বুলবুল বলল, কোথায় গিয়েছিলে? তুই কতক্ষণ এসেছিস?
ঘন্টাখানেক। গলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। বড় রাস্তায় বাসগুমটিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
বোস না, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
তোমার এখানে জল আছে?
খাবি? দাঁড়া..
নীলেন্দুর ঘরে কুঁজোয় জল ছিল। জল গড়িয়ে দিল নীলেন্দু।
জল খেয়ে বুলবুল চেয়ারে বসল।
নীলেন্দু গায়ের জামা ছাড়তে ছাড়তে বলল, কী খবর বল?
বুলবুল যেন সামান্য জিরিয়ে নিচ্ছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, তুমি একটা খবর জানো?
কী? বি
জু কাল সুইসাইড করেছে।
নীলেন্দু যেন চমকে উঠল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, সে কি! কই না, আমি কিছু শুনিনি।
বুলবুল বলল, বিজু জামসেদপুর থেকে দিন সাতেক আগে ফিরে এসেছিল, বাড়িতে যায়নি– ওদের পাড়ায় ঢোকাই যায় না। বিজু আমাদের কাছে এসে উঠেছিল। এমনিতে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। একবার শুধু সমরের সঙ্গে তর্ক করেছিল, বলেছিল–পলিসি অফ রিট্রিট চলছে বড়দের মধ্যে। তারা গা বাঁচাচ্ছে। আমাদের জন্যে কেউ ভাবছে না, ভাববে না। …পরের দিন বিজু সুসাইড করেছে। বুলবুল শার্টের হাতায় কপালের ঘাম মুছল।
নীলেন্দু তখনও নিজেকে সামলাতে পারেনি। বিজু–মানে বিজন আত্মহত্যা করার মতন পলকা ছেলে নয়; ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা না থাকলেও নীলেন্দু বিজুকে মাঝে মাঝে দেখেছে, তার কথাও শুনেছে। শক্ত, জেদি ধরনের ছেলে, তার বাবা সরকারি চাকরি করে, বিজুকে একবার পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল সিথি থেকে, বেদম মারধোর করেছিল, আত্মীয়স্বজনরা ধরাধরি করে বিজুকে খালাস করে এনেছিল। তার পরই বাড়ি থেকে জামসেদপুরে পাঠিয়ে দেয়, কোন মাসির কাছে।
বুলবুল বলল, বিজুর ডেডবডি বোধ হয় এখনও ঘরে পড়ে আছে।
নীলেন্দু চমকে উঠল আবার; কী বলছিস কী?
আমরা সকাল বেলায় উঠে বিজুকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখেছি– বুলবুল তার বাঁ হাত মাথার রুক্ষ ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিশেহারার মতন বলল, মানু প্রথমে দেখেছিল, দেখেই আমাদের ডাকল। সমর আর আমি পরে দেখলাম। উঃ, সে কী দেখতে নীলুদা, চোখে দেখতে পারবে না।
নীলেন্দু নিজেকে সামলে নেবার জন্যে বুলবুলের দিকে আর তাকাচ্ছিল না। বুলবুলের সমস্ত মুখে বিহ্বলতা, ভয় যন্ত্রণা যেন কালশিটের মতন কালো হয়ে ফুটে উঠেছে।
তোরা তো বাড়িতেই ছিলি… নীলেন্দু বলল।
আমরা সকলেই ছিলাম। বিজু বোধ হয় মাঝরাত্রে বা শেষরাত্রে উঠে ভাঁড়ার ঘরের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়েছে।
ভাঁড়ার ঘরের মধ্যে?
ঘরটা ছোট। পড়ে ছিল। মাথার ছাদে লোহার আংটা লাগানো ছিল…আমরা কোনওদিন খেয়াল করিনি, জানতামও না। সকাল বেলায় মানু ঘরের দরজাটা আধখোলা দেখে… পায়ের শব্দ পেয়ে বুলবুল চুপ করে গেল।
মায়া এল। হাতে দু কাপ চা। বুলবুলকে আবার দেখল। এই ধরনের বিশ্রী চেহারা, পোশাক-আশাকের মানুষটিকে তার তেমন পছন্দ হল না, বরং সন্দেহই হল যেন কেমন।
মায়া চলে গেলে নীলেন্দু বলল, তোরা সেই লিলুয়ার বাড়িতেই আছিস?
ছিলাম। আজ সকালে সকলেই পালিয়ে এসেছি। সমর তারকেশ্বরের দিকে যাবে বলল, আর মানু হাওড়া স্টেশনে এসে বর্ধমান লোক্যাল ধরল।
তুই সেই তখন থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?
বুলবুল চায়ে চুমুক দিল, নিতান্তই অভেসবশে যেন, তার তৃষ্ণা বা রুচি কিছুই ছিল না। বলল, আমি পদ্মপুকুরে গিয়েছিলাম একবার, আমার পিসতুতো এক দিদি থাকে, সেখান থেকে বেরিয়ে দুপুরবেলা রঞ্জিৎদাকে ফোন করলাম। রঞ্জিৎদা বিকেলে ধর্মতলা স্ট্রিটে দেখা করতে বলল। সে সব শুনে বলল, তোমার কাছে আসতে।
নীলেন্দু অনেকক্ষণ থেকেই ভাবতে শুরু করেছিল। ভাবনা অনেক সময় উনুনের ধোঁয়ার মতন শুধু ফেনিয়ে ওপরে ওঠে, তার সমস্তটাই আকারহীন, এলোমেলো, বিরক্তিকর। নীলেন্দুর ভাবনাও কোনও বিশেষ আকার পাচ্ছিল না। সে চা খেতে খেতে সিগারেট ধরাল। একেবারে চুপচাপ। গম্ভীর। কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল মনে মনে।
বিজু আমাদের এমন করে ফাঁসিয়ে যাবে ভাবিনি নীলেন্দুদা– বুলবুল বলল, ওর মাথায় কী করে যে এই ব্যাপারটা এল! এখন তো পুলিশের একেবারে খপ্পরে পড়ে গেলাম আমরা তিন জনেই…। বিজু আমাদের সকলকে ডেনজারাস পজিশনে ফেলে দিল।
অন্যমনস্কভাবে নীলেন্দু জিজ্ঞেস করল, বিজু কিছু লিখে গিয়েছে?
কী জানি! আমরা ভাল করে খুঁজে দেখিনি। ব্যাপারটায় এরকম নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম যে সঙ্গে সঙ্গে তিন জনেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি।
বাড়িতে কিছু নেই তো?
বুলবুল তাকাল। ছোট করে বলল, না; ওসব নেই।
নীলেন্দু কী যেন ভাবল, তোরা নাকি কোন রেল কলোনির বাড়িতে থাকতিস?
না; আমরা একটা আধ-পোড়ো বাড়িতে থাকতাম– বুলবুল বলল কেউ তৈরি করতে করতে আধখাপচা করে ফেলে রেখে গিয়েছিল। ওদিকটা ডিস্টার্বড ছিল খুব; এখনও লোকজন কম। একটা কাঁচ কারখানা আছে কাছাকাছি…।
কারখানায় মানু কাজ পেয়েছিল না?
নাম ভাঁড়িয়ে একটা কাজ করত..
সমর?
ও মাঝে মাঝে কলকাতায় এসে কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে নিয়ে যেত।
তুই কিছু করতে পারিসনি?
না।
নীলেন্দু বাকি চাটুকু খেয়ে ফেলল এক ঢোঁকে। বুলবুলের দিকে অকারণে তাকাল। চোখ ফিরিয়ে নিল আবার। ছেলেটা যে অসুস্থ বোঝাই যায়। জন্ডিসে ধরেছে নাকি? চেহারা দেখে মনে হয়, টি বি-তেও ধরতে পারে। আশ্চর্যের কী আছে, ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দিন কাটাচ্ছে কতদিন ধরে, খেতে পায় কি পায় না অর্ধেক দিন, যা পায় তাতে হয়তো পেট ভরে না, দিনের পর দিন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে, ঘুম নেই, গায়ে জামাকাপড়ও জোটে না, কোনও রকমে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে।