বোধন চা করতে করতে মা বাবার কথা শুনছিল। স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছিল সব।
শিবশংকর প্রথমটায় জবাব দিলেন না; পরে চাপা গলায় যেন বললেন, তা ভগবান আমার…।
ভগবান ভগবান কোরো না– সুমতি ধমকে উঠলেন; রুক্ষ গলায় বললেন, ভগবান তোমায় কোলে বসিয়ে দুধ-ভাত খাওয়াবে! যেমন কর্ম করেছ তার ফল ভোগ করছ! ভগবানকে ঝেটা মেরে লাভ কী।
শিবশংকর মুখ নিচু করে নিলেন। মাটির ভাঁড়ে ছাই দেখছিলেন।
একটু চুপ করে থেকে সুমতি বললেন, ভদ্রলোকের মতন তো থাকোনি, থাকলে অদৃষ্টে এমন হত না। ঘটকবাবুর মতন তুমিও চাকরি করতে পারতে। আরও দু এক বছর থাকত রিটায়ার করার। ব্যাঙ্কের চাকরি এখন রাজার চাকরি। কত রকম সুবিধে। বাড়ি আমারও হতে পারত। ..নাও, যেমন কর্ম করেছ। এখন তার ফল ভোগো।
শিবশংকর মুখ ফসকে বললেন, পুরনো কথা সকলেই ভুলে যায়।
মানে? সুমতি খেপে উঠলেন। ভুলে যায় মানে কী! তুমি বলতে চাইছ, বিয়ের পর আমায় কত সুখে রেখেছিলে–এই তো? মুখে রাজভোগ তুলে দিয়েছ, না? লজ্জা করে না তোমার বলতে। বিয়ের পর রেখেছিলে তো এক দশ ঘরের বাড়িতে। দেড়খানা ঘরে বন্দি থেকে ঝিয়ের মতন সারাদিন তোমাদের সংসারে গতর দিয়ে খেটেছি আর ছেলেপুলে নিয়ে নেটা ঝামটা খেয়েছি।
শিবশংকর কথা থামাবার জন্যে বিব্রত হয়ে উঠলেন। না না, আমি তা বলিনি।
বলোনি আবার কী! গোড়াটা ভুলে যাও। বলার সময় কবে গোঁফে আতর মেখেছিলে সে-গন্ধ আমায় শোঁকাতে এসেছ! কে তোমায় আতর মাখতে বলেছিল! যেমন ছিলে তেমন থাকলেই পারতে। আমি কি তোমায় মানিকতলার বাড়ি ভাড়া করতে পায়ে ধরেছিলাম! তুমি তোমার মা বোনের জন্যে করেছিলে, আমার জন্যে নয়। তখন ভেবেছিলে পয়সা কামাচ্ছ, আর কী! খাও দাও, বগল বাজাও…। চাল চালিয়াতির কমতি তো করোনি। সে তুমি করেছ, তোমার মায়ের ঘটা করে শ্রাদ্ধ করেছ, বোনের চোখের জল মুছিয়েছ! আমার কী করেছ? দুটো গয়না গড়িয়ে দিয়েছিলে! সে গয়নাও তোমাদের জন্যে বেচে তোমাদের পেটে দিয়েছি।
শিবশংকর আর কথা বললেন না।
বোধন চা নিয়ে এল। রাখল টেবিলে। বাবা অধোবদন হয়ে বসে আছে। লজ্জা, কুণ্ঠা নতুন করে আর বাবাকে আড়ষ্ট করে না। বাবা এমনিতেই আড়ষ্ট। প্রত্যহ দুবেলা বাবা এই দীনতা সহ্য করে নির্বিকার, সহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। বাবার অধোবদন মূর্তিটা এখন নাটকের দৃশ্যের মতন মনে হয়, যেন এই ভঙ্গিটুকু এই মুহূর্তের মানানসই ভঙ্গি। বোধন দুঃখের চেয়ে যেন বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ হল। বাবা কেন নিজেকে বাঁচাতে পারে না! কেন এত নির্বিকার, সহিষ্ণু! অচেতন।
তোমায় চা দেব? বোধন বলল মাকে।
না।
চা রেখেছি।
কাপড় না ছেড়ে খাব না।
বোধন মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে বোধ হয় সুমতি আপাতত থেমে গেলেন। তাঁর সমস্ত মুখে বিরক্তি, রাগ, উত্তেজনা।
সুমতি উঠে পড়লেন। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছেন।
ঘরে গিয়ে সুমতি ডাকলেন, আলো দাও। একটা মোমবাতি ছিল অর্ধেক। র্যাকের ওপর ছিল। জ্বালিয়ে দিয়ে যাও।
বোধন র্যাক খুঁজল; পেল না। এদিক-ওদিক দেখল।
শিবশংকর খুব নিচু গলায় বললেন, এটা দিয়ে এসো। ছোট টেবিল বাতিটা ঘরে আছে–নিয়ে এসো জ্বালিয়ে নেব।
বোধন লণ্ঠন তুলে নিয়ে মার ঘরে গেল।
সুমতি অন্ধকারে শাড়িটা ছেড়ে ফেলেছেন। পরনে নোংরা, ময়লা সায়া। গায়ের জামাও খুলে ফেলে নীচের জামাটা খুলছিলেন। বিশাল জামা। নোংরা, চিট। দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল মার শরীর থেকে, ময়লা আর ঘামের। বোধন মাকে দেখল। কী মোটা, বীভৎস চেহারা মার।
ছোট টেবিল-বাতিটা খুঁজে নিয়ে লণ্ঠন রেখে চলে আসছিল বোধন। শুনল, মা আপন মনে ঝাঁঝালো গলায় বলছে, এত মানুষ রোজ যায়, আমি কোন পোড়া কপাল নিয়ে বেঁচে আছি! আমি কেন যাই না! …একদিন যাব, তারপর দেখব–তোমরা কেমন চোখের জলে নাকের জলে হও।
কথাটা শুধু বাবাকে নয়, তাদের সকলকে শুনিয়ে বলা।
বোধন বাতি এনে টেবিলের ওপর রাখল। ছোট টেবিল বাতি। শিবশংকর দেশলাই জ্বেলে দিলেন। বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বোধন রান্নাঘরে গেল। তার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে! গরম গরম খাবে ভেবেছিল। মার চা ঢাকা দিয়ে রাখল। বড়ি দুটো ঘরে। শার্টের পকেটে। খেয়ে নিতে হবে। বাড়িতে ঢুকলে মাথা আরও ধরে যায়।
রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে বেরিয়ে আসছিল বোধন–মা একটা ময়লা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাথরুমে যাচ্ছে। যেতে গিয়ে থামল, বাবার দিকে তাকাল। তারপর বোধনের দিকে।
আমার ব্যাগে মুড়ির ঠোঙা আছে। দাও তোমার বাবাকে।
সুমতি বাথরুমে চলে গেলেন লণ্ঠন হাতে করে।
বোধন টেবিলের ওপর চা রেখে মার ব্যাগ খুলল। সস্তা ফোম লেদারের ব্যাগ। অনেক পুরোনো। ময়লা হয়ে গিয়েছে, মুখের কাছটায় ভেঁড়া, কাঁধে ঝোলাবার স্ট্র্যাপটার একদিকে সেফটিপিন দেওয়া।
ব্যাগ খুলল বোধন। এক ঠোঙা মুড়ি।
মা মাঝে মাঝেই অফিস থেকে ফেরার সময় ওই পাড়া থেকে ঝালমুড়ি, ভুট্টা, বাদামভাজা, কাঁচা পেয়ারা টুকটাক নিয়ে আসে। ঝালমুড়িটা প্রায়ই। ওটাই সন্ধের জলখাবার। অন্য কোনও জলখাবার থাকে না।
বোধন ঝালমুড়ির ঠোঙাটা বাবার সামনে রাখল।
শিবশংকর মাথা নাড়লেন। খাবেন না।
বোধন বুঝতে পারল। ভাবল একটু। ঠোঙা খুলে নিজে এক মুঠো নিয়ে মুখে দিল।
ভাল করেছে। বোধন বলল।
শিবশংকর কিছু বললেন না।