থেকে এই ধরনের কোনও কোনও নিয়মে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, এবং এ বিষয়ে তার কিছু মানসিক দুর্বলতাও জন্মে গিয়েছিল।
একদিন দুপুরের পর, আর-একদিন হাটবারে বিকেল করে দুই রোগী আসায় সে ফিরিয়ে দিল, দেখল না। তারপর যুগলবাবুকে বলে দিল, সকাল আটটা থেকে বারোটার মধ্যে, আর হাটবারের দিন একটা পর্যন্ত যেসব রোগী আসবে শুধু তাদেরই দেখবে হৈমন্তী। এটাই হাসপাতালের নির্দিষ্ট সময়। সকলকেই এই নিয়ম মানতে হবে, যুগলবাবু যেন সকলকেই তা বুঝিয়ে দেন।
কথাটা সুরেশ্বরের কানে গেল। এর আগে রোগী ফিরিয়ে দেবার সংবাদও তার কানে গিয়েছিল। সুরেশ্বর হয়তো বিরক্ত হয়নি, কিন্তু কেন যেন ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, বিষয়টা নিয়ে হৈমন্তীর সঙ্গে তার কয়েকটা কথা হওয়া দরকার। আগে সন্ধের দিকে হৈমন্তী প্রায় রোজই তার ওখানে আসত, গল্প-টল্প করত; আস্তে আস্তে আসা-যাওয়া হৈমন্তী কমিয়ে দিয়েছিল। কিছুকাল ধরে সে বড় একটা আর আসছিল না। পুজোর পর কলকাতা থেকে ফিরে সে দু-চার বার এসেছে, কিন্তু ইদানীং একেবারেই নয়। সকালে কোনওদিন হাসপাতাল ঘরে, কোনওদিন রোগীদের ঘরের দিকে সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর দেখা হয়েছে। অন্ধ আশ্রমের নতুন কাজকর্ম নিয়ে সুরেশ্বর নিজেও খুব ব্যস্ত। আশ্রমের মধ্যে মাঠে ঘাটে দেখা হয়ে গেলেও তেমন কোনও কথাবার্তা দুজনের মধ্যে হয়নি। হৈমন্তীর সুবিধে-অসুবিধের কথা কিছু বলেনি হৈমন্তী।
সুরেশ্বর কথাটা বলার জন্যে হৈমন্তীকে ডেকে পাঠাতে পারত। কিন্তু সুরেশ্বরের যে ধরনের স্বভাব তাতে এধরনের কথাবার্তা বলার জন্যে হৈমন্তীকে ডেকে পাঠানো তার উচিত মনে হল না। তা ছাড়া, হৈমন্তীর ঘরের দিকে সে বড় একটা যায়নি কখনও। মাঝে মাঝে তারও যাওয়া উচিত।
সেদিন সন্ধেবেলা সুরেশ্বর হৈমন্তীর ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল।
হৈমন্তীর ঘরের দরজায় পরদা ঝুলছে, আলো জ্বলছে ভেতরে, রেডিয়োতে গান হচ্ছিল, মৃদু সুরে পুরুষালি গলায় কেউ গান গাইছে। কৃষ্ণপক্ষ, অগ্রহায়ণের শেয, বাইরে বেশ শীত।
সুরেশ্বর সামান্য সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানটি শুনছিল। এই গান তার বহুশ্রুত, কথাগুলি, এখনও মনে আছে, সুরও হয়তো ভুলে যায়নি সুরেশ্বর। শুনতে বড় ভাল লাগছিল সুরেশ্বরের।
গান শেষ হলে সুরেশ্বর ডাকল, হেম।
ঘরের মধ্যে মালিনী ছিল, সুরেশ্বরের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি দরজায় এসে পরদা সরাল। মালিনী যেন অবাক, সামান্য অপ্রস্তুত। সুরেশ্বরকে ভেতরে আসতে বলতে পারল না মালিনী, শুধু পরদাটা আরও তুলে ধরল।
সুরেশ্বর ঘরে ঢুকল।
হৈমন্তী বিছানার ওপর উঠে বসেছে, পায়ের দিকে একটা হালকা কম্বল ছিল, পাট ভাঙা; বোঝাই যায় পায়ের ওপর টেনে নিয়ে শুয়ে বা বসে ছিল।
বিছানা থেকে নেমে পড়ল হৈমন্তী। মালিনী বিব্রতভাবে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
জানলার দিকে চেয়ারের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে সুরেশ্বর বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানের শেষটুকু শুনছিলাম।
হৈমন্তীর বেশবাসে সামান্য অবিন্যস্তভাব ছিল; গায়ের আঁচলটা ঢিলেঢালা, তার ওপর ছোট হালকা শাল জড়ানো। কোমরের কাছে আঁচলের কাপড় অনেকটা ঝুলে আছে, কুঁচি দিয়ে শাড়ি না পরার জন্যে সামনে কোনও কোঁচ ছিল না। একেবারে সাধারণভাবে ঘরোয়া করে শাড়ি পরা। মাথায় উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। হৈমন্তীর চোখ মুখ, মাথার চুল শুকনো ও লালচে দেখাচ্ছিল।
নিজের অবিন্যস্ত ভাবটা শুধরে নিয়ে হৈমন্তী রেডিয়ো বন্ধ করে দিতে গেল। সুরেশ্বর বাধা দিল, বলল, থাক না; গানটা শুনি।
হৈমন্তী রেডিয়োর সামনে দাঁড়িয়ে, সুরেশ্বর জানলার কাছে চেয়ারটিতে বসেছে। বসে অল্প অস্বস্তিবোধ করে হাত বাড়িয়ে জানলার বন্ধ পাট খানিকটা খুলে দিল। বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ও শীত এল দমকা।
রেডিয়োতে গান হচ্ছিল; আমার মাঝে তোমার লীলা হবে..
সুরেশ্বর এভাবে আসবে, আচমকা, হৈমন্তী ভাবেনি। খুব কম, আঙুলে গুণেই বলা যায় হয়ত, সুরেশ্বর কদিন তার ঘরের বারান্দায় বা ঘরে পা দিয়েছে। এভাবে হুট করে এসে পড়ে হৈমন্তীকে যে খানিকটা বিব্রত করেছে সন্দেহ নেই। হৈমন্তীর শরীর ভাল নেই, বিছানায় পায়ের ওপর কম্বল দিয়ে শুয়ে ছিল, বইও পড়ছিল না আজ, মালিনী বসে ছিল, তার সঙ্গে গল্প করছিল।
হঠাৎ সুরেশ্বর এখানে কেন? কতক্ষণ বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে? এত মন দিয়ে গান শোনারই বা কী হল তার? …হৈমন্তী সুরেশ্বরকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল। সুরেশ্বর একমনে গান শুনছে। শীত এমন কিছু কমনয়, তবুসুরেশ্বরের গায়ে হাতকাটা ছোট একটা ফতুয়া ধরনের গরম জামা ছাড়া পশমের কিছু নেই। পায়ের চটিটাও দরজার কাছে খুলে এসে খালি পায়ে বসে আছে।
হৈমন্তী আরও কয়েক মূহুর্ত রেডিয়োর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পাশের টুলটার ওপর বসল, মালিনী সেখানে নিত্য বসে। তার ঠাণ্ডা লাগছিল, বিছানা ছেড়ে নীচে নেমে আসায় পায়ের পাতা কনকন করছিল।
গান শেষ হল। …কী একটা অন্য জিনিস শুরু হতেই রেডিয়োটা বন্ধ করে দিল হৈমন্তী।
সুরেশ্বর যেন খুবই পরিতৃপ্ত হয়েছে, মুখ জুড়ে স্মিত হাসি, গানের থেকেই একটা কলি আবৃত্তি করল; আনন্দময় তোমার এ সংসার, আমার কিছু আর বাকি না রবে।
হৈমন্তী সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকাল, চোখ লক্ষ করল।
সুরেশ্বর বলল, এ একটা ভাল ব্যবস্থা করেছ। মাঝে মাঝে তোমার এখানে এসে গান শুনে যাব।
একসময়ে সুরেশ্বরের সঙ্গীতপ্রীতি ছিল। নিজেও সে একটু আধটু চর্চা যে না করেছে এমন নয়। হৈমন্তীর এসব অজানা ছিল না। কিন্তু এখনও যে সুরেশ্বরের সঙ্গীতপ্রীতি আছে হৈমন্তীর তা জানা ছিল না। মালিনীর কাছে অবশ্য শুনেছে, সুরেশ্বরকে নাকি আপনমনে অনুচ্চ কণ্ঠে গান গাইতে কখনও কখনও শোনা যায়; তেমন ভাগ্য, সে গান শোনার ভাগ্য, হৈমন্তীর এখানে এসে পর্যন্ত যদিও হয়নি৷ হৈমন্তী মনে মনে কেমন উপহাস বোধ করল; অন্ধ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ-মহারাজ (বিজলীবাবু বেশ বলেন, হৈমন্তীর হাসি পায়) সাধারণ গানের ভক্ত এ যেন কেমন কথা!
সুরেশ্বর এবার বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে আগের গানটা শোনার সময় আমার মনে হল, এখনও যেন সুরটা মোটামুটি মনে আছে। .. বলে সুরেশ্বর দু মুহূর্ত থেমে যেন অত্যন্ত সারল্যে এবং খুশিতে মৃদু সুরে গাইল; সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। গেয়ে থেমে গেল।
হৈমন্তী অতিমাত্রায় বিস্মিত হল। অপলকে তাকিয়ে থাকল মানুষটির দিকে। গলা যেমনই হোক, সুরের ভুলচুক যাই ঘটুক তবু ওই মানুষ এখনও গান গাইতে পারল। লোকমুখে শুনলে বিশ্বাস হত না, কানে শুনেও যেন হৈমন্তীর বিশ্বাস হচ্ছিল না। সুরেশ্বর এক সময় এসব গান যে গাইত, হৈমন্তী জানে।
স্মৃতির মধ্যে ক্ষণিকের জন্যে সুরেশ্বরের সেই পুরনো চেহারাটি ফুটে উঠে আবার মিলিয়ে গেল।
সুরেশ্বর বলল, এই গানটা আমার মারও খুব পছন্দ ছিল। …তবু মার অহঙ্কার কোনওদিন ঘঘাচেনি।
হৈমন্তী গায়ের শাল আরও একটু ঘন করে নিল।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর ঘর দেখতে লাগল। ইদানীং আসা হয়নি ঘরে। বিছানার ওপর মোটা কভার, ছোট টেবিলে লেসের কাজকরা ঢাকনা, নতুন বাতি, জানলায় পরদা, একপাশে আলনা, বইপত্র সাজানো রয়েছে অন্য পাশে, কিছু বা একধারে পড়ে আছে।
দেখতে দেখতে সুরেশ্বর বলল, তোমার এই ঘরটায় কুলোচ্ছে না, না হেম?
হৈমন্তী প্রথমে কোনও জবাব দিল না; পরে বলল, হয়ে যাচ্ছে.. বলে কাশল। তার কাশির শব্দ কানে লাগে।
অসুবিধে হচ্ছে। হচ্ছে না?
তেমন কিছু না।
হৈমন্তীর চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সুরেশ্বর এবার বলল, তোমার শরীর খারাপ! গলা ভার ভার লাগছে।
নতুন শীত; ঠাণ্ডা লেগেছিল।
জ্বর হয়েছিল?
অল্প; ছেড়ে গেছে। হৈমন্তীর বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব নির্লিপ্ত, নিরুত্তাপ।
হৈমন্তীর চোখ মুখ লক্ষ করতে করতে সুরেশ্বর বলল, তোমার মুখটাও এখনও ফুলে রয়েছে। …ওভাবে জড়সড় হয়ে আছ কেন? শীত করছে?
হৈমন্তীর শীত করছিল। পায়ের পাতা দুটো কনকনে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে গা সিরসির করছে।
ওষুধপত্র কিছু খেয়েছ? সুরেশ্বর জিজ্ঞেস করল।
মাথা নোয়াল হৈমন্তী; খেয়েছে। তার শরীর অসুস্থ এটা যেন সুরেশ্বরের অনেক দেরিতে চোখে পড়েছে। মনে মনে হৈমন্তী বিরক্তি বোধ করল কেমন।
বিছানায় ছিলে, বিছানাতেই গিয়ে বোসো না। সুরেশ্বর বলল।
থাক।
তোমার শরীর খারাপ আমায় তত কেউ বলেনি।
বলার মতন কিছু না।
সুরেশ্বর যেন অন্যমনস্ক হল সামান্য। পরে বলল, এখানকার শীত সওয়া নেই তোমার; গোড়ায় ঠাণ্ডা-ফাণ্ডা লাগবে, সইয়ে নিতে হবে ধীরে ধীরে।
এমন সময় মালিনী এল। দুকাপ চা নিয়ে এসেছে। এটা তার নিজের বুদ্ধিতে ঠিক নয়, খানিকটা আগে হৈমন্তী তাকে চায়ের কথা বলেছিল, সুরেশ্বর আসার আগেই। সাধারণত এসময় একবার ওরা চা খায়। তা ছাড়া হৈমন্তীর গলা অল্প ব্যথা ব্যথা করছিল, মাথাও সামান্য ধরে আছে।
সুরেশ্বর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হেসে মালিনীকে বলল, খাতির নাকি?
মালিনী সঙ্কুচিত হল। বলল, হেমদি আগেই চা খেতে চেয়েছিলেন।
ও! …তা রোজ বুঝি গানবাজনা শোনা হচ্ছে?
মালিনী নিচু মুখে সামান্য মাথা হেলাল।
হেমের শরীর খারাপ আমায় বলোনি তো?
মালিনী চুপ। হেমদি সম্পর্কে দু-একটা কথা আগে সে সুরেশ্বরকে বলত। হেমদি জানতে পেরে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিল। হেমদির সর্দিজ্বরের কথাটা অবশ্য সে একবার ভেবেছিল সুরেশ্বরকে বলবে, তারপর আর বলা হয়ে ওঠেনি, জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল বলেই বোধ হয়।
হৈমন্তীর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে মালিনী চলে গেল আস্তে আস্তে।
চা খেতে খেতে সুরেশ্বর আবার হৈমন্তীকে বিছানায় গিয়ে বসতে বলল। হৈমন্তী উঠল না, এক সময়ে, দিনের পর দিন সুরেশ্বরের চোখের সামনে সে বিছানায় শুয়ে বসে থেকেছে, সুরেশ্বর তার মাথার কাছে কখনও, কখনও বালিশের পাশে বিছানায় বসে থেকেছে। আজ হৈমন্তীর সে বয়েস নেই, সেই অবস্থাও না।
সুরেশ্বর এবার কথাটা তুলল, হেম, তোমার সঙ্গে একটা কথা আলোচনা করতে এলাম। কিন্তু তুমি ওভাবে বসে থাকলে বলি কী করে! …তোমায় ওই কম্বলটা এনে দেব?
সমস্ত ব্যাপারে সুরেশ্বরের এই নম্র, মধুর, শিষ্ট কথাবার্তা ও আচরণ একসময়ে হৈমন্তীর পছন্দ হত। এখন হয় না। এখন মনে হয় এ এক ধরনের কৃত্রিমতা, মানুষকে মোহিত করার, বশ করার কৌশল। হৈমন্তী সন্দিগ্ধ হল। হঠাৎ সুরেশ্বরের এখানে আসা, এসে খুশি মনে গান শোনা, গান শুনে নিজেও কৌতুক করে একটু গান গাওয়া, তারপর ক্রমে ক্রমে অবস্থাটা সইয়ে নিয়ে বলা–হেম তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে এলাম–এর অর্থটা কী? কীসের আলোচনা?
হৈমন্তী নিতান্ত বাধ্য হয়ে বিছানার ধারে গিয়ে বসল, বসে কোলের ওপর দিয়ে কম্বলটা পায়ে চাপা দিল।
সুরেশ্বর বলল, শুনলাম তুমি হাসপাতালে চোখ দেখানোর একটা বাঁধাবাঁধি সময় করে দিয়েছ?
হৈমন্তী তাকাল, স্থির চোখ রেখে সুরেশ্বরের মুখভাব দেখল। তা হলে এই? হাসপাতালের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে এসেছে? …জানতাম তুমি আসবে, মনে মনে ভাবল হৈমন্তী, কৈফিয়ত চাইতে আসবে।
হ্যাঁ, সময় বেঁধে দিয়েছি, হৈমন্তী বলল।
সুরেশ্বর শান্তভাবেই বলল, তোমার যে খুব অসুবিধে হচ্ছিলতা বুঝতেই পারছি। কিন্তু, আমি বলছিলাম, ওদের কথা ভেবে অন্য কিছু করা যায় না? সুরেশ্বর এমনভাবে বলল যেন মতামত চাইছে। কিন্তু হৈমন্তী জানে মতামত নিতে সুরেশ্বর আসেনি, তার মতামত ব্যক্ত করতে এসেছে।
না, আর কিছু করা যায় না, হৈমন্তী শক্তভাবে বলল। মনে মনে যেন সে ঠিক করে নিয়েছে সে যা স্থির করেছে তার জন্যে শেষ পর্যন্ত শক্ত থাকবে।
সুরেশ্বর জোর গলায় কিছু বলল না, শান্ত গলায়, হৈমন্তীকে যেন বোঝাচ্ছে, নরম গলায়, প্রায় অনুরোধ করার মতন বলল, আমি জানি হেম, ওদের সময়জ্ঞানটা কম। কিন্তু তুমি তো জানোই কীভাবে সব আসে, কত দূর দূর থেকে। নানা,ঝঞ্জাট করে আসা, গাড়ি-টাড়ি পায় না ঠিক মতন।
হৈমন্তী বিরক্ত হল, কী বলতে চায় সুরেশ্বর? সারাটা দিন ওই রোগীদের নিয়ে তাকে থাকতে হবে নাকি? হৈমন্তী বলল, হাসপাতালের একটা নিয়ম থাকে।
থাকে, তবে সেসব হল শহরের হাসপাতাল। এটাকে তুমি সেভাবে ধরছ কেন?
কীভাবে ধরব?
তর্কের কথা নয়, হেম। আমি ওদের অসুবিধের কথা তোমায় জানাচ্ছি শুধু। তুমি যদি নিয়ম ঠিক করে দেবার আগে আমায় একবার জানাতে…
না জানিয়ে অন্যায় হয়েছে, হৈমন্তী বিরক্ত গলায় বলল, কিন্তু আমার পক্ষে হাসপাতালটাকে মেঠাইমণ্ডার দোকান করে রাখা সম্ভব না।
সুরেশ্বরের কপালে কয়েকটা রেখা ফুটে উঠল। তুমি কি আমাদের হাসপাতালটাকে শহরের হাসপাতাল করে তুলতে চাও?
আমি কিছুই চাই না। সব জিনিসের একটা নিয়ম থাকা দরকার। আমি তোমার রোগীদের চাকর নই যে যখন তারা ডাকবে আমায় ছুটতে হবে। আমার স্নান, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রামের একটা সময় রাখা দরকার। হৈমন্তী উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।
সুরেশ্বর এবার কেমন ক্ষুব্ধ হল। বলল, কত দূর থেকে সেদিন দুজন এসেছিল তুমি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছ। নিজের সামান্য অসুবিধে করেও কী তুমি তাদের দেখতে পারতে না?
হৈমন্তীর আর সহ্য হল না। প্রচণ্ড বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঙ্গে বলল, না, পারতাম না। শীতের বেলা, আমি দেড়টা দুটোর সময় স্নান করে ভাত খেতে বসি। তার পরও তোমার রোগীরা যদি আসে, আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। তোমার রোগীরাই শুধু মানুষ নয়, আমিও মানুষ।
সুরেশ্বর কেমন যেন বিস্মিত হল। এমন রূঢ়, নির্মম, নির্দয় প্রত্যুত্তর যেন সে আশা করেনি। বলল, হেম, আমি কী তোমায় তোমার যা অসাধ্য তা করতে বলেছি? আমি শুধু বলতে এসেছিলাম, তোমার অসুবিধের কথা আমায় যদি জানাতে…
তোমায় জানাবার হলে জানাতাম।
সুরেশ্বর অবাক হল। হাসপাতালের ব্যাপারে আমায় তুমি জানাবে না…
না। হাসপাতালের রোগীদের আমি কখন দেখি, কী করে দেখি, কেন দেখি না–এসব তোমাকে জানানোর কোনও দরকার আমি মনে করি না। আমি ডাক্তার, আমার অধিকার যদি তুমি না মানো, তবে রোগী দেখা বন্ধ করে দেব।
সুরেশ্বর স্তব্ধ, নির্বাক বয়ে বসে থাকল।
৪. নীরবে কিছু সময়
১৬.
নীরবে কিছু সময় বসে থেকে সুরেশ্বর উঠল। তার মুখে না প্রসন্নতা, না অসন্তোষ বা বিরক্তি। স্মিত সরল হাসিও ছিল না; কেমন এক গাম্ভীর্য ঘন হয়ে উঠেছিল মুখে। এই গাম্ভীর্যে কোনও মানুষের ক্রোধ বা বিতৃষ্ণাও প্রকাশ করে না; মনে হয় অন্যমনস্কতাবশত এবং বেদনাজাত এক মালিন্য সৃষ্টি হয়েছে।
হৈমন্তীর ঘর থেকে শান্তভাবেই বিদায় নিয়ে সুরেশ্বর বাইরে চলে এল।
বাইরে শীত বেড়েছে। উত্তরের বাতাস এখনও তেমন করে বইতে শুরু করেনি। তবু আজ বাতাসে ধার ছিল, থেমে থেমে উত্তরের দমকা আসছিল। অগ্রহায়ণের শেষ, চারপাশে হিমের ধূসরতা জমছে, আকাশের তারাগুলি তেমন করে যেন জ্বলছে না। সুরেশ্বর ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল, যেন শীতের মধ্যে একা একা পায়চারি করছে।
হৈমন্তীর আজকের ব্যবহারে সে দুঃখিত, হয়তো ক্ষুব্ধ। তবু সুরেশ্বর হৈমন্তীর স্বপক্ষে চিন্তা করছিল। অপরের প্রতি বিরক্ত হওয়ার মধ্যে কৃতিত্ব বা কষ্ট কিছুই নেই যেন এই ধরনের মনোভাবের বশবর্তী হয়ে সে হৈমন্তীর প্রতি সহৃদয় হচ্ছিল এবং ভেবে দেখার চেষ্টা করছিল হৈমন্তী এতটা রূঢ় হল কেন।
হেম যে অসঙ্গত কিছু বলেছে তা হয়তো নয়, সুরেশ্বর ভাবছিল, হাসপাতাল আর মেঠাইমণ্ডার দোকান কখনও এক হতে পারে না। কলকাতার হাসপাতালে হেমের যা শিক্ষা তাতে সে নিয়মের বাইরে যেতে চায় না, হয়তো পারে না। হাসপাতালের বাঁধা নিয়ম সে রাখতে চায়। এতে দোষের কিছু নেই, বা তার পক্ষে অন্যায় কিছু হয়নি। তা ছাড়া, সুরেশ্বর নিজেও মনে করে, হেমের শরীর স্বাস্থ্যের ওপর লক্ষ রাখা উচিত, অনিয়ম ও অত্যধিক পরিশ্রম তার পক্ষে ক্ষতিকর।
কিন্তু, সুরেশ্বর ভাবল, হেম সহৃদয়তার সঙ্গে বিষয়টা বিবেচনা করতে কেন রাজি হল না? এই অনিচ্ছুক আচরণ তার কেন? যদি সে অত্যধিক পরিশ্রমের কথা তোলে তবে তার বিবেচনা করা উচিত ছিল, এখানে তা নিত্য হয় না, প্রত্যহ একরাশ রোগী এখানে চোখ দেখাতে আসছে না। সকালের দিকে দু-চারজন, বেলায় আরও কয়েকজন। মোটামুটি হিসেব নিলে হয়তো দেখা যাবে, সারাদিনে সাধারণভাবে আট দশজনের বেশি রোগী আসে না। হাটের দিন কিছু বাড়ে। তেমনি আবার মাঝে মাঝে সারাদিনে একটি দুটি রোগীর বেশিও যে হয় না।
হেমের এসব কথা ভাবা উচিত ছিল; ভাবতে পারত, কোনও কোনওদিন যেমন তার অত্যধিক পরিশ্রম হয়, কোনও কোনওদিন আবার তেমন তার হাতে প্রচুর সময় থাকে, বিশ্রাম পায়। তা ছাড়া একথা ঠিকই, এটা কোনও শহরগঞ্জ নয়, এখানে চোখ দেখাতে আসব বললেই আসা যায় না। আসা-যাওয়ার এই অসুবিধে তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে যে উপায়হীন হয়ে দেরিতে আসে হেম কী তা বোঝে না? না কী তা বিবেচনা করা তার দায় নয়?
সুরেশ্বর মনে করে না, বিষয়টা বা সমস্যাটা গুরুতর কিছু ছিল। সামান্য ব্যাপার, হয়তো তুচ্ছ ব্যাপার। হেম হাসপাতালের নিয়ম রাখতে চাইছে, রাখুক, কিন্তু তার বাঁধাধরা সময়ের সামান্য এদিক-ওদিক করেই তা করা যেত। সুরেশ্বর ভেবেছিল, হেমকে বলবে: তুমি বরং সকালের দিকটা আরও একটু আগে হাসপাতাল থেকে চলে এসে, স্নান খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম সেরে দুপুরে আবার একবার যেয়ো, বিকেল পর্যন্ত থেকো।
সুরেশ্বরের ধারণা, মোটামুটি এই নিয়মটাতে কারও অসুবিধে হবার কারণ নেই। যেসব রোগীর আসতে বেশ বেলা বয়ে যায়, তারা, আর যারা দুপুরের দিকে আসে তাদের হেম দুপুর-বিকেলে দেখতে পারে। হাটের দিন ছুটকো এক-আধজন অসময়ে এসে পড়লেও হেম তাদের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে।
শীতের মধ্যে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর নিজের ঘরের কাছে চলে এল।
হেম বড় অবুঝ হয়ে উঠেছে। সে তার কাজ এবং অধিকার নিয়ে আজ যা বলল তাতে সুরেশ্বর ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সুরেশ্বর বাস্তবিকই নিজের কোনও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যায়নি। হাসপাতালের ব্যাপারে নিজের মতামত চাপানোর কথাও সে ভাবেনি। তবু হেম ধরে নিল, সুরেশ্বর তার অধিকার দেখাতে এসেছে। …আমার আশ্রম, আমার হাসপাতাল, আমার কথা মতন কাজ হবে–ঠিক এই ধরনের মনোভাব কি সুরেশ্বর কোথাও প্রকাশ করেছে? জ্ঞানত করেনি, অজ্ঞানত যদি করে থাকে সে জানে না। হেমকে সুরেশ্বর ডেকে পর্যন্ত পাঠায়নি, নিজে এসেছিল, কোনও কৈফিয়ত চায়নি, রূঢ় কথা বলেনি। তবু হেম তাকে অন্যরকম ভাবল।
কিন্তু…, সুরেশ্বর এখন কোথাও যেন অদ্ভুত এক পীড়ন বোধ করল। অনুভব করল, হৈমন্তীর শেষ কথাটা তার অহঙ্কারে লেগেছে। এর আগে কখনও কেউ সুরেশ্বরকে এভাবে বলেনি, বা বোঝবার অবকাশ দেয়নি যে, সুরেশ্বর এই আশ্রমকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে। হেম ঘুরিয়ে সেকথা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। বলতে চেয়েছে, তার অধিকারের সীমা সুরেশ্বর লঙ্ঘন করতে গিয়েছিল।
আশ্চর্য! আজ চার বছর তো সুরেশ্বরের একথা মনে হয়নি, আশ্রমের ওপর সে কর্তৃত্ব করার আনন্দ পেতে চায়। বা এমনও তার মনে হয়নি, এই আশ্রমের সঙ্গে তার অদ্ভুত এক অহঙ্কার জড়িয়ে আছে, এবং নিজের অধিকার সে যত্রতত্র প্রয়োগ করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এই আশ্রম আমার, আমি এর মালিক, আমায় তোমাদের মান্য করা উচিত–এ-ধরনের নোংরা, বিশ্রী চিন্তা ও আত্মসন্তুষ্টির ভাব সুরেশ্বরের কোনওদিন কি হয়েছে।
মাথা নাড়ল সুরেশ্বর, না তার মনে এমন কোনও অহং-বোধ নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে কোথায় যেন কাতর হল এবং ভাবল, যদি এই বোধ আমার না থাকে তবে হেমের কথায় বিচলিত হলাম কেন? কেন আমার তখন মনে হয়েছিল, কী স্পর্ধা হেমের, কী স্পর্ধা! যদিও আমি তখন স্তম্ভিত নির্বাক ছিলাম, কিন্তু আমার মনের মধ্যে কে যেন হঠাৎ বিশ্রীভাবে আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিল, জ্বালা করছিল; কেমন এক তপ্ত রোষ আমার চোখে ও মুখে এসে পড়েছিল। আমি সংযত থাকার চেষ্টা করেছি, হয়তো পারিনি, হেম আমার চোখ মুখের ভাব দেখতে পেয়েছে।
কেমন এমন হয়, কেন? সুরেশ্বর যেন গ্লানি অনুভব করছিল। মাথা মুখ নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠল।
নিজের সমর্থনে তার যুক্তি নেই এমন নয়। হেমের সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে অগ্রাহ্যের ভাব ছিল, নির্দয়তা ছিল; অবিবেচনা ও অন্যায়ের জন্যে হেমের ওপর তার বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। সুরেশ্বর এই ধরনের রূঢ়তা প্রত্যাশা করেনি। তবু, সুরেশ্বরের মনে হল-সে হেমের কাছে তার কর্তৃত্ব প্রকাশ করে ফেলেছিল। সুরেশ্বর বলেছিল: হাসপাতালের কথা আমায় জানাবে না…? বাকিটা বলেনি, কিন্তু বোঝাই যায় সুরেশ্বর বলতে চেয়েছিল, আশ্রমের কোথায় কী হয়, কী হচ্ছে, কী হবে–সবই তাকে জানানো দরকার; তাকে না জানিয়ে তার মতামত না নিয়ে কিছু হতে পারে না। হেম সুরেশ্বরের এই প্রভুত্ব অথবা কর্তৃত্বের রূপটি ধরতে পেরেছে, পেরেছে বলেই সমান উদ্ধত হয়ে তার অধিকারের কথা তুলেছে।
ঘরে এসে বসল সুরেশ্বর। লণ্ঠনের আলো তেমন উজ্জ্বল নয়। ঘর প্রায় আবছা অন্ধকার হয়ে আছে, কনকন করছে ঠাণ্ডা, ভরতু একটা বই অন্য জানলা বন্ধ করেনি ঘরের, জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
কেমন যেন অপরাধীর মতন বসে থাকল সুরেশ্বর; তার গ্লানি ও অনুশোচনা হচ্ছিল। এখন বেশ স্পষ্টই সে বুঝতে পারছিল, হেমের কাছে যতই সে বিনীত নম্র সরল হয়ে উপস্থিত হয়ে থাকুক তার মধ্যে কোথাও এই বিশ্রী অহঙ্কার ছিল। আশ্রমের ব্যাপারে তার কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ণ করা তার সহ্য হয়নি, ভাল লাগেনি। সে অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়েছিল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে, সুরেশ্বর তার বিচলিত ভাব দমন করল। তার মনে হল, হেম যেমন খানিকটা বাড়াবাড়ি করেছে, সেও সেই রকম খানিকটা বাড়াবাড়ি করছে। এতটা কাতর হবার বা গ্লানি বোধ করার কিছু নেই। আশ্রমের ভালমন্দ, রোগীদের সুবিধে অসুবিধে দেখা তার কর্তব্য। হেম যদি অন্যায় করে, যদি তার কাজেকর্মে রোগীদের বা হাসপাতালের ক্ষতি হয় সুরেশ্বরের সে-বিষয়ে কথা বলার অধিকার আছে। যুগলবাবু কি শিবনন্দনজিও একথা বলতে পারতেন। যুগলবাবুও রোগী তাড়ানোর ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন। শিবনন্দনজি–যাঁর সঙ্গে হাসপাতালের কোনও সম্পর্ক নেই, তিনিও কথাটা শুনে বলেছিলেন, কাজটা ভাল হয়নি।
মনের ক্ষুব্ধ ও কাতর ভাবটা কমে এলেও সুরেশ্বর কোথাও যেন একটা কাঁটা ফুটে আছে অনুভব করছিল। এই কাঁটা কী, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। হতে পারে হৈমন্তীর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাত, হতে পারে নিজের কোনও দুর্বলতা আজ তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। অন্য কিছুও হতে পারে।
জীবনের যে সমস্ত মোটা তার সুরেশ্বর মোটামুটি একটা সঙ্গতির মধ্যে বেঁধে ফেলেছিল বা সে-চেষ্টা করে আসছিল তার মধ্যে কোনও একটা তার সুরেশ্বরের বাঁধাঘাট ছেড়ে হঠাৎ যেন ছিঁড়ে লাফিয়ে উঠল আজ। সেটা কী? অহঙ্কার?
অহঙ্কার সুরেশ্বরের মধ্যে বরাবরই ছিল, বাল্যকাল থেকেই। সম্ভবত মার চরিত্র থেকে এই অহঙ্কার-বোধ সে পেয়েছিল। বাবা যে ধরনের অহঙ্কারী ছিলেন তা সাধারণ অহঙ্কার, বিত্ত ও বংশমর্যাদার অহঙ্কার; কিন্তু মার অহঙ্কার ছিল অন্য রকম। রূপের জন্যে মার কোনও অহঙ্কার ছিল না, কেননা অসামান্য রূপ সত্ত্বেও মা সেই রূপের মধ্যে বাবাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। হয়তো সেজন্যে রূপের ব্যাপারে মা হতাশ হয়ে পড়েছিল। মার অহঙ্কার ছিল অন্য জায়গায়, এবং সেটা অদ্ভুত। মা হঠাৎ এমন কিছু করে বসত যা সচরাচর লোকে করে না। একথা ঠিক, মার স্বভাব খেয়ালি ছিল এবং মা ঠিক প্রকৃতিস্থ থাকত না সব সময়; তবু মা সংসারের মধ্যে এমন কোনও কোনও আশ্চর্য কাণ্ড করে বসত যা কল্পনা করা যায় না। নিজের জীবনেও মা এরকম করেছে। বিনুমাসি যখন খুব একটা খারাপ অসুখে পড়ল মা তাকে নিজের ঘরে এনে তুলল, নিজের বিছানায়। মাসখানেক ধরে বিনুমাসির রোগের সঙ্গে মার যেন দুবেলা লড়াই চলল। বিনুমাসি সেরে উঠলে মা নিজের ভারী ভারী দুটো গহনা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এবার ধর্মকর্ম করগে যা, পরের বাড়িতে অনেক দিন কাটালি। তুই যা আমি তোকে মাসে মাসে বিশ পঁচিশটা টাকা দেব। কারও বাড়িতে ঝিগিরি করবি না, হারামজাদি; আমার দিব্যি রইল। যা। .বিনুমাসি যাবে না, মা তাকে জোর করে যাওয়াল। লোকে বলেছিল: একটা ঝিয়ের জন্যে এত আদিখ্যেতা দেখানো কেন? …বিনুমাসি যদিও ঠিক ঝি ছিল না, তবু মার নিজের দাসী তো বটেই। বিনুমাসিকে পুরী পাঠিয়ে মা প্রায়ই বলত: বিনু পেপাড়ারমুখী যতদিন বাঁচবে ততদিন আমার কথা ভাববে, বুঝলি। এই রকম অনেক করেছে মা, কাউকে মেয়ের বিয়েতে নিজের গয়না দিয়ে দিয়েছে, কাউকে আশ্রয় দিয়েছে বারবাড়িতে বরাবরের মতন, কাউকে আবার সামান্য কারণে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলতে কী, নিজের জীবনে মা এই অদ্ভুত অহঙ্কারের জন্যে স্বামীকে পর্যন্ত অন্য রমণীর সঙ্গে বসবাস করতে ছেড়ে দিয়েছে। …এই অহঙ্কারের মধ্যে মার এক আশ্চর্য আত্মতৃপ্তি ছিল। মা ভাবত, এইসব করে মার মর্যাদা বাড়বে, লোকে মার গুণগান গাইবে। এই রকম গুণগান কিন্তু বিনুমাসি ছাড়া আর কেউ গায়নি। বিনুমাসি এখনও বেঁচে আছে, বুড়ো হয়ে গেছে, পুরীতেই থাকে, সুরেশ্বরকে অন্তত বছরে দু-একবার চিঠিও লেখে। বিজয়ার পর বিনুমাসির চিঠি আসে; বাবা সুরেশ, আমার বিজয়াদশমীর আশীর্বাদ নেবে…….বিনুমাসি এখানে আসতে চায়, সুরেশ্বর আনে না। এতকাল যার পুরীতে কাটল, তাকে এখানে এনে কষ্ট দেওয়া।
মার এই অহঙ্কারের মূল্য বাবাও দেননি৷ এমন কী তিনি কোনওদিন অনুভবও করেননি, তাঁর অপ্রকৃতিস্থ স্ত্রী তাঁকে ভোগবাসনা নিবৃত্তির জন্যে যে অফুরন্ত স্বাধীনতা দিয়েছিল তার জন্যে তাঁর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। বাবা কখনও মার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন না। শুধু মা মারা যাবার পর বাবা একদিন মার ঘরে বসে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন।
এই অহঙ্কার-বোধ সুরেশ্বরকেও বাল্যকাল থেকে অধিকার করে বসেছিল। চাপা বেদনার মতন চাপা এই অহঙ্কার তার ছিল। পরে বয়েস হলে সুরেশ্বরের মনে হয়েছে, এই অহঙ্কার তার জীবনেও আত্মতৃপ্তির কারণ, এবং এই বোধই তার অভিমান। বাবার উপপত্নী ও তার সন্তানকে যখন সুরেশ্বর সম্পত্তির অংশ হিসেবে অর্থাদি দেয় তখনও সুরেশ্বর এই অহঙ্কার ও অভিমান বোধ করেছিল। সে যে দিতে পারে, দিতে তার কষ্ট নেই–এই কথাটা যেন সে বোঝাতে চেয়েছিল। যেমন মা বাবাকে অন্য রমণীর হাতে তুলে দিয়ে নিজের অহঙ্কারে আত্মপরিতৃপ্তি লাভ করেছিল, সেই রকম সুরেশ্বর নিজের সঙ্গত দাবির খানিকটা অনায়াসে ছেড়ে দিয়ে অভিমানকে রক্ষা করেছিল ও আত্মতুষ্টি লাভ করেছিল।
হৈমন্তীর অসুস্থতার সময়ও কী সুরেশ্বর যা করেছিল তা অহঙ্কারবশে?
সুরেশ্বর আপাতত যে কোনও কারণেই হোক কথাটা আর ভাবতে চাইছিল না। সম্ভবত বিষয়টা আরও জটিল এবং জটিল বলেই নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না,ভাবাও উচিত না। অনেক সময় কর্তব্য পালন করে মানুষ আত্মতৃপ্তি পায়, সাহায্য করেও সুখ বা আনন্দ পায়। সেভাবে দেখলে, সেই অদ্ভুত যুক্তি মানতে হয়, মানুষ এক ধরনের সুখান্বেষী যন্ত্র বই কিছু না, তার প্রত্যেকটি কাজই যান্ত্রিক। ঘড়ির কাঁটার মতন সে শুধু ঘুরতে পারে, দম যতক্ষণ আছে, যতক্ষণ কলকবজা না বিগড়োচ্ছ। আর এই কলকবজাও বাঁধা ধরা, মাপামাপি করে বসানো। এই ধরনের যুক্তিতে সুরেশ্বরের কোনও আস্থা কোনও কালেই নেই। শীতার্ত, গরিব, নিরাশ্রয় ভিক্ষুককে আশ্রয় দিলে, বা তাকে একটা টাকা সাহায্য করলে আত্মতৃপ্তি ঘটে, আর আত্মতৃপ্তি ঘটে বলেই আমার দয়া-বোধ জাগে এমন নির্মম যুক্তি স্বীকার করা যায় না। সেভাবে বিচার করলে মানুষের কিছু থাকে না, সবই একটা আত্মতৃপ্তির হেতু হয়ে দাঁড়ায়; দয়া, ধর্ম, প্রেম, করুণা, মমতাকী বা নয়। ..হেমকে বা হেমদের পরিবারকে সাহায্য করার পিছনে সুরেশ্বরের কিছু গোপন ক্রয়বিক্রয় ছিল–এমন তার মনে হয় না। তার মনে হয়েছিল সাহায্য করাটা তার কর্তব্য; তার মনে হয়েছিল, হেমকে সে ভালবাসে, তার মনে হয়েছিল তার কাছে হেমের জীবনের মূল্য আছে। এবং একথাও ঠিক, সাহায্য করে, ভালবেসে, হেমের জীবনের জন্যে মূল্য আরোপ করে সে সুখ পেয়েছিল। যদি কেউ মনে করে, সুরেশ্বরের এ-সবই অহঙ্কারবোধ থেকে এসেছে তবে হৈমন্তীর আজকের কথাটা সুরেশ্বর এখন আর খুঁটিয়ে না ভেবে হৈমন্তীর আজকের ব্যবহার থেকে যা বোঝা গেছে তার কথা ভাবতে লাগল।
হেম তার প্রতি সন্তুষ্ট নয়, আশ্রমের প্রতিও না। এই অসন্তোষ এবং বিরক্তিবশে সে বিরূপ হয়ে উঠেছে। সে ক্ষুব্ধ, অপ্রসন্ন। আজকাল সুরেশ্বরের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন একটা রেষারেষির মধ্যে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন। অন্তত আজকের আচরণ থেকে মনে হয়, হেম যা করেছে তা সুরেশ্বরকে অবজ্ঞা করার জন্যে, তাকে আহত করার জন্যে। এই রেষারেষির কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু হেম ক্রমশই কেমন তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছে, এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে সে সুরেশ্বর ও এই আশ্রমকে এড়িয়ে থেকে তার অবজ্ঞা বোঝাতে চাইছে।
হেম কেন অকারণে এই অশান্তি সৃষ্টি করছে সুরেশ্বর বুঝতে পারল না। ভাল না লাগলে সে চলে যেতে পারে, জোর করে তাকে কেউ ধরে রাখবে না।
.
১৭.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মালিনীকে ডাকল হৈমন্তী।
শীতের গাঢ় দুপুরের নিবিড়তা এবার যেন কেটে যাবার সময় এসেছে, রোদ নিষ্প্রভ ও হলুদ হয়ে এল। মালিনীর ঘরের দিকে পশ্চিম হেলে বারান্দায় রোদ পড়ে আছে একটু।
মালিনীর সাড়াশব্দ নেই। হৈমন্তী আবার ডাকল।
উত্তরের বাতাসে আজ বেশ ধার। আজকাল দুপুর ফুরোবার আগে থেকেই উত্তর থেকে বাতাস আসতে শুরু করে। ঝাঁপটা দিয়ে বাতাস আসছে। ঝাঁক বেঁধে ফড়িং আর প্রজাপতি নেমেছে মাঠে; মাঠের রোদে, ঘাসের ডগায়, ফুলগাছের ঝোপেঝাড়ে ফড়িং, আর প্রজাপতি উড়ছিল। টিয়া ডাকছিল।
বার দুই ডাকার পর মালিনী বাইরে এল। শীতের দুপুরে ঘুমোচ্ছিল, চোখ ফুলে গেছে: ঘুম থেকে উঠে আসায় হাই তুলছিল বড় বড়।
হৈমন্তী বলল, স্টেশনে যাবে?
মালিনী প্রথমটায় যেন বুঝল না, পরে বুঝল। আপনি যাচ্ছেন?
যাবে তো তাড়াতাড়ি নাও। তিনটে প্রায় বাজে।
স্টেশনে যাবার কথা বললে মালিনী সব সময় পা তুলে থাকে। তবে যাবার আগে সুরেশ্বরকে জিজ্ঞেস করা তার অভ্যেস। অন্যদিন হেমদি আগেভাগেই বলে রাখে, মালিনীও অনুমতি নিয়ে রাখে সুরেশ্বরের, হাতের কাজকর্মও সেরে রাখে। আজ একেবারে হুট করে বলা, হাতেও সময় নেই, দাদা হয়তো এখন বিশ্রাম করছেন, কাজকর্মও কিছু সেরে রাখেনি সে। মালিনী দোনামোনা করল, সে যেতে চায় কিন্তু হ্যাঁ বলতে পারছে না।
মালিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে হৈমন্তী বলল, কী ভাবছ?
না, ভাবিনি মালিনী মাথা নাড়ল। দাদাকে যে কিছু বলিনি, হেমদি। কাজ সারাও হয়নি।
ও! তবে থাক; তোমায় যেতে হবে না। হৈমন্তী আর অপেক্ষা করল না; তার হাতে তোয়ালে, কলঘরের দিকে চলে গেল।
মালিনী বেশ দ্বিধায় পড়ল। হেমদি একা একা যাবে, সেটা কি ভাল দেখাবে? দাদা হয়তো রাগ করবেন। হেমদি যে একলা কখনও স্টেশনে যায়নি তা নয়, সেবার গিয়েছিল। দাদা একটু অখুশি হয়েছিলেন। একগাদা বই, কিছু জিনিসপত্র নিয়ে হেমদি ফিরে এলে দাদার নজরে পড়েছিল। অত জিনিসপত্র হেমদি একলা বয়ে আনায় দাদা আড়ালে মালিনীকে বলেছিলেন, তুমি সঙ্গে গেলে পারতে।
সে তো পারতই মালিনী। কিন্তু সেদিন অনেকগুলো কাজ ছিল হাতে, হেমদিও হঠাৎ যাওয়া স্থির করে ফেলেছিল। আজও সেই রকম। দুপুরে শুয়ে শুয়ে হয়তো হঠাৎ মাথায় পোকা ঢুকেছে, স্টেশনে যাব, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তৈরি। কিংবা পড়ার বই ফুরিয়ে গেছে, জিনিসপত্রও কিছু কেনাকাটা করতে হবে, স্টেশন যাচ্ছে। …তা যাক এখন কী করা যায়? চলে যাবে মালিনী? ছুটে এক দৌড়ে গিয়ে দাদাকে বলে আসবে? হাতের কাজগুলো আর কাউকে সেরে দিতে বলবে?
অত তাড়াতাড়ি সব হয় না। হাতের কাজ অবশ্য এমন কিছু নয় যার দু-একটা চটপট সেরে, বাকিটা পারবতিয়ার হাতে দিয়ে সে চলে যেতে না পারে। কিন্তু দাদা? দাদাকে না বলে সে যায় কী করে?
হৈমন্তী কলঘর থেকে ফিরল, চোখমুখ ভিজে, কপাল আর কানের কাছের এলোমেলো চুলগুলিতে জলবিন্দু, গলার তলায় সাবানের একটু ফেনা।
হৈমন্তী কাছে এলে মালিনী বলল, হেমদি, আপনি তৈরি হতে থাকুন, আমি একছুটে দাদাকে একবার বলে আসি।
হৈমন্তী যেতে যেতেই জবাব দিল, থাক।
মালিনীর পাশ দিয়ে চলে গেল হৈমন্তী। মালিনী এবার বলল, চা খেয়ে যাবেন না?
সময় নেই—
জল বসিয়ে দিচ্ছি, আপনার কাপড় বদলাতে বদলাতে হয়ে যাবে।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না, ঘরে ঢুকে গেল।
এ এক জ্বালা হল মালিনীর। হেমদি হয়তো রাগ করল। সত্যি, রাগ করার কথাই। হেমদি কী তার মতন, যে এখন লাঠা পর্যন্ত একা একা টংটং করে হাঁটবে, হাতে হয়তো একগাদা বই থাকবে, তারপর লাঠার মোড়ে গিয়ে হাঁ করে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা, দেহাতিগুলো আবার হেমদিকে চিনে গেছে, উঁকিঝুঁকি দেবে, খাতির দেখাবে, পানের দোকান থেকে ভাঙা টিনের চেয়ার এনে রাস্তার সামনে পেতে দেবে বসতে।
মালিনী ঘরে এসে তাড়াতাড়ি চায়ের জল বসিয়ে দিল স্টোভে। দিয়ে চোখমুখ ধুয়ে আসতে গেল।
.
হৈমন্তী প্রায় তৈরি হয়ে নিয়েছে। মালিনী চা নিয়ে এল।
অবনীর কাছ থেকে আনা খান ছয়েক বই চামড়ার কালো বড় ব্যাগটায় পুরে নিচ্ছে হৈমন্তী। মালিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল দুমুহূর্ত, তারপর বলল, আপনি চা টুকু খান হেমদি, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
হৈমন্তী পিছন ফিরে মালিনীর দিকে তাকাল না, জবাবও দিল না।
মালিনী কী করবে বুঝতে পারল না; তার মনে হল হেমদি রাগ করেছে। ইতস্তত করে মালিনী আবার বলল, আপনার হতে হতে আমারও হয়ে যাবে। আপনি বরং ব্যাগটা আমায় দিয়ে এগুতে থাকুন আমি রাস্তায় আপনাকে ধরে নেব।
থাক, তোমায় যেতে হবে না, হৈমন্তী এবার জবাব দিল।
মালিনী চুপচাপ। তারপর আস্তে করে বলল, আপনি একলা যাবেন?
কেন, কী হয়েছে? হৈমন্তী দেওয়ালে টাঙানো আয়নার কাছে গিয়ে মুখ দেখে মাথার চুল সামান্য ঠিক করে নিল।
ফিরতে তো রাত হয়ে যাবে। ভয়ে ভয়ে মালিনী বলল।
সে ভাবনা আমার।
মালিনী বুঝতে পারল না সে এমন কী করেছে যার জন্যে হেমদি তার ওপর এত রেগে গেল। হেমদির আজ কদিন কেমন অদ্ভুত রাগ-রাগ ভাব হয়েছে।
হৈমন্তী তাড়াতাড়ি চা খেতে লাগল। চা খেতে খেতেই গরম কোটটা টেনে নিয়ে বিছানায় রাখল।
এবার সরলভাবে মালিনী বলল, হেমদি, আপনি একলা একলা স্টেশনে গেলে দাদা রাগ করবেন।
হৈমন্তী যেন থমকে গিয়ে মালিনীর মুখের দিকে তাকাল, চোখ লক্ষ করল। মুখের গাম্ভীর্য আরও ঘন হয়ে এল; চোখের মণি উজ্জ্বল হল।
মালিনী কিছু বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল সরলভাবেই।
হৈমন্তী বিরক্তভাবে বলল, তোমার দাদা কি আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমায় ঘুরতে বলেছে?
কথাটার জটিল অর্থ মালিনী ধরতে পারল না, সেবার আপনি একলা গিয়েছিলেন, দাদা আমায় বললেন–আমি কেন সঙ্গে যাইনি।
সুরেশ্বর কি হৈমন্তীর আসা-যাওয়ার খবরদারি করতে চায়? হৈমন্তীর মুখ লাল হয়ে উঠল রাগে, চোখমুখে হলকা লাগল আঁচের। মালিনীর সামনে নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করে হৈমন্তী বলল, তুমি যাও, কর্তামি কোরো না।
মালিনী কেমন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর অপরাধীর মতন মুখ নিচু করে চলে গেল।
অল্প একটু সময় হৈমন্তী কেমন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, কিছু ভাবতে পারল না। চা আর খেল না। জানলা বন্ধ করে দিল, দরজার তালা খুঁজে নিল। গরম জামাটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে, ব্যাগ হাতে বাইরে এল। তালা দিল দরজায়। মালিনীই সাধারণত তার ঘরদোর বন্ধ করে, দরজায় তালা দেয়, চাবি রাখে। আজ হৈমন্তী নিজের হাতেই সব করল, মালিনী খানিকটা তফাতে তার ঘরের কাছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তালার চাবিটা পর্যন্ত দিল না হৈমন্তী। সব দেখেশুনেও যেন হৈমন্তী কিছু দেখেনি, মালিনীকে উপেক্ষা করে সে মাঠে নেমে গেল, মাঠ দিয়ে অন্ধ আশ্রমের ফটকের দিকে চলে গেল, তারপর ওপারে জামতলার রাস্তায়।
.
গত কয়েকটা দিনই হৈমন্তীর খুব স্বস্তির মধ্যে কাটছে না। মনের মধ্যে যেন কিছু জমে আছে, রাগ ক্ষোভ বিরক্তি মালিন্য নাকি দুঃখ বা অনুশোচনা তা বোঝা যেত না। নিজের যথার্থ মনোভাব নিজে বেশির ভাগ সময়েই বোঝা যায় না। কখনও হৈমন্তীর মনে হত সে ক্ষুব্ধ ও আহত হয়ে আছে, কখনও মনে হয়তো সুরেশ্বরের সঙ্গে তার বোঝাপড়ার একটা দরকার ছিল, এবং এই চাপা কলহ বা রেষারেষি যেন তার শুরু। মাঝে মাঝে আবার এমনও মনে হত, সেদিন ঝোঁকের মাথায় হৈমন্তী বেশি রূঢ় হয়ে পড়েছিল। অতটা রূঢ় হওয়া তার উচিত হয়নি হয়তো। অথচ নিজের দিক থেকে হৈমন্তী তেমন একটা দোষও খুঁজে পেত না। সেদিন তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল; মানুষ মাত্রেরই মাথা গরম হয়, এতে লজ্জায় মরে যাবার কী আছে! সবাই তো আর সুরেশ্বর নয়, গাছপাথরের মতন সহিষ্ণু হবে, শান্ত হবে। কিন্তু, সুরেশ্বর ওপর ওপর যতটা ধীরস্থির শান্ত ভাব দেখায় ভেতরে ততটা নয়। সুরেশ্বরের দৃষ্টিতে বিরক্তি এবং রাগ হৈমন্তী সেদিন লক্ষ করেছে। তার কথায় সুরেশ্বর অসন্তুষ্ট হয়েছিল, অপমান বোধ করেছে। হৈমন্তীর সন্দেহ নেই, সুরেশ্বর এই আশ্রমের সকলের কাছে আনুগত্য চায়, সম্মান চায়, না পেলে আত্মমর্যাদায় আঘাত পায়।
এই মর্যাদা হৈমন্তীরও না থাকার কারণ নেই। সুরেশ্বর নিজের মর্যাদার বিষয়ে যদি এত সচেতন হতে পারে, তবে অন্যের মর্যাদা সম্পর্কেও বা কেন হবে না? হৈমন্তীর যথার্থ মর্যাদা কী সে দিতে চায়!
গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তা ধরে লাঠার পথে হাঁটতে হাঁটতে হৈমন্তী এলোমলো ভাবে কথাগুলো ভাবছিল। শীতের এই মরা দুপুরে পথ হাঁটতে তার খারাপ লাগছিল না। আগে একলা একলা এভাবে ফাঁকায় হাঁটতে তার ভাল লাগত না, বা এতটা পথ হাঁটার অভ্যেস তার ছিল না। আজকাল হৈমন্তীর মোটামুটি অভ্যেস হয়ে গেছে। সে হাঁটতে পারে, ভালও লাগে।
সুরেশ্বর তার একা একা স্টেশনে যাওয়া পছন্দ করে না নাকি? কেন? মালিনী তার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে এটাই কি সুরেশ্বরের ইচ্ছে? নাকি আদেশ? তাই বা হয় কেমন করে, যদি হত, মালিনী তার সঙ্গে আজ যেতে পারত। দাদার বড় অনুগত মালিনী, অনুমতি না নিয়ে আশ্রমের বাইরে পা বাড়াতে সাহস করে না। মালিনী অনুমতি নেয়নি বলে যেতে সাহস করল না। শেষ পর্যন্ত যে যেতে চেয়েছিল সেটা বোধ হয় ওই ভয়ে-যদি সুরেশ্বর রাগ করে!
চিন্তাটা কেমন জটিল হয়ে সুতোর জট পাকানোর মতন জড়িয়ে যেতে লাগল। কোনও কোনও সময় ভাবনার ঝোঁক নোংরা হয়ে ওঠার উপক্রম হচ্ছিল। সুতোর জট হাতে করে খুলতে গিয়ে খুলতে না পারলে বার বার চেষ্টায় যেমন আঙুলের ময়লা লেগে কোনও কোনও জায়গা কালচে হয়ে আসে সেই রকম নানাভাবে চিন্তাটাকে ছাড়াতে গিয়ে কোথাও কোথাও মনের ময়লা লাগছিল। হৈমন্তীকে সর্বক্ষণ ছায়ার মতন অনুসরণ করতে বলার মতন মন সুরেশ্বরের নয়। স্টেশনে সে মাঝে মাঝেই যাচ্ছে বলে সুরেশ্বর মালিনীকে হৈমন্তীর ওপর চোখ রাখতে বলবে–এ রকম কুৎসিত নোংরা সুরেশ্বর কখনও ছিল না, কখনও হবে না। তার ঈর্ষার বা সন্দেহের…
ঈর্ষা বা সন্দেহে কথাটা যেন মাথার মধ্যে ঝিলিকের মতন এল। অনেক সময় যেমন চোখ ফেরাতে গিয়ে বা অন্য কোনও দিকে তাকাতে গিয়ে সহসা রোদের কোনও ঝিলিক বা প্রতিফলিত আলোর তীর এসে চোখের মণিতে লেগে চোখটা কেমন হয়ে যায়, সেই রকম মনে এবং চিন্তার মধ্যে ঈর্ষা ও সন্দেহ কথাটা তীরের মতন এসে লাগল। হৈমন্তী কেমন অ-জ্ঞানে পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, বেহুশ, কিছু দেখতে পেল না, কিছু ভাবতে পারল না, নিশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল। তারপর হঠাৎ বুকে কষ্ট অনুভব করতেই চোখ তুলে পথ এবং গাছপালা দেখল, নিশ্বাস নিল। একটা গোরুর গাড়ি আসছে, অনেকটা দূরে লাঠা, শনশন বাতাস বইছে, শালের চারা-ঝোঁপের ওপর দিয়ে বুনো মুরগি ফরফর করে উড়ে গেল।
ঈর্ষা, সন্দেহ…! কার ওপর ঈর্ষা, কী বিষয়ে সন্দেহ?
মনে মনে অবনীর মুখ দেখতে পেল হৈমন্তী। ইদানীং অবনীর সঙ্গে তার মেলামেশা বেশ সহজ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দেখাসাক্ষাৎ ঘটছে। হৈমন্তী স্টেশনে যায়, অবনীও আসে; তবে একেবারে হালে কাজেকর্মে অবনী তেমন আসতে পারছে না। হৈমন্তী আজও অবনীর কাছে যাচ্ছে। শুধু অবনীর কাছে নয়, তার কিছু কেনাকাটা করার আছে; রেডিয়োর ব্যাটারি, একটা ক্রিম, মাথার তেল, ওভালটিন– এই সব।
হৈমন্তী হাঁটতে লাগল। এখন তার কেমন অদ্ভুত লাগছিল। সুরেশ্বরের মধ্যে ঈর্ষা বা সন্দেহ বলে কিছু থাকতে পারে এ কথা ভাবা যায় না। কী কারণেই বা ঈর্ষা হবে? অবনীর সঙ্গে হৈমন্তীর মেলামেশায় তার কিছু আসে যায় না, যায় কি! সুরেশ্বর ন্যায়ত ও সঙ্গতভাবেই অবনীর ওপর ঈর্ষা বোধ করতে পারে না, হৈমন্তীর ওপর সন্দেহও তার থাকা উচিত নয়। বলতে কী, আজ হৈমন্তী ও সুরেশ্বরের মধ্যে যে সম্পর্ক তাতে হৈমন্তী অন্য কারও সঙ্গে কীভাবে মেলামেশা করছে, কী ধরনের ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে ওদের, তাতে কী এল গেল তার! যদি ভালবাসার কথাও হয় হৈমন্তী অন্য কাউকে ভালবাসল কী বাসল না তা নিয়ে সুরেশ্বরের গায়ে জ্বালা ধরার কিছু নেই।
চিন্তাটা এবার যেন কৌতুকের মতন হয়ে উঠেছে। হৈমন্তী নিজের এই হাস্যকর চিন্তায় লঘু হয়ে হেসে ফেলতে গেল। অথচ হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না, কোথাও যেন একটা বাধা এল। কীসের বাধা?
এমন তো হতে পারে–হৈমন্তী ভাবল: সুরেশ্বর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। এখানে হৈমন্তীর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই, সে একা; সুরেশ্বরই তাকে এই জঙ্গলের দেশে আনিয়েছে, কাজেই হৈমন্তীর প্রতি তার দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আছে। সুরেশ্বর সেই দায়দায়িত্ব বোধের জন্য তার অভিভাবক, এবং সেই হিসেবে হৈমন্তীর প্রতি লক্ষ রাখে।
কিন্তু, হৈমন্তী ভেবে পেল না, এটা কী ধরনের অভিভাবকত্ব যে তার ব্যক্তিগত বিষয়ের ওপর সুরেশ্বর নজর রাখবে? হৈমন্তী ছেলেমানুষ নয়, বা সে সুরেশ্বরের আশ্রয়াধীন নয় যে, সুরেশ্বর তার হাঁটাচলা বেড়ানো অথবা কারও সঙ্গে মেলামেশার ওপর চোখ রাখবে।
মনে মনে যে কৌতুকের ভাব এসেছিল সামান্য আগে সে ভাব আর থাকল না হৈমন্তীর। বরং সে বিরূপ হয়ে উঠল আবার। মানুষটা নোংরা হতে পারে না, তার মনে নিশ্চয় সন্দেহ বা ঈর্ষা থাকতে পারে না; থাকলে হয়তো ভালই হত। আসলে হৈমন্তীর ওপর সুরেশ্বর এক ধরনের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব দেখাতে চায়। বোঝাতে চায়, সে হৈমন্তীর অভিভাবক, তার ভালমন্দের মালিক। …চিন্তাটা বিশ্রী লাগল, এবং হৈমন্তী হঠাৎ সুরেশ্বরের ওপর তীব্র ঘৃণা অনুভব করল। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ইচ্ছা, রুচি, মনের ওপর অন্ধ আশ্রমের মালিকের মালিকানা স্বত্ব থাকবে নাকি? আমায় কী তুমি তোমার আশ্রমের ঘরবাড়ি, তাঁত, ঝি চাকর পেয়েছ? নাকি তুমি ভেবেছ আমি বোকার মতন তোমায় বিশ্বাস করে এসেছিলাম বরাবর, ভালবেসেছিলাম তার জোরে তুমি আমার জীবন-মরণের প্রভু হয়ে গেছ?
মাঠের ওপর দিয়ে কিছু ধুলো উড়ে এল, কিছু শুকনো পাতা। সামনে লাটুঠার মোড়। হৈমন্তী হঠাৎ কেমন জোরে জোরে হাঁটতে লাগল, কপালের দুপাশ বেশ গরম। সূর্য একেবারে মুখোমুখি। মাথায় রোদ লাগছিল বলে হৈমন্তী এই ফাঁকায় মাথায় কাপড় টেনে হাঁটছিল, এবার কাপড়টা ফেলে দিল মাথা থেকে।
দূরে বাস আসছে। সময় মতন পৌঁছে গেছে হৈমন্তী। হঠাৎ হৈমন্তীর অদ্ভুত একটা কথা মনে এল। যদি আজ সে অবনীর বাড়ি থেকে না ফেরে কী করবে সুরেশ্বর? কী সে করতে পারে…?
.
১৮.
অবনী বলল, আসুন; আমার মনে হচ্ছিল আজ আপনি আসবেন।
অবনীর সহাস্য মুখ সরল দৃষ্টি লক্ষ করতে করতে হৈমন্তী সিঁড়ির শেষ ধাপ উঠে বারান্দায় পা দিল। কী করে মনে হল আমি আসব?
ইনট্যুশান! অবনী হেঁসে হেসেই বলল।
বারান্দায় বসা যেত, কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকা যেত না। এখন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে, এখুনি দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে যাবে, শীত আর বাতাস গায়ে ফুটবে। হৈমন্তী বারান্দায় দাঁড়াল। বলল, আমি বাজারে নেমেছিলাম, ব্যাটারি-ট্যাটারি কেনার ছিল। বলে হৈমন্তী মুহূর্তের জন্যে থামল, অবনীর চোখ দেখল, তারপর হেসে বলল, সেখানে আপনার মহিন্দরকে দেখলুম, সাইকেল চেপে আসছে।
অবনী সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়ল। আরে, না না, মহিন্দর আমায় কিছু বলেনি, আমি জানিই না সে বাজার গিয়েছিল।
হৈমন্তী এবার চোখের একটু ভঙ্গি করল। তাহলে তো আপনার ইনচ্যুশানে বিশ্বাস করতেই হয়।
হাসির মুখ করল দুজনেই।
অবনী বলল, আজ আমি একবার ওদিকে যাব ভেবেছিলাম। তারপর কেমন মনে হল আপনি আসতে পারেন।
ভেবেছিলেন যখন তখন যাবেন– হৈমন্তী সুমিষ্ট করে হাসল। আমার বই ফুরিয়ে গেছে– হৈমন্তী এমনভাবে বলল যাতে মনে হয় এই ফুরিয়ে গেলে তার না এসে উপায় কী। অবশ্য এই বলাটা তেমন কৈফিয়তের মতন শোনাল না।
অবনী বলল, এত তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলেন কেন?
কেন?
এ-ভাবে পড়লে আমি আর বেশিদিন বই জোগাতে পারব না।
সে পরের কথা–।
আপনি আর-একটু রয়ে-সয়ে পড়বেন, অবনী হেসে বলল, কিন্তু এমনভাবে বলল, যাতে বোঝা যায় তার কথার মধ্যে একটা সকৌতুক ইঙ্গিত আছে। অর্থাৎ অবনী যেন পরিহাস করে বোঝাতে চাইল, অত তাড়াতাড়ি সব বই শেষ হয়ে গেলে হৈমন্তী আর কী এবাড়ি আসবে।
হৈমন্তী কথাটায় কান দিল কি দিল না বোঝা গেল না।
বসার ঘরে এসে বসল হৈমন্তী। বাতিটা জ্বালিয়ে দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে অবনী জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সুরেশ্বরবাবুর খবর কী?
হৈমন্তী প্রথমে কোনও জবাব দিল না, পরে উদাসীন গলায় বলল, ভাল।
অবনী হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। বলার ভঙ্গিটা তার কানে গেল। বাইরে তাকাল; শীতের অপরাহু গত, কোথাও রোদ নেই, আলোর সামান্য আভাস এখনও আছে, গাছপাতা প্রায় কালচে হয়ে এল, ছায়া গাঢ় হয়ে ময়লা রং ধরে যাচ্ছে। এই সময়টা অবনীর চোখে সব সময়ই বিষঃ লাগে, বিশেষ করে যখন একা একা থাকে একা একা দেখে। হৈমন্তীর কথা থেকে অবনীর মনে হল, জবাবটা খুব নিস্পৃহ; আগে এভাবে জবাব বড় দিত না হৈমন্তী, এখন দেয়; এখন সে আশ্রম সম্পর্কে বিরক্তি বা উদাসীনতা অবনীর কাছে জানাতেও দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু সুরেশ্বর সম্পর্কে বেশির ভাগ সময়ই হৈমন্তী নীরব থাকে, যা যা বলে তার মধ্যে উৎসাহ বা অনুৎসাহ কিছু থাকে না। এই মুহূর্তের ভাল বলাটা ঠিক নৈর্ব্যক্তিক নয়; কোথায় যেন একটা বিরক্তি ছিল বলার স্বরে ও ভঙ্গিতে।
অবনী বলল, বিজলীবাবু পরশুদিন গিয়েছিলেন না! কথাটা আগের কথার সঙ্গে সম্পর্কহীন। ইচ্ছে করেই অবনী অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করল।
হ্যাঁ, ওঁর স্ত্রীকে দেখাতে।
চোখে কী হয়েছে বলছিলেন–
একটু গণ্ডগোল আছে, সেরে যাবেন। হৈমন্তী হাতের ব্যাগ খুলে অবনীর বইগুলো বের করে রাখল। তারপর হঠাৎ বলল, বিজলীবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ, বার দুই দেখলাম। বেশ ভাল লাগল।
ব্যাপার কী? অবনী ইচ্ছাকৃত বিস্ময় জানাল, পরিহাস করেই।
কীসের ব্যাপার, কেন?
একে অন্যের এত প্রশংসা করছেন?
উনি বুঝি আমার প্রশংসা করেছেন?
বিজলীবাবু তো তাই বললেন। ভীষণ প্রশংসা…
ও! পরের মুখে ঝাল খেয়ে বলছেন– হৈমন্তী এবার হাসল। তার হাসি থেকে বোঝা গেল সে আগের মানসিক বিরক্তিটুকু ভুলে গেছে।
নিজের মুখে ঝাল খেতে হলে চোখের একটা উপসর্গ দরকার হাসতে হাসতে বলল অবনী। কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে বসল। বসার আগে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এল।
হৈমন্তী আচমকা বলল, বিজলীবাবুর স্ত্রীকে দেখলে আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে; অবিকল একই ছাঁচের মুখ। হাসি-টাসিগুলোও যেন এক রকম। আমার সেই বন্ধু এখন দিল্লিতে থাকে।
ডাক্তার? অবনী ভয়-ভয় গলা করে বলল।
হ্যাঁ, তবে এমনি ডাক্তারি করে না; সরকারি হেলথ ডিপার্টমেন্টে কীসের একটা চাকরি নিয়েছে। তার স্বামীও ডাক্তার।
অবনী হৈমন্তীর চোখে চোখে চাইল। হয়তো অবনী বোঝবার চেষ্টা করল হৈমন্তীর মনে কোনও রকম নৈরাশ্য আছে কি না। কিছু বোঝা গেল না। অবনী অন্য কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে যেন বিজলীবাবুর স্ত্রীর প্রসঙ্গ আরও একটু বিস্তৃত করল, বিজলীবাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর প্রথম স্ত্রীর সহোদর বোন।
শুনেছি। ..বড়কেও দেখেছি, সেই যে বিজয়ার পর গিয়েছিলাম। খুব ভারিক্কী, গিন্নি গিন্নি…
ধর্মকর্ম জপতপ নিয়েই থাকেন। সুরেশ-মহারাজের খুব ভক্ত। অবনী শেষ কথাটা যেন কেমন ভেতরের কোনও লোভের বশে বলে ফেলল।
হৈমন্তী কথাটা শুনল কিছু বলল না।
অবনী বসে থেকে থেকে একটা সিগারেট ধরাবার জন্যে হাত দিয়ে প্যাকেট বা দেশলাই পেল না। শোবার ঘরে পড়ে আছে। উঠে দাঁড়াল, সিগারেট আনতে হবে, চায়ের কথা বলতে হবে মহিন্দরকে; জানলার বাইরে যেন হু হু করে একরাশ অন্ধকার এসে গেছে, বাগানের গাছে পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ফিরে কলরব শুরু করেছে।
একটু বসুন, আসছি। অবনী চলে গেল।
হৈমন্তী বসে থাকল। অবনীর এই বসার ঘরে আজকাল তাকে মাঝে মাঝে এসে বসতে হয়, ঘরটা তাই পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। সাদামাটা বেতের সোফাসেট, তুলোর গদি পাতা, কাঠের ছোট সেন্টার টেবল, একপাশে একটা বুক র্যাক, ছোট মতন এক কাঠের সেলফ, তার তলায় কয়েকটা তামা পেতলের মূর্তি-টুর্তি, ওপরে এক ফুলদানি, টেবল ল্যাম্প; দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার, অবনীর যুবক বয়সের একটা ছবি। এই সজ্জার মধ্যে বাহুল্য নেই, একেবারে শূন্যতাও নয়, যেন কাজ চালিয়ে দেবার মতন করে সাজানো ঘর। ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন, কোথাও বিশৃঙ্খল হয়ে কিছু নেই। একলা মানুষ, ঘরদোর এলোমেলো হবার কারণ নেই। চাকরবাকররা যেটুকু করে তাই যেন যথেষ্ট।
হৈমন্তী অবনীর বসার ঘর ছাড়া ভেতরের অন্য দুটি ঘরও একদিন দেখেছে। অবনী বাড়ি দেখাবার সময় একদিন দেখিয়েছিল। কোনও ঘরেই সে বাহুল্য বিশেষ শৌখিনতা দেখেনি। শৌখিনতা যেন অবনীর নেই তার সবই সাদামাটা, যেটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত বড় কিছু রাখে না। এই ধরনের মানুষ যা হয়–অফিস নিয়ে পড়ে আছে, কাজকর্ম শেষ হলে যেটুকু সময় সেটুকু শুয়ে বসে বিশ্রাম নিয়ে কাটানো, আলস্যে বসে বসে গোয়েন্দা কাহিনী পড়া, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি দেখা, কী বড়জোর রেডিয়ো খুলে দিয়ে পায়চারি করা।
অবনী ফিরে এল। জামাকাপড় বদলে এসেছে, পরনে গরম ট্রাউজারস, গায়ে পুরো হাতা সোয়েটার, মুখচোখ পরিষ্কার, মাথার চুল আঁচড়ানো। হাতে কিছু বই। হৈমন্তীর কাছে হাতের বইগুলো নামিয়ে দিয়ে বলল, দেখে বেছে নিন, এর দু-একটা আগেও আপনাকে দিয়ে থাকতে পারি।
বাইরে এতক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে, ঘরের আলো এবার ফুটে উঠেছে। হৈমন্তী বই দেখতে লাগল, অবনী মুখোমুখি বসে ট্রাউজারসের পকেট থেকে মোজা বের করে পিঠ নুইয়ে পরে নিতে লাগল। তার আচরণের মধ্যে কোনও রকম সঙ্কোচ ছিল না।
বই দেখতে দেখতে হৈমন্তী বলল, কোথাও বেরোবেন?
আপনার সঙ্গে…।
এ যেন হৈমন্তীর জানা ছিল। সাধারণত সে এলে অবনী তাকে গুরুডিয়ায় পৌঁছে দিয়ে আসে। আজ প্রথম থেকেই হৈমন্তীর কোনও তাড়া ছিল না। অন্যদিন সে এসে পনেরো কুড়ি মিনিট অন্তর ঘড়ি দেখে, বাসের কথা বলে, আজ একবারও ঘড়ি দেখেনি, বাসের কথা বলেনি। তার ইচ্ছে আজ সে দেরি করে ফিরবে, যতটা সম্ভব সে দেরি করতে চায়।
আজ বেশ ঠাণ্ডা– হৈমন্তী বলল, যেন এতটা ঠাণ্ডায় অবনীকে গুরুডিয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে মনে মনে প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নিল।
এ ঠাণ্ডা আমাদের গা-সওয়া, অবনী সোজা হয়ে বসল। আর কদিন পরেই ক্রিসমাস, তখন কয়েকদিন, জানুয়ারির আধাআধি পর্যন্ত ভীষণ ঠাণ্ডা পড়বে। আমার নিজের খুব ভাল লাগে সময়টা।
ক্রিসমাসে গগন আসছে। হৈমন্তী তিনটে বই বেছে অন্য একটা বইয়ে হাত দিল।
চা নিয়ে এল মহিন্দর। চা আর ওমলেট। হৈমন্তী মহিন্দরের সঙ্গে দুটো কথা বলল, এ বাড়িতে তার পরিচয় এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে চাকরবাকরের মধ্যেও কোনও কৌতূহল আর দেখা যায় না। মহিন্দরের বাবার চোখের ছানি হৈমন্তীকে দিয়ে দেখিয়ে এনেছে। ছানি কাটাতে হবে। এখনও একটু দেরি আছে। হৈমন্তী নিজে ছানি কাটবে না, বলেছে ব্যবস্থা করে দেবে।
মহিন্দর চলে গেলে হৈমন্তী চা ঢেলে অবনীর দিকে এগিয়ে দিল।
অবনী বলল, আসছে হপ্তায় আমাকে হয়তো একবার পাটনা যেতে হবে।
পাটনা! কেন?
ওপরঅলার ডাক।
সেই ব্যাপারটা নাকি?
বুঝতে পারছি না। হতেও পারে। অবনী একটুকরো ওমলেট মুখে দিয়ে আস্তে আস্তে চিবোতে লাগল। তারপর বলল, নতুন যে কনস্ট্রাকসানের তোড়জোড় হচ্ছে সে ব্যাপারেও হতে পারে।
হৈমন্তী চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রেখে চামচ করে ওমলেট কাটতে বলল, জীবনে উন্নতি হয় না বলে লোকে আফশোস করে, আর আপনার ঠিক উলটো; উন্নতি পায়ে ধরে সাধছে আপনিই মুখ ফেরাচ্ছেন।
অবনী হাসির মুখ করল। বিজলীবাবুও তাই বলেন।
সকলেই বলবে; বিজলীবাবু আপনার বন্ধু.
সামান্য চুপ করে থাকল অবনী, চা খেলা শেষে বলল, এই তো বেশ আছি এখানে। উঁচু চেয়ারে বসার অনেক ঝামেলা।
ঝামেলা এড়াবার জন্যে প্রমোশান নেবেন না?
অবনী হৈমন্তীর চোখে চোখে তাকাল, পরে চোখ সরিয়ে নিল। এসব চাকরি–বিশেষ করে এখানে বাঙালি হয়ে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা মুশকিল। অনেক রকম ক্লিক থাকে। আমার কোনও ইন্টারেস্টও নেই।
হৈমন্তী ওমলেট মুখে তোলার আগে অবনীকে দেখতে দেখতে বলল, আপনার যেন কোনও বড় অ্যামবিশানও নেই।
না, নেই। অবনী হাসিমুখে জবাব দিল।
কেন?
কী হবে বড় অ্যামবিশনে।
বেশি মাইনে, প্রতিপত্তি, খ্যাতি। হৈমন্তী হাসি হাসি মুখে বলছিল, এসব তো শুনেছি হয়।
এই মাইনেতে আমার কুলিয়ে যায়, খুব একটা অভাব বোধ করি না।
একলা আছেন বলে। পরে… হৈমন্তী অসতর্কভাবে বলে ফেলল।
অবনী আবার চোখ তুলে স্পষ্ট করে হৈমন্তীর চোখ মুখ দেখল। পরিহাস হয়তো, তবু মেয়েলি কৌতূহলে হৈমন্তীর একথা মনে হওয়া বিচিত্র নয় বা সে-কৌতূহল প্রকাশ করাও অন্যায় নয়। অবনী বলল, ভবিষ্যতের কথা আমি বড় একটা ভাবতে পারি না। ওটা আমার ডিফেক্ট.
প্রতিপত্তি চান না–এটাও বোধহয় তাই, হৈমন্তী যেন আগের অসতর্ক কথাটা মোছবার জন্যে বলল, বেশ জোরে জোরে হেসে।
অল্পস্বল্প প্রতিপত্তি আমার এখানেও আছে– অবনীও পরিহাসের গলায় জবাব দিল।
পুরুষমানুষ প্রতিপত্তির খুব ভক্ত। অহঙ্কার, প্রতিপত্তি, মর্যাদা–এসব তার ভূষণ… হৈমন্তী যদিও পরিহাসের মতন করে বলেছিল তবু কথাগুলো ঠিক পরিহাসের মতন শোনাল না।
অবনী অনুভব করতে পারল হৈমন্তীর বলার ভঙ্গিতে পরিহাসে থাকলেও কেমন এক তিক্ততা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, যেন চাপা উপহাস করল হৈমন্তী। অবনী স্পষ্ট কিছু অনুমান করতে পারল না, তবে তার মনে হল, হৈমন্তীর আজকের আচরণটা কিছুটা বিসদৃশ।
এত ভূষণ গায়ে চাপালে হাঁটা যায়? লঘু স্বরে অবনী বলল।
যাবে না কেন, যায়। হৈমন্তীর ঠোঁটের কিনারা বঙ্কিম হল।
তবে তিনি পুরুষ নয়, মহাপুরুষ। অবনী ঠাট্টা করে বলল। চা শেষ করেছে অবনী, ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল।
আরও একটা বই বেছে নিয়ে হৈমন্তী অন্যগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে মুখ নিচু করে বলল, আপনার উদ্যোগ নেই, উদ্যোগ থাকলে মহাপুরুষ হওয়া যায়।
হ্যাঁ, আমি স্বভাবে খানিকটা ইন-অ্যাকটিভ অবনী হাসল।
বই থেকে চোখ তুলে হৈমন্তী বাকি চাটুকু শেষ করে অবনীর দিকে তাকাল। দুমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, উঠবেন?
আমার তাড়া নেই; আরও কিছুক্ষণ বসতে পারেন।
আমার বই বাছা শেষ হয়ে গেছে–আর মাত্র একটা নেব… বলে হৈমন্তী সামান্য দ্রুত হাতে অন্য একটা বই বাছতে লাগল।
অবনীর একটা বইয়ের ওপর চোখ পড়েছিল। বলল, ওই–ওই বইটা নিতে পারেন, ঠিক ক্রাইম বা মিস্ত্রি নয়, তবে পড়তে মন্দ লাগবে না।
এইটে…? হৈমন্তী একটা বই তুলে দেখাল।
না, নীচেরটা, আপনার কোলের ওপর
হৈমন্তী কোল থেকে বইটা তুলে নিল: এ রুম ফর টু। নামটা দেখল হৈমন্তী, মুখে কিছু বলল না, বেছে রাখা বইয়ের মধ্যে রাখল।
সন্ধে গাঢ় হয়েছে। অবনী ঘড়ি দেখল। পৌনে সাত। হৈমন্তী সময় জিজ্ঞেস করল, সময় বলল অবনী। তারপর চুপচাপ, যেন এখানে কাজ হঠাৎ সব ফুরিয়ে গেছে। নীরবে বসে হৈমন্তী তার ব্যাগের মধ্যে বইগুলো ভরতে লাগল। অবনী চুপচাপ। ঘরের বাতিটা সামান্য মৃদু হয়ে আবার জোর হয়ে উঠল। বাইরে বাতাসের শব্দ প্রখর হলে শোনা যাচ্ছিল।
চলুন উঠি, হৈমন্তী বলল।
চলুন। একটু দাঁড়ান, জুতোটা পায়ে গলিয়ে আসি। অবনী উঠল, উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।
হৈমন্তী ব্যাগের মুখ বন্ধ করল, মুখ মুছল রুমালে, দুহাতে কপালের চুলগুলো সামান্য ঠিক করল। বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করল সামান্য, দেওয়ালে টাঙানো অবনীর তরুণ বয়সের ছবিটা দেখল। খুব নিরীহ আর ভিতু ভিতু দেখায়, এখানকার চেহারার সঙ্গে বেশ তফাত। অবনী কখনও নিজের পারিবারিক কথা বলে না কেন? হৈমন্তী প্রায় সবই বলেছে, মা মামা দাদা বউদি গগনের কথা। অবনীর যেন এসব পারিবারিক কথায় আগ্রহ নেই। হৈমন্তী জানলার দিকে সরে গেল। বাইরে অন্ধকারে হিমের সঙ্গে ধোঁয়া জমেছে সামান্য, কাছে স্টেশন, ইঞ্জিনের ধোঁয়া এ-সময় একটু জমে থাকে এখানে, উত্তরের বাতাস শনশন করে বইল, এই ঠাণ্ডায় এবং বাতাসে অবনী গুরুডিয়ায় যাবে আবার আসবে ভেবে যেন হৈমন্তী কিছুটা সঙ্কোচ অনুভব করল।
আজ তার কী রকম যেন লাগছে। অবনীর বাড়িতে সে একটু দেরি করেই এল। কেন এল? একবার এমন কথাও মনে হয়েছিল আসবে না। আজ অকারণে তার কোথাও যেন কিছুটা দ্বিধা এবং সঙ্কোচ জাগছিল। সেই-তখন থেকে লাঠায় আসবার সময় থেকে বাসে ওঠা, এবং বাসে আসতে আসতে, বাজারে নেমে (বাজারে সে ইচ্ছে করেই আগে ভাগে নেমে সময় কাটাচ্ছিল এবং মন স্থির করে নিচ্ছিল) বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসার সময় প্রায়ই তার ওই বিশ্রী চিন্তাটা কাঁটার মতন ফুটছিল; সুরেশ্বরের ঈর্ষা ও সন্দেহ, এবং অবনীর মুখ মনে ভাসছিল। এ বড় অদ্ভুত চিন্তা। যেন একের সঙ্গে অন্যটা জড়ানো। যদিও এই ঈর্ষা ও সন্দেহ অসম্ভব। হৈমন্তী বিশ্বাস করে না। তবু..তবু। অবনী সম্পর্কে তার এধরনের কোনও কোনও ভাবনা সজ্ঞানে হয়নি এযাবৎ, এখন হচ্ছে, যদিও সেটা প্রায় কিছুই নয়, তবু ভাবনাটাই কেমন অকারণে তাকে সঙ্কুচিত করছিল। শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী চলে এল, কিন্তু অবনীর সামনে মাঝে মাঝে অস্বস্তি বোধ করেছে যে তাতে সন্দেহ নেই। এ রকম কেন হবে সে বুঝতে পারছিল না। আজ সে অবনীর সামনে হয়তো কিছু এলোমেলো কথা বলেছে, হয়তো অন্য দিনের মতন সপ্রতিভ হতে পারেনি। যদিও তার চেষ্টা করেছিল। এমনকী হৈমন্তী যেন গোপনে সুরেশ্বরের প্রতি তার মনের বিরূপতাও আজ কিছু প্রকাশ করে ফেলেছে। অবনী বোধহয় কিছু বুঝতে পারেনি। কিংবা পেরেছে হয়তো। কে জানে!
অবনী এল। চলুন, আমার হয়ে গেছে।
হৈমন্তী পিছু ফিরে তাকাল। গলার পাশ দিয়ে মোটা একটা মাফলার ঝুলছে অবনীর, হাতে টর্চ। দু পলক তাকিয়ে থাকল হৈমন্তী।
গরম আর কিছু গায়ে দেবেন না?
না, আর দরকার হবে না।
ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
লাগবে না।
হৈমন্তী এগিয়ে এসে সোফার ওপর থেকে তার লম্বা গরম কোটটা তুলে নিয়ে গায়ে দিল।
গাড়িতে এসে ওঠার সময় হৈমন্তী বলল, গাড়ি যদি ধীরে চালান তবে সামনে বসি। বসুন।
হৈমন্তী গাড়িতে উঠল। হালে জিপগাড়িটার কিছু সংস্কার সাধন করা হয়েছে। আগে মাথায় ছিল ক্যানভাস, এখন অ্যালুমিনিয়াম শিট দিয়ে মাথা ঢাকা হয়েছে, পিছনটা ঢেকে দিয়ে গায়ে নতুন ক্যানভাস জড়ানোও হয়েছে সদ্য। এসবই অবনীর সুবিধে মতন সে করিয়ে নিয়েছে, নয়তো এই সর্বদিক খোলা গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি করতে তার অসুবিধে হচ্ছিল; দরকারি জিনিস, কাগজপত্র নষ্ট হচ্ছিল পথে।
হৈমন্তী আজ পিছনে বসল না; পিছনে বসলে কথাবার্তা বলতে, গল্প করতে বড় অসুবিধে হয়; একজনের ঘাড়ের দিক মুখ করে সারাক্ষণ বসে থাকা বা কথা বলা বড় বিশ্রী, মুখ দেখা যায় না, জোরে জোরে চেঁচিয়ে কথা বলতে হয়। তা ছাড়া, বাইরের এই বাতাসের ঝাঁপটা পেছনে বেশি লাগে, সামনে বসলে কাচের আড়াল পাওয়া যায়, গায়ের পাশ দিয়ে বাতাস কাটিয়ে নেওয়া চলে।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় আসতে চোখে পড়ল, আকাশে বাঁকা চাঁদ উঠে আছে।
বাজার পর্যন্ত বড় একটা কথা হল না, সাধারণ কিছু বাক্য-বিনিময়। বাজার পেরিয়ে থানার দিকে পিচের রাস্তাটা ধরতেই আশেপাশে বাড়িঘর আলো কমে এল, তারপর থানা পেরুতেই সব যেন দপ করে নিবে গেল এবং লোকালয় অদৃশ্য হল। অবনী বেশ ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিল।
ঘরে বসে হৈমন্তীর যদি কোনও অস্বচ্ছন্দ বোধ হয়ে থাকে বাইরে পথে এসে এবং অন্ধকারে তা হচ্ছিল না। বরং তার ভাল লাগছিল। শীত অনুভব করলেও কয়েক প্রস্তু পোশাকের দরুন সে কাঁপছিল না বা বাতাসের ঝাঁপটা গায়ে লাগতে দিচ্ছিল না। অথচ হাতের আঙুল, নাক কান ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল।
অবনী যেন কিছু বলতে যাচ্ছিল, হৈমন্তী তার আগেই বলল, গগন এলে একটু বেড়াবার ইচ্ছে আছে। চারদিকেই শুনি বেড়াবার নানা জায়গা। একদিন টাউনে যাব।
যাননি এখনও?
একদিন দুপুরে গিয়েছিলাম, বিকেলেই ফিরতে হল…
চলুন একদিন…
গগন আসুক।
এলে আর-একবার হবে, তবে পরশু যদি যেতে চান আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। পরশু দিন আমায় যেতে হবে একবার, কাজ আছে।
কখন যাবেন?
বেলা দশটা নাগাদ—
না, আমার যাওয়া হবে না।
কেন?
হৈমন্তী কী একটু ভাবল, বলল, ওপরঅলার হুকুম নেই। বলে হাসবার চেষ্টা করল।
অবনী মুখ ঘুরিয়ে দেখল। তারা যে ভাবে যে-স্বরে ওপরঅলা শব্দটা বলে হৈমন্তী ঠিক সেইভাবে বলল। অনুকরণে ভুল হয়নি। কিন্তু এ ধরনের অনুকরণে যা থাকার কথা নয় হৈমন্তীর বলার মধ্যে তা ছিল।
অবনী হেসে বলল, আপনার আবার ওপরঅলা কোথায়? সুরেশ্বর…
হৈমন্তী হাসল না। বেলা একটা পর্যন্ত আমার হাসপাতাল; তার এদিক ওদিক করা যাবে না।
ভীষণ কড়া নিয়ম তো।
এই নিয়মটা অবশ্য আমার। ওরা আরও বেশি সময় থাকতে বলে। দিন দুপুর সন্ধে। আমি রাজি না। তাই নিয়ে গোলমাল চলছে।
গোলমাল? অবনী মুখে হাসছিল, কিন্তু মনে মনে সে বুঝতে পারছিল কোথাও একটা মনান্তর চলছে বোধহয়।
হৈমন্তী মাথা নাড়ল, বলল, সেই রকম।
গাড়ি দেখতে দেখতে অনেকটা চলে এসেছে। স্টেশনে আসার শেষ বাসটা পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। দুপাশ উঁচু নিচু মাঠ, আর গাছপালা; অন্ধকারে খুব ফিকে চাঁদের আলো জড়ানো, মাঠময় বাতাস ছুটছিল, শীত যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে এখানে।
অবনী গাড়ি চালাতে চালাতেই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। বলল, আপনার ওপরঅলা কিন্তু সব সময় আপনার সুখ্যাতি করেন।
করেন…
সেদিনও আমার কাছে প্রচণ্ড সুখ্যাতি করছিলেন।
কী হিসেবে? ডাক্তার হিসেবে তো?
হ্যাঁ; আর কীসের করবেন?
ডাক্তার হিসেবেই আমার যেটুকু দাম… হৈমন্তী হঠাৎ বলে ফেলল। বলে চুপ করে গেল।
অবনী এবার আর মুখ ফেরাল না। সে অনুভব করতে পারল হৈমন্তীর কোথাও যেন একটা ক্ষোভ জমে জমে ভারী হয়ে গেছে। আগে বোঝা যেত না, পরে অল্প অল্প বোঝা যাচ্ছিল, এখন তা আরও স্পষ্ট, প্রকাশ্য। সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর ঠিক কোথায় যে মনোমালিন্য ঘটতে পারে অবনী তা অনুমান করে আজকাল। কিন্তু সে বুঝতে পারে না–স্বেচ্ছায় যে কলকাতা থেকে নির্বাসন নিয়ে এই বন-জঙ্গলের দেশে চলে এসেছে তার মধ্যে হটকারিতা বেশি, না কি অনুরাগ, অথবা আদর্শ? আদর্শ নয়। কেন না এই কমাসের পরিচয়ে অবনী নিঃসন্দেহে বুঝতে পেরেছে অন্ধ আশ্রমের আদর্শ বা আকর্ষণ হৈমন্তীর নেই। আদর্শ যখন নেই তখন অনুরাগ ভিন্ন আর কিছু থাকে না; সুরেশ্বরের প্রতি অনুরাগবশেই হৈমন্তী সব ছেড়ে এসেছে। এই অনুরাগ কী এখানে এসে ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেন? হৈমন্তী কী আশা নিয়ে এসেছিল, কোথায় সে ব্যর্থ হল, তার আশাভঙ্গের যথার্থ কারণ কী? হৈমন্তী কি তার দিল্লির বান্ধবীর মতন হতে পারলে সুখী হত?
অবনী লাটঠার মোড় সামনে দেখতে পেল; বলল, গুরুডিয়ায় যাবেন, না বেড়াবেন একটু?
বেড়াই…
শীত করছে না?
না, তেমন নয়।
আর একটু সরে বসুন, বাতাস লাগবে না।
হৈমন্তী আরও একটু অবনীর দিকে সরে বসল। অবনী সামনে তাকিয়ে খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে লাগল, যেন এই পথে, নির্জনে, প্রান্তর আর অতিম্লান ঈষৎ নক্ষত্রের আলোর মধ্যে তারা দুজনে ঘনিষ্ঠ ও অন্যমনস্কভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
.
১৯.
বড়দিনের ছুটির সময় সময় গগন এল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই শীত প্রচণ্ড হয়ে উঠেছিল; সেই শীতের আঁচড় প্রত্যহ যেন আরও ধারালো ও তীক্ষ্ণ হচ্ছিল। গুরুডিয়ায় পা দিয়েই গগন বলল, আরে বাপস, বরফ-টরফ পড়বে নাকি রে এখানে? হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, থাকছিস তো, পড়লে দেখতে পাবি।
গগনকে দেখলেই হৈমন্তীর সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্কটা অনুমান করা যায়। দুজনের মুখের আদল প্রায় এক, চোখ মুখ কপালের সাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। তবু পুরুষ বলে গগনের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, সব যেন ছিমছাম কাটাকাটা। তার নাক হৈমন্তীর তুলনায় শক্ত এবং উঁচু, ঠোঁট কিছুটা পুরু ও বড়। চিবুকেরও সামান্য পার্থক্য আছে। গগনের গায়ের রং ফরসা, তবে মেয়ে বলে হৈমন্তীর গায়ের রঙে যে মসৃণতা এবং কোমলতা আছে গগনের তা নেই। সুশ্রী, সপ্রতিভ, হাসিখুশি মেজাজের ছেলে গগন, বয়সে হৈমন্তীর চেয়ে বছর চারেকের ছোট। দিদির সঙ্গে তার সম্পর্কটা বরাবরই সঙ্গী এবং বন্ধুর মতন। বড় ভাই, হৈমন্তীরও বড়, সেই দাদার সঙ্গে এই দুই ভাইবোনের সম্পর্ক না থাকার মতন। চা বাগানের সেই সাহেবদাদা আর তার সিকি-মেমসাহেব বউ তাদের আত্মীয় এই মৌখিক পরিচয়টুকু ছাড়া আর কিছুই নেই বলা যায়। যোগাযোগ দেখাসাক্ষাতও নেই, এমনকী মার সঙ্গে চিঠিপত্রেও দাদা যেটুকু সম্পর্ক বজায় রাখত একসময়, আজকাল তাও রাখে না। দাদার সঙ্গে তাদের দুজনের বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল; বাবা বেঁচে থাকতেই দাদা দুরে দুরে সরে যায়, তার পর বিয়ে করে, বিয়েটা সে নিজের খেয়ালখুশিতে করেছিল, সংসারের বা মার মতামত নেয়নি, গ্রাহ্যও করেনি। তখন থেকে দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্কে বড় রকমের ফাটল ধরে যায়। হৈমন্তীর অসুখের সময় দাদার ব্যবহার দেখে এরা বুঝে নিয়েছিল ওপক্ষ কোনওভাবেই আর এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নয়; দায় দায়িত্বও অস্বীকার করতে ওদের বাধছে না। তখন থেকেই যোগাযোগ ভেঙে গেছে; মা ও মামা বছরে একটি দুটি সাধারণ চিঠি লেখে মাত্র, দাদাও সেই রকম জবাব দেয়। কাজেই পারিবারিক ও সাংসারিক সম্পর্ক যা তা এই দুই ভাইবোনেই গড়ে উঠেছে বরাবর, দাদার কথা তারা ভাবে না, ভাবতেও পারে না।
গগন এসে গুরুডিয়ায় অন্ধ আশ্রমেই উঠল। সুরেশ্বরের ইচ্ছে ছিল গগন তার কাছেই থাকবে, তার বাড়িতে। হৈমন্তীর তাতে তেমন আগ্রহ ছিল না; তার ইচ্ছে ছিল গগন তার ঘরের পাশাপাশি থাকে। হৈমন্তী আর মালিনীর ঘরের গায়ে গায়ে ছোট মতন একটা ঘর ছিল, নানা রকম অকাজের জিনিসপত্র জড়ো করা ছিল। গগন আসার আগে আগে এই ঘর পরিষ্কার করাল হৈমন্তী। একটা তক্তপোশের ব্যবস্থাও হল, নিজের ঘর থেকে ক্যাম্বিসের হেলান-দেওয়া নতুন চেয়ারটা গগনের জন্যে তার ঘরে এনে রাখল, ছোট একটা বেতের টেবিল জোগাড় করে আনল মালিনী। মোটামুটি বেশ মানিয়ে গেল ঘরটা।
সুরেশ্বর ঘরের ব্যবস্থা দেখতে এসেছিল সকালে; দেখে শুনে বলল, বাঃ, বেশ হয়েছে।
বিকেলে সুরেশ্বর আর হৈমন্তী দুজনেই স্টেশনে গেল গগনকে আনতে। শীতের সন্ধে দেখতে দেখতে ঘুটঘুঁটে হয়ে এসেছিল, সেই অন্ধকারে আর শীতে বাসে করে ওরা গুরুডিয়া এল, গগনকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে সুরেশ্বর সামান্য বসে চলে গেল। ততক্ষণে রাত হয়ে আসছে, শীতও পড়ছে।
শীতের প্রকোপ দেখে গগন বলল, আরে বাপস, বরফ-টরফ পড়ে নাকি রে এখানে?
ভাইয়ের বিছানাপত্র পেতে দিতে দিতে হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, থাকছিস তো, পড়লে দেখতে পাবি।
দু-চারটে সাধারণ ঘরোয়া কথার পর গগন বলল, সুরেশদা তখন কী যেন বলছিল রে?
কিছু না। ওর বাড়িতে থাকার কথা বলেছিল প্রথমে, আমি না করে দিয়েছিলাম।
ওর বাড়িটা কী রকম?
এই রকমই প্রায়, মাটির গাঁথনি; খান দুয়েক ঘর আছে। কাল দেখিস।
কিছু মনে করল না তো?
মনে করার কী আছে, আমার বাড়ির লোক এসে আমার কাছে উঠবে না তার কাছে!
গগন বিছানার পাশে ক্যাম্বিসের হেলানো চেয়ারটায় বসে ছিল। গাড়িতে উঠেছে বেলা দশটা নাগাদ। একটু ভিড় ছিল আজ। ট্রেনের ধকলে সামান্য ক্লান্ত হয়তো, কিংবা কলকাতা শহরের হইহট্টগোল কলরব আলো থেকে হঠাৎ এই নির্জন নিস্তব্ধ অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়েছে বলে অনভ্যস্ত অজানা অচেনা পরিবেশে নিজেকে এখনও তেমন সইয়ে নিতে না পারার জন্যে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক ও ম্লান হয়ে পড়ছিল।
বিছানার ওপর একটা র্যাগ পেতে বিছানা ঢাকা দিয়ে দিল হৈমন্তী; অন্য র্যাগটা পাট করে পায়ের কাছে রাখল। বলল, তোর বিছানায় র্যাগ ঢাকা দিয়ে রাখলাম, বিছানা গরম থাকবে। পায়ের কাছে। আর-একটা থাকল।
গগন তাকিয়ে তাকিয়ে বিছানা দেখল, অন্যমনস্কভাবে ঘরের চারপাশ তাকাল, হাই তুলল।
হৈমন্তী বিছানার পাশে বসে। ঘরের জানলা বন্ধ, দরজা প্রায় ভেজানো।
গগন হঠাৎ বলল, এই ঠাণ্ডায় তোর কষ্ট হয় না?
এ কদিন একটু হচ্ছে, রাত্রের দিকে, দিনের বেলায় হয় না। দিনের বেলাটা খুব চমৎকার।
তোর শরীর খারাপ হবে না তো? গগনের গলায় চাপা উদ্বেগ ছিল।
হৈমন্তী মাথা নাড়ল, না। আমি তো সাবধানেই থাকি।
গগন এবার সিগারেট বের করে ধরাল। ধোঁয়া টানল খানিক, তারপর বলল, মা আমায় অনেক কিছু বলে দিয়েছে, বুঝলি। মামাও।
কী বলেছে?
সে অনেক কথা। আমায় আবার পয়েন্ট ওয়ান টু করে সাজিয়ে মনে করে নিতে হবে– গগন হাসল, পরে বলব।
হৈমন্তী ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। সে মোটামুটি জানে মা কী বলেছে, কী বলতে পারে, কেনই বা গগন এখানে এসেছে। শুধু যে বেড়াবার উদ্দেশ্যেই গগন এসেছে তা তো নয়।
হৈমন্তী বলল, তুই আমার সঙ্গে কথা না বলে কিছু বলবি না কাউকে।
গগন কথার ধরন থেকে বুঝতে পারল দিদি কী বলতে চাইছে। তবু যেন বোঝেনি এমনভাবে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল।
সামান্য চুপচাপ, গগন আলোর দিকে ধোঁয়ার একটা রিং ছুঁড়ে দেবার চেষ্টা করল, পারল না। পরে বলল, সুরেশদাকে অনেক দিন পরে দেখলাম। সেই সেবারে কলকাতা গিয়েছিল আর এই বছর দু আড়াই হবে প্রায়। …শরীর স্বাস্থ্য কিন্তু বেশ ভালই আছে। মাছ মাংস খায়, না ছেড়ে দিয়েছে?
মাংস এখানে হয় না।
বলিস কী?
পয়সায় কুলোয় না। …মাছ-টাছ পাবি মাঝে মাঝে, নদীটদী থেকে ধরে আনা চুনো মাছ। স্বাদ আছে।
বলিস কী! আগে তো বলিসনি।
বলেছিলাম, ভুলে গিয়েছিল হৈমন্তী হাসল। কথাটা হৈমন্তী বাস্তবিকই বলেছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো বলেনি। সে নিজেও মাংস খায় না, খেতে ভাল লাগে না। কলকাতায় থাকতেই ছেড়ে দিয়েছে।
ভাইকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই যেন হেসে হেসে হৈমন্তী বলল, তোর ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই গগন, মাংস খেতে চাস ব্যবস্থা করে দেব। ডিম খাবি, নদীর মাছ খাবি, শাকসবজি টাটকা সব– এখানকার বাগানের। সাত দিনে ফুলে যাবি। ..
তুই কিন্তু ফুলিসনি, গগন হাসল।
বলিস না; কলকাতার জামা এখন আমার গায়ে আঁট-আঁট লাগে।
মনে তো হয় না। তবে তোর শরীর খারাপও হয়নি। রংটা কেমন পুড়ে গেছে।
শীতে এখানে ভীষণ টান ধরে, আর রোদ; সকাল তোক দেখবি কী তেজ রোদের।
গগন হৈমন্তীর চোখ মুখ এতক্ষণ লক্ষ করে করে একটা কিছু সন্দেহ করছিল। এবার বলল, এত ভাল জায়গা, কমাস ধরে রয়েছিস–কিন্তু যতটা ভাল দেখানো দরকার ততটা ভাল তোকে দেখাচ্ছে না…কলকাতায় পুজোর সময় যা দেখেছি তার চেয়ে ভাল না, বরং তোর মুখে.. কথা শেষ করল না গগন।
হৈমন্তী ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক, তার মুখের ভাব হঠাৎ মলিন হয়ে এল, যেন সে এখন আর কিছু গোপন রাখতে চাইছে না বা পারছে না। চোখের দৃষ্টিতে এই ভাবটা ফুটে ওঠার পর হৈমন্তী হয়তো সচেতন হয়েছিল, হয়ে সে যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করতে চাইল। এমন সময় বাইরে মালিনীর গলা শোনা গেল।
হৈমন্তী সাড়া দিল।
মালিনী ঘরে এল। হাতে একটা কাঠের বড় পিড়ি, তার ওপর মাটির ছোট উনুন; ছোটদের খেলাঘরের উনুনের মতন। কাঠ কয়লার আগুন করে এনেছে। উনুনটা নামিয়ে রেখে মালিনী হৈমন্তীর দিকে তাকাল, গরম জল দেব কলঘরে?
হৈমন্তী একটু অবাক হয়েছিল। ঘরে এই আগুন দেবার জন্যে বা গরম জল করার জন্যে সে মালিনীকে বলেনি। নিজে বুদ্ধি খাঁটিয়েই মালিনী করেছে। খুশি হয়ে হৈমন্তী বলল, গরম জলও করেছ! বাঃ! মালিনী বড় গুণের মেয়ে– বলে ভাইয়ের মুখের দিকে হেসে তাকাল।
মালিনী অপ্রস্তুত বোধ করল সামান্য, নিচু গলায় বলল, দাদা যাবার সময় আমায় বলে গিয়েছিলেন।
এই আতিথ্য পালনের ব্যবস্থাগুলো তবে সুরেশ্বরের নির্দেশে হচ্ছে! হৈমন্তী কিছু বলল না। মালিনী সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
গগন বলল, তা হলে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলি, কী বল!
হ্যাঁ; জামাকাপড় ছেড়ে তুই আয়, কলঘরে জল দিতে বলছি। হৈমন্তী কেমন অন্যমনস্ক গলায় বলল, বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে ভাইবোনে গল্প হচ্ছিল। গগন বিছানার ওপর একটা র্যাগ চাপিয়ে বসে, হৈমন্তী শাল মুড়ি দিয়ে ক্যাম্বিসের চেয়ারে বসে। পায়ে ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে মোজা পরেছে। দুজনের সামনে কাঠের তক্তার ওপর সেই কাঠকয়লার উনুন, তার আঁচ নিবে এসেছে প্রায়।
কলকাতার বাড়ির কথা, মা আর মামার কথা, চেনাজানা কারও কারও কথার পর প্রসঙ্গটা শেষাবধি ফুরিয়ে গেলে দুজনেই থেমে গেল। অল্প সময় চুপচাপ। তারপর গগন বলল, তোদের সেই ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের খবর কী?
কে, অবনীবাবু?
হ্যাঁ
আছেন। পাটনায় যাবার কথা ছিল, অফিসের কাজে। গিয়েছিলেন জানি। ফিরে আসার কথা। এ কদিন আর স্টেশনে যেতে পারিনি।
তুই কি স্টেশনে যাস নাকি?
যাই; মাঝে মাঝে যাই। …এখানে মুখ বুজে থাকা, কথা বলার মতন মানুষ নেই একটা কথা বলতে হলে ওই মালিনী। কত আর পারা যায়!
সুরেশদা…
ও-সব বড় বড় মানুষ, ওদের কথা আলাদা। গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করার অবসর নেই। হৈমন্তী প্রসঙ্গটা অন্যভাবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও তার কথার স্বরে নৈরাশ্য ও চাপা বিরক্তি ছিল।
গগন নির্বোধ নয়, তার কানে হৈমন্তীর মনের বিরূপতা ধরা পড়ল। হৈমন্তীর চোখ লক্ষ করল গগন, পরে বলল, তোকে তো তেমন খুশি মনে হচ্ছে না।
হৈমন্তী ভাইয়ের দিকে তাকাল না। নিচু মুখে শালের পাড় খুঁটতে লাগল। বলল,অখুশির কী বুঝলি!
গগন সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। হাত দুটো উনুনের আঁচে দেবার জন্যে ঝুঁকে বসল, তাত নেবার চেষ্টা করল, আগুন নিবে গেছে, সামান্য একটু তাত, ঠিক মতন অনুভব করাও যায় না।
আমি তো এই ব্যাপারটা সেটেল করতে এসেছি গগন ধীরে ধীরে বলল, মার পক্ষে এরকম ভাবে বসে থাকা আর সম্ভব নয়। অনেক বয়েস হয়ে গেছে, শরীর খারাপ, আজকাল সবসময় দুশ্চিন্তা করে। মামা বুড়ো মানুষ, সারাটা জীবন আমাদের নিয়ে থাকল, মামাও এখন আর শুনতে চায় না। কে কবে চোখ বুজবে সেই ভাবনায় পড়েছে আজকাল, দায়দায়িত্বটুকু সেরে ফেলতে চায়।
হৈমন্তী কোনও কথা বলল না। হেঁট মুখেই বসে থাকল।
গগন অপেক্ষা করল সামান্য, তারপর আবার বলল, দাদার ব্যাপারের পর মার নানা রকম ভয়, মামারও। দাদাকে আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি অনেককাল, দাদাও দিয়েছে। তুইও যদি..
কেন, তুই তো আছিস হৈমন্তী এবার মুখ খুলল, যেন সে আপ্রাণ চেষ্টা করল গগনের কথা সমস্ত গাম্ভীর্য সামান্য হালকা করে আবহাওয়াটা নরম করার।
আমার কথা ছাড়। আমি তো তোর ছোট।
ইস, তুই এখনও কচি খোকা– হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল।
গগন হেসে হেসে জবাব দিল, আমার এখনও ম্যাচুরিটি হয়নি। তিরিশ একতিরিশ বছর বয়সে আজকাল ছেলেরা বিয়ে-ফিয়ে করে না। দাঁড়া–ওয়েট কর–আগে কেরিয়ারটা তৈরি করেনি তারপর কি আর বসে থাকব!
তোর সেই সাঁতার কাটা মেয়ে বন্ধুটার খবর কী? হৈমন্তী রগড় করে জানতে চাইল।
আরেব্বাস, তার তো সাংঘাতিক বিয়ে হয়ে গেছে–জানিস না। ফরেন সার্ভিসের এক ছোরার সঙ্গে। বিগ ফ্যামিলি। …বুঝলি দিদি, আমি আগে থেকেই বাইলাইনে চলে গিয়েছিলাম; ওসব বিগ ব্যাপারে থাকতে নেই। এখন একটা স্টেনোটাইপিস্ট মেয়ের সঙ্গে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি, নবনীর বোন, তুই দেখেছিস, নামটা বলব? গগন চোখমুখ ফুলিয়ে হাসছিল।
হৈমন্তী হাসতে হাসতে ডান হাত তুলে চড় মারার ভঙ্গি করল, তোর গালে ঠাস করে এক চড় মারব। বড্ড পেকে গিয়েছিস…! পাজি…!
পাকাপাকি কিছু নেই। প্রেম-ফ্রেম না থাকলে এই বয়সটার লাইফ থাকে না। কমলাকে আমার পাশে দেখলেই বুঝতে পারবি তার পাশে আমার লাইফ-ফোর্স কত বেড়ে যায়।
হৈমন্তী খিল খিল করে হেসে উঠল। এমন হাসি সে এখানে কোনওদিন হাসতে পারেনি, কলকাতায় হাসতে পারত। এখানে তার পারিবারিক সম্পর্ক কোথাও নেই, এমন কেউ নেই যার সঙ্গে তার এমন মেহমধুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে। কলকাতায় মা ছিল, মামা ছিল, গগন ছিল, দু-একজন বন্ধু ছিল। কলকাতায় সে সংসারের একজন মানুষ, পারিবারিক সম্পর্কে, আত্মীয়তায় স্নেহ-বন্ধুত্বে অন্যের সঙ্গে জড়িত; এখানে সে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন। আশ্রমের মানুষের কাছে সে ডাক্তার, বড়জোর মালিনীর হেমদি। কর্তব্য পালন ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক নেই অন্যের সঙ্গে। স্বাভাবিক জীবনের এই আনন্দ ও সুখটুকু থেকে সে বঞ্চিত হবে এমন কথা আগে ভাবেনি। এখন বুঝতে পারে, হৈমন্তীর কলকাতার জীবনটা ছিল ঘরোয়া, সংসারের মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল, ডাক্তারিটা তার পোশাকি জীবন ছিল; বাইরে কাজের সময়টুকু এই পোশাকি জীবনে সে কাটাতে পারত, তাতে অস্বস্তি হত না, কষ্টও থাকত না। কিন্তু এখানে যা হয়েছে তা উলটো, পোশাকি জীবনটাই তার সব হয়ে উঠেছে, পারিবারিক জীবনের স্বাদ কোথাও নেই।
হাসি থেমে গিয়েছিল হৈমন্তীর; অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শীতের কনকনানি গায়ে লাগল, শিউরে ওঠার মতন কাঁপল একটু। অনেকটা রাত হয়ে গেছে, দশটা বাজল। বাঁ হাতে বাঁধা ঘড়ি দেখে নিয়ে হৈমন্তী এবার নড়ে চড়ে উঠল। দশটা বাজল; নে আর রাত করিস না, শুয়ে পড়। বলতে বলতে হৈমন্তী উঠে দাঁড়াল।
তুই তো কিছু বললি না? গগন শুধোল।
তোর কথা আগে শুনি। মা, মামা কী সব বলে দিয়েছে তোকে মনে করে রাখ, কাল বলিস…
সে আমি সুরেশদাকে বলব।
না, আগে আমায় বলবি।
সুরেশদাকে বলার জন্যেই বলেছে।
বলুক। আমার ব্যাপারে যা বলার আমায় আগে না জানিয়ে তুই কাউকে বলবি না। …মা মামা তোকে এখানে কারও কাছে হাত জোড় করতে পাঠায়নি।
হাত জোড় করার ব্যাপারই নয়..।
না হলেই ভাল। নে শুয়ে পড়, দরজাটা বন্ধ করে দে। হৈমন্তী দরজার দিকে পা বাড়াল।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে গগন হেসে বলল, সুরেশদার কাছে তুই আমায় এই জন্যেই থাকতে দিলি না নাকি রে?
কথাটার স্পষ্ট কোনও জবাব দিল না হৈমন্তী। বলল, তোর সঙ্গে কথা বলতে গল্প করতে আমায় ও-বাড়ি ছুটতে হবে নাকি! ওবাড়িতে আমি বড় যাই না। আমার কাছে না থাকলে তোকে পাব কী করে সব সময়…নে,, দরজা বন্ধ করে দে।
অনেক রাত পর্যন্ত হৈমন্তীর ঘুম এল না। গলা পর্যন্ত লেপ টেনে শুয়ে থেকে থেকে সে কখনও চোখ খুলে নিবিড় অন্ধকার দেখছিল, কখনও চোখের পাতা বুজে ঘরের মধ্যে সঞ্চিত মাঝরাতের শীতে অস্বস্তি বোধ করছিল। তার কপাল ঠাণ্ডা, নাকের ডগাও তেমন গরম নয়, নিশ্বাসও ভারী হয়ে উঠেছে। এই শীত তাকে নিদ্রাহীন করছিল কিনা বলা যায় না, তবে শীতের প্রতি তার তেমন মনোযোগ ছিল না; সে অন্য চিন্তা করছিল, চিন্তা থেকে যখন মন সরে যাচ্ছিল শীতের স্পর্শে সামান্য অস্বস্তি বোধ করছিল। চিন্তা এবং উদ্বেগেই তার ঘুম আসছিল না।
গগন এসেছে: কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে হৈমন্তী জানে। সুরেশ্বর এবং গগনের মধ্যে কাল পরশু বা দু-একদিনের মধ্যে যে কথাবার্তা হবে হৈমন্তী তা অনুমান করে নিচ্ছিল এবং ভাবছিল। সুরেশ্বরের মনোভাব সম্পর্কে হৈমন্তীর নতুন করে আর বেশি কিছু জানার নেই, এই কমাসে ক্রমশ তা জানা হয়ে গেছে, এখন-হৈমন্তী প্রায় নিশ্চিতরূপে বলতে পারে, সুরেশ্বর গগনকে নিরাশ করবে। গগন তা জানে, কিংবা মনে মনে তার কিছুটা সন্দেহ দেখা দিলেও সে সুনিশ্চিত করে কিছু জানে না। মা আর মামাও এতটা বোঝেনি, জানতে পারেনি। হৈমন্তী কলকাতায় গিয়ে যে কদিন ছিল মাকে, মামাকে তার এই ব্যর্থতার বিষয় বুঝতে দেয়নি। কিন্তু এখন গগন এখানে আসার পর সুরেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি কথার পর কারও কিছু অজানা থাকবে না।
গগনকে নিজের কাছে রাখার পিছনে হৈমন্তীর স্বার্থ ছিল। সে চায়নি গগন সর্বক্ষণ সুরেশ্বরের কাছে থাকে। সুরেশ্বরের হাতে গগনকে ছেড়ে দিলে সুরেশ্বর তাকে কী বোঝাত, কী বলত, কোন যাদুতে বশীভূত করত কিছুই বোঝা যেত না। গগন সুরেশ্বরকে যথেষ্ট মানা করে, পছন্দ করে, এমনকী শ্রদ্ধাও করে। সুরেশ্বর গগনকে বাল্যকাল থেকে দেখে আসছে, গগনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সরল স্নেহপ্রীতির আত্মীয়তার মতনই। গগনের মতন সাধাসিধে সরল ছেলেকে অনায়াসে সুরেশ্বর গালভরা কথায় মিষ্ট ব্যবহারে ভোলাতে তার মর্জি মতন চালিয়ে নিতে পারত। তা ছাড়া, গগন বড় বোকা; দিদির প্রতি তার অনুরাগ এত বেশি যে, সে দিদির জন্যে সুরেশ্বরের কাছে যে কোনও রকম দীনতা প্রকাশ করে ফেলতে পারে। তাদের সংসারের অনেক কথা আছে যা একান্তভাবেই তাদের কথাদুর্বলতার মুহূর্তে গগন কী সে সব কথাও সুরেশ্বরের কাছে না বলে থাকতে পারত।
হৈমন্তী এ সব চায়নি। সে চায় না–তার মা, মামা বা ভাইয়ের কথাবার্তা থেকে সুরেশ্বর বুঝতে পারে তারা দীনতা প্রকাশ করছে। গগন এখানে ভিক্ষা চাইতে আসেনি, সুরেশ্বরের কাছে তারা কেউ আবেদন জানাচ্ছে না, ভিক্ষাও চাইছে না। তাদের সংসারের মর্যাদাটুকু হৈমন্তী নষ্ট হতে দিতে চায় না; সেই সঙ্গে নিজের মর্যাদা।
গগনকে নিজের কাছে রাখার বড় কারণ হৈমন্তী তাকে আগলে রাখবে। গগনকে সে এমন কিছু করতে বা বলতে দেবে না যাতে সুরেশ্বরের অহমিকা বোধ আরও স্ফীত হয়ে ওঠে। সংসারে এমন মানুষ আছে যারা এই অহমিকাকে সম্বল করে আত্মচরিতার্থতা লাভ করে, খুশি হয়। সুরেশ্বর সে-জাতের মানুষ কি না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হৈমন্তীর নেই, কিন্তু তার বাড়ির লোকের আচরণে যদি কাতর আবেদন ও ভিক্ষার মনোভাব প্রকাশ পায় সুরেশ্বরের অহমিকা বোধ তৃপ্ত হতে পারে। গগনকে হৈমন্তী তেমন কিছু করতে দেবে না, বরং যতটা সম্ভব গগনকে সে সুরেশ্বরের কাছ থেকে তফাত রাখার চেষ্টা করবে। প্রয়োজন হলে গগনকে সে তার পক্ষে টেনে এনে সুরেশ্বরের সঙ্গে লড়তেও রাজি, তবু ওই মানুষটার কাছে আত্মসম্মান সে নষ্ট করবে না, কাউকে করতে দেবে না।
সুরেশ্বরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ইদানীং প্রায় এক ধরনের বিশ্রী তিক্ততার মধ্যে এসে পড়েছে। সুরেশ্বর পরে আবার চেষ্টা করেছিল হৈমন্তী যেন দুবেলা হাসপাতাল খুলে রাখে, তার সুবিধে মতন। হৈমন্তী দুবেলা হাসপাতালে আসতে রাজি হয়নি, তবে সে আজকাল বেলায় আরও এক ঘণ্টা বেশি থাকে। তাতে তার স্নান খাওয়াদাওয়া বিশ্রামের অসুবিধে ঘটছে। তা ঘটুক, তবু নিজের জেদ থেকে হৈমন্তী নড়বে না। সুরেশ্বর হৈমন্তীর এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছে, হৈমন্তীর জন্যে দুশ্চিন্তা জানিয়েছে, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কোনও পীড়াপীড়ি করেনি।
সেদিন অবনীর সঙ্গে একটু রাত করে ফেরার সময় আশ্রমের বাইরে রাস্তায় সুরেশ্বরকে হৈমন্তী ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল। অবনী দেখতে পায়নি। সুরেশ্বর ঠিক কেন যে অন্ধকারে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল হৈমন্তী জানে না, তবে তার সন্দেহ হয়েছিল, মালিনীর কাছে হৈমন্তীর একলা স্টেশন যাবার কথা জানতে পেরে, এবং সন্ধের পরও হৈমন্তী না ফিরে আসার জন্যে বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হয়ে সুরেশ্বর ওইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সন্ধের বাসে যখন ফেরেনি তখন যে অবনীর গাড়িতে ফিরবে একথা জেনেও সুরেশ্বর কেন অধৈর্য হচ্ছিল? হয়তো সে কিছু দেখতে চাইছিল। যদি সুরেশ্বর মনে মনে কিছু দেখার আশা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করে থাকে সেদিন, তবে সে দেখেৰ্ছে হৈমন্তী আর অবনী পাশাপাশি বসে রাত্রে আশ্রমে ফিরে আসছে।
পরের দিন এ প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও কথা ওঠেনি। সুরেশ্বর আসেনি, বা হৈমন্তীকে ডেকে পাঠায়নি। মালিনীকেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি হৈমন্তী। হতে পারে, সুরেশ্বর সেদিন রাত্রে শীতের মধ্যে এমনিই ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না, হৈমন্তীর ফেরা না-ফেরার জন্যে তার উদ্বেগ বা ব্যস্ততাও ছিল না। তবু সেদিন যা ঘটেছে তাতে হৈমন্তী কোথায় যেন খানিকটা তৃপ্তি অনুভব করেছে।
কয়েক দিন পরে অন্য রকম এক ঘটনা ঘটল। পাটনা যাবার আগে অবনী দেখা করতে এসেছিল। তখন অন্ধকার হয়ে আসছে, হৈমন্তী বিকেলে খানিকটা বেড়িয়ে ঘরে ফিরেছে, অন্ধ আশ্রমের মাঠে গাড়ি দাঁড়াল অবনীর। হৈমন্তী অবনীকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। অনেকক্ষণ ছিল অবনী, গল্পগুজব করল, চা খেল, তারপর চলে গেল। সুরেশ্বরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে তার ছিল, কিন্তু গল্পগুজবের মধ্যে উঠি উঠি করেও আর ওঠা হয়নি। শেষ পর্যন্ত সুরেশ্বরের সঙ্গে তার দেখা হয়নি।
পরের দিন বেলায় হাসপাতালের সামনে সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর দেখা।
সুরেশ্বর বলল, কাল অবনীবাবু এসেছিলেন?
হ্যাঁ, পাটনায় যাচ্ছেন…
পাটনা! …কখন এলেন কখন গেলেন জানতেই পারলাম না। পাটনা যাবেন জানলে একটা কাজের ভার দিতাম। …কখন যাবেন?
আজ রাত্তিরের গাড়িতে।
ও! …দেখি…, সুরেশ্বর যেন মনে মনে কিছু ভাবল, তারপর বলল, কাল একবার দেখা হলে ভাল হত।
হৈমন্তী পলকের জন্যে সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকাল, তারপর একেবারে আচমকা কেমন যেন কোনও অদ্ভুত এক ইচ্ছার তাড়নায় বলে ফেলল, সময় পাননি। কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল।
সুরেশ্বর যে হৈমন্তীকে লক্ষ করছে হৈমন্তী না তাকিয়েও বুঝতে পারল। পরে সুরেশ্বর বলল, তাই হবে, সময় পাননি।
কথাটা হৈমন্তীর কানে খুব শ্রুতিমধুর হয়নি।
.
২০.
জায়গাটা গগনের খুব পছন্দ হয়ে গেল। এত পছন্দ যে প্রথম দিনটা সে পায়ে হেঁটে আশেপাশে সারাটা সকাল-দুপুর ঘুরে বেড়াল, শীতের লালচে ধুলো মাখল, রোদে পুড়ল, পুড়ে মাথার চুল রুক্ষ করে বিকেল নাগাদ বনের দিক থেকে বেড়িয়ে ফিরল। ফিরে এসে বলল, ব্রিলিয়ান্ট জায়গা, বুঝলি দিদি, চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়। কলকাতায় আমরা তাকাতে পারি না, দু হাত অন্তর অবস্ট্রাকসান, এখানে ফুল ভিউ; এসব জায়গায় তাকিয়েও কী আরাম!
গগন এই রকমই, অল্পতেই উচ্ছ্বসিত, সামান্যতেই সন্তুষ্ট। সে বেড়াতে এসেছে এই ভাবটা তার প্রথম দুটো দিন পুরোপুরি বজায় থাকল। বেড়িয়ে, খেয়ে-দেয়ে, ঘুমিয়ে গল্প-গুজব করে দিব্যি কাটিয়ে দিল, গুরুডিয়ার শীত নিয়ে সুরেশ্বরের সঙ্গে হাসিতামাশা করল, অন্ধ আশ্রমের গল্প-গুজব শুনল, কপি কড়াইশুটির স্বাদ, ডিমের কুসুমের রং নিয়েও অনর্গল কথা বলে গেল। বোঝার জো ছিল না, গগনের মনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে। আসল কথাটা সে ঘুণাক্ষরেও তুলল না; সুরেশ্বরকে বুঝতে দিল না কয়েকটা দিন বেড়িয়ে যাওয়া ছাড়া তার অন্য কোনও কাজ আছে।
সুরেশ্বরের কাছে কথাটা না তুললেও গগন তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল। গগন হৈমন্তীকে খুব সাবধানে লক্ষ করছিল, এবং বোঝবার চেষ্টা করছিল। দিদির মনের ভাবটা ঠিক কী ধরনের। আড়ালে দুই ভাই বোনে যেসব কথাবার্তা হত তার বেশির ভাগটাই ছিল ব্যক্তিগত; সেই কথার মধ্যে সুরেশ্বরের প্রসঙ্গটা অবধারিত ছিল। গগন সেসব ক্ষেত্রে নিজে বেশি কিছু বলত না, যতটুকু বলত তাতে তার কিছু চালাকি থাকত। সে জানতে চাইত, দিদির মনের কোনও অদলবদল ঘটেছে কি না, দিদি চেষ্টা করে কোনও কথা লুকোতে চাইছে, নাকি তার এই তিক্ততা ও বিরক্তি নেহাতই অভিমান। এক এক সময় তার মনে হত, দিদির মধ্যে এখন যে রাগ, বিতৃষ্ণা, ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে সেটা প্রকৃতপক্ষে কিছু নয়, প্রণয় কলহ হলেও হতে পারে; আবার অন্য সময় দিদির কথাবার্তা থেকে গগনের সন্দেহ হত, ব্যাপারটা ঠিক সরল নয়, দিদির মনের কোথাও এতদিনের সঞ্চিত বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নষ্ট হয়ে গেছে।
তৃতীয় দিনে গগন গেল স্টেশনে বেড়াতে। সঙ্গে হৈমন্তী। সুরেশ্বর যেতে পারল না। অবনীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় সেরে ফেরার পথে বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা। বিজলীবাবুর সঙ্গে পরিচয়টা প্রথম দিনেই ঘটেছিল, বাস স্ট্যান্ডে। বিজলীবাবু শুধোলেন, কী, কেমন লাগছে? গগন আবার হেসে বলল ওয়ান্ডারফুল। বিজলীবাবু বললেন, জায়গাটা তো ভালই, বিশেষ করে এ সময়। তা এদিকে এসে থাকুন দু-চার দিন, ঘুরে ফিরে বেড়ানো যাবে। গগন বলল সেসব ঠিক হয়ে গেছে অবনীবাবুর সঙ্গে…। বিজলীবাবু মাথা নাড়লেন সায় দিয়ে, তবে তো ব্যবস্থা হয়েই গেছে। দু-চারটে হালকা কথার পর গগনরা বিদায় নিল।
বাস স্ট্যান্ডে বাস হর্ন দিচ্ছিল, শেষ সময়ের যাত্রী ডেকে নিচ্ছে। আজ তেমন যাত্রী নেই। এই শীতের সময়টায় সন্ধের বাসে সাধারণত ভিড় থাকে না। ফার্স্ট ক্লাসে কোনও যাত্রী নেই। গগনরা উঠল। পেছনে কিছু যাত্রী বোঁচকা বুচকি নিয়ে বসে কলরব করছে।
বাস ছাড়ল সামান্য পরেই। সঙ্গে সঙ্গে কনকনে বাতাসের ঝাঁপটা এল। পাশের জানলা দুটো তুলে দিল গগন, তাদের মাথার ওপরে মিটমিটে বাতিটা আজ জ্বলছে না। বাজার ছাড়িয়ে আসতেই পৌষের শীতে গায়ে কাঁটা দিল। গগন গলায় মাফলার জড়িয়ে ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল; হৈমন্তী দুহাতে কান চাপা দিয়ে আচমকা শিউরে ওঠার ভাবটা যেন সামলে নিল।
বাজার ছাড়িয়ে, থানা ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারের মধ্যে এসে পড়ল বাস, দুপাশে কোথাও এক ফোঁটা আলো নেই, অসাড় চরাচর, সামনে জোরালো আলোর স্রোত ফেলে বাসটা চলেছে, পেছনে যাত্রীরা কথা বলছে, কাশছে, বিড়ি ফুকছে।
গগন বলল, বেড়াবার ব্যবস্থা ভালই হল, কী বল?
তা হল। কিন্তু আমি তোদের সঙ্গে অত হুড়তে পারব না।
না পারলি; রাত্রে তোকে সঙ্গে নেওয়াও উচিত হবে না। দিনের বেলাটায় থাকবি।
দেখি…, দিনে তো আবার হাসপাতাল।
সে ম্যানেজ করা যাবে।
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে গগনকে দেখবার চেষ্টা করল, অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যায় না, পেছনের আলোটুকু সম্বল। তোর সুরেশদাকে বলবি নাকি?
বললেই বা! বড়দিনের সময় একটু বেড়াবি তাতে আপত্তির কী আছে।
না, বলবি না।
গগন সিগারেটের ধোঁয়া গিলে নিয়ে হৈমন্তীর দিকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে বসল। হৈমন্তীর গলার কাছে শাড়ির ভাঁজটা ফুলে আছে, চিবুক ঢাকা পড়েছে প্রায়, গায়ের গরম কোটটা কালো, অন্ধকারে শুধুমাত্র মুখটুকু অবস্থা দেখা যায়।
গগন সামান্য অপেক্ষা করে বলল, তোর ব্যাপার-ট্যাপার আমার কাছে মিস্টিরিয়াস লাগছে।
হৈমন্তী কথার জবাব দিল না।
গগন চুপচাপ কিছু ভাবছিল। ধীরে ধীরে কয়েক মুখ সিগারেটের ধোঁয়া খেল, তারপর খুব ঘনিষ্ঠ গলায় মৃদুস্বরে বলল, তোর ইচ্ছেটা কী?
হৈমন্তী এবারও কথার কোনও জবাব দিল না। গগনের সঙ্গে একদিন নিভৃতে তার যেসব কথাবার্তা হয়েছে তাতে অন্তত একটা কথা সে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে, সুরেশ্বরের কাছে তার আর কোনও রকম প্রত্যাশা নেই। ওই মানুষটিকে সে আগে যেমন করে চিনত তার সঙ্গে আজকের সুরেশ্বরের পার্থক্য যথেষ্ট। সে দিনের সাধারণ মানুষ আজ কতখানি অসাধারণ হয়েছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার তার নেই। হতে পারে সুরেশ্বর মাটি ছেড়ে আকাশে উঠেছে, ছোটখাটো সুখ থেকে বড় সুখের অন্বেষণ করছে; কিন্তু তাতে হৈমন্তীর কী? হৈমন্তী কি এসব চেয়েছিল? না, সে চায়নি, চায় না।
অপেক্ষা করে করে শেষে গগন বলল, দিদি, তুই আমার কাছে স্পষ্ট করে বল। বলে গগন আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকল।
হৈমন্তী নীরব। তার নিশ্বাস পড়ল। বাসের পেছনের যাত্রীদের মধ্যে কে যেন দেহাতি সুরে দেহাতের গান গাইছে গুন গুন করে; একটানা প্রায় একই রকমের একটা শব্দ বাসের, কানে সয়ে গেছে, মনে হয় যেন এই শব্দটাই চিরস্থায়ী।
দিদি…
উঁ।
তোকে তো কেউ জোর করে এখানে আনেনি।
ঠকিয়ে এনেছে…
এটা তোর রাগের কথা নয় তো?
না।
তুই তো সব জানতিস।
না, জানতাম না। আমি এতদিন যা করেছি অন্যের মন রাখতে করেছি…
এতদিন।
এতদিন বই কি। ডাক্তারি পড়ার, ডাক্তার হবার শখও আমার ছিল না। আমার ভাল লাগে না। তবু সাত আট বছর এই বেগার খাটলাম কেন?
গগন সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল। কথাটা তাদের পরিবারে কেউ যে বুঝত না তা নয়, সকলেই বুঝত: দিদির ডাক্তারি পড়ার আগ্রহটাই ছিল সুরেশদার। মা বা মামার তেমন মত ছিল না। অথচ তখন কেউই খুব একটা বাধা দেয়নি; দেবার মতন মনের অবস্থা ছিল না। সকলেই ধরে নিয়েছিল সুরেশ্বরের আগ্রহ তার ভাবী পত্নী সম্পর্কে, হৈমন্তীকে সে মনোমতো করে গড়ে নিতে চায়। ওটা তার শখ হয়তো। তা ছাড়া তখন তাদের সংসার সুরেশ্বরের প্রতি এত কৃতজ্ঞ ও তার প্রতি সকলের অনুরাগ এত বেশি যে, সুরেশ্বরের ইচ্ছা ও সাধ অপূর্ণ রাখতে কেউ চায়নি। বলতে গেলে, গগনের এখন সন্দেহ হয়, দিদি সম্পর্কে তাদের সংসারের মনোভাবটা তখন যুক্তিযুক্ত হয়নি। এমনকী–মনে মনে সকলেই যেন সুরেশদাকে দিদির অভিভাবক জেনে নিয়ে দিদিকে সুরেশদার মনোমতন চলতে দিয়েছিল। পরে, বছর দুই তিন পরে, মার কেমন সন্দেহ হয়; সুরেশদা তখন কলকাতা ছেড়েছে, মাঝে মধ্যে আবার চলে যায়। মার মনে খটকা লাগলেও দিদি তখনও কিছু বোঝেনি। বা বুঝলেও শান্ত হয়ে থেকেছে, বিশ্বাস রেখেছে। তারপর যতই দিন গেছে মা ততই অস্থির অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সুরেশদা যে কী করছে, কেন এই সব আশ্ৰমফাশ্রম–এতে কী হবে মা বুঝত না, মার ভালও লাগত না। মা এসব থেকেই সাবধান হতে চেয়েছিল। অথচ দিদির মন মা ভাল করে জানত বলেই কিছু করতে পারেনি। দিদি যেন তখন মাঝনদীতে এসে পড়েছে, ফিরে যাওয়া অসম্ভব, বাকিটুকু সে পার হয়েছে প্রত্যাশা নিয়েই, দ্বিধা যদি এসেও থাকে তার অন্য কোনও উপায় ছিল না। এখন আর দিদির কোনও ভরসা নেই।
দিদির জন্যে গগনের দুঃখ হল। তার খারাপ লাগছিল। সুরেশদার সঙ্গে এখন পর্যন্ত সে কোনও কথা বলেনি, আজ বলবে। দিদির পক্ষে যা বলা সম্ভব নয়, গগনের পক্ষে তা বলতে আটকাবে না।
গগন সামান্য কুঁজো হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকল কিছু সময়। ভাবছিল। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে মুখ যেন অসাড় হয়ে আসছিল। মাফলারটা কানের ওপর চাপা দিল গগন। তারপর বলল, সুরেশদার সঙ্গে তোর সরাসরি একটা কথা হওয়া উচিত ছিল এত দিনে। তুই তো কমদিন আসিসনি।
হৈমন্তী চুপ করে থাকল। তার মনে হল না, যা সে বুঝেছে এর বেশি কিছু তার বোঝার ছিল। এতটা বয়সে সুরেশ্বরের সঙ্গে সে ছেলেমানুষের মতন গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করবে নাকি?
তুই কলকাতায় গিয়ে আবার এলি কেন–তাও তো আমি বুঝি না, গগন বলল।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না হৈমন্তী, সামান্য পরে বলল, দেখতে
দেখতে! কী দেখতে?
মহাপুরুষ–, হৈমন্তীর কথার সুরে শ্লেষ ছিল।
গগন কিছু বুঝতে পারল না। ভাবল, দিদি উপহাস করছে।
হৈমন্তী যেন বুঝতে পারল গগন কী ভাবছে; নিজের থেকেই আবার বলল, তুই ভাবছিস ঠাট্টা করছি। ঠাট্টা নয়; সত্যিই আমি মানুষটাকে দেখার জন্য থেকে গিয়েছি। হৈমন্তীর বলার মধ্যে উপহাস থাকলেও কোথাও যেন তার অতিরিক্তও কিছু ছিল, সেটা যে কী স্পষ্ট বোঝা গেল না।
গগন কথাটায় তেমন কান দিল না। বলল, অনেক দেখেছিস? এবার নিজেকে দেখ।
হৈমন্তী গাড়ির সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল; ড্রাইভারের পিঠ, কয়েকটা শিকের ফাঁক দিয়ে অতি মৃদু একটা আলো, ইঞ্জিনের শব্দ…। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হৈমন্তী মৃদু গলায়, যেন আপনমনেই বলল, মানুষ নিজেকে কত বড় করে দেখতে চায় তা যদি তুই জানতিস, গগন।
গগন ভাবছিল, দিদিকে এবার সে স্পষ্ট করে একটা কথা জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস করবে, তুই ঠিক করে বল, সুরেশদাকে তুই এখনও ভালবাসিস কি না? হৈমন্তীর কথায় তার প্রশ্নটা মুহূর্তের জন্যে তেমন এলোমেলো হয়ে গেল। নিতান্ত কথার জবাব দেবার জন্যে বলল, সুরেশদার কথা বলছিস।
কী রকম?
নিজেদের আর মানুষ ভাবে না। তোর আমার মতন হলে তাদের মহত্ত্ব থাকবে না–এই ভয়ে মেকি সাজ পরে থাকে। লোকের কাছে এমন ভাব দেখায় যেন তারা ঠাকুর দেবতা।
হ্যাঁ, সেই রকম…, হৈমন্তী এবার উত্তেজিত হয়ে ওঠার মতন হয়েছিল; মিষ্টি করে কথা বললে, বিনয়-বিনয় ভাব করে থাকলেই মানুষ ভগবান হয় না। আমি মাটির ঘরে থাকি, জঙ্গলে এসে অন্ধ আশ্রম খুলেছি–তোমরা দেখো আমি কত বড়! আমি মহাপুরুষ। –এসবই লোক-দেখানো। …আসলে মানুষটা কী তা আমি দেখতে পাচ্ছি।
হৈমন্তীর গলার স্বর উঁচু হয়ে গিয়েছিল। গগন দিদির গায়ে হাত দিল, যেন খেয়াল করিয়ে দিল সামনে ড্রাইভার রয়েছে।
অল্পক্ষণ কেউ আর কথা বলল না। বাস লাঠার মোড়ে পৌঁছে এল।
গগন আবার একটা সিগারেট ধরাল। তারপর অন্যমনস্কভাবে বলল, তুই কলকাতায় ফিরে চল।
না– মাথা নাড়ল হৈমন্তী।
কেন যাবি না?
এখন যাব না। বলে চুপ করে থাকল হৈমন্তী সামান্য, তারপর হঠাৎ বলল, আমার অসুখের সময় অনেকগুলো টাকা দিয়েছিল ও। কত টাকা আমি জানি না। মা আর মামা মোটামুটি জানে। আমায় তুই জানাস তো কলকাতায় গিয়ে।
গগন অবাক হয়ে তাকাল। কেন?
ঋণ শোধ করব, হৈমন্তী কেমন এক গলা করে বলল, আমার টাকা থাকলে আমি ওকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিতাম।
গগন হাসল না, অথচ কথাটার গুরুত্বও দিল না; বলল, এসব তোর ছেলেমানুষি।
তোরা যখন হাত পেতে টাকাটা নিয়েছিলি তখন তো ছেলেমানুষি মনে হয়নি।
গগন যেন অস্বস্তি বোধ করল। চুপ করে থাকল সামান্য, তারপর বলল, শুধু টাকা তো দেয়নি, আরও কিছু দিয়েছিল…।
কথাটার অর্থ বুঝতে হৈমন্তীর কোনও অসুবিধে হল না। বলল, আর যা দিয়েছিল–সেটা যদি দিয়েও থাকে–ও একলা দেয়নি; আমিও দিয়েছিলাম। হৈমন্তী থেমে গেল, কয়েক মুহূর্ত আর কথা বলল না, শেষে বলল, মনে মনে ওর যদি কোনও অহঙ্কার থাকে তবে একদিন আমার অসুখের সময় দয়া করে বাঁচিয়ে ছিল বলে, অন্য কোনও অহঙ্কার ওর থাকতে পারে না।
বাস লাটঠার মোড়ে এসে দাঁড়াল। দুজন মাত্র যাত্রী। তারা নামল। কে যেন উঠল একজন। বাস ছাড়ল। গুরুডিয়ায় যাবে।
সারা মাঠ জুড়ে পৌষের হিম হাওয়া হা হা করে ছুটে বেড়াচ্ছে যেন গায়ের হাড়ে শীত ফুটছিল, মাঠের প্রান্ত দিয়ে শেয়াল ডেকে যাচ্ছে। কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাসটা টাল খেতে খেতে চলেছে।
গগন হৈমন্তীর গায়ের দিকে সামান্য ঘন হয়ে বসে ইতস্তত করে শেষে বলল, দিদি, সুরেশদাকে তোর আর ভাল লাগে না?
হৈমন্তী মাথা নাড়ল। না, লাগে না।
তোর মন বদলে গেছে?
জানি না। …হয়তো গেছে।
তা হলে এখানে থেকে লাভ কী! কলকাতায় ফিরে চল।
এখন না। …
কী করবি এখানে থেকে–?
মজা দেখব। … সুরেশমহারাজ যতটা চকচক করছে তাতে লোকে তাকে সোনা ভাবে; আমি জানি, ও-মানুষ সোনা নয়, ও কত ছোট তা আমার খানিকটা জানা হয়েছে, বাকিটা দেখব। হৈমন্তী সমস্ত কথাটাই ব্যঙ্গ করে বলার চেষ্টা করল, অথচ গগন বুঝতে পারল দিদি যেন কীসের এক আক্রোশ অনুভব করছে।
আশ্রমে ফিরে এসে গগন বলল, তুই যা, আমি একটু সুরেশদার ওখান থেকে ঘুরে আসি।
হৈমন্তী বাধা দিয়ে কিছু বলল, গগন শুনল না; পিছন থেকে ডাকল হৈমন্তী, গগন সাড়া দিল না, অন্ধকারের মধ্যে হনহন করে চলে গেল। ওকে আর দেখা গেল না।
সুরেশ্বরের বাড়ির বারান্দায় এসে গগন যেন থমকে দাঁড়াল। এতক্ষণ সে কেমন যেন এক আবেগের বশে চলে এসেছে, কেন আসছে তা যেন তার খেয়াল ছিল না। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সে আলো নজর করতে পারল, সুরেশ্বরের ঘরে আলো জ্বলছে। দুমুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, ঘরের মধ্যে সাড়া শব্দ নেই।
গগন ডাকল।
ঘরের মধ্যে থেকে সাড়া দিল সুরেশ্বর, গগন, এসো।
কাগজপত্র সাজিয়ে নিয়ে বসে সুরেশ্বর কাজ করছিল, টেবিলের একপাশে লণ্ঠন জ্বলছে। গগনকে দেখে চেয়ারটা সামান্য সরিয়ে নিয়ে আরাম করে বসল সুরেশ্বর, হাত মাথার ওপর তুলে ক্লান্তি নিবারণ করল। তারপর গগনবাবু, এই মাত্র ফিরলে নাকি? সুরেশ্বর সহাস্য গলায় বলল।
হ্যাঁ। গগন অন্য চেয়ারটায় বসল।
বাসের শব্দ শুনলাম। …কেমন বেড়ানো হল?
ভাল।
কোথায় কোথায় গেলে?
অবনীবাবুর বাড়িতে। সেখানেই ছিলাম। আমরা একটু বেড়াব চার দিকে, অবনীবাবুর সঙ্গে একটা প্ল্যান করা গেল; ওঁর গাড়িটা পাওয়া যাবে।
তা হলে তো কাজ গুছিয়ে এসেছ! কোথায় কোথায় যাচ্ছ?
গগন বেড়াবার জায়গাগুলোর নাম বলল, শেষে রাত্রে তারা কোন জঙ্গলে যাবে, কোথায় কোন হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার স্টেশনের কাছে ইনসপেকশান বাংলোয় রাত কাটাবে, হরিণ দেখতে ছুটবে কোন নদীর কাছে ইত্যাদি সংক্ষেপে বর্ণনা করল।
সুরেশ্বর মনোযোগ দিয়ে শুনল। শেষে বলল, রাত্তিরে জঙ্গলের মধ্যে বেশি যেও না; তুমি যে জঙ্গলের কথা বলছ ওটা তেমন ভাল না। বন্দুক-টক সঙ্গে থাকবে?
না। আমরা কেউ ও-বিদ্যে জানি না।
তবে…সুরেশ্বর হাসল, খালি হাতে অ্যাডভেঞ্চার।
গগন পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট খুঁজতে লাগল। দিদিকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব। রাত্তিরে জঙ্গলে যাবার দিন নেব না, অন্য সময় নিয়ে যাব।
হেম যাবে বলছে?
হ্যাঁ, যাবে না কেন! ও তো কোথাও যায়নি। আমি থাকতে থাকতে ঘুরে না এলে আর হবে না। গগন সিগারেট বের করে ধরাল।
সুরেশ্বর গায়ের মোটা গরম চাদরটা গুছিয়ে নিল! বেশ তো যাক।
সকাল-দুপুর ওর হাসপাতাল। গগন কী ভেবে মনে করিয়ে দিল।
হাসপাতাল ঠিক দুপুরে নয়। যাকগে, সে ও ব্যবস্থা করে নেবে।
গগন পর পর কয়েক টান সিগারেট খেল। সে ঠিক যে জিনিসটা বলতে চায় তার ভূমিকা কীভাবে করা যায় বুঝে উঠতে পারছিল না। না পারায় মন চঞ্চল ও অস্থির হয়ে ছিল।
খুব শীত…। ঠাণ্ডা লেগে গেছে গলায় গগন গলার কাছটায় টিপতে লাগল। তোমার ভরতু একটু চা খাওয়াবে না?
ভরতুটার জ্বর হয়েছে। …আমি করে দিচ্ছি।
তুমি! ..না না…থাক…
থাক কেন, দু কাপ চা আমি করতে পারব না…সকালে আমি নিজের চা নিজে করে খাই, তা জানিস। সুরেশ্বর উঠল। গগনকে তুই-টুই করে কথা বলার অভ্যেস সুরেশ্বরের পুরনো।
গগন বলল, আমি করছি, কোথায় কী আছে বলো?
বলার চেয়ে করাটা সোজা– সুরেশ্বর সস্নেহে হেসে বলল। তা হলে ও ঘরে চল, স্পিরিট ল্যাম্পে জল গরম বসিয়ে দিয়ে গল্প করা যাক।
পাশের ঘরের বাতিটা যেন প্রদীপের মতন মিটমিট জ্বলছিল; শিখাটা বাড়িয়ে দিল সুরেশ্বর। ঘরের এক কোণে মিটসেফের পাশে ছোট টুলে স্পিরিট ল্যাম্প। স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে চায়ের জল বসাল সুরেশ্বর।
শোবার ঘরে সুরেশ্বরের সাধাসিধে বিছানা, এক পাশে লোহার ছোট মতন এক আলমারি, আলনায় কয়েকটি জামাকাপড়, একদিকে কাঠের সাধারণ র্যাকে কিছু বই, হালকা একটা টিপয়, ক্যাম্বিসের চেয়ার একটা। দেওয়ালে মার ছবি।
গগন ও-ঘর থেকে একটা চেয়ার টেনে আনল, জুতোজোড়াও খুলে রাখল ওপাশে। সু
রেশ্বর বলল, আমার সঙ্গে এক জায়গায় বেড়াতে যাবি?
কোথায়?
মিশনারিরা একটা মেলা করে ক্রিসমাসের সময়, শহর থেকে মাইল আষ্টেক দূরে। আদিবাসী দেখবি, নাচ দেখবি, এদিককার ক্রিশ্চান দেখবি। নানারকমের মজা থাকে মেলায়। যাবি নাকি?
.
সুরেশ্বর মেলাটার নানা বিবরণ শোনাতে লাগল; গাধার পিঠে উলটো দিকে মুখ করে বসে কে কতটা ছুটতে পারে–তার রগড়, উলের বল ছুঁড়ে বেলুন ফাটানো, তাসের ম্যাজিক, লটারি খেলা ইত্যাদি। আসলে মেলাটা এ দিকের দেশি মিশনারিদের চেষ্টায় অনেক দিন থেকে চলে আসছে। শালবনের মাঠে বসে যিশু-ভজনা, দরিদ্রদের পুরনো গরম জামা কাপড় বিতরণ, শিশুদের হাতে কিছু দেওয়া-থোওয়া। ওরই মধ্যে কোনও সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্যে কিছু চাঁদা সংগ্রহ।
গগন ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি চাঁদার কৌটো নিয়ে যাচ্ছ?
সুরেশ্বর চায়ের জলে চা-পাতা মেশাতে মেশাতে হেসে বলল, হ্যাঁ; ভাবছি তোর গলায় একটা চাঁদার কৌটো ঝুলিয়ে দেব।
তা হলে আমি নেই। গগন ভয়ের ভাব করে হাত মাথা নাড়ল।
সুরেশ্বর জোরে জোরে হাসতে লাগল। শেষে বলল, না, তোকে চাঁদা তুলতে হবে না। আমরা ওখানে ম্যাজিক লণ্ঠন দেখাই…
ম্যাজিক লণ্ঠন?
স্লাইড শো। দেখিসনি? কলকাতায় সিনেমা দেখিস না..
তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কীসের ম্যাজিক লণ্ঠন দেখাও?
চোখের। কী করে চোখ ভাল রাখতে হয়, চোখের কী কী রোগ হয়–এই সব। ওদের কাছে এটা দেখানো দরকার। সুরেশ্বর বলল। বলে চায়ের কাপ গুছিয়ে চা ঢালতে লাগল।
গগন একরকম মন নিয়ে এসেছিল, অথচ কথায় কথায় তার মন অন্য দিকে ভেসে যাচ্ছে বুঝে অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল। এই লোকটিকে গগন বরাবরই আত্মীয়ের মতো ভেবে এসেছে, ভক্তিশ্রদ্ধা করেছে বড় ভাইয়ের মতন, ভালবেসেছে বন্ধুর তুল্য, তর্ক করেছে, চেঁচামেচি করেছে, আবার সমীহ করতেও কোথাও বাধেনি। দিদির সঙ্গে সুরেশদার সম্পর্কের এই তিক্ততা তার ভাল লাগেনি। মনে মনে সে কষ্ট পাচ্ছিল। তাদের সংসারের কেউই চায় না–দিদির সঙ্গে সুরেশদার সম্পর্কটা এই অবস্থায় বরাবরের মতন ভেঙে যাক। দিদির যথেষ্ট বয়েস হয়ে গেছে, এ বয়সে দিদিকে কনে সাজিয়ে দেখিয়ে মা দিদির বিয়ে দেবে সে আশাও করে না। তা ছাড়া দিদির জীবনে এতকাল যা মূল্যবান হয়ে ছিল তা রাতারাতি তুচ্ছ হয়ে যাবে যে তাও নয়। মা, মামা সকলেই যা চায় তা এমন কিছু বেশি চাওয়া নয়। সমাজ সংসারে বাস করতে হলে তার কিছু কিছু নিয়ম তো মানতেই হবে। এভাবে দিদিকে রেখে দিতে পারে না সুরেশদা। যা সঙ্গত, যা উচিত, দৃষ্টিকটু নয়, অথচ দিদি যাতে সুখী হতে পারে–তুমি তাই করো। কেউ তোমার আশ্রম তুলে দিতে বলছে না, কলকাতায় ফিরে যেতেও বলছে না। তোমার এই সেবাধর্মে যদি মতি থাকে থাক, কিন্তু একটি মেয়েকে কোন আশ্বাসে তার আত্মীয়েরা এমনভাবে ফেলে রাখতে পারে।
সুরেশ্বর চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল। নাও হে গগনবাবু, খেয়ে দেখো।
গগন চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ছোঁয়াল। সুরেশ্বর তার ক্যাম্বিসের চেয়ারটায় বসল। বসে চা খেতে লাগল।
সুরেশদা– গগন আস্তে গলায় বলল।
সুরেশ্বর চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ তুলল। বলো।
গগন বিশ্রি এক অস্বস্তি অনুভব করছিল। সুরেশ্বরের দিরে তাকাতে পারল না। সুরেশ্বর অপেক্ষা করছে।
কী হল…? সুরেশদা বলে যে বসে থাকলি? কী ব্যাপার?
গগন চকিতের জন্যে হৈমন্তীর বিষণ্ণ, ক্ষুব্ধ, তিক্ত মুখ দেখতে পেল, গলা শুনতে পেল। মুখ তুলে সুরেশ্বরকে দেখল ক পলক গগন। তোমার সঙ্গে আমার কটা কথা আছে।
কী কথা? সুরেশ্বর সহজ গলায় শুধোল।
বলছি। …তুমি নিশ্চয় আমাদের ভুল বুঝবেনা। গগন জড়ানো গলা পরিষ্কার করে নেবার জন্যে চা খেল। হয়তো একটু সময় নিল নিজেকে ঘুছিয়ে নেবার জন্যে।
সুরেশ্বর বলল, আমার বোঝার ভুল না হলে তোদের ভুল বুঝব কেন?
না, বলে নিলাম। তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, তোমার সঙ্গে আমাদের রিলেশান কী তা তুমিও জান। … ব্যাপারটা যেমনই হোক আমি চাই না এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি কিছু হয়।
বেশ তো, হবে না।
মা আমায় কয়েকটা কথা জানাতে বলেছে তোমাকে। মামাও বলেছে।
তুই তো আমায় কিছু বলিসনি–
না, বলব বলব ভাবছিলাম, সুযোগ হচ্ছিল না। গগন বিছানার দিকে তাকাল, সুরেশ্বরের সঙ্গে চোখাচুখি হবার সঙ্কোচ সে অনুভব করছে।
সুরেশ্বর শান্তভাবে অপেক্ষা করছিল।
শেষ পর্যন্ত গগন দুর্বলতা ও সঙ্কোচ কাটিয়ে বলল, দিদির ব্যাপারে তুমি কী ঠিক করলে?
সুরেশ্বর নীরব থাকল। গগনের কথার জড়তা, তার অস্বস্তি, সঙ্কোচ থেকে হয়তো সুরেশ্বর অনুমান করতে পেরেছিল গগন এই ধরনের কোনও কথা তুলবে। বিস্মিত অথবা বিভ্রান্ত হবার মতন যেন কিছু ছিল না কথাটায়।
গগন আবার বলল, মা বড় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মামা বলছিল, এভাবে দিদিকে এখানে রেখে দেওয়া যায় না। ..ওদের কোনও দোষ নেই। তুমি বুঝতে পারছ–দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছে, নানা দুর্ভাবনা নিয়ে থাকে। দিদির কথাটা তারা ভুলে থাকতে পারে না। হাজার হোক মেয়ে তো, তার একটা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাবে না। গগন যেন এলোমেলোভাবে বলছিল।
সুরেশ্বর চায়ের কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। গগনের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত; তারপর বলল, হেম কি তোমাদের কিছু বলেনি, গগন?
না…, গগন মাথা নাড়ল, কী বলবে?
আমি ভেবেছিলাম কলকাতায় গিয়ে সে হয়তত কিছু বলবে মাসিমাকে।
আমি জানি না। গগন সুরেশ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, দিদির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কিন্তু সেটা তার কথা, তোমার তরফের কথা নয়।
সুরেশ্বর চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, ভাবছিল; শেষে বলল, গগন, আমার আজকাল মনে হয়, আমি কয়েকটা বড় রকম ভুল করেছি। হেমকে এখানে টেনে আনা আমার উচিত হয়নি। সে যে-জন্যে এসেছে আমি তাকে সে-উদ্দেশ্যে আনিনি। এখানে আমার কাছে তাকে বরাবর রাখা যাবে না। তোমরা যা ভাবছ তা হয় না। তাতে আরও অশান্তি বাড়বে। আমার এমন কিছু নেই যাতে হেমকে আর আমি সুখী করতে পারি।
গগন যেন কিছু সময় কেমন দিশেহারা হয়ে বসে থাকল, ভাবতে পারছিল না, কথা বলতে পারছিল না। অদ্ভুত এক বেদনা এবং আঘাত তাকে নির্বাক করে তুলছিল। শেষ পর্যন্ত কোনও রকমে নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে গগন বলল, তোমার কিছু নেই?
না। সুরেশ্বর মাথা নাড়ল।
দিদিকে তুমি ভালবাসতে…
বাসতাম। কিন্তু সে-ভালবাসায় আনন্দ পাইনি…
গগন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। রুক্ষ গলায় বলল, এতদিন পরে হঠাৎ তোমার সেই জ্ঞানটা হল নাকি?
না– সুরেশ্বর শান্ত গলায় বলল, না গগন, আগেই হয়েছিল। তুমি বিশ্বাস করবে না, তবে জীবনে হঠাৎ হঠাৎ কিছু হয়। বাইরে থেকে ওটা হঠাৎ, ভেতরে ভেতরে হয়তো হঠাৎ নয়। …একবার এক ঘটনা থেকে আমার মনে নানা সংশয়, দ্বিধা দুর্বলতা আসে। আমার মনে হয়েছিল–ওই ভালবাসায় আমার সুখ নেই, আনন্দ নেই।
তুমি শুধু নিজেকেই দেখছ।
সুরেশ্বর প্রতিবাদ করল না। সে নিজেকেই দেখছিল : যেন অতীতের কোনও ঘটনার সামনে সে দর্শক হয়ে বসে আছে।
৫. গগনের গলার স্বর
২১.
গগন অনেকক্ষণ হল চলে গেছে। যাবার আগে সুরেশ্বরকে কী যে বলেছিল সুরেশ্বর খেয়াল করে শোনেনি। গগনের গলার স্বর থেকে মনে হয়েছিল তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে; ক্রুদ্ধ, বিরক্ত হয়ে সে চলে গেছে। গগন আশা করেছিল সুরেশ্বর আরও কিছু বলবে, আশায় আশায় সে অপেক্ষা করেছে। সুরেশ্বর কিছু বলেনি। অস্পষ্ট, অসংলগ্ন দু-একটা মামুলি কথা যে যথেষ্ট নয়, এমনকী কোনও কৈফিয়তও নয়– গগন সম্ভবত সুরেশ্বরকে সেই কথাটা উচ্চস্বরে জানিয়ে চলে গেছে।
গগন চলে যাবার পর সুরেশ্বরও আরও কিছু সময় একই ভাবে বসে থাকল। গগনের শূন্য আসন, গগনের রেখে যাওয়া চায়ের কাপ তার চোখে পড়ছিল; অথচ গগনের কথা সে ভাবছিল না। গগন অসন্তুষ্ট হয়েছে একথা বুঝেও যেন সে চঞ্চল নয়।
পৌষের রাত যে কতটা হয়েছে সুরেশ্বরের খেয়াল ছিল না। ভরতুর বদলে অন্য কে যেন ঘরে এসে রাতের খাবার রেখে গেল। সুরেশ্বর অন্যমনস্কভাবে লক্ষ করল, গগনের টেনে আনা চেয়ার পাশের ঘরে রেখে, চায়ের কাপ ধুয়ে মুছে লোকটা চলে গেছে।
শেষ পর্যন্ত সুরেশ্বর উঠল। বাইরের ঘরে দরজা ভেজানো, বাতি জ্বলছে, টেবিলে এলোমেলো কাগজপত্র। দরজা বন্ধ করল সুরেশ্বর; খোলা জানলা দিয়ে কনকনে ঠাণ্ডা ঢুকছে, জানলাটাও বন্ধ করল। কাগজপত্র গুছিয়ে, বাতি নিবিয়ে ভেতরের বারান্দায় এল। বারান্দার একপাশে ছোট কলঘর, জলে হাত দেওয়া যায় না। চোখ মুখ ধুয়ে সামান্য আরাম পাওয়া গেল, গলাটা কেন যেন জ্বালা করছে।
শোবার ঘরে ফিরে এসে সুরেশ্বরের মনে হল, গগন যেন একবার তাকে কী একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কী কথা? কথাটা মনে করতে পারল না সুরেশ্বর, তবে অনুমান করল গগন তার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করে তার স্বার্থপরতা সম্পর্কে কোনও একটা কটু মন্তব্য করেছিল।
টাইমপিস ঘড়িটাতে রাত দশটা বেজে গেছে। অন্যদিন এসময় তার খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়। আজ কেন যেন আর খেতে ইচ্ছে করছিল না। দুধটুকু সুরেশ্বর খেয়ে নিল।
ঘরের জানলা ভেজিয়ে সুরেশ্বর তার বিছানার মশারিটা টাঙিয়ে ফেলল। গগন কি রাগ করে কলকাতায় ফিরে যাবে? কথাটা হঠাৎ মনে হল সুরেশ্বরের। পরক্ষণেই আবার মনে হল, হেমও কি হঠাৎ গগনের সঙ্গে চলে যাবে?
লণ্ঠনটা নিবিয়ে দেবার আগে সুরেশ্বর তার টর্চটা খুঁজে নিল, নিয়ে বাতি নিবিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
ঘন অন্ধকারের মধ্যে কিছুক্ষণ চোখের পাতা বন্ধ করে থেকে সুরেশ্বর যেন নিজেকে শিথিল করে রাখল, স্রোতে গা ভাসানোর মতন তার মন ও চিন্তাকে যত্রতত্র ভেসে যেতে দিল। অথচ সামান্য পরেই সুরেশ্বর অনুভব করল কোনও স্থায়ী ক্ষতের বেদনার মতন তার মন ঘুরেফিরে সেই একই চিন্তার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। চোখের পাতা খুলে অন্ধকারে তাকাল সুরেশ্বর, গভীর অন্ধকারে দৃষ্টি যেন আরও নিখুঁত হয়ে সেই একই বিষয়ের ছবিগুলি সাজিয়ে নিচ্ছে। গগনের সামনে যাকে স্পষ্ট করে দেখতে পায়নি সুরেশ্বর, যে অত্যন্ত ধূসর হয়েছিল, অতি ম্লান, এখন সে অতি স্পষ্ট। মনে হল, নির্মলা তখন এমন কোনও স্থানে ছিল যেখানে অন্যের উপস্থিতির জন্যে তাকে স্পষ্ট করে দেখা যায়নি, এখন দেখা যাচ্ছে।
সুরেশ্বর অপলকে, নিশ্বাস প্রশ্বাস স্তব্ধ করে নির্মলাকে যেন দেখল। নির্মলার সেই শীর্ণ, নিবন্ত প্রদীপের শিখার মতন অনুজ্জ্বল, বিষণ্ণ মূর্তিটি বুঝি সুরেশ্বেরের দিকে কেমন এক স্তিমিত আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
সুরেশ্বর অপেক্ষা করল। নির্মলা ক্ষীণদৃষ্টি ছিল; সে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে আসতে পারত না; পা ফেলে ফেলে চারপাশে দেখে অত্যন্ত ধীরে ধীরে আসত। আজ, এই মুহূর্তেও সুরেশ্বর যেন নির্মলাকে তার অভ্যাসমতন কাছে আসতে দিল।
নির্মলা কাছে এলে সুরেশ্বর তার মুখটি আর নিবিষ্ট চোখ লক্ষ করল; ওই মুখে এমন কিছু ছিল যা রূপ নয় অথচ যার আকর্ষণ রূপের অধিক। নির্মলাকে এখন এত স্পষ্ট ও একান্ত করে দেখতে পেয়ে সুরেশ্বর খুব খুশি হল।
নির্মলার সঙ্গে সুরেশ্বরের পরিচয়ের মধ্যে একটা আকস্মিকতা ছিল। সুরেশ্বর এখনও সেই পার্কের কৃষ্ণচূড়ার গাছটি যেন দেখতে পায়, যার তলায় কালবৈশাখীর ভয়ংকর ঝড়ের মধ্যে নির্মলা দাঁড়িয়ে ছিল।
তখন বৈশাখ, কলকাতা শহরের গাছপালা মাটি পথ যেন কয়েক দিন ধরে পুড়ে যাচ্ছিল; সারাদিন গুমট, কোথাও একটু বাতাস বয় না, গাছের পাতা নড়ে না। সেই দুঃসহ গ্রীষ্মে একদিন বিকেলের পর সুরেশ্বর পার্কে এসে বসে ছিল। আশেপাশে অজস্র মানুষ, বাতাসের আশায় পার্কে এসেছে, বসে আছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাবুগাছের পাতাগুলি নিশ্চল, বেড়া দেওয়া কলাফুলের ঝোপে একটিও ফুল নেই, আকাশ যেন সারাদিন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে মাথার ওপর ভস্মতূপের মতন পড়ে আছে।
সুরেশ্বর মাটিতে মরা ঘাসের ওপর চুপচাপ বসে ছিল। গরমে তার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হল, চারপাশে কেমন অদ্ভুত একটা থমথমে ভাব হয়ে এসেছে, সমস্ত বিশ্বচরাচর যেন এই সন্ধ্যার মুহূর্তে হঠাৎ কেমন অচেতন হয়ে গেছে, গাছপাতা কাঁপছে না, ধুলো উড়ছে না, পাখিদের স্বর স্তব্ধ, শূন্যতার মধ্যে শুধু অদ্ভুত এক শোষণ চলেছে, সমস্ত অবশিষ্ট আর্দ্রতাও শুষে নিচ্ছে। সুরেশ্বরের চোখ কান জ্বালা করছিল। গায়ের চামড়াও যেন কীসের আঁচ লেগে পুড়ে যাচ্ছে। …হঠাৎ, সন্ধের ঠিক মুখে একরাশ ধুলো উড়ে গেল। কেউ খেয়াল করেনি আকাশের এক কোণ ইতিমধ্যে সেজে উঠেছে। ধুলোর ঝাঁপটা থেমে যাবার পর পরই গাছের মাথায় পাতাগুলো কাঁপতে লাগল। বাতাস এল কয়েক ঝলক। তার পরই হু হু করে আকাশ ভাসিয়ে কালো মেঘ আসতে লাগল, অন্ধকার হল, ধুলোর ঝড় এল ঝাঁপটা মেরে। লোকজন ততক্ষণে পার্ক থেকে পালাচ্ছে। সুরেশ্বর উঠল না, আরও একটু অপেক্ষা করে যাবে। আসন্ন ঝড়টুকু গায়ে সামান্য মেখে নিতে তার আপত্তি নেই।
দেখতে দেখতে কালবৈশাখীর ঝড় এসে গেল। সাবুগাছের পাতার কুঁটি টেনে শনশন বাতাস বইছে, ধুলো উড়ছে, বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল। পার্ক তখন শূন্য। সুরেশ্বর কোনও রকমে চোখ বাঁচিয়ে চলে যেতে যেতে হঠাৎ দেখল পার্কের ফটকের কাছে কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায় একটি যুবতী মেয়ে দুহাতে চোখ মুখ আড়াল করে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। চলে যেতে যেতেও সুরেশ্বর কেমন থমকে দাঁড়াল। তার মনে হল, মেয়েটি এত দুর্বল যে এই ঝড়ে পা বাড়াতে সাহস করছে না।
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করেছিল, তপ্ত শুষ্ক মাটি থেকে গরম ভাপ উঠছে, মাটির গন্ধ, গাছের ডাল বুঝি ভেঙে পড়বে। পার্কের দু-চারটি বাতি জ্বলতে জ্বলতে নিবে যাবার অবস্থা, আকাশে বিজলী।
সুরেশ্বর কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে এসে মেয়েটিকে সাবধান করে দিয়ে কী যেন বলতে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
নির্মলা ভেবেছিল তার দাদা প্রমথ এসেছে।
প্রমথ যতক্ষণে পার্কে এল ততক্ষণে সুরেশ্বর নির্মলাকে নিয়ে পার্কের উলটো দিকে এক ডাইংক্লিনিংয়ের দোকানের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
বৃষ্টির মধ্যেই প্রমথকে পার্কে ঢুকতে দেখে বোঝা গিয়েছিল মানুষটা বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছে। নির্মলা বলেছিল : দাদা আসবে। অনেক কষ্টে প্রমথকে ডেকে নিতে হয়েছিল দোকানে।
ঝড়বৃষ্টি থেমে গেলে রিকশা করে যেতে যেতে পরিচয় হল। নির্মলা সামনের রিকশায়, পেছনে প্রমথ আর সুরেশ্বর।
প্রমথ বলল, ও চোখে খুব কম দেখে। আমার ভীষণ ভয় হয়ে গিয়েছিল।
সুরেশ্বর বলল, বলছিলেন বটে চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না।
কী করে বুঝব, হঠাৎ এরকম কালবোশেখী উঠবে। …আমারই ভুল হয়েছিল ওকে এভাবে রেখে দিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি।
কোথায় গিয়েছিলেন?
বেশি দূরে নয়। ওর চশমার ডাঁটি খুলে গিয়েছিল, সারিয়ে আনতে গিয়েছিলাম।
উনি তাই বলছিলেন।
বিকেলে ওকে একেটু বেড়াতে নিয়ে এসেছিলাম। যা গরম, সঙ্গে করে না আনলে হয় না, বুঝলেন না…। তবু রক্ষে ও একলা পার্ক থেকে চলে যাবার চেষ্টা করেনি করলে নির্ঘাত গাড়ি চাপা পড়ত।
সুরেশ্বর কৌতূহল বোধ করলেও নির্মলার দৃষ্টিক্ষীণতার কথা তখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
প্রমথ নিজের থেকেই বলছিল, ঝড় উঠেছে প্রথমটায় আমি বুঝতেই পারিনি। দোকানটাও আবার সেই রকম, অন্দরমহলে প্রায়, ভেতরে বাড়ির মধ্যে ছিলাম, কিছু দেখাও যায় না, বোঝাও যায় না, তারপর যখন বুঝলাম, ছুটতে ছুটতে আসছি। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, মশাই। …আপনার নামটা যেন কী?
সুরেশ্বর নাম বলল।
প্রমথ তার পরিচয় দিল। যৎসামান্য পরিচয়। বেসরকারি কলেজে পড়ায়, থাকে কাছাকাছি এক ভাড়াটে বাড়িতে। গলির মধ্যে। বিপত্নীক, সংসারে আত্মীয়-পরিজন বলতে এই বোন।
জল ঠেলে গলির মধ্যে রিকশা ঢুকল। বাতি জ্বলছে কি জ্বলছে না। চারপাশ চাপা, আকাশে তখনও মেঘ ডাকছে, দুঃসহ গরমটা বৃষ্টির জলে যেন ধুয়ে গেছে।
ঘরে এনে বসাল প্রমথ। সুরেশ্বর রিকশায় ওঠার সময় প্রথম যা আপত্তি জানিয়েছিল তারপর আর আপত্তি জানায়নি। ঠিক যে কী হয়েছিল সুরেশ্বর জানে না, কিন্তু কোনও অদ্ভুত আকর্ষণবশে অথবা কৌতূহলে সে প্রমথদের সঙ্গে চলে এসেছিল। এই আকর্ষণ কীসের, অথবা তার কৌতূহল কতটা যুক্তিযুক্ত সে কথা তখন ভাবেনি।
আকস্মিকভাবে যা ঘটেছিল সাধারণভাবে তা শেষ হতে পারত। পার্কের উলটোদিকের সেই লন্ড্রিতে দাঁড়িয়ে, কিংবা রাস্তায় নেমে, এমনকী রিকশাতে যেতে যেতেও সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রমথ এই তুচ্ছ ঘটনার সমাপ্তি ঘটাতে পারত। ঘটালে তাকে দোষ দেওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু প্রমথ তা দেয়নি। সদালাপী, সরল মানুষ ছিল প্রমথ, তার চরিত্রে সুহৃদজনোচিত আন্তরিকতা ছিল। বয়সে সুরেশ্বরের চেয়ে কিছু বড় হলেও প্রমথ চরিত্রমাধুর্যে সুরেশ্বরকে বন্ধুর তুল্য করে নিয়েছিল। কিন্তু উভয়পক্ষের পরিচয় ক্রমশ যে ঘনিষ্ঠতায় দাঁড়ায় তার মূলে সম্ভবত নির্মলার আকর্ষণই ছিল প্রধান।
জীবনের কিছু সরল সাধারণ নিয়ম অনুসারে নির্মলা কোনও যুবকের আকর্ষণের বস্তু হতে পারে না। নির্মলার বাহ্য কোনও রূপ ছিল না। তার গায়ের রং ময়লা, শরীর শীর্ণ লতার মতন ক্ষীণ, সে দুর্বল ও শিশুর মতন অসহায় ছিল। শাঁখের মতন লম্বা মুখ, দীর্ঘ কপাল, সরু চিবুকে রূপের এমন কিছু কারুকার্য ছিল না যা দৃষ্টিকে নিষ্পলক করতে পারে। নির্মলা পুরু কাচের চশমা পরত, চশমার তলায় তার চোখের পাতা মোটা দেখাত, মনে হত চোখ বুজে আছে। ওর চোখের মণির রং ছিল ধূসর, নির্মলা প্রায় সব সময়ই আনত-চোখে তাকাত, যেন এই আলো বড় প্রখর, তার চোখে সহ্য হচ্ছে না।
নির্মলার রূপ ছিল না, কিন্তু আশ্চর্য এক সৌন্দর্য ছিল। এই সৌন্দর্য তার শরীরে নয় এটা বোঝা যেত, কিন্তু বোঝা যেত না ঠিক কোথায় এই সৌন্দর্য আছে। কৃষ্ণপক্ষের দুর্বল চাঁদের আলোর মতন একটি আভা যেন তার ময়লা গায়ের রঙে মেশানো থাকত, এবং কখনও কখনও মনে হত, এই আভা বুঝি কোনও নিভৃত স্থান থেকে উৎসারিত হচ্ছে। নির্মলার শঙ্খসদৃশ মুখ কখনও কখনও এমন একটি বেদনা সঞ্চার করত যা হৃদয়ের কোনও অজ্ঞাত স্থানে অনুভব করা যেত, অথচ তাকে ব্যক্ত করা যেত না। সুরেশ্বর অনেক দিন বোঝেনি নির্মলার প্রতি তার আকর্ষণ কেন। পরেও যে বুঝেছিল তা নয়–তবু একটা ধারণা হয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, নির্মলা কখনও তার অদৃষ্টের কথা বলত সহিষ্ণুতার, এ সংসারে মানুষের যে নির্দিষ্ট নিয়তি–সেই বেদনাদায়ক স্থির পরিণতির জন্যে সে অপেক্ষা করে আছে, অথচ তার আচরণে ক্ষিপ্ততা অথবা ভীতি নেই; নির্মলা কখনও তার অদৃষ্টের কথা বলত না। সুরেশ্বরের কেন যেন মনে হত, নির্মলার পক্ষে এতটা সহিষ্ণুতা অনুচিত।
প্রমথ বলেছিল, নির্মলা ক্রমশ অন্ধ হয়ে আসছে, শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে যাবে।
ঠিক কী কারণে নির্মলার চক্ষুরোগ দেখা দিয়েছিল–এ কথা কেউ বলতে পারেনি। নানা মুনির নানা মত ছিল। শিশুকাল থেকেই নির্মলার চোখে কষ্ট ছিল, বয়স বাড়ার পর সেটা ব্যাধি হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম সাধারণ চিকিৎসা ও চশমা পরিয়ে ব্যাধিটাকে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে আরও নানা রকম চিকিৎসা হয়েছে, প্রমথ সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই ব্যাধির কোনও প্রতিকার হয়নি। এখন প্রমথ নিরুপায়, শুধু অক্ষমের মতন অপেক্ষা করে আছে। বস্তুত তার কিছু করার ছিল না, এক শুধু বোনকে আগলে আগলে রাখা ছাড়া, আর ছুটিছাটায় নির্মলাকে সঙ্গে করে বাইরে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া। প্রমথ প্রায় প্রত্যেকটি ছুটিতে নির্মলাকে সঙ্গে করে বেড়াতে বেরুত। কে যেন তাকে বলেছিল, বাইরের খোলামেলা আকাশ বাতাসে নির্মলা সাময়িক একটা উপকার পেতে পারে। উপদেশটা প্রায় সংস্কারের মতন প্রমথকে ভর করেছিল। ছুটি পেলেই সে নির্মলাকে নিয়ে বাইরে ছুটতে চাইত। নির্মলা বাইরে যেতে ভালবাসত, তবে দাদার বাড়াবাড়ি তার শরীরে সইত না। প্রমথর ইচ্ছে ছিল, সে কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যায় চাকরি নিয়ে, নির্মলার পক্ষে সেটা উপকারের হবে; কিন্তু তার ভয় ছিল বাইরে হঠাৎ কোনও গণ্ডগোল ঘটলে নির্মলার চিকিৎসা সম্ভব হবে না, বরং কলকাতায় সেটা সম্ভব; কলকাতায় তাদের পুরনো ডাক্তার ছিল। প্রমথ এই দোটানায় পড়ে মতিস্থির করতে পারত না।
সুরেশ্বর এ সময় প্রমথদের সঙ্গে বাইরে যেতে শুরু করেছিল। কখনও কখনও এমনও হয়েছে, সুরেশ্বর প্রথমে যায়নি, ওরা চলে গেছে, তারপর কয়েক দিন যেতেই সুরেশ্বর ওদের কাছে এসে পড়েছে। নির্মলার ওপর সুরেশ্বরের যে দুর্বলতা জন্মে গিয়েছিল তা ভালবাসা কি না স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। হয়তো ভালবাসা, হয়তো এমন কোনও অনুরাগ যা ব্যাখ্যা করে বলা যায় না।
নির্মলা জানত, তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে, অবশেষে সে অন্ধ হয়ে যাবে। এ নিয়ে তার যেন আর কোনও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা ছিল না। সুরেশ্বর ঠিক এভাবে নির্দিষ্ট ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মেনে নিতে পারত না। সে অস্থির ও কাতর হত, ক্ষোভ প্রকাশ করত প্রমথর কাছে।
একবার, রাঁচির দিকে বেড়াতে এসে হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল নির্মলার। ডান দিকের চোখে দুদিন প্রায় কিছু দেখতে পেল না। তৃতীয় দিনে নির্মলার পক্ষে স্বাভাবিক দৃষ্টি ক্রমে ফিরে আসতে লাগল। প্রমথ বিচলিত হয়ে পড়েছিল, সুরেশ্বর আরও বেশি বিচলিত, শঙ্কিত। সে চেয়েছিল কলকাতায় ফিরে যেতে। নির্মলা রাজি হয়নি।
কয়েক দিনের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠার পর নির্মলা একদিন বলল : তুমি নাকি বলছ, কলকাতায় গিয়ে চোখটা অপারেশন করিয়ে নিতে?
সেই রকমই তো শুনেছিলাম, প্রমথ বলে–কোন ডাক্তার যেন বলেছেন অপারেশন করে একবার চেষ্টা করা যেতে পারে…
আগেও দুবার হয়েছে…কই কিছু তো হয়নি…
তবু…
তোমার খুব ভয়, না?
হ্যাঁ, চোখ চলে গেলে তোমার কী থাকবে?
আমার চোখ দুটোই কি আমি?
সুরেশ্বর অবাক হয়ে নির্মলার দিকে তাকিয়ে ছিল : কথাটা বুঝেও যেন বুঝছিল না।
নির্মলা ধীরে ধীরে বলল, আমার এই হাত দুটো, কিংবা শুধু এই মুখ, এই চোখ যদি আমি হই তবে সে আমি কিছু না। … তুমি সেই গল্পটা জানো না?
নির্মলা এক রাজা আর সন্ন্যাসীর গল্প বলেছিল, রাজা এসেছিলেন একা এক সন্ন্যাসীর আশ্রমে মৃগয়াক্লান্ত হয়ে। সন্ন্যাসী যথোচিত রাজসম্মান প্রদর্শন করেননি, কেননা তিনি রাজাকে চিনতে পারেননি। এই অপরাধে রাজা সন্ন্যাসীকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন। সেই সভায় রাজা এবং সন্ন্যাসীর মধ্যে পরিচয় নিয়ে কূট তর্ক হল। সন্ন্যাসী বলেছিলেন : হে রাজন, যদি আপনার কর্তিত একটি বাহু পথে পড়ে থাকে কেউ কি সেই বাহুকে রাজন বলে সম্বোধন করবে? যদি আপনার বিচ্ছিন্ন পদযুগল নদীর জলে ভেসে যায় আপনার কোন প্রজা তাকে চিনে নিতে পারবে? আপনার রথের অশ্ব কি আপনি? আপনার রাজদণ্ড কি আপনি? সর্ব পরিচয়যুক্ত হলেই আপনার পরিচয়, অন্যথা আপনার কোনও পরিচয় নেই। আমার আশ্রমে আপনি রাজবেশে রাজরথে অমাত্যদল নিয়ে উপস্থিত হননি। আমার ভ্রম হয়েছিল। এই ভ্রম সত্য ও স্বাভাবিক।
গল্প বলা শেষ করে নির্মলা বলল, আমার চোখ দুটো চিরকাল থাকবে না। সুরেশ্বর কোথাও যেন পরাস্ত হয়েছিল, তবু বলল, চিরকাল কিছুই থাকে না। জানি। তবু আজীবন কিছু কি থাকে না?
কী থাকে?
থাকে। তুমি ভেবে দেখো কী থাকে?
একটা কথা বলবে?
কী কথা?
তোমার ভয় করে না? চোখ হারালে তোমার কতখানি যাবে তা ভেবে দুশ্চিন্তা হয় না?
নির্মলা মাথা নাড়ল, এক সময় হত। এখন বোধহয় সহ্য হয়ে গেছে। বলে সামান্য থেমে হাসির মুখ করে বলল, সংসারে কতশত অন্ধ আছে, বলো! তারাও তো রয়েছে।
তারাই তোমার ভরসা?
তোমরাও আমার ভরসা।
আমরা যদি না থাকি?
আমি তর্ক করতে জানি না। এত বড় জগতে কেউ না কেউ থাকবে।
ভগবান নাকি?
ভগবানে আমার ভক্তি আছে। মানুষেও আমার বিশ্বাস আছে। …সেদিন পার্ক থেকে তুমি তো আমার হাত ধরে নিয়ে এসেছিলে। কেন এনেছিলে?
সুরেশ্বর কোনও জবাব দিতে পারেনি।
রাঁচির সেই সাময়িক দৃষ্টিহীনতাকে কাটিয়ে উঠলেও পরের বছর এক বসন্তের সন্ধ্যায় কী যেন ঘটে গেল।
.
২২.
পরের বছর যা ঘটল তার সঙ্গে রাঁচির ঘটনার সম্পর্ক হয়তো ছিল, কিন্তু বোঝা যায়নি। কলকাতায় ফিরে প্রমথ নির্মলাকে তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি নির্মলার চোখে কোনও নতুন। উপসর্গ খুঁজে পাননি। রাঁচিতে যা ঘটেছিল তা এতই বিচিত্র ও সাময়িক যে তার কোনও চিহ্ন আর ছিল না।
প্রমথ নিশ্চিন্ত হল।
নির্মলা যেন সামান্য পরিহাস করেই সুরেশ্বরকে বলল, দেখলে…!
পরিহাসের কারণ অবশ্য ছিল। রাঁচিতে থাকতে সুরেশ্বরের কেমন একটা সদা-আতঙ্কের ভাব হয়েছিল। তার আচরণ দেখলে মনে হত, যে-কোনওদিন, যে-কোনও সময় নির্মলার চোখের শেষ দৃষ্টিশক্তিটুকু ফুরিয়ে যাবে এ দুশ্চিন্তায় সে শঙ্কিত হয়ে আছে। নির্মলা কাছে থাকলে সুরেশ্বর এমনভাবে তাকে লক্ষ করত, মনে হবে প্রতি মুহূর্তে সে নির্মলার নতুন কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করছে। নির্মলা পথে বেরুলে সুরেশ্বর তার পাশে পাশে ছায়ার মতো থাকত, মনে হত যেন কোনও পঙ্গু শিশুকে সে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সকালে ঘুম থেকে উঠে যতক্ষণ না নির্মলার গলা শুনত ততক্ষণ আড়ষ্ট ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত, ঘরের বাইরে আসত না।
রাঁচি থেকে কলকাতায় ফিরে সুরেশ্বরের এই সদাশঙ্কিত অবস্থাটা কাটল। অথচ তখনও তার আচরণে উদ্বেগ ভাবটা ছিল।
একদিন কি কথায় যেন নির্মলা বলল, তোমার মতন মানুষ আমি দেখিনি।
কেন?
দাদাকে কী বলেছ?
কী বলেছি।
ঘড়ির কাঁটা দেখতে আমার ভুল হয়।
সেদিন হয়েছিল।
না, কাঁটা দেখতে হয়নি; বলতে ভুল হয়েছিল। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম।
তবে আমারই ভুল। …
তোমার স্বভাবে আগে এসব ছিল না। আজকাল যেন কেমন অস্থির-অস্থির ভাব হয়েছে।
হয়েছে নাকি! … মানুষ বদলায়।
সুরেশ্বর হাসত। সুরেশ্বর যে বদলাচ্ছিল এটা হয়তো তারও জানা ছিল।
এই সময় সুরেশ্বর নিত্য অনুভব করতে শুরু করেছিল, নির্মলা তার কাছে এই আশ্চর্য আনন্দ ও অদ্ভুত বেদনার মিশ্রণ। এই আনন্দের কোনও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা সে করতে পারত না। তার মনে হত, এ-আনন্দ অবারিত, স্ফুর্ত; সে ভেবে দেখতে, নির্মলা তার দেহ ও মন নিয়ে যতটুকু সীমিত, যদি সেটা তার স্থূল অস্তিত্ব হয়–তবে এই অস্তিত্বের বাইরেও নির্মলার এক আনন্দ-স্পর্শ আছে; যেমন জ্যোৎস্নালোকের থাকে। সুরেশ্বর একদা এই ধরনের এক স্বপ্নও দেখেছিল : দেখেছিল, সে যেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, আশেপাশে কোথাও নির্মলা নেই, তবু তার নির্মলার কথা মনে হচ্ছিল, এবং সে নির্মলাকে মনে মনে খুঁজছিল। হঠাৎ সে নিজের সর্বাঙ্গে জ্যোৎস্নালোক অনুভব করল, তার খেয়াল ছিল না যে জ্যোৎস্নার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলে সুরেশ্বর চাঁদ দেখতে গেল, আড়ালে কোথাও বুঝি চাঁদ ছিল, দেখা গেল না। সহসা তার চারপাশে সে নির্মলার উপস্থিতি অনুভব করল, মনে হল নির্মলা কোনও অলৌকিক শক্তিবলে চাঁদের কিরণ হয়ে তার চতুর্দিকে বিরাজ করছে।
জীবনে এই ধরনের আনন্দের সঙ্গে সুরেশ্বরের পূর্বপরিচয় ছিল না। বাল্যাবধি সে যাদের মনে করতে পারে বাবা, মা, বিনুমাসি–কেউই তার কাছে আনন্দের মূর্তি নয়। বাবা তার কাছে সব সময়েই নিরানন্দ ও বিতৃষ্ণার–এমনকী করুণার পাত্র ছিল। মা ছিল দুঃখের মূর্তি; অবজ্ঞাত বলে মার মধ্যে অভিমানের বেদনা পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল; মার কোথাও আনন্দ ছিল না, মা তাকে আনন্দ বিলোতে পারত না। মার মধ্যে একটা জলুস ছিল, এই জলুস মার অহঙ্কার। সুরেশ্বর আবাল্য আনন্দ দেখেনি, আনন্দ জানেনি–এই যেন প্রথম দেখছে নির্মলার মধ্যে।
হেমের কথা তার এ সময় খুব মনে হত। হেমের বাড়ি তার আসা-যাওয়াও ছিল। হেম বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছিল, ডাক্তারি পড়ছিল। হেমের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাও সুরেশ্বর চিন্তা করত। হেম যে মাত্র সে-দিনও তার কাম্য বস্তু ছিল, সুখ ছিল–এ কথা সে অস্বীকার করতে পারত না। হেমের প্রতি তার মমতা ও স্নেহ কোনও অংশে কমেনি। কিন্তু সুরেশ্বর হেমের মধ্যে কোনও গভীর আনন্দ খুঁজে পেত না। কিংবা বলা ভাল, নির্মলার মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যেত, হেমের মধ্যে তা ছিল না। কেন ছিল না, কেন সুরেশ্বর হেমের মধ্যে তার আনন্দ পেত না–সে জানে না।
এ সময় কলকাতায় থাকলেও সুরেশ্বর হেমদের বাড়ি আসা-যাওয়া ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছিল। যেন তখন সে কোনও দ্বিধার মধ্যে পড়েছে। বুঝতে পারত না তার এই দ্বিধার যথার্থ কারণ কী? অথচ হেমের প্রতি তার মমতা বা স্নেহ হ্রাস পায়নি।
নির্মলার কাছে হেমের কথা মাঝে মাঝে গল্প করত সুরেশ্বর। হেমের অসুখ, তার হাসপাতালে থাকা, আরোগ্যলাভ, লেখাপড়া–এই সব গল্প। নির্মলা সহানুভূতির সঙ্গে শুনত, শুনতে শুনতে হেম যেন নির্মলার অতিপরিচিত হয়ে উঠেছিল।
সুরেশ্বর বলত, হেমকে একদিন এ বাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু আনা হত না।
মাঝেমধ্যে নির্মলাই তাগাদা দিত, কই, হেমকে তো আনলে না?
আনব। …পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত দেখি।
একদিন তো আনতে পার।
তা পারি।
আমার কী মনে হচ্ছে জানো–?
কী?
আনতে তোমার ইচ্ছে নেই।
না, ইচ্ছে নেই যে তা নয়, তবে……আনব একদিন…।
তুমি ভাবছ, আমি তাকে ভাল করে দেখতে পাব না? ঠিক পাব। নির্মলা যেন স্নিগ্ধ কৌতুক করল।
সুরেশ্বর ভেবেচিন্তে আস্তে করে বলল : তুমি পাবে, হেম হয়তো পাবে না।
এমন করেই দিন কাটছিল। সুরেশ্বর সেবার পুজোর সময় দেশে যাবে ঠিক করল। অনেক দিন দেশবাড়ি যাওয়া হয়নি, ঘরদোরের অবস্থা কেমন হয়ে আছে কে জানে, দেশ থেকে হালদারমশাই চিঠি লেখেন, তাগাদা দেন যাবার জন্যে, যাওয়া হয়ে ওঠে না।
প্রমথকে বলল সুরেশ্বর, এবার পুজোর সময় আমাদের ওখানে চলো।
চলো, ভালই হবে।
চিঠি লিখে দিচ্ছি তা হলে!
দাও। তোমাদের বাড়িতে সাপখোপ আর সিঁড়ি বেশি নেই তো?
সুরেশ্বর অবাক। কেন? হঠাৎ সাপখোপ আর সিঁড়ির দুশ্চিন্তা হল কেন?
সাপখোপে আমার ভীষণ ভয়– প্রমথ হাসতে হাসতে বলল, আর সিঁড়িওলা বাড়িতে নির্মলাকে নিয়ে থাকতে ভয় হয়।
সাপখোপের দুশ্চিন্তা সুরেশ্বরের হয়নি, কিন্তু সিঁড়ির দুশ্চিন্তা হয়েছিল। নির্মলার কথা ভেবে যাওয়ার ব্যবস্থাটা হয়তো সে বন্ধ করত, নির্মলা হতে দেয়নি।
পুজোর সময় দেশে গিয়ে সুন্দর লেগেছিল। অত বড় বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, নীচের মহলে একটা প্রাইমারি স্কুল বসেছে, ঠাকুরদালান অব্যবহৃত, জঞ্জাল জড়ো হয়েছে অনেক। তবু হালদারমশাই যথাসাধ্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়েছিলেন। দোতলায় ওরা থাকত। পুবের জানলা খুললে নদীর চর আর আদিগন্ত মাঠ দেখা যেত। সেই আমবাগান আর ছিল না। রথতলার মাঠ তখনও ছিল।
নির্মলাকে ধরে ধরে ছাদে নিয়ে যেত সুরেশ্বর। ছাদের সিঁড়িটা বরাবরই কেমন ছোট ও অন্ধকার মতন ছিল। ছাদে এসে নির্মলা হাত ছাড়িয়ে নিত; ধীরে ধীরে পায়চারি করত, সকাল অথবা বিকেলের বাতাস তার খুব পছন্দ ছিল। নদীর চরে বেড়াতে নিয়ে যেত নির্মলাকে, মাঠের সবুজের দিকে তাকাতে বলত, আকাশের দিকে চোখ তুলে সাদা ভাসন্ত মেঘ দেখতে বলত। দৃষ্টিশক্তিকে যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে দেবার জন্যে নির্মলার ব্যগ্রতা অপেক্ষা সুরেশ্বরের ব্যর্থতা ছিল বেশি। ক্ষণে ক্ষণে সে আঙুল তুলে কাছের কিছু দেখাত; ওটা কী গাছ বলো তো? বক দেখতে পাচ্ছ ওখানে, পাচ্ছ না? তোমার পায়ের কাছে ফড়িংটা ধরো…
নির্মলা এক একদিন বলত, তোমার ডাক্তারিতে আমি মরে যাব।
ডাক্তারি কোথায়! এসব তো চোখের পক্ষে ভাল।
মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমার চোখ দুটো যেন তোমার, নিজের চোখ নিয়েও মানুষ বোধহয় এত করে না…
সুরেশ্বর কোনও জবাব দিত না।
একদিন নির্মলা সন্ধেবেলায় ছাতে বসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, আমি কতদিন তারা দেখি না, তারা দেখতে বড় ইচ্ছে করে…।
প্রমথ আপনমনে গান গাইছিল, গান থামিয়ে বলল, আজ তারা নেই। চাঁদের খুব আলো, কাল পূর্ণিমা। তার কথা থেকে যেন মনে হবে, আকাশে তারা নেই বলে নির্মলা দেখতে পাচ্ছে না, তারা থাকলেই দেখতে পেত।
এমন কিছু কথা নয়, তবু সুরেশ্বর কোথায় যেন এক বুকভাঙা বেদনা অনুভব করল। এত বড় বিশ্ব, মাথার ওপর অনন্ত আকাশ, এই চাঁদের আলো-সব যেন মলিন ও অর্থহীন মনে হল। সুরেশ্বর পরে বলল, নীচে যাওয়া যাক হিম পড়ছে যেন।
আনন্দের মতন নির্মলা সুরেশ্বরের কোনও বেদনারও উৎস ছিল। জীবনের নানা দুঃখের সঙ্গে সুরেশ্বরের বাল্যাবধি পরিচয়। তার বাবা, মা, বাবার উপপত্নী, বিনুমাসি, এমনকী হেম সংসারের কোনওনা-কোনও দুঃখের ছবি। এরা যে দুঃখী–তাতে সুরেশ্বরের সন্দেহ নেই। এদের দুঃখ সুরেশ্বর বোঝে। কিন্তু তার মনে হয় না, সেই সব দুঃখ আর নির্মলার মধ্যে যে বেদনার উৎস আছে তা এক।
মার দুঃখ যেন অত্যন্ত ব্যক্তিগত, অসাধারণ রূপ ছিল অথচ মা তার স্বামীর অনুরাগ ও সাহচর্য পায়নি, মা অবজ্ঞা পেয়েছে। এই দুঃখ মা পেত না যদি বাবা মার ওপর অনুরক্ত হতেন। আর সমস্ত দুঃখই একজনের বঞ্চনা থেকে এসেছে।
বাবা ঠিক দুঃখী নয়, হতভাগ্য। বাবার কোনও দুঃখবোধ ছিল না, বা বাবাকে দেখলে দুঃখ পাবার কারণও ছিল না। অনাচারী মানুষকে দেখলে যে ধরনের করুণা হতে পারে বাবাকে দেখলে বড় জোর সেই রকম করুণা হত।
এক সময় হেমকেও দুঃখী মনে হত সুরেশ্বরের : যখন হেম অসুস্থ, যখন হেম হাসপাতালের বিছানায় অসহায় হয়ে পড়ে ছিল। সেসময় হেমের বিবর্ণ খড়িমাটি ওঠা চেহারা, তার কোটরগত করুণ দুটি চোখ দেখলে সুরেশ্বর ব্যাকুল ও অভিভূত হত। এত অল্প বয়সে ভয়ংকর এক ব্যাধি তার জীবনীশক্তিকে তিলে তিলে শুষে নিচ্ছে–এই চিন্তা সুরেশ্বরকে কাতর ও পীড়িত করেছিল। তার মনে হয়েছিল : এ-ভাবে জীবনের অপচয় ঘটতে দেওয়া অর্থহীন। হেমকে নীরোগ করে তোলা তার কর্তব্য বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু হেমের অসুস্থতা, তার রোগশয্যা, অসহায় ও দুঃখ, সুরেশ্বরকে বৃহৎ কোনও বেদনার সঙ্গে পরিচিত করায়নি। তার কখনও মনে হয়নি, হেম সাংসারিক রোগশোকের ভোগ ছাড়া আর কিছু ভোগ করছে। তারপর হেম সুস্থ হয়ে গেল। তার আরোগ্যলাভের পর হেমের দুঃখের চেহারাটা ধুয়ে গেছে। এক সময় কিছু ময়লা পড়েছিল, এখন তা পরিষ্কার হয়ে স্বাভাবিক মানুষটি ফুটে উঠেছে এর বেশি কিছু হেমকে দেখে মনে হয় না।
নির্মলার মধ্যে যে-বেদনা তা যেন তার ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয়। সুরেশ্বর বুঝতে পারত না কিন্তু অনুভব করত, নির্মলা যেন মানুষের এমন একটি অবস্থাকে ইঙ্গিত করছে যার ওপর তার কোনও হাত নেই। আয়ত্তাতীত এই অদৃষ্ট, অথবা সেই পরিণতি যাকে রোধ করার ক্ষমতা মানুষের নেই–নির্মলা যেন সেই পরিণতির অসহায়তা প্রকাশ করছে। শেষাবধি মানবজীবন মৃত্যুর কাছে পরাজিত, ভাগ্যের কাছে তার সমস্ত উদ্যম মিথ্যা হয়ে যেতে পারে, এই মুহূর্তের সুখ পরমুহূর্তে বিষাদ হতে পারে। শৃঙ্খলাহীন, যুক্তিহীন, স্বৈরাচারী নির্মম কি যেন এক আছে। তার কাছে জীবনের সমস্ত কিছুই যেন আকস্মিক, অর্থহীন। দুঃখ বই জীবনে বস্তুত কিছু নেই, যন্ত্রণা ও ক্ষোভ বিনা মানব-ভাগ্যের অন্য পরিণতি নেই।
সুরেশ্বরের মনে ক্রমশ এক নৈরাশ্য দেখা দিতে শুরু করেছিল। নিরর্থক জীবনধারণ, অস্থায়ী এই সুখ, অকারণ এই আত্মরক্ষার কী যে প্রয়োজন সে বুঝে উঠতে পারত না। অথচ এই নৈরাশ্য সুরেশ্বরের স্বভাবজাত নয়। সে অদৃষ্টবাদী ছিল না। নির্মলার বেদনা তার মনে এই নৈরাশ্য কেমন করে সংক্রামিত করছিল সে জানে না, কিন্তু নির্মলার কোথাও নৈরাশ্য ছিল না। নির্মলার সহিষ্ণুতা, ধৈর্য এবং বিশ্বাস মাঝে মাঝে সুরেশ্বরকে এত বিচলিত করত যে সে ক্ষুব্ধ ও অপ্রসন্ন হত।
তুমি সব বুঝেও বোঝো না, নির্মলা বলত, আমাদের দুটো হাত, সবদিকে লড়াই করা যায়, যায় না।
তবে তো সংসারে আমরা খুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতে পারি।
না, তা পারি না।
কেন? …
জানি না। সাধ্য আর অসাধ্য বলে দুটো কথা আছে। ..যা অসাধ্য তা না করতে পারলে আমার দুঃখ হয় না।
সুরেশ্বর যে এইসব সহজ কথাগুলো না বুঝত এমন নয়, বুঝেও কোনও মানসিক চাঞ্চল্যের জন্যে অকারণে ক্ষোভ প্রকাশ করত। সে বুঝতে পারত, এতকাল তার জীবনের যেদিকে গতি ছিল, এখন সেদিকে তার জীবন বইতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে সে অকর্মণ্য, অকারণ জীবন যাপন করে যাচ্ছিল। তার জীবনের প্রয়োজন অথবা অর্থ সম্পর্কে তার কোনও জিজ্ঞাসা ছিল না। কখনও আবেগ, কখনও অভ্যাসবশে, কখনও স্বাভাবিক দুর্বলতায় সে গা ভাসিয়েছে। কখনও স্বার্থ, কখনও অহঙ্কার, কখনও সামাজিক লোকলজ্জায় সে উদার হয়েছে। কিন্তু এর কিছুই তার অন্তরের নয়। জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেন নিরপেক্ষ দর্শকের, সক্রিয়তার নয়।
মানসিক এই অশান্তি এবং চাঞ্চল্যের সময় সুরেশ্বর একদিন নির্মলার বিদায়পর্বটা নির্বোধ, অক্ষম পশুর মতন লক্ষ করল।
সেদিন দোল পূর্ণিমা, সারাদিন কলকাতার পথে রঙের ছড়াছড়ি গেছে, লাল বেগুনি নীলের ছোপ ধরা রাস্তা, বাতাসে ফাগের ডো উড়ছে, ছেলেমেয়েগুলোর মাথার চুল রুক্ষ, গালে-গলায় রঙের ছোপ, বাড়ির দেওয়ালে পানের পিচের মতন বিচিত্র রং সব ছিটোনো, বিকেলে চৈত্রের বাতাস বইতে শুরু করল, চাঁদ টলটল করে ফুটে উঠল আকাশে।
সুরেশ্বর হেমদের বাড়ি হয়ে প্রমথদের বাড়ি পৌঁছল যখন তখন সন্ধেরাত। প্রমথ ঘরে বসে তার কলেজের কজন বন্ধুর সঙ্গে হা হা করে গল্প করছে, ঘরের মধ্যে অট্টনোল।
নির্মলা বলল, এসো, তুমি বরং আমার ঘরে বসো; ওঁরা একটু পরেই চলে যাবেন।
সুরেশ্বর প্রমথকে মুখ দেখিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসল।
নির্মলা দুধ-সাদা খোলের শাড়ি পরেছিল, পাড়টা ছিল কালোর ওপর মুগা করা। নির্মলা কোনও কালেই যত্ন করে চুল বাঁধত না, কোনও রকম খোঁপা জড়িয়ে নিত, সেদিন বুঝি মাথা ঘষে ছিল, রুক্ষ চুল তার পিঠময় ছড়ানো, শাড়ির আঁচলে চাপা দেওয়া।
সুরেশ্বর বলল, ব্যাপার কী, আজকের দিনে এরকম সাদা শাড়ি?
ব্যাপার আবার কী, পরেছি। কেন?
আজকে সাদা কিছু দেখলেই হাত কেমন করে…
রং দেবে! দাও!
বরং আবির দিই একটু…।
আমি দেব, না তুমি এনেছ..
সুরেশ্বর হাসল, তুমিই দাও।
নির্মলা তার ঘরের কোন কোণ থেকে কাঠের পাউডার-কৌটোয় রাখা লাল আবির এনে দিল। আবিরের সঙ্গে গন্ধ মেশানো।
চশমাটা খোলো…সুরেশ্বর বলল।
মুখে দেবে নাকি? না না
কপালে দেব; চশমার কাছে পড়তে পারে। …
নির্মলা চশমা খুলে হাতে রাখল।
সুরেশ্বর আবিরের একটি ছোট টিপ পরিয়ে দিল, তারপর বলল, বাঃ! বেশ দেখাচ্ছে।
নির্মলা হেসে ফেলল। তোমায় একটু দিই, পায়ে দিই।
না; পা ছোঁবে না।
তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, আমি ছোট; তোমার পায়ে হাত দিতে আমার লজ্জা নেই।
কপালে দাও।
নির্মলা শেষ পর্যন্ত অবশ্য পায়ে আবির দিল। দিয়ে অল্প একটু দাঁড়িয়ে থেকে দু-চারটে কথা বলে শেষে বলল, বসো, চা নিয়ে আসি।
নির্মলা চলে যাবার পরও যেন তার দুধের মতন সাদা শাড়ির, তার আঁচল চাপা এলো রুক্ষ চুলের, তার কপালের আবিরের ছোট টিপটির সৌন্দর্য এবং পবিত্রতা সুরেশ্বরের চোখে ভাসছিল।
হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত, অবর্ণনীয় বীভৎস আতঙ্কের চিৎকার ভেসে এল। শব্দটা ঠাওর করে ছুটে যাবার আগে যা ঘটার ঘটে গেছে। বাড়ির রাঁধুনিদিদির নাবালিকা মেয়েটি রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে, তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, আর রান্নাঘরে নির্মলা তখনও তার শাড়ি এবং চুলের আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে।
হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় নির্মলা অজ্ঞান ছিল।
পরে দিন দুয়ের মাথায় তার জ্ঞান হয়েছিল; এই জ্ঞান কুয়াশাচ্ছন্নচেতনার। অবশিষ্ট কয়েকটি দিন নির্মলার ওই ভাবেই কেটেছে। কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, পারত না; অস্পষ্ট করে কিছু বলত, কিছু বলতে বলতে থেমে যেত। কয়েকটি দাহের জ্বালা যেন তার দুর্বল শীর্ণ দেহটিকে শববাহকের মতন বহন করে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর কাছে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই সরল সমাপ্তির আগেই নির্মলা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কী করে হয়েছিল সেটা রহস্য। হয়তো সেদিন রান্নাঘরে চাকরার সময় সে হঠাৎ তার চোখের সামনে সব আলো নিবে যেতে দেখে বিহ্বল হয়ে চলে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে শাড়ির আঁচলে আগুন ধরিয়ে ফেলেছিল, হয়তো সে দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতাবশত এবং অসতর্কতাহেতু শাড়িতে আগুন লাগিয়ে ফেলেছিল আগেই–তারপর সহসা আতঙ্কে তার স্নায়ু আহত হয়ে পড়েছিল, সেই আঘাত তার অতি দুর্বল দৃষ্টিশক্তির পক্ষে অসহ্য হয়ে পড়ে। অন্য কিছুও হতে পারে… কে জানে! নির্মলা মনে করে কিছু বলতে পারেনি। বলা যায় না হয়তো।
নির্মলার মৃত্যু সুরেশ্বরের পক্ষে দুঃসহ হয়ে পড়েছিল। কী যেন তাকে সর্বক্ষণ তাড়িত করে নিয়ে। বেড়াত; অন্তরের কোনও নিভৃত যন্ত্রণা ও প্রশ্ন তাকে ব্যাকুল ও বিভ্রান্ত করত; এই জীবন মূল্যহীন অর্থহীন মনে হত; কোনও সান্ত্বনা ছিল না। এমন নিঃস্ব, রিক্ত, শূন্য আর কখনও মনে হয়নি নিজেকে।
সুরেশ্বর বুঝি কিছু অন্বেষণের আশায় বিভ্রান্তের মতন কলকাতা ছেড়ে চলে যায় তারপর। কয়েক মাস পরে ফিরে আসে, আবার চলে যায়। এইভাবে তার কলকাতায় আসা-যাওয়া ছিল। প্রমথও আর কলকাতায় ছিল না। ক্রমে সুরেশ্বর কলকাতা ছাড়ল।
.
সুরেশ্বর যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে জেগে উঠল, জেগে উঠে দেখল নির্মলা আর নেই। অন্ধ আশ্রমের ঘরে সে শুয়ে আছে, রাত কত বোঝা যায় না, টাইমপিস ঘড়িটার শব্দ বাজছে, নিকষ কালো অন্ধকার, পৌষের অসহ শীত তার ঘর জুড়ে বসে আছে।
.
২৩.
দেখতে দেখতে ক্রিসমাস এসে পড়ল।
এ কদিন গগনরা কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অবনী প্রায় নিয়মিত আসত, দুপুরের পর পর; নিজের অফিসের কাজকর্ম এবং হৈমন্তীর হাসপাতালের কথা ভেবে এই সময়টা সে ঠিক করে নিয়েছিল। কোনও অসুবিধে হত না হৈমন্তীর, সে যেতে পারত। ইতিমধ্যে ওরা শহরে গিয়েছিল। শহরটা কিছু কম পুরনো নয়, সেকালের মিশনারিদের বোধহয় খুব পছন্দ হয়েছিল জায়গাটা, ঢালাও স্কুল কলেজ আর চার্চ করেছে, এখনও তার যথেষ্ট গরিমা; চাঁদমারির দিকে সরকারি অফিস-আদালত, ওদিকটায় ছবির মতন পথঘাট কাঁকর ছড়ানো রাস্তা, দুপাশে গাছপালা, উঁচুনিচু মাঠ ময়দান, বাংলো বাড়ি। রিফরম্যাটরি স্কুল, বিহার গভর্নমেন্টের এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনসটিটিউট…এসবও আছে। শহরের একটা অংশ এই রকম, বাকিটা ঘিঞ্জি আর নোংরা, যত ধুলো তত মাছি।
আর একদিন যাওয়া হল সহদেও পাহাড়ে বেড়াতে। পাহাড়টা তেমন কিছু নয়, পাহাড়তলিটা চমৎকার। দূর থেকে দেখলে মনে হবে শাল আর মহুয়ার সবুজ জঙ্গল অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে বৃক্ষলতাকীর্ণ পাহাড়টি উধ্বাকাশকে নিবেদন করছে। পাহাড়তলিতে হরিণ আর অজস্র বুনো পাখি।
তারপর গগনরা গেল রাম-সীতাকুণ্ড দেখতে। গরম জলের এই কুণ্ডের কাছে মেলা বসে পৌষের শেষে, মেলার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এইভাবে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল গগনরা। এমনকী একদিন রিজার্ভ ফরেস্টও বেড়িয়ে এল রাত করে। সেদিন বিজলীবাবুও সঙ্গে ছিলেন। বিজলীবাবুকে গগন যেন আলাপে চিনত, আসল মানুষটিকে জানত না। সেদিন জানল। জেনে বিজলীবাবুর পরম ভক্ত হয়ে গেল, এমন রসিক-মানুষ বড় একটা তার চোখে পড়েনি। বিজলীবাবু অচিরেই তার বিজলীদা হয়ে গেল।
যদিও গগন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল, মুখে হাসিখুশি ছিল, তবু মনে তার বিন্দুমাত্র সুখ ছিল না। এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য তার ব্যর্থ হয়েছে। আসার পর তার যদি বা সন্দেহ হয়েছিল, তবু দিদির কথাবার্তা এবং মনোভাব থেকে সে দিদিকে যতটা বুঝেছিল সুরেশদাকে ততটা নয়। দিদি কী বলছে না বলছে এটা কলকাতায় ফিরে গিয়ে মাকে বলার জন্যে সে আসেনি, সেটা অর্থহীন হত; সুরেশদার কী বলার আছে তা জানতেই এসেছিল। এখন তার সবই জানা হয়ে গেছে। কলকাতায় ফিরে মাকে কীভাবে কথাটা বলবে সে বুঝতে পারছিল না। বেচারি মা একেবারে ভেঙে পড়বে।
এখানে থাকতেও যে গগনের আর তেমন ইচ্ছে করছিল তাও নয়। কিন্তু হঠাৎ চলে যাওয়া আরও দৃষ্টিকটু হত। ভেতরের গোলমালটা আরও প্রকাশ্য দেখাত, অন্তত সুরেশদার কাছে তাদের বিরক্ত, বীতস্পৃহ, ক্রোধের মনোভাব সরাসরি প্রকাশ হয়ে পড়লে যেন কোথাও একটু খেলো হয়ে থাকতে হত। গগন ভাবছিল, আর কয়েকটা মাত্র দিন কোনও রকমে কাটিয়ে সে নতুন বছরের শুরুতেই কলকাতায় ফিরে যাবে।
গগনের অন্য দুশ্চিন্তা দাঁড়িয়েছিল হৈমন্তী। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, না আপাতত রেখে যাবে।
সেদিন সুরেশ্বরের কাছ থেকে আসার পর হৈমন্তী স্পষ্ট করে জানতে চেয়েছিল সব। তার ইচ্ছে ছিল না গগন যায়; গগন ঝোঁকের মাথায় চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে গগনের বোধহয় মনে হয়েছিল, সুরেশদা যা যা বলেছে অবিকল তা বলা হয়তো রূঢ় হবে। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছিল :তোর পক্ষে এখানে থাকার আর কোনও মানে নেই।
হৈমন্তীর না বোঝার কিছু ছিল না; সে অন্য কিছু আশাও করেনি। তবু গগনের এই ছুটে যাওয়া এবং ফিরে আসার মধ্যে যে-গ্লানি তাকে অপ্রসন্ন, অধোবদন করে রাখল।
তারপর একদিন এই ঘোরাঘুরি হচ্ছিল। গগন মনে মনে মুষড়ে ছিল, তবু মুখে হাসিখুশি নিয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছিল; হৈমন্তী যে ঠিক কী ভাবছিল বোঝা যেত না–মুখ দেখে মনে হত তার উৎসাহ কিছু কম নয়।
মনে মনে দুই ভাইবোনে পরস্পরের কাছে কিছু যেন লুকোবার চেষ্টা করছিল। গগন বুঝি জানতে দিতে চাইত না, সুরেশ্বরের প্রত্যাখ্যানের মধ্যে কতটা নির্মমতা আছে; হৈমন্তীও যেন বুঝতে দিতে চাইত না, সে কতটা অসম্মানিত বোধ করছে, কী প্রচণ্ড গ্লানি এবং বিতৃষ্ণা। সম্ভবত ওরা দুজনে নিজেদের মনোভাব লুকোবার জন্যে তৃতীয় এমন কিছু চাইছিল, যা সাময়িকভাবে তাদের অন্যমনস্ক করে রাখে। ওরা হয়তো কেউই এটা চাইছিল না, এখানে এমন কিছু সহসা ঘটুক যাতে সুরেশ্বর এবং তাদের মধ্যেকার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা অন্যদের চোখে কৌতূহল ও সন্দেহের বিষয় হয়ে ওঠে। হঠাৎ তারা কলকাতা চলে যেতে পারে না, অবনীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াবার সব ব্যবস্থা ঠিক করে এসে আজ আচমকা দুই ভাইবোনে, তা বাতিল করতে পারে না, তারা সুরেশ্বরকেও হয়তো বুঝতে দিতে চায় না, সুরেশ্বর তাদের মনের সুখ আনন্দ হাসিখুশি সব কেড়ে নিয়েছে। এমন কিছু যেন না হয় যা প্রকট, যা কুৎসিত, যার লজ্জা তাদের দুই ভাইবোনকে মাটিতে মেশায়। বরং এই ভাল, সুরেশ্বর দেখুক–তারা সৌজন্য ভোলনি, তারা কোথাও ইতরতা প্রকাশ করল না। তারা কলহ করল না–ক্রোধ বা তিক্ততা দেখাল না। এমনকী সুরেশ্বর এ কথাই মনে করুক, তারা স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছে, বেড়াচ্ছে, আশ্রমে যাচ্ছে। কিছুই যেন হয়নি, বা যা হয়েছে তার গুরুত্ব যেন ওরা কেউ দিচ্ছে না।
ক্রিসমাসের আগের দিন দুপুরবেলায় গগনের হঠাৎ খেয়াল হল, সুরেশ্বর তাকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে বলেছিল, কোন মেলায়।
হাসপাতাল থেকে ফিরে স্নান খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হৈমন্তী বিশ্রাম করছিল। গগন এসে বলল, কী রে, ঘুমোচ্ছিস নাকি?
হৈমন্ত গায়ে লেপ টেনে কাত হয়ে শুয়ে ছিল, বালিশে তার মাথা, মুখ ওপাশে ফেরানো–দেখা যাচ্ছিল না। বালিশের পাশে একটা বই পড়ে আছে।
সাড়া দিয়ে হৈমন্তী বলল, না, ঘুমোইনি। বলল কিন্তু মুখ ফেরাল না। তার গলার স্বর উদাস, নিরাবেগ।
গগন জানলার দিকে গিয়ে দাঁড়াল একটু, ফিরে এসে রেডিয়োর সুইচ টিপল, নব ঘোরাল, সেতার বাজছিল, রেডিয়ো বন্ধ করল, আবার জানলার দিকে সরে এসে দাঁড়াল। এসবের মধ্যে প্রায়ই চোখ তুলে সে দিদিকে দেখছিল। হেম যেভাবে পাশ ফিরে শুয়েছিল সেইভাবেই শুয়ে আছে, গগন তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত গগন বসল, তুইও কি কাল মেলায় যাচ্ছিস?
হৈমন্তী মুখ না ফিরেই বিস্ময়ের গলায় জবাব দিল, কীসের মেলা!
কী জানি! তোদেরই তো জানার কথা…….তুই কি দেওয়াল দেখছিস? শেষের কথাটা ঠাট্টা করে বলা।
হৈমন্তী একটু চুপচাপ, তারপর পাশ ফিরে সোজা হয়ে শুল, কীসের মেলার কথা বলছিলি..?
আমি জানি না। সুরেশদা বলেছিল। ভাবলাম তুই জানিস। কোন মেলায় নাকি তোরা স্লাইড দেখাবি?
হৈমন্তী এবার বুঝতে পারল; সে যে ব্যাপারটা জানে তা নয়, তবে শুনেছে। বলল, তা মেলায় কী?
তুই যাবি নাকি?
না। আমি কেন যাব! হৈমন্তী যেন উপেক্ষার সঙ্গেই বলল, ওরা যাবে।
সুরেশদা আমায় যেতে বলেছিল। বিরাট নাকি মেলা মতন হয়: নাচ-ফাচ, গাধার পিঠে চড়া…
বলেছে তো চলে যা। হৈমন্তীর বলার ভঙ্গিটা ব্যঙ্গের মতন শোনাল।
দূর…র, আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই ওসব মেলা-ফেলায়।
তা হলে যাস না।
তাই ভাবছি। …মুশকিল কী জানিস, না বললে কী আবার ভাববে–তাই মহা ঝামেলায় পড়েছি।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। গগনের সঙ্কোচটা যে কোথায় এ যেন খানিকটা অনুমান করতে পারছিল সে।
মনের মধ্যে কোনও খুঁত খুঁত থাকলে যেভাবে মানুষ এলোমলো করে কথা বলে গগন সেইভাবে কথা বলল; বলার আগে শব্দ করল জিবের। একটা কিছু বলে দেব কী বল? শরীর ফরীর খারাপ বললেই হবে।
আমি কী বলব! হৈমন্তী ওপর দিকে চোখ তুলে বলল।
গগন কিছুক্ষণ আর কথা বলল না। তার মনে যেসব কথা ক্রমাগত আজ কদিন ধরে তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল, এবং যা বলে ফেললে তার স্বস্তি হত সেসব কথা বলতে না পারার জন্যে তার কোনও একরকম অশান্তি ছিল। সুরেশ্বরের সঙ্গও তার এখন কাম্য ছিল না। গগন সব সময় মাথা ঠাণ্ডা করে কথা বলতে পারে না, কী প্রসঙ্গে কোন কথা উঠবে, গগন মাথা গরম করে কী বলে ফেলবে–এইসব ভয় বা খুঁতখুঁতুনি তার ছিল। তা ছাড়া বাস্তবিকই তার ওই দেহাতি মেলায় যাবার আগ্রহ নেই।
গগন বলল, বরং আমি ভাবছি কাল স্টেশনে গিয়ে থাকব। ওঁরা তো বলেছিলেন সেদিন।
হৈমন্তী গলার তলায় লেপ সরিয়ে দিয়ে এবার পাশ ফিরল, গগনের মুখোমুখি হয়ে থাকল।
অবনীবাবুর ওখানে দিব্যি থাকা যাবে, আমাদের বিজলীদা আছেন, খুব একটা হইহই করে ক্রিসমাস করা যাবে। …আমার, বুঝলি দিদি, তোদের এই আশ্রম আর পোযাচ্ছে না।
হৈমন্তী বুঝতে পারছিল গগন ঠিক যে কথাটা বলতে চায় তা বলতে পারছে না, না পেরে ভূমিকা করছে।
হৈমন্তী বলল, তুই কবে কলকাতায় ফিরছিস?
পয়লা…
ছুটি শেষ হচ্ছে কবে?
ওই রকমই, দু তিন তারিখে। গগন পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করল। তার আগে সে উঠে গিয়ে জল গড়িয়ে নিয়ে খেল।
হৈমন্তী কখন যেন গালের তলায় হাত রেখে শুয়েছে।
গগন সিগারেট খেল খানিক, তারপর বলল, বুঝলি দিদি, আমি সেদিন সুরেশদাকে বলছিলাম, ব্যাপার যাই হোক, আমাদের মধ্যে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়। বলছিলাম বটে, কিন্তু এসব বলার কোনও মানে হয় না। সুরেশদাকে আমি খারাপ বলছি না, কিন্তু আমার আর তাকে ভাল লাগছে না। মানে আগে যেমন ভাল লাগত এখন আর তেমন লাগছে না। আমি তাকে অ্যাভয়েড করছে চাইছি।
হৈমন্তী বলল, জানি।
গগম দিদির মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল, দিদি হয়তো আরও একটু বেশি জানলে ভাল হত। জানলে এখানে আসত না। কী রকম বোকার মতন এসেছে, অন্ধের মতন!
কাউকে ভাল না লাগার সঙ্গে হয়তো মানুষের স্বার্থ থাকে– গগন বলল, কেনই বা থাকবে না। তবে সুরেশদাকে আমার এ রকম মনে হয়নি।
হৈমন্তী নীরব, পায়ের দিকের লেপটা সামান্য নড়ল,দুপুরের রোদ সরে গেছে–ঘরে কোথাও রোদ নেই, জানলায় নেই, পরদার আড়াল দিয়ে কিছু দেখাও যাচ্ছে না, সারা মাঠে আজ সকাল থেকে উত্তরের খেপা বাতাস : সেই বাতাসের শব্দ, কুয়ার লাটাখাম্বা উঠছে নামছে তার শব্দ, কখনও কাকের ডাক, কদাচিৎ কোনও পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল।
গগন আবার বলল, সেদিন আমার মনে হল, সুরেশদা নিজের দামটাই বেশি দেয়। …একটা লোক সব সময় নিজের পাওনা হিসেব করবে এটা আমার কাছে অসহ্য।
হৈমন্তী হঠাৎ বলল, সেদিন কী বলল?
গগন যেন না-চেয়েও শেষ পর্যন্ত অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গটায় চলে এসেছে। ইতস্তত করে বলল, কী আর, তোকে তো বলেছি।
না, তুই বলিসনি। …তুই আমার কাছে লুকিয়েছিস।
আমি তো বললাম, সুরেশদার কথাবার্তা থেকে মনে হল না তার আর কোনও আগ্রহ আছে।
তুই কী বললি তা শুনেছি, ও কী বলল তা বলিসনি। তোর মুখ দেখে আমার সেদিনই সন্দেহ হয়েছে, এমন কিছু ও বলেছে যা তুই বলতে পারছিস না।
আমার সঙ্গে সুরেশদার এব্যাপারে কথা খুব কমই হয়েছে, বিশ্বাস কর…
গগন– হৈমন্তী যেন ধৈর্যহীন হয়ে ধমকে উঠল।
গগন সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল, বলল, একটা লোক মুখে কখন কী বলে সেটা বড় কথা নয়, মুখের কথার সত্যিই তেমন কোনও দাম নেই। তবে তুই ঠিকই ধরেছিলি, সুরেশদা আর সে-মানুষ নেই। ভালবাসাটা তার কিছু নয়। ..সুখ-টুখ…আনন্দ এইসব কী যেন বলছিল। আসলে কিছুই বলছিল না। চুপ করে ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব জ্ঞান তোমার এতদিনে হল? জবাবে বলল, না আগেই হয়েছে…। আমি কিছু বুঝলাম না। জ্ঞান যদি আগেই হবে তবে এতদিন ধরে এইভাবে ধোঁকা দেওয়া কেন? তার কোনও জবাব নেই। মামুলি কথা : আমার ভুল হয়েছে…। ওটা কোনও জবাব নয়, কৈফিয়ত নয়। … যাকগে, এ একপক্ষে ভাল, যা হবার হয়ে গেল। সেই যে–মামা বলে, মামলার তারিখ পড়ার চেয়ে জজের রায় ভাল, কথাটা ঠিক…। গগন যেন শেষের দিকে তার হতাশা ও ক্ষোভ দমন করার চেষ্টায় কোনওরকম সান্ত্বনা খুঁজল।
হৈমন্তী কথা বলল না, অল্প একটু শুয়ে থেকে এবার উঠে বসল, হাঁটু মোড়া, কোমর থেকে পা লেপে ঢাকা রয়েছে।
বসে থাকতে থাকতে গগন বলল, সুরেশদা যখন আনন্দ-টানন্দ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তখন আমার মনে হয় না তোর আর এখানে থাকা চলে। মাও রাজি হবে না। …আমি চলে যাই, তুইও কয়েকটা দিন পরে আয়।
হৈমন্তী এবারও কথার কোনও জবাব দিল না, কপাল এবং মুখের পাশ থেকে এলোমেলো চুলের গুচ্ছ হাতে করে সরিয়ে নিতে লাগল।
গগন কেমন অপরাধীর মতন একবার দিদিকে দেখল কয়েক পলক, তারপর গলা উঁচু করে জানলার বাইরে তাকাল। শেষে ইতস্তত করে বলল, দেখ দিদি, কথায় বলে ভালবাসা মরে যাবার পর ভালবাসার ভানটা সাঙ্ঘাতিক, ওর চেয়ে বিচ্ছিরি আর কিছু হতে পারে না। …আমায় যদি বলিস আমি বলব, সুরেশদার ও ব্যাপারটা আর নেই, আমার তো তাই মনে হল… বোধহয় তোর দিক থেকেও এখন আর কোনও… কথা গগন শেষ করল না।
গগনের চোখে চোখে তাকিয়ে ছিল হৈমন্তী। মনে হচ্ছিল, হৈমন্তী যেন তার অভ্যস্ত দক্ষ দৃষ্টিতে গগনের চোখের সবটুকু দেখে নিচ্ছিল। দৃষ্টি তীব্র, স্থির, প্রখর। গগন রোগীর মতন তার চোখ খুলে বসে থাকল।
হৈমন্তী বলল, যতক্ষণ মুখফুটে না বলছিল ততদিন বুঝি তোর মনে হচ্ছিল ওর ভালবাসা আছে? গগন এবার নীরব থাকল, মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল।
আর কী বলল–! … বলল না যে, আমার বড় অন্যায় হয়েছে, তোমরা আমায় ক্ষমা করো, মাসিমাকে বোলো তিনি যেন কিছু মনে না করেন– ব্যঙ্গ করে করে হৈমন্তী বলছিল।
গগন মাথা নাড়ল ধীরে ধীরে, বলল, ভুলের কথা বলছিল। …একটা কথা আমি বুঝতে পারলাম না, কী বলছিল–একবার এক ঘটনা থেকে হঠাৎ তার সব কেমন হয়ে গেল, দ্বিধা-টি চলে এল…
কী ঘটনা?
কী জানি! কিছু বলল না। …তুই কিছু জানিস?
হৈমন্তী মাথা নাড়ল, না জানে না। কিন্তু সে বিস্মিত হয়েছিল এবং ভাবছিল।
সেদিন অবনীর আসতে দেরি হল; যখন এল তখন আর বিকেল ছিল না, পৌষের অপরাহ্ন ধূসর হয়েছে, অন্ধকার হয়ে এল প্রায়। উত্তরের বাতাসটাও আজ সারাদিন প্রখর, মাঠে-ঘাটে শনশন ছুটে বেড়াচ্ছিল। আকাশের রোদ দুপুর থেকেই ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল, মাঝে মাঝে জমছিল, আবার ভেসে যাচ্ছিল।
গগন বলল, আমরা ভেবেছিলাম আজ আর আপনি এলেন না।
অবনী বলল, আজ তো কোথাও যাবার কথা নেই, দেরি করেই এলাম। কাল ছুটি, পরশুও; কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরেছি দুপুরে।
গগন অবনীকে নিজের ঘরে এনে বসাল। বলল, আজকের ওয়েদারটা কী রকম যেন। শীত খুব, কিন্তু ডাল।
বৃষ্টি হতে পারে।
এই শীতে বৃষ্টি–
এ-সময় একটু-আধটু হয়। …আচ্ছা শুনুন, পরশুদিন আমরা কিন্তু হাইড্রো-ইলেকট্রিক ইনস্টলেশান দেখতে যাচ্ছি, ইনস্পেকশান বাংলো পাওয়া যাবে।
বাঃ, ওয়ান্ডারফুল। ওটা হলেই আপাতত হয়ে যায় আমার– গগন হাসল, তারপরই ঘরের ছেলে ঘরে।
কবে ফিরছেন?
পয়লা…
এত তাড়াতাড়ি! সেকি, আরও থেকে যান কদিন।
গগন হেসে মাথা নাড়ল। না; আর থাকা যাবে না। এসেছিও তো দশবারো দিন হয়ে গেল। বসুন, দিদিকে ডেকে আনি। গগন হৈমন্তীকে ডাকতে গেল।
সামান্য পরেই ফিরল গগন। বলল, আমি তো ভাবছিলাম কাল আপনাদের ওখানে যাব। আমার একটা নেমন্তন্ন পাওনা রয়েছে। গগন হাসল।
অবনী ততক্ষণে সিগারেট ধরিয়েছে, জবাব দিল, চলে আসুন। বলা তো আছেই—
বিজলীদা মুরগি-টুরগি খাওয়াবেন বলেছেন
বিজলীবাবুর রান্নার হাতযশ আছে; অবনী হেসে বলল। ঠিক আছে, ব্যবস্থা করা যাবে, আপনারা চলে আসুন।
দিদি কি যাবে?
যাবেন না? কেন?
জানি না। ওদের হাসপাতাল বন্ধ থাকলে যাবে। আমি সকালবেলাতেই পালাতে চাই। নয়তো ঝামেলায় পড়ব।
অবনী কিছু বুঝল না।
গগন নিজের থেকেই বলল, সুরেশদারা কোথায় কোন মেলায় গিয়ে চক্ষুরোগের প্রতিকার না কি তার স্লাইড দেখাবে। আমায় বলেছে, চল। ধ্যত, ওসব আমার পোয় নাকি? তার আগেই পালাতে চাই। গগন সরল গলায় হেসে হেসে বলল।
অবনী হেসে ফেলল। এই ব্যাপার?
আপনি কি মেলাটায় গিয়েছেন নাকি, স্যার? মাঝে মাঝে গগন মুখফসকে রসিকতা করে স্যার বলে ফেলে, এটা তার অভ্যেস।
না। অবনী মাথা নাড়ল; তারপর বলল, মেলা-ফেলায় এখন যাওয়া রিসকি। সেদিন কোথায় যেন শুনলাম বিদঘুটে এক রোগে কোন মেলায় দুটো লোক মারা গেছে।
কী জানি! অফিসে কে বলছিল। ..এ সময়টা এদিকে গাঁয়েটায়ে স্মল পক্সটা খুব হয়, প্লেগও শুনেছি হত।
এমন সময় হৈমন্তী এল। ঘর বেশ অন্ধকার হয়ে আসছে জেনেই যেন সে বাতি এনেছিল। বাতিটা নামিয়ে রাখল।
গগন বলল, দিদি, কাল তোর হাসপাতাল?
কেন?
না, তা হলে সকালের দিকে স্টেশনে চলে যেতাম। বড়দিনটা ওখানেই করা যেত।
তুই বুঝি নিজেই পাকা ব্যবস্থা করে ফেলেছিস!
তা করেছি। সুরেশদার সঙ্গে মেলায় যাওয়ার চেয়ে নেমন্তন্ন খাওয়া কি খারাপ?
গগন হাসতে লাগল।
হৈমন্তী গগনের বিছানার পাশ ঘেঁষে বসল।
অবনী বলল, কাল আপনারা আসুন।
হৈমন্তী হাসপাতালের কথা তুলল না, মাথা হেলিয়ে বলল, যাব।
গগন কেমন যেন অবাক হল। তোর হাসপাতাল?
ওরা দেখবে, হৈমন্তী সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, তার জবাব শুনে মনে হল প্রসঙ্গটা তার আর আলোচনা করার ইচ্ছে নেই।
গগন চুপ করে গেল। অবনীও কথা বলছিল না। হঠাৎ কেমন একটা স্তব্ধতা নামল ঘরে।
শেষে গগনই কথা বলল। চায়ের কথা বলেছিস?
না, মালিনীকে পেলাম না। দেখ তো ফিরেছে কিনা?
গগন উঠল, ঘরের এক কোণে টুলের ওপর তার সুটকেস, সুটকেসের ওপর রাজ্যের গরম জামা-টামা পড়ে আছে, পুরোহাতা পুলওভারটা টেনে নিয়ে পরে নিল, যদিও ভেতরে তিন প্রস্থ জামা আগেই পরেছে। বলল, আমি এই ফাঁকে বোঁ করে সুরেশদাকে বলে আসি, কাল মেলায় যাওয়া হবে না। বলে মালিনীর খোঁজ করতে চলে গেল।
অবনী হৈমন্তীর মুখের দিকে তাকাল, দেখল, চোখ ফেরাল, তারপর আবার তাকাল। অন্য দিনের তুলনায় হৈমন্তীকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। অবনী বলল, আপনার কি শরীর খারাপ?
হৈমন্তী চোখ ফিরিয়ে তাকাল। না; কেন?
মনে হল… অবনী হাসল, খুব গম্ভীর…
গম্ভীর থাকলে শরীর খারাপ বোঝায়?
জানি না, লোকে বলে, বোধহয় ওটা অভ্যেস। আপনিই বেশি বুঝবেন, ডাক্তার বদ্যি লোক।
হৈমন্তী অন্যমনস্ক চোখে অবনীর সকৌতুক মুখভঙ্গি লক্ষ করছিল। অবনীর সম্পর্কে তার নানাবিধ গভীর কৌতূহল জাগে আজকাল। এখন অবশ্য সেরকম কোনও কৌতূহল জাগছিল না, বরং অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেও অন্য কিছু ভাবছিল। হৈমন্তী বলল, মাথাটা বিকেল থেকে ধরে আছে; হয়তো ঠাণ্ডা লেগেছে। আজ খুব ঠাণ্ডা।
অবনী মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, বেশ শীত; বৃষ্টি বাদলা হতে পারে সামান্য।
হৈমন্তী এমন একটা মুখভাব করল, মনে হল শীতের বৃষ্টি তার বিন্দুমাত্র পছন্দ নয়।
দুজনেই প্রায় চুপচাপ। অল্প পরে অবনী বলল, গগনবাবু তো চললেন–
আপনি গগনকে বাবুটাবু বলে যেরকম বাড়িয়ে দিলেন– হৈমন্তী হালকা হবার চেষ্টা করল, ও কত ছোট, আমার চেয়েও ছোট…
অল্প দিনের পরিচয়, বেশিদিন থাকলে হয়তো গগন বলেই ডাকতাম।
কিছু না, আপনি অনায়াসেই ডাকতেই পারেন। আপনার আড়ালে ও মাঝে মাঝে যেরকম ঠাট্টা করে।
তাই নাকি?
হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল, পারল না। অবনীর সামনে সাধাসিধে মুখে গল্প-টল্প করতে গিয়েও সে পারছে না। মাথাটা সত্যিই ধরে আছে। দুপুর থেকে ক্রমাগত সে কেন যে এত ভাবছে, কী আছে এত ভাববার, সুরেশ্বরের জীবনে কত ঘটনাই তো ঘটতে পারে, তাতে তার কী আসে-যায়!
আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি অবনী হঠাৎ বলল।
হৈমন্তী সচকিত হয়ে তাকাল।
অবনী বলল, আমায় পাটনা যেতে হচ্ছে না!
হৈমন্তী খুশি হল। খুশির পরক্ষণেই তার চোখে বিমর্ষ ভাব ফুটল। গেলেই পারতেন; এভাবে জীবনের উন্নতি নষ্ট করতে নেই।
আমার জীবন খুব ছোট– অবনী হাসল, উন্নতি আর চাই না, একটু স্বস্তি চাই।
এখানে স্বস্তিতে আছেন?
অনেকটা।
অবনী অবশ্য আগেও অনেকবার বলেছে কথাটা। হৈমন্তী চুপ করে থাকল, কী ভাবল, তারপর বলল, আপনারা সবাই দেখছি এই জায়গাটায় খুব স্বস্তি পাচ্ছেন। তার কথাটা শেষ হয়েও হল না যেন।
অবনী প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, পরে বুঝল। বলল, আমরা কে কে সুরেশ্বরবাবু আর আমি! ওঁর কথা আলাদা, আমি তো ছোটখাটো সুখ-স্বস্তিতেই বেঁচে যাই।
তা হোক, তবু এটা জায়গার গুণ.. হৈমন্তী পরিহাস করে বলতে গেল।
অবনী পূর্ণদৃষ্টিতে হৈমন্তীকে লক্ষ করল, বলল, আপনার বোধহয় তেমন স্বস্তি হল না।
হৈমন্তী চেষ্টা করল অবনীর দিকে তাকাবার, কোনও রকম অদ্ভুত এক ভয়ে তাকাতে পারল না। আলোর দিকে মুখ করে বসে থাকল।
অবনীও কোনও কথা বলছিল না।
শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী নিজেকে যেন কোনও অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বাঁচাবার জন্য বলল, আজ স্বস্তি স্বস্তি করছেন, পরে আফশোস, করবেন।
কেন?
হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছেন বলে?
অবনী হাসল না, হাসির মতন মুখ করল; বলল, আফশোসের কথা বলবেন না, ওটা আমি সারা জীবনই প্রায় করে যাচ্ছি। এতদিনে গা সওয়া হয়ে গেছে। বলে অবনী চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে গা সামান্য ছড়িয়ে দিয়ে ছাদের দিকে তাকাল। কী ভেবে সামান্য পরে বলল, লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী দুইয়ের জন্যই তো দেখি মানুষের আফশোস। …তার বাইরেও কত রকমেরই আফশোস আছে! অবনী যেন কথার শেষে হাসতে চাইল।
হৈমন্তী নীরব থাকল। অবনী ঠিকই বলেছে। আফশোসের কি অন্ত আছে জীবনে!
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল অবনী, হৈমন্তীর দিকে তাকাল, তারপর মুখ নিচু করে সিগারেট ধরাল। কে যেন বলেছিল– অবনী মুখ তুলে বলল, জগৎটাকে গড়ার সময় বিধাতা ভদ্রলোকের কাণ্ডজ্ঞান বিশেষ ছিল না, কাঁচা হাতে বোকার মতন এই সংসারটা গড়ে ফেলেছেন; মোস্ট ইমপারফেক্ট…। কথাটা বন্দ বলেনি, কী বলেন? খানিকটা ভদ্রলোকের মন গড়তে পারলে এত আফশোস-টাফশোস থাকত না…অবনী এবার হাসল। হাসিটা ছাই চাপা আগুনের মতন, ওপরে হাসি ভেতরে যেন কীসের আঁচ রয়েছে।
হৈমন্তী গায়ের চাদর খুলে আবার গুছিয়ে নিল, নিজের এই স্থির অনড় ভাবটা যেন তার ভাল লাগছিল না। সামান্য নড়েচড়ে বসল। শেষে হেসে বলল, সংসারের গড়নটা আপনার তা হলে পছন্দ নয়?
মাথা নাড়ল অবনী, না। কোনওকালেই ছিল না।
কিন্তু কিছু করতেও পারলেন না।
কিছু না; শুধু বসে বসে আফশোস।
কী জানি….! আফশোস করেই বা কী লাভ! হৈমন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল।
কিছু না। বিজলীবাবু হলে ওমর খৈয়াম শোনাতেন। আমার কাব্য-টাব্য জানা নেই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনওদিন ছাদ ফুড়ে দুম করে যদি কিছু পেয়ে যাই–অমূল্য রতন, তবে আর আফশোস, করব না। অবনী হাসছিল।
গগন এল। ঘরে এসে বলল, চা দেয়নি? ..আনছে তা হলো… বুঝলি দিদি, সুরেশদাকে বলে এলাম। বললাম, কাল আমাদের স্টেশনে নেমন্তন্ন, মেলায় যাচ্ছি না। …ভেরি বিজি সুরেশদা, লোকজন রয়েছে। বলে কী মনে হওয়ায় গগন অবনীর দিকে তাকাল, আপনি ঠিকই বলছিলেন স্যার, কোথায় যেন কীসের একটা এপিডেমিক ব্রেক-আউট করেছে। ওখানেও শুনলাম।
.
২৪.
পথ মাইল পঞ্চাশের কিছু বেশি। অবনী দুপুর নাগাদ এসেছিল, বেরুতে বেরুতে তিনটে বাজল।
হৈমন্তীও যাচ্ছে। তার যাবার কিছু ঠিক ছিল না; বরং বরাবরই সে বেশি দূর পথ যেতে, বাইরের ঠাণ্ডায় রাতে ঘোরাঘুরি করতে অনুৎসাহ দেখিয়েছে। গুরুডিয়া থেকে অতটা পথ জিপে করে গিয়ে মাদাউআলের বনজঙ্গল পাহাড়ের মাঝখানে হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস দেখার উৎসাহ তার ছিল না। তা ছাড়া সারারাত সেখানে কাটাতে হবে। অসুবিধেও ছিল। তবু সে শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে।
গতকাল, অবনীর বাড়িতে গগনের সঙ্গে বড়দিন করতে এসে সারাটা দিন ভালই কেটেছিল। গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা, বিজলীবাবুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, অনেক দিন পরে হঠাৎ গগনের পাল্লায় পড়ে তাস খেলা–এসব যেন মনের কোনও গুরুভার সাময়িকভাবে অনেকটা হালকা করে দিয়েছিল। ফেরার সময় অবনী বলল, আপনিও চলুন কাল, সাইটটা খুব সুন্দর, বাঁধের গায়ে পাহাড়ের ওপর ইনসপেকশান বাংলো, চমৎকার লাগবে। একটা তো রাত। অসুবিধে খুব হবে না। পরশু দিন বেলা নটার মধ্যে যথাস্থানে পৌঁছে দেব আপনাকে।
গগন বলল, চল দিদি, এই চান্স। পরে আর তোর যাওয়া হবে না।
হৈমন্তী তখনও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। সে গগন নয়, যাব বললেই যেতে পারে না। কিছু যেন ভাবার ছিল।
আজ সকালে হাসপাতালে রোগী ছিল না; অনেকটা বেলায় দুজন এল : একটার চোখ উঠেছে, অন্যটার ঠাণ্ডায় চোখ মুখ ফুলে টসটসে। তারপর এল সুরেশ্বর, সঙ্গে শিবনন্দনজি। দুজনেই যেন ব্যস্ত; কথা বলতে বলতে এসেছিল, কথা বলতে বলতেই চলে গেল, কেন এসেছিল বোঝা গেল না। কিন্তু মনে হল, যেন এই আসা-যাওয়ার মধ্যে হৈমন্তীকে দেখে গেল।
হাসপাতালে বসে থাকতে থাকতে হৈমন্তী স্থির করে ফেলল : সে যাবে। আসার সময় যুগলবাবুকে বলে এল, কাল আসতে তার বেলা হবে, রোগী এলে যেন বসিয়ে রাখা হয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে গগনকে বলল, আমরা আজ থাকছি না তোর সুরেশদাকে বলে আয়।
পথটা নতুন; এর আগে হৈমন্তী আর এদিকে আসেনি। ছড়ানো কালো ফিতের মতন পথ, যত যাও ততই যেন ফিতেটা খুলে যাচ্ছে, আঁকবাঁক তেমন একটা নেই, পরিষ্কার ছিমছাম, ডাইনে বাঁয়ে ঢেউ-ভাঙা প্রান্তর, দূরে গায়ে গায়ে কোথাও পাহাড়ের টিলা, কোথাও বা তরুলতায় আচ্ছাদিত ছোট ছোট পাহাড়। শীতের মরা রোদ পার্বত্য পাদদেশকে ক্রমশই নিষ্প্রভ করে আনছিল। ছায়া নেমেছে তরুমূলে, ছোটখাটো দেহাতি গ্রাম, অল্পস্বল্প ক্ষেত খামার, সবজি মটরশুটি, কাঁচা কুয়ো থেকে জল তুলছে বউ ঝি, কুল ঝোপ, দু-একটা কুকুর। কদাচিৎ এক আধটা বাস চলে যাচ্ছিল।
সামনে অবনী, পাশে বিজলীবাবু। পেছনে হৈমন্তী আর গগন। নেব না নেব না করেও কয়েকটা জিনিস হয়ে গেছে। তার মধ্যে বিছানার ব্যবস্থাই প্রধান, ছোটখাটো স্যুটকেসও। হৈমন্তীর জন্যে গগন কম্বল নিয়ে নিয়েছিল, আর দুই ভাইবোনের কিছু গরম বস্ত্র। গগনরাও সুটকেস নিয়েছে একটা। জল আর চায়ের ফ্লাস্ক, টিফিন কেরিয়ার–এসব বিজলীবাবুর ব্যবস্থা। উপরন্তু বিজলীবাবুর আরও একটি ব্যবস্থা ছিল, হৈমন্তী আসছে শুনে তিনি সঙ্কুচিত ও বিব্রত হয়ে আগেভাগেই সেটা লুকিয়ে ফেলেছিলেন।
দেখতে দেখতে অনেকটা পথ চলে আসা গেল।
বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব এবার একটু রেস্ট দিন। বিকেলের চা-টা খেয়ে ফেলা যাক।
ক মাইল এলাম? গগন শুধোল।
প্রায় আধাআধি, মাইল পঁচিশ হবে– বিজলীবাবু জবাব দিলেন।
বিজলীদার দেখছি মাইলেজ পর্যন্ত মুখস্থ, গগন হেসে বলল।
এখানকার দেহাতি লোক ভাই, কোথায় কী তার একটা মোটামুটি জ্ঞান না থাকলে চলে। বলে বিজলীবাবু ডান হাত তুলে দূরে একটা পাহাড় দেখালেন, বললেন, ওই পাহাড়টা হল চন্দ্রগিরি, এখানকার লোকে বলে চাঁদওআরি, ওর নীচে দিয়ে আমাদের যেতে হবে।
পাহাড়টা তো কাছেই, গগন বলল।
মাইল ছয়েক বিজলীবাবু বললেন।
গগনের বিশ্বাস হল না, বলল, ছ মাইল? কী বলছেন! …এখানের মাইলের হিসেবটাও কি দেহাতি?
বিজলীবাবু হেসে জবাব দিলেন, পাহাড় জিনিসটা ওই রকমই মনে হয় পাই পাই তবু তারে পাই না।
বিজলীবাবুর বলার ভঙ্গিতে গগন জোরে হেসে উঠল। হৈমন্তীও হেসে ফেলল। অবনী হাসতে হাসতে বলল, বিজলীবাবু, এটা ওমর খৈয়াম নয়। বলে চা খাবার জন্যে গাড়ি দাঁড় করাল।
বিজলীবাবু সহাস্য মুখে জবাব দিলেন, না, ওমর খৈয়াম নয়। এ হল পুরনো দিনের বাংলা গান । সে যে দেখা দিয়ে দেখা দেয় না, ধরা দিয়ে হায় ধরা দেয় না। জংলা কারফা।
অবনী গলা ছেড়ে হেসে উঠল। গগনও হাসতে লাগল।
অবনী বলল, বিজলীবাবুর তা হলে পুরনো বাংলা গানও জানা আছে।
গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন বিজলীবাবু, পথে দাঁড়িয়ে গায়ের জামাটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, একটু আধটু আছে। আমার বাবার মুখে শুনেছি। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ডুগি তবলার সঙ্গে সঙ্গত করে গাইতেন। বলে বিজলীবাবু গাড়ির মধ্যে হাত বাড়ালেন, হৈমন্তীকে বললেন, দিন তো দিদি, চায়ের ফ্লাস্কটা। ওই যে হলুদ মতন কাপড়ের থলে ওর মধ্যে কাপ টাপ আছে।
গগনও নীচে নেমে দাঁড়িয়েছিল। অবনী রাস্তায় দাঁড়িয়ে জিপগাড়িটার সামনে চাকায় বার কয়েক জুতোর ঠোক্কর মেরে কী যেন দেখে নিল।
হৈমন্তী চায়ের কাপ বের করল। বিজলীবাবুর সব কাজ ব্যবস্থা মতন, কোথাও এতটুকু ভুল হবার জো নেই। চায়ের কাপ, জলের গ্লাস, কলাপাতায় মোড়া পান। হৈমন্তী গাড়ির পিছন দিক থেকে জলের ফ্লাস্ক নিয়ে কাপ ধুতে ধুতে বলল, বাড়ি থেকে সব গুছিয়ে দিয়েছে না?
বিজলীবাবু হাসলেন। ওইটুকুই সুখ, কোথাও যাব বললে আর রক্ষে নেই, মরণকালে মুখে দেবার গঙ্গাজলটুকু পর্যন্ত এগিয়ে দেবে।
হৈমন্তী হাসিমুখে ভর্ৎসনা করল, ছি, ও কথা বলবেন না।
গগন বলল, আপনি এমন তোফা আছেন বিজলীদা যে আপনাকে দেখে ম্যারেজ সম্পর্কে আমার প্যানিকটা কেটে যাচ্ছে।
ফক্কড়….! হৈমন্তী ধমক দিল যেন।
হাসাহাসির মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া হল। হৈমন্তী নামল না।
মাঠ ঘাট থেকে রোদ এবার উঠতে শুরু করেছে, যেন এতক্ষণ সারাটা সকাল দুপুর ধরে আকাশ এসে মাটিতে রোদ মেলে দিয়েছিল, এবার বেলা পড়ে যাওয়ায় দ্রুত হাতে তা তুলে নিয়ে কোলে জড়ো করছে।
অবনী এসে গাড়িতে বসল, ঠোঁটের ডগায় সিগারেট। বিজলীবাবু পান মুখে পুরেছেন, জিবের ডগায় একটু চুন চুঁইয়ে ধীরে ধীরে গাড়ির মধ্যে উঠে এলেন। গগনও সিগারেট টানতে টানতে উঠে পড়ল।
প্রায় সাড়ে চার বাজছে। রোদ পালাচ্ছে বলে বুঝি শীতের দমকা উত্তরের বাতাস তাকে তাড়া করতে শুরু করে দিয়েছিল। গাছের ছায়াগুলি এখন বেশ দীর্ঘ এবং মাটির রঙের সঙ্গে ছায়ার রং মিশে আছে।
অবনী গাড়িতে স্টার্ট দিল।
কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে? গগন জিজ্ঞেস করল।
ঘণ্টাখানেক, অবনী বলল; বলে বিজলীবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, নাওদা না কী বলে যেন, ওখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা ধরলে নাকি শর্টকাট হয়।
বিজলীবাবু মাথা নাড়লেন, রাস্তা খুব খারাপ, আমার চেনা নেই; পুরনো রাস্তাই ভাল।
গাড়ি চলতে শুরু করল। অল্প এগিয়েই অতি শীর্ণ এক নদী, নদীতে জল নেই, বালির ওপর ছায়া নেমেছে, ধীরে ধীরে যেন বনাঞ্চলের মধ্যে রাস্তাটা হারিয়ে যাচ্ছে, বড় বড় শালগাছ, অজস্র হরীতকী আর নিম। শীতের বাতাস এসে গাছপাতায় ক্ষণে ক্ষণে কাঁপুনি তুলেছে, আমলকী বন যেন হঠাৎ ছুটে এসে পালাল, আর কোথাও গাঁ-গ্রাম চোখে পড়ছে না, শুধু জঙ্গল, বিচিত্র গাছপালা, পথে মানুষজন নেই, গাড়ি নেই, নির্জন নিস্তব্ধ এক জগতে যেন ক্রমশই গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে।
বিজলীবাবু তাঁর হাতে-পাকানো সিগারেট ধরিয়েছেন। হৈমন্তীর শীত ধরতে শুরু করেছিল, গায়ের কোটটা জড়িয়ে নিল। গগন ঝুঁকে পথঘাট দেখছে, অন্যমনস্ক।
অবনী বলল, বিজলীবাবু, আপনার কপিলকে দিয়ে ক্লাচটা একবার দেখাবেন তো, মাঝে মাঝে বড় ডিস্টার্ব করে…।
বিজলীবাবু অবনীর পায়ের দিকে তাকালেন।
গগন হঠাৎ বলল, আমরা কি পাহাড়ের তলায় এসে পড়লাম?
হ্যাঁ, বিজলীবাবু জবাব দিলেন, আর একটু এগিয়েই দুদিকে পাহাড় পড়ে যাবে, মাঝ দিয়ে রাস্তা। …চন্দ্রগিরির এক গল্প আছে।
কী গল্প?
এখন তো বলা যাবে না…চেঁচাতে হবে; পরে বলব।
গগন চুপ করে গেল।
সামান্য পরেই চারপাশ থেকে পাহাড়ের আড়াল উঠে এল, যেন বনবৃক্ষ ও লতাগুল্মপূর্ণ পাথরের এক মস্ত ঝাঁপি তাদের দুপাশে। দীর্ঘশীর্ষ গাছ, কুণ্ডলী পাকানো জটাজুটধারী অশ্বথ, ভূপীকৃত ছায়া, কদাচিৎ কোনও সূর্যরশ্মির রেখা, গভীর খাদ, আর পরিপূর্ণ স্তব্ধতা; শুধু গাড়ির শব্দ শ্বাসপ্রশ্বাসের মতন কানের পরদায় মিশে আছে।
তারপর কখন যেন এই ঝাঁপি খুলে যেতে লাগল, মাথা তুলে দাঁড়ানো আড়াল সরে যাচ্ছে, বনজঙ্গল বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী হয়ে আসতে লাগল, সামনে উতরাই, শেষ বিকেলের ম্রিয়মাণ আলোয় ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ে যাচ্ছে, নিমফুলের গন্ধের মতন কেমন এক গন্ধ এল, কয়েকটি বনজ কুসুম।
গগন এতই মুগ্ধ ও উচ্ছ্বসিত হয়েছিল যে সে হঠাৎ গাইতে শুরু করল :বুঝি বেলা বয়ে যায়, কাননে আয় তোরা আয়…।
গগন গানে পারদর্শী নয়; তবু তার মোটা সাদামাটা গলা, তার উচ্ছ্বসিত মুগ্ধ হৃদয় গানটিকে কেমন সুন্দর ও জীবন্ত করে তুলল।
বিজলীবাবু ঘাড় পিছু দিকে হেলিয়ে দিয়ে গান শুনতে লাগলেন। অবনী একবার ঘাড় ফেরাল। হৈমন্তী হাঁটুর ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল।
গান শেষ হলে বিজলীবাবু বললেন, বাঃ।
গগন যেন এবার লজ্জা পেল। হৈমন্তীর দিকে চকিতে চেয়ে বলল, হঠাৎ কেমন ফিলিং চলে এল বিজলীদা, আমি গাইয়ে নয়।
না হলে গাইয়ে, কিন্তু বেশ গেয়েছ। দেখো ভাই, গান হল আধা-গাইয়েদের জন্যে; আর সুর হল পাকা-গাইয়েদের জন্যে।
গগন কেমন অবাক হয়ে বলল, সে কী! মানেটা তো বুঝলাম না।
বিজলীবাবু হেসে বললেন, মানেটা সহজ। একটা হল অন্তরের জিনিস, অন্যটা যন্তরের।
ঠিক যেন গোধূলি বেলায় মাদাউআলের কাছে ওরা পৌঁছে গেল। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সরকারি জঙ্গল দুপাশে, মনে হল এক সময়ে এই জঙ্গল কেটে মাঠ হয়েছিল, আবার নতুন করে সামনের দিকটায় গাছের চারা পোঁতা হয়েছে। ছোট ছোট গাছ, সাজানো, গোছানো, একটা সজারু ছুটে গেল, কিছু পাখি, শীতের ধূসরতা নেমে গেছে, আকাশ গড়িয়ে গোধূলির আলো মেঘের আড়ালে ডুবে যাচ্ছে, ঠাণ্ডা কনকনে মুঠো ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে শীতের।
দেখতে দেখতে এই বনের মধ্যে মানুষের পদচিহ্ন ফুটে উঠল। হলুদ রঙের কোয়াটার্স, মস্ত মস্ত লোহার থাম, ওভারহেড লাইন, নদীর রেখা, অন্যদিকে পাহাড়ের দেওয়াল। যেতে যেতে সরকারি জঙ্গলে গগন একটা হরিণ দেখতে পেল। আঙুল দিয়ে হরিণটা দেখাবার আগেই সে অদৃশ্য।
অবনী ডাইনে বেঁকল, তারপর আবার বাঁয়ে। সামান্য পথ এগিয়েই চোখের সামনে বাঁধটা দেখা গেল। এপাশ ওপাশ যেন আর দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট করে, অন্ধকার হয়ে এসেছে, বাতি জ্বলছে, দুরন্ত তীক্ষ্ম এক বাতাসের দমকা এসে সর্বাঙ্গ শিহরিত করল।
বিজলীবাবু বললেন, বছর পাঁচেক আগে একবার এসেছিলাম মিত্তিরসাহেব, তখন কাজ চলছে। এখন দেখছি ভোল পালটে ফেলেছে।
অবনী বলল, আসতে তো চাইছিলেন না, জোর করে নিয়ে এলুম।
গগন বলল, ইস, এখানে এসে সাতটা দিন থাকলেই হত। মার্ভেলাস সাইট। …কী রে দিদি, ভাল লাগছে না?
হৈমন্তী ঘাড় কাত করল। তার ভাল লাগছিল।
.
যতক্ষণ ভেতরে ছিল মনে হচ্ছিল এ এক রহস্যপুরী, যা দেখা যায় তার চেয়েও যা দেখা যায় না তার চিন্তাই যেন বিহ্বল করে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় উদাসীন বিরাটাকার কত যন্ত্র ধ্যানীর মতন বসে আছে, কোথাও তার ভ্রূক্ষেপ নেই, অথচ তার আভ্যন্তরিক রহস্যের পরিচয় শুনলে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। দুর্বোধ্যের সামনে দাঁড়ালে চমৎকৃত হবার যে স্বাভাবিক আবেগ, গগনরা সেই আবেগে চমৎকৃত ও বিহ্বল হচ্ছিল। অবনীর পক্ষে বিমূঢ় অথবা বিস্মিত হবার কোনও কারণ ছিল না। বরং পাওয়ার হাউসের ছোকরা মতন শিফট ইঞ্জিনিয়ার শ্রীবাস্তব যা দেখাচ্ছিল এবং বোঝাচ্ছিল অবনী তার বিস্তৃত ও সরল ব্যাখ্যা করে গগনদের কৌতূহলকে মোটামুটি পরিতৃপ্ত করছিল। যন্ত্রের সেই জটিল জগৎ, যেখানে কেমন একটি নিরবচ্ছিন্ন গুঞ্জন ছিল, যেখানে প্রত্যক্ষের চেয়ে অপ্রত্যক্ষে এবং অন্তরালে কত বিচিত্র কিছু হয়ে যাচ্ছিল, যেখানে আলোকিত মঞ্চে কয়েকটি মাত্র কুশীলব দৈত্যসদৃশ লৌহপিণ্ডকে করতলগত করে রেখেছিল–সেই জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে গগন বলল, এসব দেখলে মানুষের ওপর ভক্তি বেড়ে যায়। জলস্থল তাও তার হাতে বাঁধা পড়ল।
ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গেছে। চারপাশে কেমন একটা ময়লা আলোর ভাব, টিলা আর পাহাড়, গাছপালার অন্ধকার, কৃষ্ণপক্ষের শুরু, চাঁদ উঠে আসছে, দুরে দুরে বাতি জ্বলছে, যেন একটি আলোর মালা সমস্ত উপত্যকার গলায় ঝোলানো, বাতাসের ধারালো চোট গায়ে লাগছে, কুয়াশা ঝাপসায় ডান দিকের বাঁধটি মাঝরাতের তেপান্তরের মাঠের মতন দেখাচ্ছিল।
হৈমন্তীর শীত করছিল, গগন কুঁকড়ে গিয়েছে। বিজলীবাবু কান মাথা ঢেকে নিয়েছেন চাদরে। খানিকটা পথ চড়াই উঠে ইনসপেকশান বাংলো।
গগন শীতের চোটে সিগারেট ধরাল। বলল, ভেতরে যতক্ষণ ছিলাম মনেই হয়নি বাইরে এ রকম ঠাণ্ডা।
বিজলীবাবু বললেন, একে উঁচু জায়গা, পাহাড়ি; তার ওপর ওই বেঁধে রাখা জলকুল কিনারা দেখছি না; শীতের দাপট রাত্রে বোঝাবে।
হৈমন্তীর মনে হচ্ছিল একটা স্কার্ফ কিংবা মাথায় গলায় জড়ান কিছু যেন না নিয়ে এসে সে ভুল করেছে। নিয়ে নিলেই হত। গাড়ি থেকে নেমেই তারা সটান চলে এসেছিল। জিনিসপত্র যা, বেহারা-খানসামাগুলো ঘরে নিয়ে চলে গেল। বাংলোয় তারা ঢোকেনি পর্যন্ত। …একটা জিনিস হৈমন্তী লক্ষ করল, অবনীর চাকরির মর্যাদা এখানে বেশ। তার পরিচয়–অন্তত সরকারি পরিচয় এরা জানে হয়তো, খাতির কিছু কম করল না। সাধারণের জন্যে যা নিষিদ্ধ, নানা বিষয়ে যে কড়াকড়ি তার কিছুই তাদের পোয়াতে হল না। দিব্যি সব ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে দেখে এল।
রাস্তাটা সুন্দর, পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে, তফাতে তফাতে বাতি, পাশে গাছপালা, নীচে তাকালে স্টাফ কোয়ার্টার্সের আলো চোখে পড়ে। ওপাশে দৈত্যের মতন ড্যাম।
অবনী বলল, আপনার বোধহয় কষ্ট হচ্ছে?
হৈমন্তী হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল, তেমন কিছু নয়; একটু ঠাণ্ডা লাগছে।
আর বেশি হাঁটতে হবে না, কাছেই…
আপনি এখানে মাঝে মাঝে আসেন?
না; বার দুয়েক কাজে আসতে হয়েছে।
আপনাকে চেনে…
ঠিক সেভাবে নয়। তবে এখানের যিনি কর্তা ছিলেন মিস্টার মজুমদার তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কাজের ব্যাপারেই হয়েছিল। চমৎকার মানুষ। তিনি এখন নেই। বদলি হয়ে গেছেন।
বিজলীবাবু ও গগন অন্যপাশে কথা বলছিল।
কথা বলতে বলতে পথটুকু পেরিয়ে এসে ওরা বাংলোয় উঠল।
.
দুটো ঘর, প্রায় মুখোমুখি। মাঝখানে ঢাকা বারান্দা। ঘরে আসবাবপত্রের বাহুল্য না থাকলেও মোটামুটি খাট, টেবিল, চেয়ার ছিল; দেওয়ালে গাঁথা র্যাক। ঘরের লাগোয়া বাথরুম। ঘরের জানলায় কাঁচ আর খড়খড়ি।
বেয়ারা-খানসামাগুলো জিনিসপত্র ঘরে তুলে রেখেছিল।
চায়ের পাট বসল পুবের ঘরটায়। জানলা বন্ধ, দরজা ভেজানো, বাতি জ্বলছে, ঘরের আবহাওয়ায় অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছিল হৈমন্তী।
গরম জল, রাত্রের খাওয়া-দাওয়া, ঘরে আগুন তুলে দেবার ব্যবস্থা ইত্যাদির তদারকি শেষ করে এসে অবনী বলল, আপনাদের বিছানাপত্র পেতে দিক; গরম জল দিচ্ছে বাথরুমে মুখহাত ধুয়ে বিশ্রাম করে নিন খানিক। আমরা ওঘরে আছি।
অবনী আর বিজলীবাবু তাদের ঘরে চলে গেল।
.
ঘরে এসে বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব, সবই তো ভাল হল, কিন্তু শেষরক্ষা হবে তো?
অবনী বুঝতে পারল না, সিগারেট ধরাতে ধরাতে তাকাল।
বিজলীবাবু হেসে বললেন, অমন হুইস্কিটার একটা গতি করা দরকার।
অবনী হেসে ফেলল।
বিজলীবাবু চাদর বালিশ বের করতে করতে বললেন, আমি ভেবেছিলাম উনি আসবেন না। …যখন শুনলাম আসছেন তখন থেকেই ঝিমিয়ে পড়েছি। মানে, আর কিছু নয়, আমাদের হল চোরের মন, সিদ দেবার আগে ধরা পড়ার ভয় থাকে।
অবনী হাসতে হাসতে জানলা-ঘেঁষা খাটের ওপর গিয়ে বসল, বসে পায়ের ওপর পা তুলে নিয়ে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বলল, আপনি তো গুণী লোক, বুঝেসুঝে ব্যবস্থা করুন।
বিজলীবাবু ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন, বললেন, তা তো করতেই হবে, কোলের ছেলে বয়ে এনেছি বাঁধের জলে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে তো পারব না।
অবনী জুতোজাড়া খুলে ফেলে গায়ের কোট খুলল। খোলা হোন্ডঅল থেকে র্যাগ, স্লিপার এটা ওটা বের করতে লাগল।
খানসামাটাকে সোড়ার কথা বলেছিলেন? বিজলীবাবু শুধোলেন।
আনিয়ে রাখবে।
তা হলে আমার বিবেচনায়, দুটো মুখে দিয়েও ঘরের দরজা বন্ধ হলেই শুরু করা যাবে।
অবনী মাথা হেলিয়ে সায় দিল।
বাথরুমে জল দিয়ে দিয়েছে বেয়ারা, অবনী চোখে মুখে জল দিতে গেল। বেয়ারা এসেছিল। ঘরদোর বিছানা গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল।
বিজলীবাবু তাঁর বিছানাটা হাতে করে ঝাড়লেন, অকারণে, তাঁদের আনা চাদর বালিশই বিছানায় পাতা হয়েছে। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে আপন মনে গুন গুন করে গাইছিলেন : সে দেখা দেয়, দেয় না, ধরা দিয়ে হায় ধরা দেয় না। বিজলীবাবুর চোখেমুখে কিছু অন্যমনস্কতা; কী ভেবে ভেবে যেন কোনও হাসিও ঠোঁটে লেগে ছিল। স্যুটকেস টেনে দু-একটা কী যেন বের করলেন, মাথার গরম টুপিটাও।
অবনী বাথরুম থেকে সামান্য পরে বেরিয়ে এল, ট্রাউজারস বদলে পায়জামা পরেছে, গায়ে পাঞ্জাবির ওপর পুরু পুলওভার। বিজলীবাবু তখনও চেয়ারে বসে গুন গুন করে গাইছেন :সে যে ধরা দিয়ে ধরা দেয় না, শুধু আশার ভাষায় ফিরে চায় না।
অবনী হেসে বলল, আপনার সেই গান?
সুরটা একবার আনবার চেষ্টা করছিলাম, বিজলীবাবু হেসে হেসে জবাব দিলেন, ঠিক আসে না। বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, এও ওইরকমধরা দিয়ে ধরা দেয় না। বলে তাঁর সকৌতুক চাপা চোখ নিয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন, পরে বললেন, জগতে এ বড় মজার খেলা, না মিত্তিরসাহেব, ধরা দিয়েও ধরা দেয় না।
অবনী বিজলীবাবুর চোখের দিকে দু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, সব খেলাই মজার। …যান, গরম জল ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, ঘুরে এসে বসুন।
বিজলীবাবু আর কিছু বললেন না, বাথরুমে চলে গেলেন।
অবনী অন্যমনস্কভাবে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকল।
হৈমন্তীর ঘরে বসে গল্পগুজব হচ্ছিল। ঘরে আগুন রেখে গেছে বেয়ারা, জানলা বন্ধ, দরজাও ভেজানো; বাইরে শীতের প্রচণ্ডতা এখন আর অনুভব করা যাচ্ছিল না। গগন খানিকটা গল্পগুজব করার পর বিজলীবাবুর গান শুনতে উঠে গেল। আসলে গগন বিজলীবাবুর সঙ্গে খানিকটা রঙ্গরসিকতা করতে চায়। তা ছাড়া, সে আপাদমস্তক আবৃত হয়েছে, উদ্দেশ্য : বিজলীবাবুকে টেনে নিয়ে পশ্চিমের ঢাকা বারান্দায় গিয়ে জ্যোৎস্নালোকে বাঁধের জল দেখবে।
.
অবনী আর হৈমন্তী মুখোমুখি বসে, হৈমন্তী বিছানায়, অবনী কাছাকাছি চেয়ারে।
অবনী বলল, আপনিও একবার বাইরে গিয়ে দেখলে পারতেন। এতটা উঁচু থেকে সামনের লেকটা দেখতে এখন ভালই লাগত। চাঁদের আলোয় অতটা জল, আশেপাশে পাহাড় জঙ্গল, অদ্ভুত দেখায়।
দেখব হৈমন্তী বলল, এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না, কুঁড়েমি ধরে গেছে ঠাণ্ডায়।
আপনারা দুই ভাইবোনেই ঠাণ্ডায় বেশ কাবু হয়ে পড়েন, অবনী হাসিমুখে বলল।
অভ্যেস নেই। গগনের তো একেবারেই নেই, আমি তবু খানিকটা সইয়ে নেবার সময় পেয়েছি। হৈমন্তীও হাসিমুখে জবাব দিল।
তবু সইছে না– অবনী ঠাট্টা করে বলল।
না। হৈমন্তী মাথা নেড়ে হেসে উঠল।
অবনী চোখ সরাল না, হৈমন্তীর হাসি দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি–
হৈমন্তী তাকিয়ে থাকল, মুখের হাসি তখনও মুছে যায়নি।
অবনী বলল, আমার আজকাল মনে হয়, এই জায়গাটা আপনার কোনও দিক থেকেই সইছে না।
হৈমন্তীর মুখের হাসি মুছে গেল; ভীরুর মতন, হঠাৎ বিচলিত হয়ে পড়ার মতন তার চোখের কোলে এবং পাতায় কেমন অসহায়তার ভাব ফুটল। দৃষ্টি নত করে নিল।
অবনী অপেক্ষা করল, কেন করল সে জানে না; হৈমন্তী কিছু বলবে এই আশায় হয়তো; বা এই দ্বিধায়, হৈমন্তী অসন্তুষ্ট হল কি হল না?
কিছু মনে করলেন?
হৈমন্তী মাথা নাড়ল, না মনে করেনি।
অবনী সামান্য নীরব থেকে বলল, আপনাকে আমি বন্ধুর মতন একটা কথা বলতে পারি। … প্রথম যখন এসেছিলেন কী রকম, মানে আপনাকে অন্যরকম দেখাত; আমার মনে হয়েছিল, আপনিও ডেডিকেটেড, সুরেশ্বরবাবুর মতন, ওই ধরনের কিছু…। আমি বোধহয় ঠিক বোঝাতে পারছি না, নয়– অবনী দ্বিধার হাসি হাসল। সে যাই হোক, আপনাকে এখন তা মনে হয় না। …আপনার এখানে ভাল লাগছে না, আনহ্যাপি। অন্ধ আশ্রমে আপনার কোনও টান নেই। আপনি ডেডিকেটেড নন।
হৈমন্তী নিস্পন্দ বসেছিল; অবনীর দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছিল। তার কোথাও ক্রোধ নেই, বিরক্তি নেই, অসন্তোষ নেই।
অবনী মুহূর্তে কয় অপেক্ষা করল। আমি ভেবে পাই না, ঘরবাড়ি মা ভাই ছেড়ে কেন আপনি এখানে এলেন? …নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আপনি খুব জীবন্ত। … সুরেশ্বরবাবুর কাজকর্ম আপনি বিশ্বাস করেন না, তাঁর সেবা-টেবা দয়া-ধর্ম এসবেও আপনার মতি নেই। …ক্রিশ্চান নান আমি দেখেছি, আপনি নান নন।
হৈমন্তী পায়ের ওপর থেকে শাল সামান্য তুলে নিল। তার ঈষৎ কুঁজো হয়ে নত মুখে বসে থাকা, তার নীরবতা, অসহায় আড়ষ্ট ভঙ্গি এখন কেমন ছেলেমানুষের মতন দেখাচ্ছিল। যেন এই হৈমন্তীর মধ্যে বয়সের দৃঢ়তা নেই; তার সেই গাম্ভীর্য, পেশার পৃথক মর্যাদা, ব্যক্তিগত সংযম ও গোপনতা আর নেই।
যেখানে আপনার মন নেই, যা ভাল লাগে না, যাতে বিশ্বাস নেই–সেখানে আপনি কেন এলেন আমি জানি না। অবনী যেন ধৈর্য হারাচ্ছিল।
হৈমন্তী হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। বেশিদিন আর থাকব না।
অবনীর মনে হল হৈমন্তীর গলার স্বরে শীতের বাতাসের মতন ঠাণ্ডা কনকনে একটা ভাব ফুটল।
আমার কথায় রাগ করলেন?
না।
আমার পক্ষে হয়তো এসব কথা বলা উচিত হল না। তবু বললাম। …আপনাকে আমার অদ্ভুত মনে হয়…কেন এসেছেন, কেন আছেন…
কিছু না। হয়তো শখ…
শখ নয়।
তা হলে কিছু ভেবে এসেছিলাম। …আপনি কি শুধু চাকরির জন্যে এখানে এসেছেন?
অবনীর চোখ মুখের ওপর প্রবল জোরে যেন কেউ ফুঁ দিল, চমকে ওঠার মতন হল অবনীর। হৈমন্তীকে দেখল, বলল, সত্যি কথা শুনবেন?
হৈমন্তী তাকিয়ে থাকল।
আমি পালিয়ে এসেছি।
হৈমন্তী কথা বলল না, কিন্তু তার চোখে গভীর কৌতূহল ও প্রশ্ন ছিল, যেন তার দৃষ্টি বলছিল : পালিয়ে এসেছেন? কিন্তু কেন?
অবনী হৈমন্তীর চোখের বিস্ময় ও প্রশ্ন লক্ষ করতে করতে বলল, আমার আর কিছু ভাল লাগত না, চাকরিবাকরি, বন্ধুবান্ধব, বাড়ি কিছু না। সব কেমন একঘেয়েমির মতন হয়ে উঠেছিল। খুব ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম। অবনীর মুখে ক্লান্তি ও বিরক্তির ভাব ফুটছিল, গলার স্বরে হতাশা। বোঝানো মুশকিল, ঠিক যে কী বোঝাতে চাইছি তাও জানি না– অবনী ম্লান একটু হাসল, আমার মনে হত, আমার মধ্যে আর কিছু নেই, শুকিয়ে গেছে, বা যা ছিল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জীবনের এই অবস্থাটা এত খারাপ…অসহ্য..
হৈমন্তী অপলকে তাকিয়ে থাকল। মনে মনে যেন বোঝবার চেষ্টা করছিল।
কিছু সময় দুপক্ষই নীরব। শেষ পর্যন্ত অবনী এই বিষণ্ণ স্তব্ধতা কাটাবার জন্যে নড়েচড়ে বসল, সিগারেট ধরাল, তারপর বলল, আমার আসার সঙ্গে আপনার আসার কোনও মিল নেই। আমি যেন অনেকটা পালিয়ে কোথাও মাথা লুকোতে এসেছিঃ আপনি তো তা নন–আমার ধারণা, আপনি কোনও আশা নিয়ে এসেছিলেন।
হৈমন্তী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল না, কিন্তু বুকপিঠের ওঠানামা লক্ষ করা গেল।
সামান্য পরে হৈমন্তী হঠাৎ বলল, চলুন, বাইরেটা দেখে আসি।
.
স্বপ্নের মধ্যে দেখা বুঝি; অস্পষ্ট কোমল কেমন এক আচ্ছন্নতার জগৎ যেন স্থির হয়ে আছে। হিম-জ্যোৎস্নায় জড়ানো চরাচর, ব্যাপ্ত শূন্যতার মধ্যে কোনও স্তব্ধ শান্ত বিশাল এক হ্রদ যেন পড়ে আছে, নীচে, দূরে রেখার মতন পার্বত্য অঞ্চল, স্যুইস গেটের পদতলে বিষণ্ণ এক নদী। হৈমন্তী শূন্য দৃষ্টিতে দেখছিল, তার চেতনার কোথাও বুঝি কিছু ছিল যার অদ্ভুত এক অনুভূতি তাকে নির্বাক, পরম দুঃখী, বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। বাঁধের জলের দিকে চোখ রেখে হৈমন্তী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল, শীত আবার তাকে শিহরিত করল।
অবনী বলল, ঘরে যাবেন?
হৈমন্তী নীরব। তার মাথায় ঘোমটার মতন শাল জড়ানো, শালের পাড়ের একটা পাতা কপালের কাছে শুকনো পাতার মতন কালচে দেখাচ্ছিল।
চলুন যাই– হৈমন্তী বলল, কেমন যেন লাগে দেখতে—
থাকবেন আর খানিকটা?
না। আমার বেশি ঠাণ্ডা লাগানো উচিত হবে না– হৈমন্তী ফেরার জন্যে পা বাড়াল। ফিরতে ফিরতে বলল, আজ এসে ভালই করেছি। না এলে কত কিছু দেখতে পেতাম না।
অবনীর মনে হল, হৈমন্তী কত কিছু কথাটা যেন কেমন করে বলল।
.
মাঝ এবং শেষরাতের কোনও সময়ে অবনীর ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, কে যেন তাকে ডাকছে। নেশায় সে কিছু শুনছে কি শুনছে না, অথবা ঘুমের ঘোরে শুনছে, বুঝল না। ঘর অন্ধকার। বিজলীবাবু অঘোরে ঘুমোচ্ছেন, তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
অবনী বালিশ থেকে সামান্য মাথা তুলে শোনবার চেষ্টা করল, কে তাকে ডাকছে।
.
২৫.
গভীর স্তব্ধতার মধ্যে অবনী কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করল; কোনও সাড়া শব্দ নেই, কেউ তাকে ডাকছে না। মনে হল, সে ঘুমের মধ্যে জেগে উঠেছে, জেগে ওঠার সময় মনে হয়েছিল কেউ ডাকছে; বা স্বপ্নের মধ্যে সে কাউকে ডাকতে শুনেছিল। অথচ কোনও স্বপ্ন অবনীর মনে পড়ল না। সহসা ডাক শুনে ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠায় সে সামান্য চঞ্চল ও বিস্মিত হয়েছিল; ভ্রম দূর হলে নিশ্বাস ফেলল।
বালিশে মাথা রেখে চোখের পাতা বুজে অবনী আবার ঘুমোবার চেষ্টা করল। অন্ধকারে কয়েকটা মাছির মতন তার চোখের পাতার তলায়, চেতনায় কী যেন উড়ছিল; তারপর মনে হল, মাছিগুলো উড়ে গেলে সরষের দানার মতন কী যেন বা এক মুঠো তিল তার চোখ, নাক এবং কপালের মাঝখানে ভুরুর কাছাকাছি কেউ ছুঁড়ে দিল। অবনী অস্বস্তি বোধ করল। কিছু না, তবু এই মাছি বা দানার মতন কোনও কিছুর অনুভূতি চোখের ওপর ভুরুর কাছে অনুভব করা অস্বস্তিকর। অবনী চোখ খুলল।
চোখ চেয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে শুয়ে থাকল। মনে করবার চেষ্টা করল, কোনও স্বপ্ন দেখেছিল কি না। কোনও স্বপ্নের কথা তার মনে পড়ল না; এইমাত্র মনে পড়ল যে–ঘুমের মধ্যে কোনও এক সময়ে সে সুরেশ্বরকে দেখেছিল। সুরেশ্বর নির্জন কোন পথ দিয়ে যেন হনহন করে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ মাটি থেকে ওপরে উঠে হাত পা এলিয়ে মাথা উঁচু পা নিচু করে বাতাসে ভেসে যাওয়া মস্ত একটা খোলা খবরের কাগজের মতন ভেসে যেতে লাগল। হাড়গোড়বিহীন রক্তমাংসশূন্য সেই অদ্ভুত মানুষটিকে দেখে অবনী প্রথমে ভীষণ অবাক হল, পরে মশাই মশাই বলে ডাকল। পরের আর কিছু অবনীর মনে পড়ল না! .. সুরেশ্বর তাকে উড়ন্ত অবস্থায় ডেকেছিল বা দেখেছিল বলেও অবনীর মনে হল না।
গায়ের র্যাগ গলার ওপর চিবুক পর্যন্ত তুলে নিল অবনী। ঘরের বাতাস শীতে যেন জমে শক্ত হয়ে আছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বিজলীবাবু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, তাঁর নাক বন্ধ হয়ে গেছে। হুইস্কির গন্ধ ঘরে আছে কি না অবনী বুঝতে পারল না।
কখনও চোখ বন্ধ করে, কখনও চোখ চেয়ে অবনী শুয়ে থাকল, অপেক্ষা করল, ঘুম এল না। শেষে একটা সিগারেট ধরাল। ধীরে ধীরে, গলা ভরতি করে কয়েক টান ধোঁয়া নিল, খেল, হাই তুলল একবার, তারপর পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। হাতের আঙুলে সিগারেট জ্বলছে।
ঠিক কেন যে ঘুম ভেঙে গেল অবনী বুঝতে পারল না, কিন্তু তার মনে হল, ঘুম আর আসবে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অথবা আলস্যের কোনও ভাব নেই, তার চোখ বুজে আসছে না, এমনকী সে ক্লান্তি অনুভবও করছে না। অথচ কী যেন তাকে স্থির হতে দিচ্ছিল না, অব্যবস্থচিত্তের মতন সে অস্বস্তি বোধ করছে।
এখন কত রাত হতে পারে অবনী অনুমান করার চেষ্টা করল। তিনের কম নয়, অবনী অন্যমনস্কভাবে হিসেব করল, তাদের শুতে শুতে বারোটা বেজে গিয়েছিল প্রায়, ঘণ্টা তিনেক সে নিশ্চয় ঘুমিয়েছে, হুইস্কির পর আরও ভাল ঘুম হওয়া উচিত ছিল। এখন সে প্রায় কিছুই অনুভব করছে না।
শুকনো গলায় আচমকা এক মুখ সিগারেটের ধোঁয়া টেনে ঢোঁক গিলতে গিয়ে কণ্ঠনালী জ্বালা করল; কাশি এল। অবনী কাশল। নিঃশব্দ অসাড় ঘরে নিজের কাশি কানে শুনে হঠাৎ মনে হল, সে অন্য কারও গলার শব্দ পাচ্ছে। মুহূর্ত কয়েকের জন্যে এরকম মনে হলেও অবনী বিশেষ কিছু ভাবল না, আবার চোখের পাতা বন্ধ করে শুয়ে থাকার চেষ্টা করল।
সুরেশ্বর একটা ছড়ানো মস্ত কাগজের মতন বাতাসে ভেসে যাচ্ছে–এই দৃশ্যটা আবার তার মনে এল! এবং তার পরই হৈমন্তীর কথা। হৈমন্তী নির্বোধ। অবনীর মনে হল, কলকাতা থেকে ছুটতে ছুটতে হৈমন্তী একটা উড়ন্ত কাগজ লুটতে এসেছিল, ঠিক যেভাবে কিছু বাচ্চাটাচ্চা কাটা ঘুড়ির পেছনে পেছনে ঘুড়ি লুটতে ছোটে, আর শেষ পর্যন্ত অনেকটা দৌড়োদৗড়ি করে হাঁপিয়ে ঘুড়ি ধরতে না পেরে ফিরে আসে। হৈমন্তীর জন্যে দুঃখ ও সহানুভূতি বোধ করল অবনী।
সিগারেটের টুকরোটা আঙুল থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, পোড়া সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে লাগতে অবনী উঠব কী উঠব না করে শেষ পর্যন্ত উঠল। অন্ধকারে লাইটার জ্বেলে আলোর সুইচ দেখল, আলো জ্বালল। পোড়া সিগারেটের টুকরোটা নিবিয়ে বাথরুমে গেল।
ফেরার পথে অবনী ঘড়ি দেখল, সাড়ে চার। তার অনুমান ভুল হয়েছিল তবে। প্রায় ভোর হয়ে আসছে। আর সামান্য পরেই সকাল। আপাতত কী করা যায় অবনী বুঝতে পারল না। তার ঘুম আসবে আর, চুপচাপ বিছানায় শুয়ে সময় কাটানো ছাড়া উপায় নেই। বাতিটা অকারণে ঘরের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখতেও তার ইচ্ছে হল না।
শুকনো কাশি কাশল বার কয়েক, পুলওভারটা টেনে নিয়ে গায়ে দিল, ঠাণ্ডা লাগছিল। বাতি নিবিয়ে আবার বিছানায় এল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে অবনী যেন অস্পষ্ট ভাবে অনুভব করল, যে অস্বস্তিবশে সে জেগে উঠেছে সেই অস্বস্তি তার বুকের কোথাও এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল, এখন আবার দেখা দিতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা লাগার বেদনার মতন একটি বেদনা অবনী অনুভব করছে। এই বেদনা সম্পূর্ণ শারীরিক হতে পারে, হয়তো রাত্রের দিকে ঠাণ্ডা লেগেছে। বা এই বেদনা শারীরিক নাও হতে পারে, কিছু বোঝা যায় না।
বুকে হাত রেখে অবনী বেদনা অনুভব করল। কখন ঠাণ্ডা লেগেছে, কী ভাবে লেগেছে সে অনুমান করার চেষ্টা করল, পারল না। অগত্যা নিজের বেদনার ওপর সেঁক দেবার মতন গরম হাতটি রাখল, আস্তে আস্তে হাত ঘষল। হাত ঘষার সময় তার বুকের পাঁজরার একটি ভাঙা হাড়ের ওপর বুড়ো আঙুল রেখে স্থির হয়ে থাকল।
তার বুকের পাঁজরার একটি হাড় ভাঙা, কবে ভেঙেছিল মনে নেই, নিশ্চয় খুব ছেলেবেলায়, যখন তার তেমন কোনও জ্ঞান জন্মায়নি, পরে ভাঙলে তার মনে থাকত। হাড়ের জোড়টায় কিছু খুঁত তখন থেকেই থেকে গেছে, জোড়ের জায়গাটা সামান্য উঁচু, আঙুল দিলে বোঝা যায়। অসতর্কভাবে হাত পড়ে গেলে কিংবা জোরে কিছু লাগলে ব্যথা লাগে। না, ঠিক, ব্যথা নয়, বেদনার মতন। হয়তো বাস্তবিকই ওখানে কোনও ব্যথা নেই, তবু কোনও কারণে ছেলেবেলা থেকেই মানসিক একটা বেদনার ভাব ওখানে জমে উঠেছে। একবার, অবনীর মনে পড়ল, ললিতা বিছানার মধ্যে খেলাচ্ছলে তার বুকের ওপর মাথা রেখে গড়াগড়ি করছিল, হঠাৎ সে মাথা তুলে আবার যখন মাথা রাখতে গেল অবনী তীব্র বেদনা বোধ করেছিল। ললিতাকে বলেছিল, এই জায়গাটা বাঁচিয়ে ললিতা আঙুল বুলিয়ে জায়গাটা দেখেছিল; সে পরে অনেকবার ওখানে আচমকা ধাক্কা মেরেছে, হাতের বালা দিয়ে আঘাত করেছে, এমনকী প্রাণপণে হাতের মুঠো ছুঁড়েছে যাতে অবনী ভীষণ কোনও ব্যথা পায়। আশ্চর্য, অবনী যা লুকিয়ে-চুরিয়ে বাঁচাতে চাইত, যে-আঘাত সে ভয় করত, ললিতা তা বাঁচাতে দিত না। ললিতার কাছে অবনীর এই দুর্বলতা কেন যে সুখকর আনন্দ ছিল অবনী বুঝতে পারত না। তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য অবনীর ভয় বা ক্লেশ ছিল না, ললিতা হিংস্রভাবে সেই সব অঙ্গপ্রতঙ্গ দংশন করলেও অবনী অনায়াসে সহ্য করতে পারত।
ললিতার কথায় এবং বুকের বেদনার বিচ্ছিন্ন চিন্তার মধ্যে অবনীর হঠাৎ মনে হল, সে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে; জলের মধ্যে ডুবে সাঁতার কেটে খেলা দেখাবার সময় শরীর যেমন নির্ভার হয় এবং হাত পা গা শিথিল হয়ে ভাসে। অল্পক্ষণ এই রকম মনে হলেও অবনী আবার স্বাভাবিক অনুভবের মধ্যে ফিরে এল। নিজের এই রকম শিথিল নির্ভার অনুভূতি তাকে সুরেশ্বরের কথা মনে করাল। সুরেশ্বরের মতন সেও কী উড়ন্ত কাগজের মতন ভাসবে? অবনী হাসল, মৃদু হাসি।
অথচ, আরও কয়েক দণ্ড পরে, অবনী পুনরায় অনুভব করল তার জাগ্রত ও শায়িত অবস্থার মধ্যেও সে ভেঙে যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। নিজের ভিন্ন দুই অস্তিত্ব অনুভব করার সময় আয়নার সামনে মুখোমুখি দাঁড়ানোর কথা ভাবা চলে। অবনী তেমন কিছু ভাবল না, বরং তার মনে হল, কী যেন তার শরীরের তলা থেকে উঠে এসে তাকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। ছেলেবেলায় অবনী তার মার একটা ছবি দেখত : মা অবশ বিহ্বলা যুবতী হয়ে পালঙ্কে শুয়ে আছে, আর মার মাথা, পা ও পিঠের দিক থেকে কটি বৃহৎ ধূপদানের ধোঁয়া মাকে যেন জড়িয়ে ধরছে। ছবিটা মার থিয়েটারের, রংচঙে, ফ্রেমে বাঁধানো ছিল। ওই ছবি সম্পর্কে মার দুর্বলতা ছিল, কেননা ওইনাটকে মা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং সোনার মেডেল পেয়েছিল। অবনীর বারবারই মনে হত, ছবিটা শ্মশানঘাটে চাপানো চিতার মতন। সতীদাহের কোনও জমকালো দৃশ্য।
অবনী এসময় আবার একটা সিগারেট ধরাল। হয়তো কিছুই নয়, তবু লাইটারের আলো, ঠোঁটের সিগারেট এবং ধোঁয়ার ঘ্রাণ থেকে এই মুহূর্তে নিজের জীবন্ত অস্তিত্বটা পরখ করে নেওয়া হল। চুপচাপ, আস্তে আস্তে সিগারেট খেতে লাগল অবনী। আপাতত তার আর কিছু মনে হচ্ছিল না।
কিছুক্ষণ মানসিক স্থিরতার মধ্যে কাটল। এলোমেলো বিশৃঙ্খল চিন্তা বুদ্বুদের মতন উঠছিল, কিন্তু অবনী তাতে মনোযোগ দিচ্ছিল না। ক্রমশ সিগারেট শেষ হল। সিগারেটটা ফেলে দেবার আগে আর-এক মুখ ধোঁয়া নেবার সময় সহসা সে অনুভব করল, কী যেন এবং কিছু যেন তার মধ্যে থেকে বাইরে আসার জন্যে ছটফট করছে, চাপা এবং অনির্দিষ্ট এক ব্যাকুলতা এতক্ষণে তীব্র হয়ে আসছে। ফলে গলা এবং বুকের কাছে শ্বাস থেমে গিয়ে কেমন কষ্ট হচ্ছে। অবনী সিগারেটের ধোঁয়া গিলে নিল। তার বুকের পুরনো ভাঙা হাড়ের জায়গাটা কনকন করে উঠল।
বিছানার ওপর উঠে বসে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে নিবিয়ে ফেলল অবনী। বসে থাকল কয়েক দণ্ড। অন্ধকারে তার মনে হল, খুব কাছাকাছি প্রায় মুখের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এমনকী এখন তার মনে হল, হাত বাড়ালে সামনের মানুষটিকে সে স্পর্শ করতে পারে। কী কারণে অকস্মাৎ তার বুকে উত্তেজনার তাপ সঞ্চারিত হল, মুহূর্তের জন্যে ভীত এবং সঙ্গে সঙ্গে আবেগবশে অস্থির হয়ে ওঠায় হৃদপিণ্ড দ্রুত হয়ে উঠল। সেই অন্ধকারে অবনী হৈমন্তীর উপস্থিতি অনুভব করল।
অবনীর কেমন সন্দেহ হল। সন্দেহ হল, সে হৈমন্তীর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছিল। সুরেশ্বরের সেই অদ্ভুত উড়ন্ত অবস্থাটি দেখার পর, হয় সেই বিক্ষিপ্ত স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে, অথবা আলাদা ভাবে হৈমন্তীকে দেখেছিল। যেমন করে চোখ বন্ধ করে ভুরুতে আঙুল রেখে অবনী কোনও প্রয়োজনীয় চিন্তা করে সেইভাবে চোখ বুজে হাতের আঙুলে ভুরু টিপে সে স্বপ্নের দৃশ্যটি মনে করবার চেষ্টা করল।
আশ্চর্য, কিছুই মনে আসছে না। কিছুই নয়। যেন অবনী অন্ধ, অন্ধতাহেতু সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে।
অবনী এতক্ষণে তার ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার কারণটা যেন ধরতে পারল। এরকম হয়, চোখের সামনে অনেক জিনিসের মধ্যে ছিল বলে বোঝা যায়নি যে কিছু হারিয়ে গেছে;হঠাৎ চোখে পড়ল, বা খেয়াল হল, ওটা হারিয়ে গেছে। হৈমন্তীকে অবনী স্বপ্নে দেখেছিল কি না অথবা স্বপ্নে হৈমন্তী তাকে ডেকেছিল কি না–অবনী মনে করতে পারল না; কিন্তু নিঃসন্দেহে অনুভব করল তার সমস্ত অস্থিরতার মধ্যে হৈমন্তী রয়েছে। এই যে ঘুম ভেঙে গেছে, এই যে সে এক টুকরো স্বপ্নে সুরেশ্বরকে গা-হাত-পা এলিয়ে বাতাসে ভাসতে দেখেছে, ললিতার কথা এবং তার বুকের ভাঙা হাড়ের বেদনার কথাও তার মনে আসছে–এ-সবই হৈমন্তীর জন্যে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার নানারকম অদ্ভুত চিন্তা, এক একবার এক এক রকম মনে হওয়া, ঘুম না আসা, অস্থিরতা বোধ সমস্ত কিছুর পিছনেই হৈমন্তী।
হারানো জিনিসটা খুঁজে পেলে যেরকম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা যায়, অবনী অনেকটা সেই রকম নিশ্বাস ফেলল স্বস্তির। তার উত্তেজনা, অস্থিরতা কমে এল। প্রায় শান্ত স্থির হয়ে বসে থাকল কিছু সময়।
বসে থাকতে থাকতে অবনী মনে মনে হৈমন্তীকে সামনে বসিয়ে রেখে একটা কাল্পনিক কথোপকথন তৈরি করছিল :
আপনি তা হলে ফিরে যাবেন? অবনী বলছিল।
যার।
সুরেশ্বর বোধহয় খুব আশা ভরসা করে এনেছিল।
অন্য কাউকে আনবে।
ডাক্তার…
হ্যাঁ…
আপনাকে ঠিক সেভাবে বোধহয় সুরেশ্বর আনেনি।
কী জানি। নিজের স্বার্থে এনেছিল।
আমার প্রথম প্রথম নানারকম কৌতূহল ছিল; পরে দেখলাম–আপনি ওকে ভালবেসেই এসেছিলেন। …আপনাদের অনেক দিনের পরিচয়…
অনেক দিনের।
ভালবাসা?
হৈমন্তী জবাব দিল না।
অবনী বোধহয় বুঝতে পারল। বলল, সুরেশ্বরকে আমি আকাশে উড়তে দেখলাম। স্বপ্নে। আপনি সার্কাসে ট্রাপিজ খেলা দেখেছেন? ট্রাপিজ খেলোয়াড়রা যেভাবে হাত তুলে পা সোজা করে ঝাঁপ দেয়, অনেকটা সেইরকম ভঙ্গিতে সুরেশ-মহারাজ আকাশ দিয়ে উড়ছে। …বেশ মজার স্বপ্ন।
হৈমন্তী জবাব দিল না; কিন্তু মনে হল সে বর্ণনাটা উপভোগ করল।
অবনী হাসল; হাসতে হাসতে হঠাৎ সে কেমন আক্রোশ অনুভব করল সুরেশ্বরের ওপর। বলল, একটা উড়ন্ত মানুষকে ধরবার জন্যে ছোটাছুটি করাটা ছেলেমানুষি, নিছক খেলা। …আমার ধারণা, এ রকম খেলা কোনও কাজের নয়।
আমি আর খেলছি না।
ফিরে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ।
অবনী একটু ভাবল। আর থাকতে পারেন না?
না; কী হবে থেকে।
সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রমে থাকার কথা বলছি না। …অন্য কোথাও।
হৈমন্তী চোখ তুলে তাকাল। তাকিয়ে থাকল। তার দুই চোখ বড় হল, টলটল করে উঠল, ঘনান্ধকার চোখের মধ্যে অতি দূরে বিজলী ঝলকের মতন চোখের তারায় চকিতের জন্যে আলো ফুটল।
অবনী বলল, আপনাকে আমার ভাল লাগে।
জানি, হৈমন্তী অস্ফুটস্বরে জবাব দিল।
অবনী চঞ্চল হল, অস্থিরতা বোধ করল। তা হলে যাবেন না।
হৈমন্তী যেন ভাবল সামান্য, কী যেন বলল, এত ধীরে এবং জড়ানো গলায় যে অবনী শুনতে পেল না। তার মনে হল, হৈমন্তী বলল : আপনার কি মনে হয়, আমি থাকতে পারি?
অবনী সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলতে যাচ্ছিল, হ্যাঁ–পারেন; কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না, কী যেন বাধা এল, কথাটা জিবের ওপর থেমে থাকল।
হৈমন্তী তার দিকে অপলকে চেয়ে আছে। অবনী বিব্রত বোধ করছিল। যে বাধা তার মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শক্ত হয়ে পড়ে আছে সেই বাধা সরাবার জন্যে সে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করল : যেন ঝটকা মেরে এই কুৎসিত হাতটা সরিয়ে দিতে চাইল। পারল না। না পেরে অসম্ভব ক্রোধে এবং ঘৃণায় ললিতা ও কুমকুমের দিকে তাকাল। ওরা দুজন যেন কখন নিঃশব্দে, অবনীর অজ্ঞাতে কাছে এসে গেছে।
অবনী চুপ; হৈমন্তী অপেক্ষা করছে। এতটা বিলম্ব যেন তার প্রত্যাশিত নয়।
আমি জোচ্চোর, প্রবঞ্চক বা শঠ হতে পারি না, অবনী অস্থিরভাবে মাথা নাড়ল, ঠকানো মুশকিল। শেষ পর্যন্ত অবনী বলল, আমার স্ত্রী ছিল, মেয়ে আছে। স্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ডিভোর্স চেয়ে নেব।
মেয়ে!
কুমকুম। …কুমকুমকে.অবনী ব্যাকুল চোখে হৈমন্তীর দিকে তাকাল। যেন বলতে চাইল, কুমকুম। বাচ্চা, সে কলকাতায় তার মার কাছে আছে, অযত্নে, নানা অভাব-অসুবিধের মধ্যে, তার মা তাকে নষ্ট করে ফেলছে, কুমকুম দেখতে বড় সুন্দর : ছিপছিপে, ফরসা, তার গলার স্বর খুব মিষ্টি; কাছে রাখলে যত্ন করলে, ভাল শিক্ষা দিলে… পাগলের মতন এবং ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে অবনী এইসব ভাবতে ভাবতে বা বলার জন্যে ব্যাকুল হয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু বলতে পারল না।
হৈমন্তী বলল, মেয়েকে আপনি ছাড়তে পারেন না।
অবনীর কেমন অদ্ভুত এক দুঃখ হল। যাকে সে ধরে রাখেনি, তাকে ছাড়ার কথা ওঠে না। তবু, মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা অন্যরকম। অস্বীকার কি? অবনীর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।
হৈমন্তী বলল, আপনি বলছিলেন, আপনার মধ্যে কিছু নেই, শুকিয়ে গেছে–পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে…
তাই মনে হত।
এখনও মনে হয়? হৈমন্তী যেন স্নিগ্ধ সুন্দর করে হেসে বলল।
অবনী চুপ করে থাকল। মুখ নিচু করে কিছু ভাবছিল। তারপর যখন চোখ তুলল–হৈমন্তীকে আর দেখতে পেল না।
শুন্য দৃষ্টিতে অবনী কিছু সময় বসে থাকল। কল্পনায় হৈমন্তী এসেছিল। চলে গেছে। অথচ অবনীর মনে হচ্ছিল, এই আসা-যাওয়ার মধ্যে হৈমন্তী হঠাৎ যেন তার বুকের পুরনো বেদনার জায়গায় পরম সহানুভূতিতে হাত বুলিয়ে গেছে।
কুয়ার মধ্যে মুখ ঝুঁকিয়ে দেখার মতন অবনী তার হৃদয়কে দেখার চেষ্টা করছিল। একসময় তার মনে হয়েছিল প্রখর তাপে, অসহ দাহে যেমন করে কুয়ার জল শুকিয়ে যায় এবং অভ্যন্তরে, গভীরে জলস্তরও শুকিয়ে আসে–সেই রকম তার সমস্ত হৃদয় আদ্রতাহীন ও শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। কোথাও কোনও রকম আর্দ্রতা ছিল না। অথচ এখন মনে হচ্ছে, কেমন করে যেন তার শুষ্ক ক্লান্ত হৃদয়ে কিছু আর্দ্রতা সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো এই আর্দ্রতার সম্ভাবনা কিছু ছিল, অবনী খেয়াল করেনি। সম্ভবত এখন সেই আর্দ্রতা জলবিন্দুর মতন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ক্রমে ক্রমে কিছুটা সঞ্চিত হয়েছে। হয়তো তার পক্ষে এখন এই সজীবতা অনুভব করা সম্ভব হচ্ছে।
কোনও আশ্চর্য সান্ত্বনার মতন, সুখের মতন অবনী প্রসন্ন বোধ করছিল।
দরজা খুলে বাইরে এল অবনী। সবেমাত্র বুঝি প্রত্যুষ হয়েছে। চারদিকে কুয়াশা, কুয়াশা এবং হিমের স্তরে স্তরে ভোরের সাদাটে আলো জমছে, কনকন করছে ঠাণ্ডা, এখনও বড় বেশি কিছু চোখে পড়ছে না, কুয়াশা এবং অস্পষ্টতায় ঢেকে আছে।
শীতে আড়ষ্ট হয়ে কাঁপতে কাঁপতে অবনী কয়েক পা এগিয়ে গগনদের ঘরের দিকে এল। দরজা জানালা বন্ধ। গগনরা এখনও ঘুমোচ্ছে। অবশ্য ঘণ্টাখানেক সময় আছে। তারপর ফিরতে হবে। রোদ ওঠার সময় সময় অবনী বেরুতে চায়।
ঘরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় অবনীর চোখে পড়ল দরজার তলা দিয়ে আলো আসছে। গগনরা কি উঠে পড়েছে? নাকি আলো জ্বেলে রেখেই শুয়েছিল? বা এমনও হতে পারে, এই মুহূর্তে কেউ জেগে উঠেছে। অবনী অপেক্ষা করল। চারপাশ এত হিম হয়ে আছে যে অবনী কেঁপে উঠল আবার। গগনদের ঘরের বাতি নিবছে না। তবে কি ওরা জেগে উঠেছে? কে জানে, হয়তো এভাবে নতুন জায়গায় ওদের ঘুম হয়নি, গগনের বা হৈমন্তীর।
ঘরের মধ্যে থেকে কোনও সাড়া শব্দ আসছিল না। অবনীর মনে হল না, দুজনেই জেগে আছে।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অবনী, ইতস্তত করে আঙুলের টোকা দিল দরজায়। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। শীতের দাপটে আঙুল এত ঠাণ্ডা হয়েছিল যে, জোরে টোকা দেওয়া যাচ্ছিল না। এবার অবনী মুঠো করে দরজায় শব্দ করল।
কে? ভেতর থেকে হৈমন্তীর গলা শোনা গেল।
আমি।
হৈমন্তী দরজার ছিটকিনি নামাল, শব্দ পেল অবনী।
দরজা খুলে দিল হৈমন্তী। গরম চাদরে তার মাথা গলা বুক জড়ানো।
বাতি জ্বলছে দেখে ডাকলাম, অবনী বলল, সকাল হয়ে গেছে। বলে হৈমন্তীর ভোরবেলার বাসি মুখের দিকে তাকাল। সকালের এই মুখে রাত্রের, বালিশের, চুলের, ঘুমের, হয়তো বা জাগরণের কেমন এক অদ্ভুত স্বাদ মাখানো আছে।
হ্যাঁ, আমি জেগে ছিলাম। ঘড়ি দেখেছি।
ঘুমোননি? ঘুম হয়নি? অবনী বলল। বলার সময় নজরে পড়ল তার কথার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
ওই এক রকম। …খুব ঠাণ্ডা, ভেতরে আসুন।
চৌকাঠের কাছ থেকে অবনী ভেতরে পা দিল। গগনবাবু খুব ঘুমোচ্ছন। … আপনার কি নতুন জায়গায় ঘুম হয় না?
খানিকটা। অস্বস্তি হচ্ছিল। ঠাণ্ডাও খুব।
সারারাত জেগে?
না, মাঝে মাঝে ঘুমিয়েছি।
তবে তো কষ্টই হল।
না, কষ্ট কীসের?
আমারও ভাল ঘুম হয়নি; অনেকক্ষণ থেকে জেগে আছি। অবনী হৈমন্তীর চোখের দিকে তাকাল। মনে হল যেন সে বোঝবার চেষ্টা করছে হৈমন্তীর ভাল ঘুম না হবার বা জেগে থাকার অন্য কোনও কারণ আছে কিনা।
বিছানার খানিকটা পরিষ্কার করে হৈমন্তী যেন বসার মতন ব্যবস্থা করল। বলল, আমরা বেরুব?
ছটা সাড়ে ছটার মধ্যে।
হৈমন্তী হাতে ঘড়ি পরে নিয়েছিল, সময় দেখল। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।
চুপচাপ। গগন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শব্দ করল।
বাইরে এখন খুব ঠাণ্ডা, না হয় এখানের সকালটা দেখতাম– হৈমন্তী বলল, বসবেন না?
এখন বসে আর লাভ নেই, যাবার আয়োজন করতে হবে।
বিজলীবাবু উঠেছেন?
না। …ওঁকে ওঠাতে সময় লাগবে বোধহয়– অবনী হাসল।
হৈমন্তী হাসল। গগনও ভীষণ কুঁড়ে, শীতকালে ওকে বিছানা থেকে ওঠানো যায় না।
অবনী ফাঁকা চেয়ার এবং হৈমন্তীর বিছানার দিকে তাকাল। তারা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে, ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে, বাইরে সকাল হচ্ছে বোঝা যায় না, এখানে রাত্রের মতন সব। অবনী বলল, কাল একটা মজার স্বপ্ন দেখলাম, বলে হাসল, সুরেশ্বরবাবু…
কথাটা শোনার আগেই হৈমন্তী বাধা দিয়ে বলল, আপনার গলার কাছে ওটা কী হয়েছে?
গলার কাছে হাত দিল অবনী।
ওখানে নয়, আরও ওপাশে ঘাড়ের দিকে।
কী জানি। … অবনী অন্য জায়গায় হাত রাখল।
হৈমন্তী সামনে এগিয়ে ঝুঁকে বলল, আলোর দিকে ফিরুন।
অবনী আলোর দিকে মুখ করল।
হৈমন্তী দেখল, তারপর আস্তে করে আঙুল তুলে দাগের পাশে গলার চামড়ার কাছে রাখল। অবনী ঠাণ্ডা অথচ কোমল আঙুলের স্পর্শ অনুভব করল।
কিছু কামড়েছে?
মনে করতে পারছি না।
ব্যথা আছে?
অবনী আঙুল তুলে ব্যথা অনুভব করতে গেল, হৈমন্তীর আঙুলের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে আঙুলটা থামল। না; তবে জ্বালা করে উঠল যেন।
হৈমন্তী হাত নামাল। দুপলক তাকিয়ে তাকিয়ে অবনীর চোখ মুখ দেখল। কিছু না হয়তো।
পোকা টোকা কামড়াতে পারে…
বোধহয়। ..লালচে দেখাচ্ছে। আমার কাছে ক্রিম আছে, লাগিয়ে নেবেন একটু।
অবনী হাসল। নেব।
হৈমন্তী সামনে থেকে সরে গিয়ে দরজার দিকে তাকাল, তাকিয়ে থাকল কয়েক দণ্ড, তারপর বলল, বেশ ফরসা হয়ে গেছে।
অবনী ঘুরে দাঁড়াল। বাইরের ফরসা দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত এসে গেছে।
গুরুডিয়ায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে নটা বাজল। লাট্ঠার মোড়ে এসে গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার সময় অবনী জিজ্ঞেস করেছিল, কটা বাজল?
ঘড়ি দেখে সময় বললেন বিজলীবাবু, নটা পনেরো।
অফুরন্ত পৌষের রোদ, শিশির-শুকোনো মেঠো গন্ধ, শাল আর পলাশের চারা ঝাঁপটানো উত্তরের বাতাস, কয়েক মুঠো ফড়িং যেন সারাটা পথ পাশে পাশে ছুটে এল। দুহাত বিস্তার করে সেই মাঠ, ঘাট, শিশিরের সজীবতা নিয়ে গাড়িটা অন্ধ আশ্রমের মধ্যে এসে দাঁড়াল।
বিজলীবাবু নামলেন, অবনী নেমে দাঁড়াল। গগনও নেমেছে।
নামতে নামতে হৈমন্তীর চোখে পড়ল সামান্য দূরে একটা ভোলা গরুর গাড়ি ঘিরে ভিড়ের মতন হয়েছে। বিজলীবাবু, অবনী সেদিকে তাকিয়ে ছিল। গগন গাড়ির ভেতর থেকে তাদের হোন্ডঅল আর সুটকেস বের করে নিচ্ছিল।
গাড়ির শব্দে ভিড়ের অনেকেই এদিকে তাকাল। মালিনীকেও দেখা গেল। মালিনী হৈমন্তীকে দেখতে পেয়ে দ্রুত পায়ে আসছিল।
কাছে এসে মালিনী রুদ্ধশ্বাসে বলল, মনোহর ছুটি নিয়ে মেলায় গিয়েছিল না হেমদি, পরশু ফেরার কথা, ফেরেনি। কালও নয়। আজ এতক্ষণে ওকে কারা নিয়ে এসেছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। গা নাকি আগুনের মতন গরম।
কী হয়েছে?
জানি না। ওরা বলাবলি করছে, এই রোগে মেলায় খুব লোক মরছে, এখানে সব জায়গায়… মালিনী বিহ্বল, ভীত, বিচলিত, দাদা একটা ঘর খালি করাতে গেছে, ওকে রাখার জন্যে।
হৈমন্তী অবনীর দিকে তাকাল। অবনী এবং বিজলীবাবু চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। অবনী বলল, সেই এপিডেমিক না কি?
৬. পৌষ ফুরিয়ে মাঘ
২৬.
পৌষ ফুরিয়ে মাঘ এসে পড়েছিল। মধ্যে কদিন মেঘলা মেঘলা, অল্পস্বল্প বৃষ্টিও গিয়েছে, শীত চাপা পড়েছিল সামান্য; তারপর আবার আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ উঠলে মাঘের প্রখর শীত সব কিছু যেন কামড়ে ধরল। পৌষের শীতে কোথাও কিছু চঞ্চলতা ছিল, মাঘে সবই অচঞ্চল, পরিণত। উত্তরের বাতাসে আর তেমন এলোমেলো দমকা নেই, একটানা একই মুখে বইছে; গাছের পাতা ঝরতে শুরু হয়েছিল; রোদের তাতেও শীতের গুঁড়ো যেন জড়ানো; সকালে ঘাস ডোবানো শিশির, রাতে হিম আর কুয়াশা। সব যেন অবশ করে দিচ্ছিল।
গগন ফিরে গেছে; তার যাবার পর সপ্তাহ দুই কেটে গেল। যাবার সময় গগন কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে গেছে। সে থাকতে থাকতেই মনোহর মারা গেল। মনোহরের কী হয়েছিল বোঝা যায়নি, ধরা যায়নি। সকলেই বলছিল মেলা থেকে আনা রোগ। আরও কয়েকটা মৃত্যুসংবাদের কথা কানে আসছিল। কেউ বলছিল চাপা বসন্ত, কেউ বলছিল প্লেগ। এর কোনওটাই ঠিক নয়। অসুখটা অদ্ভুত। যাবার আগে গগন হৈমন্তীকে বলেছিল, তোদের এখানে এ কী অসুখ-বিসুখ শুরু হল! সাবধানে থাকবি। আমরা খুব দুর্ভাবনায় থাকব। তেমন কিছু বুঝলে কলকাতায় চলে আসবি। এমনিতেও তো তোর আর এখানে থাকার কোনও মানে হয় না।
কলকাতায় ফেরার দিন গগন অবনীর সঙ্গে দেখা করতে অবনীর বাড়ি গিয়েছিল, সঙ্গে হৈমন্তী। অবনী তখন প্রায় শয্যাশায়ী; তার সেই গলা-ঘাড়ের কাছাকাছি লাল ছোট ছোট ফুস্কুড়িগুলো শেষ পর্যন্ত হার্পিস-এ দাঁড়িয়ে ছিল, পিঠ বেয়ে নেমে এসেছিল অনেকটা। হৈমন্তী অনেকটা এই রকম সন্দেহ করেছিল প্রথমে। যে কদিন গগন ছিল, স্টেশনে যেত আসত, অবনীর অসুখের খবরটা সেই নিয়ে আসে। হৈমন্তীও গেল একদিন, ওষুধপত্র লিখে দিয়ে এল। বাকিটা করছিল স্টেশনের কালা ডাক্তার।
গগন যাবার আগে অবনীকে বলে গিয়েছিল : দিদিকে একটু দেখবেন, যে রকম শুনছি তাতে তো ভয় করছে। অবস্থা খারাপ বুঝলে ওকে আর আশ্রমে থাকতে দেবেন না, সোজা কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। ও বড় জেদি। আর হঠাৎ তেমন কিছু দেখলে অন্তত এখানে নিয়ে আসবেন। হৈমন্তী গগনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল; সবই শুনল, কিছু বলল না।
গগন যাবার পর পরই অন্ধ আশ্রমের বুড়ো তিলুয়া অসুখে পড়ল। অনেকটা একই ধরনের অসুখ বলে মনে হচ্ছিল। মনোহর জোয়ান গোছের বলে এই অদ্ভুত ব্যাধির সঙ্গে কদিন লড়েছিল, তিলুয়া পারল না, তার বয়েস হয়েছিল, প্রথম ধাক্কাতেই শরীরের কলকবজা বিগড়ে জটিলতা সৃষ্টি হল, মারা গেল নিউমোনিয়া হয়ে।
আপাতত আর-একজন বিছানায় পড়ে আছে–সে যাবে না থাকবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এসব চিকিৎসা হৈমন্তীর করার কথা নয়, সে চোখের ডাক্তার, তবু বাধ্য হয়ে তাকে এই অদ্ভুত রোগের চিকিৎসাও করতে হচ্ছে; যথাসাধ্য করছে বটে কিন্তু বুঝতে পারছে না, ভাল করছে না মন্দ করছে। চোখের ছোট্ট একটা হাসপাতাল, সাধারণ চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রায় নেই, ওষুধপত্রও না। তবু চিকিৎসা।
সুরেশ্বর একদিন বলল, হেম, অসুখটা কি সত্যিই ছোঁয়াচে বলে মনে হচ্ছে তোমার?
ঘাড় নাড়ল হৈমন্তী, তাই তো মনে হয়। বুড়ো তিলুয়া যেভাবে মনোহরের রোগশয্যায় আসা-যাওয়া করত তাতেও এরকম সন্দেহ হয়।
অসুখটা কী?
কী জানি! বুঝতে পারছি না।
তবু… তোমার কী মনে হয়?
আন্দাজে রোগ বলা যায় না। আমি চোখের ডাক্তার, এসবের তেমন কিছু বুঝি না।
অতদিন লেখাপড়া করলে—সুরেশ্বর যেন হতাশ হল। সে কিছু জানতে চাইছিল। তার এই ব্যগ্রতা স্বাভাবিক। তার মনে হত, হৈমন্তী অন্তত একটা কিছু অনুমান করতে পারবে। এ-রকম কেন মনে হত সে জানে না। হয়তো এই জন্যে যে, অন্য কোথাও থেকে কিছু জানার উপায় ছিল না; বা সুরেশ্বর ভাবত, হেম কলকাতার ডাক্তারি কলেজে অতদিন ধরে পড়েছে, তার পক্ষে এই অসুখ জানা সম্ভব। হয়তো এ-সবও কিছু না; অন্ধ আশ্রমের মধ্যে রোগটা ঢুকে পড়ায় সে উদ্বেগ বোধ করছিল; যদি এমনই হয়–লোকে যা বলাবলি করছে–এটা একটা নতুন উপদ্রব, এ তল্লাটে দেখা দিয়েছে, তবে কী করে কেমন করে আশ্রমের মানুষগুলোকে নিরাপদে রাখা যায় সুরেশ্বরের সেই দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া এখানে এমন কিছু নেই যাতে অন্য কোনও ব্যাধির চিকিৎসা হতে পারে। সাধারণ জ্বর-জালা, এমনকী এ-সময়ে এখানে যেটা হয়–জল বসন্ত–এসবে কোনও ভয়-ভাবনা ছিল না। কিন্তু এখন যা শোনা যাচ্ছে তাতে উদ্বেগ বোধ না করে উপায় নেই।
হৈমন্তীর ওপর সুরেশ্বরকে ভরসা করতে হচ্ছিল। রোগটা কী? রোগটা কি ছোঁয়াচে? সত্যিই এপিডেমিক দেখা দিল? যদি তাই হয় তা হলে কী করা যায় বলতে পার? কি করে এখানের লোকগুলোকে নিরাপদে রাখি? কেমন করে বাঁচাই? অসুখের চিকিৎসারই বা কী হবে? ওষুধপত্র কোথায়? এটা কী ধরনের ছোঁয়াচে রোগ? –এই ধরনের প্রশ্ন, উদ্বেগ তাকে চিন্তিত করছিল, এবং পরামর্শের জন্যে হৈমন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছিল।
প্লেগ বলে মনে হয় তোমার? সুরেশ্বর জিজ্ঞেস করল আর একদিন।
না–না। হৈমন্তী মাথা নেড়ে বলল।
তবে! কী এমন রোগ?
জানি না! কত রকমের রোগ আছে। সব সময় সব রোগ বোঝাও যায় না। মাঝে মাঝে এক-আধটা অদ্ভুত রোগও আসে…।
সুরেশ্বর আর কিছু বলল না।
হৈমন্তী তার সাধ্যমতো ভেবেছে, ভেবে দেখেছে এই বিচিত্র রোগ তার জ্ঞানের বাইরে। রেটিনাইটিস, কেরাটাইটিস, গ্লুকোমা–এসব হলে সে বলতে পারত, কিন্তু এ রোগের সে কী জানে, কী বা বলতে পারে। যদি কেতাবি বিদ্যেতে সন্দেহ করতে হয়, তবে হৈমন্তী সন্দেহ করবে মনোনিউক্লোসিস; অথচ পুরোপুরি তা নয়; স্কারলেটিনারও লক্ষণ পাওয়া যায়। এই দুই রোগ সম্পর্কে তার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। থাকার কথাও নয়। দ্বিতীয় রোগ এক-আধটা তবু দেখেছে
প্রথমটা আদপেই নয়। মনোহরের বেলায় কিছুই বোঝা যায়নি, বুড়ো তিলুয়ার বেলায় কিছু একটা ঠাওর করার আগেই সে নিউমোনিয়া হয়ে মারা গেল, আপাতত যে পড়ে আছে, গির্জা, তাকে দেখেই হৈমন্তীর এই রকম মনে হচ্ছে। তবে তার এই অনুমান ভুল হতে পারে, হওয়াই স্বাভাবিক। এসব রোগে মানুষ ভোগে কিন্তু কদাচিৎ মারা যায়। প্রথমটা তো সাধারণত কমবয়েসীদের। …এ সবই তার নিছক একটা অনুমান, নিজেরই শত সন্দেহ। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত যা শোনা যাচ্ছে তার কতটা গুজব, কতটা সত্যি তা কেউ জানে না। হতে পারে এদিকের এ-মেলা সে-মেলায় দশ বিশ জন মারা গেছে, কিন্তু তারা কোন রোগে মারা গেছে কে বলবে! শীতে দু-চারটে বুড়োবুড়ি অনায়াসেই মরতে পারে : যে রকম ঠাণ্ডা তাতে মেলার ফাঁকা মাঠে প্রায় নির্বস্ত্র কটা গরিব রাত্রের হিমঠাণ্ডায় যে নিউমোনিয়া বাঁধায়নি তাই বা কে জানছে। যে সব খাদ্য মেলায় খাচ্ছে তাতেও দু-পাঁচটা মরতে পারে, বিচিত্র কী! তার ওপর শোনা যাচ্ছে কোথাও কোথাও বসন্ত শুরু হয়ে গেছে, যদি তাই হয় তবে এমনও হতে পারে মেলায় গিয়ে কারও জ্বর হয়েছে, বাড়িতে ফিরেছে বসন্ত নিয়ে, বাড়ি এসে পরে মরেছে। কে জানতে যাচ্ছে কী হয়েছিল? এ তো শহর নয়, ডাক্তারবদ্যিও নেই, চিকিৎসাও হয় না। বিক্ষিপ্ত লোকালয়, ছোট ছোট গ্রাম, কোথাও দশ বিশ ঘর, কোথাও কিছু বেশি বাসিন্দে; এক গাঁয়ের খবর অন্য গাঁয়ে পৌঁছতে একটা বেলা কেটে যায়, এমন অবস্থায় ঠিকঠাক কিছু জানার উপায় নেই। বেচারি অজ্ঞমূৰ্থে কী বলছে সেটা কোনও কাজের কথা নয়। রোগটা মেলা থেকে ছড়াচ্ছে, রোগটা মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে–এসব অজ্ঞেই বলছে। তারা বলছে বলেই মেনে নিতে হবে!
মনোহর এমনভাবে মারা গেল যে কিছুই ধরা গেল না। হৈমন্তী স্তম্ভিত ও বিস্মিত হলেও কোনও কিছু স্থির করে নেয়নি। তারপর গেল বুড়ো তিলুয়া। তিলুয়ার সময়েও রোগ ধরা গেল না কিন্তু কয়েকটা প্রাথমিক লক্ষণ মনোহরের মতন দেখাল, যদিও তিলুয়া শেষাবধি নিউমোনিয়া হয়ে মরল। এবারও কিছু বুঝল না হৈমন্তী। নিজেকে বড় অসহায় মনে হল।
মেলায় অসুখ দেখা দিয়েছে এই গুজবটা তো কানে এসেছিল অন্ধ আশ্রমের কারও কারও, সে গুজবে কেউ কান দেয়নি। মনোহর মারা যাবার পর গুজবের হাওয়াটা আরও জোরে এসে লাগল। তিলুয়া বুড়ো মারা যাবার পর সকলেই ভয় পেয়েছিল। তারপর গিজা। অন্ধ আশ্রমে এখন একটা চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সুরেশ্বরও বেশ বিচলিত, শিবনন্দনজিও। এই আতঙ্ক স্বাভাবিক : অন্ধ আশ্রমের মধ্যে দু দুটো লোক পনেরো বিশ দিনের মধ্যে হুট করে মারা গেল, আর-একটা বিছানায় পড়ে আছে–এ কি উদ্বেগ আতঙ্কের পক্ষে কম হল!
সুরেশ্বর রীতিমতো উদ্বেগের মধ্যে একদিন শিবনন্দনজিকে সঙ্গে করে টাউনে গেল। সেখানে সরকারি হাসপাতাল আছে, ডাক্তার আছে, হেলথ-ডিপার্টমেন্ট আছে। ঘুরে এসে বলল, রোগের খবরটা হেলথ-ডিপার্টমেন্টেরও কানে গেছে, তারা খোঁজখবর শুরু করেছে। সরকারি হাসপাতালে এধরনের রোগী গোটা চারেক এসেছিল। দুটো মারা গেছে, একটা বেঁচেছে; একটা ভুগছে এখনও। রোগটা অদ্ভুত, কী রোগ কেউ বলতে পারছে না। কেউ বলছে, টাইফাস, কেউ বলছে অন্য কিছু।
আরও দশ পনেরোটা দিন এই ভাবেই কাটল। গির্জা কেমন করে যেন বেঁচে গেল।
তারপর বেশ বোঝা গেল, রোগ যাই হোক–মহামারীর চেহারা নিয়েই সেটা এ তল্লাটে দেখা দিয়েছে। প্রথমে যদি বা সন্দেহ ছিল, এখন অন্তত মনে হয় রোগটা যতই বিচিত্র হোক সংক্রামক রোগের মতনই সেটা ছড়িয়েছে। এই সময়টা এদিকে মেলা-টেলার সময়, নানা জায়গা থেকে ব্যাপারি আসে, কেনাবেচার জন্যে লোকে এ-মেলা থেকে ও-মেলা যায়, কিছু ধুনিঅলা সাধুবাবা থেকে ছেঁড়া তাঁবুতে ম্যাজিক দেখানো ম্যাজিসিয়ান পর্যন্ত মেলায় মেলায় টহল দিয়ে বেড়ায়, রামলীলার দল আসে, নাওটাঙ্গির নাচ–তাও থাকে। মেলাতেই প্রথমে রোগটা কেউ বয়ে এনেছিল, তারপর এ-মেলা ও মেলা হয়ে সেটা ছড়িয়েছে, এখন মেলা-ফেরত মানুষের সঙ্গে ক্রমশই গাঁ-গ্রাম গিয়ে ঢুকেছে। শহরটহর হলে, ঘন বসতি থাকলে হয়তো রাতারাতি রোগটা মারাত্মক হয়ে ছড়িয়ে পড়ত, দূরদূরান্তে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো গাঁ-গ্রামের বসতি, হয়তো তাই ব্যাধিটা ছড়াতে বিলম্ব হচ্ছিল। এক পক্ষে এটা ভাল, অন্য পক্ষে মন্দ। মন্দ এই জন্যে যে, শহরে-নগরে হলে একটা রইরই বাঁধত, মিউনিসিপ্যালিটির টনক নড়ত, ডাক্তার বদ্যি ছোটাছুটি করত, সরকারি নজর পড়ত। তাতে দশটা মরত বাকি নব্বইটাকে বাঁচাবার চেষ্টা হত। এ-জায়গাটা শহর নয়, না মিউনিসিপ্যালিটি না ইউনিয়ন বোর্ড, কোথাও কোথাও নামে নাকি পঞ্চায়েত আছে, ডাক্তার বদ্যির বালাই নেই, কাজেই কোথায় কোন দেহাতে কে মরছে, কী রোগ হচ্ছে–কে তার খবর রাখে। সরকারি নজরটাও এতদিনে পড়েনি। গা এলিয়ে কে কী দেখছে কিছুই বোঝা যায় না। শোনা যাচ্ছে, হাকিম নাকি মেলা-টেলা বন্ধ করার হুকুম দেবেন। হেলথ-ডিপার্টমেন্টের লোক কতক মুদ্দোফরাশ জোগাড় করে কিছু ব্লিচিং পাউডার আর মশা মারা তেল দিয়ে কয়েকটা গাঁ-গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কয়েকজন টিকাদার বেরিয়েছে। বসন্তের টিকে দিতে। বসন্তের টিকে এরা বড় কেউ নেয় না, টিকাদার দেখলে ঘর ছেড়ে ক্ষেতিতে পালায়, মেয়ে বউরা কান্নাকাটি শুরু করে, বাচ্চাগুলো চুহার মতন লুকোয়।
শিবনন্দনজির কাছ থেকে এই সব খবর পাওয়া যাচ্ছিল। একদিন তিনি বললেন, এ অঞ্চলে কলেরা বসন্তের মহামারী হতে আগে তিনি দেখেছেন, মহামারীটা আসে যেন পঙ্গপাল আসছে : প্রথমে ফড়িংয়ের মতন পাঁচ দশটা কোথা থেকে ছিটকে আসে, কেউ খেয়াল করে না, বোঝেও না, তারপর দেখতে দেখতে হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি আসার মতন এক ঝাঁক পঙ্গপাল এসে পড়ে; তখন খেয়াল হয়, সামাল দেবার জন্যে ছুটোছুটি শুরু হয়, কিন্তু ততক্ষণে আকাশ কালো করে অন্তহীন এক মেঘের মতন তারা এসে গেছে। সেই ভয়ংকর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আর কিছু করার সাধ্য মানুষের থাকে না।
কথাটা শিবনন্দনজি বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন, মহামারীটা আকাশ কালো করা পঙ্গপালের মেঘের মতনই এসে পড়ল। গাঁ-গ্রাম থেকে চোখ দেখাতে অন্ধ আশ্রমে রোগী আসার সংখ্যাও ক্রমশই কমে গেছে। এখন দু-একজন যদি বা আসে। ততদিনে মাঘ ফুরিয়ে আসছে।
.
সেদিন বিকেলের শেষ দিকটায় সুরেশ্বর এল। হৈমন্তী বাড়ির সামনে মাঠে পায়চারি করছিল, মালিনী ছিল এতক্ষণ, কাছাকাছি, এইমাত্র ঘরে গেছে।
সুরেশ্বর এসে বলল, তোমার কাছেই এলাম।
হৈমন্তী দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সে বুঝতে পারল না দাঁড়িয়ে থাকবে, হাঁটবে, নাকি ঘরে যাবে। সুরেশ্বর কেন এসেছে তা জানতে তার তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। আজকাল মাঝেমাঝেই সুরেশ্বরকে তার কাছে আসতে হচ্ছে, তাগিদ হোক প্রয়োজন হোক–এ সবই সুরেশ্বরের; অসুখটা আশ্রমে ঢুকে না পড়লে সুরেশ্বরের হৈমন্তীকে প্রয়োজন হত না; সুরেশ্বর বিপাকে পড়েছে, হৈমন্তীও আজ হঠাৎ প্রয়োজনীয় মানুষ হয়ে উঠেছে। হৈমন্তী মনে করে না, এর কোনও মূল্য আছে, তার ভালও লাগে না। বরং কখনও-সখনও সে কৌতুক অনুভব করে, উপহাসের ইচ্ছে জাগে, বিতৃষ্ণা আসে।
সুরেশ্বর বলল, এখনও সন্ধে হয়নি, চলো একটু হাঁটি। বলে পা বাড়াল সুরেশ্বর।
হৈমন্তীও বাধ্য হয়ে হাঁটতে লাগল।
হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর বলল, একটা খবর শুনেছ?
এখনকার সব খবরই রোগ-মহামারীর মৃত্যুর। হৈমন্তী কোনও উৎসাহ বোধ করল না। বরং তার বিরক্তি হচ্ছিল। কেন যেন আজ দুপুর থেকে সে অবনীর প্রত্যাশা করছিল। ছ সাত দিনের মধ্যে অবনী আর আসেনি। আজ সে আসবে এই রকম মনে হচ্ছিল।
সুরেশ্বর বলল, পাটনা থেকে কিছু ডাক্তার-টাক্তার আসছে শুনলাম, ভলেন্টিয়ারও আসতে পারে। তাঁবু ফেলে থাকবে। …তা তাড়াতাড়ি এসে পড়লেই ভাল, কি বল? এদের তো সব কিছুতেই গড়িমসি।
হৈমন্তী নীরবে হাঁটতে লাগল। কারা আসবে, কখন আসবে, কোথায় কোথায় তাঁবু পাতবে এর কোনও কিছু জানার জন্যে সে ব্যগ্র নয়। যদি ডাক্তার নার্স ভলেন্টিয়ার ওষুধপত্র আসে–ভালই হবে; আসা উচিত–এই পর্যন্ত সে ভাবতে পারে, তার বেশি আর কিছু নয়। সুরেশ্বরের মতন, সে কি চাতকের মতন পাটনার ডাক্তারদের জন্যে দিন গুনবে নাকি?
শিবনন্দনজি বলছিলেন– সুরেশ্বর বলল, এখন আর কোথাও মেলা বসতে দিচ্ছে না, পুলিশ গিয়ে দোকানপসার তুলে দিচ্ছে। কোথায় যেন মেঠাইমণ্ডা সব ফেলে দিয়েছে টান মেরে, চাটাই ছাউনির ঢাকা-টাকা পুড়িয়ে দিয়েছে।
মনে মনে হৈমন্তী বলল : ভালই করেছে। হতভাগার দল যত! মরছে, তবু মেলায় যাবে, গিয়ে ওই মেঠাইমণ্ডা খাবে। কিন্তু সুরেশ্বর কি এইসব কথা বলার জন্যে তার কাছে এসেছে? হৈমন্তীর মনে হল না, পাটনা থেকে ডাক্তার আসছে, পুলিশ মেলা বন্ধ করে দিচ্ছে–এসব তুচ্ছ কথা শোনাবার জন্যে বা তা নিয়ে গল্প করার জন্যে সুরেশ্বর এসেছে।
অন্ধ আশ্রমের ফটক পেরিয়ে তারা জামতলার সামনে এসে দাঁড়াল। গোধূলি নামছে। হৈমন্তী লাটুঠার দিকের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। শীত মরে আসছে, তবু বেশ ঠাণ্ডা আছে এখনও। ধুলোয় মাঠঘাট ধূসর, আলোর অভাবে এবং ছায়ার জন্যে ছোট ছোট ঝোপঝাড়গুলো কালচে দেখাচ্ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর এবার বলল, কলকাতা থেকে কোনও চিঠি পেয়েছ হেম?
হৈমন্তী মুখ তুলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এতক্ষণে যেন সুরেশ্বরের আসার কারণটা সে বুঝতে পারল।
কদিন আগে পেয়েছি, হৈমন্তী বলল।
সামান্য অপেক্ষা করে সুরেশ্বর বলল, আমি আজ গগনের একটা চিঠি পেলাম।
হৈমন্তী মুখ তুলে সুরেশ্বরকে দেখল না; না দেখেও অনুমান করতে পারল গগন কী লিখেছে। অন্যমনস্কভাবে আকাশে গোধূলির মেঘ দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল।
সুরেশ্বর অল্প সময় নীরব থাকল, পরে বলল, গগনকে তুমি কিছু লিখেছিলে?
হৈমন্তী ঘাড় ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে বলল, কীসের কী লিখব।
এখানের অসুখ-বিসুখের কথা?
গগন নিজেই দেখে গেছে।
তখন এতটা বাড়াবাড়ি এদিকে হয়নি। সুরেশ্বর যে প্রতিবাদ করল তা নয়, তবু মনে হল সে বলতে চাইছে, গগন যখন গেছে তখন এমন কিছু হয়নি যাতে খুব একটা ভয় পাবার মতন অবস্থা হয়েছিল। হৈমন্তী বুঝতে পারল গগন বেশ ভয় পেয়ে কিছু লিখেছে।
সুরেশ্বর মাঠঘাট দেখতে দেখতে বলল, গগন তোমায় কলকাতায় পাঠিয়ে দেবার কথা লিখেছে।
হৈমন্তী প্রথমটায় মুখ ফেরাল না, যেমন হাঁটছিল সেই রকম আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল, পরে মুখ তুলে সুরেশ্বরকে দেখল। গগন যে কিছু অন্যায় করেনি সে সম্পর্কে হৈমন্তীর সন্দেহ ছিল না। সে বেচারির দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা হতেই পারে; তার ওপর যদি মা আর মামা সব শোনে তবে কলকাতার বাড়িতে খুব একটা উৎকণ্ঠা যাচ্ছে যে তাতে সন্দেহ নেই।
গগনের চিঠি পড়ে আমার মনে হল– সুরেশ্বর বলল, তুমি কিছু লিখেছ। … এখানের অবস্থা যা হয়ে দাঁড়িয়েছে–দেখলাম সে প্রায় সবই জানে।
হৈমন্তী কেন যেন বিরক্তি বোধ করল। সুরেশ্বরের কথার ধরন থেকে তার মনে হচ্ছিল, হৈমন্তী যেন লুকিয়ে লুকিয়ে গগনকে ভয় পাইয়ে দেবার মতন কিছু লিখেছে। বিতৃষ্ণা অনুভব করল হৈমন্তী, সুরেশ্বরের দিকে কয়েক পলকের জন্যে তাকাল, মনে মনে বিরক্তির সঙ্গে বলল : তোমার বুঝি মনে হচ্ছে আমি এখান থেকে পালাবার মতলব করে গগনকে সব লিখেছি? গগন আমার কথা মতন তোমায় লিখেছে?
গায়ের গরম চাদরটা ঘন করে জড়িয়ে নিতে নিতে হৈমন্তী বিরক্ত গলায় বলল,তোমার মনে হলে আমার আর কী করার আছে। আমি তেমন কিছু লিখিনি। বলে একটু থামল হৈমন্তী, আবার বলল, সাধারণ একটা বুদ্ধি আমার আছে :কলকাতায় ওদের উদ্বন্ত করে তুলে কী লাভ।
হৈমন্তীর গলার স্বরে বিরক্তি ও অপ্রসন্নতা অনুভব করে সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল। ঈষৎ যেন অপ্রস্তুত হয়েছে, বলল, তা ঠিক; আমিও তাই ভাবছিলাম–দুরে যারা রয়েছে তারা কিছু জানছে না দেখছে না, অযথা ওদের ব্যস্ত করে ভয় পাইয়ে কী লাভ! … গগন বেশ ভয় পেয়েছে, মাসিমাকেও কিছু কি আর জানায়নি। … গগনটা এত কথা জানল কী করে।
হৈমন্তীর এতক্ষণে সন্দেহ হল, অবনী নিশ্চয় গগনকে লিখেছে।
সুরেশ্বর বলল, গগন তোমায় কিছু লেখেনি?
কথাটা তেমন খেয়াল করে শুনল না হৈমন্তী। সে অবনীর কথা ভাবছিল : ভাবছিল, গগনকে সবিস্তারে কেউ কিছু লিখে থাকলে অবনীই লিখেছে। তার পক্ষে লেখা সম্ভব। হৈমন্তী ভাবল, কথাটা সুরেশ্বরকে বলবে নাকি? পরে মনে হল, থাক বলবে না। অথচ হৈমন্তীর খারাপ লাগছিল; সুরেশ্বর হয়তো মনে মনে ভেবে রাখল, হৈমন্তী কিছু গোপন রাখছে।
সামান্য অপেক্ষা করে সুরেশ্বর আবার বলল, গগন তোমায় কিছু লেখেনি, হেম?
কলকাতায় যাওয়ার কথা?
হ্যাঁ। সুরেশ্বর মাথা নাড়ল।
লিখেছে।
সুরেশ্বর চুপ করে থাকল, যেন অপেক্ষা করছে হৈমন্তী আরও কিছু বলবে বলে। হৈমন্তী কিছু বলছিল না। আকাশে গোধূলি ফুরিয়ে এল; পশ্চিমের আকাশে অন্ধকারের জোয়ার আসছে, অবশিষ্ট একটু লালের আভার ওপর কালোর ছায়া। মাথার ওপর দিয়ে নিঃসঙ্গ কোনও পাখি ভীত হয়ে উড়ে যাচ্ছিল।
হৈমন্তী এই নিঃশব্দতায় কেমন আড়ষ্ট বোধ করল। আসন্ন সন্ধ্যার মতন কোনও কিছুর বিষণ্ণ ভার তাকে আচ্ছন্ন করে আনছিল। হৈমন্তী বলল, সন্ধে হয়ে গেল; ফিরি। শীত করছে।
অন্যমনস্কভাবে সুরেশ্বর বলল, চলো-ফেরা যাক।
ফেরার পথে হৈমন্তী বলল, গগন যখন যায়, তখনই তার বেশ ভাবনা হয়েছিল।
জানি। আমায় বলেছিল।
এখনকার অবস্থা আরও খারাপ! …আমি তাকে ব্যস্ত করার মতন কিছু লিখিনি; তবে চারপাশে খুব অসুখ-বিসুখ চলছে এখন–এরকম কিছু লিখেছিলাম। হয়তো তাতেই আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মা…
সুরেশ্বর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কিনা বোঝা গেল না। কিছু বলছিল না। নীরবে দুজনে আরও একটু হেঁটে এল। দেখতে দেখতে কেমন অন্ধকার হয়ে এল। দূরে নদীর দিকে শূন্যতায় ধুলোর গায়ে বুঝি কুয়াশা জমতে শুরু করেছে।
সুরেশ্বর বলল, তুমি যাবার ব্যাপারে কিছু ঠিক করেছ?
হৈমন্তীর পা থমকে স্থির হয়ে গেল, বাঁ পা বাড়িয়ে সে দাঁড়াল, ডান পা আর তুলতে পারল না। সুরেশ্বরের দিকে তাকাল, সুরেশ্বর দুপা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ যেন কেমন একটা আক্রোশ ও ঘৃণা হৈমন্তীকে কিছুক্ষণের জন্যে কিছু দেখতে দিল না, ভাবতে দিল না। জীবনে বোধহয় আর কখনও এমন তিক্ততা সে অনুভব করেনি। সুরেশ্বরকে অত্যন্ত ইতর,কপট ও স্বার্থপর মনে হচ্ছিল। কী ভাবছে সুরেশ্বর? সে কি ভেবে নিয়েছে, হৈমন্তী পালিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে রেখেছে?
সুরেশ্বর দাঁড়িয়ে পড়েছিল। হৈমন্তী আসছে না দেখে অপেক্ষা করছিল।
শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী পা বাড়াল।
সুরেশ্বর বলল, হেম, আমি কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, তোমার সঙ্গে কটা কথা বলব। ..গগন থাকতে থাকতেই ভেবেছি কথাটা বলি। বলা হয়নি। তারপর এই রকম একটা অবস্থা দাঁড়াল।
হৈমন্তী সামান্য দ্রুত পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছিল, যেন সুরেশ্বরের সঙ্গ তার আর পছন্দ হচ্ছিল না, সহ্য হচ্ছিল না। দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করতে গিয়ে উত্তেজনার মাথায় হৈমন্তীর শরীর কাঁপছিল, পা এলোমেলো হয়ে পড়ছিল।
হৈমন্তী ঝোঁকের মাথায় তিক্ত গলায় বলল, যাবার দিন আমি এখনও ঠিক করিনি কিছু কাল পরশুর মধ্যে করব।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর ক্রোধ এবং তিক্ততা অনুভব করতে পারছিল। অল্প সময় কথা বলল না। পরে বলল, তুমি আরও কয়েকটা দিন থাকলে ভাল হয়।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল দাঁড়ায়, সুরেশ্বরের নির্লজ্জ মুখের চেহারাটা একবার দেখে, বলে : কেন? তোমার এই আশ্রমের আবার কে অসুখে পড়বে তার চিকিৎসা করতে নাকি?
সুরেশ্বর যেন আগেই কিছু ভেবে রেখেছিল, এখন তা বোঝাবার চেষ্টা করছে–এমনভাবে বলছিল, আমি একজন ডাক্তারের খোঁজ করছি, হেম। পাটনায় উমেশবাবুকে লিখেছি, রাঁচিতে শিবনন্দনজির এক ভাই থাকেন ডাক্তার, তাঁকেও বলা হয়েছে। ভেবেছিলাম, কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেব–পাটনার কাগজে। কলকাতা থেকে ডাক্তার এনে লাভ হবে না, তারা এ জায়গায় থাকতে পারবে না। গগন থাকতে থাকতেই এসব ভেবেছিলাম। হয়তো এ ব্যাপারটায় এতদিনে মন দিতে পারতাম, একটা কিছু ব্যবস্থাও হত, কিন্তু হঠাৎ এই অসুখটা এসে সব গোলমাল হয়ে গেল। …আমার আর কদিন সময় দরকার।
সুরেশ্বরের কথার মধ্যে কোনও লুকোচুরি নেই, আবেগ নেই, রহস্য নেই, একেবারে সাদামাটা, সরল কাজের কথা। নিজের অসুবিধে, সমস্যা এমনকী প্রয়োজন সম্পর্কেও সে সচেতন; নিজের স্বার্থটুকু প্রকাশ করতে তার কোনও রকম সঙ্কোচ হল না।
হৈমন্তীর পক্ষে এই নির্লজ্জতা অসহ্য হল যেন। বলল, তুমি আমায় কী মনে করো?
সুরেশ্বর কোনও জবাব দিল না। হাঁটতে লাগল।
হৈমন্তীও হাঁটছিল। বলল, তোমার সুবিধে অসুবিধে বুঝে আমায় চলতে হবে?
সুরেশ্বর কী যেন বলার চেষ্টা করল; হৈমন্তী বলতে দিল না। বিতৃষ্ণায় এবং ক্রোধে প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে হৈমন্তী বলল, এখানে এই এপিডেমিকের মধ্যে আমি কেন থাকব? কী লাভ আমার থেকে? যদি আজ আমার অসুখ হয়, কে দেখবে? তুমি?
সুরেশ্বর হৈমন্তীর গলার স্বরে অস্বস্তি বোধ করছিল, বলল, হেম, তুমি মাথা গরম করছ। একটু শান্ত হয়ে ভাবো। বলে সুরেশ্বর যেন হৈমন্তীকে মাথা ঠাণ্ডা হবার সময় দিল সামান্য, বলল, এই অসুখ তোমার আমার মালিনীর–এখানের যে-কোনও লোকের হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। আমরা কিছু জানি না। যদি আমাদের হয় তুমি দেখবে যদি তোমার হয় আমরা কি তোমায় দেখব না?
তোমরা! হৈমন্তী যেন উপহাস করে হাসবার চেষ্টা করল।
সুরেশ্বর অপ্রতিভ হল না; বলল, আমরা ডাক্তার নই; কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা তোমার বেলায় হবে না বলেই কি তোমার মনে হয়!
অন্ধ আশ্রমের ফটকের সামনে এসে পড়েছিল ওরা।
সুরেশ্বর বলল, মনোহর, তিলুয়া, গির্জার বেলায় তুমি যথাসাধ্য করেছ। একজনকে তুমি বাঁচিয়ে তুলেছ…
তার জন্যে কি আমি তোমাদের কাছে বাঁধা পড়ে গেছি?
না না; তা কেন! …এখন এ অবস্থায় তুমি এতগুলো মানুষের ভরসা।
তোমার অন্ধ আশ্রমের মানুষদের, তোমার।
হ্যাঁ; আমাদের।
তাতে আমার কোনও গরজ নেই। তোমার অন্ধ আশ্রমের কার কী হল, তাতে আমার কী যায় আসে?
হেম… সুরেশ্বর যেন কোনও ছেলেমানুষের মুখে বোকার মতন কোনও কথা শুনে শুধরে দেবার মতন করে হাসল, বলল, হেম, এ তোমার রাগের কথা। মানুষের জন্যে মানুষেই করে, একের রোগে শোকে অন্যে ভাবে।
আমি ভাবিনি। আমি তোমার এখানের কারও কথা ভাবি না।
তুমি তাদের জন্যে অসুখের সময় ভেবেছ।
ওকে ভাবা বলে না। আমার কর্তব্য করেছি। উপায় ছিল না বলে করেছি।
এভাবে কি সংসারে বাঁচা যায়?
বাঁচার কথা উঠছে কেন! তোমার এই আশ্রম আমার সংসার নয়। হৈমন্তী রূঢ় গলায় বলল, নেহাতই আমি ডাক্তার, এখানে আর কোনও ডাক্তারবদ্যি নেই, তাই বাধ্য হয়ে আমায় আমার কর্তব্য করতে হয়েছে।
এদের জন্যে তোমার মমতা হয়নি?
না।
না?
জানি না; দুঃখ হলেও হতে পারে, কিংবা কষ্ট…।
তুমি শুধু ডাক্তারি নীতি মেনেছ?
তা ছাড়া কী! …এইসব আশ্রম-টাশ্রমে অন্ধ-টন্ধদের মধ্যে তোমার কোনও আদর্শ থাকতে পারে, বিশ্বাস থাকতে পারে। আমার নেই।
জানি, সুরেশ্বর ছোট্ট করে বলল।
হৈমন্তী মুহূর্তের জন্যে চুপ করে থাকলেও ঝোঁকের মাথায় বলল, তা হলে কি! এবার আমায় যেতে দাও।
সুরেশ্বর কোনও জবাব দিল না। কথা বলতে বলতে তারা অন্ধকারে হৈমন্তীর ঘরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। অন্ধকার হয়ে গেছে। মালিনী বাতি জ্বেলে রেখেছে বলে মনে হল, তার ঘরে বাতি জ্বলছিল, হৈমন্তীর ঘরের দরজা ভেজানো।
ঘরের সামনে এসে হৈমন্তী দাঁড়াল না, তবু মুহূর্তের জন্য তার পা থেমেছিল, যেন তার মনে হয়েছিল, সুরেশ্বর এখান থেকেই বিদায় নেবে। সুরেশ্বর গেল না, হৈমন্তীর পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বারান্দায় উঠে মালিনীকে দেখতে পেল না হৈমন্তী; ঘরে এসে ভেজানো দরজা খুলল। ভেতরে বাতি জ্বলছে।
সুরেশ্বর ঘরে এসে চৌকাঠের কাছে সামান্য দাঁড়াল। হৈমন্তী এগিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বোধহয় খেয়াল পড়ায় বাতিটার শিস বাড়িয়ে দিল।
এপাশ ওপাশ তাকিয়ে সুরেশ্বর জানলার দিকে চেয়ারের কাছে এসে বলল, হেম, তুমি বড় উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। শান্ত হয়ে বসো একটু। এভাবে তো কোনো কথা বলা যাবে না।
সুরেশ্বরের দিকে পিঠ আড়াল করে ছিল। তার যে উত্তেজনা রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সুরেশ্বরকে তার ভাল লাগছিল না। মানুষটার সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে আজ এমন এক হিসেবি, চালাক, প্রভুত্বপরায়ণ, সুবিধেবাদীর চেহারা ফুটে উঠেছে যে, হৈমন্তীর অসহ্য ঘৃণা হচ্ছিল। আশ্চর্য, এই মানুষ ভেতরে ভেতরে এত ভেবেছে : ভেবেছে হৈমন্তীকে সরিয়ে নতুন ডাক্তার আনবে, ডাক্তারের জন্যে চিঠি লিখেছে, বিজ্ঞাপন দেবার কথা ভেবেছে, সবই ঠিকঠাক প্রায়–অথচ ঘুণাক্ষরেও হৈমন্তীকে কিছু জানায়নি। নেহাত একটা রোগ বেধে গিয়ে সব গোলমাল করে দিল, নয়তো এতদিনে হয়তো সুরেশ্বরের নতুন ডাক্তার জুটে যেত। তখন বিনয় করে বলত : হেম, আমি ভেবে দেখলাম, তোমার এখানে অসুবিধে হচ্ছে, তুমি বরং কলকাতায় ফিরেই যাও।
চেয়ারে বসতে বসতে সুরেশ্বর বলল, বোসো, দুটো কথা বলি।
হৈমন্তী বসল না, বলল, আমি ঠিক আছি।
তুমি না বসলে আমার খারাপ লাগছে। বোসো।
হৈমন্তী বাধ্য হয়ে বসল।
সুরেশ্বর অল্প সময় কিছু বলল না, পরে বলল, তুমি যখন এসেছিলে, তখন আমি তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, থাকতে পারবে? তুমি বলেছিলে, পারবে। পরে আমার মনে হয়েছিল, তুমি হয়তো শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবে না। আমি তোমায় আগেও বলেছি, এখানে তোমার মন যদি না টানে, আমি জোর করে ধরে রাখব না। …তুমি যাবে, আমি তো তোমায় আটকাচ্ছি না। কদিন আরও থেকে যেতে বলেছিলাম। যদি না পার, থেকো না। এতে তুমি রাগ করছ কেন? অসহিষ্ণু হবার তো কোনও কারণ নেই।
হৈমন্তী চোখ তুলে না তাকিয়ে পারল না। সুরেশ্বর এমনভাবে কথা বলছে যেন হৈমন্তীর এখানে আসা, থাকা, যাওয়া–এর কোনওটাই তেমন করে গায়ে মাখার মতন নয়; সহজ একটা অঙ্ক যদি যোগে না-হয় বিয়োগ করলেই হল। কী করে, কেমন নির্বিকারভাবে একটা মানুষ এসব কথা বলতে পারে, হৈমন্তী ভেবে পাচ্ছিল না। কপালের শিরা এবং মাথায় কেমন একটা দপদপে কষ্ট হচ্ছিল।
তোমার কাছে– হৈমন্তী কী বলতে গিয়ে কথা হারিয়ে ফেলল; তার চোখের দৃষ্টি তীব্র ও সমস্ত মুখ কালশিরে পড়ার মতন কালচে হয়ে এসেছিল। নিষ্পলক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর হৈমন্তী বলল, তোমার কাছে জীবনটা যত হাওয়া বাতাসের, আমার কাছে তা নয়।
হাওয়া বাতাসের? সুরেশ্বর আপনমনে বলার মতন করে বলল, বলে জিজ্ঞাসুর মতন তাকিয়ে থাকল। কথাটা আমি ভাল বুঝলাম না, হেম।
হৈমন্তীর গলার স্বর সামান্য খসখসে এবং তীক্ষ্ণ হয়ে এসেছিল, গলার নীচে একটি শিরা ফুলে আছে। হৈমন্তী বলল, না বুঝলে বুঝো না; আমিও তো অনেক কিছু বুঝতে পারলাম না। হৈমন্তী চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকাল।
সুরেশ্বর স্থির হয়ে বসে থাকল, ভাবছিল। হৈমন্তীর শেষ কথার অর্থ সে বুঝতে পারছে। অথচ বলার মতন কিছুই যেন খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা ধরে যাচ্ছিল। আজ সারাটা দিন কেমন ভাল লাগছেনা,শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।
হৈমন্তী বলল, তোমার অন্ধ-সেবা তোমার সুখ, আমার কিছু নয়। তুমি আমায় কেন তোমার ছকের খুঁটি করেছিলে আমি জানি না।
সুরেশ্বর আহত হল। তার চোখে ক্ষণিকের জন্য আঘাত এবং বেদনার, মুখে বিষণ্ণতার ময়লা দাগ ফুটল। এই অভিযোগ সত্য হোক না হোক, তার বলার কিছু নেই। কিন্তু হেম যেভাবে কথাটা বলছে, সেভাবে ভাবতে সুরেশ্বরের কষ্ট হচ্ছিল। সুরেশ্বর অনুচ্চ, দুঃখিত স্বরে বলল, আমার ভুল আমি মেনে নিয়েছি, হেম। তবে তুমি যে কেন ও কথাটা বললে, আমি বুঝতে পারলাম না। আমি কি তোমায় সত্যিই ছকের খুঁটি করেছিলাম?
আর কী! হৈমন্তী বাঁ পাশের গলা টান করে বলল, ভঙ্গিটা দুঃখের অথচ উপহাসের।
দুজনেই নীরব হয়ে গেল তারপর। ঘরের মধ্যে কেমন জনহীনতার নিস্তব্ধতা সৃষ্টি হচ্ছিল, বাতির আলো ফ্যাকাশে সাদা, শীত ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে, কখনও হৈমন্তীর, কখনও সুরেশ্বরের দীর্ঘ নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছিল। নিঃসম্পর্কের মতন, অপরিচিতের মতন দুজনে বসে থাকল।
অবশেষে সুরেশ্বর বলল, হেম, আমি তোমায় ছকের খুঁটি করব, একথা আমি ভাবিনি কখনও। আমার মনে হত, তুমি অল্প বয়সে মানুষের দুঃখের দিক দেখেছ, নিজেও সেই অসহায়তার স্পর্শ পেয়েছ, হয়তো তুমি সাধারণ সংসারের বেড়ার বাইরে আসতে আপত্তি করবে না।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। মনে হল বলে, তুমি কী ভেবেছিলে সেটা তোমার ব্যাপার, আমার নয়। আমি কখনও তোমায় বলিনি, আমি সাধারণ সংসারের বাইরে যেতে চাই। আমি বলিনি, আমি তোমায় তেমন কিছু অনুমান করতেও দিইনি। অথচ তুমি আমায় এমন স্পষ্ট করে কোনওদিন বুঝতে দাওনি যে, আমায় তোমার শুধুমাত্র অন্ধ হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে থাকার জন্য দরকার। কবে আমি অসুখে ভুগেছি, দুঃখে পড়েছি–তার জন্য আমার সমস্ত জীবন তোমার এই আশ্রমের অন্ধ-আতুরের সেবায় ব্যয় করতে হবে। কেন? কী করে তোমার মনে হল, আমার জীবন তোমার শখ মেটাবার সামগ্রী? বেশ, শখ না বললুম, তোমার অভিমানে লাগবে, বরং তোমার আদর্শই বলি, তোমার আদর্শের জন্য আমার জীবনটাকে তুমি লাগাম পরিয়ে তুলি এঁটে ছুটিয়ে দিতে পার না। আমি আলাদা, আমার মন আলাদা, আমি তোমার মতন অন্ধ কোলে করে জীবন কাটাতে চাই না। …তুমি তো আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছ, তুমি কোনওদিন আমায় স্পষ্ট করে বলোনি, আমায় আর ভালবাস না, এ-ভালবাসায় তোমার সুখ নেই। আমাদের মতন সাধারণ মানুষের ভালবাসাবাসিতে তোমার সুখ না থাকতে পারে, কিন্তু কেন তুমি স্পষ্ট করে আগে বললে না? কী হিসেবে তুমি ধরে নিলে, তোমার সুখ আমার সুখ হবে? তোমার ইচ্ছে আমার ইচ্ছে হবে? তোমার সাধ মেটাবার জন্যে আমার জীবনটা নষ্ট করতে হবে কেন? আসল কথা কী জানো, সেই যে কথায় বলে–যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না, তেমনি যে অন্ধ হাসপাতাল করে, গরিব দুঃখীদের আশ্রয় দেয় সে কী আর নিজের জন্যে ছোট একটু ঘর বাঁধতে পারে না? পারে। দয়া ধর্ম সংসারে অনেক লোক করেছে, হাসপাতাল করতে বাড়ি ঘর টাকা অনেকেই দিয়েছে, যদি বলো জীবন উৎসর্গ তাও অনেকে করেছে, কিন্তু তার জন্যে তাদের নিজের একটু ঘর রাখতে আটকায়নি। …আমার বয়েস হয়েছে, বেশ বুঝতে পারি, আমায় তুমি তোমার আশ্রমের জন্য প্রত্যাখ্যান করোনি, অন্য কোনও কারণ আছে, গগন যা বলছিল। কিন্তু সেটা কী, আমি জানি না, তুমি গোপন রেখেছ।
.
হৈমন্তী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে স্থির অথচ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে এত কথা ভাবছিল। সুরেশ্বরও অনেকক্ষণ অন্য চিন্তা করছিল। শেষে হৈমন্তীর দিকে তাকাল, তাকিয়ে থাকল কিছু সময়, শেষে কোমল করে ডাকল, হেম।
হৈমন্তী শুনেও শুনতে পেল না।
সুরেশ্বর অপেক্ষা করল : পরে বলল, আমি তোমায় আমার স্বার্থের জন্যে চেয়েছিলাম কি না– জানি না; তবে একটা কথা ঠিক, আমি ভাবতাম তুমি আমার বড় সহায় হবে।
হৈমন্তী সামান্য মুখ ফেরাল, তুমি অনেক কিছুই ভেবেছ; যখন যা ভেবেছ নিজের দিকে তাকিয়ে ভেবেছ। …যাক, এসব কথা আমার আর ভাল লাগছে না। ছেড়ে দাও।
সুরেশ্বরের মনে হল উত্তেজনার শেষে হৈমন্তী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার মুখে চোখে কেমন অবসন্ন ভাব ফুটে উঠেছিল। হয়তো আরও কিছু বলার ছিল সুরেশ্বরের, অন্তত বলতে পারলে ভাল হত, অথচ বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। চুপচাপ বসে থাকল সুরেশ্বর, অশান্তির মতন লাগছে, কোথাও যেন কোনও গভীর কষ্ট থেকে গেল, বলা গেল না, বলা হল না; সম্ভব হল না।
হৈমন্তী হঠাৎ বলল, তুমি যা চাও এখানে সব পেয়েছ, আমি কিছুই পাইনি। … কিন্তু এ বয়সে তা নিয়ে ঝগড়া করে লাভ কী!
আমি কি চেয়েছি, হেম? ।
সুরেশ্বরের গলার স্বরে যে কাতরতা ছিল, অর্থ ছিল হৈমন্তী তা শুনল, কিন্তু অনুভব করল না। বরং বিরক্ত হল। অনেক দিন থেকে তার মনে হয়েছে কথাটা সুরেশ্বরকে বলবে; বলবে কারণ নিজের সম্পর্কে সুরেশ্বরের বড় বেশি মোহ। হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে: তুমি প্রতিষ্ঠা, সম্মান চেয়েছ; তুমি কর্তৃত্ব চেয়েছ; তোমার মধ্যে ক্ষমতা পাবার কাঙালপনা আছে; এই আশ্রমে তোমার আধিপত্য আমি দেখেছি। …সাধারণ মানুষের জগতে তোমার এ সব আশা মিটত না, তুমি ব্যর্থ হতে। সেই ভয়ে তুমি পালিয়ে এসেছ, পালিয়ে এসে এইবুনো জংলি দেশে নিজের জগৎ গড়েছ, সাধ আশা মেটাচ্ছ। তোমার সাধ্য ছিল না, খোলা সংসারের মাঠে ময়দানে দাঁড়িয়ে এত কিছু পাও। তুমি ভীরু, নিজের সঙ্গে নিজেকে ঠকিয়ে আজ সান্ত্বনা পেয়ে বেঁচে আছ।
এত কথার কিছুই হৈমন্তী বলল না। বরং শত দুঃখের মধ্যেও কেমন ম্লান হেসে, ঈষৎ বিদ্রুপের গলায় বলল, কেন, তোমার সেই বড় সুখ।
সুরেশ্বর স্থির শান্ত হয়ে বসে থাকল। বিদ্রুপে সে আহত হয়েছে কি না বোঝা গেল না।
কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হল না।
সুরেশ্বর অবশেষে উঠে দাঁড়াল। গগনকে একটা জবাব দিতে হবে চিঠির।
আমি দিয়ে দেব।
আমারও একটা চিঠি দেওয়া উচিত।
দিও।
কী লিখব?
তোমার যা খুশি হয় লিখো।
সুরেশ্বর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে এল। বাইরে এসে অনুভব করল তার খুব শীত করছে। শীতে সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠেছে, গা কাঁপছে, ঠোঁট থরথর করছিল। দাঁতে দাঁত চাপল সুরেশ্বর। মাথাটা ধরে গেছে বেশ।
সুরেশ্বর দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে যাবার চেষ্টা করছিল।
.
২৭.
পরের দিন সকালে মালিনী ছুটতে ছুটতে এল, মুখে থমথম করছে উদ্বেগ, দু চোখে ব্যাকুলতা; এমন উদভ্রান্তের মতন এসেছে যে তার কাঁধের ওপর কাপড় নেই, বুকের পাশ থেকেও শাড়ি পড়ে গিয়েছিল, আঁচলটা কোনও রকমে দুহাতে জড়ো করে ধরে আছে।
হেমদি, দাদার খুব জ্বর, ছুটতে ছুটতে এসে মালিনী বলল।
জ্বর! হৈমন্তীর বুকের কোথায় যেন ভয়ংকর একটা ভয়ের ঘা লেগে হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠল, উঠে দোলকের মতন ভয়ে দুলতে লাগল। বিমুঢ় দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে হৈমন্তী ভীত গলায় বলল, জ্বর! কখন জ্বর এল?
রাত্তির থেকে, মালিনী বলল।
হৈমন্তীর হাত-পা যেন কাঁপছিল সামান্য। মালিনীর বিহ্বলতা তাকে ভীত করেছিল। কিছু খেয়াল না করেই বলল, কত জ্বর?
কত জ্বর মালিনী জানে না। বলল, গা বেশ গরম।
তুমি দেখেছ?
মাথা নাড়ল মালিনী, দেখেছে। তার ধারণা, গা পুড়ে যাচ্ছে।
হৈমন্তী হাসপাতালে যাবার জন্যে ধীরে-সুস্থে তৈরি হচ্ছিল। আজকাল তাড়াতাড়ি হাসপাতাল যাবার দরকার হয় না, রোগীই আসেনা প্রায়। কয়েক মুহূর্ত কেমন যেন বিমূঢ়তার মধ্যে কাটল; তারপর স্টেথস্কোপটা খুঁজে নিয়ে হৈমন্তী বলল, চলো দেখি।
বারান্দায় এসে হৈমন্তী শুধোল, কী করছে? শুয়ে আছে?
বিছানায় বালিশ হেলান দিয়ে বসেছিলেন, মালিনী বলল। এতক্ষণে যেন খেয়াল হওয়ায় কাপড়ের অগুছোলো ভাবটা সামলে নেবার চেষ্টা করল মালিনী।
হৈমন্তীর মনে হল, জ্বরটা হয়তো তা হলে তেমন বেশি নয়; বেশি হলে কি বসে থাকতে পারত। কী হল হঠাৎ? মনোহর, বুড়ো তিলুয়ার মতন কিছু যদি হয়–অশুভ চিন্তাটা শিখার মতন যেন দপ করে জ্বলে উঠে তখন থেকে কাঁপছে। কথাটা ভাবতে সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসছিল।
মাঠে নেমে দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হৈমন্তী বলল, গায়ে মুখে কিছু দেখলে?
না।
কিছু বলল? কোনও কষ্টটষ্ট?
মাথায় যন্ত্রণা, গায়ে হাতে ব্যথা।
হৈমন্তী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার কপালে কি শেষ পর্যন্ত এখানে আটকে যাওয়া আছে? কাল রাত্রে সে স্থির করে ফেলেছিল, সপ্তাহ দুয়েকের বেশি আর সে থাকবে না। আর নয়। এই পনেরো বিশ দিনের মধ্যে সুরেশ্বর যদি পারে অন্য ব্যবস্থা করে নিক। আজ গগনকে চিঠি লিখবে বলেও ঠিক করেছিল, অথচ এ কী বাধা এসে জুটল!
মালিনী পাশে পাশে যাচ্ছিল; যেতে যেতে কিছু ভাবছিল, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে করছে। এত লোক থাকতে দাদারই শেষ পর্যন্ত অসুখটা হল, হেমদি? কী হবে এখন কে জানে!
মালিনীর ছেলেমানুষি আকুলতায় কান দেওয়া উচিত নয়, তবু হৈমন্তী ভাবল : ভাবল সুরেশ্বরের যদি কিছু হয় তবে এই আশ্রমের কী হবে? কী আর থাকবে? সুরেশ্বরকে বাদ দিয়ে মালিনীদের কল্পনা করা যায় না। একটা মাত্র মানুষ অথচ তার অস্তিত্বই যেন সব। হৈমন্তীর কেমন যেন বেদনা বোধ হচ্ছিল। মন থেকে এই চিন্তাটা সরিয়ে দেবার জন্যে এবং হতাশা দমনের চেষ্টায় হৈমন্তী বলল, অত ব্যস্ত হবার কী আছে, চলো আগে দেখি। জ্বর হলেই কি খারাপ ভাবতে হবে!
মালিনী বিড়বিড় করে কিছু বলল, তার কথা ভাল করে শোনা গেল না, মনে হল সে ভগবানের শরণাপন্ন হচ্ছে। ডান হাতের আলগা মুঠো বার বার কপালে ঠেকাতে লাগল, ঠোঁট নড়ছিল।
সুরেশ্বরের ঘরের বারান্দায় পা দেবার সময় হৈমন্তীর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল, হঠাৎ কেমন হাতে পায়ে অসাড় ভাব এল, বুকের মধ্যে ধক ধক করছিল। ভরতু বোকার মতন দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
সুরেশ্বর বিছানায় শুয়ে; গায়ের কম্বলটা গলা পর্যন্ত ঢাকা। পায়ের শব্দে চোখ খুলে তাকাল।
হৈমন্তী সুরেশ্বরকে লক্ষ করল। লক্ষ করার সময় তার দুরকম মনোভাব হল। প্রথম তার মনে হল, সে যে-সুরেশ্বরকে দেখছে, সেই সুরেশ্বর তার অতি অন্তরঙ্গ ও প্রিয় ছিল, যার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে যাবার পরও কোথাও যেন একটা বন্ধন আছে, দায়িত্ব। এই সুরেশ্বর তাকে ব্যাকুল, বিচলিত ও ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল। পরে, সামান্য পরে, বিছানার মাথার কাছে এসে পিঠ নুইয়ে সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় তার চোখের ওপর থেকে কয়েক মুহূর্তের আগেকার সুরেশ্বর যেন কোথায় অদৃশ্য হল, পরিবর্তে সে অসুস্থ এক রোগীকে দেখতে পাচ্ছিল। মিলিয়ে আসা ধোঁয়ার মতন পূর্বের আবেগ হয়তো ছিল সামান্য, কিন্তু এখন তা হৈমন্তীকে অত কাতর অথবা বিহ্বল করছিল না। সুরেশ্বরের মুখ লক্ষ করতে করতে হৈমন্তী হাত বাড়াল, কখন জ্বর এল?
মাঝরাতে– সুরেশ্বর বলল, বলে কম্বলের তলা থেকে হাত বের করে দিল।
হৈমন্তী সযত্নে, একটু বেশি সময় নিয়ে নাড়ি দেখল। হঠাৎ এল?
কাল সারাটা দিনই শরীরটা ভাল লাগছিল না। সন্ধের দিকে খুব শীত করছিল।
সুরেশ্বরের কপালে একবার হাত দিল হৈমন্তী, দেখল। থার্মোমিটার আছে এখানে?
না, সুরেশ্বর হাসবার মতন মুখ করল, ছিল একটা, ভেঙে গেছে।
হৈমন্তী মালিনীকে থার্মোমিটার আনতে পাঠাল। তার ঘরে থার্মোমিটার আছে, হাসপাতালে যেতে হবে না।
দেখি, বুকটা.. জড়ানো স্টেথস্কোপ খুলতে খুলতে হৈমন্তী বলল।
বুক পিঠ দেখল হৈমন্তী, জিব দেখল সুরেশ্বরের। এখনও শীত করছে?
কখনও-সখনও।
মাথার খুব যন্ত্রণা?
মাথাটা বড় ধরে আছে।
আর কী কষ্ট–?
গায়ে হাতে ব্যথা, কোমর পিঠে৷
হৈমন্তী কিছু ভাবছিল, বলল, দেখি, তোমার গা পিঠ দেখি আর-একবার।
সুরেশ্বর সকালে গায়ে জামা দিয়েছিল, জামাটা তুলল; হৈমন্তী নিজের হাতে সুরেশ্বরের গেঞ্জি তুলে গা পিঠ খুঁটিয়ে দেখল। দেখার সময় অকস্মাৎ তার মনে হল, সুরেশ্বরের গায়ের চামড়ায় যেন বয়সের নিষ্প্রভ এসেছে, অনেক ময়লা হয়ে গেছে রং।
সুরেশ্বর আবার গুছিয়ে গায়ে ঢাকা নিয়ে বসল।
হৈমন্তী বলল, দেখো, আবার চিকেন পক্স না হয়!
চিকেন পক্স!
দু তিনটে দিন না গেলে বোঝা মুশকিল। নয়তো, আর কিছু না; সর্দি-জ্বরের মতন মনে হচ্ছে।
সুরেশ্বর কয়েক মুহূর্ত হৈমন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। পরে বলল, এখানে আমার জ্বর জ্বালা আগে কখনও হয়নি। গত বছরে একবার হাঁপানির মতন হয়েছিল। কাল থেকেই কী রকম হাঁপ ধরছে, হাঁপানিটা আবার হবে না তো?
হৈমন্তী হ্যাঁ-না কিছু বলল না। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, এখন সে অনেকটা নিশ্চিন্ত। মালিনী যে রকমভাবে গিয়ে খবর দিয়েছিল তাতে ভয় পাবারই কথা।
সুরেশ্বর জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশ্বাস ফেলে মুখ ফেরাল সামান্য; বলল, হেম, আমার সত্যি লজ্জাই করছে; জ্বরটা আসার পর কেমন মনে হয়েছিল তোমায় আবার বুঝি বিব্রত করতে হল…। কিছুই তো বলা যায় না; জ্বর এসেছে দেখে দুশ্চিন্তাই হয়েছিল। এখন ভালই লাগছে; সর্দিজ্বর এমন-কিছু নয়।
হৈমন্তী কথাগুলো শুনল। তার মনে হল, সুরেশ্বর এখন বিব্রত হবার কথাও ভাবছে। কেন? সে কি ভেবেছিল, তেমন কিছু হলে হৈমন্তী আটকা পড়বে? হৈমন্তীকে তবে আর আটকে না রাখার ইচ্ছেই হয়েছে সুরেশ্বরের।
হৈমন্তী কী স্থির করেছিল সে কথা এখানে তোলার প্রয়োজন মনে করল না। সুরেশ্বরের এই জ্বর, এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, সাধারণ; এই জ্বরের জন্য তার আটকে পড়ার কোনও কারণ নেই। গগনকে অনায়াসেই হৈমন্তী কাল-পরশু নাগাদ চিঠি লিখতে পারবে।
সুরেশ্বর বলল, আমি আজই গগনকে চিঠি লিখব ভেবেছিলাম। …তুমি শীঘ্র যাচ্ছ–ওকে জানিয়ে দিতাম।
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখল। তা হলে তুমিও ভেবে নিয়েছ শেষ পর্যন্ত! যাক্, ভাল; ভালই হল। এখানে কৌতুক বা পরিহাস করা শোভা পায় না নয়তো হৈমন্তী হয়তো শুধোত, তোমার ডাক্তারের ব্যবস্থা তা হলে হয়ে গেছে!
কাল সুরেশ্বর বলল, আমি তোমায় আরও কয়েকটা দিন থাকার কথা বলছিলাম। পরে ঘরে ফিরে এসে আমার মনে হল, সত্যিই তোমাকে আর থাকতে বলা উচিত না।
হৈমন্তী অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল, সরাসরি মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখল না–আড়চোখে চকিতের জন্য একবার দেখে নিল। সুরেশ্বর কি অভিনয় করতেও শিখেছে! বরং কাল, সুরেশ্বরের স্বার্থচিন্তাও এমন কটু লাগছিল না হৈমন্তীর; এখন লাগছে। এখন মনে হচ্ছে, সুরেশ্বর বিনীত হবার এবং উদার হবার চেষ্টা করছে। এই উদারতার মধ্যে কৃত্রিমতা, বিনয়ের মধ্যে অক্ষমতা আছে। কী প্রয়োজন ছিল তোমার এসব কথা বলার! তোমার কী মনে হল, না হল, তাতে আমার যাওয়া আটকাচ্ছে না। আমি ফিরে যাচ্ছি। নিতান্ত তোমার মুখরক্ষা করার জন্য আরও দশ-পনেরোটা দিন আছি। তারপর আর নয়।
সুরেশ্বর বালিশে ভর দিয়ে আধশোয়া হল। বলল, কাল তুমি ঠিকই বলেছ, হেম। এখানে থাকলে তোমার অসুখ-বিসুখ হতে পারে; হলে সে দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। যদি কিছু হয়। এ-অসুখের কিছুই যখন ঠিক নেই তখন তোমার জীবনের দায়িত্ব আমার নেওয়া উচিত নয়। …আমি যা দিতে পারব না, তা আর নেব না।
জানলার কাঠ ছুঁয়ে রোদের পা সামান্য এগিয়েছে, দু-তিনটে চড়ুই একে অন্যের গা ঠুকরোতে ঠুকরোতে এবং কিচমিচ শব্দ করতে করতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পাক খেয়ে আবার ফরফর করে উড়ে গেল। যাবার সময় কার একটা পালক খসে গেল, পালকটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে সুরেশ্বরের বিছানার ওপর এসে পড়ল।
সুরেশ্বরের শেষ কথাগুলো হৈমন্তীর কানে লাগল, যেন অনেক কিছু লেখার পর রাবার দিয়ে আর সব মুছে শেষের কয়েকটা কথা রেখে দেওয়া আছে, আর ক্রমাগত কেউ তার উপর পেনসিল বুলিয়ে সেটা মোটা করছে। সুরেশ্বর কী বলতে চাইল? জীবনের দায়িত্বের কথাটা তুলে সে কি খুব সাবধানে এবং লুকিয়ে একটা খোঁচা দিল হৈমন্তীকে? সে কী বোঝাতে চাইল : সুরেশ্বর শুধু জীবন নয়, আরও কিছু–যেমন ভালবাসা দিতে পারবে না বলে ভালবাসা নেবে না!
নিজের ওপর হঠাৎ কেমন বিরক্ত হল হৈমন্তী। মনে হল, সে ছেলেমানুষের মতন যা-তা ভাবছে। ভালবাসার কথা আর ওঠে না। কীসের ভালবাসা! সুরেশ্বরকেই কি আর ভালবাসে হৈমন্তী? না। দেওয়া-নেওয়ার কথা অবান্তর।
হৈমন্তী বিরক্তির মধ্যেই বলল, আমি যাবার মোটামুটি সময় ঠিক করে ফেলেছি।
সুরেশ্বর যেন কথাটা শুনেও গা করল না। বলল, হেম, আমি কাল তোমায় বলেছিলাম–তোমায় আমি ছকের খুঁটি করিনি। রাত্রে আমি ভেবে দেখেছি, তুমি অন্যায় কথা বলোনি, ঠিকই বলেছ। সত্যিই ততা, আমার স্বার্থ ছাড়া তোমায় আমি আনব কেন? সামান্য চুপ করল সুরেশ্বর, পরে বলল, কাল তোমার অনেক কথাই আমার বড় লেগেছিল, হেম। কী জানি তুমি বলেছিলে বলেই লেগেছিল। মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। …যাকগে–ভালই হয়েছে। নিজেকে মাঝে মাঝে অন্যের চোখ দিয়েও দেখতে হয়। সুরেশ্বর এবার হাসবার চেষ্টা করল। সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, কথার শেষে বারকয়েক হাঁপাল, সর্দিতে গলা ভারী হয়ে আছে।
হৈমন্তী অস্বস্তি বোধ করে উঠে দাঁড়াল। মালিনী থার্মোমিটার আনতে গিয়ে হারিয়ে গেল নাকি! থার্মোমিটার খুঁজে পাচ্ছে না? কি মুশকিল, হৈমন্তী তো বলেই দিয়েছে টেবিলের ওপর সেলাই করার বাক্সের মধ্যে থার্মোমিটারটা আছে। তবু পাচ্ছে না! কথাটা কানে শুনেছে কি না মালিনী কে জানে! ওই রকমই ওর স্বভাব। বা, কে জানে থার্মোমিটার আনার ফাঁকে আরও সাত জায়গায় সুরেশ্বরের অসুখের খবরটা পৌঁছে দিয়ে আসছে কি না! হৈমন্তী অস্থির হয়ে জানলার দিকে গেল।
হৈমন্তীর চাঞ্চল্য লক্ষ করছিল সুরেশ্বর। বলল, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, না?
হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। জানলার কাছ থেকে হৈমন্তী বলল, গলার স্বর অনুচ্চ এবং বিরক্তি সত্ত্বেও কেমন উদাসীন।
তা হলে তুমি যাও। মালিনী এলে আমি জ্বর দেখে তোমায় খবর পাঠাব।
দেখি আর-একটু। …রুগি-টুগিও তো আসে না বড় একটা আজকাল.. হৈমন্তী মাঠে মালিনীতে দেখতে পেল। ছুটে ছুটে আসছে। ওই তো আসছে হৈমন্তী বলল।
অল্প পরেই মালিনী এল। তার মুখ দেখে মনে হল, কী একটা অপরাধ করে ফেলেছে। হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে থার্মোমিটার নিল, এত দেরি? বলার সময় হাতের থার্মোমিটারের খাপ দেখেই বুঝতে পারল, এই থার্মোমিটার তার নয়।
মালিনী মুখ নিচু করে অপরাধীর মতন বলল, আপনারটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।
হৈমন্তীর রাগ করা উচিত ছিল না; তবু তার কেমন রাগ হল। হুড়োহুড়ি করে আনতে গিয়ে যে মালিনী হাত থেকে থার্মোমিটার ফেলেছে তাতে সন্দেহ নেই। এত ছটফট করার কী আছে! সুরেশ্বরের জ্বর হয়েছে তার জন্য তুমি যে একেবারে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছ, যেন তোমার আর হাতে-পায়ে জোর নেই।
হাসপাতালের থার্মোমিটার ব্যবহার করার আগে হৈমন্তীর মন খুঁত খুঁত করল কিনা কে জানে, ধুয়ে মুছে সুরেশ্বরের দিকে বাড়িয়ে দিল।
জ্বর উঠল একশো এক। ছিটেফোঁটা বেশি; সেটা কিছু নয়।
হৈমন্তী সুরেশ্বরের দিকে আধা-আধি তাকিয়ে বলল, মালিনীর হাতে দু-একটা ওষুধ দিয়ে দিই। অল্পতেই সাবধান হওয়া ভাল। বলে মালিনীকে আসতে বলে চলে গেল। যাবার সময় সাবধান করে দিয়ে গেল, ঠাণ্ডা যেন না-লাগানো হয়।
বাইরে এসে মাঠ দিয়ে রোদে হেঁটে যেতে যেতে হৈমন্তীর এখন আর তেমন দুর্ভাবনা হচ্ছিল না। বরং কিছুক্ষণ আগে যে ভীষণ আতঙ্কের ভাবটা এসেছিল তা কেটে যাওয়ায় যেন মনস্থির করে ভাবতে পারছিল, চোখে দেখতে পাচ্ছিল। মাঠে অফুরন্ত রোদ, ঘাসের শিশির প্রায় শুকিয়ে এল, আকাশ নীল, আশ্রমের দু একজন সুরেশ্বরের ঘরের দিকে যাচ্ছে, তাদের কানে খবরটা যে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই, তাঁত-ঘরের দিকে কটা অন্ধ রোদ পোয়াচ্ছে, সবজি ক্ষেতে বুঝি জল দিচ্ছে কারা, কোণাকুণি বাতাসে গন্ধ ভেসে আসছে, কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে আসছে, দূরে শিমূল গাছটার পাতা হয়তো।
একটা কথা ভেবে হৈমন্তীর খুব অবাক লাগছিল। সুরেশ্বর আজ আগাগোড়া কীভাবে অম্লান বদনে সব স্বীকার করে গেল। কাল তার অন্য রকম কথাবার্তা ছিল, অন্য ধরনের যুক্তি, প্রতিবাদ; এমনকী কাল সে ক্ষুব্ধও হয়েছিল, আজ সকালে একেবারে আলাদা কথাবার্তা : মনে হল, রাতারাতি পালটে গেছে। সুরেশ্বর যে রাতারাতি অন্য মানুষ হয়ে যায়নি তা ঠিকই, বা তার কথাবার্তায় এতটা পালটে যাওয়া যে স্বাভাবিক তাও নয়, তবু-হৈমন্তীর মনে হল সুরেশ্বর যতই চাপা দেবার চেষ্টা করুক খানিকটা ঘা সে খেয়েছে। আজ সকালে যা করল, তা হল অনেকটা ভদ্রভাবে বিদায়-পর্ব সারা :বচসা, তর্কাতর্কি না করে, মনোমালিন্য আরও না বাড়িয়ে কাউকে বিদায় দেবার সময় আমরা যেমন বিনয় করে আচ্ছা আচ্ছা করি সে রকম। সুরেশ্বরের এটা স্বভাব; সে বিরোধের শেষ পর্যন্ত যেতে চায় না, তার আগেই প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে, হৈমন্তীর ধারণা, সুরেশ্বর তার স্বভাব মতন কাজ করেছে। তা ছাড়া সে বুঝতে পেরেছে জোর করে বলার মতন তার কিছু নেই, এমন একটাও যথার্থ কারণ সে দেখাতে পারবে না যা তার আচরণকে সমর্থন করবে।
হৈমন্তীর কেমন অদ্ভুত এক সুখ এবং দুঃখ হচ্ছিল। সুখ হচ্ছিল এই ভেবে যে, সুরেশ-মহারাজকে সে আহত ও ক্ষুণ্ণ করতে পেরেছে; শিক্ষা না হোক অন্তত বিব্রত ও কুণ্ঠিত করতে পেরেছে। তবু তো সব কথা-হৈমন্তীর মনে যা ছিল, যা ভাবে হৈমন্তী বলতে পারল না; নোকটার মনে যে আত্মমোহ, ভীরুতা, অহংকার, আধিপত্যের ভাব ছিল তা তাকে চিনিয়ে দেওয়া গেল না। দিলে ভাল হত। সে যে সঙ্গে সঙ্গে চিনে নিত তা নয়, তবু কাঁটার মতন বিধত। সেই জ্বালা সে ভোগ করত।
আবার হৈমন্তীর দুঃখ হচ্ছিল এই ভেবে যে, মানুষটা তার নিরাসক্ত, দৃঢ়, আত্মম্ভর চরিত্রবা চরিত্রের সেই ভান নষ্ট করে হঠাৎ যেন নিজেকে নুইয়ে দিল। বলতে গেলে, হৈমন্তী বেশ বুঝতে পারছিল, তার ঘায়ে সুরেশ্বর নুয়ে পড়েনি, ইচ্ছে করে নিজেকে অনেকটা নুইয়ে দিয়ে হৈমন্তীর সন্তোষ বিধান করল যেন। এরকম না করলেই সুখী হত হৈমন্তী। এক এক সময় এত সহজে নুয়ে পড়া দেখে মনে হয়, সুরেশ্বর যেন প্রতিপক্ষকে অযোগ্য মনে করে লড়ল না, মাথা অবনত করে উপহাস করল।
হৈমন্তী হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। রোগী দেখতে পেল না বারান্দায়। ফাঁকা পড়ে আছে সব। এই দৃশ্যও তার কেন যেন মনঃপূত হল না।
যুগলবাবুও বাইরে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। হৈমন্তী বুঝল, সুরেশ্বরের সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বিকেলের পর অবনী এল।
হৈমন্তী বলল, আসুন। এ কদিন কী হল। কাজ?
না অবনী মাথা নাড়ল হেসে, কাজের জন্যে অতটা নয়, গাড়িটা বিগড়ে গিয়েছিল।
ও গাড়ি আবার খারাপ হয় নাকি? হৈমন্তী হেসে বলল।
ঘরে এসে বসতে বসতে অবনী বলল, সব গাড়িই বিগড়োয়।
নিজের হাতেই বাতি জ্বালিয়ে নিল হৈমন্তী। সন্ধে হয়ে আসছে।
তারপর, কী খবর বলুন? অবনী শুধোল।
আপনাদের সুরেশ মহারাজের জ্বর, হৈমন্তী বলল।
জ্বর। অবনী চমকে উঠতে গিয়েও তেমন চমকাল না। হয়তো হৈমন্তীর গলার স্বরে কোনও গুরুত্ব না থাকায় এবং হালকা করে কথাটা বলায় অবনী অতটা আতঙ্কিত হল না। তবু সে উদ্বেগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
হৈমন্তী বলল, ভয়ের কিছু নয়; সর্দিজ্বর বলেই মনে হচ্ছে।
অবনীর চমকিত ভাবটা কাটল; চোখের পলক ফেলে দৃষ্টি হৈমন্তীর চোখের তলা থেকে নামাল।
সর্দিজ্বর।
তবে বলা যায় না, চিকেন পক্সও হতে পারে… এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কেমন আছেন এখন?
ভাল। দুপুরে জ্বর সামান্য বেড়েছিল, এখন বিকেলে দেখলাম, কমেছে।
কত?
একশো।
অবনী চুপ করে থাকল।
আপনি আমায় যা অপদস্থ করেছেন- হৈমন্তী সামান্য হেসে বলল, তিরস্কারও যেন রয়েছে।
অপদস্থ! কেন?
গগনকে আপনি চিঠি লিখেছেন?
লিখেছি। অবনী অবাক হচ্ছিল।
গগন আবার ওকে লিখেছে। … ও ভাবল, আমি গগনকে লিখেছি।
না, আমি লিখেছিলাম। …এখানে খুব প্যানিক। রোজই দু-চারটে করে মারা যাচ্ছে শুনি। অবনী চিন্তিত মুখে বলল।
আপনি কী যে লিখলেন, ও ভাবল–আমি এখান থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গগনকে লিখেছি। হৈমন্তী যেন এখনও এই বিষয়ে তার ক্ষুব্ধ ভাবটা সম্পূর্ণ ভুলতে পারেনি।
অবনী হৈমন্তীকে দেখতে দেখতে এবার পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলল, গগন আপনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে লিখেছে?
হ্যাঁ।
আমি তাই লিখেছিলাম।
হৈমন্তী এবার কৌতুক করেই বলল, গগন আবার আপনাকে আমার গার্জেন করে দিয়ে গেছে, কিছু তো আর বলা যাবে না।
অবনী কৌতুকটা উপভোগ করল হয়তো, গার্জেনের রেসপনসিবিলিটি বড় বেশি। …কিন্তু তা নয়। আপনি কি অবস্থাটা সব জানেন?
কী?
অবনী এবার আর হাসল না, বলল, এখান থেকে মাইল চার দূরে একটা গ্রাম আছে, মোটামুটি বড়ই, সেই গ্রামে দিন তিনেকের মধ্যে পাঁচজন মারাই গেছে, ভুগছে যে কত কে জানে! …ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার নয়। বিজলীবাবুর কাছে আমি খবরাখবর পাই, তাঁর বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টররা তো সারাটা তল্লাটে রোজ ঘুরছে, তাদের খবরে রিলাই করা যায়। …আপনি জানেন না কোনও কোনও গ্রাম থেকে তোক পালাচ্ছে।
হৈমন্তী শুনল। অবনীর উদ্বেগ অকারণ নয় হয়তো, কিন্তু গগনকে কি এইসব কথাও লিখেছে নাকি! সর্বনাশ, তা হলে বলা যায় না–কোনও রকমে মার কানে কথাটা উঠলে, হয় পত্রপাঠ ফিরে যাবার টেলিগ্রাম না হয় গগনকেই মা পাঠিয়ে দেবে তাকে নিয়ে যেতে। হৈমন্তী চোখ তুলে বলল, সর্বনাশ, আপনি কি গগনকে একথা লিখেছেন?
খানিকটা লিখেছি, অবনী হেসে ফেলে জবাব দিল।
দুপলক অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হৈমন্তী বলল, তা-ই। …এখন বুঝতে পারছি, গগন কেন অত তাড়া দিয়েছে।
অবনী কথা বলল না, ধোঁয়া গিলে আস্তে আস্তে নাক মুখ দিয়ে বের করতে লাগল।
খানিকটা চুপচাপ থাকার পর হৈমন্তী বলল, আমি তো যাচ্ছি।
অবনী তাকিয়ে থাকল, খুব একটা বিস্মিত হবার মতন কিছু যেন নয়, অথচ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিধা রয়েছে দৃষ্টিতে। যাচ্ছেন?
হ্যাঁ মাথা নাড়ল হৈমন্তী।
কখন?
দিন পনেরোর মধ্যেই। বলে হৈমন্তী আরও কিছু বলার জন্যে ঠোঁট ভেঙে তাকিয়ে থাকল; পরে কী মনে করে কিছু বলল না।
সুরেশ্বরবাবু জানেন?
হ্যাঁ–জানেন।
কিছু বললেন না?
প্রথমে আরও কিছু দিন থাকার কথা বলেছিল, পরে আর বলেনি। হৈমন্তী সামান্য বাঁকা হয়ে টেবিলের দিকে ঝুঁকে বাতির শিষ ঠিক করতে লাগল। আলো তার মুখে, চোখ নাক চিবুক আলোময় হয়েছিল, চুলের খোঁপা, ঘাড় পিঠ ছায়ায়। সোজা হয়ে বসতে বসতে এবার বলল, আগে যাবার কথা আমি কিছু ঠিক করিনি, বলিওনি; কিন্তু পরে ওর ভাবসাব দেখে আমার খারাপ লাগল। আরও আগে চলে যাওয়া উচিত ছিল, নেহাত– হৈমন্তী থেমে গেল, খানিকটা ঝোঁকের মাথায়, খানিকটা উন্মাবশে সে কথাটা বলে ফেলেছে। কাল থেকেই কথাটা সে ভুলতে পারছে না : সুরেশ্বর কী করে ধরে নিল হৈমন্তী প্রাণভয়ে ভীত হয়ে পালাতে চাইছে, কেনই বা সুরেশ্বর ঘুণাক্ষরেও হৈমন্তীকে নতুন ডাক্তার খোঁজার কথা জানায়নি! নিজেকে অন্তত এ ব্যাপারে এত অপমানিত ও আহত বোধ করেছে হৈমন্তী যে রাগ, অভিমান, অসম্মানের জ্বালা যেন কিছুতেই ভোলা যাচ্ছিল না। অন্য কাউকে কথাটা শোনানোর জন্যে তার ভেতর থেকে একটা উত্তেজনা ছিল। অবনীর কাছে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় হৈমন্তী আগে কখনও আলোচনা করত না, পরে কখনও কখনও নিজের বিরূপতা জানিয়েছে যদিও তবু সেই বিরূপতায় সুরেশ-মহারাজ ছিল, আশ্রম ছিল সুরেশ্বর ছিল না। তারপর ভাসাভাসাভাবে সুরেশ্বরও হয়তো এসেছে–তবু স্পষ্ট করে ধরাছোঁয়ার কিছু থাকত না। ইদানীং, বিশেষ করে সেদিন, মাদাউআলের সেই ইনসপেকশান বাংলোয় অবনী যেন আর কোনও অস্পষ্টতা না রেখেই সুরেশ্বরের কথা তুলেছিল, হৈমন্তী বাধা দেয়নি, দিতে পারেনি। সেদিনের পর ব্যক্তিগত কথাটা আর চাপা রাখার চেষ্টা অকারণ; বিসদৃশ বলেই যা উচ্চকণ্ঠে ওরা–অবনী বা হৈমন্তী কথাটা তোলে না, নয়তো মনে মনে আজ আর কোনও বাধা অনুভব করে না।
আজ, এখন হৈমন্তী সুরেশ্বরের ব্যবহারের প্রসঙ্গটা উম্মাবশে হঠাৎ তুলে ফেলার পর অনুভব করল, অবনীর কাছে কথাটা পুরোপুরি বলতেও তার দ্বিধা বা সঙ্কোচ হচ্ছে না। বরং বলার বাসনা জাগছে, ভাল লাগছে। হৈমন্তী বলল, আমি তাড়াতাড়ি চলে যাই এটা ওর ইচ্ছে ছিল না। আরও কিছুদিন থাকতে বলেছিল। …আশ্রমে আবার যদি কারও অসুখ-বিসুখ করে তাই রাখতে চেয়েছিল। …যে যার নিজের দিকটাই দেখে।
অবনী হৈমন্তীর আচরণের মধ্যে উত্তেজনা এবং বিরূপতা অনুভব করতে পারছিল। কিছু বলল না।
হৈমন্তী হঠাৎ বলল, আপনাদের সুরেশ-মহারাজ নতুন ডাক্তার আনছেন।
বললেন? অবনী যেন কথার কথা বলল।
কাল বললেন। …অনেক দিন থেকেই নাকি খোঁজাখুঁজি করছেন… হৈমন্তীর ঠোঁটের প্রান্ত কুঁচকে এল, চোখে কেমন উপহাস উপচে উঠছিল। আমাকে কেউ আর জানাননি অবশ্য, কিন্তু তলায় তলায় চিঠি লেখালেখি, বিজ্ঞাপন দেবার কথাও ভেবে রাখা হয়েছিল। নেহাত নাকি এই অসুখটা এসে পড়ায় সব গোলমাল হয়ে গেল। নয়তো, এতদিনে আমায় তাড়াতেন। কথার শেষে হৈমন্তী বিদ্রূপ করে হাসবার চেষ্টা করল, হাসল, অথচ সে হাসি করুণ দেখাল।
অবনী কী বলবে ভেবে পেল না। হৈমন্তীর কোথায় লেগেছে তা অনুমান করার চেষ্টা করে বুঝতে পারছিল : সম্মানে লেগেছে। লাগা অসম্ভব নয়। সে অক্ষম এই অপরাধে সুরেশ্বর নিশ্চয় নতুন ডাক্তারের খোঁজ করছে না, হৈমন্তীকে রাখা যাবে না বা হৈমন্তী থাকবে না বুঝেই হয়তো নতুন ডাক্তারের খোঁজ করছিল; কিন্তু হৈমন্তীকে কথাটা না জানিয়ে সুরেশ্বর ভাল করেনি। অবশ্য অবনী ভাবল, জানালেই কি হৈমন্তী প্রসন্ন হত?
হৈমন্তীকে শান্ত ও সুস্থির করার আশায় অবনী সামান্য হেসে হালকা গলায় বলল, না, আপনাকে তাড়াতেন না। ভদ্রলোক এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন নন। আপনি থাকবেন না বুঝেই একটা ব্যবস্থা করছিলেন আর কী!
হৈমন্তী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসার মুখ করল।
সামান্য সময় চুপচাপ আবার। অবনী শেষে বলল, সুরেশ্বরবাবুকে একবার দেখে আসা দরকার। …চলুন, যাবেন নাকি?
চা খেয়ে যাবেন না? বসুন একটু চা করে আনছি–মালিনী বোধ হয় এদিকে নেই। হৈমন্তী বলল : সামান্য অন্যমনস্ক, বোধ হয় এতক্ষণে তার খেয়াল হয়েছে সে খুব অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল, নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছিল এবার।
হৈমন্তী উঠছিল, অবনী বাধা দিল, বলল, এখন থাক, দেখাটা করে আসি, এসে চা খাব। আপনি যাবেন?
মাথা নাড়ল হৈমন্তী, না। আমি বিকেলেও গিয়েছি। আপনি ঘুরে আসুন।
অবনী কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল, যেন শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী মত বদলাতে পারে। পরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি তা হলে ঘুরে আসি।
.
সুরেশ্বরের ঘরের বারান্দায় ছোটখাটো ভিড় ভেঙে গিয়েছে, তারা কেউ সিঁড়িতে, কেউ বাগানে, কেউ বারান্দায় অবনী এসে পৌঁছল। শিবনন্দনজি তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অবনীর সঙ্গে চোখের পরিচয়, সরে দাঁড়িয়ে পথ দিলেন এবং নমস্কার জানালেন। অবনী মাথা সামান্য নিচু করে প্রতিনমস্কার জানাল, হাত তুলল না। কেমন আছেন সুরেশ্বরবাবু?
ভাল, শিবনন্দনজি জবাব দিলেন।
ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে অবনী শুনল শিবনন্দনজি বারান্দা দিয়ে নামতে নামতে কী যেন বলছেন অন্যদের : মনে হল তিনি কোনও বিষয়ে কিছু ব্যস্ত এবং ভেঙে যাওয়া ভিড়ের কাউকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কাউকে কোথাও থেকে আনা না-আনার কথা বলেই মনে হল।
মাঝের ঘরে লণ্ঠন জ্বলছিল। অবনী কয়েক পা এগিয়ে এসে ডাকল, সুরেশ্বরবাবু।
পাশের ঘর থেকে সুরেশ্বর সাড়া দিল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মালিনী ভেতরের বারান্দা থেকে ঘরে এল। মালিনী এবাড়িতেই আছে তা হলে।
মালিনী কিছু বলল না, কিন্তু এমন ভাব করল যেন অবনীকে পথ দেখিয়ে সুরেশ্বরের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে।
সুরেশ্বর বিছানার ওপর উঠে বসতে বসতে বলল, আসুন।
অবনী ঘরের মাঝামাঝি এসে বলল, কী হল মশাই, আপনি আবার জ্বর বাঁধিয়ে বসলেন কেন? ..কেমন আছেন?
ভাল। জ্বর বাঁধিয়ে সুরেশ্বর যেন অপ্রস্তুতে পড়েছে, সেই রকম হাসল একটু, বলল, বসুন। মালিনী, ওই চেয়ারটা… সুরেশ্বর মালিনীকে চেয়ার এগিয়ে দিতে বলছিল, তার আগেই অবনী নিজে চেয়ার টেনে নিল।
ঠাণ্ডা-টাণ্ডা লাগিয়েছেন খুব… অবনী বসতে বসতে বলল, কোল্ড ফিভার।
মালিনী ঘর ছেড়ে চলে গেল।
সুরেশ্বর বিছানার পাশ থেকে মোটা গরম চাদর টেনে নিয়ে গায়ে জড়াল, পায়ের দিকে কম্বল। বোধ হয় শুয়ে ছিল, অবনীর গলা পেয়ে উঠে বসেছে। বলল, হেম তো তাই বলছে, সর্দিজ্বর। আমার মনে হচ্ছে বেতোজ্বর–বলে সুরেশ্বর তার অসুখের প্রসঙ্গটা আরও লঘু করার চেষ্টা করল, বয়েস হচ্ছে, বাত ধরেছে। হাড়ে হাড়ে ব্যথা… হাসল। আপনাদের খবর কী? বিজলীবাবু কেমন আছেন?
ভাল, অবনী বলল, তার মনে হল সুরেশ্বরের চোখমুখ বেশ ফুলে আছে।
আপনাদের দিকে এখনও অসুখ-বিসুখটা ছড়ায়নি।
এক-আধটা দেখা দিয়েছে, শুরু বলতে পারেন।
সুরেশ্বর এমনভাবে তাকিয়ে থাকল, মনে হচ্ছিল যেন সে ভেবেছিল কোনও সুসংবাদ শুনবে, অথচ দুঃসংবাদ শুনল।
অবনী বলল–এই এরিয়ায় এরই মধ্যে কম করে আশি নব্বইটা এই রোগে মারা গেছে। কিন্তু দেখছেন না, কারও কোনও গা নেই। …এইভাবেই অসুখটা চলবে–আরও একশো দেড়শো মারা যাবে–তারপর নিজের থেকে থামবে। ততদিনে একটা ন্যাচারাল ইমিউনিটি গ্লো হয়ে যাবে মানুষের।
শুনেছি পাটনা থেকে কিছু ডাক্তার-টাক্তার আসছেন—
আসছেন…! আসুন আগে… অবনী যেন কথাটার কোনও গুরুত্ব দিল না।
সুরেশ্বর সামান্য সময় চুপ করে থেকে বলল, শিবনন্দনজি খবরটবর রাখেন, তিনি বলছিলেন আসবে, শীঘ্রিই আসবে। …হয়তো এই সপ্তার মধ্যেই।
আপনি বিশ্বাস করেন আসবে?
বিশ্বাস তো করতেই হয়।
আপনি একটু বেশি রকম বিশ্বাসী।
বিশ্বাস ছাড়া চলে কই। …হয় কাউকে না হয় কিছুকে তো বিশ্বাস করতেই হয়।
ঠকতেও হয়। হয় না? অবনী সুরেশ্বরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
সুরেশ্বর অবনীর দৃষ্টি থেকে কথাটার অর্থ হয়তো বুঝতে পারল। বলল, অনেকে তাই মনে করে।
আপনি করেন না?
সুরেশ্বর আস্তে মাথা নাড়ল, না–সে মনে করে না। বলল, আপনি যে ধরনের ঠকার কথা বলছেন, আমি তেমন কিছু ভাবছি না।
অবনীর ইচ্ছে হল বলে, আপনার হয়তো এমনও মনে হতে পারে আপনি কাউকে ঠকাচ্ছেন না!
অবনী সুরেশ্বরের অসুস্থ অথচ সংযত ধীরস্থির মুখভাব লক্ষ করতে করতে বলল, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনি আমাদের জীবনের খুব কমই দেখেছেন। …কখনও কিছু হারাননি, কিছু পাননি।
কিছু হারাইনি?
না; তেমন কিছু হারাননি; যে জিনিস হারালে মানুষ তার ক্ষতির মূল্য বোঝে অন্তত তেমন কিছু হারাননি।
সুরেশ্বর অপলকে অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখের তারা মুহূর্তের জন্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, যেন ফুলিঙ্গের স্পর্শ পেয়েছিল, পরে সেই উজ্জ্বলতা মরে গেল, দৃষ্টিতে অন্যমনস্কতা এবং বেদনার ভাব এল। চোখের পলক ফেলে সুরেশ্বর অন্যদিকে তাকাল। তারপর শান্ত গলায় মৃদুস্বরে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, বড় কিছুনা হারালে মানুষ নিজেকে বুঝতে পারে না। তার দুঃখ যন্ত্রণার বোধ থাকে না… সামান্য সময় নীরব থাকল; তারপর হঠাৎ বলল, আপনি কি কিছু হারিয়েছেন…
আমার কথা আলাদা– অবনী বলল, জন্ম থেকেই আমি হারের খেলা খেলছি। …ধাতে সয়ে গেছে। বলার পর সে কৌতুক অনুভবের ভান করে হাসার চেষ্টা করল।
সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে তাকাল। আপনি তা হলে খারাপ খেলোয়াড়। সুরেশ্বরও হাসবার চেষ্টা করল।
একেবারে রদ্দি। …এ ব্যাড প্লেয়ার উইথ এ ব্যাড লাক, স্যার। অবনী এবার সামান্য জোরেই হেসে উঠল।
সুরেশ্বর যেন না হেসে পারল না। হাসি থামলে বলল, মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে। …আজ শরীরটায় তেমন জুত নেই। আর একদিন যদি… বলতে বলতে সুরেশ্বর থামল, ভাবল, তারপর বলল, অবনীবাবু, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে পারলে ভাল হত। অন্য আর একদিন..
সুরেশ্বরের কথা শেষ হবার আগেই শিবনন্দনজি এলেন। সুরেশ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চিন্তিত। কিছু বলার আছে। প্রয়োজনীয় কথা। অবনীর জন্যে যেন বলতে পারছেন না।
অবনী উঠে পড়ল।
.
২৮.
দিন দুয়েক পরের কথা।
অবনী গুরুডিয়ায় আসছিল, সঙ্গে বিজলীবাবু। সুরেশ্বরের অসুখ শুনে বিজলীবাবু আসতে চেয়েছিলেন। আজ আসার পথে বাস-অফিস থেকে অবনী তাঁকে তুলে নিয়েছে।
বিকেল পড়ে গিয়েছিল, শীতের বাতাস বুঝি আজ সারাটা দিনই থেকে থেকে দিগভুল করে দক্ষিণ দিয়ে আসছিল, কয়েক ঝলক আসে আবার থেমে যায়, বাতাসে শিহরণ আছে, শীতের ধার নেই, ঈষৎ যেন উষ্ণ। ফাল্গনের মুখোমুখি এসে বাতাস বুঝি দোনা-মোনা করে কখনও মাঘ কখনও ফাল্গুনের মন রেখে বইছিল। রাস্তাটা শুকনো পাতায় ভরা, দুপাশে অজস্র ঝরা পাতা, গরগল গাছগুলোর মাথা প্রায় নিষ্পত্র হয়ে এল, মাঠেঘাটে ধুলো উঠছে, ঝোপঝাড়গুলো ধূসর, বিজলীবাবু কখন যেন ঝোপ থেকে বুনো কুলের গন্ধ পেয়ে নাক টেনে গন্ধ নিলেন।
যাই যাই করেও বিকেলটা কিছুক্ষণ ছিল, তারপর অপরাহ্ন ফুরোল।
বিজলীবাবু বললেন, শীতটা এবার গেল মিত্তিরসাহেব; আর কটা দিন।
অবনী মুখে কিছু বলল না, বার দুই ঘাড় নাড়ল আস্তে, অর্থাৎ, হ্যাঁ, শীত যাচ্ছে।
বিজলীবাবু দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে কাঠিটা ফেলে দিলেন। ইদানীং পানের সঙ্গে তিনি যে নতুন জরদাটা খাচ্ছেন সেটা নেশার পক্ষে জুতের নয়, কিন্তু গন্ধটা ভাল। নিজের মুখের গন্ধ যেন নিজেকেই মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দেয়। বিজলীবাবু বোধহয় মুহূর্ত কয় মুখ হাঁ করে সেই গন্ধ নিচ্ছিলেন, তারপর নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই মুখ বন্ধ করে হেসে ফেললেন। বললেন, মিত্তিরসাহেব, একটু পান-টান অভ্যেস করুন। … জীবনটা একেবারে বিধবার ঠোঁট করে রাখলেন…!
অবনী হেসে জবাব দিল, পানের অভ্যেস তো আমার আছে, বিজলীবাবু।
বিজলীবাবু নিজের ভুলটুকু যেন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন। বললেন, আরে না, সে হল কি না জলপান, আর এ হল স্থল পান। বলে বিজলীবাবু হাসতেই থাকলেন; পরে আবার বললেন, পানের কত রকমফের আছে জানেন?
অবনী মাথা নাড়ল; জানে না।
বিজলীবাবু একটা ছড়া কাটলেন, তার খানিকটা হিন্দি হিন্দি শোনাল, বাকিটা উর্দু-টুর্দু হবে। বললেন, আয়ুর্বেদের অনুপানের মতন নানা অনুপান আছে পানের; অনুপান মেশালে কোনও পানে মন-সুখ কোনও পানে রতিসুখ। বলে হাসতে লাগলেন।
বিজলীবাবুর যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান মাঝে মাঝে অবনীকে চমৎকৃত করে। আপাতত সে তেমন চমৎকৃত হল না, পানশাস্ত্রে আপনি বরাবরই পণ্ডিত।
শাস্ত্র-টাস্ত্র না, এ হল নিজের মুখে ঝাল খাওয়া। সমঝদার হলে বুঝতেন।
পরিহাসটা অবনী উপভোগ করল কি না বোঝা গেল না।
বিজলীবাবু অল্পসময় যেন অবনীর জবাবের অপেক্ষায় থাকলেন, তারপর সহাস্যমুখে বললেন, কথাটা আপনার মনে ধরল না মিত্তিরসাহেব; কিন্তু যা বললাম–এ হল খাঁটি কথা।
অবনী হাসল না; সামনাসামনি একটা গাড়ি এসে পড়েছে, স্টেশন ওয়াগন; রাস্তার দিকে চোখ রাখল।
বিজলীবাবু পকেট থেকে তাঁর সিগারেট কেস বের করছিলেন।
মুখোমুখি গাড়িটা পাশ কাটাল : অবনীর মনে হল গাড়িটা সে টাউনে অনেকবার দেখেছে, সরকারি গাড়ি, গাড়ির মধ্যে বেশ কয়েকজন যেন ছিল।
নিজের হাতে পাকানো সিগারেটের একটা নেড়েচেড়ে বেছে নিয়ে বিজলীবাবু দেশলাই জ্বাললেন। সিগারেটের অল্প একটু ধোঁয়া গলায় টেনে নিয়ে সামান্য পরে বললেন, আপনি যতই কেননা বলুন মিত্তিরসাহেব, এক হা