৬৩.
ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে ময়নাটাকে ছেড়ে দিলাম। খাঁচা খুলতেই ও উড়ে গেল। আজ বুঝতে পারলাম, ওটা আমার পোষ-মানা ময়না নয়।
.
তিন
০১.
নদীর জল দাঁড়ায় না। সময়ও নদীর জল, তার বাঁধা ঘাট নেই। একদিন আমি বুঝতে পারলাম, রোদ জল শীত গায়ে মেখে মেখে আমার বয়স বেড়ে গেছে। দিনের বেলায় এত কথা মনে আসত না, রাতে শুয়ে শুয়ে অনুভব করতাম কত কী! মনে হত, আমি যেন চারাগাছ থেকে ধীরে ধীরে দিনে দিনে একটা বড় গাছ হয়ে উঠছি। তবে কিনা আমার মাটি একই জায়গার জমানো পুরনো মাটি নয়, নিত্য নতুন মাটি। বলতে গেলে, আমিও নদীর জল, আমারও কোনও বাঁধাধরা ঘাট নেই।
০২.
রামেশ্বর ড্রাইভারের ট্যাক্সি নিয়ে একদিন শেষ বিকেলে দুরের এক সওয়ারি পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় সন্ধে হয়ে গেল; রেলফটকের কাছে একটা লোককে চাপা দিয়ে সেই যে পালালাম–আর পুরনো শহরে ফিরিনি। রামেশ্বর আমায় গাড়ি চালাতে শিখিয়েছিল কিন্তু লাইসেন্স করাতে দেয়নি। পরে অনেক দিন, সন্ধে হলেই আমি যেন গাড়িটার এক-চোখ কানা হেডলাইটটাকে চোখের সামনে জ্বলতে দেখতাম। আলোটা ঘোলাটে, প্রাণহীন, দাগ ধরা ধরা–মনে হত, একটা ভোঁতা জবুথবু বিশ্রী জন্তু যেন আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
০৩.
গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে কিছুকাল কাটল। কবে যেন এক মেলায় গিয়ে ভেলকি দেখানো লোকটার সাথে ভিড়ে গেলাম। ওর নাম বানোয়ারি বানোয়ারিলাল। বানোয়ারি একটা মেয়েকে নিয়ে জিব কেটে ফেলা, চোখ উপড়ে নেওয়ার খেলা দেখাত। মেয়েটার বয়স বেশি নয়, তায় আবার বেঁটে, ছোট-ছোটই মনে হত। কিন্তু ওই টুকুন মেয়ের গা বুক চলন বলন অমন হয় না। ময়লা ঘাঘরা আর খাটো জামা পরে থাকত বলে লোকে ওকেই বেশি দেখত। কুচকুচে কালো রং গায়ের, মাথা ভর্তি ঘন রুক্ষ চুল-রাশ রাশ উকুন। একদিন খেলা দেখাবার সময়, উকুনের জ্বালায় জ্বলে সে মাথা নড়িয়ে ফেলেছিল, বানোয়ারি ভুল করে নকল জিবের বদলে তার আসল জিবেই ছোরা চালিয়ে দিল। …বানোয়ারিকে সেদিন আর লোকে আস্ত রাখেনি। পুলিশ এসে পড়বার আগেই আমি পালালাম। আসল নকলের খেলা বড় সাংঘাতিক। বানোয়ারি বোধহয় নকলের খেলা আর খেলতে চায়নি।
০৪.
গাঁ গ্রামেও আমার অনেকদিন কেটেছে। কাজকর্মের ঠিক ছিল না, যখন যা জুটেছে করেছি। জল ঘেঁচেছি, ধান গোলায় তুলেছি, জনমজুরি খেটেছি। আমার ভাল লাগত না কিছুই। মনে হত, এখানকার মানুষগুলো একেবারে গাছপালার মতনই বর্ষার জলে বাড়ে, তাদের অন্য কোনও বাড় নেই। আমার সারাদিনের এই দুঃখ সন্ধেবেলায় আর মানতে চাইত না। ইচ্ছে করত, পালিয়ে যাই। কোথায় যে পালাব! বিশু ঠাকুরের দাওয়ায় গিয়ে বসতাম। শিস ওঠা ছোট্ট লণ্ঠন জ্বালিয়ে ছেঁড়া মাদুরে বসে বিশু ঠাকুর মহাভারত পড়ত। নিত্যই দু-চারজন এসে বসত কাছে, আমিও একপাশে দাওয়ার কোল ঘেঁষে বসে থাকতাম। বঁধুল ঝোঁপের অন্ধকারে থোকা থোকা জোনাকি জ্বল, পাশের ডোবা আর বাঁশঝোপে অনবরত ঝিঁঝি ডেকে যেত। বিশু ঠাকুর মধুমাখানো গলায় সুর করে পড়তেন–অর্জুনের বিদ্যা যদি হইল শেষ, রঙ্গভূমি মধ্যে কর্ণ করিল প্রবেশ। ধুধুল ঝোঁপের অন্ধকার কাঁপত না, নড়ত না কিন্তু সেই কালো মেঘের মতন আঁধারে চেয়ে চেয়ে চোখ আমার কর্ণ দুর্যোধন দ্রোণ সবাইকেই দেখতে পেত। ওই তো কর্ণ হেঁট মাথা হাতে ধনুক, অপমানে জ্বালায় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে: না দিল উত্তর কিছু কর্ণ মহাবল, বৃষ্টি হইতে ছিন্ন যেন কমলের দল। ..কুন্তীর ওপর মনটা বিষিয়ে যেত। কাঁঠাল গাছের মাথায় পাখির বাসা থেকে চোট খাওয়া কোনও পাখি কাতরে কাতরে ডেকে উঠত। আমার গলা বুজিয়ে কান্না উপচে আসত বার বার; বিশু ঠাকুর একটানা পড়েই যেতেন।
০৫.
একদিন ইন্দ্রধরদের সবজি ক্ষেতে দুটো সাপ জড়াজড়ি করে পড়েছিল। ইন্দ্র পড়িমড়ি করে ছুটে এল, মুখে তার ফেনা উঠছে। আশপাশের মাঠ ক্ষেতখামার কুঁড়ে ভেঙে পড়ল জোড়া সাপ দেখতে। ইন্দ্রর বিধবা বোন কলমি আমার হাতে চিনে সিদুরের পাতা দিয়ে বললে, মনসা মায়ের মাথায় দিয়ে এসো। ..সাপের মাথায় সিঁদুর দিতে গিয়ে দেখলাম সাপ দুটো মরা। …সাঁঝের ঘোরে কলা বাগানে কলমি আমার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। বলল, জোড়া সাপ দেখলে কপাল ফেরে। রাজা হয়। তোমারও ফিরবে। আমি হাসছিলাম কলমির কথা শুনে।
০৬.
আমার কপাল সত্যি সত্যিই ফিরল। ইন্দ্রর পায়ে এক বিষফোঁড়া হল। দেখতে দেখতে পা-টা ফুলে কলাগাছ। নড়তে চড়তে পারে না ইন্দ্র, সারা দিন শুধু চেঁচায় যন্ত্রণায়। কত লতাপাতা বাঁধা, শেকড় বেটে খাওয়া, কিছুতেই কিছু নয়, পা বিষিয়ে গেল। গোরুর গাড়ি করে ইন্দ্রকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম কলমি আর আমি। আগুনের চেয়েও গরম ইন্দ্রর গা-ভুল বকে বকে কখন সে চুপ করে গেছে। শরৎকালের রোদ ধানের মতো পেকে উঠেছে, সবুজে সবুজে ছড়াছড়ি ধানক্ষেত, কাশফুলের অন্ত নেই, পুকুর ভরা শালুক হঠাৎ কেমন একটা নাগপাশ হাওয়া এসে গোরুর গাড়িটাকে যেন ঘিরে ধরল। গোরু দুটো থমকে গেল, চাকা দুটো বার কয়েক আগুপিছু করল, কলমি কেঁদে উঠল আচমকা, ডাক ছেড়ে। আমার হাত পা অবশ। মুখ ফিরিয়ে দেখি কলমি ইন্দ্রর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাচ্ছে।