• বইয়ের নামঃ সরস গল্প
  • লেখকের নামঃ বিমল কর
  • প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
  • বিভাগসমূহঃগল্প

 অভিলাষী

জলধর মুখুজ্যে এসে বললেন, “তোমরা এখনও বসে আছ! ওদিকে যে বাসুকী ফণা নেড়েছেন।”

পশুপতি আর হাবুল সেন দাবা নিয়ে তন্ময়। সাধন একটা পুরনো রিডার্স ডাইজেস্ট নিয়ে আধশোয়া হয়ে চুরুট টানছিলেন।

মুখ তুলে সাধন বললেন, “তোমার যে কী ভাষা! যত্ত সব। হেঁয়ালি ছেড়ে কথা বলতে শিখলে না!”

জলধর তাঁর কাঁধে ঝোলানো ফ্লাস্ক নামিয়ে রেখে সোফায় বসলেন। পানের ডিবেটাও পকেট থেকে বার করে পাশে রাখলেন। বললেন, “কদম্ব মিত্তির এসেছে, সঙ্গে এবার অভিলাষী।”

কদম্ব মিত্তিরের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে পশুপতিদের দাবার ঘোড়া চাল ভুলে গেল, নৌকো টলমল করে উঠল। সাধন অবাক হয়ে বললেন, “কদম্ব মিত্তির এসেছে! কে বলল?”

“আমি বলছি, আবার কে বলবে!” জলধর বললেন।

সাধন, পশুপতি, হাবুল—মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। পশুপতি বললেন, “আসার কথা ছিল, তবে সে তো বর্ষা পড়লে।”

“বর্ষা পড়া পর্যন্ত তর সইল না,” জলধর বললেন, “আগে আগে চলে এসেছেন। অভিলাষীর ইচ্ছে।” বলে জলধর মুচকি হাসলেন। পাকা গোঁফের পাশ দিয়ে হাসিটা থুতনিতে গড়িয়ে পড়ল যেন।

পশুপতি বললেন, “অভিলাষী মানে?”

জলধর বললেন, “মেয়েছেলে!”

কয়েক মুহূর্ত সবাই কেমন হতভম্ব। তারপর নাকচোখ কুঁচকে সাধন বললেন, “ছ্যা ছ্যা! বুড়ো বয়েসে তোমার মুখ যা হয়েছে। মেয়েছেলে টেয়েছেলে কী বলছ?”

জলধর দু দণ্ড সাধনের দিকে তাকিয়ে থেকে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করলেন। বললেন, “আমার মুখকে বিশ্বাস করতে হবে না। এটা পড়ছি। শোনো।” বলে জলধর চিরকুট পড়তে লাগলেন: “জলধরবাবু, গতকাল টুয়েন্টি ওয়ান আপ-এ আমি আসিয়া পৌছিয়াছি। ঘর বাড়ি নরক হইয়া ছিল। ফকির মস্ত ফাঁকিবাজ। সে যে কিছুই করে না বুঝিতে পারিলাম। যাহা হোক, সকালে ঘরদোর ভদ্রস্থ করা গিয়াছে। আপনি অন্যদের আমার খবর জানাইবেন ও সন্ধ্যায় আসিবেন। আপনাদের এক নতুন জিনিস দেখাইব। আমার সঙ্গে এক অভিলাষী আসিয়াছেন। এমন অদ্ভুত স্ত্রীলোক আপনারা দেখেন নাই। ইহার স্পিরিচুয়াল ক্ষমতা দেখিলে অবাক হইয়া যাইবেন। পারিলে আজ সন্ধ্যায় সকলে আসুন। বাগানের ফ্রেশ টি এবং জাহাজ হইতে খালাস করা জিনিসপত্র আনিয়াছি। অপেক্ষায় থাকি। ইতি কে. ডি.।।”

দাবার চাল ভুলে পশুপতিরা জলধরের চিঠিপড়া শুনছিলেন। জলধর চিঠি পড়া শেষ করে বললেন, “নাও শুনলে তো। আর কিছু বলার আছে?”

হাবুল বললেন, “রহস্য তো আরও ঘনীভূত হয়ে গেল, জলধরদা। স্ত্রীলোক, অভিলাষী, ক্ষমতা…ব্যাপারটা কি?”

“ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করতে হলে কদম্বকাননে যেতে হয়। চলো সবাই।”

সাধন ওয়াল-ক্লকের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সাতটা বাজতে চলেছে। কদম্ব মিত্তিরের বাড়ি মাইল খানেকের বেশি। হাবুল তার ছ্যাকড়া গাড়িটাও আনেনি, আনলে তবু চেষ্টা করা যেত; এখন আর এতটা পথ উজিয়ে যাওয়া যায় না। সে-বয়েস তাঁদের আর নেই, অন্তত তিনজনের, হাবুলকে বাদ দিলে অন্যরা সকলেই যাটের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছেন, হাবুলই ষাট ধরো-ধরো করছে।

সাধন বললেন, “এখন আর কেমন করে যাবে? সাতটা বাজতে চলল। রাস্তা তো কম নয়।…তোমাকেও বলি জলধর, তুমিই বা করছিলে কী! আগেভাগে খবর দিতে পারোনি?”

জলধর বললেন “কেমন করে দেব। এই চিঠিই আমি পেয়েছি বেশ বেলায়। ফকির দিয়ে গেল। যা গরম আর লু তখন তো আর গামছা মাথায় দিয়ে বাড়ি বাড়ি খবর দেওয়া যায় না। চারটে সাড়ে চারটে পর্যন্ত লু ছুটল। তেমনি হলকা। রোদ পড়তে গা হাত ধুয়ে মুছে বেরুব, গিন্নি ঘেমেনেয়ে বমি করে এক কাণ্ড বাঁধিয়ে তুলল।”

পশুপতি ভুরু কুঁচকে বললেন, “বমি? এই বয়েসে তোমার গিন্নির বমি হয় নাকি?”

জলধর খোঁচাটা হজম করলেন না, বললেন “হয় হয়, এখনও হয়; এ গিন্নি তো প্লাস্টিকের খেলনা নয় পশুপতি, হাড়ে-মজ্জায় মেদে বিরাশি কেজি। পিঁড়ি পেতে বসলে ঘর জুড়ে যায়।…যাক যে, গরমের দিন, টক-ডাল টক দই—এ সব খেয়েছিল খুব। অম্বলে উল্টে দিল। দু ডোজ ইপিকাক দিয়ে গিন্নিকে জুত করে দিয়ে আসছি।”

পশুপতি মুখ টিপে বললেন, “বউদির কি ইপিকাক সিম্পটম?”

“তুমি কি অন্য সিম্পটম দেখেছ?”

পশুপতি হো-হো করে হেসে উঠলেন। অনন্যরাও।

হাসি থামলে হাবুল বললেন, “আজ তা হলে যাওয়া হচ্ছে না?”

“না, আজ আর কেমন করে হবে?”

“তা হলে কাল খানিকটা বিকেল বিকেল যাওয়াই ভাল।”

সায় দিলেন সবাই।

জলধর বললেন, “আমি একটা খবর পাঠিয়ে দেব মিত্তির মশাইকে; সকালেই। বিকেলে সব যাচ্ছি।”

“হ্যাঁ”, পশুপতি বললেন, “যাচ্ছি সবাই। তবে আমি ভাবছি, কদম্ব মিত্তিরের অভিলাষীকে দর্শন করতে শুধু হাতে যাই কেমন করে? বাগানে বড় সাইজের পেঁপে পেকেছে কটা, নিয়ে যাব নাকি?”

জলধর বললেন, “নিয়ে যেতে পারো। তবে অভিলাষী দর্শনের পক্ষে পাকা বেলই ভাল হত।”

হাবুল অট্টহাস্য হেসে উঠলেন। সাধনও বাদ গেলেন না। পশুপতির মুখ দেখে মনে হল, জলধরের পালটা জবাবে তাঁর প্রসন্নতা বেড়েছে ছাড়া কমেনি। ছোট করে শুধু বললেন, “তোমার গাছ থেকে ধার দিও; আমার বাগানে বাপু বেলগাছ নেই।”

আবার খানিকটা হাসাহাসি হল।

আড্ডাটা বসেছিল সাধনের বাড়িতে, বসার ঘরে। এটা হল চার প্রবীণ বা বৃদ্ধের সাবেকি আড্ডাখানা। সন্ধের মুখে রোজই বসে। অসুখ বিসুখ না থাকলে চারজনেই হাজির থাকেন। অন্য দু একজনও আসেন মাঝেসাঝে—তবে তাঁরা নিয়মিত সদস্য নন, এঁরা চারজন নিয়মিত।

সাধনবাবুর বাড়িতে মানুষ বলতে তিনি এবং তাঁর জগন্নাথ। ভদ্রলোক বিপত্নীক। জগন্নাথের হাতেই খাওয়া-পরা, ঘরদোর সংসার। সন্তান বলতে একটি মেয়ে। মেয়ে-জামাই নিজেদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার ফেঁদে আছে ডালমিয়ানগরে। সাধন হলেন শিষ্টগোছের মানুষ। কথা খানিকটা সমঝে বলেন; ধর্মে টান এবং মাঝারি অর্শ-ব্যামো দুই-ই দেখা দিয়েছে স্ত্রীর অবর্তমানে। চোখ দুটি আজকাল অন্যমনস্ক ও উদাস হয়ে উঠছে দিন দিন। বয়স বাষট্টি। স্বাস্থ্য মাঝারি।

সাধনের খুব ঘনিষ্ঠ হলেন জলধর। দুজনে কেমন একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও আছে। সম্পর্কে সাধন জলধরের শালা। জলধর তড়বড়ে মানুষ। চৌষট্টি বছর বয়েসেও বাইক চাপতে পারেন, লাল আটার রুটি আর ছোলা সেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারেন, তিন পোয়া দুধ এখনও রাত্রে তাঁর বরাদ্দ, গলার স্বর গমগম করে। স্বাস্থ্যটি দেখলে মনে হয় না, বয়েস তাঁকে তেমন কাবু করতে পেরেছে। গায়ের রং কালো। মাথায় বারো আনা টাক, চার আনা চুল—সবই সাদা। জলধরের সামান্য সন্ধ্যাপূজার ব্যবস্থা আছে। নিত্যই তিনি যে পেটমোটা ফ্লাস্কটি বয়ে আনেন—তার মধ্যে হরি শাহ-এর দোকানের দিশি মদ্য থাকে। একেবারে আনুপাতিক হারে জল মেশানো। এই বস্তুটি তিনি সাধনের বাড়িতে বসে খান। গল্প করেন। পান চিবোন। সিগারেট টানেন। এবং বলা বাহুল্য বৃদ্ধদের এই সান্ধ্য মজলিস সজীব করে রাখেন।

পশুপতি জলধরেরই সমবয়সী। মাস কয়েকের ছোট হতে পারেন। জলধর যখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন পশুপতি তখন জিয়োলজিস্ট হিসেবে কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেছেন। সেই সূত্রে প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় পরে বন্ধুত্বের পর্যায়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের সাংসারিক কুশল বিনিময় এবং সুখ-দুঃখের পত্রালাপ চলত দূর থেকেও। অনেক পরে পশুপতি এসে বাসা বাঁধলেন এই ছোট শহরে, জলধরেরই কথায়। মানুষ হিসেবে শৌখিন, সদাশয় এবং সদাতৃপ্ত। চেহারাটি চমৎকার। বোঝা যায়—একসময়ে রূপবান পুরুষ ছিলেন। এখন আধিব্যাধি ভর করেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেয়াড়া হল, হাঁপানি। বর্ষা আর প্রথম শীতটায় পশুপতি কাবু হয়ে পড়েন। হাঁপানি ছাড়া অন্য ব্যাধিটা হল ডায়েবেটিস। তবে এটা মারাত্মক নয়। পশুপতির এক ছেলে কানপুরে, অন্য ছেলে পাটনায়। বাড়িতে পশুপতি আর তাঁর স্ত্রী। জলধরের ছেলেও পাটনায়। সেদিন থেকে পশুপতি অনেকটা নিশ্চিন্ত।

হাবুল সেন—সবার চেয়ে বয়েসে ছোট। ষাটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা, মাথার চুলগুলো সব সাদা। খানিকটা যেন চুল পাকিয়ে বুড়োর দলে ঢুকেছেন বলে মনে হয়। ব্যবসাদার মানুষ। শেড কনস্ট্রাকশান-এর কাজে নাম আছে। ছোট ভাই ব্যবসা দেখে, আর হাবুল সেন জোগাড়যন্তর করেন। হাবুলের স্ত্রী কলকাতার কাগজে কবিতা লেখেন। হাবুল বলেন, “হিস্টিরিয়া সেরে যাবার পর থেকে ওটা হয়েছে।”সন্তানাদি নেই।

চারজনের পরিচয়টুকু মোটামুটি দিয়ে রাখা গেল। এর পর যিনি—তিনি হলেন কদম্ব মিত্তির। তাঁকে নিয়েই জলধরের সন্ধেবেলার আড্ডাখানা আজ জমে উঠল।

জলধর হাঁক ছেড়ে জগন্নাথকে গ্লাস আনতে বললেন। তারপর পশুপতিকে জিজ্ঞেস করলেন, “অভিলাষী জিনিসটা কী—তুমি জান?”

পশুপতি মাথা নাড়লেন, জানেন না।

জলধর বললেন, “সংসারে কিছুই জানলে না। তোমাদের দিয়ে কোনো উপকারটিই হল না জগতের।” বলে জলধর অবজ্ঞার মুখভঙ্গি করলেন।

পশুপতি বললেন, “তুমিই বলো। জগৎ উদ্ধার করতে তুমিই অবতার রূপে এসেছ জলধরবাবু, তুমিই বলো।”

জলধর কোনো কথা বললেন না। স্কুলে মাস্টারমশাইয়রা যেমন ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রশ্ন শুধিয়ে সেইভাবে অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

সাধন বললেন, “আমি কখনো কথাটা শুনিনি। স্ত্রীলোক যখন স্পিরিচুয়াল তখন উঁচু দরের কিছু হবে।”

হাবুল বললেন, “কদম্বদা এর আগে একবার এক ফিরিঙ্গি বুড়ি এনেছিলেন মনে আছে? সে নাকি কদম্বদাকে রান্না শেখাত।”

এমন সময় জগন্নাথ কাচে গ্লাস দিতে এল।

পশুপতিরা এ-সময় চা-টা খান। জগন্নাথ ইশারায় কে কে চা খাবেন জেনে নিয়ে চলে গেল।

জলধর ফ্লাস্কের ঢাকনা খুলতে খুলতে বললেন, “কদম্ব এটিকে কি-শেখাতে এনেছে কে জানে!”

পশুপতি বললেন, “শেখার কি শেষ আছে জীবনে! তা যাক, তুমি বাপু মানেটা বলো তো?”

জলধর ফ্লাস্ক থেকে হরি শা ঢেলে নিলেন। গন্ধ ছুটল। আঙুল আলতো করে গ্লাসে ডুবিয়ে আঙুল তুলে নিলেন। বার তিনেক জল ছিটিয়ে দিলেন বাতাসে। উৎসর্গ করলেন। তারপর বললেন “মানে আর কী! কদম্ব মিত্তিরের ইয়ে, মানে ওই পোষা স্ত্রীলোক গোছের কিছু। ঠিক মানেটা হাবুলের বউ জানতে পারে, পদ্য লেখে বউমা।”

পশুপতি খোঁচা মেরে বললেন, “তোমার বিদ্যেতেও কুলল না। যাক বাঁচা গেল।”

দুই

পরের দিন সন্ধের আগে আগেই চারজন কদম্ব মিত্তিরের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। হাবুল সেন তাঁর গাড়িটা নিয়েছিলেন। চারজনের পক্ষে যথেষ্ট। এখনও টানতে পারে বিলিতি গাড়িটা।

কদম্ব বাইরেই পায়চারি করছিলেন। মালিকে বোঝাচ্ছিলেন—বর্ষার গোড়ায় বাগানে কোন কোন গাছ লাগাতে হবে। বন্ধুদের দেখে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন, “আসুন আসুন।”

জলধর বললেন, “কালকে আর হয়ে উঠল না। আজ সব জুটিয়ে আনলাম। কেমন আছেন?”

“চমৎকার। কেমন দেখছেন আপনারা?”

“ভালই। চেহারায় ফ্রেশনেস এসেছে।”

“আসবে না! যার হাতে পড়েছি।” কদম্ব খুশি খুশি মুখ করলেন।

জলধর আর পশুপতি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কদম্ব কার হাতে পড়েছেন বোঝা যাচ্ছে। অভিলাষীর। কিন্তু তিনি কে? কোথায় তিনি?

কদম্ব বললেন, “চলুন আমরা বসার ঘরেই বসি। বাইরে মশা।”

সাধন বললেন, “আপনার বাগানে গাছপালা বেঁচে আছে দেখছি। এবার যা গরম গেল। বিশ পঁচিশ বছরের মধ্যে এমন গরম দেখা যায়নি। মাঠঘাট খাঁখাঁ করছে মশাই, কুয়ায় জল শুকিয়ে গিয়েছে। লাস্ট উইকে দিন দুই বৃষ্টি নামল। কালবৈশাখীর পর। তাতেই যা অবস্থাটা সহ্যের মতন হয়েছে।”

কদম্ব বলল, “শুনলাম সব। আমার বাগানের বারো আনা ওই মালি সাবাড় করে দিয়েছে। এ যা দেখছেন এ হল চার আনা। দেখছেন না, আমার মতিবাগের বেলঝাড়ে ফুলের চিহ্নমাত্র নেই, দু-চারটে যা ফুটে আছে তাতে কোনো গন্ধই পাবেন না। বাগানের জন্যে আমার আলাদা কুয়ো, অবশ্য তাতে পাম্প নেই। বেটা এক বালতি জলও ঢালত না রোজ। সব কটা ফাঁকিবাজ। আসুন—।”

বাগান থেকে বারান্দা, বারান্দা দিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন সকলে। ততক্ষণে বাড়ির চাকর-বাকর খবর পেয়ে গেছে। ফকির এসে ঘরের আলো জ্বালিয়ে পাখা চালিয়ে দিল।

জলধর বললেন, “আপনার আসার কথা ছিল বর্ষা পড়লে, আগে আগেই চলে এলেন?”

‘বর্ষা পর্যন্ত ওয়েট করতে পারলাম না,” কদম্ব বললেন, “একটা জাহাজ ভিড়েছিল মশাই ডকে, দেড় মাস কালঘাম ছুটিয়ে দিল। এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট বিলকুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। আমাদের কোম্পানির মেকানিকদের বারো চোদ্দো ঘণ্টা করে পরিশ্রম। আমারও দুশ্চিন্তা। যা গে, কাজটা শেষ হতে মনে হল, ফিলিং টায়ার্ড। চলে এলাম।” বলে কদম্ব পকেট থেকে সিগারেট কেস বার করলেন, লাইটার, তারপর সামান্য গলা নামিয়ে স্বর পাল্টে বললেন, “তা ছাড়া উনি—মানে ওঁর ঠিক কলকাতার ভ্যাপসা গরম সহ্য হচ্ছিল না। গলায় ঘামাচি বেরুতে লাগল।”

“ওঁর মানে, এই কি যেন—অভিলাষীর?” পশুপতি বললেন।

সিগারেট কেসের ওপর একটা সিগারেট ঠুকতে ঠুকতে কদম্ব বললেন, “হ্যাঁ।”

পশুপতি আড়চোখে জলধরকে দেখলেন একবার, তারপর কদম্বকেই জিজ্ঞেস করলেন, “এখানকার গরমে আরও কষ্ট হবে না?”

“না না,” মাথা নাড়লেন কদম্ব, “এখানকার গরম ড্রাই গরম, নট লাইক বেঙ্গল। উনি তো নেপাল আর বিহার বর্ডারের মানুষ। কড়া শীত, রুক্ষ গরম—দুটোতেই মানাতে পারেন।”

হবুল বলল, “নেপালের লোক নাকি?”

“মিক্সি টাইপের!” কদম্ব সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিলেন, “নেপালি, বিহারি, বাঙালি, তিনেরই ট্রেস পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে সি ইজ সামথিং ভেরি স্পেশ্যাল। এমন দেখা যায় না। রেয়ার। সাম স্ট্রেঞ্জ পাওয়ার রয়েছে। সাইকিক পাওয়ার।” কদম্ব প্রশংসার গলায় বললেন।

জলধররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

“আপনারা একটু বসুন,” কদম্ব বললেন, “আমি আসছি।”

কদম্ব ঘর ছেড়ে চলে গেলে জলধর বললেন, “সাধন, এ যে দেখছি তে-আঁশলা। ভয়ংকর একটা কিছু হবে, কী বলো!”

সাধন কোনো জবাব দিলেন না। কদম্বর বসার ঘরের চারদিকে চোখ বোলাতে লাগলেন।

কদম্ব মিত্তির সম্পর্কে দু-চার কথা এখানে বলা দরকার। কদম্বর পোশাকি নাম কৃষ্ণধন মিত্র; ইংরেজিতে কে ডি এম; কদম্ব পুরোটা আর লেখেন না, শুধু কে ডি দিয়ে কাজ সারেন। কৃষ্ণধনের সঙ্গে কদম্বের কোনো সম্পর্ক নেই, তবু কেমন করে কদম্ব নামটা চলে গিয়েছিল বলা মুশকিল। কদম্ব দেখতে সুপুরুষ বা কুপুরুষ—কোনোটাই নয়। মাথায় সাধারণ, না লম্বা না বেঁটে; স্বাস্থ্য মাঝারি, গায়ের রং খুবই ফরসা, মাথার চুল কাঁচাপাকা এবং খানিকটা খোঁচা খোঁচা। কদম্বর চুল ছাঁটার ধরনটা হল নেভি কাট। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমায় তাঁকে অভিজাতই দেখায়, সাজপোশাকে তাঁর বিত্তও বোঝা যায়। কদম্ব এখনও ষাটে পৌঁছননি—, তবে আর দু-চার মাস, ষাটে পৌছলেই কদম্ব কর্মজীবন থেকে ইস্তফা দিয়ে পাকাপাকিভাবে এখানে এসে বসবেন। মনে মনে এটা ছকে নিয়েই কদম্ব বছর চার পাঁচ আগে থাকতেই এই বাড়ির কাজে হাত দেন। অনেকটা জমি, ফলফুলের বাগান এবং নিরিবিলি বসবাস—এই তিন দিকেই তাঁর নজর ছিল। মোটামুটি সবই জুটেছে। টাকা থাকলে কী না জোটে। অর্থ এবং উদ্যম কদম্ব দুইই আছে।

কদম্বরা হলেন কলকাতার বনেদি পরিবার। শাখাপ্রশাখায় কদম্ব পরিবার নানা দিকে ছড়ানো, তবে কদম্ব নিজে বরাবরই খানিকটা একাকী। পিতৃদত্ত ব্যবসা ছাড়া তিনি অন্য কিছু নেননি পরিবারের, এমন কি ভবানীপুরে যে বাড়িতে থাকেন সেটাও একরকম তাঁর স্বোপার্জিত অর্থে রূপান্তর করা হয়েছে। কদম্ব হলেন ব্যাচেলার। বত্রিশ বছর বয়েসে একবার, আর চল্লিশে আর-একবার তাঁর বিয়েতে মন গিয়েছিল—কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনকে বশ করে ফেলেন। কদম্বর কলকাতার বন্ধুরা বলেন, প্রথমবার কদম্ব পাত্রীর পূর্ব প্রণয়োপাখ্যানের ইতিবৃত্ত জানতে পেরে সরে আসেন, আর দ্বিতীয়বার স্পষ্টই বুঝতে পারেন, পাত্রী তিন দাঁতের এক নকল সেট পরেন। কদম্ব এর পর আর বিয়ের দিকে ঝোঁকেননি। না ঝুঁকলেও ঘরোয়া ব্যাপারে তাঁর বেশ মন রয়েছে। যেমন ঘরদোর সাজিয়ে ফিটফাট রাখায় কদম্বর বিশেষ নজর, খাওয়া-দাওয়ায় হরেকরকম শখ, বন্ধুবান্ধবদের ডেকে ডেকে নানান ধরনের খানা তৈরি করিয়ে খাওয়াতেও ভালবাসেন, তাঁর বাড়িতে বন্ধুদের আড্ডা গল্পগুজবেরও ঢালাও ব্যবস্থা থাকে।

সোজা কথায়, কদম্ব ব্যাচেলার হলেও গৃহবিবাগী নন, তাঁর গাল তোবড়ায়নি, চোখ হলুদ হয়নি, কৌমার্যের দাঁত ভোঁতা করে তিনি দিব্যি ঘাটে এসে পা দিচ্ছেন।

মানুষটি চেহারায় তেমন চোখ জুড়োনো হয়ত নয়, কিন্তু ব্যবহারে সুজন। অহমিকা না থাক আভিজাত্য রয়েছে। সকলের সঙ্গে মেশেন না, গলাগলিও করেন না। কিন্তু পছন্দ করে যাঁদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাঁদের সঙ্গে আলাপে-বিলাপে কোনো আড়াল বিশেষ রাখেন না।

জলধররা হলেন কদম্বর এইরকম পছন্দের বন্ধু। এর মধ্যে জলধরই এক নম্বর ফেভারিট।

পশুপতি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

কদম্ব ঘরে এলেন। এসে বললেন, “উনি আসছেন। সামান্য দেরি হবে। তার আগে আপনারা চা-টা খান।”

তিন

চায়ের সঙ্গে কলকাতার মিষ্টি আর ডিমের সিঙাড়া খেতে খেতে জলধর বললেন, “মিত্তিরমশাই, একটা ব্যাপারে আমাদের খটকা লেগেছে!”

কদম্ব বললেন, “কি ব্যাপার?”

জলধর পশুপতিদের দেখে নিয়ে বললেন, “এরা আমায় জিজ্ঞেস করছিল, অভিলাষী বস্তুটি কী?…আমি বললাম, স্ত্রীলোক বলে শুনেছি। তা এতে এঁদের মন ভরেনি। আপনিই বুঝিয়ে দিন এঁদের।”

কদম্ব চায়ের কাপ নামিয়ে রাখছিলেন; বললেন, “ও-একটা সেক্ট, মানে গ্রুপ। ভেরি স্মল। আপনাদের যেমন বড় বড় গ্রুপ আছে—বাউল বোস্টম সাধু সন্নেসী—ওই রকম, তবে খুব ছোট। বারসমাজি শুনেছেন, বিচারি, ছুটিয়া—এসব শুনেছেন কখনো? শোনেননি। এ-সবই আছে। তবে আগে যা ছিল তার শ্যাডো মাত্র পড়ে আছে। এরা সবাই এক একটা ছোটখাটো রিলিজিয়াস সেক্ট, বা বলুন গ্রুপ। আজকাল এদের দেখাই যায় না, রেয়ার। লোকের আর বিশ্বাস কোথায় যে বিচারি হবে, ছুটিয়া হবে। চাল ডাল সব মিলেমিশে একাকার।” বলে কদম্ব চোখের চশমাটা খুলে কোলের ওপর রাখলেন। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “অভিলাষীরাও ওই ক্লাসের। দেখাই যায় না আজকাল। দু চারটে পড়ে আছে।”

পশুপতি যেন বুঝতে পেরেছেন এমনভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কী করে এরা?”

“সাধনা। চৈতন্যের সাধনা। সুপার পাওয়ার, দি আদার ওয়ার্ড—এই সবের খোঁজ রাখে।”

“মানে, ধর্ম…”

“ধর্ম তো বটেই, তবে ওই মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টা নাড়া নয়। এরা হল ভেতরে সাধক, পার্টলি তান্ত্রিক।”

“তান্ত্রিক?” হাবুল আঁতকে উঠল। “ওরে বাব্বা, সে তো ভয়ংকর ব্যাপার। শ্মশান, অমাবস্যা, মা কালী, শব…মড়ার মাথার খুলি…”

কদম্ব চশমাটা আবার পরে নিলেন। নিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন আস্তে আস্তে। হাবুলের দিকে এমন করে তাকালেন যেন ছেলেমানুষের কথায় কোনো মজা পেয়েছেন। বললেন, “না না, ওরকম ভয়ের নয়’ব্যাপারটা। তন্ত্র শুনলেই তোমাদের শ্মশান আর মাথার খুলি মনে হয়। নাথিং টু ডু উইথ দ্যাট।…আমি বোঝাবার জন্যে তন্ত্র বলিনি, আন্দাজ করার জন্যে বললুম। তন্ত্র আর তান্ত্রিক রাইটস একটা বিশাল ব্যাপার শুনেছি। আবার তান্ত্রিক গ্রুপের মধ্যেও ওরিজিন্যাল, ডুপ্লিকেট, চোরাই কতরকম কী!”

জলধর বললেন, “হ্যাঁ চোলাইও ঢুকেছে মিত্তিরসাম্বে। দু-একটা আমারও দেখা আছে বলছি। ফেগুসরাইয়ে এক তান্ত্রিক দেখেছিলাম—ছাগলের ঠ্যাং, এক কলসি চোলাই আর পিপের মতন এক ভৈরবী নিয়ে সাধনা করত। বেটা একদিন কলেরা হজম করতে গিয়ে মরে গেল।”

জলধরের কথায় সবাই হেসে উঠলেন।

কদম্ব বললেন, “ওসবের ধারে কাছে ইনি নন,” বলে আবার একটা সিগারেট ধরালেন। “ইনি অন্য ক্লাস। আমি মশাই মুখ্যু মানুষ, না পড়েছি গীতা না বাইবেল। আমার মাথায় ধম্মটম্ম ঢোকে না। তবে অভিলাষীর সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি—তাতে বুঝতে পারি—ওঁদের কথা হল, এই দেহটাই হল গাছের ডালপালা; গুঁড়ি হল ইন্দ্রিয়, শেকড় হল ভেতরের প্রাণ; আর দেহ অ্যান্ড প্রাণ এই দুইয়ের মধ্যে একটা পেণ্ডুলাম ঝুলছে—তার নাম মন। মনকে একেবারে না এদিক না ওদিক করতে হবে, মানে—মানে একেবারে স্থির। সুখ দুঃখ আরাম কষ্ট কিছুই অনুভব করবে না। ওই নিস্পন্দ স্থির অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে দেখা দেবে থার্ড কনসাসনেস, মানে আর একটা নতুন চেতনা। সেটাই হল পরম চৈতন্য, মানুষের ভেতরের পাওয়া…।”

জলধর বললেন, “ব্যাপারটা গুলিয়ে গেল মিত্তিরসাহেব। থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির মতন। কঠিন ব্যাপার। তা কী রকম পাওয়ার বলেছেন?”

পশুপতি বললেন, “হাঁদার মতন কথা হল জলধর। পাওয়ার ইজ পাওয়ার। এ তোমার হর্স পাওয়ার নয়।”

জলধর ঠোক্কর মেরে বললেন, “নাইদার হর্স, নর ইওর চশমার পাওয়ার। ও-সব ছেলেমি বিদ্যে জানা আছে। আমাকে পাওয়ার শেখাচ্ছ!”

কদম্ব বললেন, “এই সব পাওয়ার হল একটা অন্যরকম পাওয়ার। ভেতরের পাওয়ার, সাইকিক, সাধনা করে করে পাওয়া যাচ্ছে। আসলে আমি অভিলাষীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝেছি—নরম্যাল অবস্থায় মনের যে ফাংশান থাকে সেটা রিয়েলিটির ফাংশান, কিন্তু মন যখন ওই সুপার লেভেলে চলে যায় তখন তার কাছে ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নেই—সব একাকার। মনের তখন সুপার ফাংশান। তার দেখার রে বেড়ে যায়।

সাধন বলেন, “শাস্ত্রে একেই বলেছে, মার্গ…”

জলধর দাবড়ে উঠে বললেন, “চুপ করো, শাস্ত্র কি বলেছে পরে বুঝিয়ো; এখন মিত্তিরমশাইয়ের কাছে ব্যাপারটা জানতে দাও।” জলধর কদম্ব মিত্তিরকে কখনও বলেন মিত্তিরমশাই কখনও মিত্তিরসাহেব, যখন যেটা মুখে আসে।

হাবুল বললেন, “আজকাল সুপার জেট, সুপার পাওয়ার, সুপার কনসাসনেস—সবই সুপার, তাই না পশুপতিদা?”

“ধরেছ ঠিক”, পশুপতি বললেন, “নতুন জগতটা পুরনো জগতকে আরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে তো—তাই সুপার।”

কদম্ব সিগারেটের টুকরো ছাইদানে গুঁজতে গুঁজতে বললেন, “আমি ঘোর নাস্তিক। ঈশ্বর, যম, স্বর্গ, নরক—মায় পাপপুণ্য কোনোটাই বিশ্বাস করিনি। কিন্তু মশাই, এবার ঠকে গেলাম। অভিলাষী আমায় চমকে দিলেন। সত্যি বলছি, যেদিন ওঁকে আমি দেখলাম, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ইলেকট্রিক ফিলিং। গঙ্গার ঘাটে বসেছিলেন, মনে হল আমার জন্যেই এসে বসে আছেন। সঙ্গে লোক নেই, একটা পুঁটলিও নেই আশেপাশে। বললাম, থাকো কোথায়, যাবে কোথায়? অভিলাষী হেসে আঙুল দিয়ে আমায় দেখিয়ে দিলেন। বুঝলাম—আমার ঘরেই যাবেন। ব্যাস, সোজা বাড়ি নিয়ে এলাম।”

কদম্বর কথা শেষ হবার মুখে ফকির এসে বলল, “মা এসেছেন।”

চার

ফকির দরজার পরদা সরিয়ে সরে দাঁড়াল, অভিলাষী ঘরে এলেন।

জলধররা উঠে দাঁড়িয়ে অভিলাষীকে অভ্যর্থনা করবেন কিনা ভাবছিলেন—তার আগেই অভিলাষী যেন ভাব বিভোর অবস্থায় মৃদু মৃদু হাসি বিতরণ করে কোনার দিকে রাখা সোফার কাছে এগিয়ে গেলেন।

কদম্ব জলধরকে বললেন, “থাক থাক আপনাদের আর উঠতে হবে না। বসে বসেই আলাপ করুন।”

পশুপতির মনে হল, অভিলাষী প্রবীণা নয়, বৃদ্ধা নয়, পড়ন্ত যুবতী। গমনে গজেন্দ্রানী ভাব আছে এখনও।

অভিলাষী সোফায় বসলেন।

জলধররা অভিলাষীকে দেখছিলেন। অভিলাষী শাড়ি পড়েননি, আলখাল্লা ধরনের এক পোশাক পরেছেন। কোমরের তলা থেকে পোশাকটা যতটা ঢিলেঢালা কোমরের ওপর দিকটা তত নয়। কোমরের কাছে ফেট্টি বাঁধা। বুক কোমর মাপে মাপে আলগা। পোশাকের রংটা ঘন কমলা, বোধ হয় সিল্কেরই কাপড়, জেল্লা দিচ্ছিল। অভিলাষীর মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। কপাল কান দুইই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কানে কোনো গয়না নেই। ওঁর মুখের গড়নটি অনেকটা গোল ধরনের। বড় বড় চোখ, চাপা নাক, মোটা ঠোঁট। থুতনিতে তিল রয়েছে। রং ফরসা, কেমন লালচে লালচে দেখাচ্ছিল। সিঁদুরে গাল। চোখ দুটিও সমান লালচে এবং আবেশ জড়ানো। চোখের পাতায় সুর্মার ছোঁয়া।

কদম্ব আলাপ করিয়ে দিলেন।

জলধরের সঙ্গে আলাপ করাতেই তিনি বললেন, “আপনার কথাই শুনছিলাম এতক্ষণ। দর্শন পেলাম এবার। আমাদের সৌভাগ্য।”

সাধন নমস্কার জানিয়ে বললেন, “বড় খুশি হয়েছি। আপনাদের মতন সাধক সাধিকার সাক্ষাৎ পাওয়া ভাগ্য।”

পশুপতি কদম্বকে বললেন, “আমাদের বাংলা কথা উনি বুঝবেন তো?”

কদম্ব বললেন, “বুঝবে না কেন! ওর বাংলাটাই ভাল আসে, হিন্দির চেয়ে। দু একটা ইংরিজিও জানা আছে।”

হাবুল বললেন, “মুখটা বাঙালির মতন, তাই না?”

অভিলাষী প্রায় মুদিত নয়নে হাসলেন।

কদম্ব বললেন, “বাঙালি অরিজিন। নামও তত বাঙালি।” বলে কিছু বলতে গিয়ে কদম্ব জিব কাটলেন, যেন ভুল করে নামটা বলতে যাচ্ছিলেন, আটকে নিলেন। হেসে বললেন, “অভিলাষীর গেরস্থ নাম পাঁচজনের সামনে বলতে নেই। আমার আবার ও-সব মনে থাকে না।”

অভিলাষী মাথা নাড়লেন, হাসি মুখেই। কদম্বকে নিষেধ করলেন। ইশারায়।

জলধর বললেন, “দেশ বাড়ি কোথায় ওঁর?”

কদম্ব বললেন, “আগে বলেছি না—নেপাল বিহার বর্ডার। জায়গাটার নাম বললে কেউ বুঝবে না। যোগাবানীর কাছেই। তাই না?”

অভিলাষী সামান্য মাথা হেলালেন।

পশুপতি বললেন, “কবে থেকে সাধন-ভজন শুরু হয়েছে? মানে ঘর সংসার ছেড়ে এই স্পিরিচুয়াল লাইফ?

কদম্ব বললেন, “মন্দ কি! দশ পনেরো বছর তো হবেই। তাই না?” বলে অভিলাষীর দিকে তাকালেন একবার, তারপর যেন হিসেব পাকা করে নিয়ে পশুপতিকে বললেন, “পনেরো। ফিফটিন। তার আগে একটা ইনক্যুবেশান পিরিয়ড গেছে আগে—”

“কী পিরিয়ড?”

“ইনক্যুবেশান পিরিয়ড; মানে ডিমে তা দেবার সময়। ডিম ফোটার আগে তা দিতে হয় না! স্পিরিচুয়াল ব্যাপারেও একটা তা দেবার পিরিয়ড আছে। পাঁচ সাত দশ বছর লেগে যায় কারও কারও।”

সাধন মাথা নাড়লেন। “ঠিক। ঠিক কথা।”

“এর বেলায় বছর বাইশ থেকে শুরু হয়েছিল।”

অভিলাষী সামান্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

“বাইশ থেকে সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ এক্কেবারে আদাজল খেয়ে অভিলাষীর ক্রিয়াকর্মে, সাধন-ভজনে কেটেছে,” কদম্ব বললেন, “তারপর আজ বছর ছয় সাত—নিজের মতন করে আছে—মানে অ্যাজ সি লাইকস।”

জলধর আর পশুপতি মনে মনে হিসেবটা কষে ফেললেন। অভিলাষীর তা হলে বয়েস দাঁড়াচ্ছে বিয়াল্লিশ। চল্লিশের ওপর ওপর পয়তাল্লিশের নীচে। গড়ন পেটন থেকে মেয়েদের বয়েস যতটা আঁচ করা সম্ভব—ততটা আঁচ করলে অভিলাষীকে এই রকমই মনে হয়। তবে আসরে নামার আগে সাজঘর ঘুরে আসায় বয়েস আরও কম কম মনে হয়।

জলধরের নজর পাকা। তিনি অভিলাষীর খুঁটিনাটি আরও কিছু দেখে নিচ্ছিলেন। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। জলধরের মনে হল, মালার ঝুলে টান পড়েছে। তা পড়ক। দেখতে ভালই লাগে। গলায় রুদ্রাক্ষ, হাতে গালার বালা, বাঁ হাতে আংটি, চুনি বসানো। মনে হল, আঙুলের নখ চকচক করছে।

হাবুল বললেন, “আমি একবার বিন্ধাচল বেড়াতে গিয়ে এক যোগিনী দেখেছিলাম—আমার বউ যোগিনীর বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিল। তা সত্যি বলতে কি মিত্তিরদার, সেই যোগিনীর লুক আমার ভাল লাগেনি। কেমন এক পাগলি টাইপের। মাথার জটা পেছনে হাঁটু ছড়িয়ে গেছে। তবে সেই যোগিনীর ক্ষমতা দেখেছিলাম—এক টুকরো রুটি ছুঁড়তেই দু শো ইঁদুর কোনখান থেকে বেরিয়ে এল কে জানে! আশ্চর্য!”

জলধর বললেন, “কী সাইজের ইঁদুর? ধেড়ে না লেঙটি?”

“তা মনে নেই। বড় ছোট সব ছিল।”

“তুমি কি ধাতে ছিলে, হাবুল? ভাঙা, গাঁজা খাওনি তো?”

হাবুল প্রবলভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।

হাবুলের মাথা নাড়া দেখে পশুপতিরা হেসে উঠলেন।

এমন সময় বাইরে দমকা বাতাস উঠল। ঝড়ের মতন। কোনো ঘরের দরজা জানলা আছড়ে পড়ে বন্ধ হল, গাছপালায় শব্দ উঠল, একটা হুলো বেড়াল বাইরে কোথাও গজরাতে লাগল। সামান্য পরে সব শান্ত। দমকা বাতাস যেটুকু পড়ে থাকল তা কানে পড়ার মতন নয়।

সাধন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই অভিলাষী ইশারায় কদম্বকে কিছু বোঝাতে চাইলেন।

কদম্ব ঠিক বুঝতে পারলেন না। উঠে কাছে গেলেন অভিলাষীর। কিছু বললেন অভিলাষী, জড়ানো গলায়, ইঙ্গিতে। কদম্ব ফিরে এলেন নিজের জায়গায়।

“সাধনবাবু, আপনি একটু কাছে গিয়ে বসুন। কিছু বলার আছে ওর।”

সাধন বিগলিত বোধ করলেন। এত লোক থাকতে তাঁরই ডাক আগে পড়েছে। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে অভিলাষীর কাছাকাছি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন।

অভিলাষী চোখ বন্ধ করে মৃদু মৃদু দুলছিলেন। সামান্য পরে চোখ খুলে তাকিয়ে সাধনকে দেখলেন। বললেন, “দুনিয়া বড় ফাঁকা লাগে, দাদাজি?”

সাধন চমকে উঠলেন। অভিলাষীর গলার স্বর সামান্য ভাঙা ভাঙা, মোটা, জড়ানো। তা হলেও কী নরম ভঙ্গি। হাঁ করে অভিলাষীকে দেখতে লাগলেন। দু-গাল টকটক করছে। ফিকে গন্ধ চারপাশে।

সাধন বললেন, “তা লাগে! একা থাকি সংসারে। স্ত্রী আজ চার বছর নেই।”

“বিজলীবালা?”

সাধন চমকে উঠলেন। গা কেঁপে গেল। চক্ষু আর পড়ে না। হ্যাঁ। আপনি জানলেন কেমন করে?”

অভিলাষীর সেই আঙুরদানার মতন টসটসে হাসি ঠোঁটে। চোখের পাতা আরও একটু বড় করে বললেন, “রাখী পূর্ণিমায় ছেড়ে গিয়েছিলেন!”

সাধনের বুক গুমরে উঠল। অভিলাষী একেবারে ঠিক বলেছেন। রাখী পূর্ণিমাতেই বিজলী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। চার বছর হয়ে গেল। কিন্তু অভিলাষী এত কথা বলছেন কেমন করে! আশ্চর্য!

সাধনের বুক টনটন করে উঠছিল। বিজলী বেঁচে থাকতে দামি শালের মতন যত্ন করে রেখেছিল তাঁকে। দুবারের বেশি তিনবার হাঁচলে—নাকের ওষুধ, পায়ের মোজা বার করে দিত। এখন আর কে কার!

অভিলাষী বললেন, “দুঃখ করবেন না। উনি ভাল আছেন।”

সাধন বললেন, “দুঃখ করব না। আমার তিরিশ বত্তিরিশ বছরের বউ! আপনি বলছেন কেমন করে অভিলাষী! সুখদুঃখের জীবন ভেঙে দিয়ে চলে গেল। কোথায় রেখে গেল আমাকে!”

“কেউ যায় কেউ থাকে দাদাজি!…আপনি দুখ করবেন না। উধার তো ওঁর পুনরজনম হয়ে গেল!”

“পুনরজনম। ফির জনম নিয়েছেন। এখন তো ওঁর পুরা এগারা মাস বয়েস। পুরা এগারা। তিন বছর আত্মা হয়ে ঘুমেছেন ফিরেছেন। আবার জনম নিয়েছেন।

জলধর বললেন, “এগারো মাসের বাচ্চা! আরে রামো, সে তো তা হলে কাঁথায় শুয়ে আছে পেনি পরে। দুধ তুলছে। হাতে চুষিকাঠি। সাধন, ভাবতে পারছ ব্যাপারটা! ছ্যা-হ্যা!”

সাধন চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা অনুমান করার চেষ্টা করছিলেন। সেই বিজলী, যার তিন গজ কাপড় লাগত সেমিজ করতে সে এখন ইয়ে হয়ে পেনিফ্রক পরে কাঁথায় শুয়ে আছে!

সাধনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। পুনর্জন্ম তো ডেনজারাস জিনিস। সাধন যদি সামনের দু-এক বছরের মধ্যে মারা যান—এবং চট করে জন্মান আবার, তবুও বিজলী বয়েসে বড় থেকে যাবে। তার মানে আর কোনোদিন বউ হবে না, হবে দিদি। যা কচু, এ-জন্মের বউ আসছে জন্মে…।

অভিলাষী বললেন, “আপনি কিছু ভাববেন না দাদাজি! বাচ্চি ভাল আছে, সুখে আছে।”

সাধন আর কী বলবেন? বুক ভেঙে মস্ত এক দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। এরকম তো কথা ছিল না। বিজলী বলত, কর্তা তোমার আমার বন্ধন জন্ম জন্মান্তরের, পালাবে কোথায়, যেখানেই যাও কাছা ধরে টেনে আনব।’ কই কথা তো খাটল না। এবার তুমি কী করবে বিজু! তুমি আর আমায় ধরতে পারবে না।

চোখ ছলছল করে উঠল সাধনের। একেই বলে কপাল! আমি থাকলাম এখানে পড়ে, তোমার ঘরবাড়ি আগলে, তোমার মেয়ে জামাই নাতিনাতনীর কেয়ার টেকারের মতন হয়ে, আর তুমি স্বার্থপরের মতন পালিয়ে গিয়ে আবার একদফা জন্ম নিয়ে কাঁথায় শুয়ে পা ছুঁড়ছ। নিকুচি করেছে জন্মান্তরের!

সাধন চোখের জল মুছতে রুমাল হাতড়াচ্ছিলেন।

এমন সময় অভিলাষীর গলা শোনা গেল। এবার একটু জোরালো হয়েছে।

“পায়ে ছ’টা আঙলি কার আছে?” অভিলাষী বললেন।

জলধর থ’ মেরে গেলেন। নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। ধুতিতে ঢাকা। বললেন, “আমার।”

“ডান পায়ে?”

“হ্যাঁ।”

“পিঠে ঘা আছে? কারুয়া ঘা।”

“কার্বাঙ্কোল হয়েছিল। গত বছর।”

“রাতমে ঘুম হয়?”

“তোফা। এক আধদিন পেটে গ্যাস হলে ঘুম গড়বড় করে।”

“চিন্তাউন্তা নেই?”

“কিসের চিন্তা! আমার হল আপনি আর কোপনি। তা অভিলাষীজি, সাধনের পরিবারের কথা হল—এবার আমার ইয়ের কোন দশা হবে বলুন তো?” জলধর যেন ঠাট্টার মতন করে বললেন, যদিও তাঁর কোথায় সামান্য খটকা লাগছিল। জলধরের ডান পায়ে কড়ে আঙুল দুটো, আর পিঠে এক কার্বাঙ্কল হয়ে গত বছর গরমের সময় বেজায় ভুগেছিল। অভিলাষী এসব কথা জানল কেমন করে?

অভিলাষী চোখ বুজে বসে থাকতে থাকতে একবার নাকের বাঁ দিক টিপলেন, তারপর ডান দিক। দেওয়ালের ছবির আড়াল থেকে টিকটিকি ডেকে উঠল।

অভিলাষী বললেন, “চুহা, কাউয়া, বিললি—তিন জানোয়ার তু পাললি। চুহা তো আপনি জানেন জলধরজি, ইঁদুর। কাউয়া—কাক। ইঁদুর কাক আর বিললি তিন জানোয়ার সব ঘরমে থাকে আগর না থাকে তো আগ লাগে। আপনার ঘরে চুহা নেই?”

জলধর খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন, বললেন, “ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর আছে। গিন্নির পায়ে একবার কামড়ে দিয়েছিল। ইনজেকশান দিতে হয়েছিল, অভিলাষীজি।”

“কাউয়া নেই?”

“কাউয়া কি কেউ পোষে। কাক আর ইঁদুর সব বাড়িতেই আছে।”

অভিলাষী একটু যেন হাসলেন, “ঠিক বলেছেন। এবার একটা কথা বুঝে নিন। মানুষমে তিন ইন্দ্রিয় জাদা জাদা কাম করে। চুহা হল কাম, কাউয়া হল ক্রোধ, আর বিললি হল লালচ।”

পশুপতি মুগ্ধ হয়ে বলল, “ব্রিলিয়ান্ট। অভিলাষী দারুণ বলেছেন। জলধরের তিন ইন্দ্রিয়ই তেজি…।”

জলধর ধমকে উঠতে যাচ্ছিলেন তার আগেই অভিলাষী বললেন, “জোর হলে আরও তিন জনম।”

“তিন জন্ম?”।

“আগাড়ি জনম আর চুহাগিরি করবেন না!”

জলধর চট করে একবার পশুপতির দিকে তাকিয়ে নিলেন। “এ-জন্মেই করলাম তো আগাড়ি জনম!”

অভিলাষী বললেন, “ঝুট বলছেন।”

“ঝুট! কোন শালা আমার নামে বলে—!”

নিরীহ মুখ করে পশুপতি বললেন, “কোনো শালাই বলবে না। জলধরের ও-সব ফালতু দোষ নেই অভিলাষীজি। লোকে যে বলে, জলধর মধু কবিরাজের বিধবা শালীর সঙ্গে…”

“অ্যাই, হচ্ছে কি?”

“কথাটা শেষ করতে দাও না,” পশুপতি বললেন, তারপর অভিলাষীর দিকে তাকালেন। “শুনুন অভিলাষীজি! মধু কবিরাজের বিধবা শালী এখানে বেড়াতে এসে ছ’ আট মাস ছিল। গানের লাইনের লোক তো, গজল গাইত। বেনারসি না এলাহাবাদি বিবি। আমাদের জলধর কবিরাজের বাড়ি গিয়ে গানের সঙ্গে ঠেকা দিত তবলায়। জলধর ভাল তবলচি!…আমি মিথ্যে বলছি না অভিলাষীজি, মিত্তির সাহেব সাক্ষী।”

অভিলাষী মুচকি হেসে বললেন, “জলধরজি বড়া কলাচার।”

জলধর ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “তবলার কথা থাক। আপনি বলুন তো, কে থাকছে কে যাচ্ছে! আমি আগে, না গিন্নি আগে?”

“ভগবান জানেন।”

“ভগবান জানেন তো আপনি কী জানেন?”

“আমি আঁখ বন্ধ করে এক তামাশা দেখছি, জলধরজি! দূরমে রামলীলা হচ্ছে। সীতাজি কাঁদছেন, হনুমানজি হায় হায় করছেন।”

জলধরের বুক কেঁপে উঠল। বলে কি অভিলাষী! তবে কি তাঁর দশাও সাধনের মতন হবে?

জলধর বললেন, “শুনুন অভিলাষীজি! আমি সাফসুফ বলে দিচ্ছি—আই অ্যাম নট সাধন! চিরটাকাল আমি সামনে সামনে এসেছি—গিন্নি আমার পেছন পেছন। ফাইন্যাল রাউন্ডেও অমি আগে যাব। বুঝলেন।”

সাধন বললেন, “যাওয়া কি তোমার হাতে?”

জলধর বললেন, “দেখা যাবে। এখন পাঁচ সাত বছর যাচ্ছি না। পরের কথা পরে।…তা মিত্তিরমশাই আমাদের তো রাত হয়ে যাচ্ছে, এখন শুরু করলে—!” বলে ইশারায় পানভোজনের কথা বুঝিয়ে দিলেন।

খেয়াল হল কদম্বর। বললেন, “তাই তো সাতটা বেজে গেল। ফকিরকে ডাকি।’

হাবুল বললেন, “আমরা যে বাদ পড়ে গেলাম, কদম্বদা।”

“হবে হবে, অভিলাষী তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আবার একদিন হবে। ওর শরীর ভাল যাচ্ছে না। একদিনে বেশি স্ট্রেন উচিত নয়।”

হাবুল অভিলাষীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। “ঠিক আছে, তাই হবে। আমাদের একটু মনে রাখবেন অভিলাষী দিদি।”

অভিলাষী মাথা হেলিয়ে হাসলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাচ্ছিলেন অভিলাষী, সামান্য দুলছেন। পায়ে খড়ম-জুতো। ঠুক টুক আওয়াজ উঠছিল। পশুপতির পাশ দিয়ে যাবার সময় অভিলাষী আড়চোখে কেমন করে যেন ইশারা করলেন। অন্য কেউ নজর করল না। পশুপতি হাত জোড় করে বলল, “আপনি ভগবতী। কাল পরশুই আবার আসব।”

পাঁচ

ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা।

হাবুল আর সাধন সামনে। পেছনের সিটে পশুপতি আর জলধর। জলধর যেভাবে গাড়ির মধ্যে গড়িয়ে রয়েছেন তাতে বোঝা যায় তিনি বাস্তবিকই এখন জলে পূর্ণ হয়ে রয়েছেন। তাঁর চোখ বোজা। মাঝে মাঝে নাক ডাকছিল।

পশুপতি হুঁশে আছেন—তবে এলিয়ে আছেন।

সাধন সামান্য মুখে দিয়েছেন তাতেই নেশা ধরে গিয়েছে। মাঝে মাঝেই তাঁর শোক উথলে উঠছে।

হাবুল যতটুকু নেশা করেছিল তাতেই আনাড়ির মতন গাড়ি চালাচ্ছিল। ভাগ্যিস মেঠো জমি আশেপাশে, নয়ত গাড়ি ডোবায় গিয়ে পড়ত।

সবাই চুপচাপ। হাবুল নিজেকে সজাগ রাখার জন্যে জোরে জোরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল।

হঠাৎ হাবুল বলল, “জলধরদা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?”

কোনো সাড়া নেই।

পশুপতি আড়ষ্ট জিবে বললেন, “একেবারে কাদা। কাছা খুলে খেয়েছে। ওকেই আগে নামিয়ে দিও হাবুল। চ্যাংদোলা করে নামাতে হবে।”

হঠাৎ জলধর বসা গলায় বললেন, “আমি ঘুমোইনি।”

“ঘুমোওনি! নাক ডাকছ যে!”

“জেগে জেগেও নাক ডাকা যায়। আমি ভাবছিলাম।” জলধরের কথাগুলো অস্পষ্ট, জড়ানো।

“কী ভাবছিলে?”

“অভিলাষীকে ভাবছিলাম। মুখটা আমার বড় চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি।”

পশুপতি বললেন, “দেখেছ?”

জলধর কোনো জবাব দিলেন না।

আরও খানিকটা এগিয়ে আসার পর সাধন আবার যখন ফুপিয়ে কেঁদে উঠছেন হঠাৎ যেন জলধর কিছু আবিষ্কার করলেন। বললেন, “পশুপতি, এই অভিলাষী আর মধু কবিরাজের সেই বিধবা শালীটা এক নয়? সে বেটি হাওয়া হয়ে গেল—হঠাৎ। কদম্ব তখন এখানে এসেছিল। কদম্ব যাবার হপ্তা খানেক পরে ও-বেটি পালাল। তাই না?”

পশুপতি বললেন, “তুমি কোন বিধবার কথা বলছ? যার গানের সঙ্গে তবলায় ঠেকা দিতে যেতে। বাঁজা বিধবা।”

সিটের গর্ত থেকে উঠতে উঠতে জলধর বললেন, “মেয়েছেলে কেমন ভোল পালটেছে দেখেছ! ছিল কলসী, হয়ে গেল অভিলাষী। চেনাই যায় না। তাই বলি অভিলাষী এত হাঁড়ির কথা বার করছে কেমন করে? কদম্ব মিত্তির এমন পাকা ধড়িবাজ তা জানতাম না। যাক ভালই করেছে। বুড়ো বয়েসে একটা অবলম্বন তো দরকার। কি বলো?”

পশুপতি কিছু বলার আগেই হাবুলের গাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে মাঠে নেমে গেল।

আত্মাদর্শন

“এই দেখো হে কাকে এনেছি সঙ্গে করে,” বলে রমেশবাবু সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে পেছনের মানুষটিকে দেখালেন।

জগবন্ধু বেতের চেয়ারে বসে পা তুলে মোজা পরছিলেন। চেয়ারের পাশে কেডস জুতো। পায়ের আধখানায় মোজা উঠেছে। বললেন, “দেখছি তো, কাকে ধরে নিয়ে আসছ! উনি কে?”

জগবন্ধু চিনতে পারলেন না। বাগানের ফটক খুলে রমেশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে ভদ্রলোক আসছিলেন তাঁর দিকে জগবন্ধুর চোখ আগেই পড়েছিল। বাবাজি-বাবাজি গোছের চেহারা। দাড়ি, গোঁফ, ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল। আনা আষ্টেক সাদা হয়ে এসেছে। ভদ্রলোকের শরীরের গড়ন-পেটন দোহারা, রঙ বোঝা যাচ্ছিল না, কালো অবশ্য নয়।

মাথা নাড়লেন জগবন্ধু। বাবাজিকে চিনতে পারছেন না।

রমেশ বললেন, “পারলে না? আমাদের বঙ্কু। নন্দবাবুর ছেলে গো। সেই ডাক্তার নন্দবাবু, বরফ কলের কাছে দোতালা বাড়ি।”

“বঙ্কু!” জগবন্ধু, একে একে বরফ কল, নন্দ ডাক্তার, এবং খাকি হাফ প্যান্ট পরা বঙ্কুকে ঠাওর করে নিতে পারলেন, কিন্তু এই দাড়ি গোঁফঅলা, বাবরি চুলের বঙ্কুকে তার সঙ্গে মেলাতে পারলেন না। ঢোক গিলে বললেন, “তা ওর এই দশা কেন?”

রমেশ বললেন, “বঙ্কু এখন স্পিরিচুয়ালিস্ট। আত্মা ভূত প্রেত, পরকাল-টরকাল নিয়ে পড়ে আছে।”

“কেন, ওর কি বউ মারা গেছে?” জগবন্ধু বললেন, বলে গোড়ালির কাছ থেকে মোজাটা পায়ের ওপর দিকে টেনে নিলেন।

বঙ্কু মোলায়েম করে হাসল। বলল, “ভাল আছেন, জগুদা?”

“যে বয়সে যেমন থাকে ভাই সেই রকম আছি। অল্পস্বল্প ডায়েবেটিস, প্রেশারের খানিকটা ট্রাবল, হাতের গাঁটে আরথারাইটিস—এই সব উপসর্গ নিয়ে আছি। তা তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো?”

“আজ আর বসব না। আপনারা তো এখন বেড়াতে বেরুবেন।”

“ওই একটা চক্কর। মোল্লার দৌড় মসজিদ। স্টেশনের দিকে যাব একবার। কলকাতার গাড়ি এলে খবরের কাগজটা নেব, একটা পাউরুটি, এক প্যাকেট সিগারেট, গিন্নির জন্য সেউভাজা। তারপর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরব।”

“কেমন লাগছে জায়গাটা?”

জগবন্ধু আঙুল দিয়ে রমেশকে দেখালেন। “ওকে জিজ্ঞেস করো। ও হল ইঞ্জিন, আমি মালগাড়ি। নিজের বউ, আমার বউ—দুটো বউকে মন্তর দিয়ে জপিয়ে হাওয়া বদলাতে নিয়ে এসেছে আমাকে। আমার তো দেখছি একদিন খিদে হলে দু দিন পেট একেবারে ফায়ার ব্রিকস হয়ে থাকে। কুয়োর জলে চান করে করে গায়ে রাশ বেরিয়ে গেল। এটা কি কোনো ভদ্রলোকের জায়গা।”

রমেশ বললেন, “বঙ্কু, তুমি একবার সকালের দিকে এসে জগোবাবুকে দেখো। চোখের তলা লাল হয়ে গিয়েছে, গাল টকটক করছে…। নবযৌবন সঞ্চার হচ্ছে সিক্সটি টুতে।”

“সে কি তোমার জলের গুণে? চার আউন্স করে ওষুধ খাই না সন্ধ্যেবেলায়? বিলিতি ওষুধ। কাস্টমস থেকে যোগাড় করে আনতে হয়েছে?”

বঙ্কু এবার জোরেই হাসল।

রমেশ বললেন, “চলো, তা হলে বেড়ানোটা সেরে আসি। বঙ্কু, তুমি একটু বসো, আমি একবার ভেতর থেকে ঘুরে আসি। গিন্নিদের ফরমাসটা শুনে নেওয়াই ভাল। ও, একটা কথা তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছি। জগোবাবুর গিন্নি সম্পর্কে আমার বড় শালী, মাসতুতো শালী।” বলে অন্দরমহলে চলে গেলেন।

জগবন্ধু অন্য পায়ের মোজাটা পরতে পরতে বললেন, “কোন ছেলেবেলায় তোমায় দেখেছি, বঙ্কু ; তারপর এতকাল পরে ; আফটার ফরটি, ফটি ফাইভ ইয়ার্স কি বলো? চেনা মুশকিল। রমেশ তোমায় চিনল কেমন করে?”

“এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল, অন্য দু একজন ছিলেন। কথায় কথায় ধানবাদের কথা উঠল, তাতেই চিনলেন।”

“বাহাদুরি আছে রমেশের।” মোজাটা পরে ফেললেন জগবন্ধু। “তা তোমার বাবা মা?”

“নেই।”

“সেই যে দিদি ছিল, কি নাম যেন…বয়েসে সব ভুলে যাই হে।”

“দিদিও নেই।”

জগবন্ধু সহানুভূতির শব্দ করলেন। “সবই হারিয়েছে?’

“তা বলতে পারেন,” বঙ্কু নিস্পৃহ গলায় বলল।

কেডস পায়ে গলিয়ে নিলেন জগবন্ধু। “সংসার টংসার করোনি? বউ ছেলেমেয়ে?”

বঙ্কু দাড়িতে হাত রেখে বলল, “করার চেষ্টা করেছিলাম। ছেলেমেয়ে হয়নি। বউ খসে গেছে।”

এমন সময় জগবন্ধুর স্ত্রী যামিনীকুসুম এলেন। বিকেলের গা-ধোওয়া কাপড় বদলানো গিন্নি গিন্নি চেহারা। এসেই একবার বঙ্কুকে দেখে নিয়ে মুখভরা হাসি খেলিয়ে বললেন, “ঠাকুরপোর মুখে সব শুনলুম, ভাই। আপনিও সম্পর্কে আমাদের দেওর। এ বাড়িতে যখন পা দিয়েছেন একটু চা খেয়ে যান।”

বঙ্কু নমস্কার করে বলল, “আমরা একই জায়গার লোক, বউদি। ছেলেবেলাটা একসঙ্গে কেটেছে। অনেককাল পরে দেখা হল। বড় ভাল লাগল। চা আজ থাক না, পরে একদিন হবে। জগুদারা এখন বেড়াতে যাবেন, কার্তিক মাস, বিকেল তো ফুরিয়ে গেল।”

“তা যান না ; আপনি দু দণ্ড বসেই যাবেন। আশা চা নিয়ে আসছে।”

জগবন্ধু জুতোর ফিতে বেঁধে ফেললেন। “চা-টা খেয়েই নাও, তারপর এক সঙ্গে বেরিয়ে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।”

বঙ্কু মাথা হেলাল।

যামিনী বললেন, “শুনলুম আপনি এখানে আশ্রম করেছেন?”

“আশ্রম ঠিক নয়” বঙ্কু বলল, “বলতে পারেন আশ্রমের মতন। মন্দির ঠাকুর দেবতা নেই। পুজো পাঠও হয় না।”

জগবন্ধু গিন্নির দিকে তাকিয়ে বললেন, “বঙ্কু স্পিরিচুয়ালিস্ট। আত্মা নিয়ে কাজকর্ম করে। বড় কঠিন সাধনা। থিয়োসফি বোঝ?”

যামিনী পিঠের আঁচল সামলে বললেন, “বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা আছে সব তুমিই বোঝ? কত আমার ওজনদার!” বলে অবহেলায় স্বামীকে বাক্যবাণ হেনে বঙ্কুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠাকুরপো বলছিল আপনার নাকি অপদেবতা ধরার ক্ষমতা আছে। সত্যি নাকি?”

ছেলে ভোলানো হাসি হেসে বঙ্কু বলল, “অপদেবতা নয়, আত্মা।”

“ওই হল। ভূত তো?”

“ভূত হল নিচু স্তরের আত্মা। স্কুলে যেমন ওয়ান টু ক্লাস—ভূত হল সেই ক্লাসের। আত্মারা হলেন অনেক উঁচু ক্লাসের।”

জগবন্ধু ঠাট্টা করে বললেন, “হ্যাঁ গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের।”

যামিনী কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, “আত্মারা ক্ষতি করেন না? আপদ বিপদ হয় না?”

“না, না, মোটেই নয়।”

“দেখতে বড় ইচ্ছে করে। ভয়ও হয়।”

“বেশ তো, দেখবেন। দেখাব। ভয়ের কিছু নেই।”

চা নিয়ে আশালতা হাজির হলেন। পেছনে রমেশ।

স্পিরিচুয়ালিস্ট বঙ্কুকে যামিনীর খুব পছন্দ হয়ে গেল। কথায় বার্তায় নম্র, নিজে বেশি কথা বলে না, মুখে হাসিটি লেগে আছে, যখনই এ-বাড়িতে আসে কিছু না কিছু হাতে নিয়ে ঢোকে। যামিনী রাগ করেন, এ তুমি বড় অন্যায় করছ বড় ঠাকুরপো, এমন করলে তোমায় আর বাড়ি ঢুকতে দেব না। বঙ্কু এখন যামিনীর কাছে তুমি হয়ে গিয়েছে। যামিনী রাগ করলে বঙ্কু বলে, নিজের বলতে আমার কেউ কোথাও নেই বউদি ; আপনারা আমার আত্মীয়ের মতন। কদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছেন, সামান্য কিছু হাতে করে আনলে আনন্দ পাই। এতে কেন বাধ সাধবেন।’ এরপর যামিনীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

আশালতা বরাবরই খানিকটা ভিতু গোছের মানুষ। বঙ্কু ভূতভজনা করে শুনে তাঁর রীতিমত ভয় ধরে গিয়েছিল গোড়ায়। বঙ্কুর ব্যবহার দেখে, কথাবার্তা শুনে সে ভয় কেটে গেল বারো আনা। এখন তিনি বঙ্কুর চায়ে চিনি বেশি দেন, সকালে মিষ্টিমাষ্টা এলে কালাকাঁদ, কালোজাম দু চারটে সন্ধের জন্যে রেখে দেন; বঙ্কু এলে সাজিয়ে দেন। ভেজিটেবল চপ করে খাওয়ান। বঙ্কু নিরামিষাশী।

রমেশ বঙ্কুর সঙ্গে বেশ জমিয়ে ফেলেছেন। নিজেদের ছেলেবেলার গল্পগুজব ছাড়াও হরেক রকম আলোচনা হয় ; এখানকার ক্লাইমেট, জমির দাম, বাড়ি করার খরচ থেকে শুরু করে দেশের হালচাল ; ব্ল্যাক মানি, ভেজাল, ইন্দিরা, সাঁইবাবা—মায় মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তারও আলোচনা চলে।

এক জগবন্ধুই বঙ্কুকে একটু তফাতে রাখতেন। তিনি যে মানুষ খারাপ তা অবশ্য নয়, কিন্তু এ-বাড়িতে বঙ্কুর এতটা সমাদর তাঁর পছন্দ হত না। চেনাজানা মানুষ বঙ্কু, ছেলেবেলার পরিচয়, ছোট ভাইয়ের মতনই অনেকটা, তাকে বাড়িতে ডেকে চা মিষ্টি খাওয়াও, গল্পগুজব কর—আপত্তি নেই, তা বলে মাথায় তোলার দরকারটা কী? জগবন্ধু নিজেও কি হাসি তামাশা, গল্পগুজব করেন না বঙ্কুর সঙ্গে, কিন্তু যামিনী বঙ্কুকে দেখলেই যেন আহ্লাদে গলে যায়, কত কথা—সংসারের কোনো কথাই বাদ যায় না। রমেশটাও তাই। এই দুজনে মিলে হাঁড়ির সব খবরই বার করে দিয়েছে বঙ্কুর কাছে। নিজেদের ছেলেমেয়েরা কে কি করছে, কার কোথায় বনিবনা হচ্ছে না, মেয়ে নিজের পছন্দে বিয়ে করল, ছেলের বউ সকালে ঘুম থেকে উঠে লিপস্টিক মাখে—এ-সব কথা বলার কি কোনো দরকার ছিল?

সেদিন বসার ঘরে বসে গল্প হতে হতে রাত হল। জগবন্ধুর ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। আটটায় শুরু করলে ন-টায় শেষ হবে। একটু জিরেন দিয়ে রাত্রের খাওয়াদাওয়া। জগবন্ধু উসখুস করছিলেন। শেষে বঙ্কুকে বললেন, “ওহে প্রেতসিদ্ধ, আমি এবার উঠি। রাতও হচ্ছে।”

যামিনী বললেন, “উঠবে কেন? বসো। কথাটা ঠিক হয়ে যাক।”

“কিসের কথা?”

“এতক্ষণ কি ঘুমোচ্ছিলে? সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মা। জ্বালালে বাপু। বঙ্কু ঠাকুরপোর ওখানে আমরা কবে যাচ্ছি। কাল না পরশু?”

“গেলেই হয়, এ নিয়ে ভাববার কি আছে?”

“যথেষ্ট আছে। ফুরফুরে হাওয়া খেতে তো যাচ্ছি না, যাব ওই আত্মাদের দেখতে। কাল শনিবার। তার ওপর কৃষ্ণপক্ষ। কাল আমার সাহস হয় না।”

“আত্মাদের কোনো বার নেই, কি বলো বঙ্কু?” রমেশ বললেন।

“আত্মা আমাদের অধীন নয়, রমাদা, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছায় আসেন যান। অভিরুচি হলে দেখা দেন, না হলে দেন না। শনি সোম বলে কথা নেই।”

“তা হোক। শনিবারে আমি যাব না,” আশালতা বললেন।

“তবে পরশু রবিবার।” যামিনী দিন ঠিক করে ফেললেন। বঙ্কুর আশ্রমে চার জনে আত্মা দেখতে যাবেন। দেখা তো যাবে না, গলা শোনা যাবে, আর যদি গলাও না শোনা যায় পেন্সিলের লেখা ফুটবে। বঙ্কু তাই বলেছে।

আসর ভাঙল। বঙ্কু চলে গেল। জগবন্ধু খেপে গিয়ে বললেন, “ভূতো বঙ্কুর ধাপ্পায় তোমরা ভুললে। বেটা আত্মার আ জানে। তোমরা যাচ্ছ যাও, আমি যাব না।”

যামিনী সরবে বললেন, “যাবে না মানে। নিশ্চয় যাবে।”

রবিবার চার জনে শেষ বিকেলে বঙ্কুর বাড়ি হজির হলেন। আধ মাইলটাক একটানা হেঁটে এসে যামিনীর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে পা দিয়েই যামিনী জল খেতে চাইলেন ; বললেন, “এই তোমার আশ্রম। বড় নিরিবিলি তো?”

বঙ্কু বাইরের বারান্দায় চেয়ার বেঞ্চি সাজিয়ে আসন পেতে রেখেছিল। চার জনকে খাতির করে বসাল। নিজের হাতে জল এনে দিল যামিনীকে। জগবন্ধু বললেন, “তোমার আত্মাদের কখন আসতে বলেছ হে? আটটা নাগাদ আমাদের ফিরতে হবে।”

বঙ্কু বলল, “একটু বসুন। জিরিয়ে নিন। চা খান।”

“ওই করতেই তো সন্ধে হয়ে যাবে। অন্ধকার হয়ে আসছে—দেখছ না!”

রমেশ বললেন, “না না, তাড়ার কিছু নেই বঙ্কু! রাত হয় হবে। যা দেখতে এসেছি সেটা বাপু না দেখে যাব না। কি বলো দিদি?”

যামিনী সায় দিয়ে বললেন, “ঠিকই তো!” বলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, “সবাই তোমার হুকুমের চাকর। এই আয় বলে তুড়ি মারলেই আকাশ থেকে নেমে আসবে।” স্বামীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বঙ্কুর দিকে তাকালেন এবার। “না ভাই বঙ্কু ঠাকুরপো, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তুমি রয়ে সয়ে যা করার করো। ওই নাস্তিকের কথা শুনো না।”

বঙ্কু হাসিমুখে বলল, “আমি সবই ব্যবস্থা করে রেখেছি। আপনারা চা খেয়ে নিন ; তারপরই শুরু করা যাবে।”

আশালতা বললেন, “আমরা কিন্তু আজ খাওয়া দাওয়ার বাদ বিচার করিনি।”

“কোনো বিচারের দরকার নেই। আমি শুধু বলেছিলাম, আসবার সময় পরিষ্কার জামা কাপড় পরে আসবেন। আর পারলে তিনটে করে তুলসীপাতা চিবিয়ে আসবেন।”

“তা এসেছি।”

“তবে আর কি! যখন বসব তখন জুতোটুতো খুলে হাত পা মুখ ধুয়ে নেবেন। তাতেই হবে। বসুন, চায়ের কতটা হল দেখি।”

বঙ্কু চলে গেল। চার জনে বসে বসে বঙ্কুর বাড়ির বাইরের দিকটা দেখতে লাগলেন। বাড়ি ছোট নয় বলেই মনে হচ্ছে। ভেতরের দিকে ঘরটর বেশি থাকতে পারে, কে জানে। বাগানটা ভালই সাজিয়েছে বঙ্কু, দেদার গাছপালা। বাড়ির চারদিকে এত নিম কাঁঠালের গাছ রেখেছে কেন?

কুয়ো থেকে জল তোলার শব্দ হচ্ছিল। অন্ধকার হয়ে গেল।

জগবন্ধু সিগারেট খেতে খেতে রমেশকে বললেন, “ভূতো বঙ্কু এত সব করল কি করে হে রমেশ? দৌলত ভূতে জুগিয়েছে?”

রমেশ বললেন, “ওর তো এখানে কিছু জমি-জায়গা আছে। লোক রেখে চাষবাস করায়। তা ছাড়া কাঠের কারবারও করে সামান্য।”

“এ বাড়িতে থাকে কে কে?”

“বাড়ির কাজকর্ম যারা করে তারাই থাকে—আর কে থাকবে?”

জগবন্ধু ঠাট্টা করে বললেন, “ওর বউ কি প্রেতের ঠেলাতেই চম্পট দিয়েছে হে?”

যামিনী হঠাৎ বললেন, “কিসের যেন গন্ধ আসছে?”

আশালতা চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাক টানলেন, তারপর বললেন, “ঘন দুখ উথলে ওঠার মতন, তাই না? পায়েস পায়েস।”

“কেউ কি এলেন নাকি আশেপাশে।”

যামিনী চার দিকে তাকালেন।

আশালতার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি যামিনীর হাত চেপে ধরলেন।

এমন সময় চা এল। বেতের ট্রেতে সাজানো। বাড়ির কাজের লোক বয়ে এনেছে। পেছনে বঙ্কু।

“কিসের একটা গন্ধ পাচ্ছি, ঠাকুরপো?” যামিনী বললেন।

“গন্ধ!…ও বুঝেছি, আসলি চন্দনের গন্ধ। যে-ঘরে আমরা বসব, সেই ঘরে ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে,” বঙ্কু বলল।

বঙ্কুর আত্মা-সাধনার ঘরখানি দেখার মতন। মাঝারি ঘর, নানা ধরনের আসবাব। গোল টেবিল, হাতলহীন চেয়ার, হ্যাট স্টান্ডের মতন কি একটা একপাশে রাখা, চার কোণে চারটে লোহার খাঁচা। খাঁচার মধ্যে মাটির মালসায় ধুনো দেওয়া হয়েছে। একদিকে একটা চোঙা ঝুলছে—একসময় রেডিওতে যেমন হালকা গোছের চোঙা লাগানো থাকত অনেকটা সেই রকম। কোণের দিকে একটা কুলুঙ্গি কাচ দিয়ে ঢাকা। কাচের আড়ালে টিমটিমে একটা লাল বাতি জ্বলছে। সারা ঘর জোড়া মোটা শতরঞ্জি। পায়ের শব্দ হয় না। হালকা নীল লাইম ওয়াশ করা দেওয়াল, চার দেওয়ালে চারটি কাঠের গুঁড়োভরা মরা বেড়াল আর কাকের দেহ ঝুলছে। কুচকুচে কালো রং বেড়াল দুটোর। জানলা ঘেঁষে একটা সরু টেবিলের ওপর একটা পেটা ঘণ্টা, গোটা দুয়েক শাঁখ, ধূপদানি। জানলাগুলো কালো পরদা দিয়ে ঢাকা।

জুতো খুলে হাত পা ধুয়ে জগবন্ধুরা ঘরে ঢুকেছিলেন। ঘরের মধ্যিখানে গোল টেবিলের চারপাশে চেয়ার সাজানো। বঙ্কু সকলকে বসতে বলল।

টেবিলের ওপর একটা চাকা-লাগানো ছোট তেকোঠ পড়ে ছিল।

জগবন্ধু চোখ সইয়ে নিয়ে বললেন, “এটা কী?”

বঙ্কু বলল, “ওটা লেখার জিনিস। ওর মধ্যে একটা সরু-গর্ত আছে পেনসিল ফিট করার জন্যে। আত্মারা বেশির ভাগ সময় কথা বলতে চান না। তখন মিডিয়াম ওই জিনিসটার ওপর হাত রেখে আত্মার কথাবার্তা লিখতে পারেন।”

“লিখবে কিসে? চাকা লাগানো কেন?”

“কাগজে লিখবে? কাগজ দিয়ে দেব। চাকা লাগানো রয়েছে হাত ভাল সরবে বলে। তাড়াতাড়ি লেখা যাবে।”

জগবন্ধু বললেন, “কলটি তো বেড়ে বানিয়েছ!”

আশালতা বার কয়েক খুক খুক করে কাশলেন। ঘরের চারদিকই বন্ধ। ধূপধুনোর ধোঁয়ায় ঘরের সবই অস্পষ্ট।

রমেশ বললেন, “তা আর দেরি কেন?”

“না, এবার শুরু করব। তার আগে একটা কথা বলে নিই। টর্চ, দেশলাই, লাইটার—কোনো রকম আলো জ্বালবেন না। আমায় দিয়ে দিন।”

জগবন্ধু টর্চ বাইরে রেখে এসেছেন। দেশলাই দিয়ে দিলেন।

বঙ্কু বলল, “ওই লাল বাতিটা দেখছেন? যদি দেখেন বাতিটা খুব দপদপ করছে বুঝবেন আত্মা কাছাকাছি এসে গেছে। এই ঘরে তাঁর আবির্ভাব হলে আলো নিবে যাবে।”

জগবন্ধু বললেন, “আমরা কি লাল আলোর দিকে চেয়ে থাকব?”

“না। আপনারা মুখ নিচু করে চোখ বুজে যাঁকে দেখতে চান, অবশ্য তাঁর মৃত্যু হওয়ার দরকার, তাঁর কথা এক মনে ভাববার চেষ্টা করবেন। সবাই যদি একই লোকের কথা ভাবেন তাতে তাড়াতাড়ি কাজ হতে পারে। কিন্তু তা তো সম্ভব হয় না। চারজনে চাররকম ভাবলে ক্রস লাইন হয়ে যায়।”

“কলকাতার টেলিফোনের মতন?” জগবন্ধু বললেন।

বঙ্কু বলল, “এবার শুরু করা যাক। আপনারা এখন কেউ আলোর দিকে তাকাবেন না। যদি আলো কাঁপে আমি বলে দেব তখন তাকাবেন। আর একটা কথা, আপনাদের ভাগ্য যদি ভাল হয়—আত্মার কথাও শুনতে পাবেন। সূক্ষ্ম আত্মা, গলার স্বর আরও সূক্ষ্ম। কানে শোনা মুশকিল। ওই যে চোঙাটা দেখছেন, ওই চোঙা দিয়ে স্বর শোনবার ব্যবস্থা আমি করেছি। টোনটাকে হাই ভলুম করার ব্যাপার আর কি!”

যামিনী বললেন, “লেখালেখির চেয়ে গলা শোনা ভাল, নয়রে, আশা?”

আশালতার গা ছমছম করছিল। বলল, “কেন, লেখাটা খারাপ?”

রমেশ বললেন, “আমার হাতের লেখা ন্যাস্টি। তোমার তো কাগের বগের ঠ্যাং। যামিনী দিদির আঙুলে বাত। কে লিখবে! জগোবাবু পিঁপড়ে বানান লিখতে তিনটে চন্দরবিন্দু বসায়—ওর কথা বাদ দাও।”

বঙ্কু বলল, “সবই আত্মার ইচ্ছে। তিনি যদি কথা বলতে চান শুনতে পাবেন, যদি লেখাতে চান যার ওপর ভর করবেন তাঁকে লিখতে হবে। আমি নাচার। নিন তৈরি হন। আর কথাবার্তা নয়, ঠিক ঠাক হয়ে বসুন।”

বঙ্কু চারপাশ ঘুরে ফিরে সব একবার দেখে নিল। কোথা থেকে কাগজ বার করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর ঘরে হালকা বাতিটা নিবিয়ে বলল, “রেডি”। বলে পেটা ঘণ্টায় ঢং করে ঘন্টা বাজাল।

অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বঙ্কু দূরে এক কোণে গিয়ে বসল। কুলুঙ্গির টিমটিমে লাল বাতিটাই শুধু জ্বলতে লাগল।

যামিনী নিজে চোখ বন্ধ করার আগে একবার আড়চোখে দেখে নিলেন জগবন্ধু চোখ বন্ধ করেছেন কি না।

আশালতা ঢোক গিলে চোখ বুজে ফেললেন।

রমেশ মাথা নিচু করল।

বঙ্কু খানিকটা তফাত থেকে এমন একটা উদ্ভট শ্লোক পড়তে লাগল মনে হল যেন লামাদের দেশ থেকে আমদানি করেছে মন্ত্রটা।

বঙ্কুও চুপ করে গেল।

ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। কোনো রকম শব্দ নেই। নিশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যাচ্ছে না। ধুনোর ধোঁয়ায় ঘর ভরে গিয়েছে, ধূপের ঘন গন্ধ।

বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে জগবন্ধু কিছু বলে ফেলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় টেবিলের ওপর রাখা তেকাঠ নড়ে উঠল। যামিনী ফিসফিস করে বললেন, “এসেছেন।”

যিনি এসেছিলেন তাঁর বোধ হয় তেমন পছন্দ হল না জায়গাটা, তেকাঠ নাড়িয়েই চলে গেলেন।

খানিকটা পরে আবার একজন এলেন, তেকাঠ নাচালেন, রমেশের দিকে গড়িয়েও দিলেন তেকাঠ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিষ্ঠান করলেন না। পালালেন।

বার তিনেক এই রকম হল। এক একটি আত্মা আসেন, দু চার মুহূর্ত থাকেন, তারপর চলে যান। আত্মদর্শীরা তাঁদের নাগাল পান না।

শেষে আচমকা বঙ্কু বলল, “বাতি কাঁপছে, কেউ আসছেন। কাছকাছি এসে গেছেন।”

চারজনই কুলুঙ্গির বাতির দিকে তাকালেন। খুব কাঁপছে। মানে আত্মা একেবারে ঘরের দোরে।

যামিনী আঁচলটা গলায় জড়িয়ে দিলেন, আশালতা দু’হাত জোর করে কপালে ঠেকালেন।

লাল বাতি দপ দপ করতে করতে নিবে গেল।

সামান্য চুপচাপ থাকার পর বঙ্কু বলল, “উনি এসেছেন, বউদি! এবার কথাবার্তা বলা যেতে পারে। আপনারা কি কিছু বলবেন?”

বাতি নিবে যাবার পর ঘরে এক ফোঁটাও আলো নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। যামিনী স্বামীকেও ঠাওর করতে পারছিলেন না, বললেন, “তুমিই কথা বলো, বঙ্কু ঠাকুরপো।”

বঙ্কু বলল, “জগুদা, আপনারা বলবেন কিছু?”

রমেশ বললেন, “না না, তুমিই যা বলার বলো, আমরা শুনতেই চাই।”

বঙ্কু বলল, “বেশ।…কথার মধ্যে আপনারা কিন্তু বাধা দেবেন না।”

দু মুহূর্ত পরে বঙ্কু আগত আত্মার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করল।

বঙ্কু বলল, “আপনি এসেছেন, আমরা বড় খুশি হয়েছি। কোথা থেকে এসেছেন?”

আত্মা জবাব দিলেন, শোনা গেল না।

বঙ্কু বলল, “আপনার কথা কিছু শুনতে পাচ্ছি না। একটু জোরে জোরে বলুন।” চোঙা দিয়ে এবার আওয়াজ বেরুল। মেয়েলি গলা।

“আমাদের সৌভাগ্য আপনি এসেছেন। নমস্কার নিন। কোন স্তর থেকে আসছেন?” বঙ্কু বলল।

“সূক্ষ্ম তিন থেকে।”

“অনেক দূর থেকে আসছেন। বড় কষ্ট হয়েছে আসতে। আপনার পরিচয়?”

“বাড়িতে সবাই তিরি বলে ডাকত, ভাল নাম ছিল রাণী।”

বঙ্কু যেন চমকে উঠল। বলল, “সেকি। দিদি তুমি? তুমি এসেছ? এতদিন কত জনকেই তো ডেকেছি, তুমি তো কোনোদিন আসনি?”

“না। তুই ডাকতিস জানি। ইচ্ছে হত আসতে। তবু আসিনি, আজ এলাম চাঁদের হাট দেখতে।”

“চাঁদের হাট? বুঝেছি, তুমি জগুদা রমাদার কথা বলছ! সঙ্গে বউদিরা রয়েছেন—যামিনী বউদি, আশা বউদি।”

“জানি সব জানি। দিব্যি সব সুখে রয়েছে। তাইতো দেখতে এলাম। একেই বলে কপাল। ওদের সুখের কপাল।”

“সংসারে সুখের কপাল নিয়ে কজন আর আসে, দিদি। তোমার আমার মতন দুঃখের কপালই বেশি।” বঙ্কু ভারী গলায় বলল।

“আমাদেরও সুখ হত রে, বঙ্কু। কতকগুলো পাজি নচ্ছার হতচ্ছাড়ার জন্যে হয়নি। ওই তো জগুদা, ও আমায় বিয়ে করতে পারল না?”

জগবন্ধু খস খসে গলায় একটা আওয়াজ করলেন। যার অর্থ হল, এ-সব কী হচ্ছে?

বঙ্কু বলল, “বিয়ে তো বাপ-মায়ে দেয়, দিদি! জগুদা কি করবে?”

“বিয়ের বেলায় বাপ-মা। আর আমার সঙ্গে যে ছেলেবেলা থেকে প্রণয় ছিল।”

জগবন্ধু আর সামলাতে পারলেন না। বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “এটা হচ্ছে কী? তামাশা?”

তিরির আত্মা বলল, “তামাশা কে করেছে, তুমি না আমি?”

“বাজে বোকো না, আমি তোমার সঙ্গে প্র—প্রণয় করিনি।”

‘আহা রে! করিনি—মাইরি আর কি! ছেলেবেলায় কে আমায় পুকুরে নামিয়ে সাঁতার শেখাত, বাগানে নিয়ে গিয়ে অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়াত! বলুক না ওই রমাদা। সে তো দেখেছে নিজের চোখে।”

জগবন্ধু গলা চড়িয়ে বললেন, “ছেলেবেলার কথা বাদ দাও। তখন সবাই নাবালক। একসঙ্গে মিলেমিশে খেলাধুলো করে, গাছের আম পাড়ে, কোষ্ট কুল খায়, কানামাছি খেলে। ওকে কেউ প্রণয় বলে না।”

তিরি বলল, “তাই নাকি! তা পনেরো বছর পেরিয়ে গেলে তখনও কি ছেলেবেলা থাকে?”

“পনেরো পেরিয়ে তুমি বড় পাকা হয়ে গিয়েছিলে।”

“তোমার হাতে পড়লে পাকা হব না। কাঁচা আতা চালের তলায় গুঁজে রেখে মা মাসিরা আতা পাকাত দেখেছি। আর দেখলাম তোমাকে—। আমার কাঁচা বয়েসটাকে কেমন করে পাকিয়ে দিলে।”

রমেশ এই সময় গুন গুন করে টপ্পা গেয়ে উঠল, “আমার কাঁচা পিরীত পাড়ার ছোঁড়া পাকিয়ে দিল গো।”

জগবন্ধু ধমক মেরে বললেন, “ভালগার। বেহায়াপনা। আত্মা এমন বেহায়া হয় জানতাম না। ছ্যা ছ্যা—।”

তিরি হি হি করে হেসে বেঁকা গলায় বলল, “কেন গো জগুদা, ছ্যা—ছ্যা কেন? আমার সেই কচি বয়েসে যখন বাতাবিতলায় দাঁড় করিয়ে বিল্বমঙ্গল প্লে করতে তখন তোমার বেহায়াপনা কোথায় যেত!”

“বিল্বমঙ্গল ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার! তুমি তখনও মুখ্যু ছিলে এখনও মুখ্যু।”

তিরি ইস ইস শব্দ করল জিবে। বলল, “মুখ্যু তো বটেই নয়ত আমাকে পড়া দেখিয়ে দেবে বলে কেনই বা তেতলার ছাদে নিয়ে যাবে বলো। আহা দুজনে কত পড়াই পড়তাম—পড়তে পড়তে মুচ্ছো যেতাম। আমি রোগা পাতলা—তাই না তিরতিরে তিরি। আর তুমি গোবা গবলা। তোমার মুচ্ছো হলে সে ভার কি সইতে পারি, হেলে যেতাম।”

জগবন্ধু টেবিল চাপড়ে বললেন, “এ-সব হচ্ছে কি? আমার কাছা ধরে টান মারা হচ্ছে?”

যামিনী তিরির উদ্দেশে বললেন, “দাও ভাই দাও বুড়োর কাঁচাকাছা খুলে ন্যাংটো করে দাও।”

তিরি উৎসাহ পেয়ে বলল, “ও-হাঁড়ি কি ভাঙা যায়, বউদি। ও হল জ্বালা। বলতে গেলে সাত কাহন। আমার অত সময় নেই। অনেকক্ষণ এসেছি। যাবার সময় হয়ে গেল।”

জগবন্ধু গজরাতে লাগলেন, “মানুষ মরে গিয়েও এত মিথ্যে কথা বলতে পারে।”

তিরি ফোঁস করে উঠল। “কোপচো না। জ্যান্ত থাকতে তুমি আমায় দিয়ে মিথ্যে কথা বলিয়েছ? না নিজে বলছ? লজ্জা করে না। ঠাকুমার সত্যনারায়ণের মানত করা টাকা চুরি করে এনে দিয়েছি, কিনা জগুদা আমার ঝরিয়াতে সার্কাস দেখতে যাবে। দিইনি? নেমকহারাম একেই বলে! আমার কোলে লম্বা হয়ে শুয়ে উনি বললেন, তিরি আমি তোমার লখিন্দর—তুমি আমার বেহুলা, আমি তোমার প্রেমে মরেছি। তুমি আমায় যমের হাত থেকে উদ্ধার করো। আর তুমি যদি উদ্ধার না করো আমি সংসার ত্যাগ করে ভোলানাথ হয়ে ঘুরে বেড়াব হরিদ্বার লছমনঝোলা। ঠিক এই সময় জ্যাঠামশাই—জগুদার বাবা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। আর লখিন্দর আমার গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে সাক্ষাৎ যমের পাশ দিয়ে ছুটে পালাল।”

জগবন্ধু চিৎকার করে বললেন, “তোমার সেই ধেষ্টামির জন্যে বাবা আমায় সটান হেতমপুর কলেজে পড়তে পাঠিয়ে দিল তা জান?”

“তা জানব না। আমি তো তখন কুচি খুকি নই। সতেরো বছর বয়েস হয়ে গেছে।—ওই কীর্তির পরও বাড়ি এলে তোমার কত আদিখ্যেতা। আমার এ-গালে চুমু ও-গালে চুমু। এক একদিন গাল আমার নীল হয়ে যেত।”

জগবন্ধু আর্তনাদ করে উঠলেন। “প্রিভিলেজ অফ কিসিং আমার ছিল যে তোমার গালে চুমু খাব?”

“খেয়েছ!”

রমেশ বলল, “তিরি মিথ্যে বলছে না। আমি একদিন জগোবাবুকে কিস করতে দেখেছি। গোয়াল ঘরের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে করছিল।”

জগবন্ধু খেপে গিয়ে বললেন, “ও শালা, আমি হলাম চোর, আর তুমি সাধু!”।

তিরি বলল, “সাধু আবার কোথায়! সেদিন জগুদা একটা গালে চুমু খেয়ে চলে যাবার পর রমাদা এসে বলল, আমি তোদের চুমোচুমি দেখেছি। দে, আমায় দুটো দে, নয়ত বলে দেব বাড়িতে।”

রমেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বার কয়েক ঢোঁক গিলল। আমতা আমতা করে বলল, “আমার মনে নেই।”

আশালতা নিচু গলায় বলল, “কী ঘেন্না, কী ঘেন্না! এঁটো মুখে মুখ ঠেকাতে ঘেন্নাও করল না।”

বঙ্কু এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার বলল, “দিদি, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি আর কথা বোলো না, হাঁপাচ্ছ।”

তিরি একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, “সত্যি অনেক দেরি করে ফেললাম। অনেক দূর যেতে হবে। আমি এবার যাই। আমার কর্তা তো হাঁ করে চেয়ে আছেন। তা একটা কথা বলি জগুদা, বিয়ের পর আমার বর কিন্তু একদিনের জন্যেও কাছ ছাড়া করেনি। বড্ড ভালবাসত। কিন্তু কপাল যার মন্দ তাকে কে বাঁচাবে। শখ করে দু ঘটি বুনো সিদ্ধির সরবত খেয়েছিল, তার সঙ্গে চার ছটা কুলপি। ওতেই কাল হল। রাত আর কাটল না। তিরি জপতে জপতে চলে গেল মানুষটা। আর আমিই বা বেজোড়ে থাকি কেমন করে বলো। চার মাসের মাথায় আফিং খেলাম। এখন দুজনে দিব্যি জোড়ে আছি।”

যামিনী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। “আহারে সতী লক্ষ্মী!”

তিরি বলল, “এবার আসি। কথায় কথায় কত রাত হয়ে গেল। চলি গো জগুদা রমাদা। আসি ভাই বউদিরা। তোমরা ভাই সুখে শান্তিতে থাকো। বঙ্কু, আসি ভাই।”

সামান্য চুপচাপ। তারপর বঙ্কু বলল, “দিদি চলে গেছে। লাল বাতিটা আবার জ্বলে উঠেছে। এবার আমাদের উঠতে হবে।”

জগবন্ধুরা চলে যাচ্ছেন, বঙ্কু ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল।

ফটকের বাইরে এসে জগবন্ধু রাগে গর-গর করতে করতে বঙ্কুকে বললেন, “তুমি একটা হাড় হারামজাদা। শালা চিট!”

যামিনী কয়েদি ধরে নিয়ে যাবার মতন করে জগবন্ধুর ডান হাতটা খপ করে ধরে নিয়ে টান মারলেন। তাঁর বাঁ হাতে ছ শেলের ভারী টর্চ। বললেন, “কে কী সেটা পরে দেখব। আগে বাড়ি চলো।”

দু পা পেছনে রমেশ। আশালতা স্বামীকে হাতখানেক তফাত রেখে হাঁটছেন। আর বার বার স্বামীর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। মানুষটার ঘেন্নাপিত্তি এত কম! নাক সিঁটকে উঠল আশালতার।

জগবন্ধুরা সামান্য এগিয়ে যেতেই বঙ্কু ফটক বন্ধ করে বাড়ির দিকে ফিরল।

বারান্দায় ওঠার আগেই বঙ্কু খিলখিল হাসি শুনল।

“এত হাসি কিসের?” বঙ্কু বারান্দায় উঠে বলল।

হাসিতে তখন লুটোপুটি খাচ্ছে বঙ্কুর শালী বিজলী। শাড়ি সামলাতে সামলাতে বিজলী বলল, “দিলেন তো সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে?”

বঙ্কু হাসতে হাসতে বলল, “দাউ দাউ করে জ্বলবে না রে ভাই ধিকি ধিকি জ্বলবে। ভাগ্যিস তুই টাইমলি এসে পড়েছিলি! বেশ জমল।”

“আমি ভাবছিলুম সাক্ষাৎ জ্যান্ত গলা ধরা না পড়ে যাই।”

“জগুদা তখন নিজেই ধরা পড়ছে, গলা ধরার হুঁশ আছে নাকি তার। নে চল, খিদে পেয়ে গেছে। রাত হল।”

ঘরের মধ্যে পা বাড়াতে বাড়াতে বিজলী বলল, “কাল কিন্তু আমি ফিরে যাব।”

“বেশ তো যাবি। তোকে কে আটকাচ্ছে।”

বিজলী বঙ্কুর গায়ে ঠেলা মেরে বলল, “আহা! কে আটকাচ্ছে!”

কালিদাস ও কেমিস্ট্রি

যেন বাঘে তাড়া করেছে, মহেশ্বরী পড়িমরি করে ছুটে এসে ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল।

ঘরের মধ্যে তখন সাত আটটা মেয়ে মিলে তালে তালে তালি বাজাচ্ছে, মুখের মধ্যে জিবের শব্দ করছে টক্ টক্ টাকাস্‌ট্টক্‌। আশা মেঝেতে উবু হয়ে বসে সিগারেটের কৌটোর মধ্যে রাখা ক্যারামের গুটি বাজাচ্ছিল। আর বকুল হাঁটু থেকে গলা পর্যন্ত পাকে পাকে শাড়িটা জড়িয়ে দুহাত মাথার ওপর তুলে তুড়ি দিয়ে ভ্রূভঙ্গি ও কটাক্ষসহযোগে পা ঠুকে ঠুকে বিচিত্র নাচ নাচছিল। ইরানি নাচ হয়ত। তার গলা হাঁসের গলার মতন দোল খাচ্ছিল।

এই নৃত্যবাদ্যের মধ্যেই মহেশ্বরী একটু আগে উঠে কলঘরে গিয়েছিল। ফেরার সময় বাঘের তাড়া খাওয়ার মতন ছুটতে ছুটতে এসে ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল। মেয়েরা ভেবেছিল, দৌড়ে আসতে গিয়ে মহেশ্বরী চৌকাটে হোঁচট খেয়েছে। পড়ল তো পড়ল একেবারে আশার ঘাড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মহেশ্বরী। আশা মোটাসোটা গোলগাল মানুষ, ব্যাঙের মতন হাত পা তুলে মেঝেতে উলটে গেল। কোনও রকমে মহেশ্বরী শুধু বলল, ‘কার্বন ডায়োক্সাইড আতি হ্যায় রে।’

মুহুর্তের মধ্যে ঘরের চেহারা পালটে গেল। এ-বিছানা ও-বিছানা থেকে মেয়েরা আতঙ্কের ডাক ছেড়ে লাফ মেরে উঠে দরজার দিকে ছুটল, ঊষা ছুটে গিয়ে আলনার পাশে শাড়ি শায়ার আড়ালে লুকোল।

পালাবার পথ পাওয়া গেল না। খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল কার্বন ডায়োক্সাইড আসছে। মেয়েরা তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

মেয়েরা বলে ‘কার্বন ডায়োক্সাইড’ আসলে নাম ওর ফুলরেণু সোম। কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। এদিকে আবার মেয়ে হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট।

ঘরের চৌকাটের সামনে দাঁড়িয়ে ফুলরেণু রঙ্গমঞ্চের অবস্থাটা কিছুক্ষণ দেখল; গুটি ছয় সাত মেয়ে, ঘরের মধ্যে তিনটি বিছানাই লণ্ডভণ্ড ধামসানো। মেয়েরা বিছানার কাছে, কেউ বা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের জানলা খোলা, পড়ার টেবিলে কেরোসিন টেবিল-বাতি জ্বলছে। বকুল তার হাত দুটো মাথার ওপর থেকে নামিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু সারা অঙ্গে পাকে পাকে জড়ানো শাড়িটা আর আলগা করতে পারেনি; তাকে লেত্তি পরানো ঘোড়া লাট্টর মতো দেখাচ্ছিল।

চৌকাটে দাঁড়িয়ে ফুলরেণু বলল, “এত নাচগান হল্লা কিসের?”

মেয়েদের মুখে কথা নেই, ঠোঁটে সেলাই দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। একেবারে নিরীহ, গোবেচারি মূর্তি সব।

অপরাধীর মতন মুখ করে বকুল শেষে বলল, “আমরা একটু আনন্দ করছিলাম দিদি।”

আনন্দ করার কথায় ফুলরেণু বিন্দুমাত্র আনন্দিত হল না; বরং আরও গম্ভীর বিরক্ত মুখ করে বলল, “আনন্দ করতে হলে মাঠে যাও, রাস্তায় যাও, আমার হোস্টেলের বাইরে যাও। এখানে আনন্দটানন্দ চলবে না। এটা আনন্দধাম নয়। এরকম বেয়াড়াপনা, হইহুল্লোড় আমি অ্যালাও করব না।” ফুলরেণু থামল, যেন তার রায় দিয়ে দিল দু-কথায়। তারপর মেয়েদের জনে জনে লক্ষ্য করল, বকুলকেও। বলল, “বকুল তুমি ওটা কি করে শাড়ি পরেছ? ওটা শাড়ি, না সাপের খোলস। আমার এখানে সাপের খোলস করে শাড়ি পরা চলবে না। যত অসভ্যতা, সব…প্রীতি, তুমি আড় চোখে চোখে কী বলছ? আমি তোমাদের এ সব আড়বাঁশি-চাউনি দু চক্ষে দেখতে পারি না।…আর, মহেশ্বরী, তুমি—তুমি আমায় দেখে দুদ্দাড় দৌড় দিলে, ভাবলে আমি তোমায় দেখিনি। এভাবে দৌড়তে হলে তোমায় ঘোড়দৌড় মাঠে যেতে হবে, এখানে চলবে না। মেয়েদের কাছে আমি সভ্যতা ভদ্রতা ডিসেন্সি চাই—অসভ্যতা বেলেল্লাপনা নয়।”

আশা ঢোঁক গিলে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, ফুলরেণু ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, “কলেজে তোমরা যা করো আমি দেখে অবাক হয়ে যাই। এ কলেজে ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই, তোমরা দল করে সাইকেল চড়ছ, জল ছোঁড়াছুঁড়ি করছ, ছেলেদের সঙ্গে তুই-তুকারি করছ, ডালমুট কেড়ে খাচ্ছ! কী যে না করছ।…এ কলেজে কোনও ডিসিপ্লিন নেই, সহবত শিক্ষা, ভালমন্দ, ছোটবড় জ্ঞান দেখি না কোথাও; সবাই যেন নাগরদোলায় চড়ে আছে। কী অসভ্য সব। ছি ছি!…তা আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি নাচানাচি, লাফালাফি, তুড়ি বাজানো, যা তোমাদের ইচ্ছে তোমরা কলেজে সেরে আসবে, আমার এখানে আমি অসভ্যতা করতে দেব না।…যাও, নিজের নিজের ঘরে যাও।…মহেশ্বরী, আমি আধঘন্টার মধ্যে তোমাদের ঘর পরিষ্কার পরিছন্ন দেখতে চাই।” ফুলরেণু শেষবারের মতন তার তাড়না শেষ করে যেমনভাবে এসেছিল, সেইভাবেই চলে গেল! বারান্দায় তার পায়ের শব্দ শোনা গেল কয়েক মুহূর্ত।

ফুলরেণু অদৃশ্য হলে মেয়েরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। আলনার আড়াল থেকে ঊষা বেরিয়ে এল, তার চুলের বিনুনিতে কার যেন নীচের জামার হুক আটকে ঝুলছে।

মহেশ্বরী বলল, “বাস রে বাস, কার্বন ডায়োগাইড কি টেমপারেচার হট হয়ে গেছে রে…”। মহেশ্বরীর হিন্দি-বাংলা মাঝে মাঝে এই রকমই হয়। যদিও সে বাংলা কথা মোটামুটি ভালই বলতে পারে বলে তার ধারণা।

প্রীতি বলল, “হবে না। কতদিন ধরে বলছি জামাইবাবুর সঙ্গে দিদির একটা হট-লাইন পেতে দে, তা তো তোরা দিবি না।”

বকুল পাক দেওয়া শাড়ির প্যাঁচ গা থেকে খুলতে খুলতে বলল, “বলিস না আর তোরা। হট-লাইন না পাততেই এত হট, পাতলে সারাদিন আগুন জ্বলবে।”

মেয়েরা সমস্বরে খিলখিল করে হেসে উঠল।

আসর ভেঙে যেতে ঊষা বলল, “এই বা কি কম জ্বলছে। একেবারে কোপানল। আজ আবার জামাইবাবু পড়াতে আসবে। দিদি কী করবে ভাই? মদনভস্ম।”

মেয়েরা এবার কলকল করে হাসল।

এই গল্পের এইটুকু ভূমিকা। কিন্তু ফুলরেণুর রাগ বা উষ্মা কিংবা বিরক্তি বুঝতে হলে আমাদের এবার তার কাছে যেতে হবে।

মেয়েদের শাসন করে ফুলরেণু তার ঘরে ফিরে গেল। ঘরে ঢুকল না ঠিক, পশ্চিমের দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সন্ধে হয়ে গেছে। সামনের নেড়া জমিতে ধুলোভরা করবী ঝোপ। ফাল্গুনের বাতাসে মাঝে মাঝে দুলছিল। হোস্টেলের পাঁচিলের ওপাশে রাস্তা, টাঙা গাড়ি যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে দু একটা লরিটরি। শীত কবে ফুরিয়ে গেছে, সামনে ফাগুয়া, রানি-বাঁধের দিক থেকে ধোপাপট্টির হল্লা ভেসে আসতে শুরু করেছিল, ফাগুয়ার গান হচ্ছে। বাতাস খুব এলোমেলো, দক্ষিণ থেকে দমকে দমকে আসছে আর যাচ্ছে। অনেকটা তফাতে দেশবন্ধু সিনেমা হল, এখন আর গান নেই, ন’টা নাগাদ আবার সিনেমা হলের লাউডস্পিকারে গান বাজাবে এবং সেই তীব্র গান এখানেও ভেসে আসবে। ফুলরেণুর পক্ষে তখন আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।

বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফুলরেণু ঘরে এল। এসে আবার জল খেল এক গ্লাস। এই নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে তার তিনবার তিন গ্লাস জল খাওয়া হল। না, এখনও এতটা গরম পড়েনি যে ক্ষণে ক্ষণে জল খেতে হবে। তবু ফুলরেণুকে আজ জল খেতে হচ্ছে। মাথা আজ আগুন, ফুলরেণু ভাবতেও পারছে না, এটা কী করে হয়, কী করে হওয়া সম্ভব? ছি ছি!

ঘরের মধ্যে নড়ে চড়ে ফুলরেণু বিছানায় গিয়ে বসল, বসে আবার উঠল, টেবিলের দিকে তার আর তাকাতে ইচ্ছে করছিল না। একরাশ খাতা টেবিলের এক পাশে ডাঁই করে পড়ে আছে। কয়েকটা মাত্র দেখা হয়েছে, বাকিগুলো হয়নি। কে বিশ্বাস করবে, নিরীহ ওই খাতাগুলোর মধ্যে এ-রকম বেলেল্লাপনা লুকিয়ে থাকতে পারে! ছি ছি। ফুলরেণুর হাতের আঙুলের ডগা বোধহয় এখনও ঠাণ্ডা হয়ে আছে ঘামে। বুকের ধকধক ভাবটা কমেছে অবশ্য, মাথা এখনও বেশ গরম, কপালের শিরা দপদপ করছে। ফুলরেণু টেবিলের দিকে যেন লজ্জায় আর তাকাতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল: মৃদুলা যেন বুকের কোথাও একটু আবরণ রাখেনি, একেবারে বেহায়ার মতন বসে আছে, বসে বসে নিজেকে দেখাচ্ছে। ছি ছি! ওই একরত্তি মেয়ে পড়ে তো সেকেন্ড ইয়ারে, কতই বা বয়স উনিশ কুড়ি বড়জোর না হয় একুশ, এরই মধ্যে এত! অসভ্য, পাকা মেয়ে কোথাকার।

বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না ফুলরেণু, উঠল; উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল দু দণ্ড। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েদের ক্লাসে একটা প্রশ্নের উত্তর লিখতে সে দিয়েছিল। একেবারে সাধাসিধে প্রশ্ন: হোয়াট আর দি চিফ প্রপারটিস অফ সালফার ডায়োক্সাইড? হাউ ইজ ইট প্রিপেয়ারড, অ্যান্ড ফর হোয়াট পারপাসেস ইজ ইট ইউসড?…এই প্রশ্নের উত্তর যা লিখেছে মৃদুলা তাতে তাকে শক্ত হাতে নম্বর দিলেও দশের মধ্যে অন্তত চার দিতে হয়। অবশ্য এ পরীক্ষা নম্বর দেওয়া-দেওয়ির নয়, ছেলেমেয়েদের কিছু আসে যায় না এতে। ফুলরেণু নিজে ফাঁকিটাকি পছন্দ করে না, পড়ানোর ব্যাপারে সে খুব কড়াকড়ি করে, নিজে পরিশ্রমী; ছেলেমেয়েরা কেমন পড়ছে, কতটা শিখছে তা তার দেখা দরকার—এই বিবেচনায় নিজের ক্লাসে মাঝে মাঝে ‘লেসন টেস্ট’ নেয়। তার জন্য আলাদা খাতা করতে হয়েছে ছেলেমেয়েদের। ফুলরেণু ঘাড়ে করে সেই খাতা বয়ে আনে, দেখে, আবার ক্লাসে ফেরত দেয়। এবারে গতকাল তার সেকেন্ড ইয়ারের কেমিস্ট্রি ক্লাসে ওই প্রশ্নটা লিখতে দিয়েছিল; প্রপারটিস অফ সালফার ডায়োক্সাইড…।

ফুলরেণু জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে টেবিলের দিকে আবার একবার তাকাল। যেন আড়চোখে মুদুলাকেই দেখছে। ‘মৃদুলা তুমি সালফার ডায়োক্সাইডের চিফ প্রপারটিস যা লিখেছ—ডিসইনফেকটান্ট, ব্লিচিং অফ কালারড মেটিরিয়াল…এ সব মোটামুটি ঠিক, কিন্তু তোমার খাতার মধ্যে ওটা কি?’ ফুলরেণুর চোখের দৃষ্টি যেন এই কথাগুলো বলল। সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের দিকে আর সে তাকাতে পারল না, কানের লতি গরম হয়ে উঠল; মুখ ফিরিয়ে নিল।

জানলার কাছে আরও একটু দাঁড়িয়ে থেকে ফুলরেণু বিছানায় এল, বসল। চশমার কাচটা মুছে আবার পরল। গালে হাত রেখে ভাবল খানিকটা। তারপর উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। লবঙ্গ খাবার ইচ্ছে করছিল, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার। জিবে আর কোনও স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা ফুলরেণুকে টেবিলের কাছে এসে লবঙ্গের শিশি বের করতে হল।

লবঙ্গ মুখে দিয়ে নিতান্ত যেন জোর করেই ফুলরেণু চেয়ারে বসল। বসে তাকাল: টেবিলের ওপর মৃদুলার খোলা খাতা; পাশে পেপারওয়েট চাপা দেওয়া ভাঁজ করা চিঠি। এই খোলা চিঠিটাই মৃদুলার খাতার মধ্যে পাওয়া গেছে। যদি খামের মধ্যে থাকত ফুলরেণু দেখত না। একেবারে খোলাখুলি, তায় আবার রঙিন ফিনফিনে কাগজ। চোখে না পড়ে পারেনি।

কাঠি দিয়ে বাচ্চারা যেমন শুঁয়োপোকা ছোঁয়, ফুলরেণু অনেকটা সেইভাবে তার খাতা-দেখা লাল-নীল পেন্সিল দিয়ে চিঠিটা ছুঁল। এখনও তার গা বেশ সিরসির করছে। মুখের মধ্যে জিবে লবঙ্গের ঝাল ভাবটায় ঠোঁট ভিজে গিয়েছিল, লালা আসছিল সামান্য।

মৃদুলা যে চূড়ান্ত অসভ্য হয়ে গেছে, ফুলরেণুর তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছিল না। মেয়ে একেবারে পেকে হলুদ। লজ্জা-শরম বলে কিছু নেই। ছি ছি ওইটুকু মেয়ে, এই বয়সে এতটা উচ্ছন্নে গেছে কে জানত! বুদ্ধিসুদ্ধি তো একেবারে কম নেই, কিন্তু এই তোমার রুচি? আড়াই পাতা ধরে ভালবাসার চিঠি লিখেছ। তুমি এত শয়তান যে কাকে চিঠি লিখছ তা কোথাও ধরাছোঁয়ার উপায় নেই, নীচে নিজের নামটাও লেখনি। তা বলে হাতের লেখাটা যে তোমার তা তো বোঝাই যায়, খাতার আগে পেছনে তোমার বাংলা হাতের লেখার নমুনা আছে।…পেটে পেটে এত শয়তানি তোমার, অথচ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।

হতচ্ছাড়া পাজি মেয়ে কোথাকার। তুমি এত ধূর্ত যে কাকে চিঠিটা লিখেছ বুঝতে পারছি না। কলেজের কোনও ছেলেকে নিশ্চয়। তার নাম জানতে পারলে দেখতুম। এই কলেজে তাকে আর ঢুকতে দিতাম না। প্রিন্সিপ্যালকে বলে তাড়িয়ে দিতাম। তোমাকেও। তোমাদের শাস্তি এবং শিক্ষা হওয়া দরকার।

কিন্তু—ফুলরেণু ভেবে দেখল, এ যা কলেজ এখানে কোনও কিছুরই শাস্তি হত না, শিক্ষাও নয়। ছেলেমেয়েরা এইরকমই, কোনও সহবত শেখে না, মানে না। বিশ বছরের ধুমসি মেয়ে দুটো ছোঁড়ার সঙ্গে সেদিন কলেজ-মাঠে সাইকেল রেস দিচ্ছিল। আর একদিন এক ডজন কলা কিনে এনে থার্ড ইয়ারের ছেলেমেয়ের মধ্যে সে কি লুফোলুফি, কলা ছোড়াছুড়ি, খামচাখামচি। ক্লাসে কোনও ছেলে জব্দ হলে মেয়েগুলো উলু দেওয়ার মতন শব্দ করে ওঠে, মেয়েরা জব্দ হলে ছেলেরা টেবিল চাপড়ে গরুবাছুরের ডাক ডাকে। এত হুড়োহুড়ি দাপাদাপি, নাচানাচি, ঝগড়াঝাটি, তুই-তোকারি ছেলেমেয়েদের মধ্যে, তবু প্রফেসাররা কেউ কোনও কথা বলে না। বরং দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজের যেন এটাই ঐতিহ্য। তেমনি হয়েছেন প্রিন্সিপ্যাল, বুড়ো মানুষ, ছেলেমেয়েদের হাতেই লাগাম তুলে দিয়েছেন, যা করার তোমরা করো, কেউ রাশ ধরবে না।

এ-রকম যদি কলেজ হয় তবে ছেলেমেয়েরা এর বেশি কী হবে? প্রফেসারদেরও কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই; নিতান্ত তারা মাস্টার-মাস্টারনি, বয়স হয়েছে, চুলটুল পেকেছে, কারও কারও দাঁত পড়েছে, মেয়েদেরও কারও কারও গায়ে গতরে মেদ জমে মাথার চুল উঠে ভারিক্কি হয়েছে—নয়ত এরাও সব এই কলেজের ছেলেমেয়েদের মতন, বাঁধাবাঁধি ধরাধরি বলে কিছু নেই। নিজেদের ঘরে বসে রঙ্গ রসিকতা, হাহা হোহো দাদা-দিদি করে দিব্যি আছে সব। প্রফেসারস রুমের একটা পাশে পার্টিশান করা মেয়ে প্রফেসারদের ঘর। কিন্তু সারা দিনে যদি একটা ঘন্টাও সেই ঘরে মেয়ে প্রফেসাররা বসে! তারা প্রায় সব সময়ই পুরুষদের ঘরে বসে গল্প করছে, চা শরবত খাচ্ছে, পান চিবুচ্ছে, জদা বিলি করছে। ফুলরেণু অনেকবার এ-বিষয়টা আভাসে ইঙ্গিতে বলতে গেছে মেয়েদের। কথাটা কেউ কানে তো তোলেনি; যেন শোনার মতন বা ভাববার মতন কথাই ওটা নয়। ফুলরেণু এ কলেজে নতুন, মাত্র মাস ছয়েক এসেছে; তার পক্ষে পাঁচ সাত এমন কি দশ বছরের পুরনো মেয়ে প্রফেসারদের আর কি বা বলা সম্ভব। হিস্ট্রির সুমিত্রা দেবী তো একদিন বলেই দিয়েছিলেন, “এ সব ফিকির ভাল না, বহিন। ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি ছোড় দো।” হাসতে হাসতেই বলেছিলেন সুমিত্রা দেবী, কিন্তু খোঁচাটা বেশ লেগেছিল ফুলরেণুর। বেহারি মেয়ে সুমিত্রা দেবী, সাত বছর এই কলেজে আছেন, এখানকারই মেয়ে, স্বামী ছেলেদের স্কুলের হেডমাস্টার। দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজের ধারাবাহিক ইতিহাস তাঁর মুখে ম্যাগনাকার্টা চার্টারের মতন, রাজা দীপনারায়ণের কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, আদর্শ তাঁর মুখস্থ। এক দুই তিন করে পর পর তিনি বলে দিতে পারেন; এখানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ নেই, জাতিধর্ম সংস্কার নেই, প্রাদেশিকতা নেই, মাস্টার-মাস্টারনির দাপট নেই…ইত্যাদি। সোজা কথা, দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজেরর প্রফেসাররাও এই কলেজের গড়িয়ে যাওয়া জলে গা ডুবিয়ে মহাসুখে দিন কাটাচ্ছেন।

ফুলরেণুর এসব ভাল লাগে না। লাগছেও না। সভ্যতা, ভদ্রতা, সহবত, শিষ্টতা—এ-সব যদি না শেখানো হয় তবে ছেলেমেয়ের মাথা চিবিয়ে খাওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না। হচ্ছেও তাই। এই যেমন মৃদুলার বেলায় দেখা গেল। আগে আরও কিছু কিছু দেখেছে ফুলরেণু কিন্তু এরকম পরিষ্কার ও প্রত্যক্ষ নয়, এভাবে হাতেনাতে তার কাছে আর কেউ আগে ধরা পড়েনি।

হাতের পেনসিল টেবিলে ফেলে রেখে এবার আস্তে হাত বাড়াল ফুলরেণু, যেন শুঁয়োপোকার কাঁটা তার হাতে ফুটবে কিনা বুঝতে পারছে না। দু আঙুলে চিঠিটার কোনা ধরে টানল আস্তে আস্তে; বোধহয় কাঁটা যা ফোটার আগেই ফুটেছে, নতুন করে কিছু ফুটল না। চিঠিটা খুলল ফুলরেণু। আবার পড়ল। এই নিয়ে সাত আটবার পড়া হল।

বাব্বা, কী ছটা ভাষার! এতটুকু লাজ-লজ্জা নেই। কিছুই যেন আটকাচ্ছে না। আবার কথায় কথায় কবিতা, ময়ূরের মতন হৃদয় জাগছে, প্রজাপতির পাখার মতন স্বপ্ন ছুটছে, ডালে ডালে ফুল ফুটছে, মাঝরাতে বালিশের কানে কানে কথা হচ্ছে! বালিশের আবার কান! ফুলরেণুর মনে হচ্ছিল মৃদুলাকে কাছে পেলে ঠাস করে এক চড় মারত। কুমারী মেয়ে তুমি, রাত্তিরে বালিশটাকে তুমি অন্য জিনিস ভেবে গাল ঘষছ? স্বভাব-চরিত্র একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে তোমার…ছিছি এ-সব কথা কি ভাবা যায় যে মেয়েমানুষে লেখে। কোনও মেয়ে কি ভাবতে পারে তার বুকের সামনে একটা পুরুষ আয়না ধরুক, ধরে দেখুক কে আছে! অথচ ওই মেয়ে লিখেছে। হতভাগা মেয়ে কোথাকার। আবার কত আশা, আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে।

চিঠিটা বন্ধ করে ফেলল ফুলরেণু। চোখের পাতাও বুজে ফেলল। দাঁত চেপে চেপে বলল, তোমার ফুল আমি ফোটাচ্ছি ডেঁপো মেয়ে। কাল প্রিন্সিপ্যালের কাছে যাব। তোমার মা বাবার কাছেও যদি যেতে হয় তাও যাব।

চিঠি রেখে দিল ঠেলে ফুলরেণু। এত ভাষার ছটা এরা কোথায় পাচ্ছে এবার যেন তা আবিষ্কার করতে পারল। নির্ঘাত ওই বাংলা-সংস্কৃতের ভদ্রলোক স্বর্ণকমলবাবুর বিদ্যে থেকে। অমন অসভ্য তো আর দেখা যাবে না ভূ-ভারতে। কোঁচা দুলিয়ে ধুলো ঝাঁট দিতে দিতে কলেজে আসছে, মাথায় উড়ু উড়ু চুল, চোখে কুচকুচে কালো ফ্রেমের চশমা, গায়ে ঢিলে পাঞ্জাবি! হাতে চটি চটি বই, কাব্যটাব্যর হবে হয়ত। গলা কী, যেন সব সময় থিয়েটার করছে ক্লাসে। রসিকতায় প্রোফেসাররা মুগ্ধ, ছেলেমেয়েরা সব ইয়ার-বন্ধু হয়ে উঠেছে। ক্লাসে যখন পড়ায় নিজের মানসম্মান সম্রম সৌজন্যটুকু পর্যন্ত রাখে না। কি সব কথা বলে রঙ্গ রসিকতা করে, আজেবাজে গল্প…। ভীষণ ডিস্টার্বিং। ফুলরেণুকে সপ্তাহে অন্তত পাঁচবার ওই কার্তিক-টাইপের লোকটার পাশাপাশি ঘরে ক্লাস নিতে হয়। ছাই, এ-কলেজের আবার ওই এক রয়েছে; ওয়েস্ট ব্লক বলতে হলঘরের হাট। একটা বড় হলঘরের তিনটে পার্টিশান আছে কাঠের—সেখানেই ওয়েস্ট ব্লকের ক্লাস বসে ভাগে ভাগে। পাশাপাশি ঘরে ক্লাস পড়লে ফুলরেণু আর পড়াতে পারে না, কাঠের পার্টিশান টপকে ওই লোকটার থিয়েটারি গলা ভেসে আসে, সংস্কৃত কাব্য পড়াচ্ছে, তার যত ব্যাখ্যা। রীতিমত অসভ্য। কিংবা বাংলা পড়াচ্ছে—সুর করে করে—কথায় কথায় হাসি উঠছে পাশের ঘরে। জ্বালাতন একেবারে। ফুলরেণু ক্লাসের মধ্যে রাগ করেছে, ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে এসে ওই লোকটার ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে, লোকটা বেরিয়ে এলে বলেছে, “এভাবে গোলমাল হলে আমার পক্ষে ক্লাস করা যায় না।” লোকটা মুচকি হেসে বিনীত গলায় জবাব দিয়েছে, “ক্ষমা করুন। আমার ক্লাস শান্ত রাখছি, আপনি পড়ান।”

…ক্লাসের বাইরেও প্রফেসারদের ঘরে কথাটা তুলেছে ফুলরেণু, “আপনার ক্লাসে বড় গোলমাল হয়, আমি পড়াতে পারি না। কেমিষ্ট্রি একটা ছেলেখেলার সাবজেক্ট নয়।” স্বর্ণকমল হাত দুটি জোড় করে ঘাড় হেলিয়ে হেসে হেসে জবাব দিয়েছে, “আমি বড়ই লজ্জিত। রসশাস্ত্র আর রসায়নশাস্ত্রের তফাতটা ছেলেমেয়েরা বোঝে না। আমি ওদের বুঝিয়ে দি, মনে রাখতে পারে না।” ফুলরেণু গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছিল, “আপনি নিজে মনে রাখলেই আমি খুশি হব।” লোকটা চটপট হেসে জবাব দিয়েছে, “আমি তো দিবারাত্রি স্মরণে রাখি।”…হাসিটা ফুলরেণুর ভাল লাগেনি। কী রকম যেন। আর ঘাঁটাতেও ইচ্ছে হয়নি।

বাংলা-সংস্কৃতের ওই স্বর্ণকমলের সঙ্গে তার চটাচটির ব্যাপারটা প্রফেসাররা জেনেছেন, ছেলেমেয়েরাও দেখেছে, জেনেছে। ফুলরেণুর তাতে খানিকটা রাগ বেড়েছে বই কমেনি। কিন্তু উপায় কি! স্বর্ণকমল দেড় বছর এখানে আছে, সিনিয়ার; সে মাত্র ছ’ মাস—জুনিয়ার। স্বর্ণকমলের নাকি খুঁটির জোর বেশি, তার বাবা মুঙ্গেরের নামকরা ডাক্তার ছিলেন, ধনী লোক, ভাইরা সব এক একটি দিক্‌পাল। ইনি ছোট, কাজেই বয়ে গেছেন আদরে, কাব্যটাব্য নিয়ে পড়ে আছেন।

তা যাক, ফুলরেণু এবার উঠল চেয়ার থেকে, মৃদুলার চিঠিতে যত ভাষার ছটা, পাকামি, অসভ্যতা, তাতে বেশ বোঝা যায় যে স্বর্ণকমলের প্রভাব ওতে আছে। ফুলরেণুর সন্দেহ নেই। কাল কলেজে গিয়ে মেয়ে প্রফেসারদের কাছে কথাটা তুলবে ফুলরেণু। বলবে, দেখুন আপনারা—ভেবে দেখুন, মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে আপনাদের যদি কোনও কিছু কর্তব্য না থাকে করবেন না কিছু। কিন্তু আমি সহ্য করব না। আমার সাধ্যমত আমি করব! ফাইট করব। না হলে কলেজ ছেড়ে চলে যাব।

ফুলরেণু আর-একটি সিদ্ধান্ত করে নিল। স্বর্ণকমল সপ্তাহে দুদিন এই হোস্টেলে ঊষা আর মমতাকে পড়াতে আসে, শখের টিউশানি; মেয়েদের হোস্টেলে ওর আসা বন্ধ করতে হবে। লোকটা ভয়ঙ্কর, ওর ছোঁয়াচে হোস্টেলের মেয়েদের মতিগতি খারাপ হতে পারে, ফুলরেণু তা হতে দিতে পারে না। তার একটা দায়িত্ব আছে।

চিঠিটা সন্তর্পণে ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দিল ফুলরেণু। সে ভেবে পেল না—কেমিষ্ট্রি মেয়ে মৃদুলার কি করে এইসব বাজে প্রেম-ফ্রেমে মাথা গেল! জগৎ-সংসারে জানা এলিমেন্ট এখন একশো আট, তার বাইরে যে কিছু নেই মৃদুলার তা জানা উচিত। তুমি সালফার ডায়োক্সাইডের প্রপারটিস লিখেছ, ডিসইনফেকটান্ট মানে যে জিনিস ছোঁয়াচের আক্রমণ থেকে বাঁচায়, তুমি…তুমি…ছি ছি—এইসব বাজে ছোঁয়াচে নোংরামির পাল্লায় পড়লে!

ফুলরেণুর নিজের মাথাই যেন লজ্জায় কাটা যাচ্ছিল।

মাথা ধরে যাচ্ছিল বলে ফুলরেণু পায়চারি করার জন্য ঘরের বাইরে এল। বাইরে এসে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লক্ষ্য করল, মাঠ দিয়ে স্বর্ণকমল আসছে। আজ তার পড়াবার দিন নাকি? এত দেরি করে আসা কেন? কটা বেজেছে?

স্বর্ণকমলকে তাড়িয়ে দেবার ইচ্ছে হল ফুলরেণুর। কিন্তু উপায় নেই।

মাঝে মাঝে স্বর্ণকমল পড়াতে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যায়। ভদ্রতার জন্য ফুলরেণু কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ঘরেও ঢুকতে দেয় না। আজ ফুলরেণু ঠিক করল, স্বর্ণকমলের সঙ্গে দেখাও করবে না। ওর হোস্টেলে আসাও বন্ধ করতে হবে।

লোকটা বড় ছোঁয়াচে। ইভিল।

দুই

পরের দিন কলেজে এসে কথাটা তুলব তুলব করেও ফুলরেণু তুলতে পারল না। এ যা সৃষ্টিছাড়া কলেজ, যেমন সব মাস্টার-মাস্টারনি তাতে হুট করে একটা কথা তুলে সকলের কাছে হাস্যাস্পদ হওয়া বিচিত্র নয়। হয়ত তাকে নিয়ে আড়ালে হাসিঠাট্টা করবে, কাজের কথাটা কানেই তুলবে না। মৃদুলার চিঠিটা এক্ষুনি ওদের কাছে মেলে ধরতে চায় না ফুলরেণু। সেটা উচিত হবে না। তাতে ব্যাপারটা একেবারে হাটেবাজারে হয়ে যাবে। হাজার হলেও মৃদুলা মেয়ে এবং ছাত্রী; তার ভালবাসাবাসির চিঠি পুরুষদের চোখে পড়ুক এটা ফুলরেণু চায় না। সে যা করবে, শালীনতা ও সন্ত্রম বজায় দেখে করবে, গোপনে এবং যথাসাধ্য সতর্কতায়। ব্যাপারটা হই-হই করে করার নয়, হাটে হাঁড়ি ভেঙে জল ছিটানোর বিষয়ও নয়। চিঠিটা এখন থাক। ফুলরেণুর কাছে যেন ওটা বঁড়শি। প্রথমেই জোরজবরদস্তি করে টান মারতে গেলে ছিঁড়ে যেতে পারে, মাছের টাগরা থেকে খুলে যেতেও পারে; তখন আর করার কিছু থাকবে না। তার চেয়ে ধীরেসুস্থে বেশ করে খেলিয়ে তবে যা করার করতে হবে। ফুলরেণু শুধু যে মৃদুলাকে শিক্ষা দিতে চায় তা নয়, এই বেলেল্লা বেহায়া কলেজের চরিত্র শুধরে দিতে চায়, ভদ্র শালীন সভ্য করতে চায়। …তা ছাড়া আরও একটু নজর করার আছে, মৃদুলাকে নজর করতে হবে, অন্য ছেলেমেয়েদের, স্বর্ণকমলকেও। মেয়ে প্রফেসারদের কাছেই কথাটা আভাসে তুলবে ফুলরেণু প্রথমে, তুলে মনোভাবটা বুঝবে; তারপর তার ইচ্ছে পুরুষ প্রফেসারদের কিছু না জানিয়ে যদি কিছু করা যায় করবে, এমন কি, প্রিন্সিপ্যালকে যদি জানাতে হয় মেয়ে প্রফেসারদের তরফ থেকেই আড়ালে জানাতে হবে।

সেদিন আবার উমাদি আসেননি। উমাদির ওপরেই ফুলরেণুর একটু ভরসা আছে। উমাদি পুরনো লোক, বয়েস হয়েছে অনেকটা, এ-অঞ্চলের পুরনো নাম করা গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে, সভ্যতা শালীনতা মান্য করেন। কথাটা তাঁর কাছে তোলাই ভাল।

ফুলরেণুর সেদিন আর কিছু বলা হল না, কিন্তু ওয়েস্ট ব্লকের হলে ক্লাস নিতে গিয়ে পাশের ঘরে স্বর্ণকমলের পড়ানো কিছু কিছু শুনে রাখল। কাঠের পার্টিশানের ওপর থেকে যে কথাগুলো ভেসে আসছিল ফুলরেণু তার কিছুই বুঝছিল না; স্বর্ণকমল সংস্কৃত পড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে শুধু ফুলরেণু শুনছিল; ‘ফুলরেণু মদন’ ‘প্রিয়তমা রতি’ ‘বসন্ত’ ‘মকরন্দ’ ‘পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকস্তানাভ্যঃ এইসব। শেষের কথাটা ফুলরেণু পুরোপুরি শুনতে এবং স্পষ্ট বুঝতে পরছিল না; তবু তার কান মুখ গরম হয়ে উঠছিল। এইসব অসভ্য শব্দ বইয়ে থাকে? নাকি স্বর্ণকমলের বানানো; সে বুঝে উঠতে পারছিল না। সংস্কৃত-টংস্কৃত পড়ানো উচিত না। ছি ছি!

পরের দিন কথাটা আভাসে তুলল ফুলরেণু। মেয়ে প্রফেসারদের ঘরে ওরা তখন তিনজন—উমাদি, ফুলরেণু আর বিজয়া। দুপুরের চা খেতে খেতে কথাটা ওঠাল।

“এদের আর সামলানো যায় না—” ফুলরেণু বলল।

উমাদি চেয়ারে পিঠ টেলিয়ে আলস্যের ভঙ্গিতে বসে খাচ্ছিলেন। বললেন, “তোমার ক্লাসে গোলমাল আর কোথায় হয়! দেখি না তো!”

ফুলরেণু চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে বলল, “গোলমাল নয়। গোলমাল হওয়া তবু ভাল, তার চেয়েও বেশি হচ্ছে।”

বিজয়া কোলের ওপর মাথার কাঁটা খুলে রেখে খোঁপাটা সামান্য ঠিক করে নিচ্ছিল। এলাহাবাদের মেয়ে, বাঙালিদের মতন এলোমেলো করে খোঁপা রাখতে পারে না। দিনের মধ্যে পাঁচবার করে খোঁপা শক্ত করে। বিজয়া বলল, আমার সিভিকস ক্লাসে মার্কেট বসে যায়। কী গপ্‌ করে…বাসরে বাস।’

ফুলবেণু বিজয়ার মুখে প্রশ্রয় এবং হাসি ভিন্ন কিছু দেখল না। বিজয়া একেবারে বাজে। কিছু পড়াতে পারে না, নিজেই গল্পের রাজা ফাঁকিবাজ। তার ক্লাসে হুল্লোড় ছাড়া কিবা হবে আর। কিন্তু কথাটা তো ক্লাসের গোলমাল নিয়ে নয়। ফুলরেণু একচুমুক চা খেয়ে বলল, “আমাদের ডিসিপ্লিন থাকা দরকার।”

উমাদি যেন তেমন গা করলেন না কথাটায়, হাই তুললেন।

ফুলরেণু আবার বলল, “মেয়েদের ওপর অন্তত একটু নজর রাখা দরকার। এখানে যা হয় তাতে ভাল কিছু হচ্ছে না।”

উমাদি বললেন, “খারাপটা তো আমি কিছু দেখিনি। কেন, কি হয়েছে?”

ফুলরেণু চট করে কোনও জবাব দিল না। বিজয়ার সামনে যেন তার কথাটা বলতে ইচ্ছে নেই। আড়চোখে বিজয়াকে দেখল, তারপর সতর্ক হয়ে বলল, “আপনারা চোখ চেয়ে দেখেন না কিছু। দেখলেই বুঝতে পারতেন।”

উমাদির বোধ হয় ঘুম পাচ্ছিল, গরম পড়ে আসায় দিনের বেলায় আলস্য লাগছে; বড় করে হাই তুলে বললেন, “কই, আমার কিছু চোখে পড়ে না।”

“মেয়েদের খানিকটা সভ্যভব্য হওয়া উচিত”, ফুলরেণু বলল।

“তা অবশ্য উচিত—” উমাদি চায়ের বাকিটুকু চুমুক দিয়ে শেষ করলেন, রুমালে মুখ মুছলেন, তারপর বললেন, “মেয়েরা একটু চঞ্চল, হুড়মুড় করে। তা করুক। এই তো বয়েস। যত জীবন্ত হবে ততই ভরন্ত লাগবে। হইচই না থাকলে ওদের মানায় না।” বলে উমাদি হাই তুলতে তুলতে পানের ডিবে বের করে উঠে দাঁড়ালেন, পাশের ঘরে গিয়ে পান বিলোবেন পুরুষ মাস্টারদের, গল্পটল্প করবেন।

বিজয়া মাথার খোঁপা আট করে কাঁটা গুঁজে নিয়ে বলল, “মাসে দু’ডজন করে কাঁটা কিনি, মাগর খালি হারায়…।”

ফুলরেণু কোনও জবাব দিল না। বরং তার বিরক্তি হচ্ছিল, বিজয়া কলেজে পড়াতে আসে না মাথার চুল সামলাতে আর কাঁটা গুঁজতে আসে বলা মুশকিল। চুলের যত্ন শেষ হল, এইবার গিয়ে ছোকরা প্রফেসারদের সঙ্গে আড্ডা মারতে বসবে। যেমন কলেজ, তেমনি সব মাস্টারনি। ফুলরেণু নাকমুখ কুঁচকে ঘৃণার গন্ধে টেবিল থেকে একটা কাগজ টেনে নিয়ে মুখ আড়াল করল।

অথচ ব্যাপারটা এমন যেন ফুলরেণু ছেড়ে দিতে পারল না। স্বার্থ তার নয় কিছু মন্দ উদ্দেশ্যও তার নেই। সে তো ভালই করতে চাইছে, মন্দ নয়; মেয়েদের ভাল, কলেজের ভাল, সমাজের ভাল। মেয়েদের মা-বাবারও এতে উপকার বই অপকার হবে না, বরং তাঁরা যা জানেন না—তাঁদের লুকিয়ে লুকিয়ে যা চলছে সেই নোংরামিটা বন্ধ হবে।

কয়েকটা দিন ফুলরেণু তার মেয়ে সহকর্মীদের কাছে খুঁত খুঁত করল। স্পষ্ট কিছু বলল না, সরাসরি কারও নামও করল না, কিন্তু তার আপত্তি এবং অপছন্দটা প্রকাশ করতে লাগল।

“দেখুন, আমি ছেলেমানুষ নই”, ফুলরেণু একদিন ঘরভর্তি মেয়েদের কাছে বলল, “একটা প্রমাণ না থাকলে একথা আমি বলতাম না। যা হচ্ছে এখানে সেটা খুব খারাপ, মেয়েদের স্বভাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

মিসেস চৌধুরী—মানে মনোরমা চৌধুরী বললেন, “তুমি যে কী বলতে চাইছ ফুলরেণু আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।”

সুমিত্রা দেবী হেসে বললেন, “আরে বহিন, তুমি খালি বিল্লি বিল্লি ডাকছ! মাগর বিল্লি কাঁহা? পাত্তা দাও।”

ফুলরেণু রেগে বলল, “বেড়াল ঘরে না ঢুকলে আমি বলতাম না।”

“কোথায় বেড়াল?” উমাদি বললেন, “তুমি সেটা বলো, দেখাও।”

এরা অন্ধ। বেড়াল যে ঘরে ঢুকে দুধ মাছ শুঁকে যাচ্ছে, ঢাকা সরিয়ে মুখ দিয়ে পালাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না। ফুলরেণু বলল, “বেড়াল আছে। আপনারা দেখতে চাইছেন না, তাই দেখতে পারছেন না!… এইটুকু এইটুকু মেয়ে তারা কি না করছে। কেমন করে শাড়ি পরে দেখেছেন?”

“তা ভাই, যখনকার যা চলন—” গীতাদি বললেন, “কলকাতা বম্বের হাওয়া এসেছে, পরবেই তো। ওদের সাজপোশাকে হাত দেওয়ার কিছু নেই আমাদের।”

“ঘাড়ে বুকে কাপড় রাখে না”, ফুলরেণু বলল, ঝাঁঝাঁলো গলায়।

“মুঙ্গের জেলায় গরমটা বেশি যে”—মনোরমা হাসতে হাসতে বললেন।

ফুলরেণুর মাথা আগুন হয়ে উঠল; বলল, “সেদিন একটা মেয়ে জল মুখে করে ন্যাকামি করছিল, একটা ছেলে তার গায়ে সুড়সুড়ি দিতে সে ছেলেটার জামায় কুলকুচো করে দিল।”

“এরকম দুষ্টুমি ওরা করে, ফুলরেণু। তুমি নতুন বলে তোমার চোখে লাগছে—আমাদের লাগে না।” উমাদি বললেন।

“এটা হেলদি সাইন” বিজয়া বলল, “রিলেশান ইজি থাকছে। কো-এডুকেশানে অ্যায়সেই হওয়া দরকার।”

ফুলরেণু প্রায় বিজয়াকে ধমকে উঠল, “কো-এডুকেশানে এরকম হয়। আপনি আমাকে শিক্ষা দেবেন না।”

উমাদি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামলে নেবার চেষ্টা করলেন। “আমি একটা কথা বলি ফুলরেণু, হয়ত এখানকার ছেলেমেয়েরা একটু বেশি হই হই করে। কিন্তু ওটা ওদের দোষ নয়। এখানে এই রকমই হয়ে আসছে। তুমি স্বভাব চরিত্র খারাপ হবার কথা বলছ। আমরা এই কলেজে পুরনো কোনও স্ক্যান্ডেল কখনও হতে দেখিনি, শুনিনি। বরং এ রকম দেখেছি—এই কলেজেই পড়েছে এমন ছেলেমেয়েতে বিয়ে-থা হয়েছে পরে, যখন ছেলেরা আরও বড় হয়েছে, চাকরি-বাকরি ব্যবসাপত্র করেছে। ঠিক কিনা সুমিত্রা? তুমিই বলো।”

সুমিত্রা দেবী বললেন, “অনেক হয়েছে”, বলে গীতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

গীতাদি বলল, “উমাদি, পাস্ট ইজ পাস্ট।”

সুমিত্রা জবাব দিলেন, “প্রেজেন্টয়েতেও হয় রে।”

সবাই হেসে উঠল, ফুলরেণু বাদে। ফুলরেণুর রীতিমত আত্মসম্মানে লাগছিল। সবাই মিলে তাকে উপহাস করল। কেউ বিশ্বাস করল না, মেয়েদের কতটা অধঃপতন হচ্ছে চরিত্রের। ফুলরেণু নিজের ব্যাগ থেকে টুকরো কাগজ বের করল, চোখ-মুখ তার লাল হয়ে উঠেছে রাগে, গলার স্বর চিকন ও তীক্ষ্ণ। কাগজটা বের করে ফুলরেণু বলল, “আমার ক্লাসে হাট বসেছিল। কি পড়ানো হচ্ছিল আপনারা শুনুন, আমি দু চারটে টুকে এনেছি !” বলে, ফুলরেণু পড়ল,…“তোমার মতো নবযুবতীরা যদি ইন্দ্রিয়সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে তপস্যায় অনুরক্ত হয়, তা হলে মকরকেতুর মোহনশর কি কাজে লাগল ? সুন্দরী, তোমার নবীন বয়স, তোমার কোমল শরীর, শিরীষকুসুমের মতো সুকুমার অবয়ব। তোমার তপস্যার সময় এ নয়।…” ফুলরেণু থামল, তার চোখমুখ লালচে, কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা। “এইরকম আরও আছে। আমার মনে থাকে না। কিন্তু বুঝতে পারি যা পড়ানো হচ্ছে তা আগলি।…সেদিন শুনছিলাম বলা হচ্ছে : ‘সরোবরের জল দিন দিন যেমন বাড়ে, তেমনি নারী নিতম্‌…’ বলতে বলতে থেমে গেল ফুলরেণু। অনেক কষ্টে জিব আটকাল।

মেয়েরা চুপ। গীতাদি হঠাৎ হেসে বললেন, “আপনি ভাই বড় বেরসিক। স্বর্ণকমলবাবু আলাদা কী আর পড়াতে পারেন। বোধহয় কাদম্বরী পড়াচ্ছিলেন। ওদের খানিকটা ‘কুমার সম্ভব’—আর বোধহয় ‘শকুন্তলা’র দু-একটা অংশ আছে।” গীতাদি নিজে বাংলা পড়ান।

ফুলরেণু বলল, “কাদম্বরী-টরী জানি না, আপনারা জানবেন। ওসব নোংরা জিনিস পড়ে কি হয় ?”

“বলছেন কি ভাই আপনি ! ‘কাদম্বরী’, ‘রঘুবংশ’, ‘মেঘদূত’, ‘শকুন্তলা’—এ সব হল আমাদের প্রাচীন কাব্য, কত নামকরা বই, সংস্কৃত সাহিত্যের মণিমাণিক্য, এসব না পড়লে সংস্কৃত পড়া হবে কেন !”

“পড়তে হবে না।”

“হবে না ?”

“আমি হলে সংস্কৃত পড়া বন্ধ করে দিতাম। কথায় কথায় শুধু নলিনী আর মালিনী…।”

“পীনপয়োধরও আছে—” গীতাদি উলটো ঠাট্টা করলেন, “আলপিন নয় কিন্তু…।”

উমাদি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যাকগে—যাকগে, যেতে দাও। সব পড়াই পড়া। পড়ার মধ্যে দোষ কিছু নেই।…আমি বলি কি ফুলরেণু, তুমি মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখো। কলেজের ছেলেমেয়েরা তো শিশু নয়, তারা নিশ্চয় খানিকটা বোঝে। যা বোঝে না, তা না বুঝুক। বয়েস হয়েছে—জগতের কিছুটা বুঝবে বই কি ! তোমার যদি কোনও আপত্তি থাকে, কারও সম্পর্কে কোনও কমপ্লেন থাকে, তুমি প্রিন্সিপ্যালকে বলতে পারো, আমাদেরও পারো।”

ফুলরেণুর মাথার ঠিক ছিল না, রাগে অপমানে জ্বলছিল। বলল, “আপনারা যা করেছেন তাতে ছেলেমেয়েদের মাথা খাওয়া হচ্ছে। নয়তো ওইটুকু মেয়ে ভালবাসাবাসির চিঠি লেখে ?”

উমাদি, সুমিত্রা, মনোরমা, গীতা, বিজয়া—সবাই ফুলরেণুর দিকে তাকিয়ে থাকল। নয়ন বুঝি অপলক হল একটুক্ষণ।

মনোরমা বললেন, “ওমা, তাই নাকি ! কোন মেয়ে ?”

ফুলরেণু নাম বলল না। “নাম জেনে কি হবে ! এই কলেজেরই ছাত্রী, আপনাদেরই স্টুডেন্ট…”

বিজয়া পরম কৌতুকে জিজ্ঞাসা করল, “কোন ইয়ার ? আর্টস না সাইন্স ?”

বিজয়ার কথায় ফুলরেণুর ঘেন্না হচ্ছিল ! এটা কি তামাশার কথা ? কিছুই বল না ফুলরেণু।

উমাদি সিঁথির কাছে কাঁচাপাকা চুলের কাছটা একটু চুলকোলেন। সুমিত্রার মুখের দিকে তাকালেন সামান্য, তারপর বললেন, “আমি আর কী বলব ! যে বয়েসের যা⋯! এরা তবু উনিশ-কুড়িতে লিখছে, আমি ষোলো সতেরোয় লিখেছি…।”

উমাদির কথায়, সকলে কলরোল তুলে হেসে উঠল। ফুলরেণুর মনে হল সবাই মিলে তাকে নিয়ে তামাশা করল, উপহাস করল, একশেষ করল অপমানের। তার একমাত্র ভরসা ছিলেন উমাদি, সেই উমাদিই তাকে সকলের সামনে এমন ভাবে অপ্রস্তুত করলেন যে লজ্জায় অপমানে তার মাথা কাটা গেল।

আর কিছু বলল না ফুলরেণু ; কলেজ ছুটি হয়েছে, ঘর ছেড়ে চলে গেল।

ফুলরেণু বুঝতে পেরেছিল উমাদিদের দিয়ে কিছু হবে না। এরা এই কলেজের ধাত পেয়েছে, সব ব্যাপারেই হেলাখেলা, তামাশা ; দায়দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা এরা ভাবে না। সভ্যতা শালীনতার জন্য মাথাব্যথা এদের হবার কথা নয়, যদি সে জ্ঞান থাকত তবে পুরুষ প্রফেসারদের ঘরে বসে অত গল্প গুজব, হাসি, পান-জরদার আসর জমাত না। নিতান্ত এদের বয়েস হয়েছে, ছেলেপুলে আছে—ঘরসংসার করে নয়ত বয়েস কমিয়ে এই গোয়ালে ঢুকিয়ে দিলে ওই ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে এরাও সমান মিশে যেত !

যাক, এরা চুলোয় যাক। ফুলরেণু ওদের মতন হতে পারে না, পারবে না। যা করার সে একলাই করবে। সহকর্মীদেরই যখন পাওয়া গেল না, তখন পুরুষদেরও সাহায্য পাওয়া যাবে না। পুরুষদের সাহায্য নেওয়ার কথা অবশ্য ফুলরেণু আগে ভাবেনি। তবে এটা পাওয়া গেলে, ওটা পাওয়া যেতে পারত হয়ত। না পেয়েছে না পাক, কথাটা সে সরাসরি প্রিন্সিপ্যালের কাছে ওঠাবে। তার আগে তাকে একটু খোঁজ খবর নিতে হবে। মামলা সাজিয়ে না নিয়ে মোকদ্দমা লড়তে যাওয়ার মতন বোকামি সে কবে না।

তিন

সেদিন হোস্টেলে মমতাদের ঘরে এসে ফুলরেণু বলল, “মমতা, তোমার সংস্কৃত বইখানা দেখি।”

মমতা কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল, কিছুই বুঝতে পারছিল না। বলল, “কোন বই, দিদি ?”

“ক্লাসে যা পড়ানো হয়…”

“আমাদের চারটে বই। একটা বই সিলেকসানের মতন, অন্য তিনটে…”

“একটাই আগে দাও।”

মমতা একটা বই এনে হাতে দিল।

ফুলরেণু বইটা হাতে নিয়ে পাতা খুলল। “এ আমি কি বুঝব ! সংস্কৃত টংস্কৃত আমি জানি না। মানের বই নেই ?”

মমতা এবার যেন বুঝল একটু। বলল, “বাংলা আছে, দিচ্ছি।”

বইয়ের ডাঁই থেকে মোটা মতন একটা বই এনে ফুলরেণুর হাতে দিল মমতা। বলল, “এটায় দিদি, বাংলা হরফে সংস্কৃত লেখা আছে, মানে দেওয়া আছে বাংলায়। খুব সুন্দর…”।

ফুলরেণু পাতা উলটে এক লহমা দেখে নিল। কালিদাস গ্রন্থাবলি…। বলল, “তোমাদের এ বই সবটা পড়ানো হয় ?”

মমতা মাথা নাড়ল। “না, ওটা পড়ানো হয় না ; ওর থেকে দুটো কাব্যের চারটে সর্গ পড়ানো হয় !”

“কোনটা কোনটা ?”

“রঘুবংশম্ আর অভিজ্ঞান শকুন্তলম্…” মমতা বলল, কোন কোন সর্গ তাও বলল।

ফুলরেণু বই নিয়ে ফিরে আসতে আসতে বলল, “তোমাদের উনি পড়াতে এলে বলবে যাবার সময় যেন আমার সঙ্গে কথা বলে যান।” স্বর্ণকমলের নামটা ইচ্ছে করেই ফুলরেণু বলল না।

মমতা মাথা হেলিয়ে বলল, “আজ তো উনি আসবেন না, কাল আসবেন। এলে বলব।”

ফুলরেণু চলে গেল।

এতক্ষণ রেবা ঘরের একপাশে বসে কত যেন মন দিয়ে সেলাই করছিল। ফুলরেণু চলে যেতেই মাথা উঠিয়ে চোখ ভরা হাসি নিয়ে বলল, “কী ব্যাপার রে ?”

“কী জানি !”

“কার্বন ডায়োক্সাইড কালিদাস পড়বে ! বাব্বা, এর চেয়ে নাইনথ ওয়ান্ডার আর কিছু নেই। কাল সকালে উঠে দেখবি সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে।”

“ইচ্ছে হয়েছে পড়বার… !”

“ইচ্ছে !…তুই একেবারে নেকু মমতা। ইচ্ছে-টিচ্ছে নয়, চাপ—প্রেশার। জামাইবাবু চাপ দিয়েছেন, ভাল ভাল ভাষা দিয়ে কথাটথা বলতে হবে তো। পরশু বকুলের কাছ থেকে দিদি ‘চন্দ্রশেখর’ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-টুইল নিয়ে গেছেন…বকুল বলছিল।”

মমতা হেসে ফেলল। “তুই এত জানিস, বাবা !”

রেবা ঘাড় দুলিয়ে কটাক্ষ করে বলল, “জানব না কেন ! সবাই জানে। গলা টিপলে দুধ বেরোবার বয়স আমাদের নেই। জামাইবাবু এলে দিদির যেমন হয় দেখিস না। বারান্দায় এত পায়চারি কিসের ? অত গঙ্গা গঙ্গা বলে গঙ্গাদিকে ডাকাই বা কেন ?”

মমতা হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, “ওই বইটা আমার নয় রে ! আমাদের জামাইবাবুর। আমি ভাল বুঝতে পারি না বলে দিয়েছিলেন পড়তে।”

রেবা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলল, “তুই পাতায় পাতায় যাস।”

রাত্তিরে ফুলরেণু নিজের ঘরে বসে কালিদাস গ্রন্থাবলি পড়ছিল। পড়তে পড়তে সে প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে যে পাতাটা খোলা তার দিকে অনেকক্ষণ আর সে তাকাতে পারল না। সর্বাঙ্গ যেন ফাল্গুনের গরমে জ্বালা করছে, চোখ মুখ লাল, ঠোঁটের ডগায় দাঁতের চাপ বসে লাগছিল। নিশ্বাস গরম। অনেকক্ষণ পরে কোনও রকমে নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে ফুলরেণু পাতাটার দিকে আবার তাকাল। নীচের দিকে বাংলা তর্জমা। ফুলরেণু আচ্ছন্নদৃষ্টিতে পড়ল :…“সেই মুহূর্তে বায়ুবেগে পার্বতীর পরিধেয় বস্ত্র অপসারিত হইলে তাঁহার ঊরুমূলে নখচিহ্ন সমূহ দেখিয়া তৎপ্রতি শিবের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। পার্বতী শিথিল বসন বন্ধন করিতে উদ্যত হইলে মহাদেব প্রিয়তমাকে নিবারণ করিলেন। রাত্রি জাগরণ হেতু পার্বতীর নয়ন রক্তবর্ণ, গাঢ় দন্তক্ষত হেতু অধর প্রপীড়িত এবং অলকাবলী ছিন্নভিন্ন হইয়াছিল…।”

ফুলরেণু আর পড়তে পারল না। কপাল, গাল, গলা, ভীষণ জ্বালা করছিল ; নিজের নিশ্বাসের গরমটা অনুভব করে তার মনে হল তার জ্বর এসেছে। হাতের তালুতে ঘাম জমে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে ফেলল। চোখের পাতা বুজে যেন সে আর কিছু দেখছে না, তাকে কেউ দেখছে না—এই ভাব করে বসে থাকল ! কী বিচ্ছিরি, কী যাচ্ছেতাই। ছি ছি। মেয়েরা এই সব পড়ে ? শিব তো গাঁজা খায় জানত ফুলরেণু, একেবারে ক্ষ্যাপা, বোমভোলা লোক। অথচ এ সব কী ? সে নিজে মদ খাচ্ছে, পার্বতীকে খাওয়াচ্ছে…আর যা যা করছে—ছি ছি…।

ফুলরেণু উঠে পড়ল, উঠে পড়ে জল দেখল। তারপর মুর্ছা যাবার মতন করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।

পরের দিন সকালে কলেজে পড়াবার কেমিস্ট্রি বইটা খুলে বসল ফুলরেণু। চোখ মুখ গম্ভীর, থমথমে গলার স্বর ভারি যেন কাল সারারাত ঘুম হয়নি, গরমে জানলা খুলে রেখে ঠাণ্ডা লেগেছে, নাকের ডগায় জল আসছে বার বার। কেমিস্ট্রি বই খুলে অ্যাসিডের চ্যাপ্টারটা বের করল। পড়ার কিছু নেই ; তবু বার কয়েক অ্যাসিডের চ্যাপ্টার পড়ল। আজ ফার্স্ট ইয়ারে অ্যাসিড পড়াবে ফুলরেণু।

কালিদাস গ্রন্থাবলির দিকে কিছুতেই আর তাকাবে না ফুলরেণু। তাকাবে না বলেই বাসি খবরের কাগজটা চাপা দিয়ে বইটা আড়াল করে রেখেছে।

অ্যাসিড পড়া শেষ করে ফুলরেণু যখন উঠল তখন তাকে অ্যাসিডের মতনই তীব্র দেখাচ্ছিল। হয়ত সেটা শরীর খারাপের জন্য।

কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরল ফুলরেণু। আজ শেষের দিকে ক্লাস ছিল না। অন্য সময় হলে সে থাকত, এতটা রোদে আসত না, গল্পগুজব করে সময়টুকু কাটিয়ে বিকেলের গোড়ায় ফিরত। আজ থাকল না। থাকতে ইচ্ছে করল না। মনোরমা চৌধুরী আর বিজয়া বসে গল্প করছিল। ওদের সঙ্গ অসহ্য লাগে আজকাল ! শরীরটাও ভাল নেই। আলস্য আর জ্বর জ্বর লাগছে, বেশ ব্যথা হয়েছে গায়ে কোমরে। টাঙা ডাকিয়ে এনে টাঙায় চড়ে ফুলরেণু ফিরে এল হোস্টেলে। হোস্টেল খাঁ খাঁ করছে। ঝি বামুন ছাড়া কেউ নেই। রোদের কী তাত এখনও। ধুলোভরা বাতাস উড়ছে। কাক ডাকছিল, একা একা।

ঘরে এসে ফুলরেণু শাড়ি বদলাল, চোখে মুখে জল দিয়ে এসে অ্যাসপিরিন ট্যবলেট খেলে গোটা দুই : দরজা ভেজিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। খানিকটা ঘুমোতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এতটা অবেলায় ম্যাজমেজে শরীর নিয়ে ঘুমোত সাহস হল না। ঘুমও পাচ্ছিল না। কোমরের কাছটায় এত ব্যথা হলে রাত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ দিতে হবে।

এ-পাশ ও-পাশ করে, চোখ বুজে, কখনও চোখ খুলে শুয়ে, নোট লিখেও সময় যেন ফুরোচ্ছিল না। হাই উঠছিল। টুকরো কয়েকটা শব্দ ছাড়া কোনও কিছু কানেও আসছে না। কাশীর কথা মনে পড়ল। মার চিঠি আসেনি দিন সাতেক ; টোকনটাও চিঠিপত্র দিচ্ছে না। কী ব্যাপার কে জানে ! সামার ভেকেশানের এখনও দেরি। সবে তো দোল এল।

ফুলরেণু সময় কাটানোর জন্য আলস্যভরে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ তুলে নিল ! তারপর পাতা উলটোতে লাগল। পড়তে শুরু করেছিল সেদিন, মাঝপথে ফেলে রেখেছে। পাতা খুঁজে নিয়ে আবার পড়তে লাগল : “তুমি, বসন্তের কোকিল। প্রাণ ভরিয়া ডাক তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই, কিন্তু তোমার প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ যে, সময় বুঝিয়া ডাকিবে।…” এ সব বই ফুলরেণু দু-চারটে এক সময়ে পড়েছিল, তখন বোঝার মতন মন হয়নি, আগ্রহও হয়নি। কী হবে এ সব পড়ে, তার চেয়ে শক্ত একটা কেমিক্যাল কম্পোজিশান বোঝা ভাল। সেটা বুঝতে বুঝতে কলেজ জীবনটা কাটাল। তারপর এক জায়গায় চাকরি করছিল পড়ানোর, বছর খানেক সেখান থেকে এখানে—এই মুঙ্গের জেলার দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজ।

‘রোহিণীর কলসী ভারি, চাল-চলনও ভারি। তবে রোহিণী বিধবা।’…ফুলরেণু পড়ে যাচ্ছিল। হাই উঠছে। জানলার বাইরে বাতাসের ঝাপটা লেগে জানলায় শব্দ হল, কাকটা ডাকছে এখনও।

‘…অমনি সে রসের কলসী তালে তালে নাচিতেছিল। হেলিয়া দুলিয়া, পালভরা জাহাজের মতো, ঠমকে ঠমকে, চমকে চমকে, রোহিণী সুন্দরী সরোবর পথ আলো করিয়া জল লইতে আসিরেছিল—এমন সময় বকুলের ডালে বসিয়া বসন্তের কোকিল ডাকিল। কুহুঃ কুহুঃ কুহুঃ…।’ ফুলরেণু অন্যমনস্ক হল, বইয়ের পাতায় মন থাকল না। বরং তার কেমন একটা কৌতূহল—বসন্তের কোকিলকে সময় বুঝে ডাকতে বলার অর্থটা কি ? হেঁয়ালি নাকি ? কখন ডাকবে ? কোন সময়ে ?

ফুলরেণু চোখের পাতা আধবোজা করে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাল লাগছে না। কেমন উদাস লাগছে। তা যতই বল, কালিদাসের চেয়ে এই কৃষ্ণকান্তের উইল সভ্য। মেয়েরা পড়তে পারে।

ফুলরেণুর যেন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।

কতক্ষণ পরে, ঠিক খেয়াল নেই, ফুলরেণু সাড়া পেল। মেয়েরা ফিরেছে? তাদের গলা পাওয়া যাছিল। বিকেল হয়ে গেছে।

রাতের দিকে স্বর্ণকমল এল।

বাইরে থেকে সাড়া দিয়ে ডাকল। ফুলরেণু অপেক্ষা করছিল। বলল, “ভেতরে আসুন।”

স্বর্ণকমল ঘরের মধ্যে এল।

ফুলরেণু আগে ভেবেছিল, লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না, বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলবে, বা নীচে মাঠে নিয়ে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলবে। পরে ভেবে দেখল, এটা দৃষ্টিকটু দেখাবে। মেয়েরা দেখবে, ঝি বামুনরা দেখবে। ফুলরেণু রাগের মাথায় একটু জোরেই কথা বলে, বাইরে জোরে জোরে কথা বললে মেয়েদের কানে যেতে পারে। তার চেয়ে ঘরেই কথাবার্তা বলা ভাল। তা ছাড়া শরীরটাও ভাল নেই, বাইরে যেতে ইচ্ছেও করছিল না।

“আপনি আমায় দেখা করতে বলেছিলেন, মমতা বলছিল”, স্বর্ণকমল বিনয় করে বলল।

“হ্যাঁ—বসুন।”

স্বর্ণকমল বসার জায়গা খুঁজল। ফুলরেণু চেয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে, হাত কয়েক তফাতে একটা টুল। চোরা চোখে বিছানাটাও একবার দেখে নিল স্বর্ণকমল। তারপর ইঙ্গিতে টুলটা দেখিয়ে বলল, “ওখানেই বসি ?”।

ফুলরেণু তাকিয়ে দেখল। মনে মনে বলল : হ্যাঁ—ওখানেই বসো—ওই টুলে ; টুলটা উঠিয়ে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বাইরে বসলেই ভাল হত। কিন্তু তা তো বলতে পারি না, হাজার হোক ‘কোলিগ’। নিতান্ত যেন খারাপ দেখাবে, অসৌজন্য প্রকাশ পাবে বলে ফুলরেণু স্বর্ণকমলকে টুলের ওপর বসতে বলতে পারল না। চেয়ারের পাশ থেকে সরে যেতে যেতে ফুলরেণু বলল, “না না, ওখানে কেন, এই চেয়ারে বসুন।” বলে বিছানার দিকে চলে গেল।

স্বর্ণকমল চেয়ার টেনে নিল। “আপনি বসবেন না?”

“বসছি ; আপনি বসুন।”

স্বর্ণকমল বসল।

ফুলরেণু হাতের ঘড়ি দেখল। আটটা বেজে মিনিট পাঁচেক হয়েছে। সন্ধের আগে আগেই ঘড়িটা হাতে পরে নিয়েছে ফুলরেণু, যেন হিসেব রাখছে স্বর্ণকমল কখন পড়াতে এল কতক্ষণ পড়াল, তার সঙ্গে কখন দেখা করতে এল।

কথাটা ঠিক কীভাবে শুরু করা যায় ফুলরেণু বুঝতে পারছিল না। মনে মনে যা ভেবে রেখেছে—সেসব নিশ্চয় বলবে পরে, কিন্তু প্রথমে কি বলা যায় ! ফুলরেণু অস্বস্তি বোধ করল। বিছানার ওপর বসবে কি বসবে না ভাব করে দাঁড়িয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকল। দিন তিনেক পরেই দোল পূর্ণিমা। বাইরে চাঁদের আলো টলটল করছে, জানলায় জ্যোৎস্না এসে পড়েছে।

কথা শুরু করার আগে স্বর্ণকমলকে একবার লক্ষ্য করল ফুলরেণু। চেহারাটা দেখলেই বোঝা যায়—লোকটা খুব চালাক-চতুর। ছলছলে হাসিখুশি মুখ হলে কি হবে, ওই সুন্দর কার্তিকঠাকুরের মতন মানুষটা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ধূর্ত।

অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল ফুলরেণু। তারপর যেন তৃতীয় কাউকে উদ্দেশ করে কিছু বলছে, বলল, “হোস্টেলের মেয়েদের ঘরে বসে পড়ানোর ব্যাপারে একটা অসুবিধে হচ্ছে। একটা ঘর দেড় দু ঘণ্টা আটকে থাকে…অন্য বোর্ডারের অসুবিধে হয়।”

স্বর্ণকমল শুনল। হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মমতার ঘরে বসে পড়াব না বলছেন?”

“রেবার অসুবিধে হয়। সে অন্য ঘরে গিয়ে বসে থাকে, গল্প করে।”

“ঊষা যখন এ-ঘরে—মমতার ঘরে এসে আমার কাছে পড়ে, রেবা তখন উষার ঘরে যেতে পারে।”

“না, নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য ঘরে গিয়ে পড়াশোনা হয় না।”

“ও !”

সামান্য অপেক্ষা করে ফুলরেণু বলল,“মেয়েরা আমায় কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু আমার একটা দায়িত্ব আছে। সকলেরই সুবিধে অসুবিধে আমার দেখা দরকার।”

স্বর্ণকমল প্রতিবাদ করল না, বরং সমর্থন জানিয়ে মাথা নাড়ল। “তা যথার্থ। তা হলে অন্য কী করা যায় ?” স্বর্ণকমল যেন আদেশের অপেক্ষায় ফুলরেণুর দিকে তাকিয়ে থাকল।

ফুলরেণু কোন জবাব দিল না। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, পা যেন কাঁপছে, হাঁটুর ওপরটায় ব্যথা-ব্যথা। বাধ্য হয়েই ফুলরেণু বসল।

স্বর্ণকমল বলল, “নীচে একটা ঘর আছে না ? কোনার দিকে ?”

ফুলরেণু অবাক হয়ে তাকাল। “আছে এক ফালি ঘর। ঝিদের ঘরের পাশে। কেন ?”

“তা হলে ওখানে বসে ওদের পড়াই।”

ফুলরেণু এ দিকটা একেবারে ভেবে দেখেনি। চালে হেরে যাওয়ার মতন অবস্থা হল তার। বিপন্ন বোধ করে হঠাৎ বলল, “ওই ঘরটা, আমি সিকরুম করব ঠিক করেছি।” বলে অনেকটা নিশ্চিত হল যেন ফুলরেণু। উলটো চালটা যেন সামলে নিয়েছে। মনে মনে ভাবল, লোকটা কী চালাক ! এ তবুও অন্য পাঁচটা ঘরের মধ্যে ছিল, নীচে যাওয়া মানে আড়ালে পালানো। ওখানে বসে মেয়ে দুটোকে পড়াবে না ছাই, একেবারে পাকিয়ে ছাড়বে।

স্বর্ণকমল বলল, “সিকরুম করবেন ওটা?”

“হ্যাঁ।”

“তবে তো ভালই—”

“ভাল কিসের ?”

“সিক আর ক’টা বছরে ! খালিই পড়ে থাকবে। ওখানেই বেশ পড়ানো চলবে।”

ফুলরেণু অবাক চোখ করে স্বর্ণকমলকে দেখল। লোকটা কি মুখটিপে হাসছে নাকি ! মুখ বেশ চকচক করছে, কী ফরসা রং, স্নো পাউডার মেখে পড়াতে আসে নাকি ও ?

বাইরে গঙ্গার গলা। পরদা সরিয়ে দিতে বলছে। ফুলরেণু কিছু বুঝল না। স্বর্ণকমল উঠে দরজার কাছে গিয়ে পরদা সরাল। গঙ্গা ঘরে এল, হাতে দু কাপ চা। ফুলরেণু বুঝতে পারল না গঙ্গাকে কে চা আনতে বলেছে।

স্বর্ণকমল হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল। গঙ্গা অন্য কাপটা ফুলরেণুর হাতে দিতে গেল। প্রায় ধমকে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল ফুলরেণু, অনেক কষ্টে সংযত করল নিজেকে। “এখন চা ?”

স্বর্ণকমল হাসিমুখে বলল, “খান। চায়ে কিছু হয় না।…আমি আসবার সময় মমতাদের বলে এসেছিলাম। পাঠিয়ে দিয়েছে।”

ঝিয়ের সামনে কিছু বলা যায় না, উচিতও নয়, ফুলরেণু চায়ের কাপ নিল। ভেতরে ভেতরে রেগেছে। আমার হোস্টেলে এসে তুমি আমাদের মেয়েদের চায়ের ব্যবস্থা করে দিতে বল ? এ প্রায় ধৃষ্টতা !

গঙ্গা চলে গেল। স্বর্ণকমল চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে তৃপ্তির শব্দ করল বার কয়েক। ফুলরেণু চায়ের পেয়ালায় মুখ ছোঁয়াল না।

স্বর্ণকমল বলল, “তা হলে ওই ব্যবস্থাটাই ভাল হল, নীচের ঘরে—মানে সিকরুমেই আমি মমতাদের পড়াব।”

ফুলরেণু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বোধ হয়, কথাটা কানে যেতেই হঠাৎ তার খেয়াল হল। শক্ত গলায় বলল, “না।”

“না— ! না কেন ?” স্বর্ণকমল যেন কতই অবাক হয়েছে এমন চোখে তাকাল।

“সিকরুম পড়বার জায়গা নয়।”

“কিন্তু ওটা যখন খালিই পড়ে থাকবে—”

“কে বলেছে খালি পড়ে থাকবে !”

“না, মানে—তেমন কিছু বড় রোগ—বসন্ত, হাম, কলেরা, টাইফয়েড না হলে তো আপনি কাউকে সিকরুমে পাঠাচ্ছেন না। এখানে রোগটোগ বড় হয় না। মেয়েদের হবে না বলেই মনে হয়।”

“আপনার কি মনে হয় না হয় আমার তা জানার দরকার নেই। যে কোনও রকম অসুখ করলেই আমি মেয়েদের সিকরুমে পাঠাব।”

“সর্দি-কাশি হলেও ?”

“হাঁ, হাঁচি হলেও।”

স্বর্ণকমল ঢোঁক গিলল। তার চোখ চকচক করছে। পরে বলল, “আমার বাড়ি অনেকটা দূরে। মাইল খানেক। মমতাদের গিয়ে পড়ে আসতে কষ্ট হবে।”

পাগল নাকি ফুলরেণু। তোমার বাড়িতে তুমি একলা থাক, সেখানে এই সব মেয়েকে পড়তে পাঠাবে ফুলরেণু। তা হলে এখানে যাও বা পদার্থ আছে তোমার কাছে গেলে তার কিছু থাকবে না। ওই সব অসভ্যতা পড়বে, তুমি পড়াবে, আর মেয়েগুলোর ইহকাল একেবারে নষ্ট হবে।

ফুলরেণু বলল, “দূরে গিয়ে পড়া বিশেষ করে রাত্রে আমি অ্যালাও করতে পারি না।’

স্বর্ণকমল চুপ।

ফুলরেণু এবার অন্যমনস্কভাবে কাপে কয়েক চুমুক দিল। দিয়ে ভালই লাগল। গলাটা ভারি হয়ে জড়িয়ে এসেছিল, আরাম লাগল। সংস্কৃত বাংলার প্রফেসার এবার জব্দ।

স্বর্ণকমল শেষে বলল, “আপনি যেরকম বলছেন তাতে তো আর পড়ানো হয় না।”

মনে মনে খুশি হল ফুলরেণু। কে তোমায় পড়াতে বলেছে। তোমার পড়ানো বন্ধ করতেই তো চাই।

স্বর্ণকমল বেশ মনোযোগ দিয়ে ফুলরেণুকে লক্ষ করল। তারপর দুশ্চিন্তার ভাব করে বলল, “প্রিন্সিপ্যালকে তা হলে একবার কথাটা বলি, কি বলেন ?”

“কেন প্রিন্সিপ্যালকে কেন—?”

“উনিই পড়াতে বলেছিলেন। ওঁকে না জানিয়ে কিছু তো করা যায় না।”

ফুলরেণু এবার সমস্যায় পড়ল। প্রিন্সিপ্যালকে এখনই কথাটা জানানো কি উচিত হবে ? তাঁর কানে কথাটা উঠলে ফুলরেণু কি ধরনের কৈফিয়ত দেবে এখনও তা ঠিক করে উঠতে পারেনি। স্বর্ণকমলের বিরুদ্ধে তার মামলা এখন পর্যন্ত সাজানো হয়নি।…বেশ মনমরা হয়ে গেল ফুলরেণু। বলল, “অন্য ব্যবস্থা কী করা যেতে পারে আমি এখনও ভাবিনি। ভেবে দেখি। তারপর যা হয় করব। আপনি পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।”

স্বর্ণকমল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। “কবে দেখা করব ?”

“করবেন। দু একদিন পরে করবেন। শুক্রবার নাগাদ।”

এক মুহূর্ত ভাবল স্বর্ণকমল। “শুক্রবারই দেখা করব।”

“করবেন।”

“সন্ধের দিকে !”

মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল ফুলরেণু। স্বর্ণকমল যাবার জন্য পা বাড়িয়ে বলল, “আপনার শরীর তেমন ভাল নেই, না ?”

“না !”

“শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে তাই…’ স্বর্ণকমল দু পা এগিয়ে প্রায় ফুলরেণুর মুখোমুখি হল, জানলার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “বসন্তের এই বাতাসটা ভাল না। …কা ললনা দিবসন্তং কুসুমশরমসোয় হৃদ্যনাদিবসন্ত…” বলতে বলতে হাসিমুখে স্বর্ণকমল দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

ফুলরেণু কিছু বুঝল না। কী বলল, স্বর্ণকমল ? কি মানে ওই বিদঘুটে কথাটার ?

বাইরে বেরিয়ে এসে স্বর্ণকমল হাসল। মনে মনে শ্লোকটার তর্জমা করল : বসন্তের এই দুরন্ত সময়ে, এমন কোন কামিনী আছে যে হৃদয়স্থিত ফুলবান মদনকে সহ্য করতে পারে ? কেউ পারে না সখি, কেউ পারে না।

চার

সারাটা দিন মেয়েরা রং খেলছে। সেই যে দল মিলে ভূত সেজে বেরিয়ে গিয়েছিল সব, সারা শহর বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে হল্লা করে রং মেখে ঘুরে বেড়িয়েছে। হোস্টেলে ফিরেছিল বেশ বেলায়। স্নান খাওয়া করে জিরিয়ে আবার সব বেশবাস করে বেরিয়ে গেল ; মেয়েদের হাতে গায়ে কানে তখনও রঙের আবছা দাগ, চুলের তলায় আবিরের আভা। ওরা গেছে দুর্গাবাড়িতে ‘পূর্ণিমা মিলনে’, সেখানে আজ গান বাজনা। যাবার সময় বলে গেছে অবশ্য ফুলরেণুকে। ফুলরেণু নিষেধ করেনি। করা উচিত হত না। সুমিত্রা দেবী, মনোরমা চৌধুরী, গীতাদি, বিজয়া—সকলেই ও বেলায় রং মাখাতে এসেছিল ফুলরেণুকে। তখনই বলে গিয়েছিল : মেয়েদের ও-বেলায় ‘মিলনে’ পাঠিয়ে দিও, আভাদি বলে দিয়েছেন।

হোস্টেল ফাঁকা। ঝি বামুনরাও বোধ হয় সকলে নেই। ঘরদোর বারান্দায় এখনও রং লেগে আছে, আবিরের গুঁড়ো জমে রয়েছে। কেমন একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে। ফুলরেণুকে স্নান করতে হয়েছে মাথা ঘষে, আবিরের ধুলোবালি এখনও যেন মাথায় কিচকিচ করছে, চোখ মুখ গাল গলা খসখসে লাগছে, বেশ একটু উষ্ণও যেন। আজ আর চুল বাঁধা হয়নি, রুক্ষ এলোচুলে একটা গিট দিয়ে নিয়েছে ফুলরেণু। সাদা খোলের শাড়ি পরেছে, পাড়টা চওড়া, সোনালি রং পাড়ের, গায়ের জামাটাও সাদা, চিকনের কাজ করা।

সন্ধের দিকটায় আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করল না। চুপচাপ নিস্তব্ধ হোস্টেল, রান্নাঘরে ঝি-বামুনে রান্নাবান্না করছে। নীচে এসে মাঠে ফুলরেণু ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কী পরিষ্কার ঝকঝকে জ্যোৎস্না, পূর্ণিমার মস্ত চাঁদ মাথার ওপর, বাতাসটা এত সুন্দর যে গা-মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। ফুলরেণু গায়ের আঁচল বাতাসে উড়িয়ে মাঠে পায়চারি করছিল, মেয়েরা নেই, কেউ তার আঁচল ওড়ানো, মাথার এলোচুল দেখছে না। কাশীর কথা মনে পড়েছিল মাঝে মাঝে। মা চিঠি দিয়েছে ; টোকনও চিঠি দিয়েছে। টোকনের চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে ; বাড়িতে তাকে নিয়ে রহস্যময় কিছু হচ্ছে। কী হচ্ছে ফুলরেণু অনুমান করতে পারে। টোকন লিখেছে ; ফুলদি, তুই এলে তোর কাছে—মানে সিলেকশান বোর্ডের চেয়ারপার্সনের কাছে ‘ফর সিলেকশন’ ফাইলগুলো দেওয়া হবে।’…টোকনটা বড় ফাজিল হয়ে উঠেছে আজকাল। ফুলরেণুর নিজের ভাই-বোন নেই, মামাতো ভাইবোনরাই সব।

গেট খোলার শব্দ হল। ফুলরেণু অন্যমনস্কভাবে তাকাল। কে যেন আসছে। তারপর খেয়াল করে তাকাতেই যেন অবাক হয়ে গেল। স্বর্ণকমল, স্বর্ণকমল এ সময় কেন ? আজ তার আসার কি দরকার ?

কোঁচা দুলিয়ে, চুড়িদার সাদা দুধের মতন পাঞ্জাবিতে চাঁদের আলো মাখিয়ে কার্তিক ঠাকুরের মতন লোকটা আসছে। ফুলরেণু তাড়াতাড়ি নিজের উড়ন্ত আঁচল সামলে নিল।

স্বর্ণকমল কাছে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে হাসল। ফুলরেণু অবাক গলায় বলল, “কি ব্যাপার ? আপনি ?”

“এলাম।” স্বর্ণকমল হাসিহাসি মুখে বলল।

“আজ কী ? আজ তো দোল। মমতারা কেউ নেই।”

“আপনি আমায় শুক্রবার সন্ধেবেলায় দেখা করতে বলেছিলেন।”

আজ অবশ্য শুক্রবার, এবং সময়টাও সন্ধে। তা বলে লোকটা একেবারে দিনক্ষণ মেপে আসবে। যখন বলেছিল…ফুলরেণু তখন কি অত ভেবে বলেছিল, নাকি তার খেয়াল ছিল শুক্রবার দোল। মমতাদের পড়াতে আসবে যেদিন সেদিন এলেই চলত।

ফুলরেণু সে রকমই ভেবেছিল।

বিরক্ত হয়ে ফুলরেণু বলল, “তা বলে আপনি দোলের দিন সন্ধেবেলায় আসবেন। আজ কি মেয়েরা পড়ে ?”

“তা তো বলেননি আপনি”—স্বর্ণকমল বিনয় করে বলল, “মেয়েদের পড়াব বলেও আমি আসিনি। দেখা করতে বলেছিলেন তাই এলাম। আপনার সময়ের তো দাম আছে। অন্য সময়…”

বাধা দিয়ে ফুলরেণু বলল, “আপনার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থাকা উচিত ছিল।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, তা ঠিক।”

ফুলরেণু কি বলবে আর বুঝতে পারল না। লোকটা কি ইচ্ছে করেই এ সময় এসেছে ? ভীষণ চতুর তো ! কিছুই বলা যায় না। এখন কি করবে ফুলরেণু ? স্বর্ণকমলকে তাড়িয়ে দেবে ? অন্যদিন দেখা করতে বলবে ! ফুলরেণুর মনে হল, সেটা বড় বেশি অসভ্যতা এবং অভদ্রতা হবে। হাজার হোক এভাবে আজকের দিনে কাউকে তাড়ানো যায় না।

দাঁড়িয়ে থাকা অস্বস্তিদায়ক। ফুলরেণু পা বাড়াল। শাড়ির আঁচলটা বাঁ হাতে ধরে রেখেছে। স্বর্ণকমলও পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।

ফুলরেণু বলল, “ও ব্যাপারে আমি এখনও কিছু ভেবে দেখিনি। সময় পাইনি।”

স্বর্ণকমল বিন্দুমাত্র বিরক্ত হল না, বলল, “তাতে কি ! পরে ভেবে দেখবেন।”

ফুলরেণু বলার মতন আর কিছু পেল না, পায়চারি করার মতন হাঁটতে লাগল নীরব ; স্বর্ণকমলও পাশে পাশে হাঁটছে।

“মেয়েরা সব—কি বলে যেন—পূর্ণিমা মিলনে গেছে…” ফুলরেণু শেষে বলল, চুপচাপ থাকলে এই সময় অন্যরকম মনে হচ্ছে, অস্বস্তি বোধ করছে সে।

“হ্যাঁ, আজ দুর্গাবাড়িতে ‘মিলন’। দোলের দিন প্রতি বছরই হয়। এখানকার বাঙালিরা করে।”

“আপনি গেলেন না।”

“এখানে এলাম।”

ফুলরেণু বলতে যাচ্ছিল : এখানে কি ‘মিলন’ হচ্ছে ? বলতে গিয়েও কোনও রকমে বেফাঁস কথাটা সামলে নিল। নিয়ে যেন ঢোঁক গিলল। মনে মনে রাগল সামান্য।

স্বর্ণকমল চোরা চোখে ফুলরেণুকে দেখছিল। ফুলরেণুর গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, মুখটি লাবণ্যভরা। যেন বেলআটা মাখানো। বয়স বেশি না ফুলরেণুর, বছর চব্বিশ পঁচিশ ; সর্বাঙ্গে পুষ্টতা এবং শ্ৰী আছে। ফুলরেণুর মুখে ভাবে ভঙ্গিতে যে গাম্ভীর্য আছে তা কিছুটা কৃত্রিম, কিছুটা যেন কোনও সংস্কার বা গোঁড়ামি বলে…ফুলরেণুকে আজ আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল, একমাথা রুক্ষ এলো চুল, বেলফুলের মতন মুখটি যেন ফুটে আছে। চোখের পাতা বন্ধ করে স্বর্ণকমল নিশ্বাস নিল দীর্ঘ করে। নিশ্বাসে শব্দ হল।

ফুলরেণু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কি শুকছে লোকটা ! ফুলরেণু অবাক হয়ে বলল, ‘কী ?”

“কিসের…?”

“ও-রকম করলেন যে !”

“বেশ একটা গন্ধ পেলাম।” স্বর্ণকমল মুখ উঁচু করে নাক টানতে লাগল। “কিসের গন্ধ ?”

“ফুলের—”, স্বর্ণকমল মনে মনে হাসল। ফুলরেণু যেন বাতাসে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল, কোনও গন্ধ পেল না। বাতাসটা অবশ্য চমৎকার লাগছিল। মাঠের চারপাশে তাকাল, অনেকটা দূরে করবী গাছের একটা ঝোপ ছাড়া কোথাও কোন গাছ নেই।

ফুলরেণু বলল, “এখানে আবার ফুল কোথায় ?”

স্বর্ণকমল মনে মনে বলল : আমার সামনে : মুখে বলল, “বসন্তকাল—, পবনঃ সুগন্ধি।”

ফুলরেণু আড়চোখে তাকিয়ে স্বর্ণকমলকে দেখল একবার। তারপর মুখ নিচু করে হাঁটতে লাগল। মাঠের কোথাও কোথাও রং শুকিয়ে আছে, কোথাও বা আবির পড়ে আছে ধুলোয় ; মেয়েরা সকালে দৌড়োদৗড়ি করে রং খেলেছে মাঠে। ফুলরেণু মুখ উঠিয়ে সামনে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে চোখ তুলল : টলটল করছে পুর্ণিমার চাঁদ।

স্বর্ণকমল বলল, “বেশ লাগছে না ?”

ফুলরেণু কোনও জবাব দিল না।

স্বর্ণকমল আবার বলল, “আহা সেই বসন্তবর্ণনাটি মনে পড়ছে : দুমাঃ সপুষ্পা সলিলং, সপদ্মং, স্ত্রিয়ং সাকামাঃ পবনঃ সুগন্ধ…”

শ্লোকটা শেষ করতে দিল না ফুলরেণু। প্রায় ধমকে উঠে বলল, “আমার সামনে সংস্কৃত বলবেন না।”

“কেন, কেন ?” স্বর্ণকমল যেন খুব অবাক।

“আমি পছন্দ করি না।”

“ও !…কিন্তু এটা কালিদাসের বসন্ত বর্ণনা…”

“কালিদাস…।” ফুলরেণু যেন আঁতকে উঠল। মুহূর্ত কয়েক আর কথা বলতে পারল না, তারপর বলল, “অত্যন্ত অসভ্য, ভালগার।”

স্বর্ণকমল দাঁড়িয়ে পড়ে আবার হাঁটতে লাগল। “আজ্ঞে এর মধ্যে কোনও ভালগারিটি নেই। শুনুন না—‘রম্য-প্রদোষ সময়ঃ স্ফুটচন্দ্রহাসঃ পুংস্কোকিলস্য বিকৃতঃ পবনঃ সুগন্ধি’,…মানে হল—রমণীয় সন্ধ্যাকাল, বিমল চন্দ্রকিরণ, পুংস্কোকিলের কুজন, সুগন্ধি বায়ু…”

“আপনি থামুন, মানে বলতে হবে না”, ফুলরেণু আদেশের মতন করে বলল।

স্বর্ণকমল থামল।

ফুলরেণু বলল, “কলেজে ছেলেমেয়েদের সংস্কৃত পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমি হলে করতাম। …যত সব কুশিক্ষা হচ্ছে।”

“আজ্ঞে—কুশিক্ষা !”

“আপনার কি ধারণা সুশিক্ষা হয় ?”

“না, মানে—, এটা তো রস অনুভবের ব্যাপার।”

“বেশি রসে স্বাদ তেতো হয়।” ফুলরেণু ঠোক্কর দিয়ে বলল। “এখানকার ছেলেমেয়েদের তো দেখছি—কী রকম সব তেতো হয়ে গেছে। যত অসভ্যপনা, বেয়াড়াপনা, বাঁদরামি শিখেছে।”

স্বর্ণকমল নিরীহ ভালমানুষ মতন মুখ করে বলল, “আপনি কি বলতে চাইছেন এদের চিত্ত-প্রকৃতি তরল ও চঞ্চল হয়ে উঠছে।”

“আপনার ওসব ছলছল ভাষা আমি বুঝি না। আমি বলছি এরা বাঁদর হয়ে উঠছে, অভব্য অশালীন হয়ে উঠছে।”

“সংস্কৃত পড়ে ?”

“আপনাদের কাছে ওইসব ছাইভস্ম পড়ে।”

“আপনি যে কোথায় ভস্ম পাচ্ছেন আমি বুঝছি না।…তবে হ্যাঁ, বলতে পারেন ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নি ! দু একটা যদি পড়ে দেখতেন ?”

“পড়েছি—পড়েছি।” ফুলরেণু অধৈর্য হয়ে বলল।

“পড়েছেন ! বাঃ !” স্বর্ণকমল পুলকিত বোধ করল। “আরও পড়ুন—খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন কুমারসম্ভবম্ রঘুবংশম্ অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ মেঘদূতম্‌…আহা এ-সবের কি তুলনা আছে। অতুলনীয়। যদি বলেন বাংলা মানে দেওয়া বই আমি দিতে পারি।”

“থাক আমার দরকার নেই।” গম্ভীর হয়ে ফুলরেণু বলল। “সে কষ্ট আপনাকে করতে হবে না।”

“কষ্টের কিছু না। এখানেই আছে। মমতার কাছে। আমি চেয়ে নিয়ে দেব। আপনিও চেয়ে নিতে পারেন।”

“আমার চেয়ে দরকার নেই।… আমি জানি কী আছে।” ফুলরেণু গলা চড়িয়ে চোখের দৃষ্টি আগুন করে বলল। “যত ট্রাশ অসভ্যতা ! আপনাদের মতন লোকের এই সবেই মজা।”

‘আজ্ঞে…’ স্বর্ণকমল করজোড়ে বলল, “অপরাধ নেবেন না, একটা কথা বলি : উদেতি পূর্বং কুসুমং ততঃ ফলং ঘনোদয়ঃ—আগে পুষ্পেদগম পরে ফল, আগে জলোদয় পরে বর্ষণ—এই তো নিয়ম। আপনি পড়ে যান পুষ্পেদগম হচ্ছে ধীরে ধীরে পরে ফল হবে ; মেঘের উদয় আমি দেখছি বর্ষণ পরে হবে…”

ফুলরেণুর আর সহ্য হল না। লোকটা তার সঙ্গে রসিকতা করছে ! তামাশা ! কী সাহস দেখেছ ? ফুলরেণু সোজা গেট দেখিয়ে দিল, “আগে আপনি যান পরে অন্য কথা।”

স্বর্ণকমল হেসে ফেলল। ফুলরেণুকে চোখ ভরে দেখতে দেখতে বলল, “যাচ্ছি। আজ দোল পূর্ণিমা, আপনাকে তো হাতে করে আবির-কুঙ্কুম দিতে পারলাম না, প্রশস্তি লেপন করে যাই। সত্যি আপনাকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ।…কালিদাস যে এই বসন্ত ঋতুতে অনঙ্গদেবকে বহুরূপে রমণীদেহে অবস্থান করতে দেখেছেন, তা যথার্থ। আমিও, দেখছি—নেত্রেষু লোলো মদিরালসেষু গণ্ডেষু পাণ্ডুং কঠিনঃ স্তনেষু…আপনার মদিরালস চক্ষুতে চঞ্চলভাবে, গণ্ডদেশে পাণ্ডুরূপে সেই দেবতা বিরাজ করছেন…” বলতে বলতে স্বর্ণকমল গলার স্বর অতি নিচু করল, এবং শেষ শব্দের ব্যাখ্যাটা অশ্রুতভাবে নিজের কাছেই করল ! আর দাঁড়াল না, পালাল।

রাগে ফুলরেণুর সর্বাঙ্গ কাঁপার কথা, মাথায় আগুন জ্বলে ওঠার কথা, কিন্তু বেচারি হঠাৎ কেমন লজ্জায় অস্বস্তিতে আরক্তিম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এবং তার বুক কি কারণে যেন কাঁপল।

পাঁচ

দেখতে দেখতে দেড় দু মাস কাটাল। গরমের ছুটিতে ফুলরেণু কাশীতে নিজের বাড়িতে এল। মা বললেন, “আমি কত ভাবনায় ভাবনায় মরতুম, কি জানি কেমন থাকিস। তা বলতে নেই রেণু, তোর শরীর বেশ সেরেছে। মুঙ্গেরের দিকে জলহাওয়া খুব ভাল, না রে ?…” ফুলরেণু শুধু হাসল, কিছু বলল না।

রাত্তিরে টোকন এসে হাতে একটা মস্ত খাম দিল। বলল, “নে ফুলদি, তোর ফাইল। পাঁচজন ক্যান্ডিডেট আছে। তাদের ফটো, নাম ধাম বয়েস প্রফেশন—সমস্ত পার্টিকুলার নোট করে দিয়েছি। এখন তুই বাবা তোর পছন্দমত বেছে নে। …ব্যাপারটা কিন্তু বর্ষায় সারতে হবে, আষাঢ় মাসে।’’

ফুলরেণু হাসল। “বড় ফাজিল হয়ে গিয়েছিস।”

“ফাজিলের কি, বিজনেস ইজ বিজনেস। তোর পর আমি লাগাব।…যাকগে, শোন—ওই পাঁচটা একেবারে পঞ্চপাণ্ডব—ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, ল’ ইয়ার, ব্লাকমার্কেটিয়ার অ্যান্ড প্রফেসার।”

“প্রফেসার কী রকম প্রফেসার? শুধু প্রফেসার না ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার প্রফেসার?” ফুলরেণু হাসল।

“সব দেখতে পাবি। আমি চলি, একটা নেমন্তন্ন আছে।”

টোকন চলে গেলে ফুলরেণু বিছানায় শুয়ে খানিকটা সময় গড়াগড়ি দিল। বেশ লাগছে। তার হাসি পাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত উঠে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে এসে খাম খুলল। ডাক্তার পাত্র একেবারে গজকচ্ছপ টাইপের, বয়েস আটত্রিশ। বোগাস। এঞ্জিনিয়ার সাহেব একেবারে হাতুড়ি মার্কা, লিডসের ডিপ্লোমা পেয়েছে। রাবিশ। ল’ ইয়ারকে দেখেই নাক কুঁচকে নিল ফুলরেণু, ইয়ারমার্কা মুখ। যাচ্ছেতাই একেবারে ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার—অর্থাৎ বিজনেসম্যান। ওরে বাবা, এ যে বাঘ-ছালের ওপর পা দিয়ে ফুলসাইজের ফটো তুলিয়েছে, চেহারাটা শিকারি ধরনের, গোঁফটা কী বাহারি! দূর দূর! শেষে প্রফেসার মশাইয়ের ছবি বেরুল। এ যে স্বর্ণকমল। ফুলরেণু ছবিটা হাতে নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর পাটিকুলার্স দেখল। কী রকম শয়তান, কোথাও দীপনারায়ণ কলেজের নাম দেয়নি, কলেজে পড়ায় এই পর্যন্ত উল্লেখ আছে। অবশ্য স্বর্ণকমলের কোনও দোষ নেই, ফুলরেণুই বলে দিয়েছিল: “আমি জানি না, তোমাদের বাড়ির তরফ থেকে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে চিঠি দিও ; তবে মা টোকন যদি জানতে পারে আমার কলেজে তুমি পড়াও তবে আমি সিলেকশান করব না, তা বলে দিচ্ছি কিন্তু।”

স্বর্ণকমলের ছবিটা নিয়ে ফুলরেণু বিছানার মধ্যে গড়াগড়ি খেল, অনেকক্ষণ হাসল, কত কথা ভাবল, শেষে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখ: হোস্টেলে তার ঘরে বসে স্বর্ণকমল তাকে মেঘদূত পড়াচ্ছে: চুড়াপাশে নবকুরবকং…কর্ণে শিরীষং…

দিন তিনেক পরে স্বর্ণকমলের চিঠি এল। মস্ত চিঠি।

মা বলল, “কার চিঠির?’’…ফুলরেণু অন্যদিকে মুখ করে যেতে যেতে বলল, “কলেজের উমাদিটুমাদির হবে।”

বিকেল এবং সন্ধেটা চিঠি পড়ে পড়েই কাটল। বার বার পড়ল ফুলরেণু। যত পড়ছিল ততই বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছিল, আবার আনন্দেও কেমন অবশ হয়ে পড়ছিল, থেকে থেকে নিশ্বাস ফেলছিল।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে দরজা বন্ধ করে ফুলরেণু চিঠির জবাব লিখতে বসল। লেখার প্যাডে কালির আঁচড় আর পড়ে না। যাও বা পড়ে মনে হয় এমন চিঠি সে মাকে লিখেছে, টোকনকে লিখেছে ; এ চিঠি স্বর্ণকমলের বেলায় অচল। পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে আবার ফাউন্টেন পেন দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে ফুলরেণু। এইভাবে অনেকটা রাত হল, অনেকগুলো প্যাডের ফিনফিনে পাতা নষ্ট হল অথচ চিঠি লেখা হল না। ফুলরেণুর কান্না পেতে লাগল। এতদিন সে কেমিস্ট্রির শ শ’ পাতা নোট লিখিয়েছে ; সে সোডিয়াম কার্বোনেটের বিবরণ লিখতে পারে, অক্লেশে নাইট্রোজেন প্রবলেম সম্পর্কে বারোটা পাতা ঝড়ের মতন লিখতে পারে, এখুনি ক্রিস্টাল, সিমেট্রি—তাও পারে কিন্তু হায় হায়—ভালবাসার একটা চিঠি লিখতে পারে না। এই সহজ কাজটা এত শক্ত কে জানত?

শেসে ফুলবেণু উঠল। ঘরের একপাশ থেকে তার সুটকেস টেনে নামিয়ে খুলল। তারপর শাড়ি জামা হাতড়ে সুটকেসের তলা থেকে মৃদুলার খাতার মধ্যে পাওয়া সেই চিঠিটা বের করে বিছানায় নিয়ে এল। বালিশে বুক রেখে ফুলরেণু এবার চিঠি লিখতে বসল। মৃদুলার সেই চিঠি একপাশে খোলা, ফুলরেণু ফাউন্টেনপেনের ঢাকনা খুলে মৃদুলার চিঠি দেখে দেখে—অবিকল সেইভাবে সেই একই ভাষায়—চিঠির নকল করতে লাগল।

পঁচিশ বছর বয়েসে ফুলরেণুর হৃদয় মৃদুলার চিঠির বয়ান অনুযায়ী ময়ূরের মতন নাচতে লাগল, বাতাসের ঝাপটা দিতে লাগল, চাঁদের আলোয় ভরে উঠল। “চোখের পাতা বুজলে তোমায় দেখছি, চোখ খুললেও তুমি। তুমি আমার কাছে সব-সময় আছ, আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার! তোমার মুখ তোমার হাসি আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না ‘ রাত্তিরে শুতে এসে ঘুম আসছে না, এপাশ ওপাশ করছি, বাইরে সব ঘুমিয়ে পড়েছে এ সময় তুমি কাছে থাকলে সব চাওয়া পূর্ণ হত। তুমি নেই তাই বালিশের কানে কানে তোমায় আমার কথা বলছি! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?”…এই সমস্ত মৃদুলার চিঠিতে যা ছিল, যেমন ছিল লিখল ফুলরেণু। এবং চিঠির শেষে মৃদুলার চিঠির মতনই লিখল, “তুমি আমার আদর নিও।” মৃদুলার চিঠিতে তলায় নাম ছিল না। ফুলরেণু নিজের নাম দিল। দিয়ে চিঠিটা আড়াগোড়া পড়ে আনন্দের আবেশে ঘুমিয়ে পড়ল।

ছয়

বিয়ের পর ফুলশয্যার দিন পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে স্বর্ণকমল বলল, “ফুল, কাশী থেকে তুমি আমায় প্রথম যে চিঠিটা লিখেছিলে সেটা স্রেফ ‘টুকলি’।”

“টুকলি?” ফুলরেণু চমকে উঠে বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে উঠে পড়ে আর কি।

“তুমি নিজে লেখোনি।”

“মানে!…”

“ওটা—মানে ওই চিঠিটা একটা বইয়ে আছে।”

“বই!” ফুলরেণু অপ্রস্তুতের একশেষ। কিন্তু মৃদুলার খাতার মধ্যে যে ছিল চিঠিটা। কেমন সন্দেহ হল ফুলরেণুর। বলল, “তুমি জানলে কী করে!”

“জানলাম।”

“এমনি এমনি জেনে গেলে!”

“না না, এমনি কেন! বইটা আমার কাছে ছিল।” স্বর্ণকমল হাসছিল। “খুব পপুলার বই। প্রেমপত্র সংকলন।”

“ইয়ার্কি! তোমার মতন অসভ্য নাকি সবাই, যে নিজেদের কীর্তি ছাপাবে।!”

“আরে না, কীর্তি ছাপাবে কেন। বাংলা গল্প উপন্যাস থেকে বাছাই করে নেওয়া চিঠি। প্রেমপত্র।”

“বইটা আছে তোমার?”

“এখন আর পাচ্ছি না। কে যে পড়তে নিয়ে চুরি করে নিল! সকলেরই দরকার পড়ে তো!” বলে হেসে ফুলরেণুর হাত ধরে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলল, “তুমিই চুরি করেছিলে নাকি? তুমি যা চোর। ইউ আর এ টুকলি।”

স্বর্ণকমলের বুকে লজ্জায় মুখ রেখে কিছুক্ষণ পড়ে থাকল ফুলরেণু। তারপর মুখ ঘুরিয়ে স্বর্ণকমলের কানের দিকে ঠোঁট নিয়ে বলল, “আর তুমি যে আমার প্রশস্তি গাইতে, মন ভোলাতে সেও তো তোমার কালিদাসের টুকলি। তুমি চোরের বেশি বাটপাড়।”

স্বর্ণকমল হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, “এ সব চুরিতে দোষ নেই।…কি বল।”

ফুলরেণু পিঁপড়ের মতন নিশব্দে স্বর্ণকমলের কানের লতি কামড়ে দিল।

গোরাচাঁদ

গোরাচাঁদ ঘরে আসতেই বন্ধুরা তাকে সহর্ষে অভ্যর্থনা জানাল। আয় গোরা, আয়; একটু আগেই তোর কথা হচ্ছিল। হপ্তাখানেক দেখা নেই—ভাবছিলাম হল কী! জলধর কালই তোর বাড়ি যেত। তা তোর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল?

বন্ধু বলতে ঘরে তখন তারা চারজন। সলিল, জলধর, নিয়োগী আর মানিক। ওরা তাস খেলছিল। বেশির ভাগ দিন সন্ধেটা ওদের তাস খেলেই কেটে যায়। সলিলদের বাড়ির বৈঠকখানার নামই হয়ে গিয়েছে ‘তাসের ঘর’।

গোরাচাঁদ খুবই বিমর্ষচিত্তে ঘরে ঢুকেছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, জবরদস্ত ডেঙ্গুজ্বর কিংবা ম্যালেরিয়ায় ভুগে সবে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। চোখমুখ শুকনো, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, দাড়ি কামানো হয়নি ভাল করে, চোখের চশমা ঢিলে হয়ে নাকের ডগা পর্যন্ত গড়িয়ে এসেছে। এরকম হবার কথা নয়, অন্তত এখন।

হাতের তাস হাতে রেখেই জলধর বন্ধুকে দেখছিল। বলল, “কিরে গোরা, তোর এ হাল কেন? অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? আমার বাড়ির ফোনটা ডেড, নয়ত তোকে—।”

গোরাচাঁদ কোনও কথা বলল না। একেবারে কোণের দিকে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল।

নিয়োগী বলল, “বিয়ে পেছিয়ে গেল নাকি রে? মন খারাপ? আরে মন খারাপ হবার কী আছে! গরমে বিয়েটা ঠিক জমে না। গরম বর্ষা পার করে দে—মাত্তর তো আর চার পাঁচটা মাস, তারপর লাগা। অর্লি অঘ্রানে। নরম শীতে নতুন বউ…ফাইন!”

গোরাচাঁদ বেশ বিরক্ত হয়ে নিয়োগীকে দেখল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “জলের বোতলটা দে।”

বন্ধুরা তাস খেলতে বসলে চায়ের কাপ খাবারের প্লেটের সঙ্গে কয়েকটা জলের বোতলও জমে যায়।

মানিক জলের বোতল এগিয়ে দিল। বলল, “খালি পেটে জল খাবে দাদা? একটু তলানি আছে। দেব?” বলে হাসল। বন্ধুদের মধ্যে মানিক হল জুনিয়র।

গোরাচাঁদ ও-সব নেশার জিনিস খায় না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একবার দশ বিশ ফোঁটা খেয়েছিল। মিলিটারি মাল। তাতেই তার জিব জড়িয়ে গিয়ে সে কী অবস্থা! পান সিগারেট ছাড়া গোরাচাঁদের আর কোনও নেশা নেই। তার বন্ধুরাও ঠিক নেশুড়ে নয়, তবে মাঝেমাঝে দু-এক পাত্তর চড়িয়ে নেয়।

জল বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল খেয়ে নিল গোরাচাঁদ। তারপর বলল, “একটু চা হলে হত।”

সলিল বলল, “চা হবে। আগে বল, তোর হয়েছে কী?”

“সে অনেক কথা। বলছি। আগে একটু চা…।”

সলিল উঠে গেল চায়ের কথা বলতে।

জলধর বলল, “আমরা তো তোর বিয়ে নিয়েই কথা বলছিলাম। ভাবছিলাম তোকে বলব, তোর জেঠামশাই ওল্ডম্যান, তাঁকে আর কষ্ট দেওয়া কেন! তোর বিয়ের ব্যাপারটা আমরাই ম্যানেজ করে দেব। এই ধর বিয়ের চিঠি, প্যান্ডেল, খাওয়া-দাওয়া, লোকজনকে আপ্যায়ন…।”

জলধরের কথা শেষ হল না, গোরাচাঁদ বলল, “বিয়ে হচ্ছে না। আমি করছি না। ”

বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল, “সে কি রে? কেন? সব ঠিক হয়ে গেল—এখন— ?”

সলিল ফিরে এল।

সলিল ফিরে আসতেই মানিক বলল, “সলিলদা, শোনো গোরাদা কী বলছে! বিয়ে করছে না গোরাদা।”

সলিল দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল গোরাকে। অবাক হয়ে বলল, “বলিস কিরে! সত্যি নাকি?”

গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এই বিয়ে করছি না।”

“কেন?”

“আমাকে বিচ্ছিরিভাবে ইনসাল্ট করেছে। যা-তা বলেছে মেয়েটা।”

“মেয়েটা! কোন মেয়েটা?”

“ওই মেয়েটা, কমলিকা না মালবিকা— কী যেন নাম ওটার।” গোরাঁচাদ রীতিমতন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের গলায় বলল। নামটাও যেভাবে বলল—মনে হল,ওই মেয়ের নাম মনে রাখারও যেন তার প্রয়োজন নেই।

তাস খেলার পাট চুকে গেল। হাতের তাস ফেলে বন্ধুরা পরম কৌতুহলে গোরাচাঁদকে দেখতে লাগল। ব্যাপারটা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। গোরাচাঁদ কোনও কালেই বদমেজাজি নয়, হঠকারিও নয়। রুক্ষ রূঢ় সে হতে পারে না কোনও অবস্থাতেই। ওর স্বভাব নরম। নিরীহ ভিতু ধরনের মানুষ। সাদামাটা সরল। তার জেঠামশাইয়ের একান্ত বাধ্য ও অনুগত। অবশ্য তার কারণ আছে। গোরাচাঁদের বাবা যখন মারা যান গোরার বয়েস তখন তিন। জেঠামশাই জেঠাইমাই তাকে মানুষ করেছেন।

মা অবশ্য ছিলেন। কিন্তু ওর তেরো চোদ্দো বছর বয়েসে মা-ও চলে যান। জেঠামশাই জেঠাইমাই তার সব। জেঠামশাইদের কোনো ছেলে নেই, একটি মেয়ে আছে—গোরাচাঁদের দিদি। দিদিও অনেক দিন ধরে অন্য সংসারের লোক হয়ে গিয়েছে—থাকেও কলকাতার বাইরে। দুর্গাপুরে। মাঝেমধ্যে আসে অবশ্য। দিদিও গোরাচাঁদকে ভালবাসে খুব। …তা ছেলে হিসেবে গোরাচাঁদ চমৎকার। সরল, ভদ্র , সভ্য, নম্র। দেখতেও ভাল। গায়ের রং ফরসা ; চেহারা গোলগাল। চোখ দুটি বড় বড় মুখে সব সময় একটু হাসি লেগে থাকে।

বন্ধুরা যেন বুঝতে পারছিল না, শিষ্ট মার্জিত নম্র গোরাচাঁদ হঠাৎ এভাবে বিগড়ে গেল কেন? ও কি সত্যিই বিগড়েছে? না, তামাশা করছে? চেহারা দেখে তো মনে হয় না তামাশা করছে!

জলধর যেন তখনও বিশ্বাস করেনি। বলল, “তুই বেটা সত্যি বলছিস? না, নাটক করছিস?” বলে বন্ধুদের সঙ্গে একবার চোখাচুখি করে নিল।

“সত্যি বলছি।”

“হয়েছেটা কী?”

“বললাম তো, মেয়েটা আমাকে ইনসাল্ট করেছে। একবার নয় অনেকবার। কালও আমাকে যা-তা বলেছে।”

“কেন?”

“আমি কেমন করে জানব?”

“তুই কিছু করেছিলি?”

গোরাচাঁদ আরও বিরক্ত হল। বলল, “আমি কিছু করব? মানে? আমি তাকে চোখেই দেখিনি। সে তুই দেখেছিস।”

কথাটা মিথ্যে নয়। সম্বন্ধ-করা বিয়ে। জেঠামশাইয়ের এক বন্ধু সম্বন্ধটা দিয়েছিল। জেঠামশাই জেঠাইমা দিদি মেয়ে দেখেছে। আর গোরাচাঁদ ও তার বন্ধুদের তরফে দেখেছে জলধর।

মানিক রঙ্গ করে বলল, “চোখে দেখনি বোলো না দাদা, বলো ফটো দেখেছ—ফেস টু ফেস হওনি।”

সলিল বলল, “এই মানিক, চুপ কর। ব্যাপারটা শুনতে দে।” বলে গোরাচাঁদের কাছাকাছি গিয়ে বসল। “ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বল। হয়েছেটা কী?”

গোরাচাঁদ সামান্য সময় চুপ করে থাকল। বলল, “কী বলব! গত হপ্তায় যখন এখানে এলাম—তোদের বললাম, জেঠামশাই এই জষ্টি মাসেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবে বলেছে। মেয়েদের তরফও তাই চায়। জেঠাইমা বলছে, আষাঢ়। জ্যৈষ্ঠমাসে নাকি বড় ছেলের বিয়ে দিতে নেই।”

নিয়োগী বলল, “তোর আর বড় ছোট কী! তুই তো একটাই।”

সলিল বলল, “ছেড়ে দে, যাহা বাহান্ন তাহা তিপান্ন, জষ্টিমাস আর আষাঢ় মাসে তফাতটা কী!… তারপর কী হল বল?”

গোরাচাঁদ বলল, “মাস নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বিশ্বাস কর। তা গত হপ্তায় এখান থেকে ফিরে গেলাম—সেটা তোর শনিবার। রবিবার সন্ধেবেলায় এক ফোন।”

“ফোন?”

“বাড়িতে। ফোন তুলতেই একটা মেয়ের গলা। কী বলল জানিস?”

“কী?” বন্ধুরা এসঙ্গে বলল।

“বলল, কী গো নদের চাঁদ কেমন আছ?”

“নদের চাঁদ?”

“বিশ্বাস কর, প্রথম কথাই বলল, কী গো নদের চাঁদ, কেমন আছ? আমি ভাই একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। বুঝতেই পারলাম না কী ব্যাপার। আজকাল ফোনে যা সব কাণ্ড হয় তোরা জানিস। কিছু চ্যাংড়া আজেবাজে কথা বলে, অসভ্যতা করে। চেংড়িরাও করে ভাই। থার্ড ক্লাস কথাবার্তা বলে। তা আমি বললাম, কাকে চাই? কে নদের চাঁদ?.. তখন মেয়েটা বলল, আহা, ঢং কোরো না। তোমাকেই চাই! গোরাচাঁদ না কালাচাঁদ! কী নাম রে? ভদ্রলোকের ওই সব নাম হয় নাকি? শোনো নদের চাঁদ, বিয়ে করতে সাধ হয়েছে—নামটা পালটাতে পারোনি। যাও কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট করে নামটা আগে পালটে নাও। টেলিফোনের পাঁজিতে ভাল ভাল নাম পাবে। বুঝলে? নামের কী বাহার? গোরাচাঁদ! অখাদ্য। আবার করেন কী, না—গেঞ্জি জাঙ্গিয়ার ব্যবসা! ছিছি! ওই ছেলের আবার বিয়ে করতে সাধ! নোলা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে! লজ্জাও করে না?”

বন্ধুরা অবাক। বিশ্বাস করতে পারছিল না। জলধর বলল, “যাঃ, কী বলছিস! তোকে এসব কথা বলল? একটা মেয়ে? তাও আবার যে-মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা ফাইন্যাল হয়ে গিয়েছে।”

গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে সদুঃখে বলল, “শুধু ওইটুকু বলল নাকি! আরও কত কী বলল। অসভ্যের মতন। তারপর আরও বলল, কাল আবার ফোন করব। রাত আটটা নাগাদ। ফোন ধরবে। না ধরলে তোমার বারোটা বাজিয়ে দেব। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব—বুঝলে কালাচাঁদ। আমায় তুমি চেনো না।”

সলিল বন্ধুদের মুখের দিকে তাকাল। শেষে গোরাচাঁদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলল, “গোরা, দিস ইজ নট পসিবল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। বিয়ে আমরাও করেছি। আমাদের বউরাও কম তেঁয়েটে নয়। তা বলে তারা বিয়ের আগে এভাবে কথা বলেনি। সে সাহস ছিল না।”

মানিক বলল, “দাদা, তুমি কি ফোন ধরার সময় হুঁশে ছিলে?”

“মানে?”

“মানে নরম্যাল ছিলে তো? কান ঠিক ছিল! তোমার আবার কানের দোষ আছে একটু।”

“বাজে কথা বোলা না।”

নিয়োগী বলল, “গোরা, মেয়েটার গলা শুনে তুই চিনতে পারলি?”

গোরাচাঁদ রেগে গিয়ে বলল, “আমি কি মেয়ের গলা শুনেছি? না, তাকে চোখে দেখেছি।”

“তবে কেমন করে বুঝলি ওই মেয়েটাই ফোন করছে?”

“বাঃ, অদ্ভুত কথা। কেমন করে বুঝলি! মেয়েটা অত কথা বলে যাচ্ছে, হাসছে হি হি করে, টন্ট করছে—আর আমি বুঝব না! আমি কি গাধা! তা ছাড়া ও তো বুঝিয়েই দিল—এই হল সেই মেয়ে যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

সলিল বলল, “তুই নাম জানতে চাইলি না?”

“চেয়েছি। বলেছে, ন্যাকামি কোরো না! নাম না বললে চিনতে পারছ না, না?”

জলধর বলল, “সেই মেয়েই। কমলিকা। আমি তো ওকে দেখেছি। কথাও শুনেছি। মেয়েটাকে দেখতে ভাল। তবে ভেতরে বিচ্ছু বলে মনে হল। যে-ভাবে টেরচা চোখে আমাকে দেখছিল। গলার স্বরটা একটু ভাঙা ভাঙা, না কিরে গোরা?”

গোরাচাঁদ বলল, “ভাই, ফোনে গলা শুনে বোঝা যায় না। অচেনা গলা। তবে জোর আছে গলার। ধমক মেরে কথা বলে। “

মানিক বলল, “পরের দিন তোমাকে ফোন করেছিল আবার?”

“করেছিল। আটটার পর পরই।”

কী বলল?”

“ন্যাস্টি কথাবার্তা।”

“অশ্লীল কিছু?”

“নানা, ভালগার টাইপের কথাবার্তা! আমায় কেমন নাড়ু-নাড়ু দেখতে ! চোখ লিচুর মতন, নাক ভুটানিদের টাইপ। আমার নাকি গলগণ্ড রোগ আছে।”

“গলগণ্ড! তোমার? কই আমরা তো দেখছি না। বরং তোমার গল বেশ গোলগাল। তা শুধু চেহারার কথা বলল?”

“চেহারা, স্বভাব। হোয়াট নট! যা প্রাণে চাইছিল বলে গেল। তারপর শেষে বলল, পয়সা ছড়ালে কাকের অভাব হয় না বুঝলে নাড়গোপাল। তোমার মতন পাত্তর আমার পাশে দাঁড়াবার যুগ্যি নয়। আমার বাপ অনেক ভাল ভাল পাত্তর আনতে পারে—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিএ, সরকারি অফিসার। তুমি তাদের কাছে গোল্লা। হনুমান!”

“হনুমান?” মানিক আঁতকে উঠল। “দাদা, তোমায় হনুমান বলল! কী মেয়েরে বাবা! এ তো অত্যন্ত অসভ্য, বেয়াদপ!”

এমন সময় চা এল গোরাচাঁদের।

চা দিয়ে বাচ্চা মেয়েটা চলে যেতেই গোরাচাঁদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “কী বলব ভাই! রোজ রাত আটটার পর মেয়েটা ফোন করে আর একতরফা যা মুখে আসে বলে যায়। শেষে কাল বলল, শোনো নদের চাঁদ তোমায় ওয়ার্নিং দিয়ে দিচ্ছি, তুমি যদি গাড়ি সাজিয়ে টোপর হাতে সত্যিই বিয়ে করতে আস, বিপদ হবে। পাড়ার ছেলেদের বলে রাখব, বোমা মেরে তোমার বিয়ের সাধ ঘুচিয়ে দেবে।”

নিয়োগী সভয়ে বলল, “সে কিরে? পাড়ার ছেলেদের লেলিয়ে দেবে বোমা মারতে। এ তো মাইরি পলিটিক্যাল নেতাদের মতন কথা হল! মেয়েটা তো ডেনজারাস।”

গোরাচাঁদ বলল, “আমিও কাল মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। স্ট্রেট বলে দিয়েছি—গুঁড়ো মশলার মেয়ে বিয়ে করতে আমার বয়ে গেছে। যত্ত ভেজাল!”

সলিলের যেন রোমহর্ষ অনুভূতি হল। বলল, “তুই বললি?”

“বললাম। কালোকে কালো বলব—তাতে ভয় কিসের! ওরা তো গুঁড়ো মশলার বাড়ির লোক। মেয়ের বাপের গুঁড়ো মশলার বিজনেস। অন্নপূর্ণা গুঁড়ো মশলা! আমাকে যদি ও গেঞ্জি জাঙ্গিয়ার ব্যবসাদারের ছেলে বলতে পারে—আমি ওকে গুঁড়ো মশলা বলতে পারব না? আমাদের সাতাশ বছরের হোসিয়ারি কারখানা। হোসিয়ারি বিজনেসে সুতো ভালমন্দ হতে পারে— কিন্তু ভেজাল চলে না। ওরা ভেজাল। আমরা নির্ভেজাল।

বন্ধুরা প্রথমটায় কথা বলতে পারল না। গোরাচাঁদকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।

নিয়োগী শেষমেশ কথা বলল। “গোরা, তুই ঠিক করেছিস। রাইটলি সার্ভড। তোর কারেজ দেখে জয় হিন্দ বলতে ইচ্ছে করছে।”

জলধররা হেসে ফেলল। অবশ্য অট্টহাস্য নয়। মুচকি হাসল।

সলিলদের অ্যাটর্নি অফিস। বাপকাকার আমলের। আইনটা তার মাথায় আসে চট করে। ঠিক আইন নয়, তবে আসল কথাটা সে না বলে পারল না। বলল,”গোরা, কেস তুই কাঁচাতে চাইলেও কি পারবি? তোর জেঠামশাই! বলেছিস তাঁকে?”

গোরাচাঁদ বলল, ভয়ভয় গলায়, “না ভাই, বলিনি। জেঠামশাইকে কি এসব কথা বলা যায়! বিশ্বাসই করবে না। বড় এক বগ্গা মানুষ। তার ওপর ওই গুঁড়ো মশলার সঙ্গে জেঠামশাইয়ের খাতির জমে গেছে। আমি যদি বলি, মেয়েদের বাড়ি থেকে মেয়েটা রোজ রাত্তিরে আমায় ফোন করছে, জেঠামশাই ভাববে, আমি তলায় তলায় ইয়ে করছি। বলবে, রাস্কেল—তুই বললেই আমি মেনে নেব—ও-বাড়ির থেকে মেয়েটি তোকে ফোন করে। বিয়ের আগেই। তুই আমায় সহবত শেখাবি! আসলে তোর কোনো বদ মতলব আছে।”

জলধর মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক। জেঠামশাইকে একথা বলা যায় না। বলা উচিত নয়।”

নিগোগী বলল, “তা হলে জেঠাইমাকে বল।”

“জেঠাইমা মানেই জেঠামশাই। বলার সঙ্গে সঙ্গে জেঠার কানে চলে যাবে।”

“তা হলে?”

মনমরা মুখ করে গোরাচাঁদ বলল, “বড়দের কানে উঠলেই—এবাড়ি ওবাড়ি ঝগড়া লেগে যাবে। তারপর ধর হাজার হোক, ওরা মেয়ে পক্ষ! মেয়ের বাপ-মা যখন মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে—সে বড় কেলেঙ্কারি হবে। একটা মেয়ের পক্ষে নিজের প্রেস্টিজ বাঁচানো বড় কথা। …না, আমি অতটা অসভ্যতা করতে পারব না। এক আমি দিদিকে বলতে পারি! কিন্তু কোথায় দিদি? সে না আসা পর্যন্ত কিছুই করতে পারছি না।…সত্যি বলতে কি, আমি চাইছি, অন্য রকম কিছু করতে, যাতে এই নেগোসিয়েশানটা নিজের থেকেই ভেঙে যায়। …তোরা আমায় বাঁচা।”

মানিক বলল, “কেমন করে?”

গোরাচাঁদ বলল, “কেমন করে—সেটা তোরা ঠিক কর। তোরা আমার বন্ধু। বন্ধু হয়ে যদি এসময়ে আমায় না দেখিস, কবে দেখবি! আমি তোদের কাছে এসেছি বিপদে পড়ে। যা হয় তোরা কর।”

বন্ধুরা চুপ। কী বলবে! হঠাৎ জলধর বলল, “দাঁড়া, দেখছি। ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।”

দুই

মাঝে একটা দিন বাদ গেল। তার পরের দিন গোরাচাঁদ ট্যাক্সি করে এসে হাজির। বাড়ির সামনে ডিজেল ট্যাক্সির বিকট আওয়াজ মিলোতে না মিলোতেই গোরাচাঁদ যেন টলতে টলতে ঘরে ঢুকল। চোখ লালচে, মুখ টকটক করছে, ঘামছিল দরদর করে। জামার বোতাম খোলা। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটেছে। গোরাচাঁদের এমন চেহারা বড় একটা দেখা যায় না।

ঘরে এসে গোরাচাঁদ বন্ধুদের তাস খেলা দেখতে দেখতে ক্ষোভের গলায় বলল, “তাস খেলছিস! খেল! সারা জীবন তাসই খেলে যা?”

সলিল বন্ধুকে দেখতে দেখতে বলল, “কেন, কী হয়েছে?”

“না, হবে আবার কী! কিছুই হয়নি। আমি শুধু তোদের দেখছি। তোরা আমার বন্ধু! ভাবতেও কষ্ট হয়। হাউ সেলফিশ!”

নিয়োগী বলল, “কী হয়েছে বলবি তো! ঘরে ঢুকেই হেঁয়ালি শুরু করলি!”।

মানিক হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। বলল, “দাদা, তুমি বোসো। আগে বোসো।”

“বসব! আমার বসার দরকার নেই! আমি তাস খেলতে আসিনি।”

জলধর বলল, “নতুন কিছু হয়েছে বুঝি? বেজায় খেপে গিয়েছিস?”

গোরাচাঁদ বলল, “খেপে গিয়েছি। খেপে যাওয়া তো সামান্য ব্যাপার ; আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সারা গা জ্বলে যাচ্ছে! মাথা কেমন করছে!”

সলিল বলল, “বোস আগে। মাথা ঠাণ্ডা কর। জল খা।” বলে পাশ থেকে জলের বোতল বাড়িয়ে দিল।

গোরাচাঁদ জলের বোতল নিল না। বলল, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাড়ি ছাড়া করাবে ওই মেয়েটা। আমার সুখস্বস্তির বারোটা বাজিয়ে দিল।”

সলিল বলল, “আবার কী হল? এখনও ফোন করছে?”

“কাল করেনি। আজ করেছিল। আমাদের অফিসে। ভাগ্যিস জেঠামশাই তখন ছিল না?”

“কখন করেছিল।”

“এই তো বিকেলের পর, ছ’টা সোয়া ছটা।”

“তুই তা হলে তোদের অফিস থেকেই আসছিস?”

মাথা হেলিয়ে গোরাচাঁদ বলল, “না এসে পারলাম না। তোরা আমার অবস্থাটা যদি বুঝতিস!”

নিয়োগী বলল, “কী বলল মেয়েটা?”

“যা মুখে আসে বলে গেল। আমাকে নিয়ে রগড় করল, টিজ করল। …আমায় কী বলে জানিস? কত বড় আস্পর্ধা! বলল, তোমার যা বুদ্ধি গোরাচাঁদ—ছাগলের মাথাও তার চেয়ে সাফ। টুকেমুকে বি কম পাস করেছিলে, পেছনে তোমার জেঠা এক জোড়া ঠেলা লাগিয়েছিল পয়সা খরচ করে। ওই বুদ্ধি নিয়ে তুমি গেঞ্জির ব্যবসা করবে! যতদিন জেঠামশাই আছে, তারপর তো তোমায় সকলে লুটেপুটে খাবে। তুমিও দু হাতে পয়সা উড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়াবে। তোমার যে কত মুরোদ আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। না আছে বিদ্যে না বুদ্ধি! তোমার মতন অপদার্থকে বিয়ে করে আমি কি শেষে হাঁড়ি মেজে মরব। ওটি হচ্ছে না। “

জলধর বিস্ফারিত বদনে বলল, “বলিস কী! এসব কথা বলল তোকে। ছাগল বলল।”

“ছাগলের চেয়েও খারাপ বলল। …ছুঁচোটুচোও বলল।”

“আর কী বলল?”

“বলল, আমার স্বভাব-চরিত্র খারাপ।”

“স্বভাব-চরিত্র খারাপ?” মানিক হাতের তাস ফেলে দিয়ে থ’মেরে বসে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। “ওঃ, ভাবা যায় না। দাদার স্বভাব হল ঝরনার জল। স্ফটিক স্বচ্ছ! বিশুদ্ধ, জার্ম ফ্রি, ব্যাকটেরিয়া মাইনাস। এমন স্বভাব লাখে একটাও পাওয়া যায় না। সেই দাদাকে কিনা স্বভাব নিয়ে কথা বলা! ছি ছি! এ তো মানহানির মামলা আনা যায়!”

মানিককে থামিয়ে দিয়ে নিয়োগী বলল, “গোরা, স্বভাবের সঙ্গে চরিত্রও বলল? তোর চরিত্র? মানে ক্যারেকটার?”

গোরাচাঁদ এবার গলা চড়িয়ে বলল, “বলল মানে? এমন একটা খারাপ কথা বলল শুনলে তোরা কানে আঙুল দিবি।”

জলধর গলা বালিয়ে বলল, “কী খারাপ কথা বলল? ইয়ের কথাটথা—?”

“বলল, আমি একটা মেয়ের সব লুটেপুটে নিয়েছি। মেয়েটাকে চিট করেছি। তাকে পথে বসিয়ে এখন দিব্যি সাধুপুরুষ সেজে বিয়ে করতে যাচ্ছি অন্য মেয়েকে। আমি বজ্জাত, বেহায়া, ক্রিমিন্যাল। আমাকে জেলে দেওয়া উচিত।”

সলিল আর নিয়োগী মাথা নাড়তে নাড়তে একসঙ্গে বলল, “দিস ইজ টু মাচ। আর টলারেট করা যায় না।”

মানিক বলল, “দাদা, লুটেপুটে খাওয়া মেয়েটার নাম বলল?” বলে আড়চোখে তাকিয়ে থাকল।

“না।” গোরাচাঁদ প্রায় ধমকে উঠল। “নাম বলবে! কিসের নাম? কার নাম? আমি কি তোমার মতন মেয়ে-হ্যাংলা!…” বলে সলিলদের দিকে তাকাল গোরাচাঁদ। বলল, “আমার ভীষণ লেগেছে, ভাই। জীবনেও এত খারাপ, বাজে, মিথ্যে কথা শুনিনি। ভদ্রলোকের ছেলে একেবারে ইতর হয়ে গেলুম। তোমরা হয় কিছু করো, না হয় বন্ধুত্ব শেষ করে দাও।”

বন্ধুরা চুপচাপ। মুখ নিচু করে বসে থাকল যেন।

শেষে জলধর বলল, “ভাবিস না গোরা, আমি আছি। তোর হয়ে লড়ে যাব। দেখছি মেয়েটাকে। “

তিন

দিন কয়েক পরে গোরাচাঁদ বন্ধুদের আড্ডায় এসে দেখল, নতুন একজনের আবির্ভাব ঘটেছে সেখানে। এ মুখ তার দেখা নয়, চেনাও নয়। তাদের এই আড্ডায় তারা চার পাঁচ জন নিয়মিত আড্ডাধারী ছাড়াও মাঝেমাঝে অনিয়মিত দু একজন গল্পগুজব করতে চলে আসে। তারাও বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু এই নতুন মানুষটিকে গোরাচাঁদ কখনও দেখেনি।

গোরাচাঁদকে দেখেই জলধর হাত বাড়িয়ে ডেকে নিতে নিতে বলল, “আয় গোরা, তোর জন্যে হাঁ করে বসে আছি। একটু দেরি করে ফেললি।”

দেরি সামান্য হয়েছিল গোরাচাঁদের। নিয়োগী খবর দিয়েছিল, সাতটা নাগাদ চলে আসবি। জরুরি ব্যাপার আছে।

এখন প্রায় পৌনে আট।

মানিক বলল, “দাদা, তুমি কি রাত আটটার প্রোগ্রাম শেষ করে আসছ?”

গোরাচাঁদ কোনো জবাব দিল না কথার। মানিকটা দিন দিন বড় বেশি চ্যাংড়া হয়ে উঠছে।

জলধর বলল, “গোরা, আলাপ করিয়ে দিই। এ হল আমার পুরনো বন্ধু। চারু ব্যানার্জি। আমরা সিবি বলে ডাকতাম। স্কটিশে আমার ক্লাসমেট ছিল। সিবি এখন ঈগল এজেন্সির পার্টনার।” বলে সিবির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “চারু, এই আমাদের গোরা। এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম। বেচারির একেবারে যায়-যায়, অবস্থা। তোমায় কিছু একটা করতেই হবে।”

ঠিক নমস্কার নয়, চোখে চোখে এক রকম আলাপের সৌজন্য বিনিময় হল। চারুর চোখে ঈষৎ হাসি, গোরাচাঁদের চোখে খানিকটা কৌতূহল।

গোরাচাঁদ দেখছিল চারুকে। বেশ টগবগে চেহারা, ধারালো নাকমুখ, গায়ের রং কালচে। চারু গোরাচাঁদেরই সমবয়েসি হবে। গালে পাতলা দাড়ির জন্যে খানিকটা যেন ব্যক্তিত্বময় বলে মনে হয়। হাতে পাইপ।

সলিল বলল, “বোস গোরা, এখানে আয়। তোর কথা জলধর সবই বলেছে সিবিকে। …ফারদার তোর যদি কিছু বলার থাকে বলতে পারিস।”

গোরাচাঁদ বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না… উনি…!”

জলধর বলল, “উনি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। ঈগল পাখি মানে লোকের হাঁড়ির খবর টেনে বার করা ওঁর পেশা। অবশ্য টাকা দিয়ে চারুকে ভাড়া করতে হয়। …তোর কপাল ভাল গোরা, চারুকে আমি পেয়ে গেলাম। একেবারেই হঠাৎ দেখা আমাদের অফিসের সামনে। অনেক কাল পরে। চারু বলল, ও এখন ঈগল এজেন্সিতে কাজ করছে। পার্টনার। ওকে পেয়ে আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলুম। মনে হল, চারু আমাদের কাজে আসতে পারে। দারুণ হেলপ হবে। তোর কথা বললুম। আজ ওকে আসতে বলেছিলুম এখানে—তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমরাও সবাই থাকব। ভাল করে সব কথা বলা যাবে।”

গোরাচাঁদ তখনও ভাল করে কিছু বুঝছিল না। বন্ধুদের দেখছিল।

সলিল বলল, “জলধর একটা কাজের কাজ করেছে। সিবি-ই তোকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে গোরা।”

চারু পাইপের ছাই খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, “উদ্ধার করতে পারব কিনা জানি না। চেষ্টা করব। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নিই সলিলবাবু। কলকাতায় আজকাল বেশ কয়েকটা প্রাইভেট ইনটেলিজেন্স এজেন্সি হয়েছে। তারা নানা রকম কাজ করে। এমন কি সিকিউরিটি সার্ভিসও। আমরা সবরকম কাজ করি না। আমাদের ফার্ম ছোট। আমরা স্পেশ্যালাইজড কাজ নিই। তবে খুবই যত্ন করে করি।”

“আপনারা কী কী কাজ করেন?” সলিল বলল।

“প্রথমে মেটরিমোনিয়াল কাজকর্ম। ধরুন, পাত্র বা পাত্রী পক্ষ—সিক্রেটলি কিছু ইনফরমেশান চাইল, ফ্যামিলি সম্পর্কে, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে। আমরা সেটা যোগাড় করে দি। তারপর হল ডিভোর্সের ব্যাপারে পার্টিকে তাদের দরকার মতন ইনফরমেশান সাপ্লাই করা। “

মানিক বলল, “বাঃ! বিয়ে আবার বিবাহ-বিচ্ছেদ! আপনারা তো মশাই গাছেরও খান, তলারও কুড়োন!”

চারু বলল, “সরি, গাছ দু জাতের। একই গাছের নয়।”

নিয়োগী বলল, “আর কী করেন স্যার?”

“ব্ল্যাকমেলিং কেস। আপনাকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে—আপনি আমাদের কাছে এসে ক্লায়েন্ট হলেন। তারপর দেখুন সেই ব্ল্যাকমেইলারকে কী করি!”

সলিল বলল, “গোরার কেসটা ব্ল্যাকমেইল বলে চালানো যাবে?”।

“এখনই বলতে পারছি না। সব শুনতে হবে ভাল করে— তারপর ভেবে দেখব।”

জলধর গোরাচাঁদকে বলল, “গোরা, আমি সবই বলেছি যতটা পারি। এবার তুই বল। নিজের কেস নিজে বলাই ভাল। ”

গোরাচাঁদ বলব-কি বলব না করে তার বিপদের কথা বলতে লাগল।।

গোরাচাঁদের বৃত্তান্ত শেষ হল যখন তখন ঘড়িতে সাড়ে ন’টা। গরমের দিন। সাড়ে নটা এমন কিছু রাত নয়। আচ্ছা ভাঙতে প্রায়ই দশ সোয়া দশ বেজে যায়। কাজেই জলধররা কেউ চঞ্চল হল না।

সিগারেট খুঁজতে খুঁজতে সলিল চারুর দিকে তাকাল। অর্থাৎ বলতে চাইল, শুনলেন তো সব—এবার বলুন কী করা যায়?

চারু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। ভাবছিল। চোখ বন্ধ করে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চোখ খুলল। তারপর গোরাচাঁদকে বলল, “আপনি কী করতে চান?”

“আমি! আমি কী চাইব?”

“মানে মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান? না, তাকে হটাতে চান?”

ওই মেয়েকে বিয়ে! অসম্ভব! মশাই, ওই মেয়েকে কেউ বিয়ে করে? কালীর খাঁড়া। ডেনজারাস মেয়ে। অসভ্য, ভালগার, পাজি…। না, ওকে আমি বিয়ে করব না। নেভার।”

“বাড়িতে একবার বলে দেখুন না?”

“আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে বাড়িতে বলব! আমার জেঠামশাইকে আপনি চেনেন না।জেঠার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাধ্য আমার নেই। এমনিতেই বাড়িতে বিয়ের বাজার বসে গেছে। আজ বেনারসি, কাল বালুচরি, পরশু স্যাকরা, তরশু ফার্নিচার…। না মশাই ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। তবে হ্যাঁ, দিদি এলে বলতে পারি। দিদি দুর্গাপুর থেকে কবে আসবে তাও জানি না। এদিকে দেখতে দেখতে দিন চলে যাচ্ছে…।”

জলধর বলল, “চারু, বিয়েটা ভেঙে যাওয়াই দরকার। মেয়েটাকে তুই প্যাঁচে ফেলে দে। এমন কিছু একটা কর, যাতে মেয়ে পক্ষের আর মুখ না থাকে কিছু বলার। দু একটা ব্ল্যাক স্পট লাগিয়ে দে। এমনিতেই বিয়ে ভেঙে যাবে।”

গোরাচাঁদ তাড়াতাড়ি বলল, “না না, নোংরা কিছু করবেন না। হাজার হোক ভদ্রবাড়ির মেয়ে। ব্ল্যাক স্পট লাগালে কেচ্ছা হয়ে যাবে। সেটা উচিত নয়।”

মানিক রগড় করে বলল, “উঃ, দাদার যে বড় দরদ। তোমার ক্যারেকটারে যখন স্পট লাগাল। ”

“সবাই সব পারে না। আমি ভদ্রলোক। ইতরামি করতে পারব না।”

চারু বলল, “আসলে আপনি চাইছেন, সাপও মরে, লাঠি না ভাঙে। তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“বেশ দেখি কী করতে পারি! তা এ সব করতে হলে কিছু টাকা পয়সা লাগবে। কত তা বলতে পারছি না। হাজার দুই চার হতে পারে।”

গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে জানাল, তার আপত্তি নেই।

চার

জ্যৈষ্ঠ মাসের ফাঁড়াটা কাটল। জেঠাইমার দয়ায়। এখন আষাঢ় চলছে। পাঁজিতে আষাঢ় মাসের মাঝামাঝির আগে বিয়ের দিন নেই। প্রথমটা দিনটা পড়েছে বৃহস্পতিবার, দ্বিতীয়টা শনিবারে। বৃহস্পতিবারে জেঠাইমা বিয়ে দেবে না। শনিবারে মেয়ের তরফে আপত্তি। কাজেই সেই একেবারে আষাঢ়ের শেষে সোমবার দিনটাই মোটামুটি ঠিক। আর তা না হলে শ্রাবণের গোড়ায়।

আষাঢ় মাসের দু’ একটি দিন, গোড়ায় গোড়ায়, আকাশ ঘোলাটে, মেঘ হল, বৃষ্টি হল না। তারপর বৃষ্টি নামল। দিন দুই ভাল বৃষ্টি হল। আবার রোদ। রোদ-বৃষ্টির মাঝখানে পড়ে গোরাচাঁদের সর্দি লেগে গেল। বর্ষার সদি। জেঠামশাই অন্য কাজে ব্যস্ত বলে গোরাচাঁদকেই সোদপুরের কারখানা আর শোভাবাজারের অফিস সামলাতে হচ্ছিল। এমন সময় সর্দিজ্বর।

গোরাচাঁদ জ্বর গায়ে সেদিনও বেরুতে পারেনি। জ্বর ততটা নয়, একশো এক ছুঁয়েছে, কিন্তু নাক, গলা, মাথার অবস্থা খারাপ। নাক বুজে আছে, গলায় অসম্ভব ব্যথা। টনসিল ফুলেছে, গলার স্বর ভাঙা। মাথার কথা আর কী বলবে গোরাচাঁদ—ছিঁড়ে যাচ্ছিল যেন। ভীষণ যন্ত্রণা।

সন্ধেবেলায় গোরাচাঁদ খানিকটা গরম নুনজলে গার্গল করে ঘরে আসতেই দেখল, ফুটকি কী একটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ভাঙা গলায় গোরাচাঁদ বলল, “ওটা কী রে?”

ফুটকি বলল, “পুরনো ঘিয়ে আদার রস, রসুন, মধু দিয়ে মেড়ে কফের ওষুধ। বুকের সর্দি তুলে দেবে। গলা পরিষ্কার হবে।”

নাকমুখ কুঁচকে বমির ভাব করে গোরাচাঁদ বলল, “কে দিল? পুরনো ঘিয়ে আদার রস! তোর কবরেজি?”

ফুটকি বলল, “আমার নয়, জেঠাইমার। জেঠাইমাকে কে বলেছে!”

“ফেলে দে। ভদ্রলোকে ওসব অখাদ্য খায় না। একে পুরনো ঘি তায় আদার রস, তার সঙ্গে মধু। ওদিকে আবার রসুন। কী কম্বিনেশন! ফেলে দে।”

ফুটকি বলল, “ফেলে দিতে হয় তুমি দাও। আমি রেখে যাচ্ছি।”

ফুটকির ভাল নাম লীলা। কাছাকাছি পাড়ার মেয়ে। জেঠাইমার সঙ্গে লীলার মায়ের খুবই বন্ধুত্ব। লীলার বাবা কচিকাচাদের ডাক্তার। একটু খেপাটে। নাম আছে ডাক্তার হিসেবে, পয়সা তেমন নেই।

গোল মতন ছোট বাটিটা রেখে ফুটকি চলে যাচ্ছিল, গোরাচাঁদ বলল, “তুই কি বাড়ি চললি?”

“হ্যাঁ। সাতটা বাজল। বৃষ্টি আসতে পারে।”

“তা যাবার আগে আমাকে কড়া করে এক কাপ চা খাইয়ে যা। আগুনের মতন গরম। গলাটা জ্বলে যাচ্ছে। কেমন বসে আছে দেখছিস না। শব্দ বেরুচ্ছে না। কী রকম শোনাচ্ছে রে আওয়াজটা?”

ফুটকি দু’ পলক দেখল গোরাচাঁদকে। তারপর অক্লেশে বলল, “গাধার মতন। ” বলে চলে গেল।

গোরাচাঁদ থ’ মেরে গেল। ফুটকির কথাবার্তা বরাবরই বেমক্কা। যা মুখে আসে বলে দেয়। কোনও বাদ-বিচার নেই। গোরাচাঁদকে তোয়াক্কা করে না। মান্য তো নয়ই। আসলে মেয়েটা এ-বাড়িতে ছেলেবেলা থেকে আসছে যাচ্ছে বলে ওর কোনো সঙ্কোচ আড়ষ্টতা নেই। কিছুই গ্রাহ্য করে না। আগে তো গোরাচাঁদকে ‘তুই’ বলত। বয়েসে বছর পাঁচেকের ছোট। আজকাল অবশ্য ‘তুমি’ বলে তাও যেন বাধ্য হয়ে। বেশি আস্কারা মেয়ে ও মাথায় উঠেছে। জেঠাইমাই ওকে মাথায় তুলেছে। তবে মেয়েটা ন্যাকা নয়। সাফ-সুফ কথা বলে। এক সময় মেয়েদের ফুটবল খেলত। আঁটসাঁট চেহারা। মাথায় একটু বেঁটে। মেয়েদের স্কুলে ভূগোল পড়ায়। ও আবার জলধরের শালী হয় সম্পর্কে। জলধরের বউয়ের মাসতুতো বোন।

গোরাচাঁদ অবশ্য ‘গাধা’ শব্দটায় খুশি হল না। কিন্তু এখন তার দিন ভাল যাচ্ছে না। যার যা খুশি বলে গেলেও তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। সেই মশলা-বাড়ির মেয়েটা, মানে গুঁড়ো মশলার কারবারি ফটিক দত্তের মেয়েটা, আজ ক’দিন চুপ মেরে আছে। মাঝে একদিন ছাড়া আর ফোন করেনি। ফোন করে অবশ্য সেদিন বলেছে, সোনার চাঁদ গোরাচাঁদকে সে হাতিবাগানের বাজারের কাছে বাগে পেয়েছিল। ইচ্ছে করলেই গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চাঁদের মাথায় চাঁটি মারতে পারত। দয়া করে মারেনি।

তারপর আর ফোন আসেনি। গোরাচাঁদ আজকাল ফোনের ডাক পেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়, গলা দিয়ে শব্দ বেরুতে চায় না! দরদর করে ঘামতে থাকে।

বন্ধুদের ওপরেও গোরাচাঁদ বেশ ক্ষুন্ন হয়ে উঠছিল। ওরা কোনও কর্মের নয়। কিছুই করল না। এতদিনের বন্ধু, এত মাখামাখি, ভাব-ভালবাসা, দায়ে অদায়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, সেই বন্ধুরাই তাকে একা হাড়িকাঠের সামনে রেখে সরে থাকল। লাভের মধ্যে গোরাচাঁদের হাজার দেড়েক টাকা গচ্চা গেল। ওই চারু বাঁড়ুজ্যেকে দিতে হয়েছে।

কী করেছে চারু? কিস্যু নয়। মেয়ের নাম ধাম ছবি, মেয়ের বাপের খোঁজ-খবর সব নিয়ে দিব্যি বসে আছে। জলধর কোত্থেকে একটা ফালতু, বাজে লোক ধরে আনল। কে জানে লোকটা চিট ক্লাসের কী না?

বড় দুঃখেই গোরাচাঁদ বড় করে নিশ্বাস ফেলতে গেল, নাক বন্ধ থাকার জন্যে পুরোপুরি ফেলতে পারল না, বাতাস আটকে গেল।

এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কারা যেন আসছে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সলিলরা ঘরে ঢুকল। চার বন্ধু, আর সেই দাড়িঅলা চারু।

“কি রে? তোর নাকি চার পাঁচ জ্বর! হেপাটাইটিস? না, ম্যালেরিয়া?” সলিল বলল।

গোরাচাঁদ বন্ধুদের দেখছিল। বলল, “কে বলল?”

“বাজারে খবর! তা কী হয়েছে তোর? হেভি টাইপের ম্যালেরিয়া?”

“না। কে বলেছে তোদের আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে?”

“হলেই হয়। কলকাতা শহরে আকচার ম্যালেরিয়া হচ্ছে।”

“আমার সর্দিজ্বর হয়েছে। কমন কোল্ড। ইনফ্লুয়েঞ্জা!”

“তাই নাকি! তা ভাল। বাঁচালি।

“ নিয়োগী বলল, “তুই বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিস না?”

“দু’ দিন বেরোইনি। কারখানা অফিস দু’ দিক দেখতে হচ্ছিল। তার ওপর বৃষ্টি বাদলা। ”।

“কেমন আছিস এখন?”

“জ্বর। গলা বুজে আছে। মাথায় যন্ত্রণা। গা-হাত ভেঙে যাচ্ছে।”

মানিক বলল, “সেরে যাবে দাদা। মেরে কেটে সাত দিন। তবে ক্যালকাটা ফিভার হলে দশ পনেরো দিনের ধাক্কা। শরীরটা বেশ উইক করে দিয়ে যাবে। তা তাতে একদিক থেকে ভাল। আষাঢ় মাসটাও তুমি কাটিয়ে দিতে পারবে। শরীর দুর্বল হলে বিয়ে করা যায় না। এখন আমাদের টাইম দরকার। তুমি যদি আরও একটু বেয়াড়া অসুখ বাধাতে পারতে, শ্রাবণ মাসটাও গড়িয়ে দেওয়া যেত।”

ঠিক এই সময় ফুটকি ঘরে এল। গোরাচাঁদের জন্যে গরম কড়া চা এনেছে।

ফুটকিকে দেখেই জলধর বলল, “কী গো? তুমি! যাক, দেখা হয়ে গেল! কোনো খবরই পাই না। কেমন আছ? খবরটবর ভাল?”

ফুটকি হাসল। “আপনারা ভাল?” বলে সলিলদের দিকেও তাকাল। হাসি হাসি মুখ। সলিলরা সকলেই ফুটকিকে চেনে। এবাড়িতেই দেখছে বরাবর।

একমাত্র চারুই ফুটকিকে চেনে না।

জলধর চারুকে বলল, “চারু, আমার শালী লীলা। অনেক ভাগ্যে এমন শালী পেয়েছি। লীলা খেলোয়াড়। লেডিজ ফুটবলে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলত।”

চারু চকচকে চোখ করে হাসল। বলল, “বাঃ। আমি এই প্রথম মেয়ে ফুটবলার দেখলাম। এখনও খেলেন?”

জলধর বলল, “না, এখন আর—কই—খেলাটেলা…। তা তোমার হাতে ওটা কী?”

“চা। গোরাদার জন্যে!”

“আমাদের জন্যেও একটু হয়ে যাক ভাই। গোরাকে চা না খাইয়ে অন্য কিছু খাওয়ালে পারতে। এনার্জি পেত। চায়ে মুখ আরও বিস্বাদ হয়ে যাবে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় বেশি চা খেতে ভাল লাগে না।”

মানিক বলল, “দাদার চেহারা দু দিনেই যা হয়েছে। মনে হচ্ছে সলিড টায়ার পাঞ্চার হয়ে গিয়েছে।”

ফুটকি বলল, “আকুপাঞ্চার।”

হেসে উঠল সকলেই একসঙ্গে। অট্টহাসি।

গোরাচাঁদ অপ্রতিভ। সে হাসতে পারল না। ফুটকির ওপর চটে গেল। বন্ধুদের সামনে এই রসিকতার কী মানে হয়! ঠিক আছে, এক মাঘে শীত পালায় না। গোরাচাঁদও পরে দেখে নেবে ফুটকিকে।

চা দিয়ে ফুটকি চলে যাচ্ছি।

জলধর বলল, “চায়ের সঙ্গে ঝালটাল কিছু হবে? বড়া ক্লাসের। বর্ষার দিন।”

“জেঠাইমাকে বলছি।”

“থ্যাংক ইউ! তা শ্যালিকা, খবরটবর বললে না?”

“ভালই। ”

জলধর আর ফুটকির মধ্যে খুব সাবধানে, আড়ালে চোখাচুখি হল। ফুটকি চলে গেল। জলধর চারুর দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন চোখ টিপল। ছোট করে। বলল, “নিজের শালী বলে বলছি না, চারু। লীলা ভালই খেলত। আমি দেখেছি ওর খেলা। বুদ্ধি করে খেলতে পারত। বেশ মেয়ে।”

গোরাচাঁদ অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দিল। দিয়েই ‘উঃ’ করে উঠল। চা যে এত আগুন গরম বুঝতে পারেনি। জিভ পুড়ে গেল।

সলিল বলল, “কী হল রে? জিভ বার করে বসে থাকলি?”

গোরাচাঁদ জিভ সামলাতে সামলাতে বলল, “ভীষণ গরম। জিভ ঠোঁট পুড়ে গেল।

মানিক মজা করে বলল, “একটু দেখেশুনে খাও, দাদা! চোখ চেয়ে দেখো।”

সলিল ততক্ষণে আরাম করে বসে পড়েছে। সিগারেট ধরাচ্ছিল। বলল, “তোর কিছু ভাল খবর আছে, গোরা। গুড নিউজ। চারুবাবু অনেকটা সাকসেসফুল। ”

গোরাচাঁদ প্রত্যাশাই করেনি চারুর কাছ থেকে কোনো ভাল খবর শুনতে পাবে। কথাটা কানে যাওয়া মাত্র সে চারুর দিকে তাকাল। চোখে কৌতুহল।

চারু বলল, “কাজ অনেকটাই এগিয়েছে গোরাবাবু। আমি মাঝে আর কোনো খবর .দিতে পারিনি আপনাদের। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। কাজটাই তো আসল। ইন ফ্যাক্ট আমি আপনার ব্যাপার নিয়ে ভীষণ বিজি ছিলাম। কম কাঠখড় পোড়াতে, ঘোরাঘুরি করতে হয়নি।”

জলধর চারুকে বলল, “কতটা এগিয়েছ, তাই বলো গোরাকে।”

গোরাচাঁদ মাথা হেলাল। অর্থাৎ সে জানতে চায় কাজের কাজ কী হয়েছে?

চারু বলল, “প্রথমত আমি আপনাকে মেয়েটির বাড়ির ব্যাপারে অনেক কথাই বলতে পারি। ফ্যামিলি ইনফরমেশান। তারপর ওদের বিজনেস সম্পর্কেও খোঁজ-খবর করেছি। ভালই চালাচ্ছে। মাসে হাজার পঞ্চাশ টাকার বিজনেস করত। এখন ঢিলে যাচ্ছে কিছুদিন। প্রোডাক্ট খারাপ হয়ে গিয়েছে হালে। দেদার ভেজাল দিচ্ছিল। ওদিকে…”

বাধা দিল গোরাচাঁদ। মেয়ের বাপের ব্যবসা সম্পর্কে জানার কোনো আগ্রহ তার নেই। বলল, “বাপ বাদ দিন, মেয়ের কথা বলুন।”

চারু বলল, “মেয়ে, কী বলব, এমনিতে খারাপ নয়। দেখতে-শুনতে ভাল। লেখাপড়াও করেছে খানিকটা। তবে মেয়েটি একটু রোগা আর লম্বা। একটা চোখ সামান্য টেরা। তা এসব ঠিক আছে। স্বভাবটাই ঠিক নেই। রুক্ষ টাইপের, বদমেজাজি, ঝগড়ুটে। তা ছাড়া ওর একটা মেন্টাল—মানে সাইকোলজিক্যাল সিকনেস—গোলমাল আছে। ইনসমনিয়ায় ভোগে, রাত্তিরে যেখানে সেখানে ফোন করে, চেনা অচেনা মানে না, যা মুখে আসে বলে…!”

“পাগল?” গোরাচাঁদ বলল, প্রায় আঁতকে উঠে।

“না, পাগল ঠিক নয়, ওই ছিট টাইপের। তা তার চেয়েও বড় কথা ওর একজন—আই মিন—ওই কমলিকা মেয়েটির একজন ফ্রেন্ড আছে। লাভার। তা চার পাঁচ বছর ধরে দু’জনের লাভ চলছে। লুকিয়ে ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া। চিঠিচাপাটিও চলে। এরকম একটা চিঠি আমি হাতাতে পেরেছি। মেয়েটির লেখা।”

গোরাচাঁদ বলল, “লাভার! প্রেম! ও তা হলে এই বিয়েতে…”

“একেবারেই রাজি নয়, একদম নয়। ওর বাড়ি থেকে জোর করে এই বিয়েটা চাপাচ্ছিল। মেয়ে বলেছে, এই বিয়ে ঠিক হলে ও হয় বাড়ি থেকে পালাবে, না হয় গলায় দড়ি দেবে। বাড়ির লোক এখন খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। তবে পিছিয়ে যায়নি।”

গোরাচাঁদ বলল, “ভীষণ অন্যায় কথা। বাড়ির লোক এভাবে জোর করতে পারে না।”

মানিক বলল, “দাদা, ওর বাড়ির লোক নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। মেয়েকে নিয়ে মাথা ঘামাও। প্রেম করা খেপি মেয়েকে তুমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারো না!”

“আমি কি করব বলেছি! আশ্চর্য!”

“তা হলে তুমি এবার বেঁকে দাঁড়াও। তোমার রিজেকশান স্লিপ পাঠিয়ে দাও।”

“কাকে?”

সলিল কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই নিয়োগী বলল, “গোরা, দিস ইজ দি মোমেন্ট। গোল্ডেন অপারচুনিটি। কথাটা তুই জেঠাইমাকে বলে দে।”

গোরাচাঁদ ভেতরে ভেতরে খুশি হচ্ছিল। প্রেম-করা খেপি মেয়েকে তো তার গলায় ঝোলানো যাবে না। জেঠামশাই জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে খারিজ। ক্যানসেল। বলল, “জেঠাইমাকে বলা কি ঠিক হবে! ওদের ভেতরের কথাবার্তা। তার চেয়ে দিদিকে বলাই ভাল। দিদিকে বলতে পারি।”

“তাই বল।”

“কিন্তু প্রমাণ। দিদি যখন বলবে, কিসের উড়ো খবর শুনে এইসব বাজে কথা বলছিস? ভদ্দরলোকের বাড়ির মেয়ের নামে মিথ্যে গুজব রটানো ভাল নয়। নোংরামির কাজ। বাবা যখন জানতে চাইবে, প্রমাণ কী? তখন? কী বলব বাবাকে?… দিদি তো ভাই ছেলেমানুষ নয়, জামাইবাবুও পাকা লোক।”

“প্রমাণ?” সলিল বলল, “প্রমাণ পেলেই তুই এগিয়ে যাবি! এই তো?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে। প্রমাণ চারুবাবুর কাছে আছে।”

চারু বলল, “আমি আপনাকে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছি। শুধু চিঠি নয়, একটা ফটোও। যাতে ফটোর পেছনে কমলিকা লিখেছে, রাজুকে আমার ভালবাসার সঙ্গে।”

“টু রাজু, উইথ মাই লাভ!” মানিক রগড় করে বলল।

“রাজু কে?”

“ওর লাভার।”

“কই চিঠি? ফোটো কোথায়?”

চারু বলল, “দিচ্ছি। তার আগে আর-একটা কথা বলে নিই গোরাবাবু! মেয়েটি হয়তো আপনাকে আবার একদিন ফোন করবে। দু’ চারদিনের মধ্যেই। সারেন্ডার করতে পারে, কিংবা দু’ দশটা রাফ কথা বলতেও পারে। আপনি তখন সমানে সমানে লড়ে যেতে পারেন। ওকে নক আউট করতে পারেন। তাই না?”

জলধর এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “গোরা, হাতে ব্রহ্মাস্ত্র পেয়েও যদি তুই বেটা বখরি হয়ে থাকিস—ধিক তোকে। ধিক আমাদের।”

গোরাচাঁদ উত্তেজিত হয়ে বলল, “করুক ফোন, আমি ওকে দেখে নেব।”

পাঁচ

যে ফোনের নামে এতদিন গোরাচাঁদের হৃৎকম্প হত, গলা শুকিয়ে যেত ভয়ে—সেই ফোনের প্রত্যাশায় এখন সে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। অধৈর্য হয়ে ওঠে। দিন চারেক কেটে গেল। কোনো ফোন নেই। ছ’ দিনের মাথায় ফোন এল। রাত প্রায় ন’টা নাগাদ। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। বারান্দায় গিয়ে গোরাচাঁদ ফোন ধরল। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। ও দিকে প্রবল বৃষ্টি, মেঘগর্জন, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর এই সময় সব অন্ধকার হয়ে গেল হঠাৎ। লোডশেডিং।

ফোন তুলতেই সেই গলা, তবে আজ একটু চাপা, ধীর, সামান্য জড়ানো। “কে, সোনার চাঁদ নাকি?”

গোরাচাঁদ কোনো জবাব দিল না।

“কী গো, গোরাচাঁদ শুনতে পাচ্ছ না। কালা হয়ে গেলে?”

“শুনছি।”

“বাঃ, এই তো! কথা ফুটেছে। ” বলেই হাসি।

গোরাচাঁদ নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। কড়া গলায় বলল, “শুনুন, আপনি হাসি থামান। এতদিন তো একতরফা খুব হেসেছেন। রসিকতা করেছেন। অপমান করেছেন আমাকে। এবার যে আপনাকে কাঁদতে হবে।”

“কাঁদতে হবে! কেন মশাই! কী দুঃখে!… খুব বৃষ্টি হচ্ছে। একটু গলা তুলে কথা বলো গোরাচাঁদ। তোমার গলা ভাল শুনতে পাচ্ছি না! বাব্বা, কী জোর বাজ পড়ল।”

গোরাচাঁদ বাঁকা গলায় বলল, “আসল বাজটা তো পড়েনি। পড়বে।”

“তাই নাকি? কোথথেকে?”

“আমার কাছ থেকেই।… শুনুন—শুনতে পাচ্ছেন—রাজুকে চেনেন। রাজু! মনে পড়ছে!”

“রাজু। মনে পড়বে না কেন! রাজু আমার বন্ধু।”

“শুধু বন্ধু? না, আরও বেশি। লাভার।”

“লাভারই তো! অনেক দিনের।”

“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বড় বড় চিঠি লেখা হত। আমার আদরের, রাজু। তাই না। একটা চিঠি এনে পড়ব?”

“পড়তে পারো। আমার কাঁচকলা হবে। প্রেম করি, চিঠি লিখি। বেশ করি। তাতে তোমার কী গো নদের চাঁদ!”

গোরাচাঁদ ঘাবড়ে গেল। কী মেয়ে রে বাবা! একটুও দমল না, ভয় পেল না। কী বলবে বুঝতে না পেরে সে বলল, “ওদিকে প্রেম হচ্ছে, আর এদিকে—”

“মশাই, প্রেম নয় শুধু চুটিয়ে প্রেম। রাজু কি স্মার্ট, কী রকম ম্যানলি দেখতে, হ্যান্ডসাম! তোমার মতন গোবরগণেশ, হাঁদা, রসগোল্লা নাকি সে?”

গোরাচাঁদ চটে গেল। পড়ক বৃষ্টি। চেঁচিয়ে বলল, “শাট আপ। কথা বলতে শেখেননি? অসভ্য, অভদ্র, থার্ড ক্লাস! ন্যাস্টি! লজ্জা করে না, একটা ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেন বলছেন—আর এদিকে বিয়ের—”

“কে তোমাকে বিয়ে করতে কেঁদে মরছে নদের চাঁদ! আমি তো গোড়া থেকেই বলছি—লেজ গুটিয়ে পালাও। নয়ত বিপদে পড়বে।”

“চুপ করুন। আমি বিয়ে করছি না। আপনার মতন অসভ্য ন্যাস্টি মেয়েকে কোনো ভদ্রলোক বিয়ে করে না। এ বিয়ে হবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।”

“আঃ! বাঁচা গেল!”

“হ্যাঁ, বাঁচা গেল। আমি বাঁচলাম।”

হঠাৎ কী যে হল, ফোনের ওপারে হাসির লহরা ছুটল। কী জোর হাসি। হাসতে হাসতে যেন মরে যাবে মেয়েটা। হাসছে তো হাসছেই। জোরে, ধীরে, লহর তুলে, ছররার মতন হাসির ধ্বনি ছিটিয়ে হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে ক্রমশ যেন কী একটা হচ্ছিল। স্বর পালটে যাচ্ছিল। গলা অন্যরকম হয়ে আসছিল।

গোরাচাঁদের কানের দোষ। বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় হাসির দাপট কমল। ভোল্টেজ কমে গেলে আলো যেমন নিভু-নিভু হয়ে আসে, সেইভাবে হাসির দমকা কমে এল। তারপর ওপার থেকে কে যেন বলল, “কী গো?”

গোরাচাঁদ চমকে উঠল। যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ধরতে পারল গলার স্বর।

“কী গো?”

“ফুটকি!”

“আমি।”

“তুই ওখানে কী করছিস?”

“আমি ওখানে কেন! আমি তো এখানে জামাইবাবুর বাড়িতে।”

“জামাইবাবু! জলধরের বাড়িতে?”

“হ্যাঁ, জলধরদার বাড়িতে আজ আমার নেমন্তন্ন ছিল। যা বৃষ্টি! আর বাড়ি ফেরা হবে না। এখানেই থেকে যাব।”

গোরাচাঁদ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই-তুই এতক্ষণ আমার সঙ্গে রগড় করছিলি। আশ্চর্য!”

“এতক্ষণ কেন করব, বরাবর করছি, এতদিন।”

গোরাচাঁদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। ফুটকি, ফুটকি এতদিন তার সঙ্গে মজা করছিল। তাকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। “ফুটকি তুই—তুই…।”

“তুই তুই কী করছিস?” এবার জলধরের গলা, মানে ফুটকির হাত থেকে ফোনটা সে নিয়ে নিয়েছে। “কুঁতিয়ে কথা বলছিস কেন! স্ট্রেট বল.।”

“জলধর।”

“জলধর মিত্তির। লীলার জামাইবাবু। প্রাণের আরাম। তোরও বন্ধু। …তা কেমন খেলালাম তোকে।”

“শালা!”

“বল, বল। যা খুশি বল।… তা তুই কিছু বুঝলি? তোর যা মাথা, ইট মারলে ইষ্টক হয়ে যায়। তুই মাইরি সত্যি স্টকে এক পিস মালই। বুঝলি কিছু?”

“কী বুঝব?”

“লীলা।”

গোরাচাঁদ সামান্য চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “বুঝেছি। তবে ওকে। একেবারে ইয়ে অবস্থা থেকে দেখছি।”

“ভালই তো! ইয়েরাই পরে টিয়ে হয়। আরে তুই নিজের বাগানের গাছের ফল খাবি—তার স্বাদই আলাদা। আমরা তো টুকরির মাল খেয়েছি। ” ও পাশে গুঞ্জন উঠল যেন।

গোরাচাঁদ এবার হেসে ফেলল জোরে। বলল, “তা না হয় খাব। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ইউ নো মাই জেঠামশাই!”

“কি ভাবিস না তুই। ঘণ্টা আমরা বাঁধব। দিদি বাঁধবে। নিয়োগীকে দিদির কাছে দুর্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। এভরিথিং ও-কে।”

“ও! মানে তোরা সবাই তা হলে…”

“বিন্দুমাত্র সন্দেহ রাখিস না গোরা, সবাই মিলে মাথা খাটিয়েছি। তুই আমাদের বন্ধু, তোর ভাল-মন্দ আমরা না দেখলে কে দেখবে!” জলধর হাসছিল।

শালা! ভাল-মন্দ দেখনেওয়ালা।… তা ওর কী হবে? মশলাবাড়ির মেয়েটার? ভদ্রবাড়ির একটা মেয়েকে নিয়ে তোরা যা কেচ্ছা করলি… ছি ছি!”

জলধর বলল, “তুই ভাবিস না। চারুর এনট্রি পাকা হয়ে গেল।”

চারু! কেন রাজু?”

“ওই একই হল। যা চারু তাই রাজু। টাকার এপিঠ ওপিঠ।”

“কী বলছিস তুই?”

“ঠিকই বলছি। চারু আসলে ফুড ডিপার্টমেন্টে আছে, নলিনীর সঙ্গে। অফিসার। তোর গুঁড়ো মশলার যাওয়া-আসা আছে চারুর কাছে। ইয়ের ব্যাপার থাকে তো—! চারু মশলাবাড়ির সদর পেরিয়েছিল, এবার অন্দরে ঢুকে যাবে। ও নিয়ে তুই ভাবিস না। তোর টাকাও আমার কাছে।”

গোরাচাঁদ ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “এখানেও ধাপ্পা! তোরা আমায় বুদ্ধ বানিয়ে ছাড়লি।”

জলধর হো হো করে হাসছিল। বলল, “গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—!”

“থাম, গীতা আওড়াতে হবে না। …ফুটকি আছে? ওকে একবার দে।”

ফুটকি ফোন নিল। “কী বলছ?”

“বলছি, তোর কেরামতি দেখলাম। তা তুই গলাটা পালটাতিস কেমন করে?”

ফুটকি হাসছিল, বলল, “কায়দা আছে। ফোনের মুখে পাতলা রাংতা রাখতাম। একটু পেঁজা তুলো। তা ছাড়া তোমার তো বাঁ কানটা ভাল না।”

“বাঃ! চমৎকার! যেমন জামাইবাবু তেমনি তার শালী।… তা তুই এত কাণ্ড করতে গেলি কেন? ব্যাপারটা কান ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতন হয়ে গেল। সরাসরি দেখালেই পারতিস!”

“যাঃ! নিজে দেখতে জানে না, আবার আমায় বলে!” বলতে বলতে ফোন রেখে দিল ফুটকি।

গোরাচাঁদ ফোন নামিয়ে রাখল। দাঁড়িয়ে থাকল সামান্য। তখনও বৃষ্টি পড়ে চলেছে। গোরাচাঁদের মজা লাগছিল। ভালও লাগছিল। বেশ ঝরঝরে মনে হচ্ছিল নিজেকে। বুকের কাছে কী যেন একটা ঝুলত এতদিন। এখন একেবারে হালকা।

চার তাস

নলিন ফোনে কান রেখে সাড়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল; ওপারে গলার স্বর উঠতেই নলিন বলল, “কী ব্যাপার?”

“কিসের কী ব্যাপার!”

“ন’টা পাঁচ থেকে ন’টা তেরো⋯চারবার ফোন তুলেছি⋯এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল?”

“দিদি কথা বলছিল…”

“দাদার সঙ্গে নিশ্চয়।”

“হ্যাঁ।”

নলিন দু-মুহূর্ত চুপ; তারপর বলল, “তোমার দাদাটি ভেবেছেন কী? বাড়ির ফোন কী তাঁর আর তাঁর গিন্নির মৌরসিপাট্টা?⋯আলাদা ফোন নিতে বলো। বউয়ের ঘরে থাকবে।”

ওপারে চাপা হাসি।

নলিন বলল, “হাসছ যে?”

“দাদাকে বললে দাদা কী জবাব দেবে যদি জানতে…” ওপার থেমে গিয়ে হাসতে লাগল।

“যদি জানতে…” নলিন বলার ভঙ্গি অনুকরণ করে ভেঙাল। “লহর তুলে হাসছ যে! এ্যাঁ⋯! জানার কি আছে শুনতে পাই?”

ওপারের হাসি থামল না, স্টেশনের কাছে গাড়ি পৌঁছে গেলে গতি এবং শব্দটা যেমন মন্থর ও মৃদু হয়ে আসতে থাকে, সেই রকম হাসিটাও ঈষৎ কমে আসতে লাগল। তারই ফাঁকে ফাঁকে কথা। ওপার বলল, “দাদা বলবে, তুমিই আলাদা একটা ফোন তোমার বউয়ের ঘরে রাখো। বাড়ির ফোন তোমারও মৌরসিপাট্টা নয়।”

নলিন থমকে গেল যেন। তারপরই বলল, “মানে—?”

“খুবই সহজ।”

“এ রকম কথা বলার কোনো রাইট পুলিনের নেই। আমি দিনে ক’বার বাড়িতে আমার বউয়ের সঙ্গে ফোনে গল্প করছি। সে হরদম করছে। যখনই ফোন তুলি—দেখি লাইন নেই। তারই উচিত তার বউয়ের ঘরে একটা প্রাইভেট লাইন নেওয়া।”

“তা তুমিই বা হরদম ফোন তোলো কেন?”

“তুলি না।”

“না তুললে কেমন করে জানলে দাদা দিদিতে গল্প হচ্ছে⋯”

নলিন এবার একটু যেন থতমত খেয়ে গেল, সামলে নিল অবশ্য, বলল, “বোঝাই যায়। দেখতেই তো পাচ্ছি। বেলা আটটা সোয়া আটটায় চেম্বারে এসেছে, একটাও পেশেন্ট নেই, টেবিলে পা তুলে বউয়ের সঙ্গে গল্প করছে।”

“পেশেন্ট নেই কেন?”

“থাকলে কেউ সাত সকালে পেশেন্ট ফেলে বউয়ের সঙ্গে গল্প করে?”

“ও!⋯তোমারও বুঝি পেশেন্ট নেই?”

নলিন একেবারে বোবা। মাথা ফেরাতেই চোখে পড়ল তার ডেন্টিস্টস চেয়ারটা শূন্য। জানলা দিয়ে একমাত্র যা রোদই ঘরে এ-যাবৎ এসেছে, এসে দিব্যি সেই চেয়ারে বসে আছে। নলিন হেসে ফেলল। তারপর গলার সুর পাল্টে ডাকল, “ফুলটুসি!”

“শুনেছি, বলো—”

“আমার ঘরে একজন পেশেন্ট আছে।”

ওপারে বুঝি বিস্ময় এবং সামান্য বিব্রত হবার শব্দ এল।

নলিন বলল, “পেশেন্ট বেশ শান্তশিষ্ট, কিন্তু তার দাঁত নেই।”

ওপার অস্পষ্ট করে বলল, “বুড়ো?”

“এখনও হয়নি, হতে হতে দুপুর ফুরোবে।”

“ইয়ার্কি মারা হচ্ছে, না?⋯তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারার সময় আমার এখন নেই। অনেক কাজ। কী জন্যে ডাকছিলে বলো?”

“কী করছ?”

“স্নান করতে যাব, স্নান করে মার সঙ্গে…”

“সর্বনাশ, এই শীতে এখন স্নান! তোমার না চোখ ফুলে ব্যথা হয়েছে। পুলিন সকালে কী বলল?”

“বলল, কিছু না।”

“কিছু না?”

“না।”

নলিন দু-মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, “তোমার দিদিকে বলো, আমার বউয়ের চোখ নিয়ে যদি পুলিন ছেলেখেলা করে, তবে আমি তার বউয়ের দাঁত নিয়ে অ্যায়সা হেলাফেলা করব⋯”

ওপার আবার যেন জোরে হেসে উঠল। সেই হাসির মধ্যে কি হল নলিন দেখতে পেল না। দেখতে না পেয়ে জোরে জোরে বলল, “অত হাসির কিছু নেই, আমি পুলিনের বউয়ের ভাঙা দাঁতটা সেপটিক করিয়ে দেব। টিট ফর ট্যাট…”

“তাই নাকি! দিয়েই দেখ, কত মুরোদ বুঝব?”

নলিন প্রায় চমকে গেল। এ যে অন্য গলা, ফুলটুসির নয়, তার দিদির; পাশেই ছিল নিশ্চয়। সঙ্গে সঙ্গে নলিন গলার স্বর পাল্টে নিল। “আরে তুমি! যমুনাপুলিনে⋯। তা, সারা রাত কর কী, সকালবেলাতেও গল্প থামে না। ডিসগ্রেস্⋯! রাম, রাম। চেম্বারে এসে সাত-সকালে কর্তা ফোন করছে আর গিন্নি ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে চেম্বারে পেশেন্ট বসে। ⋯মিত্তিরবংশে এরকম একটা স্ত্রৈণ আর জন্মায়নি। একেবারে ভেড়ুয়া⋯”

“কে?”

“কে আবার, তোমার হাজবেণ্ড গো, শ্রীমৎ স্বামী…!”

“তাই নাকি! লোকে তো বলে আমার দেওর—।”

“আজ্ঞে না মেমসাহেব, দেওর অন্য জিনিস।”

“জানি তাঁর আবার পুজোয় মন নেই, নৈবিদ্যিতেই চোখ…”

নলিন বুঝতে পারল না, থেমে গেল। অথচ কানে শুনছিল খুব একটা রগড়দার হাসি হচ্ছে ওপাশে, দু-বোনেই হাসছে। নলিন অপ্রস্তুত হয়ে সামান্য চুপ করে থেকে শেষে বলল, “মানেটা বুঝলাম না।”

“বুঝে নাও।”

“মেয়েলি ছড়া মানেই অসভ্য কিছু।”

“ওরে, কি আমার সভ্য পুরুষ।”

“আমি বুঝতে পারছি, তোমার পাল্লায় পড়েই পুলিনটা অসভ্য হয়ে গেছে।”

“তাও ভাল; তা ও না হয় অসভ্যই হয়েছে, আর তুমি যে এদিকে কীর্তি করে রেখেছ। কি মশাই, আমার বোনটার সভ্যসমাজে বের হবার পথ এত তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলে⋯।”

ওপাশে কেমন একটা ‘এই’ ‘যা’ ‘মাগো ‘অসভ্য’ ইত্যাদি ভাঙা, বেখাপ্পা, অনুচ্চ-স্বর কথাবার্তা, সলজ্জ হাসি শোনা গেল এবং বোঝা গেল মুখ চাপা দেবার চেষ্টা হচ্ছে। নলিন পরমুহূর্তেই সব বুঝতে পারল। ঈষৎ শিহরিত ও লজ্জিত হয়ে নিতান্ত ভাল ছেলের মতন নলিন আমতা আমতা করে বলল, “তুমি একেবারে ভল্গার। যাক গে, দয়া করে কথাটা গেজেট করে দিও না। যা পেট পাতলা মানুষ। ⋯বুঝলে⋯ ! প্লিজ। কৃতজ্ঞতার একটা পুরস্কার আছে, আমি তোমার আর পুলিনের জন্যে কম করিনি।”

“বড় ভাইকে পুলিন কি? দাদা বলো।”

“দরকারে মানুষ বাবা বলে। যাক সে পরে হবে!⋯তুমি কিন্তু এখন কোনো কিছু ফাঁস করবে না। মাইণ্ড দ্যাট। ⋯আমার হাতেও অস্ত্র আছে।” নলিন হেসে ফেলল।

দুই

এরা এই রকমই, পুলিন, নলিন এবং তাদের বউ। লোকে বলে, তাসের প্যাকেট। অর্থাৎ তারা বোঝাতে চায়, তাসের যেমন চার বাহার, দুই কালো দুই লাল, নয়ত তাসই হয় না, এরাও তেমনি, কাউকে বাদ দেবার উপায় নেই।

পুলিন এবং নলিনের একটা চলতি নাম আছে এ শহরে বাঙালিদের মধ্যে। পুলিনকে বলা হয় ‘চক্ষু’, আর নলিনকে ‘দন্ত’; পুলিন চোখের ডাক্তার বলেই তাকে ঠাট্টা করে যে ‘চক্ষু’ বলা হয় একথা পুলিনও জানে; আর নলিনও জানে সে দাঁতের ডাক্তার বলে তাকে ‘দন্ত’ বলা হয়। এ ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র রাগ নেই। রাগ করে লাভ কি, যারা বলে তারা হয় ঠাট্টা করে বলে, না হয় আদর করে তামাশা করে। ওদের মধ্যে কেউ হয়ত পুলিন নলিনের আবাল্য বন্ধু, কেউ হয়ত তাদের বাবার বন্ধু, রীতিমত গুরুজন ব্যক্তি, যাঁদের কাউকে পুলিনরা হয়ত বলে জ্যেঠামশাই, কাউকে কাকাবাবু। অবশ্য এই ঠাট্টার ডাকটুকু সর্বদার নয়, সকলের কাছেও নয়। মুখোমুখি দেখা হলে, ‘পুলিন, নলিন’ কদাচিৎ কোনো বন্ধু হয়ত বলল, ‘এই যে চক্ষু দন্ত, যাচ্ছিস কোথায়?’

পুলিনরা এ শহরে তিন-পুরুষ বসবাস করছে। ঠাকুরদা ছিলেন সিভিল সার্জন, বিহারের যত রাজ্য ঘুরে রিটায়ার করার পর জলবাতাস, গঙ্গা এবং গাছপালা পাহাড়ের জন্যে এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসলেন। বাড়িঘর তৈরি হল, ঠাকুরদাদা মারা গেলেন। বাবা অন্য কোথাও গেলেন না, এই শহরের আদালতেই ওকালতি শুরু করলেন, এবং দেখতে দেখতে প্রতিষ্ঠা পেলেন।

ক্ষিতীশ মিত্তির (পুরো নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মিত্র) এ শহরে একটা মানুষের মতন মানুষ ছিলেন। বেহারিদের ধারণা ছিল, মিত্তিরবাবুর মতন উকিল পাটনাতেও নেই, আর ‘লালচ্‌’ থাকলে উকিলবাবু পাটনায় গিয়ে লাখো টাকা কামাতেন। ‘সাচ্চা আদমি’ ছিলেন উকিলবাবু। বাঙালিরা বলত, দেবতুল্য ব্যক্তি। শ্রদ্ধাভক্তি করত, ভালবাসত, বিপদে-আপদে শরণাপন্ন হত, অভিভাবকের মতামতের মতন তাঁর মতামত মান্য করত।

মানুষটি ছিলেন নিরহঙ্কার, কর্মী, আমুদে; এমন কি থিয়েটারপাগলও। ওকালতিতে তাঁর পশার ছিল হিংসে করার মতন, তবু তিনি জীবনটা নথিপত্র আদালত করে শেষ করে দিতে চাননি। দুর্গাবাড়ির পাকা ঘর, কালীবাড়ির গায়ে লাগানো লাইব্রেরি এবং স্টেজ ইত্যাদি ক্ষিতীশ মিত্তিরই করেছিলেন। এই শহরের মধ্যে কলেজ করার পেছনেও তাঁর পরিশ্রম ছিল।

এমন একজন মানুষ মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন ভাবতেই কেমন লাগে যেন। শিবরাত্রির দিন যে মানুষ সারা রাত ‘কর্ণার্জুনে’ কর্ণের পার্ট করেছেন, সেই মানুষ পরের দিন জ্বরে পড়লেন, জ্বর হু-হু করে বাড়ল, চারদিনের দিন ডবল নিওমোনিয়ায় মারা গেলেন। বাঙালি মহল্লার লোক ক্ষিতীশ মিত্তিরের বাড়ি ঘিরে তিনদিন সমানে বসে ছিল, যেন যমকে কোন পথ দিয়েই ঢুকতে দেবে না। ছোটাছুটি, ডাক্তার ডাকাডাকি, এটা-সেটা করতে বেহারিরাও পিছপা হয়নি, মনিরামের গাড়ি গিয়েছিল পাটনার সবচেয়ে বড় ডাক্তার নিয়ে আসতে, ডাক্তার আসার আগেই ক্ষিতীশ চোখ বুজে ফেললেন চিরকালের মতন।

শোকটা সকলেরই গায়ে লেগেছিল। পুলিন তখন সবে কলেজে ঢুকেছে, নলিন স্কুলে। অভিভাবক বলতে শুধু তাদের মা। দিদি জামাইবাবু তো দূরে থাকে। অবশ্য পাড়ার লোক সবসময়ই কাছে ছিল। শোকের পর্বটা আস্তে আস্তে কাটল। প্রভাময়ী নিজেকে সামলে নিলেন।

আই-এস-সি পাশ করে পুলিন চলে গেল পাটনা মেডিকেল কলেজে পড়তে। ক্ষিতীশবাবুর সেই রকম ইচ্ছে ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন সিভিল সার্জন। ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তারি পড়ে। ক্ষিতীশের ডাক্তারিটা তেমন পছন্দ ছিল না, তবে বাবাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘তোমার নাতি পড়বে।’

পুলিন পাটনা থেকে পাশ করে গেল বিলেত, চোখের বিদ্যেতে একটা ডিপ্লোমা আনার জন্যে। সেখানে থাকতে থাকতে ছোট ভাইকে নিয়ে গেল। নলিন শিখল দন্ত চিকিৎসা। পুলিন ফিল আগে, নলিন ফিরল মাস দুই তিন পরে।

পুলিন নলিন অতঃপর এখানেই বসেছে। বাবা চাইতেন না—অর্থ এবং প্রতিষ্ঠার জন্যে ছেলেদের কেউ এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। ‘যা করার এখানে থেকেই করবে ; এদের জন্যে করবে।’ প্রভাময়ীরও সেই রকম ইচ্ছে ছিল। শ্বশুরমশাই অনেকটা জমিজায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন, বাগান করেছিলেন; স্বামীর হাতে সেই বাড়ি-বাগান জমি-জায়গা আরও তকতকে হয়েছিল, ছোটখাটো অদল-বদল হয়েছিল। দীর্ঘকাল থাকতে থাকতে এই বাড়ি আর এই জায়গার ওপর যে মায়া জন্মেছিল, সেটা পুরুষানুক্রমে মমতা এবং দুর্বলতা। শ্বশুর ও স্বামী যে ভিটেতে বসবাস করেছেন, শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তা ত্যাগ করে যাওয়ার চিন্তা প্রভাময়ী করতে পারতেন না। পুলিন-নলিনও তা চায়নি। তাদের সংসারে অস্বচ্ছলতা কোথাও ছিল না, বরং ঠাকুরদা এবং বাবা যা রেখে গেছেন তা যথেষ্ট, ভদ্রভাবে জীবন কাটাবার পক্ষে অপ্রতুল নয়। তা ছাড়া পুলিন এবং নলিন এই শহরেই বসবে এ তারা বরাবরই স্থির করে রেখেছিল। জন্মাল এখানে, মানুষ হল, লেখাপড়া শিখল, ঘরবাড়ি থাকল এখানে—আর তারা যাবে পাটনা কি ভাগলপুরে প্র্যাকটিস শুরু করতে! দূর…তা কি হয়। পুলিন ভাল করেই জানত সে একেবারে সাধারণ ছেলে, তার এমন কোনো মেধা নেই যে, বাইরে গিয়ে চেম্বার খুললেই রাতারাতি সে পশার জমিয়ে ফেলবে। বিলেত থেকে একটা ডিগ্রি ডিপ্লোমা আজকাল কে আর না আনছে! ওটা কিছুটা শখ, কিছুটা ফালতু। তার চেয়ে এই শহরে চোখের ডাক্তার নেই, চেম্বার খুললে এখানেই খুলবে। বাবা যা চাইতেন, মা যা চায়। নলিনেরও মনোভাব সেই রকম। দাঁতের ডাক্তারও তো নেই এখানে, অথচ দাঁতের গোড়া কার না ফুলছে—এইখানেই সে প্র্যাকটিস করবে, কম্পিটিটার নেই।

পুলিন বিলেত থেকে ফিরে এসে সদর বাজারের কাছাকাছি ওদেরই এক ভাড়া দেওয়া বাড়ি মেরামত করাল, বাহারি করল। ওপরতলায় খান চারেক ফালি-ফালি ঘর থাকল, সেটা হল ক্লিনিক। নীচের তলায় দুই ভাইয়ের চেম্বার, আলাদা আলাদা, একটা আই স্পেশ্যালিস্ট ডাক্তার পি সেন-এর, অন্যটা ডেন্টাল সার্জন ডাক্তার এন সেন-এর।

পুলিন আর নলিন একেবারে পিঠোপিঠি ভাই, বছর দেড়েকের ছোটবড়। মাথার ওপর ছিল দিদি, তার বিয়ে হয়েছে মুঙ্গেরে, ভগ্নিপতি কলেজে কেমিস্ট্রির প্রফেসার। আসা-যাওয়া আছে। অতি রসিক-পুরুষ। পুলিন নলিনের বিয়েতে ভদ্রলোকের কিছুটা কারসাজি ছিল।

ওদের বিয়ের গল্পটা প্রসঙ্গত কোনো সময়ে আসবে, আপাতত এইটুকু মাত্র জানা দরকার—পুলিনের স্ত্রী মানসী, এবং নলিনের স্ত্রী সরসী সহোদর বোন, পুলিন নলিনের মতনই পিঠোপিঠি। চারজনের সম্পর্কটা তাই আরও কৌতুকপ্রদ হয়ে উঠেছে। পুলিন অনেক সময় ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে শালী সম্পর্কে ঠাট্টা করে, এবং নলিনও প্রত্যুত্তরে পুলিনের বউকে বড়শালীর প্রাপ্য খোঁচাটুকু মারতে ছাড়ে না।

বিয়ে হয়েছে বছর পুরতে চলল, অথচ দুই ভাই এমন সব কীর্তি করে যাতে মনে হয় এরা সদ্য বিবাহিত। যেমন আজ সকালে ফোন নিয়ে করল। এ-রকম নিত্যই হয়। চেম্বারে এসে রুগি না থাকলেই যে যার বউকে ফোনে ডেকে গল্প করতে চাইবে। মুশকিল এই, চেম্বারে পুলিনের নিজের ফোন আছে, নলিনেরও আছে; অথচ বাড়িতে মাত্র একটা ফোন। পুলিন-মানসী বাক্যালাপ চলতে থাকলে নলিন লাইন পায় না, নলিন-সরসী বাক্যালাপ চলতে থাকলে পুলিন হাঁ করে বসে থাকে। এবং দুজনেই দুজনের আক্কেল দেখে বোধ হয় অবাক হয়ে যায়।

তিন

বারোটার পর পুলিন গায়ের কোটটা কাঁধে ঝুলিয়ে শিস দিতে দিতে নলিনের চেম্বারে এসে ঢুকল। ছিপছিপে-চেহারা পুলিনের, গায়ের রং ফরসা, মুখ লম্বা ধরনের, সোজা শক্ত নাক, চোখ দুটো চকচকে, মাথার চুল কোঁকড়ানো। বাবার মুখের আদল পেয়েছে বড় ছেলে। ঘরে ঢুকে পুলিন বলল, “কই রে, তাড়াতাড়ি নে। ⋯খিদে যা পেয়েছে!⋯তোর সিগারেটের প্যাকেটটা কই⋯?” পুলিন নলিনের টেবিল হাতড়ে সিগারেট খুঁজতে লাগল।

সামান্য আগে নলিনের এক রুগি বিদায় নিয়েছে, নলিন সাবানে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছছিল। হাত মোছা হয়ে গেলে—একপাশে রাখা স্টেরিলাইজার যন্ত্রপাতির বাক্সটা কাচের আলমারির মধ্যে সরিয়ে রাখল।

নলিন বেশ গোলগাল, গায়ের রং পুলিনের চেয়েও ফরসা। নলিনের মুখও গোল, ফোলা ফোলা গাল নাক একটু পুরু, চোখ দুটো স্বচ্ছ ও সুন্দর, মাথায় সাবেকি ধরনের টেরি, চোখে ক্যারেট গোল্ড ফ্রেমের চশমা; নলিন হাসলে তার দাঁত দু পলক তাকিয়ে দেখার মতন। দাঁতের ডাক্তার বলেই বোধ হয় নিজের দাঁত দেখিয়ে নলিন অনেক রুগিকে পরোক্ষে ঘায়েল করে। নলিনের মুখের আদলে মায়ের মুখের ছাপ আছে।

পুলিন সিগারেট খুঁজে ধরিয়ে নিয়েছিল। সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে কি ভেবে সে দাঁত-দেখানো চেয়ারে এসে বসে পড়ল। বসে বলল, “এই দেখ তো, দাঁতের ফাঁকে কোথায় একটা কাঁটা আটকে আছে, বের করে দে।”

নলিন বিন্দুমাত্র গরজ দেখাল না। জানলার কাচের পাল্লা বন্ধ করে পরদা টেনে আলো আড়াল করে দিল।

পুলিন বলল, ‘কি রে, কাঁটাটা বের করে দিলি না?’

নলিন তার টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়োতে কুড়োতে জবাব দিল, “ওবেলা দেব। এক সঙ্গে।”

“একসঙ্গে।”

“দুপুরে গিলতে গিয়ে আবার তো একটা কাঁটা ঢোকাবি।”

পুলিন ঘাড় ফিরিয়ে ভাইকে দেখছিল, এবার উঠল। পুলিন প্রায়ই খেতে গিয়ে দাঁতের ফাঁকে কাঁটা আটকে ফেলে, নাকি আটকে যায়। তার একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যেস, মাছের কাঁটা বাছাও তার সহ্য হয় না। নলিন তাকে খোঁচা দিল আর কি! দিক।

ক্লিনিকের বাইরে শীতের রোদে ওদের গাড়িটা দিব্যি রোদ পোয়াচ্ছে। ছোট্ট একটা হিলম্যান, টকটকে লাল রং। পুলিন নলিন এগিয়ে গেল, চাকর চেম্বারের দরজা জানলা বন্ধ করছে, শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

গাড়িতে উঠে পুলিন বলল, “শেতলদার মার ছানি কাটতে হবে, বুঝলি।”

নলিন অন্য পাশ দিয়ে উঠে পুলিনের পাশে বসল, “কেটে ফেল।”

নলিন এমন সাদামাটা নিরুত্তাপ গলায় বলল যে, পুলিনের মনে হল ব্যাপারটা নলিন অবহেলার চোখে দেখছে। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে পুলিন বলল, “এ তোর দাঁত তোলা নয়, সাঁড়াশি ধরে মারলাম টান, বেরিয়ে গেল জান-প্রাণ…।”

গাড়ি চলতে শুরু করল। নলিন জবাব দিল, “হাতুড়ের মতন কথা বলিস না। দাঁতের তুই কী জানিস?”

“যা যা, দাঁতের আবার জানা⋯ ! তোরা যে কত ব্লাফ দিস লোকে তো আর জানে না। জানলে কাছে ঘেঁষত না।”

“তোরাও ঘর অন্ধকার করে যে ম্যাজিক দেখাস তাই বা ক’জন জানে বল? বুদ্ধু হয়ে টাকা গুনে দিয়ে চলে যায়।”

রাস্তায় কে একজন হাত তুলে কিছু বলল, পুলিন মাথা নাড়ল, নলিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি। জয়মলরামের দোকান পেরিয়ে গেল, বাজারের একটা রাস্তা এখানে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে, পুলিন বাঁদিকে পথ নিল, ম্যাকসাহেবের বেকারি, মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে হালদারদা কার সঙ্গে যেন গল্প করছে, পুলিন নলিনকে দেখে হাসল, ওরাও প্রত্যুত্তরে হাসিমুখ করল, তারপরই গণেশ হালুইকরের মিষ্টির দোকান পড়ল ডানপাশে।

পুলিন গাড়ি দাঁড় করাল। বলল, “দই নিয়ে আসবি?”

“শীতকালে দই খেতে নেই⋯”

“দইয়ের কথা বলেছিল; কি-যেন বলল আরও একটা মনে পড়ছে না।”

“আমায় কিছু বলেনি।”

“মানসী আমায় বলেছে।”

নলিন অগত্যা হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলল। “টাকা দে।”

“তুই নিয়ে আয়⋯”

“বেশ আছিস—”

পুলিন হাসল, বলল, “গাড়ির তেল কিনতে হবে, আমার কাছে তেলের টাকাটা আছে।”

“সকালে কিছু ইনকাম হয়নি তোর?”

“দূর⋯র। প্রথমে এল সেই ফেরিঅলা বুড়োটা তারপর এল শেতলদা। টাকা দিতে চেয়েছিল, ওকি আর নেওয়া যায়!”

নলিন দু-মুহূর্ত বড় ভাইকে দেখে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে নেমে পড়ল। দু-পা এগুতেই শুনল পুলিন সিগারেট-সিগারেট করে চেঁচাচ্ছে। নলিনের হাসি পেল। তাদের দুই ভায়ের পক্ষে এখানে চেম্বার খুলে বসা বোকামি হয়েছে। অর্ধেক লোকের কাছে তারা টাকা নিতে পারে না। এত সব চেনাশোনা, কেউ দাদা, কেউ কাকা-মামা, কেউ আসে বাচ্চা ছেলেমেয়েকে দেখাতে, কেউ মা-পিসিকে নিয়ে। কেউ বা নিজের জন্যেই আসে। এদের বেশির ভাগই দু-পাঁচ টাকা দিতে চায়, স্বেচ্ছায়, পুলিন-নলিন নিতে পারে না। নিতে লজ্জা করে। এভাবে কতদিন প্র্যাকটিস চলবে? নিতান্ত বাপ-ঠাকুর্দার পয়সা ছিল তাই চলছে, নয়ত মুশকিলে পড়তে হত। অবশ্য নলিন ভাবল, তারা এখন একেবারে নতুন; পুরানো হলে ফ্রি-রুগি কমে যাবে, আশপাশ থেকে দেদার রুগি আসবে।

দই কিনে নলিন দেখল টাটকা বালুসাই তৈরি হয়েছে। ফুলটুসি বালুসাই খেতে খুব ভালবাসে। নলিন বালুসাই কিনল। হালুইকরের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গেল পানের দোকানে, সিগারেট কিনল। গাড়িতে ফিরে আসার সময় নলিন হিসেব করে দেখল, তার সকালের রোজগার শেষ হয়ে দু-টাকা গাঁট-গচ্চা গেছে। মন্দ নয়!

গাড়িতে এসে বসে দরজা বন্ধ করল নলিন।

পুলিন শুধোল, “ওটা কী আনলি?”

“বালুসাই।”

পুলিন হেসে বলল, “সরসী বলেছিল?” বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল আবার।

“না, তোর মতন আমার চেম্বারে বসে বসে বউয়ের অর্ডার নিতে হয় না।”

গাড়ি চলছে। পুলিন ভাইকে দেখল মুখ ফিরিয়ে। হাসছিল। শিস দিল একবার। তারপর মুখ গম্ভীর করে বেসুরোভাবে গাইতে লাগল, “যৌবন সরসী নীরে…।”

নলিন গম্ভীর হয়ে বলল, “বাড়িতে তোর শোবার ঘরে আরও একটা লাইন করিয়ে নে ফোনের। এ-রকম আর চলবে না। ফেড আপ হয়ে গিয়েছি।”

জবাবে পুলিন বলল, “তুই-ই বরং একটা করিয়ে নে, আমার তো লজ্জাই করে।”

নলিন পুলিনের মুখের দিকে তাকাল। “বাজে কথা বলিস না। আমি দেখেছি, যখনই ফোন করতে গেছি বাড়িতে তুই মানসীর সঙ্গে গল্প করছিস।”

“আমি তো দেখেছি, ঠিক উল্টো, তুই সরসীর সঙ্গে গল্প করছিস।”

“লায়ার।”

পুলিন হাসতে লাগল। সামান্য দূরে পেট্রল পাম্প। পেট্রল নিতে হবে গাড়িতে। পুলিন রাস্তার ধার ঘেঁষে পেট্রল পাম্পের দিকে এগুতে লাগল।

দুপুরের খাওয়াটা সাবেকি ধরনের। দুই ভাই খেতে বসে এক সঙ্গে, বউরা বসে না। কাছে থাকে। মা-ই সব দেখাশোনা করেন। বউরা ফরমাশ খাটে। রাত্রে অবশ্য মা থাকেন না, দুই ভাই এবং দুই বউ টেবিল ঘিরে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে খায়। খাওয়ার চেয়ে গল্প-গুজবই বেশি করে, হাসিঠাট্টার পাট সহজে মিটতে চায় না।

পুলিন নলিন খেতে বসেছে, মা সামনে, মানসী এবং সরসী হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রভা শুধোলেন, “কই মাছটা কেমন খাচ্ছিস? নটু কোথথেকে যোগাড় করে এনেছে।”

পুলিন বলল, “কে রেঁধেছে?”

“ছোট বউমা।”

“মন্দ না⋯” পুলিন সামান্য মুখ তুলে একবার ভাই এবং পরে সরসীকে দেখে নিল। গম্ভীর হয়ে বলল, “শীতের কই এমনিতেই খেতে ভাল লাগে। ⋯তা কই মাছ রাঁধে দিদি⋯”

“কার দিদি?” নলিন সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলল।

পুলিন সামান্য অপ্রস্তুত। “কার দিদি মানে? আমাদের দিদি।”

“ও!” নলিন ঘাড় নাড়াল বার কয়েক, বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুই সরসীর দিদির কথা বলছিস।”

সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে সরসী ও মানসী চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। হাসি চাপল।

পুলিন অল্পের জন্যে দমে গেলেও ত্বরিতে সামলে নিল। বলল, “তোর ভাবাভাবি ওই রকমই। বুদ্ধি বলে জিনিসটা তো কোনো কালে হল না। নিরেট।”

“তোর ব্রেনের ওয়েট কত?”

“যতই হোক, তোর চেয়ে বেশি।”

“তা হলে ওটা ব্রেন নয়, ব্রেনগান।”

সরসী জোরেই হেসে ফেলল। মানসী ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।

পুলিন মার দিকে তাকাল। প্রভা বুঝুন না বুঝুন, হাসছিলেন। এটা নিত্য দিনের ঘটনা। এ যদি বলে ‘তুই গাধা’, ও বলবে ‘তুই এল্ডার গাধা’।

“মা, তোমার ডেন্টাল সার্জনকে বলো দাঁতের পাটি সব সময়ে চোখের তলায় থাকে।”

পুলিন বলল, “ভগবানই মেরে রেখেছেন, আমার হাত নেই।”

“ও তোর ছোটই—” প্রভা বললেন।

“ব্যবহার দেখে তো মনে হয় না। ⋯বড় ভাইয়ের বউকে নাম ধরে মানসী বলে। আস্ত একটা ছোটলোক।”

নলিন এক মনে খেয়ে যাচ্ছে, হাসিটা চোখে জড়ানো।

মানসী বলল, “হ্যাঁ মা, এটা আমিও বলব। বাইরের লোকের সামনেও ও এইভাবে ডাকে।” বোঝাই যায় মানসী ইচ্ছাকৃতভাবে নলিনকে খোঁচাবার চেষ্টা করছে।

প্রভা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নলিন বলল, “বাইরের লোকের সামনে তোমায় কি বলে ডাকব, যদি বলো ‘মা জননী’ বলতে পারি।”

সরসী খিল খিল করে হেসে উঠল। প্রভাও হাসলেন। পুলিনও হেসে ফেলল। মানসী অপ্রস্তুত।

নলিন পুলিনকে বলল, “খাবার সময় বেশি কথা বলিস না ধীরে সুস্থে কাঁটা বেছে খা। কই মাছ খাচ্ছিস তো, সামলে⋯”

মানসী তার অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠেছিল। নলিনকে চোখের ইশারায় কি যেন বুঝিয়ে শাসাল। নলিন সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম মুখ করে চোখে চোখে বলল, খবরদার।

প্রভা বললেন, “পরশু সকালে বেয়াই-মশাই আসছেন, শুনেছিস?”

পুলিন এবং নলিন দুইজনে মার মুখের দিকে তাকাল। তারা শোনেনি। শোনার অবসর হয়নি। চেম্বার থেকে ফিরে সোজা স্নান করতে গেছে, স্নান সেরে খেতে এসেছে। ইতিমধ্যে মানসী অথবা সরসীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে বুঝি একবার, কিন্তু খবরটা তখনও পাওয়া যায়নি।

“হঠাৎ ?” পুলিন শুধলো।

“যাবেন গয়া। যাবার পথে এখান থেকে ঘুরে যাবেন।”

“গয়া কেন? কার পিণ্ডি⋯না, মানে কে থাকে গয়ায়?”

“মেসোমশাই—” মানসী বলল, “মেসোমশাই অনেক দিন ভুগছেন অসুখে, দেখতে যাবে বাবা।”

পুলিন বলল, “রাত জেগে ঠাণ্ডা লাগিয়ে আসছেন কেন? মুঙ্গের থেকে দিনের বেলায় গাড়ি পাওয়া যায়।”

জবাব দিল সরসী। “বাবা রাত্তিরের গাড়িই পছন্দ করে।”

পুলিন জল খেল, ঢেঁকুর তুলল, বলল, “একলাই আসছেন নাকি?”

“একাই”, মানসী জবাব দিল।

“ন্যাচারেলি। ⋯তোপের মুখে বসে কেই বা আসতে চাইবে।” নলিন গম্ভীর মুখে বলল।

সরসী মানসী ভ্রূকুটি করে কিছু বলবার আগেই নলিন উঠে পড়ল। পুলিনও।

বিকেলে আবার চেম্বার। শীতের বেলা, পাঁচটাতেই অন্ধকার হয়ে যায় বলে পুলিন নলিন চারটে নাগাদই চলে আসে চেম্বারে। সকালের চেয়ে বিকালের দিকটাতেই লোকজন বেশি, মানে দশ বিশজন নয়, হরেদরে চার পাঁচটা রুগি। কোনো কোনোদিন ফাঁকাও যায়।

পৌষ মাস, শীতটাও বেশ পড়েছে। সাতটা নাগাদ নলিন তার কাজকর্ম শেষ করে পুলিনের চেম্বারে ঢুকল। পুলিন টেবিলে পা তুলে দিয়ে জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছিল।

নলিন বলল, “তোর হল? আর আসবে কেউ?”

হাতের কাগজ রেখে পুলিন বলল, “না। সাতটা বাজল, চল উঠি।” বলে পুলিন তার হাতের কাছের জিনিসগুলো গুছোতে লাগল। গুছোতে গুছোতে বলল, “চন্দ্রবাবু তাঁর ভাগ্নিকে এনেছিল, বুঝলি, গ্লুকোমা বলে মনে হচ্ছে। সিরিয়াস কিছু নয়, তবু এ-বয়সে জেনারেলি গ্লুকোমা হওয়ার কথা নয়।”

“সারিয়ে ফেল।”

“সেরে যাবে। ওষুধ দিয়েছি।”

“আজ আমার একটা সাংঘাতিক এক্সপিরিয়ান্স হয়েছে।” নলিন তার সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বিভীষিকা দর্শনের ভঙ্গি করল। “একটা কাবলিঅলা এসেছিল—।”

“কাবলি⋯!” পুলিন এমনভাবে বলল, যেন কাবলিঅলাদের দাঁতে রোগ হয় এ তার জানা ছিল না।

নলিন ভাইয়ের দিকে তাকাল। “বাঃ, কাবলিদের কি দাঁত থাকে না!”

“হয়েছিল কী ওর?”

“দাঁত তুলতে হল।”

“কটা?”

“একটাই তুললাম। একটা দাঁত তুলতে ঝাড়া এক ঘণ্টা। বেটা কিছুতেই পুরো মুখ খুলবে না প্রথমে। ভুলিয়ে ভালিয়ে হাঁ করালাম তো মুখের মধ্যে কিছু ঢোকাতে দেবে না। তাতেও বাগ মানালাম তো মাড়িতে ইঞ্জেকশান করার আগেই গলগল করে ঘামতে লাগল। ওই চেহারা ভয়ে কাঠ। তারপর বেটার কী কান্না।”

“দাঁত তুললি?”

“দিলাম তুলে। বললাম, এটা তুলে দিলেই আর একটা গজাবে।” নলিন হাসতে লাগল। “অদ্ভুত, বুঝলি। নতুন দাঁত গজাবে শুনে বেটা কাবলি কাবু হয়ে গেল। ⋯ভাবল আসলটা যাক সুদ আসবে। বাপস, যা ট্রাবল দিয়েছে।”

“ক’টাকা নিলি?”

“টেন।”

“বি কেয়ারফুল। ⋯ওই কাবলি আর ক’দিন পরেই তোর চেম্বারে এসে লাঠি ঠুকবে। হামারা দাঁত কাঁহা? দাঁত দো।”

নলিন গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

বাড়ি ফিরতে দেরিই হয়ে গেল সামান্য। শীতটাও আজ গায়ে লাগছে। বিকেল থেকেই কনকনে ভাবটা বোঝা যাচ্ছিল, শুকনো অথচ বরফকুচির মতন ঠাণ্ডা আস্তে আস্তে জমছে। জমতে জমতে এই প্রথম রাত্তিরে শরীরে কাঁটা ধরিয়ে দেবার মতন শীতল হয়ে গেছে। নাক মুখ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, হিম পড়ছে খুব।

পুলিনের ইচ্ছে ছিল একটু খেলা হোক। বাড়ির সামনে বাগানে ঘাসের লনে তাদের ব্যাডমিন্টন কোর্ট, আলোর ব্যবস্থা আছে, নেট টাঙাবার খুঁটি আছে। প্রায়ই দুই ভাই দুই বউ নিয়ে র‍্যাকেট হাতে নেমে পড়ে। শরীর চর্চা তো বটেই তার সঙ্গে আনন্দ চর্চাও।

চায়ের পাট শেষ হলে (এ-সময় একবার চারজনে বসে চা খায় ওরা) মানসী বলল, “না আজ আর খেলতে পারব না, যা ঠাণ্ডা।”

পুলিন বলল, “একটু ছোটাছুটি করলেই গা গরম হয়ে যাবে।” মানসী মাথা নাড়ল। “না। সরসীর শরীরটাও ভাল নেই।”

সরসী দিদির দিকে তাকাল। মুখে আতঙ্ক ও গোপন মিনতি।

পুলিন বলল, “কী হয়েছে?”

সরসী অন্য দিকে তাকাবে ভেবেছিল, সে চাইছিল না তার মুখের ভাবটা দাদার চোখে পড়ে, কিন্তু সরসী অন্য দিকে না তাকিয়ে সোজা নলিনের দিকে তাকাল।

পুলিন কিছু বুঝতে পারল না।

জবাব দিল মানসী। বলল, “হয়েছে কিছু। শরীর খারাপ হবে না, বাঃ রে—! ও খেলতে পারবে না। আমিও বাবা এই ঠাণ্ডায় বাইরে যেতে পারব না।”

অগত্যা পুলিন তাস খেলার প্রস্তাবটা পাড়ল।

“চলে এসো—” নলিন রাজি। “ব্রিজ না ব্রে?”

“ব্ৰে না, ব্রে আমি খেলব না। ইস্‌⋯সবাই মিলে আমায় হারাও।” সরসী ব্রে খেলতে রাজি না।

“তবে ব্রিজ?” নলিন তাস আনতে উঠল।

“না, আমি তোমার পার্টনার হয়ে খেলব না, তুমি খালি রাগবে আর চেঁচাবে⋯” মানসী ব্রিজ খেলবে না।

“আমি সরসীকে নিয়ে খেলব।” নলিন বলল।

পুলিন বিপদ বুঝে বলল, “ব্রিজটা থাক, বরং ফিশ হোক। পয়সা লাগাও। নলিন আজ কাবলিঅলার দাঁত তুলে দশ টাকা পেয়েছে।”

মানসী হাঁ করে নলিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর সারা গা মুখ কুঁকড়ে কেমন একটা ভঙ্গি করল। “ই⋯মাগো! তুমি তুলতে পারলে?”

“কেন, কি হয়েছে?”

“গন্ধ⋯! বাব্বা, যা দুর্গন্ধ⋯”

“কি করে তুমি বুঝলে দুর্গন্ধ? নাক লাগিয়ে শুঁকেছ?”

“থাক, আমাকে আর শুঁকতে হবে না।” মানসী ঠোঁট উল্টে গা বিড়োনোর ভাব করল।

পুলিন বলল, “ইডিয়েট।”

তাস এনে সাফল করতে বসল নলিন। দুই ভাইয়ের শোবার ঘরের মাঝামাঝি একটা ঘরে তারা বসে আছে। এই ঘরটাই তাদের রাত্রের আড্ডাখানা। আসবাবপত্র মোটামুটি কিছু কম নেই, মেঝেতে মোটা গালচে পাতা, সোফা-সেটির সঙ্গে একপাশে ফরাসপাতা চৌকি, দরকার হলে দু-দণ্ড কেউ গড়িয়ে নেয়, এক কোণে একটা ডোয়ার্কিনের অর্গান, বাবার আমলের, অন্য কোণে দেওয়ালে একটা হরিণের সিং-অলা মাথা, তার নীচে টেলিফোন। ঘরের দরজা জানলা, কাচের শার্সি সবই বন্ধ, ফলে ঘরটা রীতিমত আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে।

নলিন তাস সাফল করছে দেখে মানসী বলল, “আমায় কেউ ক’টা টাকা ধার দাও।”

সরসী সঙ্গে সঙ্গে পুলিনের দিকে হাত বাড়াল, “আমার সেদিনের দু-টাকা শোধ করুন।”

নলিন বলল, “নো লোন বিজনেস। যে যার টাকা পয়সা নিয়ে এসো।”

“বারে, আমি দু-টাকা সেদিনের পাই—”

“সে পরে নেবে, এখন গাঁট থেকে বের করো।”

“একই হল, আমাদের কি আলাদা গাঁট, তোমাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা—” বলে মানসী বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল, তারপর পুলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “দাও, আমাকেও দুটো টাকা দাও।”

“বাক্যেন মারিতং জগৎ—” নলিন মন্তব্য করল।

পুলিন পকেট থেকে টাকা বের করে মানসী ও সরসীকে দিল, বলল, “আমার প্রথমেই চার টাকা গচ্চা। বেশ আছো!”

তাস খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিকে তেমন একটা কলরব শোনা যায় না, গল্প-গুজব এবং তাস একই সঙ্গে চলতে থাকে; তারপর ক্রমশই এদের হইচই বাড়ে। প্রভাময়ী সন্ধের পর এদিকে থাকেন না, তাঁর নিজের ঘরে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অবশ্য তাঁর কাজ বলতে জপতপ ধর্মগ্রন্থ পাঠ। কোনো কোনোদিন পাড়ার কোনো প্রবীণা আসে তাঁর সঙ্গে গল্প করতে। বউদের ডাকাডাকির প্রয়োজন তাঁর বড় একটা হয় না। তিনি এদের চারজনের আনন্দের মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটাতে চান না। বরং এই সময়টা নির্জনতা ও শান্তিই তাঁর পছন্দ। এক একদিন বউরা কিংবা ছেলেরা তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে এ সময় যেতে যেতে শুনেছে মা গুন গুন করে কীর্তন গাইছেন। প্রভার গলাটি যে এককালে অতি সুমিষ্ট ছিল তা ছেলেরা জানে, বউরাও এখন জেনে নিয়েছে।

খেলা চলছিল। মানসীর আজ কপাল ভাল। জিতেই যাচ্ছে। নলিন একবার মাত্র জিতেছে। এই দানটা কাউকে আর তাস ফেলতে সময় দিল না মানসী, হুট করে প্রায় টাকা খানেক জিতে নিল।

নলিন মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর মানসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কার মুখ দেখে উঠেছিলে আজ একটু বলবে।”

“কেন বলব…” মানসী পয়সার হিসেব করতে করতে জবাব দিল।

“বললে আমাদের দুই ভায়ের উপকার হত। ভোরে উঠেই সোজা চোখ বুজে তার কাছে চলে যেতাম।”

“সে আছে; তুকতাক করা মুখ। ⋯” মানসী চোখের পাতা টান করে রঙ্গভরে হাসল।

পুলিন গম্ভীর হয়ে বলল, “সেই মুখটা আমার। তুই আমার কাছে আসিস, আমি শুয়েই থাকব।”

মানসী হেসে উঠল। সরসী হাসতে হাসতে পুলিনকে বলল, “আর আপনি নিজে যে হারছেন⋯”

“নিজের মুখ নিজে নিজে তো আর দেখা যায় না, তাই।”

“বালিশের পাশে একটা আয়না নিয়ে শুবি—” নলিন জবাব দিল।

চারজনেই হেসে উঠল। পুলিন সিগারেট ধরাল। সরসী তাস দিতে লাগল।

মানসী এবং সরসীর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই চেহারায়। মুখের আদল প্রায় এক, দুজনের মুখের ছাঁচই বটপাতার মতন অনেকটা; কপাল পুরন্ত, চিবুক সুডৌল। মানসীর গায়ের রং সামান্য মরা, চোখ দুটিও ঈষৎ বড়। মানসীর নাক তেমন উঁচু নয়। সরসীর নাক উঁচু, চোখ দুটি টলটল করছে। দুটি মুখেই প্রসন্নতা ও তৃপ্তি দেখে মনে হয় কে যেন প্রসন্নতা ও তৃপ্তির হাসির একরকম মোম ওদের মুখে মাখিয়ে এক মসৃণতা সৃষ্টি করেছে।

পুলিন একটা তাস তুলে নিয়ে দেখল, এবং মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শিস দিল।

নলিন আপত্তি জানাল, “শিস দেওয়া চলবে না⋯”

“কেন, কেন?” পুলিন কৈফিয়ত তলব করল।

“মানসী এবার হাত ফেলে দেবে। তুমি ওকে জানিয়ে দিলে। ওটা বেআইনি।”

“তোমরাও ফেলে দাও।”

নলিন ততক্ষণে তাস টেনে নিয়ে দেখেছে, তাসটা হাতে রেখে বলল, “মামার বাড়ি আর কি! চলে এসো।”

সরসী বলল, “শিস দেওয়া কিন্তু সত্যিই চলবে না। ⋯বাবা শিস শুনলে রেগে আগুন হয়ে যায়।”

মানসীও বোনকে সমর্থন করল, বলল, “সত্যি, শিস দেওয়া যে কি বিশ্রী অভ্যেস তোমার! যতসব অসভ্যতা শিখেছ!”

পুলিন নলিনের দিকে তাকাল, তারপর মানসী ও সরসীর দিকে, “তোমার বাবা কোন ঘরে থাকবেন?”

“কেন?” দু-বোন একই সঙ্গে জানতে চাইল।

“সেই বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। উনি ওপরে থাকলে আমায় নীচে দিও; আমার নেচারের সঙ্গে কোনো সাইলেন্সার ফিট করা নেই কিনা!” পুলিন রঙ্গ করে বলল।

মানসী সরসী দু’জনেই ঘাড় সোজা করে বসল। মানসী বলল, “গুরুজন নিয়ে তামাশা—”

“মোটেই নয়,” পুলিন মাথা নাড়ল, “আমরা হইচই চেঁচামেচি করে শিসফিস দিয়েই বাড়িতে থাকি। দুম করে স্বভাব পালটাব কি করে!”

“পালটাবে—” মানসী আদেশ জারি করার মতন করে বলল, “পালটালে মরে যাচ্ছে না কেউ।”

“না—মোটেই না⋯” বলতে বলতে নলিন হাতের তাস ফেলে দিল। পুলিন ভেবেছিল দানটা জিতবে, নলিন মেরে দিল। অনেকগুলো পয়সা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল পুলিন।

পয়সা বুঝে নিয়ে নলিন তাসগুলো সরসীর দিকে এগিয়ে দিল। সিগারেট ধরাল আরাম করে। তারপর মানসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি পালটানোর কথা বলছিলে, পুলিন বলছিল পারবে না। ⋯ওকে একবার মনে করিয়ে দাও না, বিয়ের কনে পালটে যাওয়ায় ওর কোনো আফশোস হয়েছে কি না!”

পুলিন ঠিক এই ধরনের একটা জবাব আশা করেনি, কেমন হকচকিয়ে গেল, অপ্রস্তুত সামান্য, তারপর কয়েকবার ‘যাঃ যাঃ’ করল। সরসী এবং মানসী দুজনেই হাসতে লাগল।

ঘটনাটা চারজনেরই জানা, কৌতুক অনুভব করতে বাধা পেল না কেউ।

মুঙ্গেরে দিদির কাছে গিয়েছিল পুলিন-নলিন। সরসীকে নয়, সরসীর ছবি দেখেছিল মুঙ্গেরের মহিলা সমিতির ছবিতে, দিদি সেই সমিতির পাণ্ডা। ছবি দেখে পুলিনের মনটা কেমন এলোমেলো করছিল। নলিনকে বলল, এ-রকম একটা মেয়ে হলে বিয়ে করা যায়। নলিন মেয়ের খোঁজ করতে গিয়ে দেখল, সরসীরা দু-বোন, সরসী ছোট। নলিন সরসীর সঙ্গে আলাপ করে ফেলল—, জামাইবাবু সহায় হলেন। মনে ধরে গেল সরসীকে। কিন্তু পুলিন?

নলিন ভাইয়ের মনটা প্রথমে আঁচ করে নিল ভাল করে, গুরুতর কিছু কি না, দেখল সে-সব নয়। তারপর বলল, ‘দেখ, মুশকিলটা কি জানিস! ওরা দু-বোন, ওই মেয়েটা ছোট। বড়টা আরও ফাইন। ওদের বাবা আবার একই সঙ্গে দুটোর বিয়ে দিতে চায়। তা তুই যদি ছোটটাকে করিস, আমায় বড়টাকে করতে হয়। সেটা কি ভাল দেখাবে! লোকে বলবে কি, ছোট ভাই বড় বোনকে বিয়ে করল! তুই যদি বলিস, আমি তোর জন্যে সেক্রিফাইস করতে পারি, নয়ত তুই বড়টাকে কর, আমি ছোটটাকে। ভেবে দেখ…।’

পুলিন বড়র ছবি চাইল দেখতে। নলিন দেখাল। বড়র গুণগানের ব্যাখ্যা সে শুধু নিজেই করল না, জামাইবাবুকে দিয়েও করাল। পুলিনের অবশ্য অত দরকার ছিল না। মানসীকে এমনিতেই তার ভাল লেগেছিল। তা ছাড়া মেয়ে দুটি তাদের বাড়ির যে যোগ্য এ-কথা দিদি বার বার বলেছে।

পুলিন দিব্যি রাজি হয়ে গেল।

নলিন বিয়ের পরই মানসী সরসীর কাছে পুলিনের মেয়ে পছন্দের গল্পটা প্রকাশ করে দিল।

পুলিন ছোট ভাইয়ের ওপর চটে গিয়েছিল, একটা ইডিয়েট; বলেছিল ‘আমি কি মেয়ে পছন্দ করেছিলুম, এমনি ঠাট্টা করে বলেছি আর—তুই সেটা নিয়ে লেগে পড়লি। আসলে ইন্টারেস্ট তোর ছিল, আমার নয়।’

‘আমার তো সেন্ট পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট ছিল, নয়ত তোর জন্যে ওই সিক্সটি টু মডেলের জ্যান্ত কামানের সামনে কেউ দাঁড়ায়।’ সিক্সটি টু মডেল অর্থে বাষট্টি বছরের শ্বশুর।

দেখতে দেখতে রাত হয়ে এল। শীত যেন ঘরেও ঢুকেছে। তাসের পাট তুলে দিয়ে মানসী উঠল, হাই তুলল বড় করে। বলল, “বড্ড শীত, আর নয়, চলো। খেয়েদেয়ে যে যার শুয়ে পড়ি।”

সরসীও উঠে দাঁড়াল, তার বেশ ক্লান্তি লাগছে।

পুলিন আড়মোড়া ভেঙে বলল, “তোমরা বসো গে যাও, আমি একবার মার ঘর থেকে আসছি।”

চার

নির্দিষ্ট দিনে বেলা নটা নাগাদ করুণাকেতন এসে পৌঁছলেন। মেয়ে জামাইরা স্টেশনে আসতে গিয়েছিল। গাড়ির দরজা খুলে করুণাকেতন এবং তাঁর মালপত্র নামানো হল—দেখা গেল, তাঁর আকৃতির সঙ্গে তাঁর বয়ে-আনা হোন্ডঅলের আকৃতির বিশেষ কোনো তফাত নেই। লেপ, তোশক, কম্বল বালিশ যাবতীয় বিছানাপত্র ঠাসা বিপুলকায় ও খাটো মাপের হোল্ডঅলটা প্লাটফর্মে কোনো রকমে নামিয়ে কুলিরা হাঁ করে পদার্থটি অবলোকন করছিল, এবং জামাইরা দেখছিল দু-প্রস্থ জামা-জুতোর ওপর আপাদ-কণ্ঠাবৃত অলেস্টার শোভিত তাদের বেঁটে এবং গোলাকার শ্বশুরমশাইকে। গলায় মস্ত এক মাফলার তিন পাক জড়ানো, মাথায় কান-গুটানো বাঁদর-টুপি। সঙ্গে মালপত্র কিছু কম নয়, মস্ত এক সুটকেস, কপির ঝুড়ি, মিষ্টির হাঁড়ি, টিফিন কেরিয়ার, জলের কুঁজো, ছড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি।

করুণাকেতন যে বস্তুত তাঁর হোন্ডঅলের মতন নির্জীব নিরীহ নির্বাক পদার্থ নন, অবিলম্বে তা প্রকাশ পেল। মেয়ে-জামাইরা প্রণাম সারতেই তিনি দণ্ডায়মান কুলিদের দিকে তাকিয়ে তাঁর ভাঙা খসখসে গলায় চিৎকার করে ধমকে উঠলেন, “খাড়া হো কর কিয়া করতা হ্যায়, পাঁটঠা কাঁহাকার…”

তাঁর হুঙ্কার এবং মুখভঙ্গি দেখে পাঁঠারা ঘাবড়ে গিয়ে হোন্ডঅলটা টানা-হেঁচড়া করতে লাগল।

মানসী শুধল, “মা কেমন আছে?”

“যেমন থাকে,⋯” করুণাকেতন কুলিদের দেখছিলেন, “বেতো ঘোড়া।” বেতো ঘোড়া কে? মা না কুলিরা।

সরসী বলল, “বিজুর কলেজ খুলেছে?”

“দরজা খুলেছে।” মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে কুলি তাড়ানোতেই তাঁর মনোযোগ।

পুলিন বলল, “আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসছি—আপনারা এখোন।”

“আরে না না, এ তোমার বিলেত নয়; এখানকার কুলিরা লেজি, ফাঁকিবাজ, ডাকাত…। তুমি এদের সঙ্গে পারবে না।”

করুণাকেতনের বিলেত-প্রীতি না থাক, জামাইরা বিলেত-ফেরত এই অহংকার আছে। মেয়েদের বিয়েতে পাত্র অপেক্ষা পাত্রদের বিলেত-ফেরতের কথাটাই তাঁর মন টেনেছিল। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।

নলিন আড়চোখে শ্বশুরমশাইকে দেখে নিয়ে বলল, “বিলেতের কুলিরা সাহেব কুলি, এরা তো এদেশি, বেহারি-টেহারি…”

“ধড়িবাজ।” করুণাকেতন বললেন। কাকে বললেন, জামাইকে না কুলিদের বোঝা মুশকিল।

মেয়েরা তাদের বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে টেনে নিয়ে চলল, পুলিন-নলিন কুলিদের দিয়ে মালপত্র গোছাতে লাগল।

নলিন বলল, “তোকে আসবার সময় বললাম, চাকায় পাম্প দিয়ে নে; নিলি না এবার…?”

“ধরবে তো সব?”

“আমি গাড়িতে যাচ্ছি না। ⋯তোরা চলে যা, আমি হেঁটে চেম্বারে চলে যাব।”

“না না, সেটা বিশ্রী দেখাবে।”

“দেখাক গে, গাড়ির চাকা খুলে মাটিতে বসে রগড়ানোর চেয়ে সেটা ভাল।”

“চল চল—যাবার সময় চাকায় পাম্প দিয়ে নেব।”

“তোমরা যাও। আমি ওর মধ্যে থাকছি না।”

“শ্বশুর কি আমার একলার? তোমারও শ্বশুর। মাইণ্ড দ্যাট—”

নলিন যুক্তিটা অস্বীকার করতে পারল না, চুপ করে গেল। পরে প্লাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “বিয়েতে আমরা এ-রকম একটা ফাউ পাব জানলে বিয়েই করতাম না।”

করুণাকেতনের অভ্যর্থনায় কোনো ত্রুটি হল না। নীচের তলায় তাঁকে মস্ত ঘর দেওয়া হয়েছিল। খাট-বিছানার অভাব থাকার কথা নয়, ঘরের মধ্যেও সারাদিন রোদ, জানলার বাইরে বাগান, ঘরের সঙ্গে লাগানো কলঘর। করুণাকেতন প্রীত হলেন। প্রভাময়ী নিজেই বেয়াইয়ের সুখ-সুবিধা স্বাচ্ছন্দ্য দেখছিলেন, তাঁর কথা মতনই সব ব্যবস্থা হয়েছে। দোতলায় ওঠানামা করতে বুড়ো মানুষের কষ্ট হবে বিবেচনা করে নীচেই ব্যবস্থা করেছিলেন। মনে একটু শঙ্কা ও সঙ্কোচ ছিল, বেয়াইমশাই এই ব্যবস্থায় ক্ষুণ্ণ হন কি না। করুণাকেতন বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হলেন না, বললেন, তিনি একটু নিরিবিলি পছন্দ করেন।

করুণাকেতনের খাবার সময় মেয়েরা কাছে থাকলেও প্রভাময়ী নিজেই দেখাশোনা করলেন। কুটুম মানুষ, ব্যবস্থার কোনো রকম ত্রুটি, সুখ-সুবিধের স্বল্পতা প্রভাময়ী রাখেননি। দেখলেন, করুণাকেতন ভোজন বিষয়ে অসংযমী। খেতে ভালবাসেন। খাওয়ার গল্প করতে ভালবাসেন। এক সময় হাকিম ছিলেন, ঘুরেছেন নানা জায়গায়; কোথায় কোন খাদ্যটা পাওয়া যায়, তার স্বাদ কেমন, দাম কত এ-সবও নখদর্পণে।

“আমার হাই ব্লাডপ্রেশার⋯” করুণাকেতন নিজেই বললেন, “বেশ হাই। আমার ফ্রেণ্ড বলাই-ডাক্তার বলে খাওয়া কমাতে। আমি বলি ও-সব বুজরুকি, খাওয়া কমালে প্রেশার কমে না। তোমার তো বাপু এই দুটো আহার, তোমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে কেন? বলাই জবাব দিতে পারে না। বলে, বয়েস⋯। আরে, বয়েসে যা তা হবেই, মাথার চুল পাকবে, দাঁত পড়বে, ঘুম হবে না। বয়েসে যদি ব্লাডপ্রেশার বাড়ে, বাড়বে; তা বলে খাব না। ⋯মরব ভেবে খাওয়া বন্ধ রাখা আমার কুষ্ঠিতে লেখেনি।”

প্রভাময়ী প্রতিবাদ করলেন না, করা উচিত নয়, বললেন, “তা তো ঠিকই।”

দুপুরে করুণাকেতন বেশ একটা ঘুম দিলেন। ঘুম থেকে উঠেই বিপত্তিটা দেখলেন।

মুখ ধুয়ে অভ্যাস মতন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিরলকেশ মাথাটি আঁচড়াতে গিয়ে লক্ষ করলেন ডান চোখটা একটু লাল। চোখে জল দেবার সময় সামান্য জ্বালা জ্বালা করছিল, অতটা খেয়াল করেননি। ঘুমের জন্য চোখটা লাল হতে পারে। দু’চোখের জমি বিচার করে যদিও মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল, করুণাকেতন তখনকার মতন ডান চোখ লাল হওয়াটাকে ঘুমের দরুন হতে পারে ভেবে কাউকে কিছু বললেন না।

আধঘণ্টা খানেকের মধ্যে বার দশ-বারো চোখ দেখলেন। উহুঁ, লাল ভাবটা কাটছে না।

মানসী চা এনেছিল। চা খাবার সময় মেয়েকে বললেন, “আমার ডান চোখটা দেখ তো।”

মানসী চোখ দেখল, বলল, “একটু লাল হয়ে আছে।”

“কেন?”

কেনর জবাব কি দিতে পারে মানসী। বলল, “কি জানি! চোখে কিছু পড়েছিল হয়তো।”

কোথায় কি পড়েছে মানসীর জানার কথা নয়, তবু আমতা আমতা করে বলল, “ট্রেনে এসেছ, ধুলোবালি পড়েছে হয়তো। ⋯”

“জ্বালা করছে।” করুণাকেতন বললেন, এবং ডান চোখটা একটু ছোট করে তাকিয়ে থাকলেন।

সরসী এল। সরসী আসতেই করুণাকেতন ছোট মেয়েকে দিয়ে আর একবার চোখ দেখালেন। “লাল হয়েছে—” সরসী বলল।

“টকটকে লাল?”

“না—, অতটা টকটকে নয়, তবে লালই⋯”

“কেন?”

সরসী দিদির দিকে তাকাল। মানসী কোনো সঙ্গত জবাব ইশারায় বলে দিতে পারল না। অগত্যা সরসী বলল, “ঠাণ্ডা লেগেছে হয়তো, রাত্রের গাড়িতে এসেছ।”

“কেমন করে লাগল!” করুণাকেতন বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন, এবং ডান চোখ বন্ধ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। খুললেন আবার বন্ধ করলেন। এই রকম চলতে লাগল।

মানসী বলল, “তুমি ভেবো না, ওরা চেম্বারে চলে গেছে, ফিরে এসে দেখবে।”

করুণাকেতন অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “যাবার সময় এখান থেকে ঘুরে যাওয়া যেত না!” মেয়েরা মুখ নিচু করে থাকল।

সন্ধে থেকে করুণাকেতন রীতিমত অধীর হয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। ঘন ঘন আয়নায় চোখ দেখছেন, মেয়েদের দিয়ে দেখাচ্ছেন। প্রভাময়ী গোলাপজল আনিয়ে দিলেন। চোখে জল দিয়ে ঘরের সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করিয়ে সবরকম গরম জামা-কাপড় পরে করুণাকেতন বিছানায় শুয়ে থাকলেন। ঘরের বাতিটা পর্যন্ত বদলাতে হল।

মানসী স্বামীকে ফোন করল, “একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। বাবার ডান চোখটা লাল হয়েছে। বড্ড অধীর মানুষ তো, চেঁচামেচি করছেন।”

“চোখ লাল !⋯খুব⋯?”

“না, না। ডান চোখ। অল্প।”

“অত চোখ লাল করলে একটু ওই রকম হয়ই…” পুলিন ঠাট্টা করে বলল।

“তামাশা কোরো না, আমার বাবা; তোমারও শ্বশুর।”

“সে আর বলতে। ⋯ঠিক আছে, আমরা আধঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরব।”

বাড়ি ফিরে পুলিন-নলিন অবাক। করুণাকেতনের ঘরের আবহাওয়া যেন হাসপাতালের কেবিনের মতন করে ফেলা হয়েছে।

পুলিন চোখ দেখল শ্বশুরের। বলল, “ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি।”

“কী হয়েছে?” করুণাকেতন শুধোলেন।

“তেমন কিছু না⋯কাশিটাশি হয়েছে আপনার?”

“শীতকালে একটু আধটু কাশি হবে না?”

“না, না, জোর কাশি? দমক?”

“না।”

“ঠাণ্ডাফাণ্ডা লাগতে পারে। ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি।”

“জ্বালা করছে যে হে⋯, ব্যথা ব্যথা লাগছে।”

“মাইল্ড ইনফেকশান হতে পারে, ওষুধ দিচ্ছি সেরে যাবে।”

“কী ওষুধ?”

“বিলেতি।” পুলিন গম্ভীর হয়ে বলল।

পাঁচ

ব্যাপারটা অত সহজে মিটল না। পরের দিন সকালে করুণাকেতন নিজের চোখ দেখে মূর্ছা যান আর কি। ডান চোখের লালটা আরও ছড়িয়েছে। একেবারে রক্তের মতন টকটক করছে লাল। জামাই কি ওষুধ দিল? করুণাকেতন হাত-পা ছোঁড়া শুরু করলেন। ভয়ে বুক ধকধক করছে, মাথা ঘুরছে।

পুলিন আবার চোখ দেখল। বলল, “স্লাইট স্প্রেড করেছে। ওষুধটা দিন। বিকেলে দেখব আবার।”

মানসী আড়ালে স্বামীকে বলল, “বাবার খুব আতুপুতু আছে। একটু কিছু হলেই বাড়ি মাথায় তোলে। তাড়াতাড়ি সারিয়ে দাও বাপু। বদখেয়ালের মানুষ, মুখেরও কিছু ঠিক নেই, কখন কি বলে ফেলবে, আমি লজ্জায় পড়ব।”

পুলিন হেসে বলল, “সিরিয়াস কিছু না। কত কারণেই চোখ লাল হয়। তোমাদের মুখ যেমন লাল হয়।”

মানসী মুখভঙ্গি করে স্বামীকে ঠেলে দিল।

করুণাকেতন বিকেল থেকে আর আত্মসংবরণ করতে পারলেন না। থেকে থেকেই করুণকণ্ঠে নিজের দৃষ্টিহীনতার সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করতে লাগলেন, মাথা চাপড়ানোও শুরু হল, ডান চোখের ওপর একটা মস্ত রুমাল চাপা দিয়ে স্বাগত-ভাষণে জানাতে লাগলেন যে, তিনি ইহজীবনের মতন একটি চক্ষু হারালেন।

মেয়েরা এবং প্রভাময়ী যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়েও করুণাকেতনকে সংযত রাখতে পারছিল না।

পুলিনরা বাড়ি ফিরলে মানসী সরসী বলল, “বুড়ো মানুষকে এত কষ্ট দেওয়া কেন? কি রকম যে আনচান করছেন। যা হয় করো একটা কিছু।”

প্রভা বললেন, “ওঁর কষ্ট হচ্ছে। গাল মুখও ব্যথা ব্যথা বলছেন।”

পুলিন বলল, “চোখ উঠলেও দু-চার দিন কষ্ট হয়, তার কি করা যাবে! এমন কিছু হয়নি যার জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছ। ⋯আজ একটা অয়েন্টমেন্ট এনেছি, রাত্রে লাগান, কাল দেখব ভাল করে।”

পরের দিন পুলিন নানারকম যন্ত্রপাতি এনে ভাল করে দেখল শ্বশুরকে। দেখতে কি দেন করুণাকেতন, সোজা তাকাতে বললে বাঁকা তাকান, চোখের পাতা ছুঁতে গেলে ধমকে দু-পা সরিয়ে দেন। ইতিমধ্যে একটা গগলস তাঁর চোখে উঠেছে। চোখের সঙ্গে গালগলারও যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল, মাড়ি ফুলেছে দাঁতের।

পুলিন কোনো হদিশ করতে পারল না, তার যাবতীয় জ্ঞান বলছিল চোখের কোথাও কিছু হয়নি। অথচ…অথচ…।

পুলিন নলিনকে বলল, “তুই একবার দাঁতটা দেখ⋯”

নলিন দাঁত দেখল এবং গোটা কয়েক ওষুধপত্র এনে দিল। “কুলকুচো করুন, এই পেন্টটা দিনে চারবার, ট্যাবলেটটা খাবার পর দুটো করে⋯।”

কিছুতেই কিছু না। যদিবা একটু কমেও থাকে করুণাকেতনকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তাঁর মেজাজ এবার চড়ায় উঠে গেছে। কোনো কিছু পরোয়া করছেন না, মেয়ে জামাই বলে কোনো সঙ্কোচ নেই। প্রভাময়ীর ওপরই যেটুকু প্রসন্ন আছেন এখন পর্যন্ত।

মানসী মাথা ধুইয়ে দিচ্ছিল, সরসী সুজির পায়েস, ওভালটিন এনে গুছিয়ে রাখছিল বিছানার কাছে টেবিলে।

করুণাকেতন বললেন, “আমি কিছু খাব না। ⋯বিজুকে তার করে দাও, সে এসে আমায় নিয়ে যাক। আমি এখানে থাকব না।”

মেয়েদের মুখ লাল হয়ে উঠল। তারপর যেন কালসিটে ধরে গেল।

মানসী বলল, “তুমি এত অধীর হয়ে পড়ছ কেন? এরা তো দেখছে।”

“কারা?”

“তোমার জামাইরা⋯” মানসী রাগ করে বলল।

“ওরা জামাই না কসাই?”

সরসীর চোখে জল এল ; বলল, “ডাক্তার তো⋯বিলেতফেরত…”

“বাজে কথা। ওরা বিলেতে গিয়ে আড্ডা মেরেছে। জাল ডিপ্লোমা টাকা দিয়ে বাগিয়ে এনেছে। চিট…। ⋯ঘোড়ার ডাক্তার ওরা, বুঝলে⋯! বাঁদর—!”

সরসী আর কথা বলল না, ঘর ছেড়ে চলে গেল।

মানসীও চলে যেত, তবু গেল না, সে বড়। বলল, “বিজুকে তার করতে হবে না। মা কি ভাববেন! আমি দেখছি—”

“তুমি আমার কোনটা দেখবে! বিয়ে করে পর হয়ে গেছ। বাপ মরছে মরুক, তোমরা তোমাদের বরের আত্মসম্মান দেখছ।”

মানসীর গলা ক্ষোভে বন্ধ হয়ে গেল।

দুপুরে পুলিন নলিন বাড়ি ফিরতেই দুই বোন ঝাঁপিয়ে পড়ল। করছ কী তোমরা? কিছু না করে চারটে দিন বুড়ো মানুষটাকে অযথা যন্ত্রণা দিচ্ছ! মনে রেখো, আমাদের বাবা। তোমরা কেমন ওর জামাই? কী শিখে এসেছ বিলেতে? রোগ যদি সামান্যই হয়—তবে সারছে না কেন? ঘুম নেই, খাওয়া নেই, বুড়ো মানুষ চার দিনে কতটা কাহিল হয়েছে দেখতে পাচ্ছ না! ডাক্তার না হাতি!

পুলিন বলল, “ঠিক আছে, আজ বিকেলে আমাদের শঙ্করমামাকে ডাকি, একবার দেখে যান। ⋯ওঁর ওপিনিয়ান নেওয়া হোক।”

শঙ্করবাবু প্রবীণ লোক, এ শহরের সেরা ডাক্তার। এলেন, দেখলেন যত্ন করে। বললেন, তেমন কোনো গণ্ডগোল তো দেখতে পাচ্ছি না। প্রেশারটা বেশ হাই। ব্লাড টেস্ট করতে পারি, তবে দরকার কি! চোখ দাঁতের ব্যাপারে তোমরাই তো আছ, আমি আর কি করব। প্রেশারের জন্যে একটা ট্যাবলেট দাও।

রাত্রে পুলিন নলিনকে বলল “কমপ্লেনটা দাঁতের হতে পারে, চোখে সেপটিক ফোকাস পড়েছে। তুই দাঁতের ট্রিটমেন্ট কর।”

নলিন বলল, “দাঁতে যা করার আমি করছি, তুমি চোখ সামলাও, হেমারেজ চোখে হয়েছে, দাঁতে নয়।”

“আহা, কিন্তু সেটা তো দাঁতের জন্যে হতে পারে—”

“পারে তো অনেক কিছুই—”

“তুই একটা আস্ত ইডিয়েট। কিচ্ছু জানিস না, কোনো কিছু শিখিসনি, পড়িসনি।”

“তুমি আমার সাবজেক্টে কথা বলতে এসো না; আই নো বেটার দেন ইউ। তুমি চোখ সামলাও, আমি দাঁত সামলাব। দাঁতে মস্ত একটা কিচ্ছু হয়নি।”

“ননসেন্স—। রেসপনসিবিলিটি বলে কিছু নেই তোর।”

“বোগাস—। তোর এবিলিটি তো দেখতেই পাচ্ছি।”

শোবার ঘরে মানসী বলল, “করছ কি তোমরা⋯, বাবার স্বভাব তো জানো না। এখন ঘরে বসে গালাগাল দিচ্ছে, এরপর সকলের সামনে যাচ্ছেতাই করবে। মার কানে যদি যায়, কেলেংকারি।”

পুলিন চিন্তিত মুখ করে বলল, “ব্যাপার কি জানো। চোখের ব্যাপারে একটা মাইনর কিছু করতে পারি। কিন্তু ওই রকম হাই ব্লাডপ্রেশার, সাহস হয় না। বুড়ো মানুষ, তায় শ্বশুর, তার ওপর রিস্ক। যদি কিছু একটা হয়⋯আপদ বিপদ⋯।”

মানসী আঁতকে উঠল। সর্বনাশ! হিত করতে বিপরীত কিছু একটা হয়ে যাক, তারপর লোকে বলবে বড় জামাই শ্বশুরকে মারল। মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। ছিছি করবে সকলে। তা ছাড়া বরাবরের মতন একটা দাগ থেকে যাবে, বদনাম অপযশ, খুঁত। স্বামীর ডাক্তারিতেও নিন্দে রটবে। যে ডাক্তার নিজের শ্বশুর মারে তার কাছে কোন রোগী আসবে গো!”

মানসী পুলিনকে আঁকড়ে ধরল, বলল, “সর্বনাশ! না—না, ওসব তোমার করতে হবে না। খুনের দায়ে পড়বে নাকি!⋯দরকার নেই আগ বাড়িয়ে বিপদ ডেকে। ⋯যা করার অন্যে করুক।”

“নলিন দাঁতটা তুলে দিলেই আমার মনে হচ্ছে সব সেরে যাবে—”

“তবে কি! ঠাকুরপোই যা করার করুক, তোমার দালালি করতে হবে না। ওই নমো-নমো করে থাকো, লোশান-টোশান পর্যন্ত দাও তার বেশি নয়।”

সরসী নলিনের মধ্যেও কথাটা খোলাখুলি হয়ে গেল।

নলিন বলল, “একটা দাঁত তো ডেনজারাস হয়ে রয়েছে। তুলে দিতে পারি, তুলতে অসুবিধে নেই। কিন্তু যেরকম হাই ব্লাডপ্রেশার। তুলতে গিয়ে কোনো রকম বেকায়দা কিছু হয়ে যাক, ক্লট ফ্লট হয়ে যাক একটা, তারপর দম করে তোমার বাবা স্বর্গলাভ করুন। বাপস, ওই রকম রুগির চিকিৎসা!”

সরসী শিহরিত হল! বলে কি? এত কাণ্ড ভেতরে। না বাবা, দাঁত তুলে দরকার নেই। বলা কি যায় বিপদের কথা! এক করতে আরেক হবে। তখন লোকে বলবে, ছোট জামাই শ্বশুরকে মারল। বরাবরের বদনাম, মা ভাইয়ের কাছে মুখ দেখানো যাবে কোনোকালে। কেন বাবা, দরকার কিসের আমার পা বাড়িয়ে গর্তে পড়ে। এসব জিনিস থেকে সরে থাকা ভাল। সংসার বড় মুখ বাঁকা, একবার বেঁকলে সারাজীবন তার মুখ সোজা হয় না।

সরসী স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরল, বলল, “আমার মাথার দিব্যি, তুমি ওকাজ করতে যেও না। মানুষ মারার দায়ে পড়বে, তাও আবার শ্বশুর। বদনাম, নিন্দে। মাগো, ভাবতেও পারি না। রুগিও জুটবে না আর কপালে। কাজ কি তোমার ফাঁসির দড়িতে হাত দিয়ে। আপনারটা সামলে থাকো…”

নলিন বলল, “আমি কি অত বোকা! পুলিন যা করার করুক, চোখ নিয়েই তো গণ্ডগোল শুরু! দাঁতের কথা কার বা খেয়াল হবে।”

সরসী বলল, “সেই ভাল। দাদা যা পাপ করবে…। তুমি গা-আলগা দিয়ে থাকো।”

অতঃপর কয়েকটা দিন মানসী পুলিনকে ও সরসী নলিনকে আগলে আগলে রাখল। কারোরই ইচ্ছে নয়, তার স্বামী এমন একটা মারাত্মক কাজে হাত দেয়। ওদের ভয় ছিল বাবা যেরকম বেপরোয়া হয়ে হইচই, চেঁচামেচি, গালমন্দ শুরু করেছেন তাতে স্বামীরা না অসহ্য হয়ে সত্যি সত্যি একটা কিছু করতে বসে। মানসী পুলিনকে আড়ালে বার বার বলত, ‘খবরদার’; সরসী নলিনকে বলত; ‘মাথা গরম করে দাঁত তুলতে যেও না।’…

দুই বোন কেউ কাউকে বুঝতে দিত না, আড়ালে তারা স্বামীদের কেমন করে সামলাচ্ছে। বরং বিরক্তিই দেখাত সামনা-সামনি। কী যে সব ডাক্তার ছাই বুঝি না। হপ্তা কেটে গেল, কোনো কিছু করতে পারলেন না। ⋯এর চেয়ে বাবার মুঙ্গেরে ফিরে যাওয়াই ভাল ছিল। বিজুকে সত্যিই একটা টেলিগ্রাম করে দি, কি বলিস!

প্রভাময়ী ছেলেদের ওপর ভরসা রাখেননি। পাড়ার প্রবীণা যারা আসত তাদের কাছে বলতেন সব। তারা নানারকম টোটকার খবর দিত। অমুকের পাতার রস, তমুকের মাজন, অমুক ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়ানো হলুদ ভেজানো কাপড়, তমুক ফল বেটে পুড়িয়ে গরম জলে মিশিয়ে কুলকুচো⋯ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রভাময়ী সেই টোটকা যা যা সংগ্রহ করতে পারছিলেন করুণাকেতনকে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করাচ্ছিলেন। করুণাকেতনও করছিলেন।

বিজুকে টেলিগ্রাম করা হল মুঙ্গেরে। করুণাকেতনের চোখে সর্বদা গগলস। সারাটা দিন ছটফট করতে করতে আর চেঁচামেচি করে করে শরীর কাহিল হয়েছে, গলা বসে গেছে। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ থাকায় আলো বাতাস আসতে পায় না; বাতাসে বন্ধ গন্ধ ধরে গেছে।

ছয়

অবশেষে একদিন কেমন করে কী যেন হয়ে গেল। করুণাকেতন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চোখে গগলস এঁটে কলঘরে মুখ ধুতে গেলেন। মুখে জল দিতে গিয়ে দেখলেন মুখে স্বাদ লাগছে, কুলকুচো করতে কোনো কষ্ট হল না, মাড়ি বা দাঁতের গোড়ায় ব্যথাও নেই, গাল গলা টিপলেন নিজে নিজেই—ব্যথা লাগল না। এতদিন ভয়ে গগলস জোড়া খুলতেনই না, মুখে চোখে জল দিতে হলে ডান চোখটা বন্ধ করে রাখতেন। সাহস করে আজ গগলস খুলে ভয়ে ভয়ে ডান চোখের পাতা খুলে আয়নায় চোখ দেখলেন। বিশ্বাস হল না, আবার দেখলেন ভাল করে, সর্বাঙ্গে বুঝি আনন্দের তড়িৎ খেলে গেল।

ঘরে এসে মেয়েদের ডাকাডাকি শুরু হল। মানসী ছুটে এল, সরসী এল। প্রভাময়ীও এলেন সামান্য পরে। ঘরের দরজা জানলা করুণাকেতন নিজের হাতেই মহানন্দে খুলে দিচ্ছিলেন। বিকট শব্দ হচ্ছিল। এ ক’দিন ঘরে আলো বাতাস ঢোকেনি। সকালের আলো রোদ ও বাতাসে বাসি ঘর যেন ধোয়ামোছা হতে লাগল।

করুণাকেতন মানসীকে বললেন, “দেখ…চোখটা দেখ একবার…”

মানসী দেখল। চোখের কোথাও লালের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বলল, “লাল নেই কোথাও, পরিষ্কার একেবারে সাদা।”

সরসীকে দিয়েও চোখটা দেখালেন একবার। সরসী দেখল। বলল, “কিছু নেই কোথাও। সেরে গেছে।”

করুণাকেতন এবার দাঁত দেখলেন। না তাঁর সেই মাড়ির গোড়া আর ফুলে নেই, সাদাটে দাগ ধরে নেই ব্যথার জায়গাটাতে।

করুণাকেতন ঘরের মধ্যে নাচতে লাগলেন যেন। প্রভাময়ী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসলেন।

পুলিন নলিন এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে আসেনি, চেম্বারে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। তারাও এল।

করুণাকেতন পুলিনের দিকে তাকিয়ে অতিশয় গম্ভীর হয়ে গেলেন, এবং নলিনকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বারণ করলেন।

প্রভাময়ী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিয়ে করুণাকেতন কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বললেন, “ছেলেদের বলুন, ডিসপেনসারি তুলে দিয়ে আপনার কাছে টোটকা শিখুক। ⋯ওয়ার্থলেস⋯ওই দুটোই সমান। কিচ্ছু জানে না⋯। হাতুড়ে⋯।”

পুলিন নলিন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। মানসী সরসীকে দেখল একবার আড়চোখে। বউরা কেউই লজ্জিত নয়, মুখে চোখে রাগের ভাবও দেখা যাচ্ছে না।

পুলিন কোনোরকমে বলল, “আপনি টোটকা করছিলেন?”

করুণাকেতন প্রায় ভেঙিয়ে উঠে জবাব দিলেন, “না করব না, তোমাদের জন্যে, বসে থাকব, কবে আমায় অন্ধ কর,—না?”

নলিন বলল, “আমাদের বলা উচিত ছিল…”

মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে করুণাকেতন জবাবে বললেন, “কেন? আপনারা কে? আপনাদের কেরামতি কত তা আমার জানা আছে…যত সব পেন্টুল ডাক্তার।”

পুলিন নলিন মুখ লাল করে বেরিয়ে গেল।

একটা দিন অপেক্ষা করে করুণাকেতন গয়ার গাড়িতে উঠলেন। যথারীতি সাজ-পোশাক ও মালপত্র সমেত। মেয়ে জামাইরা স্টেশনে তুলে দিতে এসেছিল।

গাড়ি ছাড়ার আগে করুণাকেতন জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জামাইদের বললেন, “কিছু মনে কোরো না; বুড়ো মানুষ, দু-চারটে কটু কথা বলেছি। —দেখো হে, আমি দেখলাম তোমাদের একটু টোটকাও শিখে রাখা দরকার। দেশি জিনিসটা ফেলনা নয়। বিলেতিটা বাইরে দেখাবে, দেশিটা আণ্ডারহ্যাণ্ড।”

দুই জামাই একই সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে—”

তারপর করুণাকেতন মানসীকে বললেন, “তোদের শাশুড়িকে বলবি নাতিকে যেন কানের ডাক্তার করে। ওটাই যা বাকি।”

মানসী ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে সরসীর দিকে তাকাল।

গাড়ি ছেড়ে দিল, এবং দেখতে দেখতে করুণাকেতনের মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল।

পুলিন নলিন হাঁপ ছাড়ল। নলিন বলল, “বাপ্‌স⋯”, পুলিন বলল, “উন্মাদ একেবারে!”

মানসী হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তোমাদের ক্ষমতায় কুলোলো না, এখন তো আমাদের বাবাকে উন্মাদ বলবেই—”

সরসী বলল, “লজ্জা করা উচিত।”

পুলিন প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, “সারাবার কী ছিল, এ সিমপ্ল কেস অফ কন্‌জাংটিভাইটিস⋯। নিজের থেকেই সেরে যেত…। বরং দাঁতটা⋯”

নলিন বাধা দিল, বলল, “দাঁতে তেমন কিছু হয়নি, ইন ফ্যাক্ট গামবয়েল হয়ে কোথাও সেপটিক অ্যাবজরপ্‌শান হচ্ছিল। একটু চিরে দিলেই চলত—এমনিতেও কুলকুচো করলে পেন্ট লাগালেও অনেক সময় সেরে যায়।”

মানসী সরসী হাঁটতে লাগল। পুলিন নলিনও।

মানসী বলল, “এখন তো দুজনেই গলা বড় করে বলছ, কিছুই না, এটা সিমপ্ল সেটা সিমপ্ল, তখন এত বিদ্যে কোথায় ছিল?”

পুলিন নলিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসল। তারপর মানসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার দোষ কি, তুমিই তো বাগড়া দিচ্ছিলে। ভাবছিলে তোমার বুড়ো বাবাকে মেরে আমি কেন দোষের ভাগী হই। মরে মরুক নলিনের হাতে…”

নলিন বলল, “সরসীও যা শত্রু পরে পরের তালে ছিল—”

দুই বোন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেমন সব মানুষ দেখছ? দুম্‌ করে সব বলে দিল। লজ্জায় মরে আর কি দু-বোনে!

ছি ছি। মাথা কাটা যাচ্ছে যেন। চটে গিয়ে মানসী বলল, “বা, এখন আমরা⋯। তুমি যে তখন বললে, ভয়ের ব্যাপার আছে…”

সরসীও নলিনকে আক্রমণ করল, “তুমি না বলেছিলে, এটা আছে ওটা আছে…দাঁত তুলতে গেলে অঘটন ঘটতে পারে…”

নলিন পুলিনের দিকে তাকাল, পুলিন চোখ টিপল। দুজনে চোরা হাসি হাসল। তারপর নলিন বলল, “ও আমরা বলেই থাকি। মানে, ইচ্ছে করেই বলেছি।”

“কেন, কেন?” দুই বোন দুই স্বামীর হাত ধরে টান মারল।

পুলিন নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “না, মানে—এ রকম কিছু না বললে তোমার বাবা আর তোমাদের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যেত না। বাব্বা, যা দৌরাত্ম্য!”

মানসী পুলিনের গায়ে জোর একটা ঠেলা মারল। “অসভ্য কোথাকার।”

নলিন বলল, “তোমাদের বাবা হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে যে ওই বাবাটিই বাঘ।”

সরসী নলিনের পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল।

পুলিন ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠতে উঠতে শিস দিচ্ছিল, নলিন হাসছিল।

দুই বোনে পাশাপাশি ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠছিল। মানসী বলল, “দেখ, বাবা তো সব সময় চোখে গগলস দিয়ে থাকত, না হয় ডান চোখটা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখত। আমার মনে হয়, অনেক আগেই চোখ সেরে গিয়েছিল, দেখতে তো দেয়নি আমাদের, নিজেও দেখত না ভয়ে।”

সরসী মাথা নাড়ল; হয়তো তাই। বলল, “দাঁতের ব্যথাও ছিল না বুঝলি। আতঙ্কে ওই রকম করত। গালে ব্যথা হলে অত চেঁচামেচি কি মানুষ করতে পারে। শক্ত টোস্টই বা খেত কি করে।”

মানসী মাথা নাড়ল। ঠিক। তারপর দুবোনেই সিঁড়ি উঠতে উঠতে খিলখিল করে হেসে উঠল।

চুম্বক চিকিৎসা

মুদির দোকানে যেভাবে ফর্দ মেলায় সুবোধ ডাক্তার সেইভাবে হাতের কাগজগুলো মিলিয়ে নিয়ে গুরুপদ সান্যালকে বললেন, “বাঁচতে চাও, না, মরতে চাও?”

গুরুপদ ভিতু মানুষ। ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “কেন? কী হয়েছে?”

সুবোধ ডাক্তার বললেন, “মানুষের পাঁচটা ইন্দ্রিয়। তোমার পাঁচটাই বরবাদ হতে চলেছে। হবে না? টাকা ছাড়া কিছু চিনলে না। হরিনামের মালার মতন শুধু টাকা টাকা জপ করে গেলে। এবার বোঝো!”

এমনিতেই গুরুপদর ঘাম-ধাত; গলগলিয়ে ঘামেন সারাক্ষণ, তারপর ফাল্গুন মাস পড়তে না পড়তেই গরম শুরু করেছে এবার। গুরুপদ ঘামতে লাগলেন। গলা শুকিয়ে গেল। বললেন, “কী হয়েছে সেটা বলবে তো?”

সুবোধ বললেন, “কী হয়নি। ব্লাড প্রেশার হাই, ব্লাড সুগার অ্যাবনরমালি বেশি, যে কোনোদিন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে পারো। ব্লাড কোলেস্টরাল যাচ্ছেতাই, তার ওপর হার্ট, ওদিকে তোমার পুরনো পাইলস। কোনটা দেখব। যেদিকে দেখছি চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে। এত্ত সব বাধিয়ে বসেছ যে তোমার কোন চিকিৎসা আমি করব বুঝতে পারছি না।”

গুরুপদর মাথা ঘুরতে লাগল। চোখের সামনে মশার মতন পোকা উড়তে লাগল নেচে নেচে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনো রকমে বললেন, “আমি আর বাঁচব না?”

“বাঁচার পথ কি খোলা রেখেছ যে বাঁচবে!”

গুরুপদ শুকনো গলায় বললেন, “তুমি ভাই আমাকে আর ভয় দেখিয়ো না। এমনিতেই আমি মরছি। বন্ধু লোক তুমি, ডাক্তার মানুষ। তুমি কিছু করো।”

সুবোধ বললেন, “আমি যন্ত্র। যন্ত্রী তো তিনি—” বলে ডাক্তার ছাদের দিকে আঙুল দেখালেন। “ওপরঅলাই হিসেবের খাতা ঠিক করে রেখেছেন। তাঁর হিসেবে যা আছে তাই হবে।—যাক গে, কাগজগুলো রেখে যাও। কাল পরশু একটি বার এসো। দেখি কী করা যায়। একটু ভেবে নিই।”

গুরুপদর তর সইছিল না। বললেন, “দেরি করে কী লাভ?”

সুবোধ ধমক মেরে বললেন, “বাহান্নটা বছর দেরি করলে আর এখন দু রাত্তির তোমার কাছে বেশি হল। যাও, মিথ্যে বকিয়ো না। বাড়ি যাও। লেট মি থিংক। পরশু সন্ধেবেলায় চলে এসো।”

“তুমিও তো বাড়িতে আসতে পারো! গিন্নি বড় চিন্তায় থাকবে। তুমি গিয়ে বুঝিয়ে বললে ভাল হয়—!”

সুবোধ ডাক্তার রাজি হয়ে গেলেন। পরশু মানে রবিবার।

রবিবার সন্ধেবেলায় সুবোধ ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ থাকে।

গুরুপদ উঠতে যাচ্ছিলেন, সুবোধ হঠাৎ বললেন, “তোমার গিন্নির চেক আপটাও করিয়ে নিলে পারতে, গুরুপদ! এক যাত্রায় পৃথক ফল হয়ে লাভ কিসের?”

“কথাটা মন্দ বলোনি হে! গিন্নিরও শরীর ভাল যায় না। তা তুমি যখন বাড়িতে যাবে, বুঝিয়ে বোলো একবার। আজ আসি ভাই।”

“এসো।”

চেম্বারের বাইরে এসে গুরুপদ দেখলেন, তাঁর গাড়ি রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি একটা সিনেমা হাউস, পাড়াটাও বাজারপাড়া। ফলে রিকশা, অটো, মিনিবাস, বাসে রাস্তার যা অবস্থা তাতে এপার থেকে ওপারে যেতে হলে গাড়ি চাপা পড়ার ষোলো আনা আশঙ্কা।

এই ভরসন্ধেতে গাড়িচাপা পড়ে মরতে রাজি নন তিনি। হাত নেড়ে চেঁচিয়ে ড্রাইভারকে ডাকতে গিয়ে দেখলেন, ভিড়ভাড়াক্কা হইহল্লার মধ্যে তাঁর গলা দশ পনেরো হাত দূরেও পৌঁছচ্ছে না। গাড়িও বার বার আড়াল পড়ে যাচ্ছে।

গুরুপদ রাস্তার একটি ছেলেকে বললেন, “বাবা, ওই যে নীল গাড়িটা, ওর ড্রাইভারকে একটু বলবে, গাড়ি ঘুরিয়ে এদিকে আনতে।”

ছোকরা গুরুপদকে দেখল। তারপর বলল, “দাদু, এই রাস্তায় এখন গাড়ি ঘুরবে না। জাম্প লেগে যাবে। দশটা টাকা ছাড়ন—দুজনকে ডেকে আনি, আপনাকে ঠেলে দেব। ভিড়ে যাবেন।”

গুরুপদ একেবারে থ। কী ছেলে রে বাবা! বলতে যাচ্ছিলেন, “বাঁদর, জন্তু কোথাকার!” বললেন না। একে বেপাড়া, তায় লক্কা ছোঁড়া। মনে মনে বললেন, “শালা!”

ছোকরা একগাল হেসে চোখ টিপে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, “বুড়ো দোতলা বাস মাইরি।”

গুরুপদ কথাটা কানে শুনলেন। কিছুই বলতে পারলেন না।

বাড়ি এসে গুরুপদ নিজের শোবার ঘরে ঢুকে পাখা খুলে দিলেন। আলো জ্বলছিল ঘরে। পা পা করে দোতলায় উঠেও হাঁফ লাগছিল তাঁর।

এমন সময় শশিতারার উদয় হল। ঘরে ঢুকে স্বামীকে বললেন, “গিয়েছিলে?”

গুরুপদ কোনো জবাব দিলেন না। এমন মুখ করে বসে থাকলেন যেন জগৎ সংসার অসার হয়ে গিয়েছে তাঁর কাছে।

“হল কী তোমার?”

গুরুপদ বললেন, “শশি, আমি আর বাঁচব না।” বলে বিরাট করে নিঃশ্বাস ফেললেন।

“কী? বাঁচবে না?”

“ডাক্তার বলল, সামনে শমন—”

“শমন?”

“ওই মরণ আর কি!”

“কার, তোমার না তার।” শশিতারার গলা রুক্ষ হয়ে উঠল।

গুরুপদ বললেন, “আমার! ডাক্তার বলল, আমার সব খারাপ হয়ে গিয়েছে। পাঁচটা—কি বলে পাঁচটা ইন্দ্রিয়।”

শশিতারা মাথায় কাপড় দেন না। সে বয়েস আর নেই। দেহের যা বহর তাতে এগারো হাত শাড়িও টেনেটুনে পরতে হয়, মাথায় কাপড় তোলার উপায় থাকে না, দরকারই বা কিসের।

শশিতারা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, “চুলোয় যাক ইন্দ্রিয়। কবেই বা ভাল ছিল! …বাজে কথা থাক—। আসল কথা বলো। তোমার ডাক্তার কী বলল?”

“বললাম তো! আমার সব খারাপ হয়ে গিয়েছে। বরবাদ হয়ে গেছে। শরীরে কিছু নেই।” বলতে বলতে ইশারা করে জল চাইলেন গুরুপদ।

শশিতারার ঘরেই জল ছিল। ঠাণ্ডা জল। জল গড়িয়ে এনে স্বামীকে দিলেন।

জল খেয়ে বড় করে নিশ্বাস ফেললেন গুরুপদ। তারপর বললেন, “সুবোধ পরশু বাড়িতে আসবে।”

শশিতারা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আসবে আসুক। আমি জানতে চাইছি—অত যে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন হল—তো সেসব দেখে তোমার বন্ধু বললটা কী? কিসের ব্যারাম?”

গুরুপদ একটু থিতিয়ে গিয়েছিলেন। গায়ের জামাটা খুলতে খুলতে এবার বললেন, “বলল, প্রেশার সুগার হার্ট—সবই খাবি খাচ্ছে। যে কোনো সময়ে ফট হয়ে যেতে পারি!”

শশিতারার ঠোঁট মোটা। মানুষটিও গায়ে গতরে স্বামীর সমান। একশো কেজির ধারে কাছে। গায়ের রঙের অমিল না থাকলে, এবং খানিকটা মুখের ছাঁদের—স্বামীস্ত্রীকে যমজ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত।

শশিতারা ঠোঁট উলটে বললেন, “ফট—! তোমার সুবোধ ডাক্তার ফট বললেই ফট? সে ভগবান নাকি! যা মুখে এল বললাম আর তুমিও তার বাক্যি বলে মেনে নিলে! ও আবার ডাক্তার নাকি? কম্পাউন্ডার!

“কম্পাউণ্ডার?”

“তা নয়তো কি! আমি ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি। সাত বার ফেল করে পাস করেছে।”

গুরুপদ একটু যেন খুশি হলেন। সুবোধ তাঁকে বড় দমিয়ে দিয়েছে। শশিতারার কাছ থেকে যেন সাহস পাওয়া গেল সামান্য। কিন্তু বন্ধুকে যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন শশিতারা, তাতে আঁতে লাগল গুরুপদর। সাত সাতবার ফেল করা ছেলে সুবোধ নয়। গুরুপদ জানেন। পুরনো বন্ধুত্ব।

গুরুপদ বললেন, “সুবোধ একটা সোনার মেডেল পেয়েছিল!”

শশিতারা নাক বেঁকিয়ে জবাব দিলেন, “এ-ক-টা!—আমার বাবার একমুঠো মেডেল ছিল। সোনা রুপো—!”

“তুমি সুবোধকে ফেলনা ভেবো না, শশি! এত বছর প্র্যাকটিস করছে। জমজমা প্র্যাকটিস। কী ভিড়ও রোগীর! পয়সাও মন্দ করেনি।”

“পাড়ার মদন মুদিও পয়সা করে কদমঘাটায় বাড়ি করেছে। তাতে হয়েছেটা কী!” শশিতারা বললেন, “যাক—তোমার সুবোধকে নিয়ে তুমি থাকো। আমি তার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। তোমার অসুখটা কী আমার জানা দরকার। হেঁয়ালি ধোঁয়ালি শুনে লাভ নেই আমার।”

গুরুপদ বললেন, “পরশু ও আসবে। জিজ্ঞেস কোরো।” বলেই তাঁর অন্য কথা মনে পড়ে গেল। আবার বললেন, “সুবোধ বলছিল, তোমারও একবার চেক আপ করানো দরকার।”

শশিতারা হাত উঠিয়ে ঝাপটা মারার ভঙ্গি করলেন, “থাক, আমার আপ-টাপে দরকার নেই। বেশ আছি। তুমি নিজেরটা দেখো। নাও, ওঠো, গা ধুয়ে এসো, ফল শরবত খাও।”

শশিতারা আর দাঁড়ালেন না।

গা-হাত ধুয়ে গুরুপদ ঘরে বসলেন। পরনে সাদা লুঙি, গায়ে বগলকাটা পাতলা ফতুয়া। পায়ে মোটা হাওয়াই চটি।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিলেন। অল্প চুল। হু হু করে পেকে যাচ্ছে।

নিজের মুখের চেহারাটাও আয়নায় দেখলেন গুরুপদ। শশিতারা যাই বলুক, গুরুপদ নিজেই বুঝতে পারছেন, তাঁর শরীরের অবস্থা ভাল নয়। মুখটা কেমন থমথমে হয়ে রয়েছে। চোখ অল্প লালচে। নেশা ধরলে যেমন দেখায়। প্রেশারের জন্যে নাকি! কিসের যে দুর্বলতা ক্লান্তি—কে জানে! বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। ওজন কমারও কোনো লক্ষণ নেই। রোজ সকালে বাড়ির ছাদে পাক মারছেন, ফুলের টবে জল ঢালছেন—তবু ওজনের কমতি হচ্ছে না। ভুঁড়িরও হ্রাসবৃদ্ধি নেই। সেই একই রকম।

মনের দুশ্চিন্তাই বড় শত্রু। গুরুপদর সময়টা ভাল যাচ্ছে না। বছরখানেক ধরে নানা গণ্ডগোলের মধ্যে রয়েছেন। কারখানায় একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। আজ ষোলো দফা দাবি, কাল হুমকি, পরশু ঘেরাও। পাগলা হয়ে যাবার জোগাড়। আরে বাবা, তোরা তো বোকা কালিদাসকেও হার মানালি। কালিদাস নিজে যে ডালে বসেছিল সেই ডাল কাটছিল। তোরা এমন মুখ্যু—ডালপালা তো তুচ্ছ, গোটা গাছটাই উপড়ে ফেলার জন্যে লেগে পড়েছিলি। তাতে গুরুপদর আর কী হত, কারখানা বন্ধ হয়ে যেত, মাস কয়েক পরে দেখতিস লছমনদাস বাজপুরিয়া কারখানা কিনে নিয়েছে, নিয়ে নতুন নাম দিয়ে কারখানা চালু করেছে। গুরুপদ ঠকত না, ঠকতিস তোরা। বাঙালির এই হল দোষ; চরিত্তির। নিজের মুখের রুটি হাতে নিয়ে খেলা করে; আর চিল এসে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যায়।

গুরুপদ তেমন একবগ্গা মালিক নন। কত রকমভাবে বুঝিয়েছেন, মিষ্টি করে কথা বলেছেন, মাইনেপত্র বাড়িয়েও দিয়েছেন, মায় মাসে পনেরো টাকা করে টিফিন খরচাও ধরে দিয়েছেন রফা করে। তবু মন তুষ্ট করা যায় না। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতন তাঁর কারখানা ছোট—লোক বিস্তর।

শেষে একদিন গুরুপদ বললেন, “নরম মাটি পেয়ে আমায় তোমরা পায়ে চটকাবে? হবে না। আমি আর কারখানায় আসব না; কথাও বলব না। যা খুশি করো তোমরা।”

তেরিয়া না হলে আজকালকার সংসারে কাজ হয় না। গ্রাহ্যি করে না লোকে। গুরুপদর উকিল নীলমণি চাটুজ্যে ঠিকই বলে। বলে, কলকাতা শহরে মানুষ মিনিবাসকে ডরায় কেন গুরুপদবাবু? অ্যাজ বিকজ দে আর অল ডেসপারেটাস। নীলমণি ইংরিজি শব্দের শেষে নাকি ইটালি ভাষা মেশাতে পছন্দ করে।

গুরুপদ কি আর মিনিবাস? মানুষ বলে কথা। আর ব্যবসা তো, আমলা তেল, চালমুগরার সাবান, শাঁখের গুঁড়ো উইথ চন্দন—এ সবের। আর হালে তৈরি করেছিলেন কাপড়কাচা গোল সাবান। দেখতে গেলে কিছুই নয়। তবে ভাল ভাল নাম দিয়েছিলেন জিনিসগুলোর। ‘আদি আমলা শশি কেশ তৈল’ ‘চর্মদশানন চালমুগরা’ ‘মুখশোভা; শঙ্খ চন্দন চূর্ণ’। কাপড়কাচা গোল সাবানের নাম; ‘নব বাংলা সাবান’।

গুরুপদ ব্যবসার মূল কথাটা জানেন; পাবলিকের যা হামেশাই দরকারে লাগে তা নিয়ে ব্যবসা করো, যত তুচ্ছ জিনিসের হোক, লেগে যাবে। পাড়ায় পাড়ায় মুদির দোকান কেন চলে? কেন পানের দোকান ফেল মারে না? তেলেভাজার দোকানে গিয়ে লাইন মারতে হয় কেন?

পঁচিশ বছর আগে গুরুপদ যখন নিতান্তই চাকরি করতেন একটা ফারমাসিউটিক্যাল কম্পানিতে তখন থেকেই মাথায় ব্যবসার পোকা নড়েছিল। বিয়ের পর এক মামা-শ্বশুরের দর্শন পেলেন। গুরুদর্শন। মামাশ্বশুর আলপিন, সেফটিপিন, ক্লিপ তৈরি করে চারতলা বাড়ি হাঁকিয়েছেন। পাতিপুকুরে মামাশ্বশুরমশাই বললেন, খোস-পাঁচড়া-দাদের মলমের কত বিক্রি জানো, বাবাজি। এ দেশ হল গরিবের দেশ; এখানে যত লোক পাউডার মাখে তার পাঁচশ গুণ লোক দাদ চুলকুনি হাজার ওষুধ খুঁজে বেড়ায় বুঝলে? রাইট জিনিস পিক করো, লেগে যাবে।

গুরুপদ পাঁচ রকম ভেবেচিন্তে প্রথমেই ধরলেন, ‘আদি আমলা শশি কেশ তৈল’। বন্ধুরা বলল, ‘আমলার আবার আদি কী রে? গুরুপদ হেসে বললেন, ‘আদির একটা মার্কেট ভ্যালু আছে। আদি কবি বাল্মীকি, ব্রাহ্ম সমাজ, আদি ঢাকেশ্বরী—পুরনো ঘিয়ের গন্ধ ভাই। আর শশি আমার লাক—দেখা যাক বাজারে লাগে কিনা!”

কাগজে পাঁজিতে বিজ্ঞাপন। শিয়ালদা হাওড়া স্টেশনে হ্যান্ডবিল। আমলা তেল বাজারে লেগে গেল। বাজারে মানে বাবুবিবিদের বাজারে নয়, ছাপোষা গরিব-গুর্বোদের ঘরে। মফস্বলে মার্কেট হয়ে গেল। আমলার সাফল্যে খুশি হয়ে গুরুপদ ‘চর্মদশানন চালমুগরায়’ নেমে গেলেন। পাঁজিতে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন। বিবিধভারতীতে স্পট। চমর্দশাননও সাকসেস। তারপর মুখশোভা শঙ্খ চন্দন চূর্ণ।

সাত আট বছরের মধ্যে গুরুপদ পায়ের তলায় শক্ত মাটি পেয়ে গেলেন। শোভাবাজারের দিকে একটা ভাঙা পোড়া বাড়ির নীচের তলার একপাশে তাঁর ‘শশিতারা কোং’ চলতে লাগল। চলতে চলতে পুরো নীচের তলাটাই তাঁর কারখানা হয়ে গেল। জনা তিরিশ লোক খাটে কারখানায়।

গুরুপদ টাকার স্বাদ বোঝার পর থেকেই মন প্রাণ ঢেলে দিলেন ব্যবসায়। আজ বিশ বছরে তিনি না করলেন কী! পাইকপাড়ায় তেতলা বাড়ি করেছেন। কারখানার জন্যে একটা ভ্যান রয়েছে। মধ্যমগ্রামের দিকে বাগান কিনে ফেলে রেখেছেন।

ভাগ্য একদিকে গুরুপদকে যথেষ্ট দিয়েছে। অন্যদিকে অবশ্য মেরে রেখেছে। গুরুপদরা সন্তানহীন।

বছর সাত আট অপেক্ষা করার পরও যখন শশিতারার কিছু হল না, ডাক্তার বদ্যি, তাবিজ মাদুলি, পাথর, মায় উত্তরপাড়ার ডাকসাইটে তান্ত্রিক গুরুর যাগযজ্ঞ পর্যন্ত বিফলে গেল—তখন শশিতারা বললেন, দত্তক নেবেন। গুরুপদ আপত্তি করলেন না। করে কী লাভ? স্ত্রী থেকেই তাঁর ভাগ্যে শশির উদয়। স্ত্রীকে ভয়ভক্তি করেন গুরুপদ। ভালও বাসেন।

শশিতারা তাঁর এক সম্পর্কের বিধবা বোনের ছেলেকে হাফ দত্তক নিলেন। মানে লালনপালনের সব দায়দায়িত্ব। কিন্তু আইনগতভাবে নয়। সে বোনও বিগত হল।

গুরুপদর একটা মেয়ে মেয়ে শখ ছিল। বছর কয়েক পরে গুরুপদর ইচ্ছে হল, এক ভাগ্নিকে নিজের কাছে এনে রাখেন। না, দত্তক নয়। গুরুপদর কোষ্ঠীতে নিষেধ বলছে। বিষ্টপুর থেকে ভাগ্নিকে তুলে এনে নিজের ঘরে আশ্রয় দিলেন গুরুপদ। সেই ভাগ্নির বয়েস এখন কুড়ি। নাম, বেলা।

দত্তকরূপী ছেলের নাম ছিল চাঁদু। নাম পালটে শশিতারা তাকে সুশান্ত করে দিয়েছেন। ডাকেন, শানু বলে।

ছেলে একেবারে তৈরি। বছর বাইশ তেইশ বয়েস বড়জোর। এখনই দোল দুর্গোৎসবে দু এক পাত্র টানতে শুরু করে দিয়েছে। দিনে দু তিন প্যাকেট সিগারেট ওড়ায়।

গুরুপদ কিছু বলতে পারেন না। বললেই শশিতারা খরখর করে ওঠেন। ছেলে আমার বলে তোমার চোখ টানছে। আর নিজের মেয়ের বেলায়? তাঁর তো সাবান শ্যাম্পু চুল ছাঁটা গানের ক্লাস ছাড়া করার কিছু দেখি না। নিজের বেলায় চোখ বুজে থাকো, তাই না?

তা বেলার বেলায় গুরুপদ যতটা স্নেহান্ধ, শানুর বেলায় ততটা নয়। আর শশিতারা শানুর বেলায় যতটা লাগামছাড়া বেলার বেলায় ততটা নয়। তবে, একথা স্বীকার করতেই হবে, ছেলে মেয়ে দুটো এমনিতে খারাপ নয়; বয়েসের টানে খানিকটা তরল, চঞ্চল চপল; টাকাপয়সার সাফল্যে কিছুটা বেহিসেবি, বিলাসী। কী আর করা যাবে? গুরুপদ আর শশিতারার টাকা খাবে কে? ওদের জন্যেই সব।

গুরুপদ বিছানায় গিয়ে বসবেন ভাবছিলেন এমন সময় শশিতারা নিজের হাতে ফল আর শরবত নিয়ে ঘরে এলেন।

জানলার কাছে শ্বেতপাথরিয় চৌকো ছোট টেবিল। ফল-শরবত নামিয়ে রেখে শশিতারা বললেন, “নাও, খেয়ে নাও।”

গুরুপদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “খাব?”

“কেন! খাবে না কেন?”

“বুঝতে পারছি না। ব্লাড সুগার যদি আরও চাগিয়ে যায়।”

“নিকুচি করেছে তোমার ব্লাড সুগারের। রোগের কথা ভাবতে ভাবতে যা ছিরি করেছ! আগে তোমার বন্ধু আসুক। বলুক, কী হয়েছে। তারপর দেখা যাবে, কী খাবে কী খাবে না।”

গুরুপদ ফলের প্লেটে হাত দিলেন। শশার কুচি, কলা, কমলালেবু, বিশ পঁচিশটা আঙুর।

খেতে খেতে গুরুপদ বললেন, “শরীরকে আর অবহেলা করা উচিত নয়, শশি। প্রেশার সুগার—দুটোই খুব খারাপ। তার ওপর হার্ট। সুগারে লোকে নাকি অন্ধ হয়ে যায়।”

শশিতারা বললেন, “কে বলেছে তুমি অন্ধ হবে! তোমার ওই সুবোধ?”

“না না, সে বলেনি। আমি শুনেছি।”

“শোনা কথার আবার কী দাম গো?”

একটু চুপ করে থেকে গুরুপদ বললেন, “আজকাল বুকের ভেতরটাও কেমন করে। চাপ চাপ লাগে। ব্রিদিং ট্রাবল…”

“ওসব তোমার বাই। ⋯আমারও তো মনে হয়, বুক না বালির বস্তা। নোয়াতে পারি না।”

গুরুপদ স্ত্রীর বুকের দিকে তাকালেন। ওই বুকের আর নোয়ানোর কিছু নেই। পেট বুক এক। শশিতারাকে এখন দেখলে কে বিশ্বাস করবে, বিয়ের সময় শশির ওজন ছিল মাত্র তিরিশ সের। এক কি দু কলা উদয় ঘটেছিল শশির। চমৎকার ছিপছিপে গড়ন ছিল তার। তবে মাথায় খাটো। গুরুপদ নিজেও মাথায় লম্বা নন। বরং বেঁটেই বলা যায়। বিয়ের সময় জোড় মন্দ মানায়নি। এখন অবশ্য জোড় হিসেবে মানানসই হয়ে আছেন। পাড়ার লোক আড়ালে বলে জোড়া গিরজে।

শশিতারা হঠাৎ বললেন, “রোগের কথা রাখো। তোমায় একটা খবর দি। রসময় এসেছিল আজ বিকেলে। বড় ঝোলাঝুলি করছে।”

গুরুপদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এমন সময় পাশের ঘরে ফোন বেজে উঠল।

শশিতারা উঠে গিয়েছিলেন ফোন ধরতে। ফিরে আসতে সামান্য সময় লাগল।

ফিরে এসে বললেন, “তুমি চশমা ফেলে এসেছ ডাক্তারের ঘরে?”

গুরুপদর খেয়াল হল। কাছের জিনিস দেখতে, কাগজটাগজ পড়তে তাঁর চশমা লাগে। সুবোধের চেম্বারে চশমাটা পকেট থেকে বার করেছিলেন। আসার সময় মনের যা অবস্থা হয়েছিল চশমাটা খাপে ভরতে ভুলে যেতেই পারেন।

গুরুপদ বললেন, “কী জানি! আমার পকেটটা দেখো একবার।’

শশিতারা এগিয়ে গিয়ে স্বামীর ছেড়ে রাখা পাঞ্জাবিটা ঘাঁটলেন। না চশমার খাপ নেই। বললেন, “কাল সকালে দিনুকে পাঠিয়ে দেব। চশমাটা নিয়ে আসবে।’

চশমার জন্যে গুরুপদর ব্যাকুলতা দেখা গেল না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “সুবোধের সঙ্গে তোমার কথা হল?”

“হল।” শশিতারা ফিরে এসে স্বামীর কাছাকাছি বসলেন।

“কী বলল?”

“ছ্যাচড়ামি করল” শশিতারা যেন খানিকটা বিরক্ত। বললেন, “সামনাসামনি হলে দেখে নিতুম। ফোনে তো অত কথা বলা যায় না।”

“বলল কী?”

“ঠুকে ঠুকে কথা বলল; রসিকর্তা করল। বলল, কর্তাকে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি, পোলাও, মাংস, পাকা রুই মাছের পেটি, দুধ, সন্দেশ, রাজভোগ খাইয়ে যাও⋯, বলি চোখ আছে না নেই, তার যে চেহারাখানা তৈরি করেছ, এমন চেহারা অর্ডার দিয়ে কুমোরটুলিতেও গড়ানো যায় না। —বেলুন ফোলাতে ফোলাতে কোথায় নিয়ে গেছ—তোমার চোখেও পড়েনি। পতিভক্তি যা দেখালে—এবার তার ঠেলা বুঝতে হবে।”

“বলল তোমায়?”

“বলল। আরও কত রকম রসিকর্তা।—আমিও ছেড়ে কথা বলার লোক নই।”

“তুমিও বললে?”

“বলব না।—আমিও বললুম, যার পুকুর তার মাছ, অন্য লোকের বুকে বাজ। নিজেরটি তো হারিয়েছ তাই অন্যেরটি দেখে আফসোসে মরো। বেশ করেছি আমি আমার কর্তাকে গাওয়া ঘিয়ের লুচি-মাংস খাইয়েছি। তোমার বউ বেঁচে থাকতে কোনদিকে ঘাটতি ছিল তোমার। তখন নিজে যে কুমারটুলির কার্তিক হয়ে ঘুরে বেড়াতে। আমাকে বাজে বকিয়ো না। তোমার মতন ডাক্তার আমি ট্যাঁকে গুঁজতে পারি।”

গুরুপদ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “সুবোধকে তুমি এসব বললে?”

“কেন বলব না! আমার পেছনে লাগতে এলে আমি ছেড়ে দেব!”

“না না, তা নয়। তবে কিনা কতকালের পুরনো বন্ধু, ভাল ডাক্তার। তা ছাড়া তোমাদেরও নিজের লোকের মতন ছিল। যদি কিছু মনে করে!”

“করলে করবে। আমায় যখন যা-তা বলে তখন কি তোয়াক্কা করে মুখের।”

গুরুপদ আর ও পথে গেলেন না। শুধু বললেন, “পরশু আসবে তো?”

“আসবে।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর গুরুপদ বললেন, “রসময়ের কথা কী বলছিলে?”

শশিতারার পান-জরদার নেশা। পানের কৌটো আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। আবার উঠলেন। দরজার কাছে গিয়ে হাঁক মারলেন, “পারুলের মা—আমার পানের ডিবেটা দিয়ে যাও।”

পানের ডিবে, জরদার কৌটো আসতে সময় লাগল। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকলেন শশিতারা।

পারুলের মা পানের ডিবে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, শশিতারা বললেন, “দাদা-দিদি ফেরেনি এখনও?”

“এই ফিরল।”

“ঠিক আছে।”

শশিতারা আবার স্বামীর কাছাকাছি এসে বসলেন। পান জরদা মুখে দিয়ে বললেন, “রসময় বলছিল, ও পক্ষ বড় তাড়া দিচ্ছে।”

“কোন পক্ষ?”

“কোন পক্ষ আবার! ছেলেদের তরফে তাড়া দিচ্ছে।”

গুরুপদর খেয়াল বল। বললেন, “আমি তো বলেই দিয়েছি, বেলুর বিয়ে এখন আমি দেব না।”

শশিতারা বললেন, “কেন?”

“কেন আবার কী! উনিশ কুড়ি বছর বয়েসে—এখন বিয়ে?”

শশিতারা স্বামীকে লক্ষ করলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, “উনিশ বছরে মেয়েদের বিয়ে হয় না? আমার কত বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে ছিল। উনিশ কুড়ি।”

“সে তখন। এখন কুড়ি একুশ কম করে। চব্বিশ পঁচিশের আগে মেয়েরাও বিয়ে করে না।”

“ও ! তোমার মতলব তা হলে এখনও দু চার বছর তোমার বেলুকে গলায় ঝুলিয়ে রাখা।”

গুরুপদর হাই উঠল। বড় করে হাই তুলে মুখের সামনে তুড়ি মারলেন। পরে বললেন, “এত হইচইয়ের আছে কী। সময়ে বিয়ে হবে।”

“হ্যাঁ, হবে। ততদিন এই ছেলে বসে থাকবে নাকি! নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। সাত সুমুদ্র উড়ে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে আসবে না।”

গুরুপদ নির্বিকার গলায় বললেন, “দরকার নেই আসার।”

শশিতারা চটে গেলেন। গুরুপদ এমনভাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পাত্র তাড়াচ্ছেন, যেন অমন পাত্র শয়ে শয়ে দেখা যায়। কাক বককে মানুষ এই ভাবে তাড়ায়। রেগে গিয়ে শশিতারা বললেন, “আমেরিকায় থাকে ছেলে, দিদি ভগিনীপতির সঙ্গে। ভাল চাকরি-বাকরি করে দেখতে ভাল। টাকাপয়সার অভাব নেই। মেয়ে তোমার সুখে থাকত। নিজেরা যেচে হাত বাড়িয়েছিল। তুমি হাতের জিনিস পায়ে ঠেলছ।”

গুরুপদ বললেন, “আমেরিকা, লন্ডন আমার দরকার নেই। আমলা তেল আর চালমুগৱো সাবানের ব্যবসা করি আমি। একবারে দেশি ছেলের সঙ্গে বেলুর বিয়ে দেব।”

সেই ছেলে কি তোমার গোকুলে বাড়ছে?”

“কপালে বাড়ছে। কে কার জন্যে বাড়ে তুমি জান? আমি কার জন্যে বেড়েছিলাম।”

শশিতারা বললেন, “ঠিক আছে। থাক তোমার মেয়ে ধিঙি হয়ে ওই তো কাঠবেড়ালি চেহারা। দেখি কোন গোকুল এসে নিয়ে যায়!”

দুই

শানু আর বেলার ঘর পাশাপাশি। দোতলায় বারান্দার দিকের দরজা ছাড়াও দু ঘরের মাঝামাঝি দরজা আছে। খোলাই পড়ে থাকে। সারাদিন। রাত্রে শোবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দেয় বেলা। কোনোদিন বা শুধু ভেজিয়ে রাখে। বেলার ছেলেবেলা থেকেই ভূতের ভয়। সে যখন বিষ্ণুপুরে ছিল তখন তাদের বাড়ির পাঁচ সাতটা বাড়ি তফাতে রাধার মাকে ভূতে ধরেছিল। বটগাছের মাথা থেকে নেমে সেই যে ভূতে ধরল মাকে—একটানা পাঁচ ছ মাস বেচারিকে নাস্তানাবুদ করে যখন ছেড়ে দিল তখন বাতাসিমাসি—মানে রাধার মায়ের হাড়চর্মসার চেহারা। বাতাসিমাসি মারাও গেল পরে।।

ছেলেবেলায় স্বচক্ষে বেলা ভূতে ধরার ব্যাপারটা দেখেছে। আহা, বাতাসিমাসি না পারত খেতে, না পারত শুতে। কুয়োতলায় রান্নাঘরে, উঠোনে, কলঘরে দুমদুম করে আছাড় খেত, মুখ দিয়ে গেঁজলা বেরত, আবোতল তাবোল বকত, কখনও কাঁদত, কখনও গালগাল দিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলত। আরও কত কী করত।

বেলার তখন থেকে ভূতের ভয়। ভয় আর কাটল না।।

একা ঘরে শুতে বেলার আপত্তি নেই। তার ঘর। নিজের মতন করে সে সাজিয়ে গুছিয়ে গা হাত ছড়িয়ে মহা আরামে থাকে। ঘরের লাগোয়া বাথরুম। ছিটেফোঁটাও অসুবিধে নেই। তবু—ওই যে—কোনোদিন যদি কোনো কারণে একবার গা শিউরে ওঠে, বেলা হয়ে গেল। শানু আর তার ঘরের মাঝখানের দরজা সে আর বন্ধ করবে না, আলগাভাবে ভেজিয়ে রাখবে শোবার আগে।

শানুও এক একদিন মজা করে। কোথাও কিছু নেই, বেলা হয়তো সন্ধেবেলায় বসে বসে কলেজের পড়া দেখছে, শানু কোথা থেকে একটা গোবদা বই এনে বেলার কাছে ফেলে দিল। “বেলা দারুণ দারুণ ভূতের গল্প আছে বইটায়। পড়ে দেখ। গায়ে কাঁটা দেবে।” কখনও বা “মৃত্যুর পরপারে” “প্রেতসিদ্ধ মহারাজ নকুলেশ্বর” “কলকাতা শহরের ভূতের বাড়ি”—এই ধরনের বই বা লেখা এনে বেলাকে পড়ে পড়ে শোনাবে।

বেলা চেঁচাবে, ঝগড়া করবে, কাঁদবে—কিন্তু ভয়টা মন থেকে তাড়াতে পারবে না।

“আমি তোর পাশের ঘরে থাকব না, তেতলায় চলে যাব” বেলা হয়তো বলল।

“চলে যা! আমার দু-দুটো ঘর হয়ে যাবে।” শানুর জবাব।

“সবই তো তোর। ”

“অফকোর্স। আমি বাড়ির ছেলে, তুই মেয়ে। তোর বিয়ে হলেই কাটিয়ে দেওয়া হবে। তখন তোর কপালে যা আছে। তার শাশুড়ি তোকে কেরাসিন তেল ঢেলে পুড়িয়ে মারতে পারে। শ্বশুর আর তোর বর মিলে তোকে কোপাতে পারে! বেলি, পোড়া মানুষের যা চেহারা হয় দেখেছিস! বীভৎস। আর আগুনে পুড়ে, খুনখারাবি হয়ে মরলে নির্ঘাত ভূত।”

বেলা হাতের সামনে যা পেল ছুঁড়ে মারতে লাগল শানুকে। “তুই আমাকে তাড়াতে পারবি? আমি যাব না। এটা আমার মামার বাড়ি।”

“আমার মাসির বাড়ি। মায়ের বাড়িও বলতে পারিস। আমি একরকম দত্তক, তুই তক্ষক।”

বেলার মুখ অভিমানে অপমানে থমথম করে উঠত। জল আসত চোখে।

শানুকে চেষ্টা করতে হত বেলার রাগ অভিমান ক্ষোভ ধুয়ে মুছে তার মুখে হাসি ফোটাতে।

সম্পর্কটা এই রকমই ছিল। চিমটি কাটার, চটিয়ে দেবার, ভয় পাইয়ে মজা পাবার এই শানু আর বেলা পরস্পরকে হাসি তামাশা অন্তরঙ্গতার অবলম্বন করে নিয়েছিল।

সেদিন দুজনে খাওয়া শেষ করে নিজেদের ঘরে এল গম্ভীর মুখে।

ঘরে এসে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়ে শানু একটা সিগারেট ধরাল।

বেলা নিজের ঘরে।

শানু আবার ডাকল, “বেলি?”

এবার সাড়া দিল বেলা।

শানু ডাকল, “এখানে আয়।”

বেলা মাঝের দরজা দিয়ে শানুর ঘরে এল।

“কী বুঝলি?” শানু বলল।

বেলা কোনো জবাব দিল না।

শানু মুখের ধোঁয়া গিলে ফেলে বলল, “তোর মামার নাকি মহাপ্রস্থানে যাবার অবস্থা হয়েছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত রোগে রোগে ভরতি। প্রেশার, সুগার, হার্ট, কিডনি, লিভার—।”

বেলা বাধা দিয়ে বলল, “আমার মামা তোমার মেসো। ধর্ম বাবাও।”

“ম্যাটার লাইজ দেয়ার—। মাসি কেমন বলল শুনলি? শানু সঙ্গে সঙ্গে শশিতারার গলা নকল করে বলতে শুরু করল, “সংসারে একটা মানুষ মাথায় গন্ধমাদন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল দশটায় বেরোয় রাত আটটায় বাড়ি ফেরে। যত্ত ঝক্কি ঝামেলা, টাকাপয়সা ব্যবসার চিন্তা তার। খেটে খেটে ভাবনায় ভাবনায় তার সতেরো রকম রোগ বাঁধল। ডাক্তার বলেছে, এভাবে চললে দু দিনেই ফট। চাট্টিখানি কথা নাকি। মাত্তর পঞ্চাশ বাহান্ন বয়েস হল, এখন তো চুল পাকা দাঁত পড়ার বয়েসও হয়নি। অথচ কী দশা হয়েছে মানুষটার চোখ খুলে দেখা যায় না। শরীর পাত হয়ে গেল।—আর তোমরা বাবুবিবিরা মনের আনন্দে ছররা করে বেড়াচ্ছ। তোমাদের না চোখ আছে, না চোখের পাতা আছে। কার ছায়ার তলায় দাঁড়িয়ে আছ বুঝতে পারছ না। বুঝবে একদিন। ছি ছি—!”

শানু শশিতারার পার্টে প্রক্সি দিয়ে হাতের সিগারেটটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিল।

বেলা বলল, “ওই কথাটা আমার খুব খারাপ লেগেছে।”

“কোন কথা?”

“ওই যে মামি বলল—যার যায় তার যায়—অন্য লোকের আয় দেয়। ”

শানু খেয়াল করে কথাটা শোনেনি। শুনলেও পরোয়া করেনি। মাসির একটু ছড়াকাটা অভ্যেস আছে। মেয়েলি ছড়ায় কে কান করে?

শানু বলল, “ছেড়ে দে। বাজে কথায় কান করিস কেন?”

বেলা বলল, “বাজে কথা! এটা বাজে কথা হল? মামার শরীর খারাপ হলে আমাদের কোন আয় বাড়বে—তুইই বল।”

শানু বলল, “ধুত, তুই এনিয়ে মাথা ঘামাতে বসলি! মুখে এসেছে বলে ফেলেছে। মাসির ওই টাইপ। মন থেকে কিছু বলে না। ভেবেও বলে না।” বলে শানু একটা চেয়ারে বসে পড়ল। মাথার চুল ঘাঁটল সামান্য। আবার বলল, “তোর কী মনে হয়?”

“কিসের?”

“মেশোর শরীর দেখে কী মনে হয় তোর?”

বেলা কী বলবে বুঝতে পারল না।

“মেসোকে সিক মনে হয়?”

বেলা একটু অন্যমনস্কভাবে বলল, চোখে দেখে কি অসুখ বোঝা যায়। ডাক্তার যখন বলছে”—

“ডাক্তাররা এইট্টি পার্সেন্ট ফালতু কথা বলে। —তোর মনে নেই, আমার হল ম্যালেরিয়া ডাক্তার বলল প্যারাটাইফয়েড। তোর হল টনসিলাইটিস—বলল, ডিপথেরিয়া। মাসির কান পাকল, বলল নাকের মধ্যে ফোঁড়া হয়েছে। যত্ত বোগাস।”

বেলা বলল, “ সে পাড়ার ডাক্তার ঘোষবাবু। সুবোধ মামা বাজে কথা বলার লোক নয়। তোর আমার বেলায় তো সুবোধ মামাই পরে এসে দেখে ঠিকঠাক বলে ওষুধপত্র দিয়ে গেল।”

শানু কথাটা অস্বীকার করতে পারল না। এবাড়িতে তেমন বেগড়বাঁই কিছু হলে সুবোধ মেসোকেই ডাকতে হয়। আসলে সুবোধ মেশোমশাই থাকেন মাঝ কলকাতায়, আর শানুরা থাকে পাইকপাড়ায়। দরকারে পাড়ার ডাক্তারকেই ডাকতে হয় প্রথমে। আর তাদের পাড়ার ঘোষ একটা ছাগল। এ গোট উইথ টু লেগস।

শানু বলল, “তুই বোস না। ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হবার নয়। ভাবতে হবে। ডিপলি ভাবতে হবে। সাপোজ মেশোর দারুণ কিছু হয়েছে —বডির ফাংশন খারাপ হয়ে গিয়েছে, সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—তা হলে আমাদের চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। একটা কিছু করতেই হবে।”

বেলা আর দাঁড়িয়ে থাকল না, শানুর বিছানায় বসল। মনে মনে এখনও সে অখুশি। মামির ওই কথাটা তার প্রাণে ভীষণ বেজেছে। মামাকে সে কম ভালবাসে না, সেই মামার কিছু হলে তার লাভ কিসের! বেলা কি তেমন স্বার্থপর!

শানু বলল, “বেলি, আমার মনে হয় মেসোর রক্তটক্ত আর একবার পরীক্ষা করানো দরকার। ভাল জায়গা থেকে। আর একটা ই সি জি।—তুই জানিস না পাড়ার শেতলা মন্দিরের মতন রাস্তায় ঘাটে যত রক্তমূত্র কফ পরীক্ষার ঝুপড়ি গজিয়ে উঠেছে—তার নাইন্টি পার্সেন্ট হল রদ্দি। টাকা পেঁচার কল। কিস্যু দেখে না, এর পেচ্ছাপ ওর ঘাড়ে চাপায়, রামের ব্লাড শ্যামের বলে চালিয়ে দেয়। স্টুল রিপোর্ট এ টু জেড একই কিসিমের। এরা ডেনজারাস—।”

বেলা বলল “মামা ভাল জায়গা থেকে পরীক্ষা করিয়েছে। ”

“রাখ তোর ভাল জায়গা। নামেই ভাল। রিলায়েবল লোক দরকার। নিজে যে সব কিছু পরীক্ষা করবে, অন্যের হাতে ছেড়ে দেবে না।”

“মামাকে বল।”

“বলব। মাসিকে আগে বলি। আমি বলব, তুই আমার পোঁ ধরবি।”

বেলা বলল, “বল মাসিকে।”

শানু বলল, “তারপর রিপোর্টগুলো নিয়ে কলকাতার তিনজন টপ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তারাই বলবে—কী হয়েছে। শেষে ভেবেচিন্তে একটা উপায় বার করতে হবে।”

বেলা বলল, “তুই সুবোধ মামাকে পাত্তা দিচ্ছিস না?”

“কে বলল দিচ্ছি না! সুবোধ মেসোই টপ ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলবে।”

“যা খুশি কর তুই।”

“আমি মাসিকে ম্যানেজ করব তুই মেসোকে কর।”

বেলা এবার হাই তুলল। হাই তোলার সময় হাত ছড়িয়ে গা ভাঙল।

“তোকে ফ্রাংকলি বলছি বেলি আমার কিন্তু মনে হয়—মেসোর র‍্যাশান কাট করলেই ভদ্রলোক ঠিক হয়ে যাবেন।”

বেলা এ ব্যাপারে আপত্তি করল না। মামি যে মামাকে বেশি খাওয়ায়—এটা সে বরাবরই দেখে আসছে। আগে অত বুঝত না, এখন বোঝে।

“বডি তো বেলুন নয় যে যত্ত খুশি ফুলিয়ে যাও। বেলুনও ফটাস হয়ে যায়,” শানু বলল, “মাসি সকাল থেকে যা শুরু করে। চার বেলা ওই রকম পেটে পড়লে তুই আমি মরে যেতাম! ডিম, ছানা, হরি মোদকের রসগোল্লা, সন্দেশ, তিন চার পিস করে একশো গ্রাম ওজনের মাছের পিস, দুধ, দই, ফল, রাত্রে লুচি ফাউল—হোয়াট নট? খাবার একটা বয়েস থাকে মানুষের। চল্লিশের পর ডায়েটিং-এ চলে যেতে হয়। সেদিন একটা কাগজে পড়ছিলাম চল্লিশের পর সারা দিনে দু টুকরো রুটি, চার চামচে মধু, এক লিটার দুধ, দু পিস মাংস, বা একটা ডিম আর সাফিসিয়ান্ট ওয়াটার খেলে মানুষের আয়ু আশি পর্যন্ত রিচ করতে পারে।”

বেলা বলল, “কিছু না খেলে একশো। ”

শানু বেলাকে দেখল। “ইয়ার্কি মারছিস।—বেলি, কিছু শিখলি না। জীবনে তোর অনেক দুঃখ। শুধু সাজতে, গান গাইতে আর কলেজে গিয়ে আড্ডা মারতে শিখলে কিছু হয় না।”

“তুই কী শিখলি? শেখার মতন তো দেখলাম, কতকগুলো চ্যাংড়া বন্ধুর সঙ্গে নীচের হলে টেবিল টেনিস খেলছিস, না হয় পপ গান শুনছিস। আর বাইরে গিয়ে সিনেমা, খেলার মাঠ, কফি হাউস করে বেড়াচ্ছিস। সিগারেট ফুঁকছিস বিশ পঁচিশটা করে পড়াশোনায় তোরও যা মাথা—!”

শানু একটু হাসল। বলল, “তুই আগাপাশতলা মুখ্যু। তোকে বললেও বুঝবি না ওরে বেলি, আমার ধর্মবাবা—মানে তোর মামা—আমলা, চালমুগরা, শাঁখ চন্দনের ভেজাল প্রোডাক্ট আর ওই বাংলা সাবান, যা রেখে যাবে তাতে আমার দু দুটো লাইফ কেটে যাবে। হোয়াই শুড আই বদার ফর এ থার্ড ক্লাস এম এস সি ডিগ্রি!—আমার চোখ-মুখ দেখ। গৌতম বুদ্ধ। বডি দেখ, চাবুক।—তোর নিজের চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে নে।”

বেলা উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমার সঙ্গে তুলনা করতে যাস না। আমি ফিন ফিন করছি। তোর মতন ভোঁদামাকা নয়।”

শানু বলল হাততালি দিয়ে, “ওরে আমার ফিনফিনে ফিঙে। দেখিস ফিন ফিন করতে গিয়ে ফিনিশ না হয়ে যাস।”

বেলা তার ঘরের দিকে পা বাড়াল। “নিজের চরকায় তেল দে।”

শানু হেসে বলল, “দিয়ে যাচ্ছি, ভাবিস না।— কিন্তু একটা কথা তুই জেনে রাখবি; বেলি। যে গাছে বসে আছিস তার ডাল কাটলে পড়ে মরবি।”

বেলা চোখ পাকিয়ে বলল, “আমি তোর গাছে বসে আছি?”

“এখন পর্যন্ত নয়। তোর মামামামির গাছের ডালে বসে আছিস।”

“তা হলে শাসাচ্ছিস কাকে!”

শানু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। কাঁধ নাচিয়ে বলল, “এখন যে ডালে বসে বসে দানা খাচ্ছিস তাদের বিপদে তোর কোনো চেতনা নেই।” বলেই নিজের লাগসই ভাষা সংশোধন করে নিল, “আসন্ন বিপদে ক্রাইসিস।”

বেলা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বলল, “আমি ডাক্তার?”

“কে বলেছে! কিন্তু তুই যেভাবে পাল তুলে চলে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে—তোর কোনো দুর্ভাবনা নেই।”

বেলা যেন এবার একটু সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। কপালের চুল সরিয়ে শানুকে দেখতে দেখতে বলল, “আমি কী করব?”

“ভাব। একটা উপায় ভাব।”

“আমার মাথায় আসে না।”

“তা হলেও ভাব। আমিও ভাবছি। মেসোকে এভাবে আপসেট হতে দেওয়া যায় না। মানুষটা ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে। আর মাসির অবস্থা দেখলি, এক বেলাতেই তিরিক্ষে। এভাবে দশটা দিন চললে এ বাড়িতে আর তিষ্ঠোতে হবে না।”

বেলারও মনে হল, মামিকে সামলাতে না পারলে বাড়িতে একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে। মামির যা মেজাজ আর মুখ।

বেলা বলল, “বেশ ভাবছি আমি। তুইও ভাব।”

“ও কে।—লেট মি থিংক!”

বেলা তার নিজের ঘরে চলে গেল।

তিন

সুবোধ ডাক্তার যথাদিনে যথাসময়ে এসে হাজির। রবাির সন্ধেবেলায়।

পরনে মিহি দিশি ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি, হাতে বাহারি ছড়ি, মুখে সিগারেট। দোতলায় উঠতে উঠতে সুবোধ ডাক্তার হাঁক পাড়লেন, “কই হে গুরুপদ শুয়ে আছ নাকি?”

এ- বাড়িতে সুবোধের অবারিত দ্বার। তবু তিনি আসার সময় ষষ্ঠীচরণ ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেয়েছিল। আসুন আসুন করে ডেকে এনে দোতলার একপাশে বসার ঘরে বসাল।

বাতি জ্বলছিল ঘরের, পাখাটা চালিয়ে দিল। দিয়ে বাড়ির কর্তাকে খবর দিতে ছুটল।

সুবোধ ডাক্তার বসতে না বসতেই শশিতারা ঘরে এলেন। সদ্য গা ধুয়ে মাড় করকরে সাদা খোলের শাড়ি পরনে। মুখে পান। এসেই বললেন, “তুমি ডাক্তার, না, থানার দারোগা?” বলে সুবোধের সাজগোজ লক্ষ করতে লাগলেন।

সুবোধ হেসে বললেন, “দেখে কি দারোগা মনে হচ্ছে?”

মাথা নেড়ে শশিতারা জবাব দিলেন, “দেখে তো মনে হচ্ছে বুড়ো কার্তিক।”

হো হো করে হেসে উঠলেন সুবোধ। মাথার চুল দেখিয়ে বললেন, “এখনো চুল পাকেনি, দাঁত পড়েনি। বুড়ো বোলো না, বলল বাবু কার্তিক।”

শশিতারা ঠোঁট ওলটালেন। “বাবুই বটে। গিয়েছিলে কোথায়? সাজগোজের অত ঘটা!”

সুবোধ বললেন, “ঘটার কী দেখলে! রবিবার সন্ধেবেলায় আমি পুরো বাঙালিবাবু। তুমি যেন নতুন দেখছ।”

“না, তা দেখছি না। তবু আজ একেবারে—”

“ও! চোখে পড়েছে তবে! —তবে বলি, ফিরতি পথে একটা বিয়েবাড়ি হয়ে নিজের ডেরায় ফিরব। দেখা করে যাব। —তা উনি কোথায়, তোমার কর্তা?”

“আসছে।” শশিতারা এবার সরে গিয়ে একটা সোফায় বসলেন। “তুমি যে আমার কথার জবাব দিলে না? আমি জানতে চাইছিলাম—তুমি ডাক্তার না দারোগা? ওই ভিতু মানুষটাকে আধমরা করে ছেড়ে দিয়েছ!”

সুবোধ হেসে বললেন, “তুমি যে মানুষটাকে পুরো মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছ! কী করেছ গুরুপদকে—তুমি নিজেই জানো না! তোমার নামে মামলা ঠুকে দেওয়া উচিত।”

শশিতারা হাতের ঝটকা মেরে বললেন, “বাজে বকো না! মামলা আমি তোমার নামে ঠুকব। ডাক্তার হয়ে একটা মানুষকে অকারণ ঘাবড়ে দিয়ে ভয় পাইয়ে মারার চেষ্টা করছ।”

এমন সময় গুরুপদ ঘরে এলেন। তেল ফুরিয়ে যাওয়া বাস-মিনিবাসের মতন গড়িয়ে গড়িয়ে।

সুবোধ বললেন, “এসো।” বলে গুরুপদকে দেখতে লাগলেন।

গুরুপদ সোফার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। স্নানটা সেরে এলাম। বড্ড গরম।”

সুবোধ বললেন, “আছ কেমন?”

সোফায় বসলেন গুরুপদ। বললেন, “আর থাকা! পরশু সারা রাত ঘুম হল না। কাল আর বাড়ির বাইরে বেরোইনি। আজ রবিবার। বসে বসেই কাটছে। বড্ড দুর্বল লাগছে হে। মাথায় থেকে থেকে চরকি মারছে।”

সুবোধ এবার শশিতারার দিকে তাকালেন। “ওকে উপোস করাচ্ছ নাকি?”

“আমি কি করাচ্ছি! নিজেই করছে!”

“কিছুই খাচ্ছে না?”

“ওই একটু শরবত, ফল, মিষ্টি।”

“ভাতটাত খাচ্ছে না? মাছ মাংস, লুচি?”

“কই আর! মুখে তুলছে। খাবে কেমন করে, তুমি ওকে সমন ধরিয়ে দিয়েছ।—মুখে উঠছে না—তবু মুখ কামাই নেই। আমায় দুষছে। “

সুবোধ হেসে বললেন, “পেয়াদার কাজ পেয়াদা করেছে, আমি তো আর কোর্ট নই।—যাক গে, কাজের কথা বলি তুমিও শুনে রাখো, শশি!” বলে সুবোধ পকেটে হাত দিয়ে একটা খাম বার করলেন। তার মধ্যে গুরুপদর রিপোর্টের কাগজগুলো ছিল। খামটা সেন্টার টেবিলের ওপর ফেলে দিলেন সুবোধ। বললেন, “সেদিন তোমায় যা বলেছিলাম আজও বলছি। তোমার অনেক আগে থেকেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল। শরীরটাকে বাইরে ফুলিয়েছ, ভেতরে সবই গোলমাল। এখন থেকে যদি স্ট্রিকলি সাবধান না হও—বিপদে পড়বে।”

শশিতারা বললেন, “হয়েছে কী?”

সুবোধ বললেন, “কোনটা হয়নি! ব্লাড প্রেশার, সুগার, কোলেস্টরাল— ভাবাই যায় না । হার্টও ঝিমিয়ে পড়ছে। হার্টের অপরাধটা কী! বোঝা বইতে পারছে না। তাকে ফাংশান করার পথ খোলা রেখেছ?”

গুরুপদ বললেন, “যা হবার হয়েছে—এখন কী করতে হবে বলো?”

সুবোধ এবার পাঞ্জাবির অন্য পকেট থেকে দুটো কাগজ বার করলেন বললেন, “যা করতে হবে আমি লিখে দিয়েছি। ওষুধপত্র যা খাবে তার জন্যে একটা কাগজ। অন্যটা হল তোমার খাওয়াদাওয়ার চার্ট। যেমনটি আছে তেমনটি ফলো করবে। আপাতত পনেরো দিন তারপর একমাস। আমি দেখব, অবস্থাটা কী দাঁড়ায়। পরের ব্যবস্থা পরে। তোমরা যদি আমার ওপর খবরদারি করো, আমি কিন্তু কোনো দায়িত্ব নেব না। অন্য ডাক্তারের কাছে যাবে। অ্যাজ ইউ লাইক।”

গুরুপদ একবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর বন্ধুর। বললেন, “তুমি রাগ করছ কেন? আমি ভাই, তোমার অ্যাডভাইস মতন চলতে চাই। যা যা বলে দেবে করব।” বলে স্ত্রীকে দেখালেন, “খোদকারি যা করার উনি করেন, ওঁকে বলো।—বাট আই সে, আর খোদকারি সহ্য করব না।”

সুবোধ শশিতারার দিকে তাকালেন।

শশিতারা বললেন, “বা! যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর।”

সুবোধ বললেন, “শশি, তুমি গুরুপদর বউ হতে পার, ডাক্তার নও। তোমার সব ব্যাপারে নাক গলানো উচিত নয়। আমার কথা মতন না চললে আমি কিন্তু এই পেশেন্ট আর দেখব না!”

গুরুপদ বলেন, “না না, এ তুমি কী বলছ! আমি ভাই, তোমাকে বিশ্বাস করি। হাই হাই ডাক্তার কলকাতায় অনেক আছে। তাতে আমার কী! তুমি আমার ধাত জানো, তোমার দেওয়া ওষুধ খেলাম এতদিন। বাঁচি তোমার হাতেই বাঁচব, মরি তোমার হাতেই মরব।”

মাথা নাড়লেন সুবোধ। না, আমার হাতে মরতে হবে না।”

শশিতারা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। স্বামীর দিকে তাকাচ্ছিলেন একবার, অন্যবার সুবোধকে দেখছিলেন। স্বামী কেমন ঝট করে বন্ধুর দিকে হেলে গেলেন। গোটা দোষটাই যেন শশিতারার। রেগে গেলেন শশিতারা। বললেন, “তোমরা যা বলছ তাতে মনে হচ্ছে আমিই স্যান্ডেলবাবুকে মারছি।”

সুবোধ ঠাট্টা করে বললেন, “নিজেও মরছ।”

“আমি মরছি?”

কথাটা মাঝখানে থেমে গেল। চা এসেছে। মানিক আর ফেলু—ট্রের ওপর চায়ের কাপ সাজিয়ে, জলের গ্লাস মিষ্টির প্লেট নিয়ে ঘরে এল। এসে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল।

শশিতারা বললেন, “ঠিক আছে। তোরা যা।”

মানিক আর ফেলু চলে গেল। ফেলু একেবারে বছর তেরো-চোদ্দোর বাচ্চা। শানু তার নাম দিয়েছে ‘গুলতি।‘

শশিতারা বললেন, “যা বলছিলাম। আমি মরছি—কে বলল?”।

সুবোধ মিষ্টির প্লেট দেখতে দেখতে বললেন, “তোমাদের মোদকের সন্দেশ। সাইজটা ভালই করে। আমাদের ওখানে এর অর্ধেক—।—তা গুরুপদ এই সন্দেশ তোমার বউ তোমায় কটা করে গেলায় রোজ?”

গুরুপদ বললেন, “চার ছটা।”

“বাঃ বাঃ! আর ওই কালোজাম—?”

“কালোজাম আমি খাই না, ছেলেমেয়েরা খায়। গিন্নি খায়। আমি রসগোল্লা খাই, ছানা থাকে বলে।”

সুবোধ বললেন, “তোমার শরীরের মধ্যে চিনি এখন সাড়ে তিনশোর ওপর। তারই মধ্যে ছটা বিরাট সন্দেশ, আট দশটা রসোগোল্লা চালিয়ে যাচ্চ! আবার বলছ, তোমার চিকিৎসা করতে।— আমি তো পারব না ভাই, তোমার গিন্নিকে বলো। ডাক্তারের মেয়ে।”

শশিতারার মাথা গরম হয়ে গেল। বললেন, “না তো কি উকিলের মেয়ে! আমার বাবা চারশো সুগার নিয়ে মাছ মাংস রাবড়ি সন্দেশ-মিহিদানা সব খেত আর গায়ে প্যাঁক করে ইনসুলিন ফুঁড়ত।” বলে শশিতারা ইনজেকশান নেবার ভঙ্গিটা দেখালেন।

সুবোধ চায়ের কাপ উঠিয়ে নিলেন। “তা হলে তো হয়েই গেল, গুরুপদ। তুমি যেমন চালাচ্ছ চালিয়ে যাও—তোমার গিন্নি রোজ প্যাঁক করে ছুঁড়ে দেবে। এ ফোঁড় ফোঁড়।”

আতকে উঠে গুরুপদ বললেন, “পাগল! শশির নিজেরই শরীর খারাপ। হাত পা কাঁপে, ঘাড় মাথা টনটন করে, তার ওপর বুক ধড়ফড়—”

চায়ের আরাম করে চুমুক দিয়ে সুবোধ বললেন, “ঈশ্বরের ইচ্ছেয় উনি তোমার যথার্থ সহধর্মিণী। দাঁড়িপাল্লায় রাখলে তোমরা সমান।”

“আজকালকার দিনে তাই হতে হয়, শশিতারা গম্ভীরভাবে বললেন। বলে হাতের মোট মোটা চুড়ি ঘোরাতে লাগতেন। আঁট হয়ে বসে গেলে কষ্ট হয়।

গুরুপদ সুবোধকে বললেন, “শশি যা বলছে বলুক। আমি তোমার কথা মতনই চলব। যেমন যেমন লিখে দিয়েছ তেমন তেমন করব। তুমি শুধু বলো, আমার কী হয়েছে?”

হাত বাড়িয়ে সুবোধ একটা সন্দেশ নিলেন। বললেন, ‘অত শুনে তোমার লাভ নেই। সোজা কথা যেমনটি বলেছি সেই ভাবে চলো। গায়ের চর্বি কমাও, ওজন কমাও, খাওয়াদাওয়া হিসেব মেপে করো, হার্টটাকে খানিক সামলাতে দাও। তারপর দেখা যাবে কী করা যায়!”

“আমার হার্ট কি খারাপ হয়ে গেছে?”

“যাচ্ছে।”

“তা হলে?”

“হায় হায় করে লাভ নেই। যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি—সেই রকম আর কি। এত গিন্নির কথায় চোব্য-চোষ্য খেয়েছ—এবার তার ফল ভোগ করছ।”

গুরুপদ হঠাৎ স্ত্রীর দিকে বিরক্তভাবে তাকালেন। বললেন, “আমি আর ওর কথা শুনব না।”

শশিতারা মুখ ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, “পাড়ার পঞ্চার মায়ের কথা শুনো।”

সুবোধ এবার শশিতারার দিকে তাকালেন। বললেন, “কর্তার তো হল। তোমারটাও হোক। একবার চেক আপটা করিয়ে নাও।”

“দরকার নেই”,শশিতারা মাথা নাড়লেন।

“ভাল কথা বলছি। পরে আর চারা থাকবে না।”

“না থাকুক।— তোমার মতন ডাক্তারের খপ্পরে আমি পড়ব না।”

“আমি ডাক্তার খারাপ নই। এম ডি।”

গুরুপদ হঠাৎ বললেন, “শশি তোমাকে কম্পাউন্ডার বলে সুবোধ।”

সুবোধ গলা ছেড়ে বেজায় জোরে হেসে উঠলেন। হাতের চা চলকে গেল। আর একটু হলে গলায় সন্দেশ লেগে বিষম খেতেন।

হাসি থামলে সুবোধ বললেন, “ঠিকই বলে। আমি যখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র তার আগে থেকে শশির বাবা—বলাই মেশোমশাইয়ের দাবাইখানায় মিক্সচার, মলম তৈরি করতাম। মেশোমশাই বলতেন, ওহে সুবোধ, ওটাকে সুই মেরে দাও। দিতাম। “

শশিতারা বললেন, “তাতেও কিছু হল না।”

চোখে মজার হাসি নিয়ে সুবোধ বললেন, “কই হল! মালাটা গুরুপদর গলায় পড়ে গেল। অবশ্য ভালই হল।” বলতে বলতে হেসে উঠলেন।

গুরুপদও হেসে ফেললেন।

শশিতারাও না হেসে পারলেন না। বললেন, “রঙ্গটাই শিখেছ!”

চা খেয়ে সুবোধ উঠে পড়ছিলেন। “আমি চলি। একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে একবার মুখ দেখিয়ে যেতে হবে।”

শশিতারা ধমকের গলায় বললেন, “চলি মানে! মিষ্টিগুলো কে খাবে?”

“গুরুপদকে খাওয়াও। নিজে খাও। আমি মিষ্টিটিষ্টি বড় একটা খাই না তোমরা জান! ঘি নয়, মাখন নয়।— তুমি গুরুপদর লেজ কেটো—আমাকে কাটবার চেষ্টা কোরো না।— চলি, গুরুপদ মন খারাপ কোরো না, তাঁর ইচ্ছেয় সব হয়।— পনেরো দিন পরে আমার কাছে যাবে। বুঝলে?”

সুবোধ দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, “সে দুটো কোথায়? গলা পেলাম না?”

শশিতারাও উঠে পড়েছিলেন। বললেন, “চরতে বেরিয়েছে। চরা ছাড়া তাঁদের আর কাজ কী!”

চার

দিন পনেরো পরে রাত্রে খেতে বসে শানু বলল, “মাসি একজন ভাল ডাক্তারের খোঁজ পেয়েছি।” বলে আড়চোখে বেলাকে দেখে নিল।

শশিতারা গম্ভীর হয়ে বললেন, “ডাক্তার আমার কী করবে?”

“মেসোর কথা বলছিলাম…।”

“যার কথা তাকে জিজ্ঞেস করো।” বলে শশিতারা গজগজ করতে লাগলেন। “আমি কে? আমড়া গাছতলায় নেতা হয়ে বসে আছি। কে শুনবে আমার কথা। চব্বিশ ঘণ্টা ঘড়ি মিলিয়ে সুবোধ ডাক্তারের ওষুধ খাচ্ছে আর আয়নায় নিজের মুখ দেখছে। গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার নাকি বলেছে, আরও পনেরো দিন চালিয়ে যাও—তারপর কথা। হাঁড়িতে চাল নেই জল ফুটছে—সেই রকম অবস্থা এখন। খাবার কথা বললে দুর্বাশা মুনি হয়ে যায়। এটা বারণ ওটা বারণ, ভাত দু চামচে, রুটি দেড়খানা, এক হাতা চারাপোনার ঝোল, এক টুকরো মাছ, উনি আবার চিকেন বলতে আধ পো ওজনের ছানা বোঝেন, তার স্টু, এক পিস মাংস। মুড়ি দু মুঠো, দু কুচি শশা। মিষ্টি-মাস্টা একেবারে নয়। তেল না, ঘি নয়।—এইভাবেই যদি থাকতে হয় বনে গিয়ে তপস্যা করলেই পারে। সংসার করা কেন।”

বেলা একবার শানুকে দেখে নিল। তার কাজ পোঁ ধরার ; শানুদার সঙ্গে সেই রকম কথা। বেলা বলল, “মামাকে আজকাল যা শুকনো দেখায়।”

“দেখাবে না।” শশিতারা বললেন, “মদ্দ মানুষ একজন। কাজকর্ম আছে, কারখানা আছে। হোক না গাড়ি। তবু পাঁচ জায়গায় ছোটাছুটি রয়েছে। ধকল কি কম শরীরের ওপর। অথচ খাবার কথা বললে তেড়ে আসে। বলে, সুবোধ ডাক্তারের পারমিশান করিয়ে আনো। নিকুচি করেছে তোর সুবোধ ডাক্তারের। অমন ঢের ডাক্তার আমি টেকে গুজতে পারি। ওরা হল অনাহারী ডাক্তার ; না খাইয়ে খাইয়ে রুগিকে হাড় জিরজিরে করে দেয়। তারপর ফক্কা। ” বলে দু হাত ওপরে তুলে তালি দিয়ে ফক্কা বোঝালেন। “ছিল বেশ। সুখে থাকলে ভূতে কিলোল।— আমি কিছু বলব না। বললে তেরিয়া হয়ে যেন মারতে আসে।”

শানু বলল, “মেসোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মাসি, তুমি শুধু রাগ করে বসে থাকলে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাবে।”

“যাক।”

“আহা—তুমি বুঝছ না, দেহ বলে কথা। দেহ ঠিকমতো ধরে রাখতে না পারলে—বিলীন হয়ে যায়।”

“কী হয়?”

“বিলীন—” শানু মাথার ওপর হাত ঘোরাল ; ঘুরিয়ে ফাঁকা বাতাস বোঝাল।

শশিতারা শানুকে দেখতে লাগলেন।

বেলা সরল গলা করে বলল, “একজন দেখলে আর একজন ডাক্তারকে দেখানো ঠিক নয়। খারাপ লাগে দেখতে। কিন্তু একবার পরামর্শ নিলে কিসের ক্ষতি।”

সঙ্গে সঙ্গে শানু বলল, “অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে কত লোক হোমিওপ্যাথি খায়। হোমিওপ্যাথির সঙ্গে কবিরাজি। সুবোধ মেশোর ওষুধবিসুধ যেমন চলছে চলুক না। তার সঙ্গে যদি ধরো ম্যাগনেট ট্রিটমেন্ট চলে, আটকাচ্ছে কোথায়!” বলে শানু মুরগির ঠ্যাং তুলে নিয়ে মুখে পুরল। বেলাকে ইশারা করে দিল চোখ টিপে।

শশিতারা অবাক হয়ে শানুকে দেখতে লাগলেন। কর্তাকে শশিতারা হপ্তায় অন্তত তিনটে দিন মুরগির ঠ্যাং খাওয়াতেন। এখন আর ভদ্রলোক ঠ্যাং খান না। ছোট একটা টুকরো মুখে দেন ; তাও প্যানপ্যানে স্টুয়ের মাংস। মুরগির পনেরো আনা ছেলেমেয়েদের পেটে যায়। শশিতারার এখানে খানিকটা রাগ আছে।

শানুর কথায় রাগ-টাগ ভুলে শশিতারা অবাক হয়ে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। “কী ট্রিটমেন্ট?”।

“ম্যাগনেট?” — হাড় চিবোতে চিবোতে শানু বলল।

“সেটা কী?”

বেলা তৈরি ছিল। বলল, “ম্যাগনেট থেরাপি। চুম্বক চিকিৎসা।”

শশিতারা মাথায় হাত দিলেন। গরমের দাপটে চুলের খোঁপা আর ঘাড়ে থাকে না, ক্রমশই মাথায় উঠে যাচ্ছে। বললেন, “সে আবার কী। চুম্বক চিকিৎসা। জীবনে শুনিনি।”

শানু বলল, “আমরাও কি আগে শুনেছি! সেদিন বেলি ইংরেজি কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিল। ফক্কুড়ি করছিল। আমায় দেখাল। আমিও দেখলাম। দেখে ওকে বললাম—” শানু বেলাকে দেখাল, “হাসিস না। ভেরি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আজকাল কত রকম নতুন নতুন চিকিৎসা বেরুচ্ছে, মান্ধাতা আমলের ট্রিটমেন্ট বাতিল হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের যুগ। তুই সাইন্স জানিস না, তাই হাসছিস।”

বেলা কিছু বলল না। গম্ভীর হয়ে থাকল। ভেতরে ভেতরে ভয় করছিল। শানুদা এক করতে আরেক না করে ফেলে।

শশিতারা বললেন, “লেকচার থাক। জিনিসটা কী বল?”

শানু বলল, “তোমাকে কাগজ দেখাব?”

“কাগজ? কিসের কাগজ?”

“ডাক্তার পাকড়াশির কাগজপত্র! প্যাম্ফলেট। লিফলেট।— আমি কাগজের বিজ্ঞাপন পড়ে একদিন ডাক্তার পাকড়াশির কাছে চলে গেলাম। ধর্মতলা স্ট্রিটে, তালতলার মুখেই। দোতলায় পাকড়াশির অফিস চেম্বার। দশ বারো জন রোগী বসে আছে। বুড়ো বুড়ো, মাঝবয়েসি, কমবয়েসি। মাড়োয়ারি, বাঙালি।—আমাকে ওদের অফিস থেকে ছাপানো কাগজপত্র দিল। বলল, কাগজে সব লেখা আছে।”

“এনেছিস কাগজগুলো?”

“এনেছি। মন দিয়ে পড়েছি। বেলিকেও পড়িয়েছি।”

শশিতারা গলার তিন ভরি হারের তলায় আঙুল দিয়ে একবার গলার পাশটা চুলকে নিলেন। “কী দেখলি?”

“দেখলাম প্রায় সব রকম রোগই ম্যাগনেট ট্রিটমেন্টে সারানো যায়। কি বল, বেলি?”

বেলা ঘাড় হেলিয়ে বলল, বাত, ব্লাড প্রেশার, মাথা ধরা, মাইগ্রেন, স্পনডিলাইটিস, আরও কত কী!”।

শশিতারা কেমন সন্দেহের গলায় বললেন, “সত্যি? না মাদুলির মতন?” মাদুলির ওপর শশিতারা হাড়ে হাড়ে চটা। এক সময়, যখন বয়স ছিল, পেটে একটা বাচ্চা আসার জন্যে হরেক রকম মাদুলি পরেছেন। দুটো হাত আর গলা মাদুলিতে ছেয়ে গিয়েছিল। পাথরও পরেছেন অনেক রকম। কিস্য হয়নি। এখন আর বাড়িতে মাদুলি ঢুকতে দেন না। তবে পাথর আসে। শশিতারা নিজে এখন একটা সাত রতি মুক্তোর আংটি ছাড়া কিছু পরেন না। স্বামীর হাতে চারটে আংটি। পলা, গোমেদ, পান্না আর মুক্তো। পুরুষ মানুষ, কাজকর্ম, কারখানা, নানান অশান্তি—পাথর ছাড়া চলে কেমন করে!

শানু খেতে খেতে বলল, “ওদের কাগজপত্র পড়ে আমার মনে হল, ব্যাপারটা পুরোপুরি ফেলনা নয়। ম্যাগনেটের ব্যাপারটাই রহস্যময়, মাসি। কেন আছে, কেমন করে আছে, এর রহস্য কেউ ধরতে পারল না। ঠিক কিনা বল, বেলি?”।

বেলা বিজ্ঞান পড়ে না। কিন্তু শানুর কাছে শুনে রেখেছে। মাথা নেড়ে বলল, “মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতন।”

“একজ্যাক্টলি। ইট ইজ দেয়ার বাট হাউ? ইট ইজ এ মিষ্ট্রি।— জানো মাসি, সেদিন টিভি-তে একটা প্রোগ্রাম দেখাচ্ছিল। বিদেশে এখন রোগ ধরার জন্যে ম্যাগনেটিক ডিটেকটার ব্যবহার করছে। দারুণ দেখাচ্ছিল।”।

শশিতারা বললেন, “অত শুনে আমার দরকার নেই। কী করে চুম্বক নিয়ে তাই বল।”

“কিচ্ছু না। রোগ বুঝে ওজন মতন ম্যাগনেট পিস বডিতে বেঁধে দেয়। নর্থ পোল, সাউথ পোল। ব্যাস ওতেই—। আসলে ট্রিটমেন্টের ব্যাপার তো লিখে দেবে না; এটা তো ডাক্তারদের ব্যাপার!”

“এ রকম চিকিৎসা আর কোথায় হয়?”

“বম্বে ; দিল্লি। —বিদেশে অনেক জায়গায়।”

শশিতারা এবার উঠবেন। ছেলেমেয়েদের খাওয়াও শেষ হয়েছে। বললেন, “বেশ, তোরা বল ওঁকে। আমি বলব না।”

শানু বলল, “বাঃ! তুমি না বললে—”

বেলা বলল, “মামি, আমরা বললে মামা কানেই তুলবে না। তোমারই বলা ভাল। তারপর যা করার শানুদা করবে।”

মাথা নাড়লেন শশিতারা। “আমি কিছু বললেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে ওঠে। ভাবে, আমি তোর মামার সর্বনাশ করার জন্যে মন্ত্র দিচ্ছি! ওই সুবোধ ডাক্তার যে কী বুঝিয়ে দিয়ে গেল। তোমার মামা-মেশোর ধারণা হল, আমার জন্যেই ওর শরীরের এই অবস্থা! এখন আমি শত্রু।”

বেলা বলল, “আমরা সবাই বলব। তুমি, শানুদা, আমি।”

শশিতারা উঠে পড়লেন। বললেন, “ঠিক আছে, বলে দেখো। এই মানুষ আমায় সারা জীবন জ্বালাচ্ছে, আরও জ্বালাবে। যেমন কপাল আমার।”

শানু আর বেলা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে মুখ টিপে হাসল।

খাওয়ার দাওয়ার পর ঘরে ফিরে এসে শানু বলল, “বেলি কাল তুই তোর মামাকে ক্যাচ কর। তোকে অত ভালবাসে, না করতে পারবে না। জোঁকের মতন লেগে থাকবি—আদিখ্যেতা করবি, কাঁদবি—”

বেলা বলল, “তুই গিয়ে লাগ না!”

“আমার দ্বারা হবে না। তুই মেয়ে। মামার ভাগ্নি। তুই পারবি। তোকে ভদ্রলোক জেনুইন ভালবাসে।— তা ছাড়া কেসটা তোর—তোকে লেগে থাকতে হবে।

বেলা তার সরু বুড়ো আঙুলটা দেখাল! পরে বলল, “তোর কি চোখ নেই! তুই দেখছিস মামিই এখন পাত্তা পাচ্ছে না। মামার কাছে তো আমি—!”

শানু বনেদি চালে একটা সেঁকুর তুলল। তুলে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজতে খুঁজতে বলল, “কিসের একটা কথা আছে না রে টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান— আমি দেখছি মানুষের কারবার গল্পকেও হার মানায়।” বলতে বলতে শানু সিগারেট ধরিয়ে বড় করে ঢোঁক গিলল। “যে মাসি মেসোকে মুঠোয় পুরে রেখেছিল সেই মেসোই এখন মাসিকে হাঁকিয়ে দিচ্ছে! ভাবা যায়।—তুইও কম যাস না!”

শানুর কথাটা বোধ হয় মিথ্যে নয়। অন্তত গুরুপদ আর শশিতারাকে দেখে তেমন মনে হতে পারে। যে গুরুপদ একমাত্র ব্যবসা ছাড়া উঠতে বসতে খেতে শুতে স্ত্রীর কথায় চলতেন ফিরতেন—এত বছর চলেছেন—হঠাৎ তিনিই এখন স্ত্রীর ওপর বেজার। মাঝে মাঝে রাগে ফুসেও উঠছেন। গুরুপদর যেন এতকাল পরে চৈতন্যোদয় হল। দেখলেন, শশিতারার আদর আতিশয্য ধমক হুকুম মেনে চলে চলে তাঁর অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছে। গুরুপদর এই ভয়াবহ শারীরিক অবস্থার জন্যে শশিতারাই যেন দায়ী। খাও খাও করেই তাঁর জীবনটা শেষ করে দিলেন শশিতারা। আর নয়। গুরুপদ এখন স্ত্রীর কথা কানেই তুলছেন না, উলটে নিজেই ধমক মারছেন।

বেলা বলল, “তুই ভাবছিস কেন! মামিই রাজি করিয়ে দেবে।”

“দিলে ভাল। না দিলে ওয়ে আউট বার করতে হবে।” বলে শানু গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। সিগারেটে টান মারতে মারতে বলল, “বেলি, তুই শুধু মাসির ভরসায় বসে থাকলে পারবি না। নিজে একটু লেগে পড়। ইনসিয়েটিভ নে।”

“মানে?”

“মেসো সিরিয়াসলি ভয় পেয়ে গেছে। ভয় পেয়েছে বলেই মাসির ওপর খাপ্পা হয়ে গেছে। মাসি এখন বিরোধী পক্ষ। তুই তোর মামার পক্ষ নে।”

“রেখে দে।—মামিকে তুই চিনিস না। কদিন সবুর কর—দেখবি।”

“দেখব।— তুই কাল তোর মামাকে মিট করছিস? ছাদে মিট করবি। তোর মামা যখন ফুলের টবে জল দেয় তখন। মনটা সেসময় নরম থাকবে।”

বেলা চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল, “সে আমি করব। কিন্তু তারপর?”

“কিসের তারপর?”

“যদি মামা রাজি হয়ে যায়?”

“ম্যাগনেট ট্রিটমেন্ট হবে।”

বেলা নজর করে শানুকে দেখতে লাগল। বলল, “হলে তো মরব।”

শানু অবাক হাঁ করে বেলাকে দেখতে লাগল! বলল, “তুই বকছিস কী! ম্যাগনেটে কেউ মরে! তোকে আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। ফাঁসি হতে পারে, মরবি না।”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

শানু বিছানা থেকে উঠে পড়ল। বলল, “বেলি, তুই ডোবাবি। তোকে এত করে বোঝালাম তিন পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে এসে লাভ হবে না। তোকে এগুতে হবে।”

বেলা বলল, “মামা যদি জিজ্ঞেস করে, ম্যাগনেটে রোগ সারে কেমন করে?”

“বলবি, সারে নিশ্চয়। ম্যাগনেটের একটা এফেক্ট আছে। ডাক্তার ওসব বুঝবে—তুই আমি কী বুঝব! আমরা পেনিসিলিন পর্যন্ত জানি। ম্যাগনেট আরও অ্যাডভান্স। পঞ্চাশ বছর পরে দেখবি—এম ডি উঠে যাবে, তার বদলে ডাক্তাররা হবে ডক্টর অফ ম্যাগনেটিক থেরাপি।”

বেলা হাই তুলতে তুলতে বলল, “ততদিন আমি বেঁচে থাকব না।”

“বলিস কী! তুই সত্তরের আগে মরবি? একেবারেই নয়। তুই ঝুনো বুড়ি হবি, তোর দাঁত পড়বে, মাথার চুল সাদা হয়ে যাবে, লাঠি নিয়ে নিয়ে হাঁটবি, চোখে দেখতে পাবি না, শুকনো আমসি হয়ে মরবি।”

“আর তুই মরবি?”

“আমি।—আমি বোধ হয় ছেঁড়া জুতোর সোল হয়ে।”

বেলা বলল, “না, তুই মরবি পিপড়ে ধরা বাতাসা হয়ে।” বলতে বলতে বেলা হেসে উঠল।

শানুও হেসে ফেলল।

হাই তুলতে তুলতে বেলা উঠে পড়ল এবার। তার ঘুম পাচ্ছে।

চলে যাচ্ছিল বেলা, শানু বলল, “কাল সকালে লেগে পড়বি।”

পরের দিন বেলা দশটা নাগাদ শানুর ডাক পড়ল তেতলায়।

গুরুপদ চেয়ারে বসে আছেন। শশিতারা হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে।

শানু মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।

গুরুপদ শানুকে দেখতে দেখতে বললেন, “ডাক্তারের নাম?”

“পাকড়াশি।”

“পুরো নাম?”

“এম পাকড়াশি।”

“ছোকরা?”

“দেখিনি। কাগজপত্র নিয়ে চলে এসেছি।—ছোকরা নয় বোধহয়। অতগুলো ডিগ্রি ডিপ্লোমা।”

“ট্রিটমেন্টটা কী রকম?”

শানুর মনে হল, মেসোর গলা একটু নরম। বলল, “আমি প্যাম্ফলেট পড়ে যা দেখলাম, ম্যাগনেটের টুকরো বেঁধে দেয় শরীরে। অন্য কিছুও থাকতে পারে জানি না।”

“কত বড় টুকরো?”

“অসুখ আর অবস্থা বুঝে।”

“আর কিছু নয়?”

“আবার কী?”

“খাওয়া দাওয়া ওষুধ?”

“জানি না। বোধহয় তেমন কোনো রেস্ট্রিকশন নেই।”

“ফোন নম্বর আছে ডাক্তারের?”

“আছে।”

“একটা কল দিয়ে দাও। বাড়িতে এসে দেখে যাক।”

শানু একবার শশিতারার দিকে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে চলে গেল।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শানু লাফ মেরে মেরে নামছিল।

পাঁচ

এম পাকড়াশির পুরো নাম মহাদেব পাকড়াশি। দেখতে যাত্রাদলের মহাদেবের মতন। তফাতের মধ্যে যাত্রাদলের মহাদেব বাঘছালের বদলে গেরুয়া রঙে ছোপ ছোপ ছাপানো খাটো কাপড় পরে, লুঙির মতন করে, মহাদেশ পাকড়াশি পরেন গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট। নয়তো ভুড়ি থেকে প্যান্ট নেমে যায়।

মহাদেব পাকড়াশি বাড়িতে রোগী দেখতে আসেন না। তাঁর চেম্বারে গিয়ে দেখিয়ে আসতে হয়।

গুরুপদকেও যেতে হল। সঙ্গে শানু।

শশিতারা বায়না ধরলেন, তিনিও যাবেন। শানু ছেলেমানুষ। সব কথা গুছিয়ে বলতে পারবে না। ডাক্তার বলবে এক, শুনবে অন্য আর। গুরুপদ তো ভিতুর বেহদ্দ। একজন শক্ত লোক থাকা দরকার, যে সামলাতে পারবে, কথা বলতে পারবে।

কাঁটায় কাঁটায় সোয়া ছটায় গুরুপদরা হাজির হলেন মহাদেব পাকড়াশির চেম্বারে। গিয়ে দেখেন, জনা তিনেক রোগী বসে আছে। একটা চৌকো ঘরে। ঘরে বাতি জ্বলছে, পাখা চলছে। কতকগুলো পুরনো ম্যাগাজিন ফরফর করে উড়ছে। রোগীদের মধ্যে দুই জেনানা। গায়ে গতরে শশিতারাকে ছাপিয়ে যায়। তৃতীয় জন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। অম্বুলে চেহারা।

জেনানাদের দেখে শশিতারা নিচু গলায় বললেন, “সার্কাসের হাতি”। গুরুপদ বললেন, “চুপ। শুনতে পাবে। এরা কলকাতার মাড়োয়ারি। বাংলা বোঝে।”

সাড়ে ছটায় ডাক পড়ল গুরুপদর। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল আগেই।

গুরুপদ সদলবলে ডাক্তারের ঘরে ঢুকে পড়লেন।

ঘরে ঢুকে গুরুপদ যাকে দেখলেন তাঁকে ডাক্তার বলে মনে হল না।

গুরুপদ নমস্কার করলেন। শশিতারার দেখাদেখি শানুও হাত তুলল।

“আপনারা সবাই—?”

গুরুপদ বললেন, “আমার স্ত্রী। আর আমার শালীর ছেলে। আমার সঙ্গেই এসেছে।”

“বসুন।”

গুরুপদরা বসলেন।

মহাদেব তাঁর ঝাঁকড়া মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে নিলেন। ঝুলঝাড়া লাঠির আগায় যেমন শনের আঁটি থাকে মহাদেবের মাথার চুল সেই রকম দেখাচ্ছিল। অবশ্য রঙে। ঢঙে নয়। ঢঙে যাত্রাদলের মহাদেবের মতন ফাঁপানো।

মহাদেব বললেন, “আপনি পেশেন্ট?”

“আজ্ঞে হা।”

“কী হয়েছে আপনার?”

“প্রেশার, সুগার, কোলেস্টরাল, হার্ট, পাইলস—।”

“বাবা! এ যে পঞ্চবাণ!”

“আজ্ঞে?”

“না বলছি, পঞ্চবাণে বিধে ফেলেছে যে!”

শশিতারা ফিস ফিস করে শানুকে বললেন, “কাগজগুলো দেখা। পরীক্ষার কাগজগুলো।”

শানুর কাছেই পরীক্ষার কাগজগুলো ছিল। ডাক্তারের সামনে এগিয়ে দিল।

মহাদেব কাগজগুলো দেখলেন না। না দেখে গুরুপদকেই দেখতে লাগলেন।

“কী নাম যেন আপনার?” মহাদেব বললেন।

“গুরুপদ সান্যাল।”

“থাকেন কোথায়?”

“পাইকপাড়ায়।”

“হুঁ!” এবার পাতা উলটে উলটে কাগজগুলো একবার দেখলেন মহাদেব। চোখ বোলালেন। “কত বয়েস হল?”

“তা বছর বাহান্ন!”

মহাদেব কথা বলতে বলতে পট পট করে দু চারগাছা চুল ছিড়লেন নিজের মাথার। এটা তাঁর মুদ্রাদোষ।

“ফিফটি টু। তা হলে দাঁড়াচ্ছে ছাব্বিশ। সিকি দাঁড়াচ্ছে তেরো। দশে এক হলে— দাঁড়াচ্ছে এক কেজি আর তিনে তিনশো গ্রাম মতন—”

গুরুপদ কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন।

মহাদেব এক টুকরো কাগজে পেনসিল দিয়ে কিসের হিসেব নিকেশ সারতে সারতে বললেন, “আপনি কী ধরনের ট্রিটমেন্ট চান। শর্ট অর লং?”

গুরুপদ বোকার মতন ডাক্তারকে দেখতে দেখতে বললেন, “বুঝলাম না।”

‘বুঝিয়ে দেব। সবই বুঝিয়ে দেব”, মহাদেব বললেন। বলে টেবিলের ওপর রাখা একটা মোটা মতন ছাপানো কাগজ তুলে নিলেন। “আপনি দেখবেন, না, আমি বলে দেব?”

“আপনিই বলুন।”

“আমাদের এখানে ট্রিটমেন্টের দুটো গ্রুপ আছে। কোর্স বলতে পারেন। শর্ট অ্যান্ড লং। শর্ট হল ছ সপ্তাহ থেকে দশ সপ্তাহের মতন। লং হল—থ্রি টু সিক্স মাস। যে যা পছন্দ করে।”

শশিতারা আর শানুর দিকে তাকালেন গুরুপদ।

শশিতারা বললেন মহাদেবকেই, “উনি কাজের মানুষ। তাড়াতাড়ি যা করা যায় করতে হবে।

মহাদেব বললেন, “তা হলে দাঁড়াচ্ছে ছয় থেকে দশ।” বলে দু-পাশে ঘাড় দোলাতে লাগলেন। “ছয়ে হবে বলে মনে হয় না। অতগুলো রোগ। দশও কম হল। আরও দু এক উইক বেশি লাগতে পারে। যাক, সে পরের কথা।”

শানু এতক্ষণ চুপ করে ছিল এবার ফট করে বলল, “স্যার, শর্ট কোর্স ট্রিটমেন্টের রেজাল্ট কী রকম?”

“খারাপ নয়। ভাল।— তবে শর্টে পেশেন্টকে বেশি স্ট্রেইন নিতে হয়। চাপ বেশি থাকে।” বলে গুরুপদর দিকে তাকালেন মহাদেব। “আপনি শর্টই নিন। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”

শানু বলল, “ট্রিটমেন্টটা—! মানে কীভাবে—”।

“বলছি। সবই দেখাচ্ছি।” বলতে বলতে মহাদেব ঘণ্টি টিপলেন। বেয়ারা এল।

মহাদেব বললেন, “জুনিয়ারকে ডাকো। দেখো ঘর ফাঁকা হয়েছে কিনা?”

মহাদেব উঠে পড়লেন। উঠে ডানদিকে এগিয়ে গিয়ে দেওয়ালের কাছে দাঁড়ালেন। জানলার পরদার মতন পরদা ঝুলছিল একপাশে। সরসর করে পরদা সরিয়ে গুটিয়ে ফেললেন।

গুরুপদরা অবাক হয়ে দেখলেন, দেওয়ালের গায়ে একটা বোর্ড। ব্ল্যাক বোর্ডের মতন কালো কুচকুচ করছে। বোর্ডের মধ্যে দুটি মানুষের চেহারা। একপাশে পুরুষ, অন্য পাশে মেয়ে। স্বাস্থ্য বইয়ে নারী পুরুষের ছবি যেভাবে আঁকা হয় সেইভাবে। শুধু আউট লাইন। তবে সাদা খড়ি বা রঙিন পেনসিলে আঁকা নয়, চকচকে কোনো বস্তু বোর্ডের মধ্যে গেঁথে দিয়ে চেহারা দুটি করা হয়েছে।

মহাদেব বাড়তি আলো জ্বেলে দিলেন। দিয়ে আরও একটা সুইচ টিপলেন। বললেন, “নাউ লুক অ্যাট দিস ফিগার। “ বলে পুরুষ চেহারাটা দেখালেন। “আমরা যখন আপনার চিকিৎসা শুরু করব—তখন কতকগুলো পয়েন্ট বেছে নেব। যেমন—এই হল হার্ট—দেখতে পাচ্ছেন। এখানে আমরা দু পিস ম্যাগনেট প্লেস করব। নেক্সট করব, হিয়ার অ্যান্ড হিয়ার দু দিকেই—কোমরের দু পাশে— রাইট অ্যান্ড লেফট সাইডে। তারপর নামব। হাঁটুতে—বোথ সাইডস। আর একটা পিস থাকবে বিটুইন দি শোলডার ব্লেডস। •…তার মানে— আপনার শরীরে অল টোটাল লাগছে দুই আর দুই চার, প্লাস হাঁটুতে দুই—ছয়, আর ঘাড়ে এক—মানে সাত পিস।” বলতে বলতে মহাদেব টেবিলের কাছে এসে হিসেবের কাগজটা দেখলেন। বললেন, “আপনার বডি ওয়েট আর বয়েসের একটা আন্দাজ করে নিয়ে দেখছি—ইউ রিকোয়ার তেরোশো গ্রাম ম্যাগনেট পিস। ওজনটা হচ্ছে লোহার টুকরোগুলোর। ম্যাগনেট স্ট্রেংথ আলাদা। সেটা আপনারা বুঝবেন না। ওটা আমরা নিজেরা করে নিই। চার্জ দিয়ে। ইলেকট্রো ম্যাগনেট।”

এমন সময় ছিপছিপে চেহারার একটি ছেলে এসে দাঁড়াল। দেখতে বেশ। পঁচিশ ছাব্বিশ বয়েস। চোখে ধরার মতন চেহারা। শানু যেন খুঁটিয়ে ছোকরাকে দেখতে লাগল।।

মহাদেব বললেন, “আমার ভাইপো। জুনিয়ার মহাদেব। ওর নাম মুরলী। ও আমার অ্যাসিসটেন্ট। হাতে কলমে যা করার ওই করে।” বলে মহাদেব তাঁর জুনিয়ারকে বললেন, “একটু দেখিয়ে দাও। হার্ট, ওয়েস্ট, নী—আর ঘাড়।”

জুনিয়ার—মানে মুরলী সেই বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। গিয়ে নিজের অ্যাপ্রনের পকেট থেকে দাবার গুটির মতন গোল লাল গুটি বার করল। পাতলা, ছোট সাইজের। বার করে বোর্ডের ছবির জায়গায় জায়গায় ছুইয়ে দিল। দিতেই গুটিগুলো আটকে গেল।

শানু বলল, “ম্যাগনেট?”

“হ্যাঁ।”

“বাঃ।” বলে শশিতারার দিকে ঘাড় ফেরাল। “মাসি, পুটুসকে আমরা যেই যে ব্যাঙ ঘড়ি কিনে দিয়েছিলাম, জন্মদিনের, আলমারির গায়ে আটকে রাখত—সেই রকম।”

শশিতারা বললেন, “মানুষ তো লোহার আলমারি নয়।”

মহাদেব বললেন, “আটকে রাখার ব্যবস্থা আমাদের আছে।…জুনিয়ার—এঁকে নিয়ে যাও। বুথে বসাও।” বলে গুরুপদর দিকে তাকালেন, “আপনাকে কি নিয়ে গিয়ে ম্যাগনেটগুলো বসিয়ে দেবে?”

গুরুপদ থতমত খেয়ে বললেন, “এক্ষুনি?”

“আপত্তি কী! আজই বসিয়ে দিক।— ভয় পাবার কিছু নেই। আপনি আজ থেকেই শুরু করুন। দিন সাতেক পরে একবার আসবেন। একবার ম্যাগনেটিক ওয়াশ দেব।”

জুনিয়ার গুটিগুলো তুলে নিল। নিয়ে সুইচ বন্ধ করল।

শানু বলল, “পিসগুলো ছোট ছোট হবে?”

“তা কেমন করে হয়।” মহাদেব বললেন, “তেরোশো গ্রাম টোটাল ওয়েট। এ তো চন্দনের ফোঁট্টা নয়।”

গুরুপদ স্ত্রীর দিকে তাকালেন।

শশিতারা বললেন, “গিয়ে দেখো। অসুবিধা হলে বলতে পারবে। ”

শানু বলল, “জুতোর দোকানে গেলে পায়ের সঙ্গে জুতো ফিট করিয়ে নিতে হয়। সেই রকম আর কি।”

বাধ্য হয়েই গুরুপদ উঠে দাঁড়ালেন।

জুনিয়ার মানে মুরলী বলল, “আসুন।”

গুরুপদকে নিয়ে মুরলী পাশের ঘরে চলে গেল।

মহাদেব নিজের চেয়ারে বসলেন। বললেন, “একটা কাজ করা যেতে পারে। মাঝে মাঝে পিসগুলো চেঞ্জ করার দরকার হয়। সে-কাজটা না হয় বাড়িতে গিয়েই করে দিয়ে আসবে জুনিয়ার। তবে বার তিনেক ম্যাগনেটিক ওয়াশ, বার দুই ট্রেমার দিতে হবে। ওটা বাড়িতে হবে না। এখানে আসতে হবে।”

শানু বলল, “ইয়ে মানে, উপকারটা কখন থেকে বোঝা যাবে?”

“হপ্তা খানেক পর থেকে একটু একটু বোঝা উচিত। সেকেণ্ড উইকের পর সিওর।”

“ছ সপ্তাহ পর থেকে—”

“ভাল ইমপ্রুভমেন্ট হবে।”

শশিতারা বললেন, “খাওয়াদাওয়া? —আজকাল কিছুই খায় না।

“ “কেন?”

“ভয়ে।”

মহাদেব হাসলেন নিজেকে দেখালেন। বললেন, “আমি সব খাই, আমার বয়েস পঞ্চাশ। হ্যাঁ, বয়েসে একটু রেস্ট্রিকশান দরকার। তার মানে একাদশী করা।—আপনি একটু দেখেশুনে খেতে দেবেন। ব্যাস আর কী!”

শশিতারা যেন খুশি হলেন।

হঠাৎ মহাদেব বললেন, “আচ্ছা, মিস্টার সান্যাল কি কখনো গড়পারের দিকে থাকতেন?”

শশিতারা অবাক। বললেন, “গড়পারেই তো থাকতেন। ওদের বাড়ি ছিল। শরিকি বাড়ি। আপনি কেমন করে জানলেন?”

মহাদেব হেসে বললেন, “ধরেছি ঠিক। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। স্কটিশ স্কুলে।”

শশিতারা মাথার কাপড় গোছাতে গোছাতে বললেন, “ওমা! দেখছ!”

মহাদেব বললেন, “আমি ওঁর চেয়ে জুনিয়ার ছিলাম। —চেহারাটা পালটে গিয়েছে। কিন্তু মুখ দেখে কেমন মনে হল—।”

শানু বলল, “একেই বলে কোয়েনসিডেন্স!”

মহাদেব টেবিল চাপড়ে বললেন, “কিছু ভাববেন না বউদি। এই কেস আমি ভাল করে দেব।”

শশিতারার বুক থেকে ভার নেমে গেল। বলবেন, “বড় অশান্তিতে আছি। ভেবে ভেবে মানুষটা শুকিয়ে গেল। মুখে কিছু তুলতেই চায় না। আপনি যা পারেন করুন।”

খানিকটা পরে গুরুপদ এলেন। সঙ্গে জুনিয়ার, মানে মুরলী।

গুরুপদ এমনভাবে এলেন যেন মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলেন কোথাও। চোট খেয়েছেন। হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল।

মহাদেব মুরলীকে বললেন, “সব ঠিক করে দিয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“বসুন।” মহাদেব গুরুপদকে বসতে বললেন, “প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে। পরে সয়ে যাবে।”

গুরুপদ বললেন, “লোহার খোঁচা লাগছে।”

“প্রথমটায় লাগে।—তা আপনি তো দেখলেন কীভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে টুকরোগুলো। ঠিক এইভাবে সকালে দু ঘন্টা দুপুরে দু ঘণ্টা রাত্রে এক ঘণ্টা। শোবার সময় সব খুলে রাখবেন। শোবেন উত্তর দক্ষিণ মাথা করে। যদি পারেন বিছানায় ম্যাগনেটগুলোকে রেখে দেবেন। প্লাস দাগগুলো মাথার দিকে, মাইনাসগুলো পায়ের দিকে।”

শশিতারা উসখুশ করছিলেন। আর পারলেন না। স্বামীকে বললেন, “ডাক্তারবাবু তোমায় চেনেন। স্কুলের বন্ধু।”

গুরুপদ মহাদেবকে দেখতে লাগলেন।

মহাদেব বললেন, “স্কটিশ স্কুল!”

“হ্যাঁ—তা—”

“আপনি আমার সিনিয়ার ছিলেন। স্কুলে আপনাকে সকলে গুরু বলে ডাকত। আর আমাকে বলত, মানে আমার ডাকনাম ছিল, ঝন্টু।”

গুরুপদ যেন চমক খেয়ে গেলেন। “ঝনু ঝন্টু যে স্কুলের মধ্যে খেপা ষাঁড় ঢুকিয়ে দিয়েছিলে?”

মহাদেব হাসতে হাসতে বললেন, “নাম আমার মহাদেব। ষাঁড় আমার বাহন। “

গুরুপদ হেসে উঠতে গিয়ে বুকে খোঁচা খেলেন। সামলে নিয়ে বললেন “তুমি আমায় অবাক করলে ঝন্টু! শুনেছিলাম তুমি নেভিতে গিয়েছ। তা এ তো অন্য ব্যাপার। তোমার এই ম্যাগনেট ডাক্তারি কবে থেকে?

“অনেক দিন হল। কলকাতায় এসেছি বছর দুই। এখনও জমাতে পারিনি তেমন। দিল্লি চণ্ডিগড়ে ভাল জমিয়েছিলাম।—শেষে আর ভাল লাগল না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম। ভাইপোটাকে তো মানুষ করে দিয়ে যেতে হবে।”

শশিতারা মুরলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার ভাইপো ছেলেটি বেশ।”

শানু একবার শশিতারাকে দেখে নিল।

ছয়

মাস খানেক পরের কথা। চৈত্রমাসের শেষ। গরমে কলকাতা পুড়ে যাচ্ছে। বৈশাখে বুঝি ঝলসাবে।

গুরুপদ গলদঘর্ম হয়ে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে ডাকলেন।

শশিতারার সারা দিনে বার চারেক স্নান আর গা-ধোওয়া হয়েছে। সবে গা ধুয়ে শাড়ি পাল্টাচ্ছিলেন। সাড়া দিয়ে বললেন, “আসি।”।

শশিতারা ঘরে আসতেই গুরুপদ বললেন, “সুবোধের কাছে গিয়েছিলাম।”

“কী বলল?”

“দেখল। বলল, ভেরি গুড। এই রেটে ঝরে যাও।” গুরুপদ একেবারে নগ্নগাত্র হয়ে গায়ের ঘাম শুকোচ্ছিলেন। “আরও ছ মাস ঝরতে হবে।”

শশিতারা বললেন, “কেন, তুমি কি খেজুর গাছ। কলসি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখলে রস ঝরবে!”

গুরুপদ বললেন, “আমি বললাম, আরও ছ মাস ঝরব। বলো কী! তা ও বলল, শীতের পাতা ঝরা দেখে ভয় পেও না। শীতের পরই বসন্ত। তখন নবপল্লব।”

“যত্ত বাজে কথা! আর ঝরাঝরিতে কাজ নেই। “।

“মাস খানেক বাইরে গিয়ে বেড়িয়ে আসতে বলল। ফাঁকা জায়গায়। বলল, বাইরে গিয়ে মাঠেঘাটে মাইল দু তিন করে হাঁটবে রোজ। “

“বেশ কথা। মাঠে মাঠে গোরু চরে, মানুষ নয়। ”

“আমি বললুম, বৈশাখ মাসে একবার না হয় চেষ্টা করব। পুরী যেতে পারি।”

“সে বরং ভাল। সমুদ্র ভাল।”

“অনেক দিন বাইরে বেরুনো হচ্ছে না। পুরীই ভাল। কার্তিকবাবুর বাড়িটা নিয়ে নিলেই হবে। সবাই মিলে ঘুরে আসব। ”

“হবেখন। পুরীতে বাড়ি পেতে আটকাবে না। আমাদের ছোড়দার বাড়ি আছে।—ওদের লোকজন থাকে। ব্যবস্থা করা রয়েছে।—নাও তুমি সেরে নাও। তোমার মুরলী এসে বসে আছে!”

“ম্যাগনেট মুরলী!” স্ত্রীকে একবার দেখলেন গুরুপদ।

“বেলুর সঙ্গে বসে গল্প করছে।”

“শানু নেই?”

“এখনও ফেরেনি।”

“আমি চানটা সেরে আসছি।”

মুরলীর নাম হয়েছে এ-বাড়িতে ম্যাগনেট মুরলী। শানুই চালু করেছিল। এখন অন্যদের মুখে মুখে ঘুরছে।

শশিতারা বললেন, “চান করে তুমি দোতলায় নামবে? না—?”

“নীচেই নামব।”

“আজ দুটো ডায়াবিটিস সন্দেশ খাও। মুরলী হাতে করে এনেছে।”

“সন্দেশও আনছে নাকি মুরলী আজকাল! বাঃ বাঃ!”

শশিতারা চলে গেলেন।

গুরুপদও আর বসে থাকলেন না বৃথা। স্নান করতে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন।

দোতলার বসার ঘরে মুরলী বসে বসে গল্প করছিল। এক পাশে মুরলী, মুখোমুখি সোফায় বসে বেলা।

মুরলী ছেলেটিকে প্রথম দিন যতটা মুখচোরা মনে হয়েছিল, ততটা মুখচোরা সে নয়। তবে খুব যে সপ্রতিভ তাও নয়। হাসি-খুশি মুখ। কথা বলে নরম গলায়।

স্নান সেরে গুরুপদ নীচে নামলেন।

“এই যে জুনিয়ার!” গুরুপদ ঘরে ঢুকে ঠাট্টা করে বললেন, “এসেছ কখন? কাকার খবর কী?”

মুরলী উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, “এসেছি খানিকক্ষণ। কাকা ভালই আছে।”

“বসো বসো।—আমার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।”

“কী বললেন?”

“ভালই বলল। বলল, আরও ঝরতে হবে। লাইক এ উইনটার ট্রি।” বলতে বলতে গুরুপদ নিজে সোফায় বসলেন। “ব্যাপারটা কী জান, আমি নিজে আজকাল মন্দ বুঝছি না।” বেলা উঠি উঠি ছিল। গুরুপদর সেদিকে নজর পড়তেই হাত তুলে ইশারায় বেলাকে বসতে বললেন।

মুরলী বলল, “খারাপ হবার কথা নয়। ইন ফ্যাক্ট আপনাকে যে কটা পিস ম্যাগনেট দিয়েছিলাম লাস্ট টাইম—তার টোটাল ওয়েট সাতশো থেকে সাড়ে সাতশো গ্রাম। এক কেজি মতন দিলে ঠিক হত। কাকা বলল, খানিকটা কম দিয়েই দেখা যাক।”

গুরুপদ বললেন, “আমি কিন্তু বাবা ডাক্তারের কাছে যাবার সময় গা থেকে খুলে গাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম।” বলে একটু হাসলেন।

“ভাল করেছিলেন” মুরলী বলল, ‘কুকুর বেড়ালে মিশ খায় না। যারা ট্রাডিশনাল ডাক্তার তারা আমাদের ব্যাপারটা মানতে চায় না। শুনলে চটে যায়। আপনার বন্ধুর সঙ্গে অনর্থক কেন চটাচটি করবেন!”

এমন সময় শশিতারা নিজেই কর্তার জন্যে ডায়াবেটিস সন্দেশ, আর ঘোলের শরবত নিয়ে হাজির। শরবতে চিনির নামগন্ধও নেই, নুন আছে।

স্বামীর কাছেই একটা টিপয় ছিল। সন্দেশ শরবত নামিয়ে রাখলেন।

মুরলী বলল, “ম্যাগনেটগুলো আবার পরেছেন?”

“না। চানটান সেরে এলাম। পরে পরব।”।

মুরলী বলল, “ওগুলো আর পরবেন না। আমি নতুন সেট এনেছি।” এমনভাবে বলল কথাটা যেন নতুন সেট গয়না এনেছে।

গুরুপদ বললেন, “নতুন সেট?”

“হ্যাঁ,” বলে পাশে রাখা প্লাস্টিকের ছোট বাক্স দেখাল মুরলী।

শশিতারা স্বামীকে তাড়া দিলেন, “তুমি খেয়ে নাও। “

গুরুপদ সন্দেশের দিকে হাত বাড়ালেন।

মুরলী বলল, “ছটা। দুটো হার্টের জন্যে। একশো গ্রাম মতন। ফিফটি ফিফটি গ্রামস। দুটো থাকবে কোমরে। এদের ওয়েট একশো গ্রাম ইচ! এই হল তিনশো। আর লেগ-ম্যাগনেট একশো টোটাল-ওয়েট এবার চারশো। “

বেলা বলল, “অর্ধেক হয়ে গেল যে আগের চেয়ে।”

“জাস্ট ফর এ উইক। পুরনোগুলো আবার ম্যাগনেটাইজ করে পাওয়ার বাড়াতে হবে। বডিতে থাকতে থাকতে উইক হয়ে গিয়েছে।”

গুরুপদ বললেন, “মানে বড়ি কনট্যাক্টে?”

মুরলী বলল, “হ্যাঁ। আমরা রিচার্জ করে স্ট্রেংথটা বাড়িয়ে দি। মাঝে মাঝে স্ট্রেংথ কমবেশি করে দেখি রোগীর পক্ষে কোনটা স্যুটেবল হচ্ছে।” বলে গুরুপদর দিকে তাকাল, বলল, “আমাদের একটা বড় অসুবিধে কি জানেন, ডাক্তারদের মতন আমরা ওষুধের শিশির গায়ে লেখা স্পেসিফিক ডোজ দেখে কাজ করি না। আমাদের হল অবজারভেশান, আন্দাজ, এক্সপেরিমেন্ট।—এই যে আপনাকে নতুন সেটটা যা দেব—তার টোটাল ওয়েট কম। ম্যাগনেটিক স্ট্রেংথও কম। কিন্তু দিয়ে দেখব, কী রেজাল্ট হয়। এটা একটা ব্রেক—!”

গুরুপদ বললেন, “আচ্ছা মুরলী, হরিনামের মালার থলির মতন একটা মশারির থলি করে যদি বুকের কাছের ম্যাগনেটগুলো ঝুলিয়ে রাখি, হয় না? —তুমি যাই বলো, পট্টি দিয়ে ওই লোহার টুকরো বুকে বেঁধে রাখতে কষ্ট হয়। খচখচ করে লাগে।—গরম কাল। একেই তো আমার ঘামের ধাত।”

বেলা হেসে ফেলল। মুরলী মাথা নাড়ল। বলল, “না জেঠু ; বডির সঙ্গে যত বেশি কনট্যাক্ট হবে তত কাজ হবে।”

গুরুপদ কিছু বললেন না। হাঁটুর কাছে চুম্বক দুটো পট্টি দিয়ে বেঁধে নিকাপ পরে চালাচ্ছেন তিনি, কোমরের কাছেও চুম্বক রেখে পট্টি বাঁধছিলেন। অসুবিধে অস্বস্তি দুইই হচ্ছে। তবে বুকের পট্টিটাই সবচেয়ে কষ্ট দিচ্ছিল তাঁকে।

বেলা আড়চোখে চাইল। বলল, “হেড ফোনের মতন একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে পারলে ভাল হয় না?”

মুরলী বলল, “ভেবে দেখব। বলে গুরুপদকে বলল, “ম্যাগনেটের পোলগুলোকে ঠিক মতন রাখছেন তো! দাগ তো দেওয়াই আছে। শোবার সময় নর্থ সাউথ হয়ে শোবেন। বসার সময়ও যতক্ষণ পারবেন—”

শশিতারা বললেন, “আমার বাতের জন্যে এক জোড়া দিও তো। আমি কিন্তু বাঁধাবাঁধি করতে পারব না!”

মুরলী যেন কিছু ভাবল। তারপর বলল, “আপনাকে কীভাবে দেওয়া যায় ভেবে দেখব।—তবে আপনি উপকার পাবেন। বাত, স্পণ্ডিলাইটিস—এসব রোগে ম্যাগনেট ট্রিটমেন্ট ভীষণ কাজে দেয়।”

“অ্যাকুপাংচারের চেয়েও বেশি?” গুরুপদ বললেন।

“অনেক বেশি। অ্যাকুর হল নারভাস সিস্টেমের কতকগুলো ভাইট্যাল পয়েন্ট নিয়ে কাজ। ম্যাগনেটের হল পুরো শরীর নিয়ে। এটা কাজ করছে ইউনিভারসাল ম্যাগনেটিক এফেক্ট নিয়ে।”

“ও ! ইউনিভারসাল—!” গুরুপদ প্রথম সন্দেশ শেষ করে দ্বিতীয় সন্দেশ মুখে পুরলেন। “কোথাকার সন্দেশ হে?”

“নিউ সুইটস-এর।—শিয়ালদার কাছে।”

“মন্দ নয়। তবে একটু গন্ধ আছে।”

“আজ্ঞে চিনি থাকলে গন্ধটা লাগত না।—সন্দেশে একটু ফ্লেভার নেই?”

“বুঝতে পারছি না। যাক গে, আগের বারে কী একটা এনেছিলে?”

“চিনি ছাড়া রসগোল্লা!”

“তাই হবে!” বলে শশিতারার দিকে তাকালেন গুরুপদ, “দিনে দিনে কী হচ্ছে দেখছ তো! চিনি ছাড়া সন্দেশ রসগোল্লা, ফল ছাড়া ফলের রস, তা ছাড়া ডিম। আরও কত হবে দিনে দিনে। এই যেমন দেখছি—ম্যাগনেট ট্রিটমেন্ট—।”

মুরলী তার ঘড়িটা দেখে নিল। বলল, “এবার আমি উঠব। পুরনো ম্যাগনেটগুলো নিয়ে যেতাম।”

শশিতারা বেলাকে বললেন, “যা তোর মামার ঘর থেকে ওগুলো নিয়ে আয়।”

বেলা উঠতে যাচ্ছিল, গুরুপদ বললেন, “ওপরে কি পাবে?”

“কোথায় রেখেছ তবে?”

“মনে করতে পারছি না। সুবোধের কাছে যাবার সময় গাড়িতে খুলে রেখেছিলাম।”

“গাড়ি তো গ্যারেজে।”

“দেখতে হবে।”

“বেলি, দেখ কোথায় রেখেছে। গাড়িতে থাকলে দুলালকে বলবি, গ্যারেজ খুলে গাড়িটা দেখতে।”

বেলা চলে গেল।

গুরুপদ মুরলীকে বললেন, “তোমাদের এই ম্যাগনেট ট্রিটমেন্টটা কোথায় শিখেছিলে? দিল্লিতে?”

“আজ্ঞে হ্যা। ডক্টর ভার্গবের কাছে। উনি জার্মানি থেকে ফিরে এসে ব্যাপারটা শুরু করেন। বম্বেতে শুরু করেন ডক্টর দেশপাণ্ডে। অনেক পরে। কাকা ভার্গবের সঙ্গে কাজ করতেন। আমাদের দেখে আপনি ডক্টর ভার্গরে ব্যাপারে কিছু বুঝবেন না।ওঁর ক্লিনিক দেখার মতন জিনিস। কত রকম ব্যবস্থা, যন্ত্রপাতি—! আমরা কিছুই করে উঠতে পারিনি। কাকার ইচ্ছে অনেক ; কিন্তু অত টাকা পয়সা আমাদের নেই।”

ঘোলের শরবতে চুমুক দিতে দিতে গুরুপদ বললেন, “হবে, তোমাদেরও হবে।”

শশিতারা ইশারায় গুরুপদকে দেখালেন ; দেখিয়ে বললেন, “উনি কত ছোট থেকে শুরু করেছিলেন। সকাল রাত দিন দুপুর খেটে খেটে মরেছেন। তবে না আজ—”

গুরুপদ কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, “বাড়ি, গাড়ি, কারখানা—। সবই ওঁর বরাতে হে।—তা মুরলী, তোমার কাকা না হয় ছেলেবেলা থেকে স্কুলে ষাঁড় ঢুকিয়েছে। তুমি বাপু কাকার লাইন ধরলে কেন?”

মুরলী যেন কথাটা বুঝতে পারল না। আমতা আমতা করে বলল, “আজ্ঞে, কাকাই আমার সব। কাকাই আমায় মানুষ করেছে। বাবা নেই, মা নেই। তা ছাড়া আমি ফিজিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছি।”

“ও! —বুদ্ধিমান ছেলে!” গুরুপদ ঘোল শেষ করে সেঁকুর তুললেন। দরজার দিকে তাকালেন একটু। “কই, গেল তো গেলই, আর এল না।”

মুরলী বলল, “আমি তো নীচেই যাচ্ছি। নিয়ে নেব।—নতুন সেটটা রেখে গেলাম।”

প্লাস্টিকের বাক্সটা রেখে দিয়ে উঠে পড়ল মুরলী। “আসি। খবর নিয়ে যাব।”

মুরলী চলে গেল।

গুরুপদ দুটি চোখ বন্ধ করে সামান্য বসে থাকলেন। তারপর নিজের মনেই বললেন, “ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখোনি।”

শশিতারা কিছু বুঝতে পারলেন না। “কী হয়েছে?”

“না; তেমন কিছু নয়।— চলো, ওপরে যাই।”

গুরুপদ সোফা থেকে উঠে পড়লেন। শশিতারা বললেন, “তোমার কি এত ওপর নীচ পোষায়! নামলে যখন তখন দু দণ্ড বসলেই পারতে।”

“একটা ফোন করব।”

“কাকে?”

“চলো, দেখবে।”

শশিতারাকেও উঠতে হল।

দরজার দিকে পা বাড়িয়ে শশিতারার মনে হল চুম্বকের টুকরো রাখা প্লাস্টিকের বাক্সটা পড়ে রয়েছে। তুলে নিতে গেলেন।

গুরুপদ বললেন, “ওটা থাক।”

“কেন? পরবে না?”

“না।— এসো।”

শশিতারা কিছুই বুঝলেন না। অবাক হলেন। হয়েও কিছু বললেন না। পাখা বন্ধ করে দিলেন। দিয়ে স্বামীর পিছু পিছু সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

তেতলায় এসে গুরুপদ শোবার ঘরে না ঢুকে পাশের ঘরে ঢুকলেন। ডাকলেন স্ত্রীকে।

“একটা ফোন করব।”

“কাকে?”

“মহাদেবকে। বাড়িতেই পাব এখন। দেখি।”

গুরুপদ একটা সরু খাতা হাতড়ে মহাদেবের ফোনের নম্বরটা দেখে নিলেন। নম্বরটা হালে টোকা হয়েছে।

শশিতারা পাখাটা চালিয়ে দিলেন ঘরের।

গুরুপদ বার পাঁচেক চেষ্টা করে মহাদেবকে পেলেন।

“মহাদেব নাকি? আমি গুরুপদ বলছি।” —গুরুপদ ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, “—না না, ভালই আছি।— সুবোধ ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।— বলল, বেটার।— বাড়ি ফিরে এসে দেখি, তোমার জুনিয়ার বসে আছে।—হ্যাঁ গো, তোমার ম্যাগনেট মুরলী।— কী।—তা তুমি অমন জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছ কেন? মালটাল খেয়েছ নাকি! —যাক গে শোননা। তুমি তো স্কুলে ষাঁড় ঢোকানো ছেলে! তা আমার পেছনে এবার যে ম্যাগনেটটি ঢুকিয়েছ তার কী হবে! —কী বলছে, বুঝতে পারছ না! মহাদেব—আমাকে তুমি বুদ্ধু ভেবেছ। শোনো, তোমার ওই ভাইপো মুরলী, আর আমার ভাগ্নি বেলা—এই ছোঁড়াছুঁড়ি দুটোর আগে থেকেই চেনাজানা হয়েছে।—আরে বাবা, তুমি আমায় কী শেখাবে! আমি শিখে শিখে বুড়ো হয়ে গেলুম।—দাঁড়াও, দাঁড়াও—আমাকে কথা শেষ করতে দাও—কলকাঠি তুমি নাড়োনি জানি। নেড়েছে আমার ভাগ্নি আর শালীর ছেলে। হারামজাদা কেমন প্যাঁচ কষে আমাকে, আমার গিন্নিকে তোমার কাছে নিয়ে গেছে বুঝতে পারছি। তুমিও বাপু, বেশ ম্যাগনেটটি ঢুকিয়ে দিলে। ”

শশিতারা যতই অবাক হচ্ছিলেন ততই স্বামীর গা ঘেঁসে আসছিলেন। যেন পারলে মহাদেবের কথাগুলোও শুনে নেন।

গুরুপদ বললেন, “—শানু—আমার শালীর ছেলেটি অতি ধুরন্ধর। ভাগ্নিটাকে আমি বোকাই ভাবতাম।—দেখছি, এখনকার ছেলেমেয়েগুলো আমাদের কান কাটতে পারে।—তা যাকগে এখন তোমায় সাফসুফ বলি, তোমার ভাইপোকে আমার জামাই করতে পারছি না। ছোকরাকে বলে দিও!” বলে গুরুপদ ফোন নামিয়ে রাখলেন।

শশিতারা অবাক হয়ে স্বামীকে দেখছিলেন। প্রথমে কথা বলতে পারছিলেন না পরে বললেন, “হল কী তোমার?”

“আমার সঙ্গে ভাঁওতা বাজি।”

“করলটা কে?”

“ওরা!—আমি বলব না করে শেষে সুবোধকে বলেই ফেললাম, ম্যাগনেটিক ট্রিটমেন্টের কথা। সুবোধ তো হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে মরে। শেষে বলল, আমার মতন ছাগল আর দেখেনি।”

“তোমায় ছাগল বলল! ও নিজে কী?”

“ও কী তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।—সত্যি বলতে কি, আমি ফেরার সময় গাড়িতে ভাবতে ভাবতে এসেছি।—আমার বরাবরই কেমন ধোঁকা লাগছিল। চার ছটা লোহার টুকরো বেঁধে চিকিৎসা! —তা কলকাতা শহরে হাজার লোক হাজার ফিকির করে খায়! তোরাও খা। নো অবজেকশান। আমিও শালা আদি আমলা তেল, চালমুগরা করে খাই।—কিন্তু তোরা আমার ভাগ্নিকে চিট করবি?”

শশিতারা হঠাৎ বললেন, “মুরলী ছেলেটি কিন্তু ভাল। দেখতে ভাল ব্যবহার ভাল। লেখাপড়া শিখেছে। সভ্য—”।

“সভ্য! —বেটাকে তুমি সভ্য বলছ! —তুমি কিস্যু জানো না।—শোনো, তোমায় বলিনি আজ আমি যখন ওপরে আসছি, কানে এল বসার ঘরে বসে ওই রাস্কেল হি হি করে হেসে হেসে বেলিকে বলছে, বেলা তোমার কাছে এইভাবে বসে থাকলে আমার মনে হয় ময়রার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। জিবে জল আসে।”

শশিতারা হেসে ফেললেন। জোরেই। তাঁর মোটা গলার স্বর সরু হয়ে এল।

গুরুপদ বললেন, “হাসছ।”

শশিতারার হাসি আর থামতে চায় না। শেষে বললেন, “সে তুমি বলতে। তুমি ময়রার দোকান বলতে না, বলতে—”।

গুরুপদর মনে পড়ে গেল, কী বলতেন। নানা রকমই বলতেন, মাঝে মাঝে তামাশা করে বলেছেন, শশিসোনার ভ্যারাইটি স্টোর্স—।

হেসে ফেলে গুরুপদ বললেন, “সে তখনকার কথা। বিয়ের পর। বিয়ের আগে অমি তোমায় দেখেছি, না, কিছু বলেছি?”

শশিতারা বললেন, “দেখোনি বলোনি।—এরা দেখাদেখি করছে তাই বলছে।”

এমন সময় বেলার গলা পাওয়া গেল। ঘরে এল। এসে বলল, “গাড়িতে কিছু নেই। “বেলার হাতে বসার ঘরে ফেলে আসা প্লাস্টিকের বাক্স।

গুরুপদ ভাগ্নিকে দেখতে দেখতে বললেন, “নেই জানতে এতক্ষণ লাগল?”

বেলা চুপ। মুখ নিচু করল।

শশিতারা বললেন, “তোর মামার খেয়াল থাকে না কোথায় ফেলে দিয়েছে।”

বেলা নতুন বাক্সটা এগিয়ে দিচ্ছিল, গুরুপদ বললেন, “আমার দরকার নেই। তুমি নিয়ে যাও।”

বেলা হকচকিয়ে গেল। “আমি?”

শশিতারা ইশারা করে বললেন, “তুই নিয়ে যা। যা—!”

বেলা যেন কেমন থতমত খেয়ে ভয় পেয়ে চলে গেল।

গুরুপদ গোঁফ চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “শশি? কী করব?”

“আর একবার ফোন করো।”

“কাকে?”

“মহাদেবকে?”

“কী বলব?”

“বলো, যা হয়েছে ; তাই হবে।”

“শুধু এই?”

“হ্যাঁ।—তুমি তো খাঁটি দিশি ছেলে খুঁজছিলে। মুরলী তোমায় ম্যাগনেট দেওয়া চুলের তেলও করে দিতে পারে।”

গুরুপদ আবার ফোন করলেন।

“মহাদেব।—আমি গুরুপদ।—শোনো, আমার বউ বলছে—যা হচ্ছিল, তাই হবে।—কী? শুনে খুশি হলে।—আরে—কী বললে ম্যাগনেট ট্রিটমেন্ট! না আমার দরকার নেই। ওটা যাদের দরকার তারাই করুক।—কী? —কী বলছ? —তা বলতে পার। ছাড়লাম।”

গুরুপদ ফোন নামিয়ে রাখলেন।

শশিতারা বললেন, “কী বলল গো মহাদেব?”

“বলল, বউদিই তোমার বেস্ট ম্যাগনেট! —শালা ধড়িবাজ।” বলে গুরুপদ বেশ হাসিখুশি মেজাজে শশিতারার বুকে খোঁচা মারলেন। “ম্যাগনেট! মন্দ বলেনি, কী বলো? তবে এত বিগ সাইজ—!”

শশিতারা বুক সামলে বললেন, “আঙুল না ছাতার বাঁট! আমার লাগে না?”

গুরুপদ হাসতে লাগলেন।

প্রেমশশী

বিয়ের পর পনেরোটা দিনও কাটেনি প্রেমকিশোর বন্ধুদের কাছে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ভাই, তোরা আমায় ত্রিশূল পর্বতের একটা টিকিট কেটে দে, আমি পাহাড়ে চলে যাব।

ত্রিশূল পর্বতটা কোথায় বন্ধুদের কারও জানা ছিল না। গুহ জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কাজ করে, ভারতবর্ষের মানচিত্রটা তার মোটামুটি জানা—সেই গুহও বলল, একজ্যাক্ট লোকেশানটা কোথায় ত্রিশূলের?

প্রেমকিশোর বিরক্তির চোখে গুহর দিকে তাকাল।

সুবীর হাজরা আর মন্মথ প্রেমকিশোরকে ভাল করে নজর করতে লাগল। পনেরো দিনেই প্রেমকিশোর রং-ওঠা জামার মতন মেড়মেড়ে মেরে গেছে, তার মুখে জেল্লা নেই, মাথার চুলে হেয়ার-ক্রিমের পালিশ নেই, গাল-টাল শুকনো, চোখ গর্তে ঢুকেছে। দেখলে মনে হচ্ছে, ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি থেকে সদ্য উঠে এসেছে।

সুবীর হাজরা জীবনের নানা ব্যাপারে অভিজ্ঞ। প্রেমকিশোরের প্রায়-বিধ্বস্ত চেহারা খুঁটিয়ে নজর করতে করতে বলল, “বুঝেছি দি সেম প্রবলেম। আমাদের বঙ্কিমের মতন। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি বুঝি?” বলে সুবীর একটু টেরচা চোখে হাসল।

মন্মথ বলল, “আমরা তো জানতাম তুই বউ নিয়ে হনিমুন করে বেড়াচ্ছিস। পুরী যাবি বলেছিলি না?”

প্রেমকিশোর বুক ভাঙা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হনিমুন কোথায় ভাই, আমার হনি গন, —আর মুন ভ্যানিশ হয়ে গেছে।”

গুহ ভড়কে গিয়ে বলল, “হনি গন মানে কি রে? বউ পালিয়ে গেছে নাকি?” প্রেমকিশোর বলল, “না, বউ পালায়নি। আমি পালাব। ।’’

সুবীর বলল, “কি আজেবাজে কথা বলছিস! তুই পালাবি কেন? কী হয়েছে তোর! বিয়ের পর প্রথম প্রথম ছেলেদের ও-রকম একটু হয়। ওটা নার্ভাসনেসের ব্যাপার। মালটি-ভিটামিন খা, আর দুটো আসন কর, ঠিক হয়ে যাবে।”

প্রেমকিশোর প্রবলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল; “না না, তা নয় ; বঙ্কিমের কেস না। সে-কেস অনেক ভাল ছিল। আমার কেস কোয়াইট ডিফারেন্ট। আমি আর বাঁচব না।”

মন্মথ বন্ধুর অবস্থা দেখে বলল, “তুই অত কাহিল হয়ে পড়ছিস কেন। ব্যাপারটা কী খুলে বলবি তো! আমরা এতগুলো ম্যারেড লোক রয়েছি; সিজন্‌ড, তোর প্রবলেম সল্‌ভ করতে পারব না? আলবাত পারব। কী হয়েছে বল?”

গুহ বলল, “তুই একটু জল খেয়ে নে প্রেম, সুস্থ হয়ে নে। শুধু জল খাবি, না জলবৎ ব্র্যান্ডি খাবি? দুই তোকে খাওয়াতে পারি।” বলে গুহ হাসল।

প্রেমকিশোর অভিমান করে বলল, “আমায় কিছু খাওয়াতে হবে না ভাই, নিমতলায় যাবার পর দু ফোঁটা গঙ্গার জল দিস, তা হলেই হবে।”

মন্মথ জিভ কেটে বলল, “ছি ছি, বলছিস কি! এখন তুই ম্যারেড, সবেই লাইফ শুরু করেছিস,…কত সুখ আহ্লাদ পড়ে আছে জীবনে।”

বুকে হাত রেখে প্রেমকিশোর বলল, “আমার জীবনে আর কিছু নেই। এখন একটা খাঁচায় পোরা বাঁদর বনে গিয়েছি।”

সুবীর বলল, “বাজে বকিস না। তোর মাথায় শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে। সব ঠিক করে দেব। এই গুহ, চা বলে আয় ভেতরে।”

গুহ বাড়ির মধ্যে চায়ের কথা বলতে গেল।

প্রেমকিশোরের বিয়ের একটা ইতিহাস আছে। তার বন্ধু—বান্ধবরা আটাশ ত্রিশ বড় জোর বত্রিশের মধ্যে বিয়ে করে ফেললেও প্রেমকিশোর সাঁইত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত অনড় অটল থেকে গেল। তার কারণ প্রেমকিশোরের বাল্যকাল থেকেই কেমন একটা প্রেম-প্রেম বাতিক হয়েছিল। তার বাল্যসঙ্গিনী ছিল পাশের বাড়ির লাবণ্য—ডাক নাম লাবু। প্রেমকিশোর সেভেন ক্লাসে পড়ার সময় সাপ-লুডো খেলতে খেলতে একদিন লাবুকে মনোচোর বলেছিল ; তার ফলে লাবু প্রেমকিশোরের হাতে এমন কামড় কামড়েছিল যে বেচারি প্রেমকিশোরকে এ টি এস নিতে হয়েছিল। ‘মনোচোর’ শব্দটা প্রেমকিশোর নজরুলের গানে শুনেছিল। মানেটা বোঝেনি। যাই হোক, বাল্যপ্রেমে এই ভাবে বিচ্ছেদ ঘটে। কৈশোরে প্রেমকিশোর তার এক পিসির ভাশুরঝির প্রেমে পড়ে। সেই মেয়েটির নাম ছিল হাসি। হাসি যত না হাসত তার চেয়ে বেশি কাঁদত। একবার শিয়ালদায় রথের মেলায় প্রেমকিশোর হাসিকে নিয়ে রথ দেখতে গিয়েছিল। রথ দেখতে গিয়ে সে তার কিশোরী প্রেমিকা হাসিকে এত বেশি তেলেভাজা খাইয়েছিল যে হাসি পেটের ব্যথায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। তার কান্না শুনে লোকজন ভিড় করতে থাকল, শেষে পুলিশ এসে দাঁড়াল। হাসি রাস্তায় উবু হয়ে বসে বমি করে অনবরত, আর আঙুল দিয়ে প্রেমকিশোরকে দেখায়, বলে, ওই ছেলেটা—ওই ছেলেটা—। যাই হোক, প্রেমকিশোর খুব বেঁচে গিয়েছিল। কলেরা হতে হতে হাসিও বেঁচে গেল। কিশোর প্রেমটাও রথের মেলায় ভেঙে গেল প্রেমকিশোরের। তারপর যৌবনে প্রেমকিশোর বার তিনেক নিজেকে লটকে ফেলার চেষ্টা করেছে, একবার বেণুর সঙ্গে ; পরের বার সুরূপার সঙ্গে ; আর শেষ বার আইভির সঙ্গে। বেণুর বাবা প্রেমকিশোরের পিছনে তাঁদের বিশাল অ্যালসেশিয়ানকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন, ফলে প্রেমকিশোর বেণুদের বাড়িতে ঢুকতেই পারল না। সুরূপার বেলায় প্রেমকিশোর একদিন ট্যাক্সি করে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল সুরূপাকে নিয়ে। সন্ধেবেলায় রেড রোডে গাড়ি গেল খারাপ হয়ে, অ্যাক্সেল গেল ভেঙে। ড্রাইভার বলল, বাবু তোমরা একটু গাড়িটা দেখো। আমি মিস্ত্রি ডেকে আনছি। ডাইভার গেল তো গেল, আর আসে না। প্রথম প্রথম প্রেমকিশোরের ভালই লাগছিল—এমন নির্জনে নিরিবিলিতে সুরূপাকে পাওয়া ভাগ্যের কথা। একটু চঞ্চল হয়ে সুরূপাকে প্রেম-ট্রেমের কথা বলতে গিয়েই ধাক্কা খেল প্রেমকিশোর। সুরূপা বলল, এ সমস্ত তোমার চালাকি! তুমি ড্রাইভারের সঙ্গে সাঁট করেছ। ছোটলোক, অসভ্য, ইতর। দাঁড়াও না, পুলিশের গাড়ি এবার এলেই আমি হাত দেখাব। তোমায় আমি দেখাচ্ছি।…

সুরূপার হাতে পায়ে ধরে প্রেমকিশোর বাঁচল। একটা প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে চলে গেল সুরূপা; আর প্রেমকিশোর ট্যাক্সির মধ্যে ভূতের মতন বসে থাকল। ঘণ্টা দুই পরে ট্যাক্সিঅলা ফিরল, বলল, আমার সর্বনাশ হল বাবু, আপকো তো মজা হল, থোড়া জাদা টাকা ছাড়ন, পঁচাশ…। প্রেমকিশোর নাক কান মলে পালাল। শেষে এল আইভি। নাচ জানত। প্রেমকিশোরকে মাস কয়েক বেশ নাচাল, তারপর একদিন প্রেমকিশোরকে দিয়েই বম্বের একটা ফার্স্ট ক্লাস টিকিট কাটিয়ে বম্বে চলে গেল ফিল্মে চান্স খুঁজতে।

প্রথম থেকে পর পর এতগুলো ধাক্কা খাবার পর প্রেমকিশোর নারী—বিদ্বেষী হয়ে উঠল। প্রতিজ্ঞা করল, বিয়ে করবে না। মা যতদিন বেঁচে ছিল বিয়ে বিয়ে করত, মা মারা যাবার পর সেদিক থেকেও নিশ্চিন্ত। বাবা আগেই গিয়েছেন। নিজের বলতে আর কেউ নেই। ছোট বোন বিয়ের পর মাদ্রাজে থাকে। আসেও না। নির্ঝঞ্ঝাটে ছিল প্রেমকিশোর; বাপের আমলের ছোট্ট বাড়ি, আর বেসরকারি অফিসে চাকরি—চমৎকার ছিল।

বন্ধুবান্ধবদের বিয়ে হয়ে যেতে লাগল, বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্চা; তাদের নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখত প্রেমকিশোর আর হাসত, বলত, নে এবার ঠেলা বোঝ ; আমি আমার লর্ড হয়ে আছি। বন্ধুরা প্রেমকিশোরকে বিয়ের উপকারিতা সম্বন্ধে বোঝাত, জ্ঞান দিত, ফুঁসলাবার চেষ্টা করত। প্রেমকিশোর বলত, তোমরা লেজ কেটেছ, বেশ করেছ, আমি লেজ কাটছি না, ভাই।

গত বছর প্রেমকিশোর হুট করে এক বড় অসুখে পড়ল। ভুগল মাসখানেক। বন্ধুবান্ধব তাদের স্ত্রীরা প্রেমকিশোরের দেখাশোনা করল। বাড়ির চাকরটা কত আর পারবে। অসুখ থেকে উঠে প্রেমকিশোরের মনোভাব খানিকটা পালটে গেল। বছর সাঁইত্রিশ বয়েস হয়ে গেল, দেখতে দেখতে চল্লিশ হবে, তারপর চল্লিশের ওপারে হেলে পড়বে। আফটার ফরটি মানেই দাঁত আলগা হওয়া, চুল উঠে যাওয়া, চোখে দোতলা চশমা পরা, ব্লাড সুগার আর প্রেশারের জন্যে উৎকণ্ঠা, মানে ‘শেষের সে-দিনের জন্যে’ ঘন ঘন তাকানো।

অসুখের পর প্রেমকিশোর মনে মনে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের স্ত্রীর খোঁজ-খবর নেওয়া, সেবাযত্ন করা, পাশে বসে গল্প করা, এই সব দেখে শুনে তার মনে হল, বিয়ের একটা প্রয়োজন আছে। হাজার হোক, বউ থাকা মানে একজন কেউ থাকা, সে অন্তত প্রেমকিশোরকে দেখাশোনা করতে পারবে, অসুখ-বিসুখে মাথার কাছে বসে থাকবে, আর প্রেমকিশোর মারা যাবার পর অন্তত এই বাড়িটার মালিক হবে।

প্রেমকিশোর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। বন্ধুদের বলল, বেশ, বিয়ে আমি করব। কিন্তু মেয়ে নয়—মহিলা। বয়েস মিনিমাম পঁয়ত্রিশ হতে হবে। মোটামুটি দেখতে হলেও চলে যাবে, তবে মোটা চলবে না। জাতের ব্যাপারে আমার কোন প্রেজুডিস নেই। মহিলাকে শিক্ষিতা হতে হবে। আর আমার অন্য শর্ত, বাপের বাড়ির গুষ্টি আমি অ্যালাও করব না।

বন্ধুরা বলল, ঠিক আছে; একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দি—দেখা যাক।

তিন মাসে তিন রবিবার বাংলা কাগজে প্রেমকিশোরের বিয়ের পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন বেরুল। চিঠি এল শ’ দেড়েক। বন্ধুরা সর্ট করল, চিঠি পড়ল, আলোচনা করল, কোন মেয়েকেই পছন্দ হল না প্রেমকিশোরের।

দেখতে দেখতে আরও মাস দুই কাটল। এমন সময় আচমকা প্রেমকিশোরই ইংরেজি কাগজ থেকে এক বিজ্ঞাপন এনে হাজির করল। এমন বিজ্ঞাপন সচরাচর চোখে পড়ে না, আদপেই পড়ে কি না কে জানে, মেয়েপক্ষ নিজেই নিজের বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

ব্যাপারটা প্রেমকিশোরকে খুবই রোমাঞ্চিত করেছিল। এই তো হওয়া উচিত। কোন ন্যাকামি নেই, একেবারে সোজাসুজি ব্যাপার। মেয়ে লিখেছে: ‘আমার বয়েস ছত্রিশ, ডক্টরেট করার পর আমি আরও রিসার্চ করছি, আমার গায়ের রং এবং চেহারা সাধারণ। যে কোন ভদ্রলোক, বয়েসে অন্তত আমার সমবয়স্ক হবেন, এক আধ বছরের ছোটতেও আপত্তি নেই। অবশ্যই তিনি শিক্ষিত ও উপার্জনসক্ষম হবেন, বিবাহের ব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। পছন্দ হলে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-পরিচয় করব।’

বন্ধুরা বিজ্ঞাপন দেখে রীতিমত ভড়কে গিয়েছিল। বলেছিল, এ তো মাইরি ডেঞ্জারাস মহিলা।

প্রেমকিশোর বলেছিল, এমন মেয়েই আমি সারা জীবন ধরে খুঁজছি। স্ট্রেট, ডিরেক্ট, প্রোগ্রেসিভ।…তোদের ন্যাকামি নেই, লজ্জা নেই, বাজে টলানি নেই। একেই শালা মডার্ন ক্যারেকটার বলে। রিয়েল লিব মুভমেন্ট।

বন্ধুরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল, তা হলে লেগে পড়।

প্রেমকিশোর লেগে পড়ল। চিঠি লিখল পোস্ট বক্স-এর নম্বরে। দিন কুড়ি বাইশ পরে জবাব পেল। নাচতে নাচতে বন্ধুদের এসে বলল, ইন্টারভিউতে ডেকেছে রে। পার্ক স্ট্রিটে চিনে দোকানে ইন্টারভিউ হবে।

গুহ বলল, “জেনারেল নলেজের বইটা পড়ে যাস।”

প্রেমকিশোর বলল, “হ্যাত, আমি তার চেয়েও একটা টেরিফিক বই পড়ছি, আমেরিকান বই। কী নাম জানিস? হাউ টু উইন এ উইমেন ইন বেড অ্যান্ড আউট অফ বেড?”

গুহ বলল, “বেডটাও কি সাজিয়ে ফেলেছিস?”

প্রেমকিশোর বলল, “ডোন্ট বি ভালগার। সি ইজ এ লেডি…মাইন্ড দ্যাট।”

এরপর মাস দেড়েকের মধ্যে প্রেমকিশোর রেজেস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেলল। বন্ধু আর বন্ধুর স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের ভূরিভোজ দিল। বাড়িতেই। তার স্ত্রীকে দেখলেই সমীহ করতে ইচ্ছে করে। মোটামুটি লম্বা চেহারা, ছিপছিপে গড়ন, চোখে মোটা চশমা, ভীষণ সিরিয়াস মুখ, ধারালো চোখ, নাকটা লম্বা, মাথার চুল বব করা। কথার মধ্যে দু-চারটে হিন্দি চলে আসে। শাড়ির চেয়ে ঢিলে প্যান্ট আর মেয়ে-শার্ট পরতে পছন্দ করে বেশি। নাম, শশিকলা।

শশিকলা নামটা বন্ধুদের পছন্দ হয়নি। এ আবার কি নাম? পুরানো।

প্রেমকিশোর বলল, “শুধু শশী বলবি। কী সুন্দর। ও আবার হিন্দি দেশেই মানুষ কি না—ওই রকমই নাম—ওরা বলে শাশি…”

মন্মথ বলল, “ভালই হয়েছে। প্রেম-শশী। তোরা মিলে যা ভাই, আমরা চক্ষু সার্থক করি।”

সেই ঘটনার পর আজকের এই ঘটনা। প্রেমকিশোর বিয়ের দশ বারো দিনের মাথায় রক্ত-আমাশায় ভোগা রোগীর মতন চিঁ চিঁ করতে করতে ছুটে এসেছে বন্ধুদের কাছে। এই কদিন যে বন্ধুরা খোঁজখবর নেয়নি, তার কারণ, প্রেমকিশোর বলে রেখেছিল সে নতুন বউ নিয়ে হনিমুন করতে পুরী ওয়ালটেয়ার যাবে। বন্ধুরা ভেবেছিল, প্রেমকিশোর কলকাতায় নেই, প্রেম-মিলন করে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের ধারে ধারে।

দুই

বাড়ির ভেতর থেকে চা এসে গিয়েছিল।

চা আর সিগারেট খেতে খেতে সুবীর বলল, “এবার ব্যাপারটা বল?”

প্রেমকিশোর আস্তে আস্তে চা খাচ্ছিল। সিগারেট ধরিয়ে নিল একটা। তারপর বলল, “সব কথা বলতে হলে মহাভারত হয়ে যাবে। অত কথা বলতে পারব না, সময় নেই। ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”

‘ছুটি নিয়ে পালিয়ে এসেছি মানে?” মন্মথ জিজ্ঞেস করল।

“আর বলিস না ভাই, আমি এখন হিউম্যান গিনিপিগ। চব্বিশ ঘণ্টা ওই মেয়েছেলের অবজারভেশানে আছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। একেবারে চোখে চোখে রেখেছে।”

বন্ধুরা হাঁ হয়ে গেল। পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। এ রকম হবার কথা নয়। তবে কি শশিকলা তার ছত্রিশ বছরের জমানো প্রেম দিয়ে প্রেমকিশোরকে জমিয়ে ফেলতে চাইছে? এ তো ভাবাই যায় না আজকালকার দিনে। এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দেবে না, হলেই অচেতন হবে—এসব বৈষ্ণব কাব্যে হত! দারুণ ব্যাপার তো!

সুবীর বলল, “তুই বলছিস কি, প্রেম? এ তো তোর ভাগ্য! ছত্রিশ বছর বয়েসের মহিলা, তুই তার ফার্স্ট হাজবেন্ড অ্যান্ড লাভার! ভেবে দেখ, যৌবন যায়-যায় বলে কেমন সলিড প্রেমে তোকে ধরে রাখতে চাইছে শশী।’’

প্রেমকিশোর ক্ষুন্ন হয়ে বলল, “যথেষ্ট হয়েছে ভাই, কাটা ঘায়ে আর নুনের ছিটে কেন?”

মন্মথ হাত তুলে বন্ধুদের বলল, “দাঁড়া, তোরা চুপ কর। আমি ব্যাপারটাকে বুঝি।’’বলে সে প্রেমকিশোরের দিকে তাকাল, বলল, “শশী তোকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে চোখে রাখছে এইটেই তোর মেইন কমপ্লেন?”

“হ্যাঁ, আমার আরও হাজারটা কমপ্লেন আছে।’’

“একটা একটা করে বল। নয়ত গুলিয়ে ফেলব।…তোর অফিস কবে?”

“এক মাস ছুটি নিয়েছিলাম। মাত্র পনেরো দিন হয়েছে। আরও পনেরো দিন-মর্নিং টু নাইট ওর কাছে থাকতে হবে। বাবা গো, আমি মরে যাব।”

গুহ বলল, “গোড়া থেকে শোনাই ভাল, মন্মথ। আমার মনে হচ্ছে, প্রেম নিজের মতন করে বলুক। তার যেখান থেকে ইচ্ছে।”

সুবীর বলল, “সেই ভাল। …প্রেম, তুই প্রথম থেকে—তোর যা বলতে ইচ্ছে করে। বল। আমরা শুনছি।”

প্রেমকিশোর চা শেষ করল। একটা সিগারেট শেষ করে আরও একটা ধরিয়ে নিল। তারপর করুণ মুখ করে বলল, “ভাই, প্রথম দিন, দি ভেরি ফার্স্ট নাইট আমরা তো তোদের মতন ফুলশয্যা করিনি। তবু কিছু ফুল-টুল ছিল, নতুন চাদর, নতুন বালিশ, সেন্ট-টেন্ট একটু ছড়িয়ে দিয়েছিলাম বিছানায়। তোরা সব খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে এলি, আমরা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বিছানায় এলাম। আমার বুকের মধ্যে একটা টেনিস বল যেন লাফাচ্ছিল ভাই। রিয়েলি, কেমন যেন আবেশও লাগছিল, আবার নার্ভসও লাগছিল। সেই যে বইটা পড়েছিলাম, হাউ টু উইন এ উইমেন ;সেই টেকনিকে প্রথমেই খুব স্মার্ট ভাবে শশীকে বললাম, তোমার জন্যে দুটো জিনিস কিনে রেখেছি—বলে দামি পোখরাজ বসানো একটা আংটি, আর সাদা পাথর বসানো কানের গয়না ওর হাতে তুলে দিলাম। আংটিটা পরিয়ে দিলাম। কানের গয়নাটা শশী রেখে দিল। শুরুটা ভালই হল। দুজনে বিছানায় বসলাম। দু-পাঁচটা কথা হল। আমি বেশ হেসে হেসে কথা বলছিলাম। হঠাৎ ভাই শশী আমায় কি বলল জানিস?”

“কী?’’

“বলল, মানে আমায় জিজ্ঞেস করল, তোমার অত চোখ পিটপিট করে কেন? মিনিটে তিরিশ বার?”

সুবীর বলল, “সে কি রে?”

প্রেমকিশোর বলল, “হ্যাঁ ভাই, ফর গডস সেক, ওই কথা বলল। বলার পর আমার চোখ পিটপিট বেড়ে গেল; মিনিটে থার্টি থেকে বাড়তে বাড়তে ফর্টি ফিফটি হয়ে গেল।”

“তারপর?”

“তারপর আরও একটা ব্লো মারল।”

“ব্লো? মানে ঘুঁষি।”

“ঘুঁষি নয়, দাবড়ানি। বলল, কথা বলার সময় তোমার খানিকটা তোতলামি আছে, তুমি প্রপার ওআর্ড মনে করতে পারো না, ইউ মিস ইট। হোয়াই?”

মন্মথ বলল, “যাঃ বাব্বা। ফুলশয্যা করতে বসে এই ডায়লগ?”

প্রেমকিশোর পরম দুঃখীর মতন বলল, “হ্যাঁ, ভাই, এই ডায়লগ। রাত দেড়টা পর্যন্ত আমার ডিফেক্ট সম্পর্কে কত রকম কি শুনতে হল। তারপর বাতি নিভিয়ে শুলাম।”

গুহ এবার একটু গলা ঝাড়ল।

প্রেমকিশোর মাথা নেড়ে বলল, “গলা ঝাড়ার দরকার নেই। যা ভাবছ তা নয়। আমি তখন এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছি একটার পর একটা অ্যাটাকে যে আমার কোলাপ্‌স করার অবস্থা। একেবারে শালা ডেড হয়ে শুয়ে থাকলাম। আর শশী একেবারে চাঁদের মতন ঢলে পড়ল। ও দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল। আমি সারারাত জেগে থাকলুম।”

গুহ বলল, “টাচ লাইনের বাইরে বেরুতে পারলি না?”

“টাচই হল না তো বাইরে!”

কেসটা যে রীতিমত গোলমেলে সুবীর হাজরা যেন তা বুঝতে পারল। বুঝে চুপ করে থাকল।

প্রেমকিশোর তার মাথার রুক্ষ চুলে আঙুল চালাল। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল। বুকে হাত বোলাল।

মন্মথ বলল, “পরের দিন কী হল?”

“পরের দিন সকাল থেকেই আমার ওপর অবজারভেশান শুরু হয়েছে।’’

“মানে?”

“মানে আমার হাঁটা, চলা, কথা বলা, দাঁত মাজা, খাওয়া, শোওয়া, জামাকাপড় পরা, তাকানো সব এখন শশিকলার অবজারভেশানে রয়েছে।”

“কেন?”

“শশী সাইকোলজি নিয়ে ডক্টরেট করেছে।”

“কোন ইউনিভার্সিটি?”

“বিদর্ভ গন্ধর্ব কোন একটা জায়গা থেকে হবে। বছর কয়েক ওদিকেই কোথাও সাইকো-অ্যাট্রিস্ট হিসেবে কাজ করেছে। তারপর কলকাতায় এসেছে। এখন ওর হায়ার রিসার্চ চলছে।”

“হায়ার রিসার্চ?”

“তাই তো বলে ভাই, বিয়ের পর পাঁচ বাক্স বই, দু বাক্স কাগজপত্র, এক বাক্স নানা ধরনের খেলনা টাইপের জিনিস আর সব কি কি এনেছে।”

“এখন কী তোকে নিয়ে রিসার্চ করছে?”

“হ্যাঁ ভাই। আমি এখন শশিকলার হিউম্যান গিনিপিগ। চব্বিশ ঘণ্টা পিছনে লেগে আছে।”

সুবীর কপালে করাঘাত করে বলল, “সর্বনাশ!”

প্রেমকিশোর বলল, “শুধু সর্বনাশ নয়, আমার জীবননাশ হতে বসেছে।”

গুহ মাথা চুলকে বলল, “তোকে নিয়ে কী রিসার্চ করছে, প্রেম? রিসার্চের সাবজেক্টটা কী?”

প্রেমকিশোর বলল, “ভাই, আমি সাইকোলজির কিছু বুঝি না। তবে কথাবার্তা শুনে যা মনে হয় মানুষের ডেন্টাল ফরমেশান তার হিউম্যান নেচারকে ইনফ্লুয়েন্স করছে—সেই নিয়ে এক গবেষণা।”

কথাটা শোনামাত্র তিন বন্ধু এক সঙ্গে আঁতকে উঠল। আঁতকে উঠে তিনজনেই তাদের দাঁত উন্মুক্ত করে বসে থাকল।

প্রেমকিশোর বলল, “ব্যাপারটা আমিও বুঝি না। তবে শশীর কথা থেকে মনে হয়, মানুষের দাঁতটাই আসল; দাঁত দেখে তার স্বভাব প্রকৃতি—ফিজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল, দুইই বলে দেওয়া যায়।”

সুবীর বলল, “বলিস কী! দাঁত দেখে শুনেছি ঘোড়ার বয়েস আন্দাজ করা যায়। আমরা কী ঘোড়া?”

প্রেমকিশোর সদুঃখে বলল, “ঘোড়াও ভাল; আমরা ঘোড়ারও অধম; গাধা।”

গুহ আর মন্মথ দাঁতে দাঁত বাজাল। দেখল, দাঁতগুলো শক্ত না নরম।

মন্মথ বলল, “তোকে কী করতে হয়? বউয়ের কাছে দাঁত বের করে বসে থাকতে হয়

মাথা হেলিয়ে প্রেমকিশোর বলল, “একজ্যাক্টলি। সকালে ঘণ্টা দেড়েক; দুপুরে ঘণ্টাখানেক। আর রাত্রে কম করেও দু’ ঘণ্টা।”

সুবীর উৎকট এক শব্দ করল। মনে হল, যেন বাব্বা বলল। তারপর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে থাকিস একটু দেখা তো।”

প্রেমকিশোর বলল, “কী ভাবে আর থাকব! শশী চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে থাকে, টেবিলে দিস্তে দিস্তে কাগজ, হাতে কলম। আমি হাত তিনেক দূরে একটা টুলের ওপর দাঁত বের করে বসে থাকি। কখনো তার দিকে তাকাই, অবশ্য তাকাতে বললে, আর না হয় জানলার দিকে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে।…শশী দেখে আর কাগজে কি লেখে। দেখে আবার লেখে। মাঝে মাঝে এসে ফরসেপ দিয়ে মাড়ি উঠিয়ে ভেতর দিকের দাঁত দেখে যায়।”

বন্ধুরা থ মেরে গেল। এমন ঘটনা তারা জীবনে শোনেনি। মাথায় কিছু আসছিল না।প্রেমকিশোরের দুঃখে তারাও বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল।

প্রেমকিশোর বলল, “এখন বল, আমি কী করি! আমার ত্রিশূল পর্বতে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।…সাধে কি ব্যাচেলার ছিলাম।”

কথাটা ঠিকই। প্রেমকিশোর যতদিন অবিবাহিত ছিল, বেশ ছিল, বিয়ে করেই ডুবল। শুধু ডুবল নয়। পনেরো দিনেই যে হাল তাতে এই অবস্থা চলতে থাকলে মাসখানেকের মধ্যেই ওকে নিমতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।

তিন বন্ধুই গুম। মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। প্রেমকিশোরের এই বিপদে কি করবে, বুঝে উঠতে পারছে না।

শেষে মন্মথ প্রেমকিশোরের ওপরই চটে গেল। বলল, “তখনই তোকে বলেছিলাম, এইসব বিয়ে করিস না। মেয়েছেলে নিজের বিয়ের বিজ্ঞাপন নিজে দিচ্ছে, ব্যাপারটা গোলমেলে। তুই বেটা এমন উজবুক, আমাদের কথা শুনলি না, দারুণ দারুণ বলে নাচতে লাগলি। এখন বোঝ, সামলা তোর শশিকলাকে। দন্ত শোভা প্রদর্শন করে বসে থাক।” রাগের মাথায় মন্মথ ভাল ভাল বাংলা বলে ফেলল। এক কালে কাব্যচর্চা করতে বলেই বোধহয়।

প্রেমকিশোর অপরাধীর মতন বলল, “ভাই, যা করেছি ভুল করেছি। গাধার মতন কাজ করেছি। আর করব না। কিন্তু এখন আমার কী হবে? হয় ত্রিশূল, না হয় সুইসাইড। সুইসাইড করতে আমার ইচ্ছে নেই। বড় পেইনফুল। মারা যাবার পরও কাটাকাটি করবে। শরীরটাকে আমি মুদ্দাফরাসের হাতে দিতে চাই না।”

সুবীর বলল, “শোন, তোর প্রবলেমটা ভেরি ডিফিকাল্ট। ঝট করে ভেবে কিছু বলা যাবে না। লেট আস থিংক ওভার দি ম্যাটার। আমরা ভাবি। আলোচনা করি। পরে তোকে একটা কিছু বলব। কী বল, গুহ?”

গুহ বলল, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা কঠিন। ভাবতে হবে।”

“তোরা আমায় ধাপ্পা দিচ্ছিস?” প্রেমকিশোর সন্দেহ প্রকাশ করল।

“না, না, ধাপ্পা দেব কেন! তুই আমাদের পুরনো বন্ধু। তোর লাইফ মিজারেবল করে একটা মেয়ে পার পেয়ে যাবে—তা হয় না। এটা চ্যালেঞ্জ। আমরা পুরুষ হয়ে একটা মেয়ের বাঁদরামির কাছে হেরে যাব?”

“বাঁদরামি বলিস না ভাই”, প্রেমকিশোর বাধা দিয়ে বলল, “হাজার হোক লিগাল ওয়াইফ।’’

“যা যা বাজে বকিস না; ওয়াইফের নিকুচি করেছে। তুই শনিবার আয়।” “কেমন করে আসব?”

“ধাপ্পা মেরে আসবি শালা। আমরা থাকব। তখন তোকে বলব কী করা যায়। বুঝলি ?…আর দেরি করিস না, পালা। তোর শশিকলা নাইট সিটিংয়ের জন্যে বসে আছে।”

প্রেমকিশোর উঠে পড়ল। দু’ ঘণ্টার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। ঘড়ি দেখল। তারপর বলির পাঁঠার মতন কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, “ভাই, তোরাই আমার শেষ ভরসা। যা হয় করিস। হয় বাঁচাস, না হয় মেরে ফেলিস। আচ্ছা যাই।”

প্রেমকিশোর চলে যাবার পর তিন বন্ধু পরস্পরের দিকে তাকাল। তিনজন তিনজনকে দাঁত দেখাল। তারপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকল।

তিন

প্রেমকিশোর যা বলেছিল সেটা যে মিথ্যে নয়, পরের দিনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে সেটা বোঝা যাবে।

পরের দিন সকালে প্রেমকিশোর ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে চা খেতে বসল বারান্দায়।

টেবিলে চা সাজিয়ে শশিকলা বসে ছিল। বারান্দায় যথেষ্ট আলো রয়েছে; রোদও এসেছে। ছোট টেবিল। আলো আর রোদ যেদিকে বেশি প্রেমকিশোরের বসার চেয়ার সেদিকেই। উল্টো দিকে শশিকলা বসে আছে। তার একপাশে টেবিলের ওপর কিছু সাদা কাগজ ক্লিপ দিয়ে আঁটা। পাশে একটা ফাউন্টেন পেন। টেবিলে চায়ের পট, দুধ, চিনি ; আর তিন চার রকম খাবার। একেবারে কড়কড়ে টোস্ট ; এক প্লেট শক্ত মটর, গোটা চারেক কলা। সকালে কি কি খাবে প্রেমকিশোর শশিকলা ঠিক করে রাখে আগে থেকেই।

প্রেমকিশোর চেয়ারে বসে গোবেচারার মতন মুখ করে হাসল একটু। তারপর দু’ পাটি দাঁত বের করে বসে থাকল।

শশিকলা ডাক্তারের মতন তীক্ষ্ণ চোখ করে দাঁত দেখল। তারপর বলল, “ক’ দাফে করেছ? টু অর থ্রি?”

প্রেমকিশোর আঙুল তুলে দুই দেখাল।

“আই টোল্ড ইউ টু মেক থ্রি। মনে থাকে না?”

প্রেমকিশোর বলল, “নতুন পেস্ট; মাড়ি জ্বলে যাচ্ছিল।”

“জ্বলে যাচ্ছিল! বাচ্চে কি মাফিক বাত মাত্‌ বোলো জি।”

শশিকলা কলম তুলে নিয়ে কাগজে কি যেন লিখল। শশিকলার মুখের চেয়ে চশমা যেন বড়, মোটা মোটা কাচ, চৌকোনো ফ্রেম, কাচের মধ্যে আবার গোল গোছের অস্পষ্ট দাগ। নাক প্রচণ্ড লম্বা। বব করা চুল। পাঁশুটে রং চুলের। গায়ে হালকা নীল শাড়ি, আঁটসাঁট করে পরা, গায়ের ব্লাউজ ধবধবে সাদা। চোখে-মুখে অবাঙালিয়ানার ছাপ আছে। মুখ দেখতে মন্দ নয়, কিন্তু সারা মুখে কেমন রুক্ষতা রয়েছে। চোখ দুটো ভীষণ তীব্র লাগে।

শশিকলা চা ঢালবার আগে হাত দিয়ে কলার প্লেটটা দেখাল। বলল, “কেলা খাও পহেলে।’’

প্রেমকিশোর বলল, “তুমি আমার কাছে হিন্দি বোলো না। আমি বুঝতে পারি না। আইদার ইউ ম্পিক ইন ইংলিশ অর ইন বেঙ্গলি।’’

শশিকলা স্বামীর দিকে তাকাল। “অল রাইট। কোলা খাও।”

প্রেমকিশোর চটে গেল। বাংলা নিয়ে ঠাট্টা। তুমি কোন মহারানি গো যোধপুরের? কলার প্লেট টেনে নিয়ে বলল, “কোলা নয় কলা। শশিকোলা কিংবা শশিকেলা বললে তোমার শুনতে ভাল লাগবে?”

শশিকলা চোখের চাউনিতে যেন বিস্ময় ফোটাল। বলল, “আচ্ছা! ইউ আর শোয়িং সাম ক্যারেজ।”

প্রেমকিশোর কলার খোসা ছাড়িয়ে মুখে দিল।

শশিকলা চা ঢালতে লাগল। হঠাৎ শশিকলা বলল, “স্টপ।”

প্রেমকিশোর ঠোঁট বন্ধ করল, মুখের মধ্যে কলা।

শশিকলা বলল, “দাঁত দেখাও।”

প্রেমকিশোর দাঁত বের করল। মুখের কলা গলায় আটকে যায় আর কি!

শশিকলা দেখল। তারপর আবার কলম তুলে কি লিখল। লেখা শেষ হয়ে গেল। “ফ্রম সফট টু হার্ড। আজ তুমি প্রেম, নার্‌ম চিজ খাবে ফাস্ট, উসকি বাদ হার্ড, হার্ডর। আমি তোমায় অবজার্ভ করব। সমজ মে আয়া?”

প্রেমকিশোর মাথা নাড়ল। —না।

“কাহে?”

“হিন্দি আমি বুঝি না। বাংলায় বললা।”

শশিকলা দু মুহূর্ত যেন কি ভাবল, তারপর বলল, “সরি।” বলে বাংলায় বলল “পহেলে কলা খাবে নার্‌ম চিজ; নেক্সট খাবে টোস্ট, বাদ মে মটর।”

কাল বন্ধুদের কাছ থেকে ঘুরে আসার পর প্রেমকিশোরের মনে খানিকটা সাহস এসেছিল। তা ছাড়া কাল রাত্রে সে স্বপ্ন দেখেছে, প্রেমকিশোর ঝোলাঝুলি কাঁধে করে লাঠি হাতে গেরুয়াশোভিত মুণ্ডিতমস্তক হয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হিমালয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। খুব সম্ভব ত্রিশূল পর্বতেই ডেরা বাঁধতে যাচ্ছে। স্বপ্নটা তাকে তাড়া দিচ্ছিল, চাগিয়ে দিচ্ছিল। সংসার যদি ছাড়তেই হয় সে বীরের মতন ছাড়বে, ভীরুর মতন নয়। ভেতরের এই বিদ্রোহ প্রেমকিশোরকে সামান্য সাহসী করে তুলছিল।

কলা খেয়ে আরও কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে প্রেমকিশোর বলল, “তোমার মুখে বাংলা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে, শশী। প্লিজ বাংলাতেই কথা বলো।”

শশিকলা প্রেমকিশোরের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল।

মাখন লাগানো বিস্কিট নিল শশিকলা, মুখে দিল, দিয়ে দাঁতের ডগায় ভাঙল। চমৎকার দাঁত শশিকলার, ঝকঝকে, সুবিন্যস্ত, সাজানো। শশিকলা ধীরে ধীরে খায়, ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে।

প্রেমকিশোর সাহস করে বলল, “তুমি আমায় একটু বুঝিয়ে দেবে।”

“কী?”

“এই দাঁতের সাইকোলজিটা?” বলে প্রেমকিশোর স্ত্রীকে সর্বোৎকৃষ্ট তেল দিচ্ছে এ রকম একটা ভাব করে বলল, “তুমি দারুণ লার্নেড, অর্ডিনারি মেয়েদের মতন নও, তোমার সাংঘাতিক অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার, রিসার্চের সাবজেক্টটাও ভেরি ডিফিকাল্ট। আমার দারুণ ইন্টারেস্ট লাগছে।”

শশিকলা কথাটা কানে তুলল না। বলল, “নার্‌ম জিনিস যখন খাও তখন তোমার দাঁতের ফিলিং কেমন হয়?”

প্রেমকিশোর চুপ। জিভটা দাঁতের ওপর বুলিয়ে নিল। তারপর বলল, “নরম জিনিস মানে ডাল ভাত পেঁপে কলার কথা বলছ?”

“জরুর।”

“নাথিং স্পেশ্যাল। কিছুই ফিল করি না। আরও নরম কিছু খেতে পারলে ডিফারেন্সটা বুঝতে পারতাম।”

“আরও নার্‌ম?”

প্রেমকিশোরের ইচ্ছে হল রহস্যময় দৃষ্টিতে একবার শশিকলার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে। সাহস হল না। সাহসের বাড়াবাড়ি ভাল নয়। প্রেমকিশোর বলল, “আরও নরম কিছু থাকতে পারে।”

“এনি ফুট?”

“ফল!…হ্যাঁ তা ফলও বলা যায়।”

“তো বোলো— ’’

মাথা চুলকে প্রেমকিশোর বলল, “বিম্বোধর!”

“কেয়া?”

“দ্যাটস এ ফুট। ক্ল্যাসিকাল ফুট। ওরই বড়সড় ফল হল পয়োধর।”

“আমার মালুম নেই!”

“যেমন ধর খরমুজ আর তরমুজ। দে আর মোর অর লেস এ সেম কাইন্ড অফ ফ্রুট। বাট দে ডিফার ইন সাইজ অ্যান্ড টেস্ট।”

“তুমি কী নাম বললে জি?”

“বিম্বোধর আর পরোধর।”

“আই হ্যাভ নেভার হার্ড অফ ইট? কলকাত্তায় পাওয়া যায়?”

প্রেমকিশোরের ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। হাসি চাপতে না পেরে সে পটাস করে একবার চোখ টিপে দিল। মনে মনে বলল, শশী, কলকাতায় কেন এই বাড়িতেই পাওয়া যায়। তুমি মাইরি কী ক্রুয়েল।

শশিকলা ঝপ করে কলম তুলে নিল! বলল, “নার্‌ম ফুড খাবার পর তোমার আঁখ নাচে। দ্যাটস ভেরি ফানি। আই মাস্ট মেক এ নোট অফ দিস পারটিকুলার এফেক্ট…” বললে বলতে শশিকলা খসখস করে নোট লিখতে লাগল।

প্রেমকিশোর বিপদ বুঝে আবার চোখ পিটপিট শুরু করল।

টোস্টে হাত দিল প্রেমকিশোর। কড়কড়ে টোস্ট। মাখন দেওয়া হয়নি। মাখনে নরম হয়ে যেতে পারে বলেই বোধহয়।

প্রেমকিশোরের দাঁত অত মজবুত নয়। রীতিমত কষ্ট করে খেতে হচ্ছিল। এরপর শক্ত মটরদানা খেতে হবে। চোখে জল চলে আসছিল প্রেমকিশোরের। শশিকলা প্রথম কাপ চা শেষ করে আরও এক কাপ চা ঢেলে নিল। নিয়ে হাফ—বয়েল ডিমের প্লেটটা টেনে নিল।

প্রেমকিশোর মনে মনে গালাগাল দিয়ে বলল, শালা, আমার বেলায় সব শক্ত, আর তোমার বেলায় নরম! ঠিক আছে, দু’ দিন সুখ করে নাও, তারপর দেখবে প্রেম কোথায় যায়, সোজা ত্রিশূল পর্বতে চলে যাবে।

হাফ—বয়েল খেতে খেতে শশিকলা বলল, “তুমি আমার থিয়োরির কুছ জানতে চাইছিলে?” প্রেমকিশোর মাথা নাড়ল। তার দাঁত ব্যথা করছে। টোস্ট এত কড়কড়ে হয়? এ একেবারে লোহা!

শশিকলা তার দাঁতের থিয়োরি বোঝাতে লাগল। মানুষের দাঁতই তার চরিত্র, দাঁতই তার ইমোশানকে বুঝিয়ে দেয়। যেমন, যাকে আমরা সুন্দর বলি—ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক—সাধারণত তাদের দাঁত সুন্দর, ঝকঝকে, সুবিন্যস্ত। যাদের আমরা দেখতে খারাপ বলি তাদের দাঁত বেশির ভাগ সময়েই বিশ্রী। যথার্থ সুন্দরী কোন মেয়ের দাঁত খারাপ হতে পারে না, যেমন হেলেনের দাঁত ছিল সোনার মতন ঝকঝকে, ক্লিয়োপেট্রার দাঁত ছিল মুক্তোর মতন, কিন্তু দাঁতের ডগা ছিল ধারালো ; যিশুর ছবিতে তাঁর দাঁতের যে আকার তাতে বোঝা যায় এমন মহাপুরুষ বিরল। শ্রীরামকৃষ্ণের হাসির সময় তাঁর যে ক’টি দাঁত ছবিতে দেখা যায়—তাতে বোঝা যায়, এমন আত্মভোলা সরল সাধক মানুষ আর দ্বিতীয়টি হয় না।

শশিকলা দাঁতের সাইকোলজি বোঝাতে বোঝাতে বলল, “আদমি শয়তান হলে দাঁত বড়া হয়, এজ শারপ হয়, ফরমেশান খারাপ হয়। ইসলোক ক্রিমিন্যাল। বাচ্চারা ইনোসেন্ট, তারা হাসলে দাঁত দেখো, সো বিউটিফুল। ইউ নো প্রেম, অল দি হিউম্যান ইমোশান্স অফ পেইন অ্যান্ড প্লেজার—দাঁতকে রিঅ্যাক্ট করায়। আগর তুমি গোসা করো—দাঁতে দাঁত ঘষবে, তুমি মজা পাও, তুমি হাসো, অ্যান্ড সো অন…হাজারো একজাম্পল আছে জি।”

প্রেমকিশোর মটরদানা চিবোচ্ছিল; একটা শক্ত মটর খটাস করে দাঁতে লাগল। দাঁতের একটা পাশ ভেঙে গেল। ব্যথায় লাফিয়ে উঠল প্রেমকিশোর।

শশিকলা বলল, “কেয়া হুয়া?”

প্রেমকিশোর বলল, “মর গিয়া।”

চার

শনিবার দিন প্রেমকিশোর যথাসময়ে বন্ধুদের কাছে হাজির হল। তার ডানদিকের গাল সামান্য ফোলা, রুমাল চাপা দিয়ে রেখেছিল।

বন্ধুরা প্রেমকিশোরের জন্যেই অপেক্ষা করছিল; সে আসতেই সুবীর অভ্যর্থনা করে বলল, “আয় আয়, তোর জন্যেই ভাবছিলাম।”

প্রেমকিশোর গালের পাশ থেকে রুমাল সরাল।

মন্মথ বলল, “কী হয়েছে রে? ফোলা ফোলা দেখছি!”

প্রেমকিশোর বলল, “তোদের কাজ দেখে যাবার, তোরা শুধু দেখে যা; আর আমি তোদের চোখের সামনে তিলে তিলে মরি।”

গুহ বলল, “হয়েছে কী বলবি তো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রেমকিশোর গাল ফোলার বিবরণ দিল। বলল যে, শশিকলার হুকুমে সে শক্ত মটরদানা চিবিয়ে খাচ্ছিল। শক্ত জিনিস খাবার সময় তার দাঁত কেমন ব্যবহার করছে শশিকলা সেটা দেখছিল। হঠাৎ একটা মটরদানা এমন বেকায়দায় কষদাঁতের একটাতে লেগে যায় যে, নীচের দাঁতের একটা চাকলা ওপর থেকে উঠে বেরিয়ে গেল। মনে হল, ব্রহ্মতালু পর্যন্ত নড়ে গেল।

প্রেমকিশোর বলল, “সে কী যন্ত্রণা ভাই, ছুরির মতন ধারালো একটা পাশ গালে লেগে ঘা হয়ে গেল দুপুরের মধ্যেই। বিকেলে ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে ঘষিয়ে এলাম। ভাঙা জায়গাটায় এনামেল নেই, কিছু লাগলেই কনকন করছে, জল পর্যন্ত খেতে কষ্ট হয়। ওষুধ চালাচ্ছি। ফোলা আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে।”

সুবীর বলল, “তোর বউকে এখনও দাঁত দেখাচ্ছিস?

“মাঝে মাঝে দেখাতে হয়, সিটিং বন্ধ আছে। এখন নরম নরম জিনিস খাইয়ে মাঝে মাঝে দেখছে।’’

“কী খাওয়াচ্ছে?”

“ঢেঁড়স সেদ্ধ, পেঁপে সেদ্ধ, কলা সেদ্ধ,…এইসব।”

“তোর দাঁত ঠিক হয়ে গেলে আবার ধরবে?”

“ধরবে মানে, গলা টিপে ধরবে। এই দু-তিন দিন ঠিক মতন সিটিং হচ্ছে না বলে বেশ রেগে আছে।’’

গুহ চায়ের জন্যে হাঁক ছাড়ল।

মন্মথ বলল, “তুই কিছুই করতে পারছিস না, প্রেম?”

“নাথিং।” মাথা নাড়ল প্রেমকিশোর বিরস মুখে, “তোদের এখান থেকে ফিরে গিয়ে পরের দিন একটু গরম নিচ্ছিলাম, শালা দাঁত ভেঙে গেল।’’

সুবীর মাথা নেড়ে বলল, “ব্যাপারটা আমি বুঝতেই পারছি না। বউকে বললাম, হ্যাঁ গো, তুমি তো আমার মুখ দেখেই জীবন কাটাবে বলেছিলে, কিন্তু প্রেমের বউ বলেছে, সে প্রেমের দাঁত দেখেই জীবন কাটাবে। কোন ভালবাসাটা বেশি গভীর বলতে পারো?…তা মাইরি বউ যা একটা কথা বলল, সে আর পাবলিকলি বলতে পারব না। আজকালকার বউগুলো ব্যালেস্টিক মিসাইলের মতন দূর থেকে একেবারে জায়গা মতন হিট করে।”

মন্মথ হেসে উঠল। গুহও।

গুহ বলল, “সত্যি প্রেম, তুই বাঘের খাঁচায় পড়েছিস! তোর জন্যে বড় দুঃখ হয়।”

প্রেমকিশোর বলল, “বাঘের খাঁচা, কুমিরের মুখ, নদীর দ—যা খুশি বল, তবে এ-জীবনে এমন প্যাঁচে আমি পড়িনি। লাইফ সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে যাচ্ছে। জীবন, জগৎ, প্রেম, স্ত্রীলোক, সবই অলীক। বেঁচে থাকা অনর্থক।”.

মন্মথ বলল, “তুই শালা ফিলজফার হয়ে যাচ্ছিস নাকি! হয়ে যা, যে রকম কেস তাতে ত্যাগী, যোগী এসব না হলে আর বাঁচবি না।”

কিছুক্ষণ এইসব চলল। চা এল তারপর।

চা খেতে খেতে প্রেমকিশোর বলল, “তোরা কিছু ভাবতে পারলি?”

বন্ধুরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সিগারেট ফুঁকল।

শেষে গুহ বলল, “আমরা অনেক প্ল্যান করেছি; ভেবেছি; তার মধ্যে তিনটে প্ল্যান স্ট্যান্ড করছে। এর মধ্যে তোকে একটা বেছে নিতে হবে।”

প্রেমকিশোর বলল, “প্ল্যান তিনটে কী শুনি?’’

মন্মথ বলল, “প্রথম প্ল্যানটা তোর ত্রিশূল পর্বতে পালিয়ে যাবার মতন।”

“মানে?”

“মানে, তুই একদিন বাড়ি থেকে কেটে পড়। কোন খোঁজখবর বাড়িতে দিবি না। ইচ্ছে করলে কলকাতার বাইরে পালাতে পারিস ; কলকাতার বাইরে যেতে না চাস, কোনো হোটেলে কিংবা আমাদের কারও বাড়িতে থাকতে পারিস। আমাদের কারও বাড়িতে থাকলে আমাদের বউরা সন্দেহ করবে। কাজেই হোটেল ভাল।”

“তাতে কী হবে?”

“তোর শশিকলা ঘাবড়ে যাবে। সে একা বাড়িতে দুদিন থাকলেই বুঝতে পারবে, শশী ইজ দেয়ার, বাট কলা ইজ নট দেয়ার ; কলাহীন শশী মানে নো শশী। সপ্তাহখানেক তুই ডুব মেরে থাক শশীর বারোটা বেজে যাবে। তারপর আমরা কেউ তোর বউয়ের সঙ্গে দেখা করব ; বলব, প্রেম ত্রিশূল পর্বত থেকে লিখেছে, সে আর সংসার করবে না। এই টরচার সে সহ্য করতে রাজি নয়। আপনি যদি মশাই, চুক্তিপত্র লিখে দেন, প্রেমকে আর টরচার করবেন না, তাকে চব্বিশ ঘণ্টা আপনার সামনে দাঁত বের করে বসে থাকতে হবে না, স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনযাপন করবেন, তা হলে প্রেম ফিরতে পারে। নয়ত নয়।”

প্রেমকিশোর মন দিয়ে পরিকল্পনাটা শুনল। তারপর বলল, “এটা হবে না; শশী অত কাঁচা নয়। নেক্সট টাইম যখন বাড়ি ঢুকব, আমায় ফায়ার করে দেবে।…সেকেন্ড প্ল্যানটা বল, শুনি।”

গুহ বলল, “সেকেন্ড প্ল্যানটা আমার। আমি অত ন্যাকামি বুঝি না। আমার কথা হল স্ট্রেট ডিল, প্রত্যেক হাজবেন্ডের রাইট আছে স্ত্রীর সঙ্গে নর্মাল লাইফ এনজয় করা। তোকে প্রেম কড়া হতে হবে, সাহসী হতে হবে। তোর বউ যেই দাঁত বের করতে বলবে সঙ্গে সঙ্গে তুই টারজানের মতন লাফ মেরে বউয়ের ঘাড়ে গিয়ে পড়বি। পড়ে বউকে নিয়ে বিছানায় ধরাশায়ী হয়ে যাবি। যেখানে সেখানে বার কয়েক কামড়ে দিবি, জোরে কামড়াবি না বেটা প্রথমে, ধীরে কামড়াবি, তাতেও বাগ না মানলে আরও জোরে কামড়াবি। মানে বউকে তুই ফিজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল স্ট্রেংথ দিয়ে জিতে নিবি। পুরুষমানুষের মতন চেঁচাবি শালা, চেঁচাবি, লাফাবি, জিনিসপত্র দু-চারটে ভাঙবি, একটু মাল টেনে নিবি, দেখবি তোর বউ কেঁচো হয়ে গেছে। নিজের বউয়ের উপর যে স্বামী তার রাইট এস্টাব্লিশ করতে পারে না—তার মরে যাওয়া ভাল। বুঝলি?”

প্রেমকিশোর গুহর কথা শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, কিন্তু যখন তার মনে হল শশিকলার সঙ্গে তাকে টারজানের খেল খেলতে হবে—তখন সে ভয় পেয়ে গেল। করুণ কণ্ঠে বলল, “না ভাই, ও আমি পারব না। আমি রোগাসোগা লোক, টারজান হতে গিয়ে বুকের হাড় ভাঙবে, পিঠের মাসল-এ খিচ লেগে যাবে, না হয় হাতের হাড় সরে যাবে, তারপর শালা বিছানায় শুয়ে ককিয়ে মরি আর শশিকলা আমায় অনবরত খোঁচাক। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। না ভাই, আমি পারব না।”

প্রেমকিশোর সামনের সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট টেনে নিয়ে ধরাল। জিজ্ঞেস করল, “থার্ড প্ল্যানটা কী?”

এই প্ল্যানটা সুবীরের। কাজেই সুবীরকে বলতে হল।

সুবীর বলল, “তুই আগের দুটোতেই রাজি হচ্ছিস না, শেষেরটা কি পারবি?”

“শুনি।”

সুবীর বলল, “আমি অনেক ভেবে দেখলাম তোকে দাঁত তুলে ফেলতে হবে।”

প্রেমকিশোর হেঁচকি তোলার মতন শুরু করল, আসলে শব্দটা ভয়ের, শব্দ করে নিজের গালে হাত দিল। বলল, “দাঁত তুলে ফেলতে হবে, মানে?”

“মানে তোর নিজের কোন দাঁত থাকবে না। যদি তোর নিজের দাঁত না থাকে তবে আর তোকে নিয়ে কিসের রিসার্চ করবে? ফলস দাঁত তো আসল দাঁত নয় যে তার নিজের কিছু থাকবে। ঠিক কী না বল? ফলস চোখে দেখা যায় না, ফলস হাতে ধরা যায় না। মেয়েদের বাচ্চা হবার সময় ফলস পেইনে বাচ্চা হয় না। তোর দাঁত ফলস হলে শশিকলাও রিসার্চ ছেড়ে দেবে।”

প্রেমকিশোর খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগল এবং ভাবতে লাগল।

সুবীর বলল, “আমার এক বড় শালা ডেন্টিস্ট। ধর্মতলায় বসে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। তবে বত্রিশটা দাঁত তো একদিনেই ভোলা যাবে না। মাস দুই অন্তত সময় লাগবে। তারপর বাঁধানো দাঁত করতে আরও হপ্তা তিন। এই তিন মাস তোকে কষ্ট সহ্য করতে হবে।”

প্রেমকিশোর গালে হাত রেখে বলল, “তোর কী মাথা খারাপ! তিন মাস আমি বাড়িতে সামাল দেব কী করে? তা ছাড়া আমার এই শক্ত শক্ত দাঁতগুলো চড়চড় করে টেনে তুলবে, উরে বাব্বা মরেই যাব! গলগল করে রক্ত বেরুবে, ব্যথায় প্রাণ যাবে, গাল ফুলে থাকবে। আমি এসবের মধ্যে নেই।”

সুবীর বলল, “তোর দাঁত কিন্তু যা বাঁধিয়ে দেব দেখবি।”

“নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ! সরি, আমি নাক কাটতে পারব না।”

সুবীর বলল, “ভালো করে ভেবে দেখ। যদি রাজি থাকিস, তোর ওই ভাঙা দাঁত দিয়েই নেক্সট উইক থেকে শুরু হতে পারে।”

প্রেমকিশোর জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

গুহ বলল, “ব্যাপারটা পেইনফুল ; কিন্তু সুবীরের থিয়োরিটা কারেক্ট। ফলস দাঁত থাকলে শশিকলা তোর দাঁত দেখে একটি বর্ণও তোর রিঅ্যাকশন বুঝবে না। ঠাণ্ডা মেরে যাবে। আমার বউয়ের একবার ফলস হয়ে হয়েছিল।…”

হঠাৎ প্রেমকিশোর লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই খেপার মতন বলল, “হয়েছে, হয়েছে! শালা হয়েছে! ইউরেকা! ইউরেকা!” বলে প্রেমকিশোর ঘরের মধ্যে চরকিপাক খেয়ে মাথার ওপর হাত তুলে নাচতে লাগল।

বন্ধুরা থ’ মেরে বসে রইল। হাঁ করে, অবাক হয়ে।

নাচতে নাচতে প্রেমকিশোর হাসতে লাগল, হাসতে হাসতে সুবীরের গলা জড়িয়ে পটাস করে দুটো চুমু খেয়ে ফেলল। বলল, “মার দিয়া! সাবাস সুবীর। শালা তুই গুরু লোক। আয়, তোকে একটা প্রণাম করি।”

প্রেমকিশোর আর দাঁড়াল না। হাত তুলে বন্ধুদের বলল, “চলি ভাই, কর্ম ফতে করে তবে ফিরব।”

“তোর হল কী? হঠাৎ খেপে গেলি কেন?”

“সে পরে শুনবি। আমি চললাম।”

“ব্যাপারটা বলে যা—।”

“এখন নয়। পরে। বাই বাই। “ নাচতে নাচতে প্রেমকিশোর চলে গেল। বন্ধুরা বোবা হয়ে বসে থাকল।

গুহ বলল, “বেটা কী দাঁত তোলাতে গেল নাকি?”

“মনে তো হয় না।”

“তবে?”

সুবীর, মন্মথ, গুহ কেউ কোন কিছু বুঝল না। অনুমান করতেও পারল না। চুপ করে বসে থাকল।

পাঁচ

বাড়িতে ঢোকার আগে প্রেমকিশোর কাছাকাছি বার-এ গিয়ে অল্প হুইস্কি খেয়ে নিল। তার সঙ্গে স্যারিডন। হুইস্কি তাকে মেজাজ দেবে ; আর স্যারিডন দাঁতের ব্যথা মারবে।

অন্যদিন প্রেমকিশোর চোরের মতন বাড়ি ঢোকে ; আজ বড় বড় পা ফেলে শব্দ করতে করতে ঘরে ঢুকল। শশিকলা ঘরে বসে বই পড়ছিল, প্রেমকিশোরকে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকতে দেখে চোখ তুলে অবাক হয়ে তাকাল। তার পরনে মেয়ে প্যান্ট, গায়ে কামিজ।

প্রেমকিশোর বউয়ের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসল।

শশিকলা বলল, “কী হয়েছে? উতনা হাসছ কেন?”

প্রেমকিশোর বলল, “রাস্তায় একটা লোক বাংলা খেয়ে খেমটা নাচছে।”

“খেমটা কী?”

প্রেমকিশোর অক্লেশে কোমরে হাত দিয়ে খেমটা নাচ দেখাল।

শশিকলা নাক মুখ কুঁচকে ধমক দিয়ে বলল, “স্টপ। ইয়ে ভালগার হ্যায়।”

প্রেমকিশোর কোমর থেকে হাত নামিয়ে বলল, “তোমাদের ইয়ে ঘুরিয়ে নাচ আরও ভালগার।”

“কোথায় গিয়েছিলে জি?”

“ডেন্টিস্টের কাছে।”

“কাল ভি গিয়েছিলে!”

“আজও গিয়েছিলাম। দাঁত ব্যথা করছিল। ওষুধ খেয়েছি।” প্রেমকিশোর হুইস্কি খাওয়াটা মেরে রাখল।

শশিকলা হাতের বই নামিয়ে রাখল। —“খানা খাবে?”

“খাব! রুটি, তরকারি, মাছ—সব খাব।”

“মাগর তোমার দাঁতে পেইন আছে।”

“গোলি মারো।”

শশিকলা ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। সন্দেহের চোখে স্বামীকে দেখল।

প্রেমকিশোর গ্রাহ্য করল না। আপন মনে প্যান্ট জামা খুলতে খুলতে হঠাৎ গান গাইতে লাগল : আমি ভয় করব না।

শশিকলা চমকে গিয়ে বলল, “সিঙ্গিং?”

“ও ইয়েস।”

“কেয়া হুয়া তোমারা জি?”

“ফিলিং ফাইন আফটার দি মেডিসিন।”

শশিকলা তাকিয়ে থাকল। প্রেমকিশোর গান গাইতে গাইতে বীরবিক্রমে বাথরুমে চলে গেল।

খেতে খেতে প্রেমকিশোর বলল, “দাঁত দেখাব?”

“নট নাউ।”

“ও-কে।…দাও রুটি দাও ; তরকারি দাও। কি মাছ, চিংড়ি? লাগাও, শালা সব খাব আজ।”

শশিকলা এবার ভয়ে ভয়ে প্রেমকিশোরকে দেখল। —“তোমার দেমাক খারাপ হয়ে গেছে জি।”

‘কুছ পরোয়া নেই। তুমি যখন আছ মাথা নিয়ে ভাবি না, ঠিক করে দেবে। সাইকোলজিস্ট বউ, হোয়াই শুড আই ফিয়ার!”

শশিকলার জন্যে অপেক্ষা করল না প্রেমকিশোরকে, নিজেই টেনে টেনে খাবার নিতে লাগল। শশিকলা বলল, “ডক্টর তোমায় কী ওষুধ দিয়েছে?”

“জানি না। ব্রান্ডি টাইপের গন্ধ ছিল।”

“হোয়াই ব্রান্ডি?”

“ডাক্তার জানে। আমি ডাক্তার নই।”

“ওহি বাস্তে তোমারা এতনা ফুর্তি…।”

“তোমায় বড় ভাল লাগছে। এই ড্রেসটা পরে থাকবে না ছাড়বে?”

“তুমি লুজ টক করছ।”

“তোমাকে লুজ করব।”

শশিকলা রেগে মেগে আর কথা বলল না।

শুতে এসে প্রেমকিশোর বেশ মেজাজের মাথায় সিগারেট খাচ্ছিল।

শশিকলা এল বেশ কিছুটা পরে। শাড়ি পরে শুতে পারে না শশিকলা। সিলোনিজ সায়ার মতন একটা বড়-সড় মাপের পেটিকোট পরে, সেটা অনেকটা ঘাঘরার মতন। গায়ে ঢিলেঢালা ব্লাউজ।

বিছানায় শুয়ে শশিকলা বলল, “বাত্তি বুজাও।”

প্রেমকিশোর বলল, “তুমি হিন্দি ছাড়বে না ছাড়বে না? বাঙালি মেয়ে তুমি। হিন্দি যতই বল, ভাল লাগে না।”

শশিকলা বলল, “বেশ।”

“বেশ মানে?”

“বেশ মানে বেশ, হিন্দি বলব না।”

“খুশি হলাম।”

শশিকলা গা-হাত ঝেড়ে গুছিয়ে শুল।

প্রেমকিশোর শশীর দিকে ফিরল। বলল, “তুমি চুলে কি মাখো?”

“কুছ না।”

“ফাইন গন্ধ দিচ্ছে।”

“শ্যাম্পুর গন্ধ।”

“বিউটিফুল। তোমার বডি পাউডারটা মার্ভেলাস।”

“তোমার আজ কী হয়েছে কী? এতনা বকবক করছ? কিতনা ব্র্যান্ডি খেয়েছ?” মনে মনে প্রেমকিশোর হাসল। শালা এক পেগ বড় হুইস্কিতেই এই কর্ম।

বলল, “বেশি নয়।”

“বাত্তি নেভাও।”

“বাত্তি নয়, বাতি—” বলে প্রেমকিশোর সোজা তার ডান হাত বউয়ের গায়ে চাপিয়ে দিল। ফুলশয্যার দিন হাত বাড়ানোর চেষ্টাও করতে পারেনি, ধমক খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।

শশিকলা চমকে উঠে হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। —“ই কেয়া?”

প্রেমকিশোর বলল, “বাংলায় একে আলিঙ্গন বলে ভাই, আলিঙ্গন জানো না?”

“হাত উঠাও।”

“নেভার।”

“ইউ মাস্ট।”

“নেভার, নেভার, নেভার…” বলতে বলতে প্রেমকিশোর হাত নামিয়ে শশিকলার পেটের কাছে সুড়সুড়ি দিল।

শশিকলা ছিটকে যাবার চেষ্টা করল, পারল না। প্রেমকিশোরের হাত উঠিয়ে দেবার জন্যে ধাক্কা মারল, পারল না।

প্রেমকিশোর এবার দু’হাত দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল কোমরে আর পেটে।

শশিকলা শরীর ভেঙে দুমড়ে বেঁকে ক্ষণে ক্ষণে বিচিত্র আকার ধরতে লাগল। এবং সে হাসতে লাগল।

প্রেমকিশোর বিছানার ওপর উঠে বসে কীচক বধের ভঙ্গি করে শশিকলার সর্বাঙ্গে সুড়সুড়ি দিতে লাগল।

শেষ পর্যন্ত শশিকলা বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে মাটিতে নামল। প্রেমকিশোরও লাফ মারল। ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি। শশিকলার ঘাঘা পেখম মেলে নাচছে, হাত কখনো বুকের কাছে, কখনো মুখের কাছে। আর প্রেমকিশোর শশিকলার সামনে কোমর ভেঙে ফ্রি স্টাইল কুস্তির ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে রয়েছে সুড়িসুড়ি দেবার জন্যে। “প্লিজ প্রেম”—

“নেভার।”

“আমি বেশি হাসতে পারি না।”

“কেন পারো না। হাসি ভাল। হাসলে আয়ু বাড়ে, চর্বি ঝরে যায়।”

“আমার চর্বি নেই প্রেম।”

“ভয়ঙ্কর চর্বি তোমার। মেন্টাল চর্বি।” বলতে বলতে প্রেমকিশোর আবার ধরে ফেলল শশিকলাকে। শশিকলার গলার স্বর মোটা হয়ে গিয়েছে, মোটা গলায় হাসতে লাগল, যেন জলভরা বোতল থেকে জল পড়ছে।

তারপর সারা ঘর লণ্ডভণ্ড। শশিকলা লাফ মেরে বিছানায় উঠল। প্রেমকিশোর লাফ মারল। শশিকলা মাথার দিকে পালাল বিছানার—প্রেমকিশোর পাশ থেকে গিয়ে জাপটে ধরল।

হাসতে হাসতে বসে পড়ল শশিকলা। প্রেমকিশোর দাঁড়িয়ে থাকল। শশিকলা এবার পালাবার চেষ্টা করল। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে ছুটল।

দরজার ছিটকিনিতে হাত দিতেই পারেনি শশিকলা—প্রেমকিশোর এসে জাপটে ধরল।

কোমরের দু’পাশে হাত রেখে জোর কাতুকুতু দিতেই শশিকলা এত জোরে হেসে উঠল যে কি যেন তার মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে দরজায় খট করে লাগল। লেগে মাটিতে পড়ল। শশিকলা একেবারে থ।

প্রেমকিশোর দেখল, দাঁতের বাঁধানো পাটি, পুরো পাটি।

শশিকলা তাকাল প্রেমকিশোরের দিকে। চোখে মুখে ধিক্কার, দুঃখ, বেদনা, ধরা পড়ে যাবার ভয়, লজ্জা।

প্রেমকিশোর মাটি থেকে দাঁতের পাটিটা কুড়িয়ে নিল। নিয়ে ডান হাত পাতল।

শশিকলার চোখে জল এল। মুখ থেকে অন্য দাঁতের পার্টিটা বের করে প্রেমকিশোরের হাতে দিল।

ছত্রিশ বছরের শশিকলার ভরন্ত মুখ চুপসে গেল। যেন কেউ পিন ফুটিয়ে বেলুন চুপসে দিয়েছে। হঠাৎ শশিকলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

প্রেমকিশোর দাঁতের পাটি দুটো বিছানার দিকে ছুড়ে দিল। বলল, “কেঁদো না। প্লিজ।”

শশিকলা আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

প্রেমকিশোর শশিকলার হাত ধরে টানতে টানতে বিছানায় এনে বসাল। বলল, “তুমি রোজ রাত্রে, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর দাঁতের পাটি দুটো বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখতে?”

মাথা নাড়ল শশিকলা। হ্যাঁ, রাখত।

প্রেমকিশোর বলল, “আবার ভোরে উঠে পরে নিয়ে বাথরুমে যেতে?”

এবারও স্বীকার করল শশিকলা।

“আমায় বরাবর ফলস দিচ্ছিলে?”

শশিকলা চুপ।

“তোমার দাঁত ফলস বলে তার কোনো ফিলিং ছিল না।”

শশিকলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

প্রেমকিশোর একটু হাসল। হাত দিয়ে শশিকলার চোখের জল মুছিয়ে দিতে গিয়ে সারা গাল লেপটে দিল। তারপর বলল, “তোমাকে এখন আরও বিউটিফুল দেখাচ্ছে। আই ডোন্ট কেয়ার ফর দোজ ফলস…। এসো, শুয়ে পড়ো।”

প্রেমকিশোর শশিকলাকে শুইয়ে দিয়ে নিজে পাশে শুয়ে পড়ল।

বেড সুইচ টিপে বাতি নেভাল। তারপর শশিকলার দিকে ফিরে তাকে জাপটে নিয়ে বলল, “ডার্লিং, তুমি মন খারাপ করো না। তোমার নিজের দাঁত না থাক—আমার আছে। আমি, তোমার কাজ চালিয়ে দেব। কই, মুখটা দেখি…। তোমার মুখে মার্ভেলাস গন্ধ।…শশী, এসো ভাই লক্ষ্মীটি…” বলতে বলতে প্রেমকিশোর এমন জোর একটা চুমু খেল বউকে—মনে হল নতুন টিউবওয়েলে জল তুলছে।

ফণীমনসা

মনোবীণা গিয়েছিলেন তীর্থ করতে। তীর্থ মানে হরিদ্বার হৃষীকেশ ঘুরে আসতে। গিয়েছিলেন বন্ধু হালদারের দলের সঙ্গে। বাড়ি ফিরে যা দেখলেন তাতে ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠার অবস্থা।

মনোবীণার কর্তা ফণীশ্বর শোবার ঘরে দড়ির জালের দোলনা—যাকে কিনা হ্যামক বলে—সেইরকম এক দড়ি-দোলনা ঝুলিয়ে তার মধ্যে শুয়ে আছেন। তিন চারটে গোল লম্বা বালিশ বা কুশন তাঁর দেহের এ-পাশে ও-পাশে, মাথায়। বাঁ হাতে প্লাস্টার, ডান পায়ে প্লাস্টার। পরনে লুঙ্গি, গায়ে বেঢপ ফতুয়া। ফণীশ্বরের ডান হাতের কাছে এক ফিডিং বটল, আজকাল যেমনটি দেখা যায়—সেই ছাঁদের।

মনোবীণা তীর্থ সেরে এসেছেন। তীর্থ সেরে এসে তাঁর ডাকসাইটে শাশুড়ি সদরে দাঁড়িয়ে তিন ঘটি জল পায়ে ঢেলে তবে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেন। মনোবীণা দেখেছেন।

গাড়ি থেকে নামতেই পারুল আর খেঁদা ছুটে এসে যে-খবর শোনাল—তাতে আর মনোবীণার পায়ে জল ঢালার সময় হল না। ক’দিনের ঘোরাঘুরি হাঁটাহাঁটিতে এমনিতেই তাঁর পা ফুলেছে, ব্যথা ; তবু সেই ফোলা পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সোজা দোতলায়। শোবার ঘরে।

ঘরে ঢুকে দেখেন স্বামী দোলনায় শুয়ে, ডান হাতে দুধ-বোতল। কর্তা ছাদের দিকে চোখ তুলে শুয়ে গান গাইছেন, ব্রহ্মসঙ্গীত।

“ওমা! কী হয়েছে? এ কী দশা তোমার?” বলতে বলতে মনোবীণা স্বামীর দোলনার পাশে এসে ঝুঁকে পড়লেন। এমন করে ঝুঁকলেন যেন কর্তার বুকের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

ফণীশ্বর যেহেতু ব্ৰহ্মসঙ্গীত গাইছিলেন, ‘হৃদয় আরাম তুমি হৃদয়নাথ’ সেহেতু আধবোজা চোখে, আধ্যাত্মিক আবেশের গলায় বললেন, “পতিত হয়েছি।”

মনোবীণা একে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তার ওপর বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই স্বামী-দুঃসংবাদে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় দিশেহারা, কাজেই স্বামীর ওই মিনমিনে আধ্যাত্মিক গলা ভাল লাগল না ।বললেন, “আদিখ্যেতা রাখো। কী হয়েছিল? কেমন করে পড়ে গেলে?”

ফণীশ্বর বললেন, “তোমার তেলের শিশিতে।…তেলের শিশি ভাঙল বলে—।”

মনোবীণা অবাক। আজ পনেরো দিনের বেশি তিনি বাড়ি-ছাড়া, তাঁর তেলের শিশিতে কর্তার আছাড় খাবার কী হল?

গায়ের পাতলা চাদরটা খুলে একপাশে ছুড়ে দিতে দিতে মনোবীণা বললেন, “আমি রইলুম হাজার মাইল দূরে, আমার তেলের শিশিতে তুমি আছাড় খেলে? তামাশা।”

“তামাশা কেন হবে! যা হয়েছে তাই বললাম। ”

“কখনওই নয়। আমি বিশ্বাস করি না। কত খেয়েছিলে তখন—পেট পর্যন্ত, না, গলা পর্যন্ত?”

ফণীশ্বর তখনও শান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “সেদিন পূর্ণযোগ ছিল না, ফকির চেটো—মানে চাটুজ্যের মা উননব্বইতে স্বর্গ গেলেন ; আমরা বন্ধুর মাতৃশোক জানাতে অর্ধযোগ সেরেই ফিরে এসেছিলাম। বীণা, স্বামীকে বিশ্বাস করা তোমার পবিত্র কর্ম।”

মনোবীণার মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। এই ন্যাকামি আর সহ্য হচ্ছিল না। রাগের মাথায় দোলনাটা ঠেলে দিলেন। দোলনা সামান্য দুলতে লাগল। বললেন, “নিকুচি করেছে তোমার পবিত্তর কম্মে। ঠিক ঠিক বলল কী হয়েছিল। আমার তেলের শিশি থাকে কলঘরে। সেই শিশি উড়ে এসে তোমার পায়ে পড়ল! তার পাখা গজিয়েছিল নাকি?”

ফণীশ্বর কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বীণা ধমকে উঠে বললেন, “ঢং করে কথা বলবে না। সাফ সাফ বলো। সাদা কথায় বলো।”

“ভেতো বাংলায়?”

“হ্যাঁ।”

ফণীশ্বর বললেন, “তা হলে যা যা ঘটেছিল বলি। একটিও মিথ্যে কথা বলছি না, ধর্ম সাক্ষী। …সেদিন বিকেলে চাটুজ্যের মায়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটল! আমরা চেটোকে বললাম, তুমি শ্মশানে যাবে—লোকজন তোমার অঢেল, রাবণের ফ্যামিলি, আমরা আর বোঝার আঁটি হয়ে কী করব! তার চেয়ে বরং একটু শোক পান করে বাড়ি ফিরে যাই। চেটো এক পাত্তর টেনে চলে গেল। বড় দুঃখ তার। মা বলে কথা। হোক না নব্বইয়ের গোড়ায়। আমি, দ্বিজু, গণেশ খেলাম খানিকটা, পুরো খাইনি। অর্ধযোগ। তারপর যে যার বাড়ি।… বাড়ি ফিরে এসে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। তুমি নেই। তুমি না থাকলে আমি একেবারে অনাথ শিশু। অরফ্যান—”, বলতে বলতে ফণীশ্বর একটু থামলেন। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার বললেন, “ভাবলাম, একটু শুদ্ধ হয়ে নিই চান করে। হাজার হোক চেটোর বাড়ি থেকে ফিরছি। সংস্কার বলে একটা কথা আছে তো!… তা ইয়ে, মানে তোমার অভাবে তোমারই মাথার তেল—জবাকুসুম মাথায় ঘষতে ঘষতে পায়চারি করছিলাম এখানেই। সাম হাউ, হাত ফসকে শিশিটা পড়ে গেল। অ্যান্ড ব্রোকেন…। আমিও তেলের মেঝেতে পা হড়কে পড়লাম। জবর পড়লাম গো! অ্যান্ড ব্রোকেন..!”।

“বেশ হয়েছে।”

“বেশ হয়েছে। আমার হাত ভাঙল, পা ভাঙল—আর তুমি বলছ বেশ হয়েছে। তোমার বাক্য শুনে…।”

“তোমার মাথাটা ভাঙল না কেন!” বলে মনোবীণা স্বামীর হাতটা দেখতে লাগলেন, “গোটা হাতটাই ভেঙেছে?”

“কবজির ওপরটা দুটুকরো…”

“চমৎকার। চার হল না কেন? …আর পা? দেখি পা দেখি।”

ফণীশ্বরের কপাল ভাল গোড়ালির তলার দিকে হাড় পুরোপুরি না ভাঙলেও চিড় ধরেছে। প্লাস্টার করা আছে পা, প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত।

পা দেখতে দেখতে মনোবীণা বললেন, “ছেলেকে খবর দিয়েছিলে?”

“দিয়েছিলাম। খোকা বউ নিয়ে ছুটতে ছুটতে এল মোটর বাইক হাঁকিয়ে। ওদের কারখানায় হুজ্জোতি চলছে। প্লাস্টার হয়ে যাবার পর আমিই ওদের বললাম, তোরা যা, এসময় কারখানা ছেড়ে থাকিস না।”

“ওরাও চলে গেল? মানুষ, না জন্তু?”

‘আহা, গালাগাল দিচ্ছ কেন! ছেলে আর বউমার দোষ কোথায়? আমি বললাম বলেই ওরা চলে গেল। খোকার কারখানায় ভীষণ ঝামেলা চলছে না! গো স্লো, মিটিং, লাঠালাঠি, পুলিশ—যা হয় আজকাল। খোকার কোয়ার্টারটাও বেমক্কা জায়গায়। এ সময় নিজের কোয়ার্টার আর কারখানা ছেড়ে আসতে নেই।”

মনোবীণ খুশি হলেন না। গরমকালের বাঁধাকপির মতন বিদিকিচ্ছিরি মুখ করে বললেন, “খোকার বউ কী করছিল? সে কোন আক্কেলে বুড়ো হাত-পা ভাঙা শ্বশুরকে ফেলে রেখে চলে গেল?”

ফণীশ্বর বললেন, “দুঃসময়ে স্ত্রীকে পাশে থাকতে হয়। সীতা রামকে ফলো করেছিল কেন?”

“চুলোয় যাক তোমার সীতা!… খোকাকেও বলিহারি। তোর বুড়ো বাপ থাকল পা-ভেঙে পড়ে, তুই বেহায়ার মতন বউ ট্যাঁকে করে পালালি! ছি ছি, আজকালকার ছেলেমেয়েদের লজ্জা শরম, কর্তব্য জ্ঞান বলে কিছু নেই!”

ফণীশ্বর গম্ভীর হয়ে বললেন, “আগেও ছিল না!”

“ছিল না? আমরা হলে এ কাজ করতে পারতাম?”

“চমৎকার পারতাম। এই ধরো, তোমার-আমার কথা। তখন আমাদের মাত্তর পাঁচ মাস বিয়ে হয়েছে। বাবার টাইফয়েড হল। পানাগড়ে। খবর পেয়ে আমরা ছুটে গেলাম। দিন আষ্টেকের মাথায় বাবা যখন টাল সামলেছে—আমি চলে আসতে চাইলাম। তুমি তখন কী করলে? আমার লেংটি ধরলে। কিছুতেই বাবা-মায়ের কাছে থাকবে না, বললে—আমায় নিয়ে চলল, আমি একলা থাকতে পারব না। সে কী মুখ তোমার? কী কান্না!..কই, তখন তোমার লজ্জা-শরম কোথায় ছিল?”

মনোবীণা ধরাপড়া চোরের মতন মিইয়ে গিয়ে বললেন, “অমন জলজ্যান্ত মিথ্যে কথাটি বোলো না। বাবার মোটেই টাইফয়েড হয়নি। জঙ্গল ম্যালেরিয়া হয়েছিল। বাবা তখন সেরে উঠেছেন। মা বললেন বউমা—তুমি যাও, ছেলে একা থাকে—রাত-বিরেতে চাকরি। তুমি না থাকলে ওর অসুবিধে হবে।”

“মা বললেন—”আর তুমি আমার কাছাটি ধরে সুড়সুড় করে চলে এলে! কী আমার শাশুড়ি-ভক্তি।”

‘কাঁচা তোমার ছিল যে ধরব! করতে তো এ টি এস-এর কাজ, পরতে খাকি হাফ প্যান্ট…, ধরতে হলে ওই পেন্টুল ধরে টানতে হত।” বলতে বলতে বীণা দেওয়ালের পুবদিকে তাকালেন। শাশুড়ির বড় ফটো। জাঁদরেল মহিলা ছিলেন। হাত জোড় করে বার কয়েক প্রণাম সেরে ফেললেন স্বর্গ শাশুড়ির উদ্দেশে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে পশ্চিমের দেওয়ালে শ্বশুরমশাইয়ের ফটোকেও প্রণাম জানালেন। তীর্থ সেরে ফিরে এসেছেন সবে, গুরুজনরা সশরীরে বর্তমান থাকলে ঘটির জলে পা ধুইয়ে দিয়ে প্রণাম করতেন। তা যখন নেই, তখন তো নমো নমো করতেই হয়।

ফণীশ্বর এবার দুধ-বোতল মুখে তুললেন।

মনোবীণা বললেন, “ওটা কী? খোকা হয়েছ?”

ফণীশ্বর বললেন, “টু ইজটু থ্রি প্রপোরশানে মেশানো আছে। দুই তিন ভাগাভাগি।”

“গন্ধতেই বুঝতে পারছি কী মেশানো আছে।”

ডাবের জল আর ইয়ে—মানে এক নম্বর দিশি।”

“দিশি! দিশি…।”

“ডাক্তার বলল আমি কী করব! বলল, বিলিতি রাত্তিরে খেয়ো, সারাদিন খেলে সইবে না। তার চেয়ে ডাবের জলের সঙ্গে লোকাল মিশিয়ে খেলে গরমে তেষ্টা মিটবে, গায়ে-হাতের ব্যথা মরবে। ফুরফুরে হয়ে থাকতে পারব—তাই!”

“তাই! তাই খোকাপনা ধরেছ!”

‘না, না, তার জন্যে কেন হবে! দোলনায় দুলে দুলে খাই তো, হাত ভাঙা মানুষ, ধরতে সুবিধে। আমি তো আর বোঁটা চুষি না! ওটা খুলে রেখেছি।”

মনোবীণা স্বামীকে বিলক্ষণ চেনেন। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সমানে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিল মানুষটা। বললেন, “এটাও কি ডাক্তারে বলেছে?”

“মাপ! মাপ পাব কোথায়! এখানে শিশির গায়ে মাপের দাগ আছে, ওয়ান আউন্স টু আউন্স—! কত সুবিধে!”

“কে দেখেছে তোমাকে কোন ডাক্তার?”

“সরোজ।”

“সরোজিনী! সরোজিনী তোমাকে দেখেছে! ও তো মেয়ে ডাক্তার!” বীণার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলেন।

ফণীশ্বর বেশ গম্ভীর এবং আবেগের গলাতেই বললেন, “সরোজ না থাকলে সেদিন হাড়ভাঙা দ হয়ে পড়ে থাকর্তাম। খবর পেয়েই ছুটতে ছুটতে এল। তারপর যা করার সেই করছে। শুধু প্লাস্টারটা করে দিয়েছে মানিক মুখুজ্যে।”

সরোজিনী থাকেন কাছেই। দু’চার বাড়ির পরই। একটু কোনাচে জায়গায় বাড়িটা। পেশায় ডাক্তার। রেল হাসপাতালের। মহিলার চেহারা দেখলে পুরুষ বলে ভুল হতে পারে। মাথায় বেঁটে, রং কালো, বহর বিশাল, সামান্য গোঁফ আছে নাকের তলায়, সপ্তাহে বার দুই মিহি করে গোঁফ পরিষ্কার করে নেন ইলেকট্রিক রেজারে। মেজাজ অতি উগ্র। চোখে বড় বড় কাচের চশমা, মাথার চুল কাঁচা-পাকা, ঘাড় পর্যন্ত চুল। সরোজিনী হলেন মিস, মানে বাহান্ন-তিপান্ন বছর বয়েসেও কুমারী।।

মনোবীণার ইচ্ছে হল, শুয়ে পড়ে মেঝেতে মাথা ঠোকেন কিছুক্ষণ! শহরে এত ডাক্তার বদ্যি থাকতে শেষে নাকি ওই ‘মা মনসা’!মনোবীণা আড়ালে সরোজিনীকে মা মনসা বলেন। পাশাপাশি বাড়ি, (যদিও মা মনসার হল ভাড়া বাড়ি) আলাপ পরিচয় আছে বইকি! কিন্তু মেলামেশা তেমন নেই। মনসা মদ্দ নয়, মাগি ; ও সিগারেট খায় বলে শুনেছেন মনোবীণা, এমন কি বাড়ির মধ্যে রাত্রে ঢুকুঢুকুও চলে!

“তুমি শেষ পর্যন্ত মনসার খবরদারিতে আছ, ছিছি!”

“সরোজ ভাল ডাক্তার। গোল্ড মেডেল পেয়েছিল।”

“ও তো মেয়েদের ডাক্তার!”

“তা বলে গাইনি নয়। জেনারেল ফিজিশিয়ান, প্লাস কার্ডিওলজিস্ট!”

“নিকুচি করেছে অমন ডাক্তারে। আসলে তোমার ধাতটি ও বোঝে তো! রতনে রতন চেনে। তাই ফিডিং বোতলে মদ ঢেলে খেতে বলে গেছে! ঘেন্নায় মরি।”

ফণীশ্বর যেন কত কৃতজ্ঞ সরোজিনীর কাছে, মুক্তকণ্ঠে বললেন, “এই দোলনাটিও ও নিজের বাড়ি থেকে এনে টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। বলেছে, জানলার কাছে নিচু করে টাঙিয়ে দিয়ে গেলাম। শুয়ে শুয়ে সব দেখবেন শুনবেন, ভাল লাগবে। দিন কেটে যাবে।”

মনোবীণা বললেন, “তা হলে আর কী! ওই দোলনায় শুয়ে শুয়ে দোলো! ঢং যত্ত।”

দুই

আর খানিকটা বেলায় স্বামীকে এমন করে স্নান করিয়ে দিলেন মনোবীণা যেন পনেরো দিনের ময়লা কলঘর সাফ করছেন। অবশ্য প্লাস্টার সামলে, যেন না জলে ভিজে যায়!

স্নানের পর স্বামীকে পোশাক পরিয়ে দিলেন। লুঙ্গি আর ঢোললা ফতুয়া। দিয়ে বললেন, “একটু বসো, আমি চান সেরে নিই!”

স্নান শেষে মনোবীণা পুজোর শাড়ি পরে খালি গায়ে স্বামীর কাছে এসে তীর্থ থেকে আনা প্রসাদী ফুল পাতা ছোঁয়ালেন তাঁর মাথায় বুকে। তারপর আঁচলের গিট খুলে কাগজে মোড়া একটা মাদুলি বার করলেন। বললেন, “পুজো দেওয়া শুদ্ধ করা মাদুলি। এটা পরো।”

“কেন?”

“আমি কোন মুলুক থেকে এনেছি ; ভৈরবচণ্ডীর মন্দিরে পুজো দিয়ে…”

“কী হবে পরে? পুজোই বা দিতে গেলে কেন?”

“এ খুব জাগ্রত। এতে কত কী হয়!”

“আমার আবার কী হবে! হবার দিন তো শেষ।”

“তোমার ওই নেশাটি আমি ছাড়াব! বয়েস এখন কত হল? পঁয়ষট্টি। সেই কোন বয়েস থেকে গেলাস ধরেছ! তবু যৌবনকালে সব সয়। এখন কি ওই সব সইয়ে নেওয়ার বয়েস আছে! বরং দিন দিন তুমি ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে বসে গেলাস গিলছ গাদা গাদা। শরীর তো যেতে বসেছে। লিভার পচে গেল।”

ফণীশ্বর স্ত্রীকে দেখতে দেখতে বললেন, “লিভার পচবে কেমন করে! সব সময় অ্যালকোহলে ডুবিয়ে রাখছি। তুমি জান, অ্যালকোহল হল বেস্ট জার্মিসাইডাল। বীজাণু নিরোধক : অ্যান্টি ব্যাকটিরিয়া প্রপার্টি রয়েছে ওতে। আমার লিভার…”

স্বামীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বীণা কর্তার পিঠে এক ধমক-মারা কিল বসিয়ে দিলেন। রুক্ষ গলায় বললেন, “আমি পরতে বলছি, পরতে হবে। এর বেশি কথা নেই। আমি তোমার বউ, আমার কথাই শেষ কথা।”

কী ভেবে ফণীশ্বর একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “বেশ। তোমার কথাই থাক। যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।”

মনোবীণা স্বামীর হাতে মাদুলি বেঁধে দিলেন।

তিন

ফণীশ্বর যাকে ‘পতিত হওয়া’ বলেছিলেন সেই ঘটনাটি ঘটেছিল—গরমের মুখে, ফাল্গুন মাস নাগাদ। তারপর তিনটি মাস কেটে গেল। তিন মাসে হাত-পায়ের প্লাস্টার খোলা হয়ে গিয়েছে। পায়ের চোট এখনও সামান্য ভোগাচ্ছিল, যেমন ব্যথা, মাঝে মাঝে গাঁট ফোলা। হাত মোটামুটি কর্মক্ষম। বয়সের হাড়-ভাঙা, সহজে কি সারবে! বাত-টাত ধরবে বইকি।

এই তিন মাসে ফণীশ্বরের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। বন্ধুদের আসরে যাওয়া কমেছে খানিকটা। আরও কমে আসছে ক্রমশ। সাইকেল রিকশা করে চেটোদের আড্ডাখানায় আসা যাওয়ায় বোধহয় অসুবিধে হয়। পায়ের জন্যেই হবে হয়তো। ফলে পানাদি অভ্যাস কমে আসছে। বাড়িতে তো মনোবীণা মেয়ে দারোগা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সর্বক্ষণ, কাজেই সুবিধে হয় না তেমন। তবে মনোবীণা তো অতিরকম নিষ্ঠুর নন, স্বামীর ধাত বোঝেন। মানুষটাকে তিনি ধীরে সুস্থে সামলাতে চান, সৎ পথে আনতে চান। এতকালের অভ্যেস দুম করে একদিনে ছাড়িয়ে দিতে তিনি চান না, তাতে ভীষণ ক্ষতি হবে। রয়ে সয়ে যা করার তেমন করাই ভাল। মানুষটার শরীর মনও তো দেখতে হবে।

ফণীশ্বর মদ্যমাত্রা বেশ কমিয়ে ফেলেছেন।

মনোবীণাও কত স্বস্তি পাচ্ছেন মনে মনে। আর দু’চার মাস পরে স্বামী একেবারে সাধু সন্ত হয়ে যাবেন।

বীণা যখনই সময় পান ফণীশ্বরের হাতে বাঁধা মাদুলিটি দেখেন প্রাণভরে, মনে মনে ভৈরবচণ্ডীকে প্রণাম জানান। ঠাকুর তুমি আমায় বাঁচালে। তোমার মতন জাগ্রত দেবী আর কে আছে। তা সেদিন সন্ধের মুখে মুখে ফণীশ্বর পাজামা পাঞ্জাবি চড়িয়ে নীচে নামতে যাচ্ছেন-—মনোবীণা বললেন “যাচ্ছ কোথায়?”

ফণীশ্বর বললেন, “এই কাছেই।”

“কোথায়?”

“এই তো— আশেপাশে। খেতে যাচ্ছি না আজ। শরীরটা বড় অলস হয়ে যাচ্ছে। একটু ঘোরা-ফেরা না করলে কী চলে!”

মনোবীণারও মনে হল, কর্তার আগে যেমন হাঁক ডাক ছিল—এখন তার অর্ধেক কমে গিয়েছে। গলার জোর কমতির দিকে। আগে সকালে বাজার যাবার সময় খেঁদাকে গোটা চারেক থলি নিতে বলতেন, এখন দুটোতেই চলে। বয়েস হলেও খাওয়া-দাওয়ায় রুচি ছিল খানিকটা ভোজনপটু ছিলেন ; অকারণ সাত রকম বাজার সেরে ফিরতেন। মিষ্টিমাস্টা তো বাঁধা ছিল। দু’দুটো করে রসগোল্লা একসঙ্গে মুখে ফেলতেন। মাছ মাংসও চলত সমানে। বীণা শত বলেও খাওয়া-দাওয়ায় সামলাতে পারতেন না তাকে। এখন সেই মানুষেরই বাজার কমেছে, খাওয়া কমেছে। দিন রাত বড় বেশি হাই তুলছেন। হালে কোথথেকে ঘেঁটেঘুটে একটা গীতা বার করেছেন। পাতা ওলটান রোজ।

ছেলে ছেলের বউ হপ্তায় একদিন করে আসে। শনিবার। রবিবার সন্ধেবেলায় আবার মোটর বাইক হাঁকিয়ে নিজের জায়গায় চলে যায়। খোকাও বলছিল, “মা, বাবাকে কেমন উইক উইক দেখাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তুমি কিছু বলছ না?”…ছেলের বউয়েরও একই কথা, “মা, বাবার শরীরটা কেমন ভেঙে আসছে।”

মনোবীণা ছেলে বা ছেলের বউকে কিছু বলেননি। ওকথা কি বলা যায়, আমি তোদের বাপকে নেশা ছাড়াবার জন্যে মাদুলি পরিয়েছি মানত করে। নেশাখোর মানুষ তো, নেশা ছাড়তে গিয়ে একটু-আধটু ন্যাতানো লাগতেই পারে। ও ঠিক হয়ে যাবে।

ফণীশ্বর পা বাড়াতে যাচ্ছেন, মনোবীণা বললেন, “বেরোেচ্ছই যখন—আরও খানিকটা আগে আগে বেরুলে পার। বিকেল বিকেল। সকালেও তো খানিকটা হেঁটে চলে আসতে পার!”

ফণীশ্বর বললেন, “সকালে উঠতে ইচ্ছে করে না। আমি তো হাঁস-মুরগি নই যে ভোর হল কি বেরিয়ে পড়ব!… আর বিকেল-বিকেল বেরুব কোথায়! যা ভ্যাপসা গরম!”

মনোবীণা আর কিছু বললেন না।

ফণীশ্বর বেরিয়ে গেলেন।

সন্ধের গোড়ায় গা ধুয়ে, এক কৌটো পাউডার গায়ে ছড়িয়ে, চুলের একটা আলগা ঝুটি বেঁধে মনোবীণা গেলেন ঠাকুরঘরে। ঠাকুরঘরে তিনি রোজই প্রদীপ জ্বালান। শাশুড়ির সেই প্রদীপটি এখনও তিনি মেজে ঘষে পরিষ্কার করেন নিজের হাতে। প্রদীপ জ্বালান। ঠাকুর নমস্কার করেন।

ঠাকুরঘর থেকে ফিরে নিজের ঘরে এসে জল পান খাচ্ছেন, এমন সময় বৃষ্টি এল।

‘ওরে খেঁদা, ওরে খেঁদা—বৃষ্টি এল দেখ দেখ— বলতে বলতে তিনি শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় আসতেই আচমকা চোখে পড়ল—একেবারে কোণাকুণি বাড়ির দোতলায় একটা ঘরের পরদা উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, আর পরদার ফাঁক দিয়ে কাকে যেন দেখা গেল না? কর্তা! কর্তা—এই বাড়িতে না?

বৃষ্টির ছাঁট বাঁচাতে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ হয়ে গেল বাড়িটার। আর কিছু দেখা গেল না।

মনোবীণা নিজের চোখকে বিশ্বাস করবেন? নাকি মাথাটাই গোলমাল হয়ে গেল? ওই বাড়িটা তো মা মনসার—মানে সরোজিনীর। কর্তা ওই বাড়িতে গিয়েছেন কেন? ওখানে কী দরকার তাঁর? আশ্চর্য তো!

চোখের ভুলও হতে পারে।

তা চোখের ভুল হোক না-হোক, ব্যাপারটা তাঁর পছন্দ হল না। ভাল লাগল না মোটেই। মন কেমন খুঁত খুঁত করতে লাগল।

আসুন কত বাড়ি ফিরে, তারপর দেখা যাবে!

ফণীশ্বর বাড়ি ফিরলেন আটটা নাগাদ।

মনোবীণা দেখলেন কর্তাকে। “কোথায় গিয়েছিলে?”

“এই তো! বৃষ্টি চলে এল।”

“সে সবাই জানে। তুমি কোথায় গিয়েছিলে!”

“এই তো—এদিকেই। কাছেই ছিলাম।”

“এই তো সেই তো রাখো! কোথায় গিয়েছিলে বলো?”

ফণীশ্বর গিন্নিকে দেখতে দেখতে বললেন, “হল কী তোমার?”

“তুমি ওই মা মনসার বাড়ি গিয়েছিলে?”

ফণীশ্বর একটু যেন থতমত খেলেন। “হ্যাঁ, একবার যেতে হল!”

“যেতে হল? কেন?”

“তেমন কিছু নয়।”

“তেমন-টেমন থাক। কেন গিয়েছিলে?”

ফণীশ্বর নিজের বুকটা দেখালেন। বললেন, “একটু ব্যথা-ব্যথা করে উঠল।”

“কী! মনসার জন্যে ব্যথা?”

“আরে না! কী যে বলো! হার্ট।… হার্টের এই পজিসনে— বাঁ দিকে ব্যথা-ব্যথা। বাঁ-হাতটাও ঝিনঝিন করে উঠল। তা ভাবলাম, যাই একবার সরোজকে দেখিয়ে নিই।”

“মনসাকে তোমার বুকের ব্যথা দেখাতে গেলে?”

“বাঃ! সরোজ ভাল কার্ডিওলজিস্ট। সে আমাকে গত তিন চার মাস ধরে দেখছে। ওর কাছে, মানে বাড়িতেই যত্তর আছে। পটাপট ইসিজি করে ফেলে।”

মনোবীণার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল, “ও, তুমি বুড়ো—ওই মনসার বাড়িতে গিয়ে জামা খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লে!”

“বিছানা! হায় প্রভু! বিছানা! চওড়া সোফা—সোফা, লম্বা সোফা। টেবিল তো একতলায়। সেখানে গিয়ে শুতে হলে…”

মনোবীণার আর সহ্য হল না, খপ করে স্বামীর হাত ধরে টানতে টানতে বিছানায়। “কী হয়েছে তোমার বুকে?”

“ব্যথা?”

“কই আগে তো বলোনি?”

“বলে তোমাকে—মানে তোমাদের অনর্থক উ-উদ্বেগ— উদ্বিগ্ন করব—তাই বলিনি।”

“উদ্বিগ্ন! ন্যাকামি! কবে থেকে হচ্ছে ব্যথা?”

“তা হচ্ছে—” ফণীশ্বর মাথা হেলালেন সামান্য, “হচ্ছে আজকাল। মাঝে মাঝে। সরোজ সেই পা-ভাঙার সময় থেকেই দেখছে। ভয়ের কিছু নেই! এই বয়েসে হয় একটু। কলকবজার ব্যাপার তো! পুরনো হয়ে গেলে আলগা হয়ে পড়ে।”

“আচ্ছা!… তা মনসা তোমায় দেখল!”

“সঙ্গে সঙ্গে।”

“এত খাতির!”

“বলো কী! গায়ে-গায়ে থাকি। পা-ভাঙার সময় থেকেই তো দেখছে আমাকে। …তা তুমি কিন্তু ওই যে মা মনসা মা মনসা করো—ওটা কিন্তু ঠিক নয়। সরোজ ভাল ডাক্তার। হরেনবাবুর মাকে যমের হাত থেকে ফিরিয়ে আনল, দত্তর তো…”

মনোবীণা ধমক মেরে কথা থামিয়ে দিলেন স্বামীর। “যাও যাও ডাক্তার দেখিয়ো না। অমন ডাক্তারকে আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। …তা ছাড়া মনসাকে মনসা বলব—তাতে তোমার অত গায়ে লাগার কী আছে! আমি বলব, একশো বার বলব আমার খুশি!

“বললে তো কারুর মুখে হাত চাপা দেওয়া যাবে না।”

“দেবার চেষ্টা করে দেখো, হাত মুচড়ে দেব!”

“ভাঙা হাত, না, আস্ত হাত।”

“আস্ত হাত।”

“সর্বনাশ! তা তুমি এত খেপে গেল কেন?”

“তুমি খেপাবে, আমি খেপব না। ..কী বলল মনসা তোমার বুক দেখে?”

“বলল, মাঝে মাঝেই দেখিয়ে নিতে।”

“মাঝে মাঝে দেখাতে বলল, রোজ নয়?”

“কই তেমন কিছু তো বলেনি।”

“পান খেয়েছ কোথায়?”

“পান! দোকানে! কেন?”

“মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মনসা তোমায় চা পান খাইয়ে আতিথ্য করেছে!”

“পা-ন! না, পা-ন তেমন কই?”

“কাল থেকে বাড়ির বাইরে যখন যাবে—খেঁদা তোমার সঙ্গে থাকবে। আমার হুকুম

চার

বর্ষা ঘোরতর হয়ে উঠল। ভাদ্র মাস। ফণীশ্বর একটু বেশি রকম মনমরা। বৃষ্টিবাদলা হলেই সকাল থেকে নেতিয়ে থাকতেন, দুপুরে বড় বড় শ্বাস ফেলতেন ; আর বিকেল হলেই খেঁদাকে ডাকতেন। ‘ওরে খেঁদু, নে। একবার চেটোর বাড়ি যাব।”

খেঁদার বাবা ছিল ফণীশ্বরের অফিসের খাস পিয়ন। চাকরি থেকে যখন ছুটি পেলেন ফণীশ্বর, খেঁদার বাবা তার ছেলেটিকে সাহেবের হাতে গুঁজে দিল। পাঁচ পাঁচটা ছেলে খেঁদার বাবার, খেঁদা ছোট। ধরে করেও তো পাঁচ ছেলের কাজ জোটানো সম্ভব নয়। কাজেই খেঁদা হল ফণীশ্বরের ফাউ। তা ছেলেটাকে নিজের কাছে রেখে রেখে মানুষ করেছেন ফণীশ্বর। সামান্য লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বয়েসটা বেটার যোলোও হয়নি তায় রোগা-পাতলা, বেশ ট্যারা। ফণীশ্বরের ইচ্ছে—এবার ধরে-করে কোথাও ঢুকিয়ে দেবেন কাজে। থাকবে এখানেই। খোকার কারখানায় ঢোকাতে পারলে অবশ্য এখানে থাকা হবে না।

খেঁদা তার প্রতিপালকের পরম ভক্ত। প্রতিপালিকারও। আবার প্রতিপালিকাকে ভয়ও পায় ভীষণ। মনোবীণা তাকে এ-বেলায় যদি মাথায় তোলেন, ও-বেলায় গালমন্দ করে ভূত ভাগিয়ে দেন।

খেঁদার সবই ভাল। দোষের মধ্যে সে হিন্দি সিনেমার নামে পাগল, আর বিড়ি টানে লুকিয়ে লুকিয়ে।

মনোবীণার হুকুম, খেঁদা ছাড়া কর্তার বিকেলে বেরুনো চলবে না। তা গিন্নির হুকুম মেনেই তিনি খেঁদাকে নিয়ে বেরোন।

খেঁদা বড়বাবুর সঙ্গে বেরিয়ে যায়, ফেরে বাবুর সঙ্গেই সন্ধে উতরে, কোনও দিন সামান্য রাত করে।

বাড়িতে কাজকর্মের অসুবিধে যে না-হয়, এমন নয়, তবু মনোবীণা তাঁর হুকুম পালটাননি।

একদিন মনোবীণা স্বামীকে বললেন, “তুমি ওকে চোখে চোখে রাখো, না ছেড়ে দাও?”

ফণীশ্বর বললেন, “সে কি কথা! ওই তো আমায় চোখে চোখে রাখবে বলে পেছনে জুড়ে দিয়েছ। গোয়েন্দাগিরি! ওকেই তুমি জিজ্ঞেস করো।”

মনোবীণা বললেন, “গোয়েন্দা লাগাব কেন? হার্টের রোগী তুমি, পথে-ঘাটে যদি একটা বিপদ হয় ; সাবধান হবার জন্যেই সঙ্গে নিয়ে যেতে বলি।”

ফণীশ্বর বললেন, “তা হলে আর কথা কেন! ও থাকে।”

“কোথায় থাকে?”

“চেটোর বাড়িতে বন্ধুদের আসরে তো ওকে পাশে বসিয়ে রাখতে পারি না ; বাইরে কোথাও থাকে। ওকে জিজ্ঞেস করো।”

“অন্য সময়—? যখন ইয়ারদের আড্ডায় থাকো না—তখন ও কী করে?”

“আমাকে ফলো করে।”

“ও!… তো তোমার ছেলে বলছিল, বাবার হার্ট নিয়ে ছেলেখেলা কোরো না, মা! হার্টের অসুখের মজা হল, আজ এখন এই—তো তখন একেবারে ওই।”

“ঠিকই বলেছে। কারেক্ট। হার্ট এই—ঠিক এই মুহূর্তে হয়তো ছক্কার দান ফেলেছে, পরের মুহূর্তে অক্কার দান ফেলবে।”

“আমায় ভয় দেখাচ্ছ!”

“তোমায় ভয় দেখাব! তুমি হলে ভয়তারিণী ভয়ভঞ্জনা…!”

“দেখো, ঠুসে ঠুসে কথা বলবে না। এক্কেবারে বলবে না।.. যখনই বলো, বুকটা কেমন কেমন করছে—সঙ্গে সঙ্গে তোমার হুকুম মতন ওই মা মনসাকে ডাকতে হয়। আমার তো গা জ্বালা করে, মাথা আগুন হয়ে ওঠে ওকে দেখলে। তবু তোমার বায়না শুনে ডাকতে হয়।… হাজার বার করে বলছি, মনসা কিচ্ছু জানে না, মাদি মদ্দা হলেই কি সব জেনে বসে থাকবে। আমাদের জয়রাম ডাক্তার কত বড়, তাকে দেখাও, তা তুমি দেখাবে না কিছুতেই।”

ফণীশ্বর বললেন, “জয়রাম খোস পাঁচড়ার ডাক্তার। সে হার্টের কী বুঝবে?”

“অত বড় ডাক্তার…?”

“দুঃ ।”

“বেশ, তবে চৌধুরি ডাক্তারকে দেখাও।”

“সেটা তো ডাক্তার নয়, টাকার কল। টাকা টাকা করে বেটার এমন হয়েছে, শুনেছি, নিজের শাশুড়িকে দেখতে গিয়ে ফিজের জন্যে হাত বাড়িয়ে ফেলেছিল। ওকে জেলে দেওয়া উচিত।”

“শহরে আর ডাক্তার নেই?”

“রায় ভাল ডাক্তার। রায়কে দেখিয়েছি। বলেছে, দাদা মিস সরোজিনী গুপ্ত এ-ব্যাপারে ভাল বোঝেন। আপনার চয়েস ঠিক হয়েছে। তা ছাড়া বাড়ির পাশেই থাকেন উনি, ইমারজেন্সিতে উনি যত হেলপফুল হবেন—আমরা অতটা হব না।”

মনোবীণা বিরক্ত হয়ে বললেন, “যত্ত ছুতো! আচ্ছা, আমি দেখছি।”

ফণীশ্বর কিছু বললেন না। মনে মনে হাসলেন।

সপ্তাহ খানেক পরের কথা। মনোবীণা গিয়েছিলেন, পাল মশাইয়ের বাড়ি, সন্ধেবেলায়। পালগিন্নি বারবার বলে পাঠাচ্ছিলেন। তিনি নিজে সদ্য ভুগে উঠেছেন, শরীর বড় দুর্বল। পালগিন্নির বড় ইচ্ছে, এবারে বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন প্রতিমা গড়িয়ে। সংসারে অনেক শুভ ঘটনা ঘটেছে, সবই মায়ের কৃপায়। এবার মাকে যদি এনে না বসান তা হলে কী চলে! এ-ব্যাপারে দিদির পরামর্শ দরকার। মনোবীণা হলেন পাড়ার সবচেয়ে যোগ্য পরামর্শদাতা।

পালবাড়ি থেকে ফিরছিলেন মনোবীণা। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। পালবাড়ির খাস-ঝি রাধা ছাতা আর টর্চ নিয়ে মনোবীণাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল। গলিতে আলো কম। সামান্য কাদা জমেছে।

মনোবীণা ধীরে ধীরেই আসছিলেন। পা টিপে টিপে, সাবধানে। গড়াইদের বাড়ি পেরিয়েছেন, হরেনের ছোট্ট চা-খাবারের দোকান পাশে, গায়ে এক লম্বাটে রক, হঠাৎ রাধা টর্চের আলো ফেলে বলল, “ওমা, খেঁদা।”

মনোবীণা তাকালেন। প্রায় অন্ধকারে বৃষ্টি বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে খেঁদা।।

“তুই এখানে?”

খেঁদা যেন ধরা পড়ে গেছে। মুখে কথা নেই। চোর যেমন করে হকচকিয়ে যায় ধরা পড়ার পর সেইভাবে হকচকিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

“এখানে তুই কী করছিস?”

খেঁদার মুখে কথা নেই।

“বাবু কোথায়?”

খেঁদা চুপ। বাবুর সঙ্গেই সে বেরিয়েছিল। বাবুর সঙ্গেই ফেরার কথা।

“কথা বলছিস না?” মনোবীণা ধমকে উঠলেন।

খেঁদা ভয় পেয়ে বলল, “বড়বাবুকেই খুঁজছি।”

মনোবীণা বলতে যাচ্ছিলেন, বাবু কি গোরু ছাগল না কচি খোকা যে তুই তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিস রাত্তির বেলায়! কথাটা মুখ ফসকে বেরুতে দিলেন না, জিবের ডগায় আটকে নিলেন। বললেন, “কেন, বাবু তোর সঙ্গে ছিলেন না?”

খেঁদা মাথা নাড়ল। “ছিলেন, না ছিলেন না। …বড়বাবু…!”

মনোবীণার কী মনে হল, মুখ তুলে তাকালেন। বিশ তিরিশ পা দূরে মা মনসার বাড়ি। সদর বন্ধ।

মনোবীণা খেঁদাকে বললেন, “আয় তুই।”

খেঁদা মুখমাথা নিচু করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মায়ের পিছু ধরল, ঠিক যেন চোর-আসামী ধরা পড়ে পুলিশের পাশে পাশে চলেছে।

বাড়ি এসে মনোবীণা খেঁদাকে সার্চ করলেন। প্যান্ট, জামা, ট্যাঁক—কিছুই বাদ দিলেন না।

খেঁদার কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়া গেল। সিনেমার টিকিটের ভেঁড়া কাগজ, নতুন পুরনো, সরু চিরুনি, একটা পেট্রল লাইটার, বিড়ি আর দুটো দুমড়ানো সিগারেট, সিনেমার একটা চটি বই, নগদ সাড়ে পাঁচ টাকা, আধ-প্যাকেট চানাচুর, একটা লোহার আংটি ইত্যাদি।

মনোবীণা বললেন, “এসব থাক এখানে। তুই নীচে যা। …আজ তোর খাওয়া বন্ধ। কাল তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। এখানে তোর জায়গা হবে না। চোর, বদমাশ, মিথ্যুক, শয়তান। ডুবে ডুবে জল খাওয়া দেখাচ্ছি তোকে।”

খেঁদা প্রায় কেঁদে ফেলেছিল, “মা আমার দোষ নেই। বড়বাবু—”

“চোপ। হারামজাদা। দেখাচ্ছি তোকে। যা আমার চোখের সামনে থেকে। বেরিয়ে যা।”

খেঁদা মুখ নিচু করে বেরিয়ে গেল। মনোবীণা বিছানায় বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন।

পাঁচ

ফণীশ্বর বাড়ি ফেরার পর পরই মনোবীণার ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তিনি ঝাঁপালেন না। এমনকি, এতটা দেরি কেন, খেঁদা কেন অমুক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল—সেসব কথাও তুললেন না। ফণীশ্বরের চোরের মন—নিজেই দু‘একবার খেঁদা, বৃষ্টি, চেটো, ঘাড়ের ব্যথা—ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে দেখলেন, গিন্নি হয় কথাগুলো কানেই তুলছেন না, না-হয় ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছেন। বাক্যালাপের সুযোগই হচ্ছে না।

মনোবীণা কিন্তু স্বামীকে যে নজর করছিলেন না—তাও নয়। আড়ে আড়ে করছিলেন। স্বামীর চোখ মুখ তাঁর তো কম জানা নয়। ওই চোখের মধ্যে যে পাতলা ঢুলুঢুলু ভাব ছিল তাও তিনি নজর করেছেন। লক্ষ করেছেন, কথা বলার সময় ভদ্রলোকের দু’চারটে কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, শব্দ পিছলে যাচ্ছিল জিবের ডগা থেকে।

ফণীশ্বর পাকা লোক। তিনি বুঝতে পারছিলেন, বাঘ বা বাঘিনী এখন আশপাশে নিজেকে আড়াল করে রেখে শিকারটিকে দেখছে। যথাসময়ে লাফ মারবে।

ফণীশ্বর অনুমান করার চেষ্টা করতে লাগলেন, কখন কোন দিক থেকে কী ধরনের আক্রমণ ঘটলে তিনি বাঘিনীকে জব্দ করতে পারবেন।

খাওয়া সেরে ফণীশ্বর শুয়ে পড়লেন।

মনোবীণা খানিকটা পরে ঘরে এলেন।

ফণীশ্বর ভাব করলেন যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনোবীণা নিত্যকার মতন ঘরের মধ্যে ঘুরলেন ফিরলেন, ছোটখাটো কাজ সারলেন। দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। কোনও কথাই বললেন না।

ফণীশ্বর অনুমান করেছিলেন, নিভৃতে শয্যায় তাঁর ওপর আক্রমণটা ঘটতে পারে। তিনি মনে মনে নিজেকে তৈরি করে রেখেছিলেন। হায় রে, কিছুই যে ঘটছে না।’

রাত বাড়তে বাড়তে বুঝি মাঝরাত পেরিয়ে যাচ্ছিল, ফণীশ্বর বাস্তবিকই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ পেটের কাছে খোঁচা খেয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, “আঃ!”

আবার খোঁচা। বার দুই তিন।

ঘুম ভাঙল ফণীশ্বরের। কী হল?”

“আমার বুকটা কেমন করছে। উঠতে পারছি না। জল দাও!”

ফণীশ্বরকে উঠতে হল। “অম্বলের ব্যথা?”

“উঃ! মাগো—”

“কী খেয়েছিলে রাত্তিরে?” বলতে বলতে ফণীশ্বর উঠে পড়ে ঘরের বাতি জ্বাললেন। জল গড়িয়ে দিলেন স্ত্রীকে।

মনোবীণা উঠে বসলেন। বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন।

“নাও। …ইয়ে একটু জোয়ানের আরক খাবে নাকি? বুকের তলায় ব্যথা তো! অম্বল! গ্যাস আটকে গেছে। “

জলের গ্লাসটা নিলেন মনোবীণা, তারপর আচমকা, একেবারে আচমকাই বললেন, “মনসা তোমায় যে ওষুধটা খেতে দেয়—সেটা দাও!”

ফণীশ্বর থতমত খেয়ে গেলেন।

“মনসা—মানে সরোজের ওষুধ?”

“হ্যাঁ।”

“সেটা তো হার্টের…।”

“আমারও হার্ট।”

ফণীশ্বর বললেন, “কে বলল! তোমার অম্বল। গ্যাসট্রিক। গ্যাস—।”

“হার্ট। আমার শরীর আমি ভাল বুঝব না, তুমি বুঝবে?”

“তুমিই বোঝে। কিন্তু কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে হার্টের ওষুধ খেয়ে বসবে।”

“খাব।”

“তারপর যদি কিছু হয়!”

“হলে পাপ চুকবে।…দাও ওষুধটা দাও।”

ফণীশ্বর বড় বিপদে পড়লেন। হার্টের ওষুধ তাঁর কাছে কিছু নেই। সরোজ তাঁকে কোনও ওষুধ দেয়নি খেতে। কেননা, এই বয়েসেও হার্টের এমন কোনো গণ্ডগোল নেই যে নিত্য কোনও ওষুধ খেতে হবে। ওষুধের ব্যাপারে সরোজ বড় কড়া। হুটহাট ওষুধ খাওয়া সে পছন্দ করে না। একটা ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে চান খাবেন। পেটে বুকে চাপ বুঝলে—সোডামিন্ট। আপনার তো সোডার অভ্যেস ভালই আছে। কোনও ক্ষতি হবে না।’…ফণীশ্বরের কাছে সেই সোডামিন্ট ট্যাবলেট পড়ে ছিল। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে দেখিয়ে সেটাই খেতেন। কিন্তু আজ এই সময়—!

ফণীশ্বর তবু ওষুধ খোঁজার ছুতো করে একটা কী এনে দিলেন।

মনোবীণা দেখলেন ওষুধটা। বললেন, “এটা তো তোমার ত্রিফলার কবিরাজি বড়ি।”।

“আরে না না।”

“না না মানে! আমি জানি না। গুণ্ডু কম্পানির ত্রিফলা বড়ি। নিজের হাতে উষ্ণ জলের সঙ্গে মিশিয়ে আমি তোমাকে খেতে দিই।”

ফণীশ্বর বিপাকে পড়ে গেলেন। “ও! তা হলে ভুল হয়ে গেছে। ঘুম চোখে মাঝরাত্তিরে—দাও তবে?”

“তোমার আজকাল খুব ভুল হচ্ছে, না?” মনোবীণা এবার পা গুটোলেন।

“ভুল! কই না!”

“খুব হচ্ছে, রোজই হচ্ছে। উত্তরে যাব বললে দক্ষিণে যাও, চেটোর বাড়ি যাচ্ছি বলে মনসার বাড়ি যাও।”

ফণীশ্বর বুঝতে পারলেন, বাঘিনী সময় মতন ঝাঁপ দিয়েছেন। প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললেন, “সরোজের বাড়ি যাই! কী আশ্চর্য! কে বলল? কোথায় সরোজ! কোথায় আমি!”

“যাও না?”

ফণীশ্বর ভয় পেয়ে গেলেন কিনা কে জানে, বললেন, “দরকার না-পড়লে যাব কেন? এই হার্টের কোনও…”

“আজ যাওনি?”

ফণীশ্বর বললেন, “খেঁদা বলেছে?”

“খেঁদাকে তুমি উচ্ছন্নে পাঠিয়ে দিলে! ছিছি! ওই হারামজাদাকে তুমি টাকা খাইয়ে বশ করে নিয়েছ! ওকে পয়সা দাও সিনেমা দেখার, বিড়ি-সিগারেট ফোঁকার। ওকে বলো, যা খেঁদা পিকচার দেখে আয়। আর নিজে গিয়ে ওঠো মনসার বাড়ি। লজ্জা করে না তোমার! বুড়ো হাবড়া। এই বয়সে কোথায় ধম্ম কম্ম করবে, ঠাকুরুদেবতার কথা ভাববে, তা নয়—কোথাকার একটা মদ্দাটে মেয়েছেলের বাড়িতে গিয়ে বসে বসে ফস্টিনস্টি করো। ছি ছি! আমার মরতে ইচ্ছে করছে।”

ফণীশ্বর স্ত্রীকে দেখলেন। বললেন, “ফস্টিনস্টি করি না। ভগবানের দিব্যি। তোমার দিব্যি।.. মিথ্যে বলব না, সরোজের কাছে যাই। গল্প গুজব করি। আর ইয়ে একটু জিন খাই। ব্লু রিবন উইথ লাইম।”

“কী খাও?”

“জিন!…মেয়েরাই বেশি খায় ওটা। আমাদের কাছে কিস্যু নয়। জল। লেবু জল!”

“ওই মদ্দা মাগিটাও বুঝি খায় তোমার সঙ্গে?”

“এক আধ দিন। বেশির ভাগ দিন সরোজ সফট ড্রিঙ্ক খায়….”

“আর তুমি মদ গেলো!”

“ধুত, ও আবার মদ নাকি? আমাদের পেটে বার্লি…সেরেফ বার্লি….।”

স্বামীকে দেখতে দেখতে মনোবীণা বললেন, “তোমার যত দোষই থাক—এই মনসা-দোষ তো ছিল না। কী কুক্ষণে তোমার পা ভাঙল, আমি ছিলাম না বাড়িতে, আর ওই মনসামাগি এসে জুটল! আমার কী কপাল! কোথায় আমি কোন পাহাড়ে গিয়ে মায়ের পায়ে মাথা ঠুকে তোমার জন্যে মাদুলি নিয়ে এলাম মদের নেশা ছাড়াব বলে, তা ওটা যদি বা কমল একটু এটা একেবারে চড়চড়িয়ে বেড়ে গেল।”

ফণীশ্বরের মাথায় যেন বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে গেল। বললেন, “মাই গড। ঠিক তো! মাদুলি পরার পর থেকেই চেটোর আচ্ছা কমেছে বটে—বেশ কমেছে। কিন্তু ওই সরোজ আমায় চোঁ চোঁ করে টানছে। যেন ম্যাগনেট। দারুণ পাওয়ারফুল ম্যাগনেট। সত্যি তো— আগে কথাটা খেয়াল করিনি।”

মনোবীণা বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন স্বামীকে। ফণীশ্বর গ্লাস ধরলেন।

মনোবীণা কোনও কথা বললেন না। স্বামীর হাতে বাঁধা মাদুলির সুতোটা টেনে পট করে ছিড়ে ফেললেন। যথেষ্ট জোর আছে হাতে। মাদুলিটা ছুড়ে দিলেন জানলা দিয়ে। বললেন, “নাও, এবার তুমি তোমার ইয়ার বন্ধু চেটোর বাগানে চরে বেড়াও। ও বরং আমার সইবে। এতকাল সহ করেছি, আর না হয় ক’বছর—যতদিন না মরছি। কিন্তু ওই মনসা আমার সইবে না।”

ফণীশ্বর চতুরের মতন হাসলেন। বললেন, “মাদুলিটা তুমি ফেলে দিলে? তা ভালই করেছ! ওটা বোধ হয় ভুল মাদুলি ছিল। ‘ম’য়ের ভুল। এক করতে আরেক করছিল। তবে মনো, আমি আগের মতন চরে বেড়াব ঠিকই—কিন্তু সরোজকে তুমি গালমন্দ কোরো না। সত্যি সে ভাল। আমায় দাদা বলে। “

“বলুক। দাদা বললেই সাত খুন মাপ!”

“না ইয়ে—! মানে এর মধ্যে সরোজেরও একটা পার্ট ছিল। সে সবই শুনত, আর হাসত। বলত, দাদা—আপনি কিন্তু বউদিকে অনর্থক খেপাচ্ছেন। এটা চোর-পুলিশ খেলা হচ্ছে। বুড়ো বয়েসে এত মজার খেলাও খেলতে পারেন! ধন্যি আপনারা।”

মনোবীণা স্বামীর হাত থেকে খপ করে জলের গ্লাস কেড়ে নিয়ে ফণীশ্বরের মাথায় ঢেলে দিলেন।

 বউ নিয়ে খেলা

শচীন আসতেই তার বন্ধুরা সাদর অভ্যর্থনা করে বলল, “আয় আয়, তোর পথ চেয়ে বসে আছি।”

শচীনের বন্ধু বলতে আপাতত এই ঘরে চারজন: প্রতাপ, সুবিমল, আশু আর হালদার। চারজনেরই বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। প্রতাপ হয়তো চল্লিশে পা দিয়েছে, বাকিরা সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে। প্রতাপের চেহারাও কলকাতার পুরনো বাবু-বাড়ির বংশধরদের মতন: গোলগাল, ফরসা, মাথায় টাক, চোখে চশমা। হগ মার্কেটে ফুলের দোকান প্রতাপের। আর তার বাড়ির বৈঠকখানায় বন্ধুদের আড্ডা। সুবিমল কলেজের বাংলা টিচার, আগে বোধ হয় কবিতা লিখত, এখন রচনাবই লেখে, কবিতার ভাঙা লাইন আর রচনা-বইয়ের স্থূলতার মতন তার চেহারা। চোখ মুখ ভাঙা ভাঙা দেখালেও গায়ে গতরে চর্বি জমেছে। আশু হল ইনকাম ট্যাক্সের উকিল। ছিপছিপে চেহারা, চোখে মুখে ঝরঝরে হাসি। গালের আধখানা জুলফি দিয়ে ঢেকে রেখেছে। হালদারই সবচেয়ে নিরীহ ধরনের; দেখলেই বোঝা যায় অম্লশূলের রোগী।

প্রতাপ তার চুরুটের পিছনে কাঠি করতে করতে বলল, “গিয়েছিলি?”

শচীন একপাশে বসল। বসে তার বাঁ হাতটা সুবিমলের দিকে বাড়িয়ে দিল। “পালস্‌টা একবার দেখ তো, ভাই?”

সুবিমল বলল, “কেন? জ্বর হয়েছে তোর?”

মাথা নাড়ল শচীন। “হার্ট সিঙ্ক করে যাচ্ছে। বাব্বা কী জিনিস দেখলাম। জঙ্গলের বাঘ দেখেছি। এ ভাই বাঘের বাবা। সরি, মা।”

আশু বলল, “খুলে বলো! আমরা হাঁ করে বসে আছি তোমার জন্যে। গজেন কাটলেট আনতে গিয়েছে। এসে পড়বে এখুনি।”

হালদার বলল, “কলকাতায় বড় কলেরা হচ্ছে। কাটলেটটা না খেলেই পারতেন।”

“রাখুন তো মশাই, কলেরা টাইফয়েড করেই আপনি গেলেন।”

প্রতাপ বলল, “ব্যাপারটা বল, শচীন।”

শচীন বলল, “ভাই আমি যথারীতি যথাস্থানে গিয়েছিলাম। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ছ’টা। পাঁচতলা বাড়ি, তেতলায় অফিস। লিফট নেই। উঠলাম ওপরে। অফিসের বাইরে দরজার সামনে টুলে এক দরোয়ানি মেয়ে বসে ছিল। হাতে কাগজ পেনসিল। নাম লিখে দিলাম। তারপর ডাক পড়ল।”

সুবিমল হাত বাড়িয়ে আশুর সিগারেটের প্যাকেট টেনে নিল।

শচীন বলল, “ঘরের মধ্যে ঘর। প্রথম ঘরে জনা চারেক মহিলা। লম্বা, বেঁটে, কালো ফরসা নানা টাইপের। চেহারায় সব ক’জনই পুষ্ট। আন্ডার সিক্সটি কেউ নয়।”

“বয়েস?”

“না না, বয়েস কেন হবে, কেজি-তে। মহিলারা কফি-ব্রেক করছিলেন, উইথ চানাচুর। ঘরে দিব্যি সেন্টের গন্ধ। আমায় দেখে চোখে চোখে খেলা চলল। গলায় ব্লটিং-চাপা হাসি।”

এমন সময় গজেন এল। লম্বা চওড়া চেহারা, মাথায় চুল কোঁকড়ানো, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। হাতে কাগজের ঠোঙায় কাটলেট।

প্রতাপ বলল, “ডিস্টার্ব করবি না, বোস। যা কাটলেটগুলো তোর বউদিকে দিয়ে আয় ভেতরে। চায়ের সঙ্গে দিতে বলবি।”

গজেন ভেতরে গেল। হাঁক মারল। আবার ফিরে এল।

শচীন বলল, “ঘরের মধ্যে আর একটা ছোট ঘরে ঢুকে দেখলাম, দারুণ ব্যাপার। মেঝেতে জুট কার্পেট, একপাশে ছোট সোফা, সামনে সেক্রেটারিয়েট টেবিল, ওপাশে বিশাল চেয়ার, এপাশে একটি মাত্র চেয়ার, ঘরের একদিকে এক ছোট আলমারি, গোটা দুয়েক ছবি ঝুলছে।”

“তুই বড় বেশি গৌরচন্দ্রিকা করছিস,” সুবিমল বলল।

শচীন বলল, “গাছে না উঠে এক কাঁদি তো হয় না, ভাই। ব্যাপারটা চোখে না দেখলে বুঝবে না, তবু মুখে বললাম।… তা টেবিলের ওপাশে ছিলেন রেহান লাহিড়ি।”

“রেহান! পুরুষ মানুষ নাকি?” আশু জিজ্ঞেস করল।

“না, মহিলা। লেডি। তবে পুরুষের কান কাটেন। একেবারে বয়কাট চুল, চোখের চশমা কালো কর্ড দিয়ে বুকের কাছে ঝুলিয়ে রাখেন, মাঝে মাঝে পরেন চোখে, আবার ঝুলিয়ে দেন বুকের ওপর। চেইন স্মোকার। রোস্টেড টোবাকো বোধ হয়, যা গন্ধ!”

হালদার বলল, “পরনে কি প্যান্ট?”

“না প্যান্ট নয়। অন্তত আজ প্যান্ট দেখলাম না। শাড়িই পরেছেন। তবে শাড়িটা নেহাত গায়ে জড়ানো। থাকে থাকে খুলে যায়।”

“ব্লাউজ-টাউজ ছিল না—?” আশু চোখ টিপে বলল।

“যেটুকু থাকার ছিল। মিনিমাম।… মুখে নো রংচং; হাতে ডবকা সাইজের ঘড়ি। গলায় এক পাথরের মালা।”

“তা ওজন-টোজন কেমন?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“মিনিমাম পঁচাত্তর। আশি কেজিও হতে পারে।”

“বাপস! হাতি নাকি?”

“আজ্ঞে না। উনি আদিতে ছিলেন রোহিনী। রোহিনী থেকে রেহান।”

সুবিমল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল! “হায় বঙ্কিম!”

আশু বলল, “যাক, তারপর কী হল—শুনি!”

শচীন এবার একটা সিগারেট ধরাল। কয়েকটা টান মেরে বলল, “কথাবার্তা হল। তা প্রায় আধঘণ্টা মতন। আমায় কফি খাওয়ালেন।”

গজেন বলল, “কী কথাবার্তা হল সেটা বল! ওটাই তো আসল।”

শচীন বলল, “আমি স্পষ্টই বললাম, একটা ডিভোর্স কেস প্রায় সেটল্‌ড—সেটা আনসেটেল করতে হবে। শুনে রেহান তো প্রথমে চটে গেলেন। বললেন, দেখুন, আমরা মেয়েদের ইনটারেস্ট দেখার জন্যে এই অরগানিজেশান খুলেছি। আমাদের উদ্দেশ্য মেয়েদের স্বার্থ দেখা। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।… আমাকে প্রায় উঠিয়েই দিচ্ছিলেন, কিন্তু অত সহজে কি আমাকে ওঠানো যায়! লাইফ ইনসিওরেন্সের এজেন্সি দিয়ে লাইফ শুরু করেছিলাম ভাই। ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করাতে পারি। মিষ্টি কথা, ন্যাকা কথা, তৈল দান—শেষে পকেট থেকে চেক বই বার করে এক শো একান্ন টাকার অ্যাডমিশান চার্জ দিতেই রেহান আমায় তাঁদের ক্লায়েন্ট করে নিলেন। খাতায় নাম-ধাম লেখা হল। আমার নম্বর হল…” বলে শচীন পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করল—ব্যাগ হাতড়ে একটা রসিদ। বলল, “নম্বর হল, জিরো জিরো থার্টি ওয়ান।”

প্রতাপ হাত বাড়াল। “দেখি রসিদটা…।”

শচীন রসিদটা দিল।

দেখল প্রতাপ। বলল, “নামটা পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির মতন মনে হচ্ছে যে!”

“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল শচীন, “রেহানদের সমিতিও অনেকটা ওই ক্লাসের। ওটা মহিলা পীড়ন নিবারণ সমিতি গোছের।”

আশু বলল, “তা, ওখানে আর যে সব জিনিস দেখলে, যাঁরা কফি খাচ্ছিলেন—তাঁদের কেমন মনে হল, ক্লেশ আছে।”

শচীন বলল, “ভেতরে থাকতে পারে, ওপরে দেখলাম না। সকলেই বেশ ব্রে-শ-”।

আশু জোরে হেসে উঠল। সুবিমল বলল, “তোর নজর ভাল।”

এমন সময় ভেতর থেকে চা এল। চা আর কাটলেট।

গজেন সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

হালদার বলল, “ব্যাপারটা একটু ইয়ে হয়ে যাচ্ছে না?”

কাটলেট চিবোতে চিবোতে আশু বলল, “ইয়ে হবে কেন! যা হওয়া উচিত তাই হচ্ছে।”

হালদার সাহস করে কাটলেটের দিকে হাত বাড়াতে পারছিল না। গন্ধটা নাকে লাগছিল! প্রতাপ কচকচ করে স্যালাড চিবোচ্ছে। জিভে জল আসছিল হালদারের।

“না, আমি বলছিলাম”, হালদার ঠোঁট চাটল, “ব্যাপারটা তো তেমন সিরিয়াস নয়। শচীনবাবুর স্ত্রী সত্যি সত্যি তো আর ডিভোর্স করছেন না।”

“কে বলল?” শচীন আবার খানিকটা কাটলেট মুখে পুরল। “আর কত সিরিয়াস হবে! আমার বউ আজ তিন হপ্তা হল তার বাপের বাড়ি চলে গেছে। ও-বাড়িতে গেলে দেখা করে না। ফোন করলে ধরে না। চিঠি লেখেছি, জবাব দেয়নি। বলছিল, লিগ্যাল হেল্প নিচ্ছে। নিতেই পারে। ওর এক কেমন মাসতুতো দাদা ছিল। আই থিঙ্ক হার লাভার, প্রি-ম্যারেজ। সে বেটা উকিল। এই চান্সে বেটা বগল বাজাবে।”

প্রতাপ বলল, “না না, কাজটা ভালই হয়েছে। বরং আমি বলব, স্টেটসম্যানে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়ে শচীনকে খুব হেল্প করল। না কি সুবিমল?”

সুবিমল চায়ের কাপ টানল। “নিশ্চয়। একেই বলে গডস ব্লেসিং।”

“বিজ্ঞাপনটা ভাগ্যিস আশুর চোখে পড়েছিল।”

আশু বলল, “আমার চোখে সবই পড়ে। শচীনদার যা হাল দেখেছিলাম…”

হালদার হাত বাড়িয়ে কাটলেটের সিকি ভাগ তুলে নিল। “না, আমি বলছিলাম—এ-সব ব্যাপার যদি নিজেরা সেটল করা যেত!”

“কেমন করে যাবে?” শচীন বলল, “আমার বউয়ের দশ দফা দাবি। চার দফা আমি কোনো রকমে মেটাবার চেষ্টা করতে পারি।”

“কী কী?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“ধর, যদি পাই—ধারকর্জ করে একটা ফ্ল্যাট কেনার টাকা যোগাড় করতে পারি। দুই: দু’বছর অন্তর বউকে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারি কলকাতার বাইরে। তিন: ঝি না থাকলে হোটেলে খেতে পারি। চার: আমি কিছু টাকা বউয়ের হাত-খরচা হিসেবে স্পেয়ার করতে পারি। ব্যাস,..আর কিছু পারব না।”

আশু বলল, “বাকি ছ’ দফার মধ্যে কোনটা একেবারেই পারবে না।”

“বাচ্চা! বাচ্চা আমদানি আমার হাতে নয়। আমার বউকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, তার কপালে যদি না থাকে আমি কী করব? এ তো কুমারটুলিতে অর্ডার দিলে পাওয়া যায় না।”

প্রতাপ বলল, “তোর অর্ডার প্লেস সঠিক জায়গায় কর, হয়ে যাবে।” বন্ধুরা হোহো করে হেসে উঠল।

ঘটনাটা যেভাবে ঘটেছিল একটু বলা দরকার।

শচীন হল সেই ধরনের মানুষ যার মধ্যে এক ধরনের পৌরুষ আছে। অর্থাৎ সে তেজি এবং তেড়া। ভয়ঙ্কর আড্ডাবাজ এবং অসংসারী। সে বউকে ঠিক ততখানি তোয়াক্কা করতে নারাজ যতটা করলে ঘরে শান্তি থাকে। এই স্বভাবের জন্যে তাকে বিয়ের পর থেকেই পস্তাতে হচ্ছে। আজ চার বছরে তার বউ—মলয়া বার ছয়েক শচীনকে জব্দ করার জন্যে নানা রকম কাণ্ড করেছে। একবার, বিয়ের নতুন নতুন অবস্থায় চার আউন্স ক্যাস্টর অয়েল খেয়েছিল। শচীন তাতে যত না জব্দ হয়েছিল তার চারগুণ হয়েছিল মলয়া নিজেই। ধাত ছেড়ে যাবার জো হয়েছিল তার। পরের বার মলয়া আর অয়েলে যায়নি, ট্যাক্সি ধরে চলে গিয়েছিল দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায়। ভেবেছিল হয় আত্মবিসর্জন দেবে, না হয় সন্ন্যাসিনী হবে। সারাদিন ভেবেও মতি স্থির করতে পারেনি। রাত্রে ফিরে এসে দেখে শচীন পাঞ্জাবির দোকানের কষা মাংস খাচ্ছে, তার পাশে ছোট এক বোতল হুইস্কি। মলয়াকে দেখে শচীন বলল, “আমি ভাবলাম তুমি দুর্গাপুরে লাটুদার কাছে বেড়াতে গেছ।” স্বামীর ব্যবহার দেখে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছিল মলয়া। তৃতীয়বার মলয়া টানা বাহাত্তর ঘণ্টা উপবাস করেছিল পলিটিক্যাল চাল মেরে। শচীন তাতেও কাবু হল না, বরং শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বলে এল, “আমি অফিসের কাজে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছি, আপনাদের মেয়েকে দেখবেন।” এইভাবে চতুর্থও পঞ্চম বারের পর মলয়া ইঁদুর মারা বিষ খেয়েছিল, কিন্তু ভেজাল বিষ তেমন কোন কাজ করল না শরীরে; মলয়া বার দুয়েক বমি করল। শচীন বলল, “চলো তোমায় গাইনির কাছে নিয়ে যাই। এই সময়ে বমি ভাল।”

মলয়া শেষ পর্যন্ত বুঝে ফেলেছিল, শচীন বদলাবার নয়। তার কাছে স্ত্রী আর ডাক্তারের কাছে স্টেথসকোপ একই জিনিস। দুটোই গলায় ঝোলাবার। কাজে লাগানোর যন্ত্র। শচীনের না আছে বউ নিয়ে আদিখ্যেতা, না গদগদ ভাব, না স্বার্থত্যাগ। দায়িত্বহীন, আড্ডাবাজ, নেশুড়ে, নিস্পৃহ—এই মানুষটাকে আর সহ্য করা সম্ভব হল না মলয়ার। তার ওপর বাচ্চাকাচ্চাও হল না বেচারির। কী নিয়ে থাকবে সে?

চটেমটে মলয়া বলল, “তোমার সঙ্গে আমি থাকব না।”

কাঁচি দিয়ে গোঁফ ছাঁটতে ছাঁটতে শচীন বলল, না থাকলে—!”

“এত বড় কথা! বেশ, আমি ডিভোর্স করব তোমায়।”

“করো ।”

“তোমায় আমি শায়েস্তা করব, তবে আমার নাম।”

“ভয় দেখিও না, আমি তোমার মতন একগণ্ডা মেয়েছেলে পকেটে পুরতে পারি।”

“পারো বলেই তো আমার এই হাল।… আমি আজই চলে যাচ্ছি।”

“যাও। আই ডোন্ট কেয়ার।”

“অল রাইট।”

মলয়া তার ট্রাংক সুটকেস গুছিয়ে, লকারের চাবি নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি চলে গেল সেই দিনই। শচীন মাথা ঘামাল না। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। সাত দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সাত দিনের হিসেব পনেরো, তারপর একুশ দিনে গিয়ে দাঁড়াল। মলয়া আর ফিরল না। শচীন প্রথম দিকে গ্রাহ্য করেনি। ধীরে ধীরে গ্রাহ্য করতে বাধ্য হল। বাড়িতে তার দ্বিতীয় আত্মীয়া নেই। ঠিকে ঝি আর ঠিকে বামুনের ভরসায় সংসার। তারা সকালটা চালিয়ে দেয়, বিকেলে কেউ আসে না। শচীন বাড়ি থাকে না, আসবে কেমন করে। সব দিকেই অসুবিধে হতে লাগল। বাধ্য হয়েই শচীন একদিন ফোন করল শ্বশুরবাড়িতে। মলয়াই ফোন ধরেছিল। বলল, “উকিলের সঙ্গে কথা হচ্ছে। কানুদা বলেছে, সব ব্যবস্থা করে দেবে। আজকাল ডিভোর্স পাওয়া জল-ভাত। তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

শচীন বলল, “বাঃ, নেই মানে? তুমি আমার লিগ্যাল ওয়াইফ। কানু দাদার বাড়ি পেয়েছে!”

“আমি তোমার ওয়াইফ নই। লিগ্যাল ঝি ছিলাম। আর থাকব না। তুমি ছোটলোক, শয়তান।”

শচীন বলল, “বাড়াবাড়ি কোরো না, পস্তাতে হবে।”

“তোমাকেও হবে।” ফোন ছেড়ে দিল মলয়া।

শচীন তার পৌরুষকে খাটো করে গেল শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরমশাই বললেন, “তুমি যা করেছ এরপর কোন মুখে এবাড়িতে এসেছ! মালু যাবে না।”

শাশুড়ি কেঁদে বললেন, “মেয়ের তুমি যা হাল করেছ, ছিছি, তোমায় পুলিশে দেওয়া উচিত।”

বড় শালা বললে, “মালুকে তুমি শ্যাটার করে দিয়েছ। ওর নার্ভ ব্রেক করেছে। ওকে আমরা আর পাঠাব না। ডিভোর্স স্যুট ফাইল করব।”

শচীন ফিরে এল। বুঝল, মাথা-খাওয়া আদুরে মেয়ের মাথা আরও নষ্ট করে দিচ্ছে তার বাপের বাড়ির লোক। এমনিতেই মলয়া আদুরি, ন্যাকা, জেদি, ছিটেল, অপদার্থ। এখন তার আরও মাথা খাবার ব্যবস্থা হচ্ছে।

শচীনের দুঃখই হল। বউ তার, অথচ মাতব্বরি করছে বাইরের পাঁচজনে।

বন্ধুদের কাছে শচীন সবই বলত। বন্ধুরা শুনত, কোনো উপায় বাতলাতে পারত না। ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ করে চলত।

শেষ পর্যন্ত আশুই একদিন বিজ্ঞাপনটা আবিষ্কার করে ফেলল। একটা কুকুর বাচ্ছা কিনবে বলে আশু স্টেটসম্যান-এর বিজ্ঞাপন হাতড়াচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ল এক মজাদার বিজ্ঞাপন। আশুর মাথা বড় সাফ। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের কাছে চালান করে দিল কাগজটা।

বন্ধুরা প্রথমটায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। আজকাল নারী জাগরণের দিন। চতুর্দিকে হইহই চলছে। লিব মুভমেন্ট, নারীবর্ষ। নানা ধরনের নারী সমিতি আসরে নামছে। তারা ভেবেছিল সেই রকম কিছু একটা হবে। এই সমিতি মেয়েদের নানান সমস্যা ও সামাজিক পীড়ন নিয়ে মাথা ঘামাবার জন্য তৈরি হয়েছে। তা হোক। কিন্তু ব্যাপারটা মেয়েদের, শচীনের মামলা তারা নেবে কেন?

আশু বলল, “কেন নেবে না! কেস শচীনদার একলার নয়, সঙ্গে বউদি আছে।”

সুবিমল বলল, “একবার ট্রাই নিতে পারে শচীন। নেয় নেবে, না নেয় না নেবে। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে তো দেবে না।”

প্রতাপ বলল, “তুই চলে যা শচীন। কেঁদে ককিয়ে পড়বি। ট্রাই ইয়োর লাক।”

শচীন বন্ধুদের পরামর্শ কানে তুলে বলল, “বেশ যাব।”

দিনক্ষণ ঠিক করে দিল বন্ধুরা। শচীন যথারীতি গেল। ফিরে এসে যা বলল—তার বিবরণ আগেই দেওয়া হয়েছে।

দিন দুই বাদে অফিসে শচীন ফোন পেল। রেহানের গলা। বলল, “আপনাকে আজ একবার আসতে হবে।”

“অফিসে?”

“হ্যাঁ। পাঁচটার পর আসুন। বাই ফাইভ থারটি।”

ঢোঁক গিলে শচীন বলল, “অন্য পার্টিও কি থাকছে?”

“অন্য পার্টি? ও!… না কেউ থাকছে না। আমাদের কিছু কোশ্চেন আছে। ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। আপনার ফিজ লাগবে পঁচিশ টাকা।”

“পঁচিশ?”

“মেয়েদের কাছে পনেরো নিই। আপনার কাছে তিরিশ নেওয়া উচিত ছিল আমরা কনসিডার করেছি…। যদি আপত্তি থাকে আসবেন না।”

“না না আমি যাব।”

হগ মার্কেটে প্রতাপকে একটা ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিল শচীন। “ওরে আমার ডাক এসেছে। পাঁচটায় যাচ্ছি। পঁচিশটা টাকা গচ্চা যাবে।”

প্রতাপ বলল, “সঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট নিবি? আমি খালি আছি।”

“না। একলা যাব। কবি বলেছেন—একলা চলো রে!”

“যা তবে। সন্ধেবেলায় বাড়িতে আসিস। শুনব।”

শচীন যথাসময়ে ওয়েলেসলিতে হাজির হল।

আগের মতনই সব। সেই আয়া, স্লিপ লেখা। ডাক এল সঙ্গে সঙ্গেই।

রেহানের ঘরে ঢোকার আগে শচীন আজ মাত্র দুজন মহিলাকে দেখল। একজন টাইপ করছে। অন্য জন ফাইল ঘাঁটছিল।

রেহানের ঘরে ঢুকতেই রেহান বলল, “আসুন।”

শচীন নমস্কার করল। “দেরি হয়ে গেল?”

“না, বসুন।”

বসল শচীন। দেখল রেহানকে। রেহানের পরনে তাঁতের সাদা শাড়ি, কালো পাড়। গায়ের জামা সাদা। আজ গলায় মালা নেই, যথারীতি গলায় চশমা ঝুলছে। রেহান একটা ফাইল টানল। পাতা ওলটাল। “আপনার ফাইল দেখলাম। কিছু ডিটেল দরকার।”

“বলুন?”

“আপনার স্ত্রীর ঠিকানা আপনি দেননি। ঠিকানা কী?”

শচীন ঠিকানা বলল। রেহান ঠিকানা টুকে নিল। পেনসিলটা হাতেই থাকল। “মিসেস বাপের বাড়িতে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“কত দিন?”

“মাস খানেক।”

“এর মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয়নি?”

“আজ্ঞে সরাসরি নয়। ফোনে একবার হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম—পাত্তা পাইনি।”

“আপনার ম্যারেজ লাইফ চার বছরের?”

মাথা নাড়ল শচীন।

রেহান পেনসিল ফেলে দিয়ে এবার একটা সিগারেট ধরাল, লাইটার দিয়ে। “আপনার এগেনসটে কী কী কমপ্লেন মিসেসের?”

শচীন দুবার মাথা চুলকাল, কাশল বারকয়েক। “আজ্ঞে, কমপ্লেন তো হাজারো রকম। স্ত্রীরা স্বামীর বিরুদ্ধে কী না কমপ্লেন করে বলুন। ফ্রম এ টু জেড—!”

“স্বামীরাও করে, আপনিও করেছেন। কাজের কথা বলুন, ইউ মাস্ট টক বিজনেস, নাথিং এলস। আপনার মিসেস যে কমপ্লেনগুলো মেইনলি করতেন—বলুন!”

“মেইনলি! বলছি…! মেইন কমপ্লেন বলতে আমার বউ…”

“বউ নয়, স্ত্রী। সম্মান দিয়ে কথা বলুন। বউ বর এ সব ভালগার ওয়ার্ড ইউজ করবেন না।”

“আজ্ঞে বউ তো…।”

“প্লিজ স্টপ। কমপ্লেনের কথা বলুন।”

শচীন পকেট থেকে রুমাল বার করল। কপাল মুছল। বলল, “আমার স্ত্রীর মেইন কমপ্লেন হল—আমি স্ত্রৈণ নই।”

“স্ত্রৈণ! মানে আপনি স্ত্রীর বাধ্য ছিলেন না?”

“আজ্ঞে, কোনো কালেই নয়। স্ত্রী তো আমার জননী নয় যে বাধ্য হব!”

“আপনি বড় বাজে কথা বলেন।” বলেই রেহান বেল বাজালেন।

পাশের ঘর থেকে ফরসা বেঁটে ওজনদার এক মহিলা এসে দাঁড়াল।

রেহান বললেন, “সন্ধ্যা, জাস্ট সিট ডাউন। এই ভদ্রলোককে আমি তোমার কেয়ারে দিচ্ছি। তুমি কেসটা হ্যান্ডল করবে। এখন বসো, লিসন টু আওয়ার টকস। পরে ফাইলটা দেখে নিও। নিন, কমপ্লেনগুলো বলুন।”

শচীন সন্ধ্যা নাম্নী মহিলাকে দেখে নিল। সব দিকেই মানানসই। পছন্দই হল শচীনের। শচীন বলল, “আজ্ঞে আমার স্ত্রীর ধারণা, আমি ইরেসপনসিবল আমি আড্ডাবাজ। আমার মায়াদয়া নেই। আমি স্বার্থপর। স্ত্রীকে নাকি আমি ইগনোর করি। আমি নেশাখোর। আর লাস্টলি হল, আমি ইয়ে—মানে ফ্যামিলি ক্রিয়েট করছি না।” বলে শচীন অসহায় মুখ করল।

“বাচ্চা কাচ্চা না হবার কারণ?”

“ভগবান জানেন।”

“ডাক্তার দেখিয়েছেন?”

“সব রকম। সবাই আশা দিচ্ছে। কিন্তু…”

“বুঝেছি। তা আপনার কী কী গ্রিভান্স আছে স্ত্রীর বিরুদ্ধে?”

শচীন নিজে এবার সিগারেট খাবার জন্যে উসখুশ করতে লাগল। তারপর পকেট থেকে প্যাকেট বার করল সিগারেটের। “আমার গ্রিভান্স একটাই। আমার বউ—মানে স্ত্রী টু মাচ আদুরে। তার বাপের বাড়ি বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে মলয়ার। খুকি করে রেখে দিয়েছে।”

রেহান হাতের সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুজে দিল। বলল, “অন্য কিছু না?”

“না, স্যার”, বলেই নিজেকে শুধরে নিল শচীন, “সরি ম্যাডাম।”

আবার পেনসিল তুলে নিয়ে দাঁতে টোকা দিল রেহান। “ডিভোর্সের প্রপোজালটা কার?”

“আমার স্ত্রীর!”

“তা ডিভোর্স যদি হয়—আপনার অসুবিধে কী?”

শচীন সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া গিলে বলল, “অসুবিধে কিছুই নেই তেমন। তবে আফটার অল চার বছর একসঙ্গে ছিলাম। ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তা ছাড়া ভদ্রলোক একবারই বিয়ে করে। আমি আবার একটা বউ কোথায় পাব বলুন?”

রেহান বলল, “ঠিক আছে। আমরা দেখি কী করতে পারি।… ওই সন্ধ্যা আপনার কেস হ্যান্ডল করবে। আপনি ওর অ্যাডভাইস মতন চলবেন। ভাল কথা, সন্ধ্যার ঘোরাফেরা, এটা-ওটার কস্টও আপনাকে বিয়ার করতে হবে। সেটা আমাদের বিলে থাকবে না। আমরা পরে একটা বিল করব আপনাকে। অফ কোর্স ব্যাপারটা সেটল করতে পারলে।”

শচীন একবার সন্ধ্যার দিকে তাকাল।

রেহান বলল, “আমাদের চার্জটা?”

“ও! হ্যাঁ!” শচীন মানিব্যাগ খুলে পঁচিশটা টাকা বার করল।

টাকা নিল রেহান। “সন্ধ্যা, ওঁকে রসিদ দিয়ে দাও।”

প্রতাপরা অপেক্ষা করছিল বাড়িতে। শচীন আসতেই হর্ষধ্বনি করে উঠল।

“আয় আয়—হাঁ করে বসে আছি। কী হল?”

শচীন বলল, “দাঁড়া আগে দম নিই তারপর বলছি।”

গজেন তার চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল শচীনকে। “নাও দাদা, চা খাও, তোমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে।”

চা খেতে খেতে শচীন বিকেলের বৃত্তান্ত বর্ণনা করল।

সব শুনে সুবিমল বলল, “তোর তো ভালই হল রে? নাকের বদলে নরুণ পেলি। লেগে যা। উইশ উই বেস্ট লাক।”

সন্ধ্যা মেয়েটিকে বেশ পছন্দই হয়ে গেল শচীনের। অবশ্য সন্ধ্যা মেয়ে নয়, মহিলা। বছর বত্রিশ বয়েস। গোলগাল চেহারা। একটু ভারি গড়ন। গায়ের রং ফরসা। মুখটি হাসিখুশি মাখানো। বিবাহিতা। চট করে ধরা যায় না। স্বামী থাকে জাহাজে। মেরিনের লোক। ছ’ মাসে ন’ মাসে ঘরে ফেরে।

সন্ধ্যার আর সবই ভাল। বুদ্ধিমতী, স্মার্ট, জীবন্ত। কিন্তু বড় বেশি খাদ্যলোভী। শচীনকে নিয়ে যখন রেস্টুরেন্টে ঢোকে কম করেও দশ বারো টাকার খাদ্য একাই খায়। দুটো মোগলাই একসঙ্গে যদি বা সাঁটা যায়, তার সঙ্গে ডবল ডেভিল কেমন করে মানুষ হজম করে কে জানে। কাটলেট আর চপ একই সঙ্গে কেমন করে ওড়ায় মানুষ কে জানে! ভেলপুরি, চানা মটর তো হরদম হচ্ছে। মুহূর্মুহূ কোল্ড ড্রিঙ্ক। তার সঙ্গে ট্যাক্সি, সিনেমা।

শচীন হিসেব করে দেখল সাত দিনে সন্ধ্যার পিছনে তার প্রায় শ’ দুয়েক টাকা বেরিয়ে গিয়েছে। এইভাবে চললে কলসির জল তো ফুরিয়ে যাবে।

সেদিন বিকেলে মেট্রো সিনেমার কাছে দেখা হতেই সন্ধ্যা বলল, “আধঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, ব্যাপার কী?”

“একটু দেরি হয়ে গেল। অফিসের কাজ।”

“আমার খিদে পেয়ে গিয়েছে। টিকিট কেটেছেন কুরবানির?”

“না, পারিনি।”

“জানতাম আপনি পারবেন না। আমি কেটে রেখেছি। নাইট শো।”

“নাইট শো।”

‘আটটা থেকে। আগে চলুন পেট ঠাণ্ডা করি। মার্কেটের রেস্টুরেন্টে যাব। বেড়াব খানিকটা, তারপর কুরবানি।”

শচীন বলল, “আজ আমার শরীরটা ভাল নেই। জ্বর জ্বর লাগছে।”

“ও ঠিক হয়ে যাবে। একটা স্যারিডনই যথেষ্ট। লেট আস গো।”

শচীন হিসেব করে দেখল, আজ তার অন্তত পঁচিশ ত্রিশ টাকা গচ্চা যাবে। উপায় নেই। পরের বউ বা অন্য মহিলা নিয়ে ঘোরাফেরা সত্যি বড় এক্সপেনসিভ। নিজের বউ এর ফিফটি পার্সেন্টও ছিল না। শচীনের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।

রেস্টুরেন্টে খেতে বসে শচীন বলল, “ওদিকে আমার কতটা কাজ হল?”

“হচ্ছে।”

“হচ্ছে মানে?”

“কথাবার্তার চেষ্টা চলছে, সন্ধ্যা বলল ফাউল কাটলেট চিবুতে চিবুতে। “আপনার স্ত্রী ভীষণ অ্যাডামান্ট।”

“বলছে কী?”

“অনেক কথা। আপনি কোনো ভাবেই স্বামী হবার যোগ্য নয়।”

শচীন মাছ মাংসের দিকে যায়নি। পুডিং চা খাচ্ছিল। সন্ধ্যা আজ সিল্কের শাড়ি পরেছে, চন্দনের রং ব্লাউজটা একেবারেই খাটো, চুলের স্টাইল পালটেছে, দারুণ গন্ধ মেখেছে। শচীন বলল, “যোগ্য নয় বললে আমি আর কী বলব! আচ্ছা আপনিই বলুন—?”

“কী বলব?”

“না, আমার সঙ্গে মেশামেশিতে আপনার কী মনে হচ্ছে?”

সন্ধ্যা মুখ তুলে শচীনকে দেখল। চোখ ভরা হাসি। “আমার তো খুবই পছন্দ আপনাকে। ভীষণ।”

শচীন খুশি হল। “তা হলে? আপনার মতন মহিলা যদি পছন্দ করতে পারেন আমাকে আমার স্ত্রী কেন পারবেন না বলুন?”

সন্ধ্যা কাঁটা চামচ নামিয়ে দু হাত খোঁপার কাছে তুলে চুল ঠিক করল। হাসল। “সকলের পছন্দ এক নয়। আমি আপনাকে যতই দেখছি ততই ইমোশানালি অ্যাটাচড হয়ে পড়ছি। সত্যি! আমাদের যদি আগে দেখা হত…”

শচীন আহ্লাদে গলে গেল যেন। “কপাল! জীবনটা এই রকমই। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাহি না…।”

“বাঃ! আপনি কবিতা লেখেন নাকি? কবিরা স্বামী হলে স্ত্রীদের কত আনন্দ—তাই না?”

শচীন সিগারেট ধরাল। “না আমি কবি নই। তবে আপনাকে দেখে মাঝে মাঝে পোয়ট্রি ফিল করি।”

সন্ধ্যা যেন খেলাচ্ছলে বুকের আঁচল সরিয়ে আবার শাড়ির ভাঁজ ঠিক করল। চাপা হাসি মুখে। “আমি জানি। আপনার চোখ বলে আপনি কী ফিল করেন। কিন্তু আমি কী ফিল করি আপনি বোঝেন?”

শচীন বলতে গিয়েও বলল না। তাকিয়ে থাকল।

সন্ধ্যা বলল, “পুরুষরা মেয়েদের কথা বোঝে না। আমরা কিন্তু আপনাদের কথা বুঝি।…নিন, এবার উঠব। আর ভাল লাগছে না। কুরবানিতে আমাদের সিট খুব ভাল।”

খানিকটা ঘোরাফেরা শেষ করে সিনেমা হলে।

সন্ধ্যার বাহাদুরি বলতে হবে। চমৎকার এক জোড়া সিট জোগাড় করেছে। একেবারে পিছনের সারি, ডানপাশের দেয়াল ঘেঁষা।

শচীন হিন্দি সিনেমার ভক্ত নয়। মাঝে মাঝে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যায়। রগড় দেখে আর হাসে।

সিনেমায় তার মন ছিল না। সন্ধ্যার সঙ্গে একটু খেলাখেলি করার ইচ্ছেই ছিল আসল। পায়ে পায়ে, কনুইয়ে কনুইয়ে, কাঁধে কাঁধে কিছুক্ষণ খেলাধুলো চলল, তারপর শচীন বলল, “আমার ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুরে আসি।”

‘ঘুম! এই রকম ছবি দেখা ছেড়ে?”

“আমার এই সময়ে একটু ঘুম-ঘুম পায়। বাইরে একটা চক্কর দিলে ঘুম কেটে যাবে। আপনি বরং ছবি দেখুন, আমি শোয়ের শেষে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব।”

“ঠিক?”

“বিলকুল ঠিক।”

“আসুন তা হলে?”

শচীন বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে ঘড়ি দেখল। হাতে ঘণ্টা খানেকেরও বেশি সময়। ব্রিস্টল থেকে দেড়খানা মেরে আসা যায়। আর দাঁড়াল না শচীন। হন হন করে ছোট ব্রিস্টলের দিকে এগুলো।

শচীন তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে পান সিগারেট। চোখ সামান্য লালচে। সন্ধ্যা আসতেই শচীন হাত তুলল। “এই যে!”

কাছে এল সন্ধ্যা। শচীন বলল, “একটু তাড়াতাড়ি করুন। বৃষ্টি আসবে।”

“তাই নাকি? তা হলে ট্যাক্সি ধরতে হয়।”

“ধরা যাবে। আসুন।”

সন্ধ্যাকে নিয়ে ফাঁকায় আসতেই ট্যাক্সি পাওয়া গেল।

সন্ধ্যাকে উঠিয়ে শচীন উঠছে তার কানে এল কে যেন বলল, “শালার হেভি ব্ল্যাক মানি। সুখের পায়রা মাইরি। কেমন জুটিয়েছে।”

শচীন তাকাল। জনাপাঁচেক লোফার টাইপের ছোঁড়া।

ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে শচীন বলল, “আমি একটা কথা ভাবছিলাম।”

“জানি” সন্ধ্যা বলল।

“জানেন? কী—?” শচীন গায়ে গায়ে বসল, একটা হাত সন্ধ্যার পিঠের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিল। “কী জানেন?”

“আপনিই বলুন?”

“না, আপনি। মেয়েরা অনেক কিছু আগে বোঝে বলছিলেন না তখন? দেখি, কী বুঝেছেন আপনি?”

সন্ধ্যা খানিকটা ক্লান্তির ভাব করে আরও ডুবে গেল গদির মধ্যে। তার কাঁধে শচীনের হাত। রাস্তার দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা বলল, “ভাবছিলেন ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়াই ভাল। তাই না?”

শচীন হাঁ হয়ে গেল। বলল, “একজ্যাক্টলি। আপনি কি থট রিডিং জানেন?”

“তা জানি। কিন্তু একতরফা যদি ডিভোর্স হয় লাভ কী? আমার তো মুক্তি নেই।”

“আপনিও করে নিন।”

“তার পর?”

“তারপর তো সবই সম্ভব। আমরা দুজনেই তখন মুক্ত।”

“না বাবা, আমার অত মুক্ত থাকতে ভাল লাগে না।”

“আহা—অত থাকবেন কেন? দু-এক মাস। তারপর আমরা যুক্ত হব।”

সন্ধ্যা শচীনের ঝোলানো এবং চঞ্চল হাত নিয়ে খেলা করতে লাগল। “মুখেই বলছেন। কাজের বেলায় তখন—?”

“না না মুখে বলব কেন! আমি মন থেকে বলছি।”

“যাঃ! মদ খেয়ে বলছেন?”

শচীন যেন বেজায় ধাক্কা খেল। বলল, “মাত্র দেড় খেয়েছি। এতে মাথা গোলমাল হয় না। যা বলছি একেবারে সজ্ঞানে।”

“সজ্ঞানে কেউ বোকা কথা বলে না,” সন্ধ্যা হাসল।

“মানে?”

“মানে আপনি আমার কেস। ক্লায়েন্ট। আপনার পরামর্শ শুনতে গেলে আমার কী দশা হবে! রেহানদি তাড়িয়ে দেবে আমায়। আমার চাকরি যাবে।”

“যাক। আমি চাই তোমার চাকরি যাক। কিসের পরোয়া তোমার! আমার সবকিছু তোমার।” বলে শচীন সন্ধ্যার কোলের ওপর ঢলে পড়ল।

সন্ধ্যা শচীনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি একেবারে নেংটি মাতাল। আমার এই নেংটি মাতালদের ভাল লাগে না। একদিন ধেড়ে মাতাল হয়ে কোলে শুয়ো তখন ক-ত আদর করব। নাও ওঠো। আর ন্যাকামি কোরো না।” বলে সন্ধ্যা চুলের ঝুঁটি ধরে শচীনকে তুলে বসিয়ে দিল।

জরুরি তলব রেহানের। টেলিগ্রাম হলে লেখা হত: কাম শার্প। ফোনে রেহান গম্ভীর গলায় বলল, “ছ’ টায় আসুন। জরুরি দরকার।”

শচীন বেশ ভয় পেল! দিন দুই আর দেখা নেই সন্ধ্যার। হয়তো অসুখ-বিসুখ করেছে। তার বাড়িটাও জানে না শচীন। জানবার চেষ্টা করেও পারেনি। সন্ধ্যা বলেছে, এটা আমাদের বলতে নেই। কনফিডেনসিয়াল। কী হবে বাড়ির ঠিকানা জেনে, ঠিকানার মানুষই তো হাজির।

শচীন এটাও লক্ষ করেছে, সন্ধ্যাকে যখনই ট্যাক্সি চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছে এলগিন রোডের মুখে এসে সন্ধ্যা বলেছে, আর নয়—এবার আপনি আসুন.’ একটা লোক এলগিন রোডের মুখ থেকে যে কোনো দিকে চলে যেতে পারে—সোজা ডাইনে বাঁয়ে—কাজেই সন্ধ্যা কোন দিকে যায়, কতটা যায়—তা শচীনের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

শচীন ভাবল প্রতাপকে একবার ফোন করে। করল না। করে লাভ নেই।

ঘড়িতে ছ’টা বাজার আগে আগেই শচীন রেহানের অফিসে গিয়ে হাজির। অন্যদের দেখল, সন্ধ্যাকে দেখতে পেল না।

রেহানের ঘরে ঢুকতেই দেখল, রেহান একেবারে সার্কাসের ড্রেস পরে বসে আছে। প্যান্ট, গেঞ্জি ধরনের জামা। হাতে সিগারেট।

শচীন প্রথমেই কেমন ভড়কে গেল।

“বসুন।”

বসল শচীন। রেহান টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল। দু মুহূর্ত চুপচাপ! তারপর বলল, “আপনি গত দু’ হপ্তা কী কী করেছেন—তার রিপোর্ট আমি দেখেছি। নাউ টেল মি, আপনার মোটিভটা কী?”

শচীন ঘাবড়ে গেল। “মানে?”

“মানে, আপনি কোন মতলব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আপনার স্ত্রীকে আপনি ফিরে পেতে চেয়েছিলেন—তাই না?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই।”

“আপনার স্ত্রী ডিভোর্সের মামলা আনছেন এই ভয়ে আপনি আমাদের কাছে ছুটে এসেছিলেন। আপনি চাইছিলেন, এই মামলা যেন তোলা না হয়। ইউ আর উইলিং টু গেট ব্যাক ইওর ওয়াইফ! কারেক্ট?”

শচীনের মনে হল, রেহান নিশ্চয় ল’ পাস করেছে, এবং প্র্যাকটিস করে। চমৎকার জেরা করছে। শচীন বলল, “হ্যাঁ, দ্যাটস রাইট।”

“মুখে রাইট বলছেন, কিন্তু কাজে কী করছেন?”

“কাজে। কেন, কাজে কী করব! আই ডিড নাথিং।”

“মিথ্যে কথা বলবেন না।” বলেই রেহান ফট করে টেবিলের ফড়িং টাইপের বাতিটা জ্বেলে দিয়ে হাতের কাছের ফ্ল্যাট ফাইল তুলে নিল। ফাইলটা তুলে নাচাবার ভঙ্গি করল—যেমন করে লোকে হাতের চাবুক নাচায়। “এখানে আপনার ডে টু ডে অ্যাকটিভিটি লেখা আছে নিন দেখুন—।’ রেহান ফাইলটা ছুড়ে দিল। দিয়ে ল্যাম্পটার মুখ ঘুরিয়ে দিল। “রিড ইট।”

শচীন রীতিমত ঘাবড়ে যাচ্ছিল। ফাইলটা খুলে নিয়ে পাতা ওল্টাল।

পাতা উলটে শচীন অবাক। সন্ধ্যা প্রতিদিনের রিপোর্ট পেশ করেছে বেশ গুছিয়ে। এরকম রিপোর্ট সামারি পেলে অফিসের বড়কর্তারা নিশ্চয় খুশি হতেন। কখন কোথায় দেখা হল, দেখা হবার পর কোথায় যাওয়া হল, কথাবার্তা কী হল, কেমন খাওয়া-দাওয়া হল—তার সমস্ত বিবরণ সংক্ষেপে লেখা।

শচীন এর কোনোটাই আপত্তি-যোগ্য বলতে পারে না।

“দেখলাম। কিন্তু আপনি যে বলেছেন আমি কিছু করেছি, কই, এখানে তা লেখা কোথায়?”

রেহান আবার একটা সিগারেট ধরাল। “করেননি?”

“না।”

“আপনি শেষ রিপোর্টটা দেখেছেন?”

“চোখ বুলিয়েছি।”

“দুজনে মিলে নাইট শোয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন?”

“গিয়েছিলাম।” শচীন সাহস সংগ্রহের জন্যে একটা সিগারেট ধরাল।

“সিনেমা হলে আপনি—কী বলব—সন্ধ্যার হাত-টাত কাঁধ ধরেছিলেন?”

“ধরাধরির কী আছে মশাই! উনি টিকিট কেটেছিলেন নিজে। সিট দুটোও ভাল ছিল। চুপচাপ বসে সিনেমা দেখতে আমি পারি না। আমার একটু ইয়ে হয়…। আমি জাস্ট মজা করছিলাম।”

“মজা!… মজা ছেড়ে আপনি মদ খেতে বেরিয়ে গেলেন?”

“মজা ঠিক মতন করতে না পারলে বোর করে। আমার হাই উঠছিল, ঘুম পাচ্ছিল। সামান্য খেতে বেরিয়েছিলাম।”

রেহান হাত বাড়াল। ফাইলটা ফেরত নেবে। “সিনেমা থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে আপনি যা সব কাণ্ড করেছেন তা থেকেই বোঝা যায় আপনি তো একটা যাচ্ছেতাই ধরনের মানুষ।”

শচীন চুপ করে থাকল দু’মুহূর্ত, তারপর বলল, “কাণ্ড কিছুই করিনি। মানে তেমন কিছু!”

“করেননি! ইউ আর এ ড্যাম লায়ার! সন্ধ্যার হাত ধরে কী সব বলেছিলেন? ছি ছি, এদিকে আমাদের কাছে কাঁদুনি গাইতে এসেছেন, স্ত্রী যেন ডিভোর্স না করে, ওদিকে অন্য একজনের স্ত্রীকে উসকোচ্ছেন সে যাতে স্বামী ত্যাগ করে। তারপর…”

“আমি”, শচীন বাধা দিয়ে বলল, “কী বলেছি খেয়াল নেই। টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি খানিকটা নেশার ঘোরে ছিলাম। তবে হ্যাঁ, এটা বলেছিলাম, আমার তো কিছু হল না—আপনারও যা হাল—তাতে দুজনেই লেজ খসিয়ে পরে আবার ইয়ে করলে ভাল হয়।”

“ভাল হয়! আশ্চর্য! আপনি একজন পরস্ত্রীকে…”

“দেখুন! পরস্ত্রী-টরস্ত্রী জানি না। আমার গাঁটগচ্ছা কত যাচ্ছিল রোজ জানেন! বাড়িতে হিসেবের খাতায় লিখে রেখেছি।”

রেহান টেবিলের ওপর জোর থাপ্পড় মারল। “চুপ করুন। খরচার কথা তুলবেন না। আপনাকে বলাই হয়েছিল, সন্ধ্যার প্রফেশন্যাল এক্সপেন্সেস আপনাকে দিতে হবে। আপনি রাজি হয়েছিলেন।”

শচীন মাথা কাত করল। “হয়েছিলাম। তা বলে এত খরচ? মশাই খাওয়ার শেষ নেই। এক এক দিন চোদ্দো টাকার খাবার একাই খেতেন উনি। তার ওপর সিনেমা, ট্যাক্সি চড়ে হাওয়া খাওয়া…! আমাকে ফতুর করার জন্যে আপনি এই জিনিসটি আমার ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন। তা আমি দেখলাম—পয়সা যখন যাচ্ছে তখন আমিই বা একতরফা খরচ করে যাই কেন শুধু শুধু, একটু রিটার্ন তো দরকার।”

রেহান বিকটভাবে চিৎকার করে উঠল, “রিটার্ন! দাঁড়ান রিটার্ন দেখাচ্ছি।” বলতে বলতে রেহান ঘণ্টি টিপল। ও-ঘর থেকে একজন এসে দাঁড়াল।

“সন্ধ্যাদের আসতে বল!”

শচীন কেমন ঘাবড়ে গেল। যাচ্চলে, সন্ধ্যাও আছে তা হলে? কোথায় ছিল সন্ধ্যা লুকিয়ে, শচীন তো দেখতে পায়নি!

রেহান হাত বাড়িয়ে ল্যাম্পটা টেনে নিজের দিকে করে নিল।

শচীন বলল, “একটা কথা বলব?”

“বলুন?”

“আমি আপনাদের অ্যায়সা প্যাঁচে পড়েছিলাম যে প্যাঁচ কেটে বেরুবার উপায় পাচ্ছিলাম না। ইচ্ছে করেই ওসব করেছি।”

“আমরা আপনাকে প্যাঁচে ফেলেছিলাম?”

“দারুণ প্যাঁচে ফেলেছিলেন। বউ ফিরিয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে এক্সপ্লয়েট করছিলেন। আপনারা…”

শচীনের কথা শেষ হল না, দরজা খুলে সন্ধ্যা এল; সঙ্গে আর-এক মহিলা।

শচীন তাকিয়ে দেখল। তারপর তার ধাত ছেড়ে যাবার জো। মলয়া। একেবারে জ্বলজ্যান্ত। শচীনের গলা শুকিয়ে গেল।

রেহান সন্ধ্যাদের দেওয়াল-ঘেঁষা সোফায় বসতে বলল। তারপর শচীনের দিকে তাকাল। “আপনি বলছিলেন, আমরা আপনাকে প্যাঁচে ফেলেছি। তা খানিকটা ফেলেছি অবশ্য। যে রিপোর্টগুলো আপনি দেখলেন, তার একটা করে কপি আমরা সব সময় আপনার স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়েছি, টু ইনফর্ম হার অ্যাবাউট ইওর মিসডিডস!”

শচীন ঘামতে লাগল। এ তো সর্বনেশে জায়গা রে বাবা!

রেহান সন্ধ্যাদের দিকে তাকাল। মলয়াকে বলল, “ভাই, এবার আমি তোমাকে ওই স্বামী নামক মানুষটির কিছু কথাবার্তা শোনাব। প্লিজ লিসন।” বলে রেহান কোথায় একটা কল টিপল। তারপর শোনা গেল শচীনের গলা।

শচীন চমকে উঠেছিল। তারপর বুঝতে পারল রেহান আজকের কথাবার্তা কায়দা করে টেপ করে নিয়েছে। টেবিল ল্যাম্পটার দিকে তাকাল শচীন। তার একবারও মনে হয়নি, ওটা শুধু বাতি নয়, আর-এক গেঁড়াকল।

রেহানের টেবিলের আড়াল থেকে টেপ বাজতে লাগল।

আর শচীন বসে বসে ঘামতে লাগল।

শেষকালে টেপ শেষ হল।

একেবারে চুপচাপ।

রেহান বলল, “ভাই মলয়া, এই তোমার স্বামী। নিজের কানেই সব শুনলে। তুমি কি ওঁর কাছে ফিরে যেতে চাও? না কি ডিভোর্স স্যুট ফাইল করবে? আমরা তোমার তরফে সাক্ষী দিতে পারি। রেডি ডকুমেন্ট আছে।”

সন্ধ্যা বলল, “আমি কোর্টে আরও অনেক কিছু বলব। মোস্ট আনফেথফুল হাজবেন্ড। তুমি ডিভোর্স পেয়ে যাবে।”

শচীন চিৎকার করে বলল, “এ-সব কী হচ্ছে! বাঃ! আমি বউ ফেরত পাবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছি—আর আপনারা ব্যাপারটা কাঁচিয়ে দিচ্ছেন!”

রেহান বলল, “আপনি কি স্ত্রী ফেরত পাবার যোগ্য?”

“তার মানে!” শচীন আসামীর মতন মলয়ার দিকে তাকাল। “আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কী ছিল বলুন? স্ত্রীর জন্যেই এসেছিলাম। শালীদের জন্যে নয়।”

রেহান থ। তারপরই গর্জন। “কী বললেন, শালী!”

শচীন বলল, “স্ত্রীর বোনরা শালীই হন। বাংলা মতে। …নিন, অনেক হয়েছে, আর আমায় ঘাঁটাবেন না।” বলে শচীন মলয়ার দিকে তাকাল। “তুমি তোমার দিদিদের সব কথা বিশ্বাস কোরো না, প্লিজ। যা করেছি তোমার জন্যে। ঘরে চলো লক্ষ্মী! পা ধরব?”

সন্ধ্যা খিল খিল করে হেসে উঠল।

রেহানও হাসছিল। হাসতে হাসতে বলল, “মলয়া, এমন লেজকাটা ভগ্নিপতি আমি দেখিনি ভাই। তা যা করার তোমরাই ঠিক করো। এই মশাই, বউ নিয়ে যান আর না-যান আমাদের পুরো ফিজ কিন্তু দিয়ে যাবেন।”

ট্যাক্সিতে পাশাপাশি বসে শচীন বলল, “তুমি আমার বাইরে বাইরে চিনলে ভাই, ভেতরটা দেখলে না?”

মলয়া কথা বলল না।

শচীন স্ত্রীর হাত টেনে নিয়ে বলল, “তোমার প্রাণে একটু মায়া নেই। চার বছরের স্বামী। দেড় মাস তাকে খেলালে?”

মলয়া বলল, “মায়া-টায়া জানি না। তবে খুব খেলছিলে। তোমার খেলার কথা শুনে গা আমার রিরি করত, বাড়ি চলো—খেলা দেখাব।”

শচীন বউয়ের কোলে হাত ডুবিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই দেখাবে। তোমার খেলা না দেখে মরে যাচ্ছিলাম মাইরি।”

মলয়া স্বামীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “অসভ্যতা কোরো না।”

বসন্ত বিলাপ

অতি তুচ্ছ ঘটনা থেকে অনেক বৃহৎ কাণ্ড ঘটে যায়। শ্যামের বেলায়ও ব্যাপারটা সেই রকম ঘটেছিল। রেল স্টেশনের বাইরে সিঁড়ির কাছে শ্যাম দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে প্রায় ফুরিয়ে-আসা সিগারেট। ভিড়টিড় বলতে আশপাশে তখন বিশেষ কিছু ছিল না, শাট্ল্ ট্রেনের যাত্রীরা সকলেই চলে গেছে একরকম। শ্যাম সামনের দিকে তাকিয়ে একটা সাইকেল রিকশা খুঁজছিল। কিন্তু সে বেশ অন্যমনস্ক ছিল। অন্যমনস্কতার মধ্যেই শ্যাম দূরের একটা রিকশাকে ডান হাত তুলে ইশারায় কাছে ডাকল, এবং অন্যমনস্কভাবেই বাঁ হাতের আঙুলের টোকায় সিগারেটের অতিক্ষুদ্র অংশটা বাঁ দিকে ছুড়ে দিল। শ্যাম সামনের রিকশা দেখছিল—আপপাশ দেখেনি। রিকশার জন্যে শ্যাম এগুতে যাচ্ছে, আচমকা তার জামা ধরে কেউ বেজায় জোরে টান মারল। মুখ ফিরিয়ে শ্যাম দেখল ‘বসন্ত বিলাপ’-এর সেই সিংহবাহিনী, পাশে তার অন্য এক সঙ্গিনী।

একেবারে প্রথমটায় শ্যাম কিছু না বুঝে চমকে ওঠার মতন হলেও পরের কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে সব বুঝে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। তার সিগারেটের টুকরোটা মেয়েটির—অর্থাৎ সেই সিংহবাহিনীর শাড়ির সামনের কুঁচির মধ্যে ছুঁছো বাজির মতন ঢুকে গিয়েছিল। স্টেশনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, দিবালোকে শাড়ির পায়ের কাছটা দুলিয়ে, নাচিয়ে, কিছুটা বা সামনে বাড়িয়ে মেয়েটি অগ্নিমূর্তি হয়ে শ্যামকে সগর্জনে ধমকাতে ও গালিগালাজ করতে শুরু করল। মেয়েদের আরক্ত মুখ, রাঙা চোখ, সকুঞ্চিত ভ্রূ স্ফুরিত নাসা, দস্তপঙ্‌ক্তি—কোনোটাই শ্যামের অপ্রিয় বস্তু নয়, কেননা শ্যামের মাত্র চৌত্রিশ বছর চলছে, সে একটু-আধটু শৌখিন কাব্যচর্চাও করে থাকে এবং এখনও অবিবাহিত। কিন্তু এই মুহূর্তে শ্যাম চোখে অন্ধকার দেখছিল, তার সম্মুখস্থ মেয়েটির তর্জন-গর্জনে তার হুঁশ প্রায় ছিল না, আর গালিগালাজ যেটুকু মরমে প্রবেশ করছিল তাতে অপমানে শ্যাম একেবারে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল।

ইডিয়েট, অসভ্য, জন্তু অভদ্র—ইত্যাদি শব্দগুলি ছুরির মতন শ্যামের আত