নীলেন্দু বলল, তোর কি অসুখ-বিসুখ করেছে?
বুলবুল অস্বীকার করল না, বলল পেটে একটা ব্যথা হয়, জ্বরও হয় মাঝে মাঝে। সব সময় কেমন গাবমি গা বমি লাগে।
দেখ আবার আলসার-টালসার হল কিনা! …যাকগে, এখন আমায় কী করতে হবে বল।
বুলবুল অদ্ভুত মুখ করে বলল, তুমি আমায় কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দাও। যেখানে থোক কলকাতায় নয় বাংলা দেশের বাইরে যেতেও আমি রাজি।
নীলেন্দু অপলকে বুলবুলকে দেখতে লাগল। বেচারির সমস্ত মুখ এমন দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তে সে কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে বেঁচে যায়।
কী করা যায় নীলেন্দু ভাবতে লাগল। কলকাতায় এক-আধটা দিন হয়তো বুলবুলকে রাখা যায়, কিন্তু তাতে ছেলেটা স্বস্তি পাবে না। পুলিশের ভয় আর তাড়া থেকে বাঁচবার জন্যে সে কোনও নিরাপদ জায়গায় যেতে চায়। বিজুর আত্মহত্যার পর পুলিশ যে ওই বাড়িটার বাকি তিনজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। বুলবুলদের যথার্থ পরিচয় জানতে বেশি সময় লাগবে না।
নীলেন্দু বলল, আজ রাত্রে তুই কোথায় যাবি? এখানেই থেকে যা। …দেখি, ভেবে দেখি কী করা যায়।
বুলবুল শূন্য চোখে নীলেন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকল।
.
আরও খানিকটা রাত্রে নীলেন্দু আর বুলবুল অন্ধকার ছাদে আলসের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশের সেই একফালি চাঁদ মেঘের আড়ালে চলে গেছে। এখন আকাশে ভাঙা ভাঙা মেঘগুলো আবার যেতে শুরু করেছে। হয়তো মাঝরাতে বৃষ্টি নামতে পারে।
বাতাসটা ঠাণ্ডা। বুলবুল সারাদিন পরে এবাড়িতে স্নান করতে পেরেছে। খাওয়া-দাওয়া সেরেছে। অবশ্য তার খিদে মরে গিয়েছিল, তবু বাড়ির রান্না খেয়ে তার চোখে হঠাৎ জল এসে পড়ছিল, অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছে। খেতে বসে বুলবুল একটা জিনিস বেশ লক্ষ করেছে। নীলুদা একেবারে গম্ভীর, মুখ নিচু করে তাড়াতাড়ি খাচ্ছিল, যেন ব্যাপারটা চুকিয়ে উঠে পড়তে পারলেই বাঁচে। নীলুদার কাকিমারা কিছু না বললেও বুলবুলকে যে অন্য চোখে নজর করছে সেটাও সে বুঝতে পারছিল। হয়তো নীলুদার এই সব চেনাজানা ছেলেদের ব্যাপারটা বাড়ির লোক জানে।
অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বুলবুল সারাদিনের ক্লান্তি, উৎকণ্ঠা, ভীতির ভার অনুভব করতে করতে শব্দ করে হাই তুলল।
নীলেন্দু কখনও আকাশ দেখছিল কখনও কাছাকাছি বাড়ির ছাদের ভাঙাচোরা চেহারা। আসলে সে কিছুই দেখছিল না, ভাবছিল। ভাবছিল, বুলবুলকে কোথায় পাঠানো যায়? পাকুড়ে জয়ার এক দেওর থাকে, কিন্তু সে তেমন বিশ্বস্ত নয়। আসানসোলে গোপীজীবন থাকে, সে এ ধরনের ঝামেলা ঘাড় পেতে নিতে চাইবে না।
কোথায় পাঠানো যায় বুলবুলকে? মহীদার কাছে? কিন্তু…
নীলেন্দু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুই মহীদার নাম শুনেছিস?
কে মহীদা?
শুনিসনি?
না। সে কে?
তুই চিনবি না। …যাক গে, কলকাতায় এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে চার-পাঁচটা দিন থাকতে পারিস?
না।
হুট করে কোথাও পাঠাবার আগে একবার জেনে নিতাম…
আমার কোথাও থাকার জায়গা নেই, নীলুদা! ..কী রকম অবিচার দেখো! আমি কিছু করিনি, আমি আর মানু একেবারে ইনোসেন্ট, আমরা কোনওদিন একটা খারাপ কিছু করিনি–শুধু ওদের সঙ্গে মেলামেশাই ছিল, তাতেই পাড়া রেড করার সময় আমাদের তাড়া করল। কুকুরের মতন সব তেড়ে এল, পাড়ার লোক আর পুলিশ। না পালিয়ে কী করব! তারপর মাসের পর মাস লুকিয়ে দিন কাটাচ্ছি। বিজুটা আত্মহত্যা করে আরও ফাঁসিয়ে দিল…
নীলেন্দু কিছু বলল না। সে জানে। বুলবুল তো একা নয়, এরকম অজস্র রয়েছে, জেলে পচছে, লুকিয়ে লুকিয়ে দিন কাটাচ্ছে। নীলেন্দুকজনকে আর চেনে। বুলবুলকেও তার চেনার কথা নয়, তাদের পুরো দলটাকেই নীলেন্দু আগে চিনত না; চিনেছে পরে, অনেক পরে।
নীলেন্দু বলল, চল শুবি চল, আমি একটু ভেবে নিই।
.
১০.
নীলেন্দুর ঘুম আসছিল না। রাত ঠিক কত বোঝা যায় না, হয়তো দেড়টা দুটো হবে, একপশলা পাতলা বৃষ্টি হয়ে থেমে গেছে, বাতাস ভিজে, আবার কোনও সময়ে ঝপ করে বৃষ্টি এসে যেতে পারে।
বুলুবুল ঘুমোচ্ছে। মাটিতে। নীলেন্দুর খাট দুজনের শোবার মতন নয়, সে অবশ্য বুলবুলকে খাটে শুতে বলে মাটিতে একটা শতরঞ্জি আর ময়লা চাদর বিছিয়ে নিয়েছিল শোবার জন্যে কিন্তু বুলবুল কিছুতেই খাটে শুতে রাজি হল না, মাটিতে শুয়ে পড়ল। ছেলেটা সারাদিন এত ছোটাছুটি করেছে, ভয়ে বিহ্বলতায় এমনই দিশেহারা হয়ে ছিল যে শোবার খানিকটা পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে তার শরীর মন আর তাকে টানতে পারছিল না। বুলবুলের নিশ্চিন্ত ঘুম দেখে নীলেন্দুর মনে হচ্ছিল, ছেলেটা যেন তার সমস্ত দায় দুশ্চিন্তা নীলের হাতে সঁপে দিয়ে নির্ভার হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
নীলেন্দু নিজে ঘুমোতে পারছিল না। বুলবুলকে কোথায় পাঠানো যায় ভাবতে ভাবতে তার মাথা ভার হয়ে উঠল। কোনও জায়গা সে খুঁজে পেল না। আজকাল জায়গা পাওয়া মুশকিল, সবাই সাবধান হয়ে গেছে, পুলিশের ভয়, পাড়ার ছেলেদের ভয় তাদের ভীষণ সাবধান করে দিয়েছে। যে রঞ্জিৎ বুলবুলকে নীলের কাছে পাঠাল–সেই রঞ্জিতেরই একসময় কত জানাশোনা ছিল, আজ সে আর কাউকে বিশ্বাস করে না, তার সাধ্যে কিছুই আর কুলোয় না।
কিন্তু নীলেন্দুই বা বুলবুলকে কোথায় পাঠাবে? তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। এক মহীদার কাছে বুলবুলকে পাঠানো যেতে পারে। পারে মানে উপায় নেই বলেই পাঠানো যায়। নীলেন্দু নিজে যে এটা পছন্দ করছে তা নয়, কেননা মহীদা বা দেবীদি ব্যাপারটা ভাল মনে নেবে না, তারা মনে করবে নীলেন্দু জেনেশুনেও তাদের ঘাড়ে একটা বিপদজনক ঝুঁকি চাপিয়ে দিল। হয়তো অন্য কিছুও ভাবতে পারে–যেমন দেবীদি ভাবতে পারেনীলেন্দু ইচ্ছে করেই তাদের কোনও খুঁটির সঙ্গে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।