চুয়া রাগে ঘেন্নায় মুখ কালো করে পেছন ফিরল। আর দাঁড়াবার সময় নেই তার।
হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলেন সুমতি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়ের দিকে হাত বাড়ালেন, ধরতে গেলেন মেয়েকে। কী বললি তুই?
চুয়া মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ঘোরাল। ঠিক বলেছি।
চলে যাচ্ছিল চুয়া সুমতি চেয়ার থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে মেয়ের চাদর ধরে ফেললেন। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। নিজের বাপকে ধাপ্পাবাজ বলিস। আজ আমি তোর মুখ ভাঙব। হারামজাদি।
চুয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যে চাদর ধরে টানল। তারও মাথায় আগুন উঠে গেছে। ধাপ্পা মারে তো ধাপ্পাবাজ বলব না। …ছেড়ে দাও আমাকে।
নিজেকে প্রচণ্ড জোরে টান মেরে ছাড়িয়ে নিতে গেল চুয়া। তার গায়ের চাদর খুলে গেল। সুমতির হাতে থাকল চাদরটা।
চাদর টান মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে সুমতি মেয়েকে ধরতে গেলেন। তাঁর আঁচল খুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চুয়া দরজার দিকে চলে যাচ্ছিল। তার শাড়ির আঁচলটা সুমতির হাতে এসে গেল। ধরে টানতে লাগলেন।
চুয়া তার শাড়ি আর ব্যাগ বাঁচাতে বাঁচাতে বলল, ছেড়ে দাও আমায়।
ছেড়ে দেব? তোর মুখ আমি ভাঙব। সাপের পাঁচ পা দেখেছিস না? সুমতি প্রাণপণে মেয়েকে টানতে লাগলেন তার শাড়ি ধরে।
চুয়া নিজেকে ছাড়াবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। রাগে, জ্বালায় সে হিংস্র হয়ে উঠেছিল। বাঁ হাতে ব্যাগ, তবু দুহাতে শাড়ির আঁচলের বাকিটা ধরে সে টানছে। আমায় ছেড়ে দাও বলছি। শাড়ি ছিঁড়ে যাবে আমার।
ছিডুক। তোর শাড়ি আমি কুচি কুচি করে ছিঁড়ব। আগুনে দেব। তোর বড় বাড় বেড়েছে। এত বড় আস্পর্দা তোর তুই তোর বাপকে মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলিস। গালাগাল দিস। আজ তোরই একদিন, না আমারই একদিন।
ঝটকা মেরে শাড়ি ছাড়িয়ে নিল চুয়া। আগুনে দেবে না? একটা সুতো কিনে দিতে পার না, শাড়ি আগুনে দেবে। আমি নিজের রোজগারে এশাড়ি কিনেছি।
সুমতি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কোনও হুঁশ ছিল না। মুখ লাল। চোখ জ্বলছে ঘৃণায়, অপমানে। সমস্ত শরীর কাঁপছিল। গলার স্বর যত তীক্ষ্ণ তত কর্কশ! প্রায় লাফিয়ে পড়ার মতন করে এগিয়ে তিনি মেয়ের চুল ধরলেন মুঠো করে। তোকে আমি রোজগার দেখাচ্ছি! মেয়েকে ঠাস করে চড় মারলেন। বাইরে নেচে, ধাড়ি ধাড়ি মদ্দাগুলোর গায়ে ঢলে তুই পয়সা রোজগার করিস, তা আমি জানি না। সুমতি চুলের ঝুঁটি ধরে মেয়েকে টানতে লাগলেন। রোজগার! আবার ঠাস করে চড় মারলেন। আমাকে রোজগার দেখাতে আসিস, হারামজাদি!
চুয়া নিজেকে বাঁচাবার জন্যে মরিয়া হয়ে সুমতিকে ধাক্কা দিতে গেল। তার হাতের ব্যাগ মুখে লাগল সুমতির। সুমতি উঃকরে যন্ত্রণার শব্দ করে চোখ বুজলেন। চুল ছেড়ে দিলেন। দিয়েই পর মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা কেড়ে নিলেন। তারপর ব্যাগ দিয়ে পাগলের মতন মারতে লাগলেন মেয়েকে। চুয়াও কেমন বেপরোয়া।
চুয়ার গায়ের কাপড় খুলে মাটিতে লুটোচ্ছে, চুল পাগলের মতন, গালে দাগ বসে গেছে আঙুলের, হাতের একপাশ ছড়ে গেছে। সুমতি তখনও পাগলের মতন ব্যাগ দিয়ে মেরে যাচ্ছেন মেয়েকে।
চুয়াও হাত ছুড়ছিল। খামচা-খামচি করছিল। কাঁদছিল।
শিবশংকর চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠে বার বার বলছিলেন, কী করছ, ছেড়ে দাও। সুমু ছেড়ে দাও। ছি ছি। একি কাণ্ড! মেরে ফেলবে নাকি ওকে?
বোধন কোনও পক্ষকেই ধরবার সাহস করছিল না। মাকে এসময় সামলাতে যাওয়া বিপদ। চুয়া যা বলেছে তাতে মার মাথায় আগুন জ্বলে যাওয়া অন্যায় নয়। চুয়ার একটু শিক্ষা হওয়া উচিত। সত্যি, সে বড্ড বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু মা-মেয়ের এই কুৎসিত ঝগড়া, মারপিট তার ভাল লাগছিল না। এত জোর চেঁচামেচি হচ্ছে যে ফ্ল্যাটের বাইরে হয়তো কান পাতছে কেউ কেউ!
চুয়া কাঁদছিল। কাঁদছিল আর ভাঙা কান্না জড়ানো গলায় হিংস্রের মতন যা মুখে আসে বলছিল। সে কাউকে বাদ দিচ্ছিল না। বাবাকে নয়, মাকে নয়, বোধনকেও নয়।
আমার রোজগারের পয়সা নাও, আবার আমায় লাথি মারো। ভগবান দেখছে, তোমার ওই পা খোঁড়া হবে।
তোর মতন মেয়ের রোজগারের পয়সায় আমি থুতু ফেলি। হারামজাদি।
তুমি মিথ্যুক। তুমি পয়সা নাও না?
তুই কার পয়সায় খাস? কার বাড়িতে থাকিস? কে তোকে এতকাল খাইয়ে পরিয়ে এসেছে? তোর থিয়েটারের দাদারা?
খাওয়াতে পরাতে পারবে না তো জন্ম দিয়েছিলে কেন। লাথি-ঝেটা মারার জন্যে? স্বামীভক্তি দেখাচ্ছ?
মা আচমকা চুয়ার মুখের ওপর ব্যাগ দিয়ে মারল। পর পর।
চুয়া সামলাতে পারল না। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল।
তুই বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। ছোটলোক, শয়তান মেয়ে কোথাকার! যা বেরিয়ে যা। যেখানে তোর জোটে সেখানে চলে যা…।
যাব। এ বাড়িতে আর থাকব না।
যা, মরগে যা– আমায় ভয় দেখাস না। একজন গিয়েছে–তুইও যা।
বোধন আর সহ্য করতে পারল না। মার হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিল। কী করছ! মেরে ফেলবে ওকে?
মরুক ও। সুমতি জোরে জোরে হাঁফ নিচ্ছিলেন। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে শ্বাস টানতে। চোখের দৃষ্টি উন্মাদের মতন। সমস্ত মুখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে।
চুয়ার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। জোরেই কাঁদছিল। তার শাড়ির আধখানা মাটিতে লুটোচ্ছে, মাথার চুল এলোমেলো। জামা ছিঁড়েছে। গালে ঘাড়ে পিঠে দাগ ফুটেছে মারের।