পাশের দোকান থেকে নীলেন্দু সিগারেট কিনল। কিনে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। বড় রাস্তা ধরে আরও খানিকটা হেঁটে ট্রাম।
কলকাতায় বর্ষা নেমে গেছে। আজ সারাদিন যদিও বৃষ্টি হয়নি, তবু মেঘলায় মেঘলায় কেটেছে, কখনও মেঘলা ঘন হয়েছে, কখনও ফিকে। আকাশে এখনও মেঘ ভাসছে, কোথায় বুঝি চাঁদ উঠে আছে, দেখা যাচ্ছে না, মেঘের গায়ে ময়লা জ্যোৎস্না পড়ছে মাঝে মাঝে।
নীলেন্দু হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম স্টপের কাছে এসে দাঁড়াল। চারদিক তাকালে খুব আশ্চর্য লাগে, ওপাশের রাস্তায় ইটের পাঁজার মতন ময়লা জমানো রয়েছে, সেই ময়লা উড়ছে বাতাসে; অন্য দিকে মাটি খুঁড়ে পাহাড় জমানো, গাড়ি-টাড়িতে এখনও মানুষ গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরছে, রিকশায় আলো নেই, একটা চাকা ভাঙা লরি কাত হয়ে একপাশে পড়ে।
নীলেন্দু বিরক্ত হলেও তেমন কিছু মনে করল না। কলকাতা শহরে চতুর্দিকে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখ এখন অভ্যস্ত, মনও যেন আর বিরূপ হয় না, কেননা হয়ে লাভ নেই। একটা ট্রাম আসছিল। নীলেন্দু তাকাল। ভিড়। ভিড়ের মধ্যেই উঠে পড়ল নীলেন্দু।
সামনের দিকে যতটা পারে এগিয়ে যাচ্ছিল নীলেন্দু। হঠাৎ তার মনে হল; লেডিস সিটে পাশাপাশি যারা বসে আছে তার মধ্যে একজনকে সে চেনে। কয়েক পলক লক্ষ করে দেখল নীলেন্দু। কোনও সন্দেহ নেই দেবেন আর দেবেনের বউ পাশাপাশি বসে। বউ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। গায়ে গা দিয়ে বসে নিচু গলায় কথা বলছে।
নীলেন্দুর একবার ইচ্ছে হল, দেবেনকে ডাকে। দেবেন বছর তিনেক বি ডিভিসনে খেলে শেষে রেলে চলে যায়। রেলওয়ের হয়ে দু-এক বছর খেলেছিল। হাঁটুতে জখম হবার পর আর খেলতে পারল না। চাকরিটা অবশ্য তার থেকে গেছে।
পরের স্টপে নীলেন্দুর পাশ কাটিয়ে জনা দুয়েক যাত্রী যাবার জন্যে এগিয়ে আসতে সে আরও একটু এগিয়ে গেল। মানে দেবেনদের ছাড়িয়ে সামনে চলে গেল। ট্রামের রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নীলেন্দু কেমন কৌতূহলবশে আবার দেবেনের দিকে তাকাল। দেবেন খানিকটা মোটা হয়েছে। তার বউকেও মন্দ দেখাচ্ছিল না, যদিও গায়ের রং কালো তবু চোখমুখ মিষ্টি ধরনের। একটু সাজগোজ করেছে তার বউ। বোধ হয় নেমন্তন্ন রাখতে গিয়েছিল কোথাও, বা সিনেমায় গিয়েছিল।
দেবেন তাকাল। নীলের সঙ্গে চোখাচুখি হল। কিন্তু অন্যমনস্ক থাকায় নীলেন্দুকে চিনতে পারল না। অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।
আরও দু-তিন স্টপ পরে নেমে গেল দেবেনরা। সামনের এক ভদ্রলোকও নামলেন। নীলেন্দু বসবার জায়গা পেয়ে গেল।
সিটে বসে নীলেন্দুর হঠাৎ কেমন একটা মজার খেয়াল হল। আচ্ছা, যদি এমন হত দেবেন নয় নীলেন্দুই তার বউ নিয়ে বসে ট্রামে করে ফিরছে কেমন হত? দেবেন বেটা দেখত তাকে। নীলেন্দু যখন দেবীদিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, ট্রামে বাসে ট্যাক্সিতে–তখন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তারা যে ধরনের শয়তানি হাসি হাসতোর মর্ম বোঝা নীলেন্দুর দুঃসাধ্য ছিল না। এমনও হত, কোনও বন্ধু পরে দেখা হলে রহস্যময় হাসি হেসে জিজ্ঞেস করত, কী রে, কবে হচ্ছে? মানে তারা জানতে চাইত নীলেন্দু কবে তার সঙ্গিনী মেয়েটিকে বিয়ে করতে যাচ্ছে!
নীলেন্দু রঙ্গ করে দেবযানীকে বলত, দেবীদি, আমার বন্ধুরা কিন্তু তোমাকে আমার প্রেমিকা ভাবে।
দেবযানী কটাক্ষ করে জবাব দিত, যেমন সব বন্ধু তোমার।
তোমার বাড়ির লোক, চেনাজানারা আমাকে তা হলে কী ভাবছে?
যা ভাববার ভাবছে।
আমি তোমার লাভার।
ইস কী আমার লাভার! গাল টিপলে দুধ পড়বে রে তোর…!
দুগ্ধপোষ্য বালকদের ভালবাসাই খাঁটি বুঝলে দেবীদি, এ ভালবাসার তুলনা সেই… বলে নীলেন্দু হো হো করে হাসত।
ট্রামের মধ্যে আচমকা হাসি এসে গেল নীলেন্দুর। কোনও রকমে সামলে নিল।
আরও খানিকটা পথ এসে নীলেন্দু জানলার পাশে জায়গা পেল, তার পাশের ভদ্রলোক নেমে গেলেন। আরাম করে বসল সে। বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। প্রায় কিছুই লক্ষ না করে শুধু অন্যমনস্কভাবে মানুষজন বন্ধ দোকানপাট গাড়ি দেখছিল নীলেন্দু। মনের মধ্যে বার বার কীসের যেন আঘাত এসে লাগছে বোঝা যাচ্ছে না। অনেক সময় জোয়ার আসার আগে নদীর পাড়ে এইভাবে জলের ধাক্কা এসে লাগে। অনেকটা সেই রকম। অথচ নীলেন্দু বুঝতে পারছিল না আঘাতের যথার্থ কারণ কী হতে পারে!
.
বাড়িতে ঢোকার আগেই কে যেন ডাকল। জায়গাটা অন্ধকার মতন, স্পষ্ট করে দেখা যায় না। নীলেন্দু কিছু বোঝবার আগেই তার গা ঘেঁষে যে এসে দাঁড়াল তাকে যেন প্রায় ছায়ার মতন দেখাচ্ছিল।
নীলুদা আমি বুলবুল।
বুলবুল!
তোমার সঙ্গে কথা আছে।
নীলেন্দুকে বিশেষ কিছু বলতে হল না। বুলবুলকে বলল, আয়।
বাড়িতে ঢোকার সময় নীলেন্দু যেন সামান্য আড়াল চাইছিল। সিঁড়িতে ছোটকাকিমার সঙ্গে দেখা হল, দোতলার মুখে মায়ার সঙ্গে; মায়া হাঁ করে বুলবুলকে দেখছিল। নীলেন্দু স্বাভাবিক হবার জন্যে মায়াকে বলল, এই, দুকাপ চা করে আনতে পারিস? তাড়াতাড়ি? বলে নীলেন্দু দাঁড়াল না, তেতলার সিঁড়ি ধরল।
নিজের ঘরে এসে নীলেন্দু বাতি জ্বালল।
আলোয় বুলবুল কেমন অস্বস্তি বোধ করে একবার বাতিটার দিকে তাকাল।
বোস নালে বলল; বুলবুলকে সে দেখছিল। বুলবুলের ছিপছিপে চেহারা হাড়সার হয়ে গিয়েছে, চোখ একেবারে হলুদ, গালে যেন একফোঁটাও মাংস নেই, নোংরা একটা জামা গায়ে, প্যান্ট আরও নোংরা, পায়ের চটিটার অবস্থাও বিশ্রী।