শিশির–তুষার কিছু ভাবতে ভাবতে বলল, এবারে পুজোর সময় কান্তিমামাদের ওখানে যাবি?
কান্তিমামা! শিশির বোধ হয় অবাক হয়েছিল।
চল না। অনেকবার তো বলেছে।
তুই পাগল। শিশির বলল।
পাগল! –কেন?
এই ঘর বাড়ি ফেলে যাওয়া! …তা ছাড়া আমাদের সঙ্গে তার কিই বা আত্মীয়তা?
আমাদের কার সঙ্গেই বা আত্মীয়তা! তুষার বলল, ওসব আত্মীয়তার কথা ধরলে তোর আমার যাবার জায়গা কোথাও নেই। এখানেই সারা জন্ম থাকতে হয়।
রয়েছি তাই। শিশির দিদির চোখে চোখে তাকিয়ে বলল।
তুষার কেমন যেন বাধা পেল। কয়েক পলক ভাইকে দেখল, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল, মৃদু গলায় বলল, একবার না দুবার আমরা বাইরে গেছি, বাবা বেঁচে থাকতে। তারপর সেই যে এখানে পড়ে আছি, কোথাও যাইনি। আর ভাল লাগে না রে!
দিদির গলার স্বর শিশির মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। দিদির কথায় হতাশা ক্লান্তি, দিদির মন তার গলার স্বরে ধরা পড়ছিল। শিশির স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, দিদির যেন আজ কদিন কিছু আর ভাল লাগছে না।
অল্প সময় শিশির নিজমনে কিছু ভাবল। ভেবে নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ও সব তোর খেয়ালের কথা ছাড়। এখান থেকে তুই কোথাও গিয়ে থাকতে পারবি না, যেতেও পারবি না। কেন বাজে কথা বলছিস, দিদি।
তুষার বুঝতে পারল না, বাস্তবিক এই অসম্ভব অকারণ কথা কেন সে বলতে গেল। এখান ছেড়ে এবাড়ি ছেড়ে কোথাও কি কখনও গিয়েছে তুষার? যাবার কথা কি ভেবেছে?
অথচ যখন তুষার কথাটা বলেছিল, তখন মনে হয়েছিল, সত্যিই এখানের একঘেয়েমি এবং ক্লান্তি সে অনুভব করছে; অন্য কোথাও যেতে পারলে হয়তো বাঁচে।
শিশির হাত বাড়িয়ে একটা বালিশ টেনে নিল, কোলের ওপর রাখল। জ্যোতিদার খবর কী রে?
তুষার যেন শুনতে পায়নি। মুখ সামান্য বেঁকা করে বসেছিল। জানলার দিকে সরাসরি মুখ নয়, কিন্তু জানলা দেখা যাচ্ছিল। জ্যোৎস্না এসেছে, জানলার শিক গলে, শিকের ছায়া ফেলে আলো এসে গেছে।
জ্যোতিদার সঙ্গে তোর দেখা হয় না? শিশির আবার বলল।
কথাটা এতক্ষণে তুষার শুনতে পেয়েছে। জ্যোতিদা…! শিশিরের মুখের দিকে তাকাল তুষার। জ্যোতিবাবুর কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিল তুষার এমন চোখ করে তাকিয়ে থাকল। বলল, দেখা হয়।
একদিন আসতে বলিস না। অনেক দিন আসেননি।
তুষার শুনল। কোনও জবাব দিল না। মনে মনে জ্যোতিবাবুর কথা ভাবছিল।
এ-রকম মানুষ আমি দেখিনি। শিশির বলল, স্কুল নিয়ে মাতল তো মাতলই, আর এ-মুখো হল না।
অনেক কাজকর্ম নিয়েছেন যে। তুষার অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিল। সামান্য চুপ করে থেকে আরও বলল, সারাদিনই একটা না একটা ঝাট থাকে।
বাড়িতেও আসে না। শিশির বালিশের ওপর কনুই রেখে সামান্য কুঁজো হল। তোকে বলিনি। সেদিন জয়ন্তীদি এসেছিল।
এখানে?
হ্যাঁ। শিশির মাথা নাড়ল। বলল, দুপুরবেলায় কী কাজে বেরিয়ে এখানে এসেছিল, অনেকক্ষণ ছিল। গল্প করল অনেক।
কী বলল? তুষার আগ্রহ বোধ করছিল।
সে অনেক কথা শিশির পিঠ সোজা করল। জ্যোতিদা বাড়ি আসে না, ছেলেমেয়ে নিয়ে জয়ন্তীদি একলা। বড় ছেলেটা হাত ভেঙেছে। মেয়েটার জ্বর। তার ওপর এমন দুই ভাড়াটে জ্যোতিদাদের, রোজই ঝগড়া মারপিট করছে, একজন আবার থানায় গিয়ে ডায়রি করেছে।
তুষার মন দিয়ে শুনছিল। বলল, জ্যোতিবাবুকে বলব।
বলিস!
সামান্য ইতস্তত করে শিশির বলল, আরও একটা কথা, দিদি।
কী?
তোকে বলব? শিশিরের মুখে সামান্য দ্বিধা।
আমায় বলবি না! কী কথা?
তোদের সেই মলিনার বাবা একদিন জ্যোতিদাদের বাড়ি গিয়ে যা তা করেছে।
যা তা–! অস্ফুট বিস্মিত স্বর বেরুল তুষারের গলা দিয়ে। তুষার অপলকে তাকিয়েছিল। শিশির সসঙ্কোচে মৃদু গলায় বলল, একদিন মদ ফদ খেয়ে হাজির হয়েছিল জ্যোতিদাদের বাড়িতে। জয়ন্তীদিকে যা তা বলে গেছে। জ্যোতিদা নাকি তার মেয়েকে ভুলিয়ে স্কুলে নিয়ে গেছে! শিশির আর কিছু বলল না।
তুষার স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল।
.
১০.
জ্যোতিবাবু এই শহরের লোক। তুষাররা যত দিনের তার চেয়ে অবশ্য কম। তবু পুরনো বাসিন্দেই বলা যায়। জ্যোতির বাবা ছিলেন পুলিশ দারোগা। চাকরির শেষ পর্বে এখানে এসে ছিলেন, তারপর অবসর নিয়ে আর অন্য কোথাও যাননি, পুরনো হাটের দিকে অনেকটা জায়গা কিনে বাড়ি তুলেছিলেন। বাংলো ছাঁদের বাড়ি, একতলা। বাড়ির মাথায় টালির ছাউনি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এখানে বসেই। সেই মেয়ে পাঁচ বছরের মধ্যেই বিধবা হয়ে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এল! জ্যোতির মা তার আগেই মারা গেছেন।
বিধবা মেয়ে ও নাতি নাতনিদের নিয়ে কয়েকটা বছর হরসুন্দর দারোগার কেটে যায়, তিনি বজ্রাঘাতে মারা যান। লোকে বলত পাপের জীবন এমনি করেই শেষ হয়। হরসুন্দর দারোগার কোথায় পাপ কেউ জানত না, তিনি এ-শহরে এসে এমন কিছু করেননি যাতে পাপের কথা মুখে আসে, তবু লোকে বলত। প্রথমে স্ত্রী, তারপর জামাতা হারালেন। শেষে নিজে ভগবানের পায়ে ঠাঁই নিলেন। সবই যে তাঁর পাপের ফল এ-ধারণা এখানের বহু লোকেরই ছিল, হয়তো আজও আছে।
বাবা মারা যাবার সময় জ্যোতি সবে মাত্র কলেজের পড়া শেষ করেছে। বছর বাইশ তেইশ বয়স। এই ছেলে ছিল আলাদা প্রকৃতির। শহরে তার কোথাও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। বাল্যাবধিই বাইরের স্কুল কলেজে পড়েছে, হোটেল-বোর্ডিংয়ে থেকেছে। ছুটিতে বাবার কাছে এসেছে, কিন্তু সে-থাকা এত নিভৃত নিঃসম্পর্ক যে শহরের তার সমবয়সীরাও তার নাগাল পায়নি।