ওরা নেমে গেলে বাস ফাঁকা। এই ফাঁকার দিকে তাকালে তুষারের একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ছেলেবেলায় সে দেখত, একটা প্যাসেঞ্জার গাড়ির কামরা তাদের স্টেশনে কেটে রেখে বাকি গাড়িটা চলে যেত। বাবার অফিসে গিয়ে তুষার কিছুক্ষণ জ্বালাতন করত বাবাকে, তারপর প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে অনেকটা চলে আসত শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। কামরাটা দাঁড়িয়ে আছে লাইনে, কোনও কোনও দরজা খোলা, ভেতরটা একেবারে ফাঁকা, কেউ নেই, কিছু নেই। মাঝে মাঝে এই ফাঁকা কামরার মধ্যে উঠে পড়ত তুষার। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। কেমন যেন লাগত তার। ভাল লাগত না।
ফাঁকা বাসটার মধ্যে তাকিয়ে কয়েক পলক যেন তুষার ছেলেবেলার সেই দৃশ্য মনে করে নেয়। তারপর মাথা নিচু করে কোমর নুইয়ে তাকে আবার উঠতে হয় বাসে। তিনটে সরু সরু লম্বা বেঞ্চির কোথাও না কোথাও, বেঞ্চের নীচে কিছু কিছু জিনিস রোজই পড়ে থাকে, ওরা ফেলে যায়।
তুষার চারপাশে একবার তাকিয়ে নিল। কে তার বই ফেলে গেছে একটা, এক কোণে ধ্রুবর নতুন লাট্ট পড়ে আছে, তপুর পিসি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব দেখে ভাইপোর গায়ে কোট পরিয়ে দিয়েছিল–তপু সেটা খুলে ফেলে কুঁকড়ে-মুকড়ে একপাশে ফেলে রেখেছে, বিনুর বা চন্দ্রার কানের দুল, বেঞ্চির তলায় এক পাটি জুতো। জুতোটা অশোকের। এক পাটি এখানে ফেলেছে, আর-একপাটি এতক্ষণে মাঠের কোথাও ফেলে রেখে পালিয়েছে।
একে একে তুষার সব কুড়িয়ে নিল। কুড়িয়ে বুকের কাছে জড়ো করে নীচে নামল। নুটু ততক্ষণে নীচে নেমে তার গাড়ির মুখের ঢাকা খুলে দিয়ে হাওয়া খাওয়াচ্ছে। তুষারকে নামতে দেখে নুটু নিজের জায়গায় ফিরে এসে তুষারের বেতের টুকরিটা তুলে নিয়ে এগিয়ে দিল তুষারকে। এক হাত বুকের কাছে আড় করে, বাচ্চাগুলোর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র আগলে, অন্য হাতে নিজের বেতের টুকরিটা ঝুলিয়ে তুষার ফটকের দিকে এগিয়ে চলল।
ছেলেমেয়েগুলো কেউ আর এখানে নেই। নামা মাত্রই সব কটা দৌড় দেয়। ১৮
তুষার ফটক পেরিয়ে রাস্তা ধরল।
আশাদির ঘরে গান হচ্ছে। একেবারে কচিগুলো গান গাইছে। আশাদি নিজেও ভাল গাইতে পারে। সামান্য দূরে ডান দিকের ঘর থেকে আষো আধো কচি কচি গলার গান ভেসে আসছিল। তুষার হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে তাকাল একবার। চমৎকার রোদ হয়েছে আজ, সোনার মতো চকচক করছে। তুষার একটু মুখ উঁচু করে আকাশ দেখে নিল, নীলের রং লেগেছে, আশে পাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ।
গাছে গাছে পাখি ডাকছিল। কোথায় যেন অনেকগুলো চড়ুই ঝগড়া বাধিয়েছে। একটা কাককে তাড়া করে লোমের ঝালর ঝোলানো ক্ষুদে কুকুরটা ছুটতে ছুটতে তুষারের পায়ের কাছে পড়ল।
অভ্যর্থনা। ওর নাম তুলল। সাদা লোমের পুঁটলি বলে কুকুরটার ওই নাম হয়েছে। তুলো তুষারের পায়ের ওপর লাফিয়ে, শাড়ির প্রান্ত কয়েকবার দাঁত দিয়ে টেনে, লাফাতে লাফাতে আবার ছুটল।
তুষারের ঘর ও-দিকটায়; ওই যে কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে! তুষার তার ঘর দেখতে পেল। খোলা জানলা; পশ্চিম দিকের দেওয়াল ঘেঁষে ছায়ার চওড়া পাড় বসানো যেন। দোপাটির বাগান শুকিয়ে গেছে, কয়েকটা কলাফুলের গাছ ঘরের সিঁড়ির পাশে রোদে স্নান করছে। করবীর ঝোঁপ একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
সামান্য এগিয়ে আসতেই আড়াল পড়া দূরের ঘরটাও চোখে পড়ল। ওটা জ্যোতিবাবুর ঘর। জ্যোতিবাবুর ঘরের সামনে আমতলায় তাঁর ছেলেমেয়েরা শুয়ে বসে কী যেন শুনছে, আর জ্যোতিবাবু একটা বেতের মোড়ায় বসে কী বলছেন।
মাঠের ঘাস মাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে আরও অল্প এগিয়ে আসতেই তুষারের চোখে পড়ল শিরিষ গাছের ডালে বাঁধা দোলনার ওপর আদিত্যবাবু বসে আছেন। তুষার যেতে যেতে মুহূর্তের জন্যে থামল, দেখল। কেমন অস্বস্তি বোধ করল।
আশাদির ঘর থেকে গানের সুর ভেসে ভেসে আসছে, জ্যোতিবাবুর ছেলেমেয়েরা একসাথে কী যেন একটা বলছে, সেই সমবেত স্বর কানে বাতাসের স্রোতের মতন এসে লাগল, তুষার সামান্য দ্রুত পায়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
শিরিষ গাছের কাছে আসতেই আদিত্য দোলনার পিড়ি একটু দুলিয়ে সামান্য যেন ঝুঁকে এল।
মুখ তুলল তুষার। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে যেমন মিষ্টি হাসি আসে মুখে তেমন হাসিমুখ করল।
আদিত্য শিষ্টাচার প্রকাশ করল না, যেন ওসবের কোনও প্রয়োজন নেই। চোখের তারা স্থির, কয়েক মুহূর্ত দেখল তুষারকে, তারপর ঘরের দিকটায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করে দেখাল।
তুষার বুঝল। কিছু বলল না। ও চলে যাচ্ছিল, আদিত্য কথা বলল। আপনার ভেড়ার পালকে কী রকম ঠাণ্ডা করে রেখেছি দেখেছেন। গলার স্বরে, বলার ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ ছিল স্পষ্ট। আদিত্যর ঠোঁটের কোণায়, গালে বিদ্রুপের হাসিও দেখতে পেল তুষার।
পা বাড়াতে গিয়েও তুষার একটু দাঁড়াল। তাকাল, তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। আসার পথেই বুঝতে পেরেছিলাম।
আদিত্য দোলনা থেকে উঠে দাঁড়াল। আমায় দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন?
বোঝা যায়।
কী বোঝা যায়, আমি রয়েছি।
হ্যাঁ। তুষার মাথা নাড়ল। নয়তো আমার ঘরে এত শান্তশিষ্ট হয়ে সব থাকবে কেন।
আদিত্যর হাতে একটা ঢিল ছিল, ঢিলটা সে দূরে একটা ময়নার দিকে ছুঁড়ে মারল। তুষার দেখল।
আপনাদের এই..কী যেন শিশুতীর্থ না বোগাস কী যেন এই আখড়া–এই আখড়ার নিয়মকানুন কে তৈরি করেছে? আদিত্য বিরক্ত মুখে বলল।