অন্যমনস্কভাবে দেবযানী বাইরে এল। ভেতর বারান্দা অন্ধকার। অন্ধকার দিয়েই কলঘরের দিকে চলে গেল। যাবার সময় দেখল, রান্নাঘরের দরজা আধাআধি খোেলা! লাটু উনুন ধরিয়ে রেখে গেছে যাবার সময়।
হাতে পায়ে জল দিয়ে মুখের ঠাণ্ডা ভাবটা মুছতে মুছতে দেবযানী রান্নাঘরে এল। কুয়ার তোলা জল হাতে পায়ে দেবার পর শীত ধরে গেছে। সামান্য কাঁপুনি লাগছিল। ছোট লণ্ঠন জ্বেলে নিল দেবযানী। লাটু ভোলা উনুন ধরিয়ে কাঠকয়লা ছড়িয়ে রেখেছে। কয়লাগুলো প্রায় সবই জ্বলে উঠেছে।
হাত দুটো সামান্য সেঁকে নিল দেবযানী। লাটুর গুণের শেষ নেই। সে যেন জানে কোন কাজটা তার সেরে রাখা দরকার। লাটুকে এই বাড়িতেই রাখতে চেয়েছিল দেবযানী; লাটু রাজি হয়নি, বাড়িতে তার বুড়ো বাপ আর হাবাগোবা এক ভাই। লাটু সাত-সকালে এ বাড়িতে আসে, সন্ধে নাগাদ চলে যায়। বাসন-কোসন মাজা আর ঘরদোর পরিষ্কার ছাড়া বাকি সবটাই লাটুর হাতে, লাটু বাজারহাট করে, বাগান দেখে, জল তোলে, দেবযানীকে খুঁটিনাটি কাজে সাহায্য করে। সকালে এ বাড়িতে খায়, রাতে নিজের বাড়িতে।
মালসা টেনে নিয়ে দেবযানী কাঠকয়লার আগুন সাজাল চিমটে দিয়ে, কয়েক টুকরো নতুন কয়লাও। দিয়ে দিল।
মালসা দুটো চৌকাঠের বাইরে সরিয়ে রেখে দেবযানী চায়ের জল বসাল। একটু পরে দিয়ে আসবে, সামান্য আঁচ উঠে যাক।
নীলেন্দুর জন্যে আজ উনুন ধরানো। রাত্রের দিকে উনুন ধরানোর প্রয়োজন বড় একটা করে না। শীতের দিন, সকালে করা রান্নাবান্না রাত্রে স্টোভ ধরিয়ে গরম করে নিলেই চলে, এমনকী গরম তাওয়ায় সকালের রুটি সামান্য ঘি মাখিয়ে নেড়েচেড়ে নিলেও নরম হয়ে যায়।
হাতের কাছে তরকারির ঝুড়িতে কড়াইশুটি ছিল। টাটকা কড়াই। দেবযানী একটা কাচের বাটিতে কড়াইশুটি ছাড়িয়ে রাখতে লাগল। নীলেন্দুকে এখন খেতে দেবার মতন কিছু নেই, কড়াইশুটি সেদ্ধ বসিয়ে তাতে দু টুকরো আলু আর টমাটো দিয়ে দেবে। খেতে ঘুগনির মতন, অথচ কতটুকুই বা সময় লাগবে।
তার এই গৃহিণীপনা দেখলে নীলেন্দু হেসে বলবে, দেবীদি, তুমি তো কিছুই বাকি রাখলে না, আদর্শ বঙ্গবন্ধু।
কোনও সন্দেহ নেই, দেবযানী আজ ছ-সাত মাসে অনেক কিছু শিখেছে। তার মানে এই নয় যে, আগে তার কিছু জানা ছিল না। যে ধরনের পরিবারে জন্মালে–এমন বাঙালি পরিবার আছে কিনা দেবযানীর অবশ্য জানা নেই–মেয়েদের কুটো কাটবারও দরকার হয় না, বা সে শিক্ষা তারা পায় না– দেবযানী তেমন পরিবারে জন্মায়নি। তাদের বড় পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা ছিল গৃহস্থ ধরনের। মা যতদিন বেঁচে ছিল, ঠাকুর-চাকরের হাতে সংসার ছেড়ে দেয়নি। ঠাকুর-চাকর ছিল, তাদের মাথার ওপর ছিল মা। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি নজরে রাখত। নিজের হাতে সকাল বিকেল তদারক করত সব। বড়দার বিয়ের পর বড়বউদিকেও মা সংসারের এই সাধারণ ব্যাপারটার বাইরে থাকতে দেয়নি। হেঁশেলে জুতে দিয়ে বড়বউদিকে যে মা জব্দ করেছিল তাও নয়। ঘরের বউ-মেয়ে কোনও কিছু জানবে না, শিখবে না, পাঁচভূতের ওপর ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পা তুলে শুয়ে থাকবেমা মোটেই তা বরদাস্ত করত না। অর্থাৎ মার পুরো শিক্ষাটাই ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বউদের যেমন হওয়া উচিত সেই রকম। ঘরের মধ্যে ছন্নছাড়া ভাব দু চোখের বিষ ছিল মার। মেজবউদিকেও মা একই ছাঁচে তৈরি করেছিল। অবশ্য বউবউদি কিংবা মেজবউদি–কেউই এমন পরিবার থেকে আসেনি যাতে মেয়েলি এই সব শিক্ষা তাদের থাকবার কথা নয়। বউদিরা মার সাংসারিক শিক্ষায় নতুন কিছু দেখেনি, অখুশিও হয়নি। মা মারা গেল মেজদার বিয়ের পরের বছর। তখন ঠিক শীতকাল নয়, কার্তিকের শেষ, একটু একটু ঠাণ্ডা পড়ছে; মা সকালের বাসি কাপড় ছেড়ে ঠাকুরঘর থেকে ফিরে সবে শ্বেতপাথরের কাপে রাখা চায়ে মুখ দিয়েছে, শরীরটা কেমন আনচান করে উঠল। বার কয়েক কাশল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বাকি চাটুকু খেয়ে, সবজির ঝুড়ি টেনে বসল; বড়দা মেজদার অফিস, তরকারি কুটে দেবে। বড়বউদি মার পান সেজে আনল। আর সেই সময়, সবে বঁটির গলায় আলু ছুঁইয়েছে, মা কেমন ছটফট করে উঠেই বউদিকে কিছু বলতে গেল, পারল না, মেঝের ওপর টলে পড়ে গেল। মার ভারী শরীর দুহাতে জড়িয়ে বউদি চেঁচাতে লাগল; বাড়িতে হইচই ছুটোছুটি, ডাক্তার এল পাড়ার, হাসপাতালে নিয়ে চলো এখনি। হাসপাতালে বিকেলের দিকে মা মারা গেল। সেরিব্রাল হেমারেজ।
বাবা মারা গিয়েছিল তারও আগে। দেবযানীর বয়েস যখন বছর তেরো। মা মারা গেল–তার একুশ বছর বয়েসে। বাবাকে দেবযানী যত বেশি করে পেয়েছিল, মাকে বোধহয় ততটা নয়। মার স্বভাবে শৃঙ্খলা ছিল বেশি রকম, শাসন ছিল চাপা, বাস্তব বোধ ছিল প্রখর। বাবার স্বভাবে এসব ছিল না বড়, বরং চরিত্রের দিক থেকে বাবা বোধ হয় মার উলটো প্রকৃতির ছিল। সংসারে যারা পুরোপুরি ডুবে থাকতে পারে না, ভালও বাসে না বাবার স্বভাব ছিল তাদের মতন। বাবা স্বভাবে এলোমেলো ছিল, অনেক ব্যাপারে উদাসীন, সরলহৃদয় মানুষ। মার সাংসারিক দূরদৃষ্টি, বাস্তব জ্ঞানের পাশে বাবাকে মানাবার কথা নয়। কিন্তু মার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে বাবা নিঝঞ্ঝাটে এবং শান্তিতে জীবন কাটিয়ে গিয়েছে। তাদের কলকাতার বাড়ি–সেও মার সম্পত্তি। দাদামশাই-দিদিমার জীবিত সন্তান বলতে মা ছাড়া কেউ ছিল না, কাজেই মা বাবার যা-কিছু মেয়ে পেয়েছিল। এ ব্যাপারে বাবার যদি বা মনে একটা অস্বস্তির ভাব থেকেও থাকে তা স্পষ্ট বোঝা যেত না। মাঝে মাঝে মা বাবার হাসি-তামাশার মধ্যে বাবার সঙ্কোচটা বোঝা যেত। কিন্তু তাও এমন কিছু নয় যে মনে করে রাখা যায়।