৫০.
মাড়োয়ারি স্কুলের বারান্দা থেকে আমায় তাড়িয়ে দিয়েছিল কবে। কাঠগোলার সামনে কতকালের পুরনো ধসা আগাছা ভর্তি একটা বাড়ি, আমরা–আমি আর কতক কানা কুষ্ঠ ভিখারি, একটা ঘেয়ো কুকুর, আট দশটা পায়রা সেখানে রাত কাটাতাম। একদিন এক থুথুড়ে বুড়ো তার ধুমসো পেট লিকলিকে মেয়ে নিয়ে রাত কাটাতে এল। মেয়েটা অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে পায়রা ধরছিল। আমি দেখতে পেয়ে তার হাত ধরে ফেললাম। মেয়েটা সাথে সাথে কেঁদে ফেলল। বুড়ো বলল, ওর মেয়ের রক্তকাশের ব্যারাম, পায়রা পুড়িয়ে খেলে সেরে যাবে, বদ্যিতে বলেছে।
৫১.
বুড়ো আর বুড়োর মেয়ে থেকে গেল; শেষ চারটে পায়রাই একদিন সকালে উড়ে গেল, আর এল
৫২.
আবার শীত পড়ল। মাঘ মাস। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে রামেশ্বর ড্রাইভার আমায় দিয়ে গাড়ি ধোয়ায় মোছায়, তেল ঢালায়। মোবিল তেলের টিনে বাজারের কল থেকে জল ভরে এনে আগুনের মতন গরম ধোঁয়াওঠা ইঞ্জিনের মুখে জল ঢালি। মাঝে ভাবি ওটার পেটে যেন রাবণের চিতে জ্বলছে। বুকটা রাক্ষসের মতন হা-হা করা জ্বালায় পুড়ছে সর্বক্ষণ। …ওর মুখের ভাপে আমার বুকটাও জ্বলে যায়। আমারও তেষ্টা পায় খুব। জল খেয়ে খেয়ে সে-তেষ্টা যায় না, ভাপের সেই জ্বালা চোখ মুখ থেকে মোছে না।
৫৩.
গোটা রাত অসুখের ঘোরে থাকি। আকাশ দেখতে পাই না, বাতাসের জন্যে দমবন্ধ হয়ে আসে। খাঁচায় পোরা ময়নাটা মাথার কাছে থেকে থেকে পাখা নাড়ে, ডেকে ওঠে। গলির আলোটা তার গায়ে না খাঁচার শিকে–আমি স্পষ্ট করে দেখি না। গভীর রাতে সেও ঘুমিয়ে পড়ে। আমার সঙ্গী পাখিটা বোবা হয়ে গেলে সমস্ত ঘর আমায় ডুবিয়ে নেয়। মনে হয়, আমি ভয়ের কুয়োয় ডুবে আছি, ফাঁকা অসাড় অন্ধকার এক জগতে।
৫৪.
পাড়ায় পাড়ায় বসন্ত এল। মা শীতলার দশটা মূর্তিতেও কুলোন পাওয়া গেল না। একদিন আমাদের বস্তির উত্তর দিকটা আগুনে আগুনে লাল হয়ে গেল। মিউনিসিপ্যালিটির বিশ পঁচিশটা ধাঙর, পুলিশ আর সাহেব ডাক্তার নাগবাবুদের বস্তির আধখানা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিল।
৫৫.
রামেশ্বর ড্রাইভারের আমি ক্লিনার। বিকেল তিনটের সওয়ারি তুলতে স্টেশনে গাড়ি ভিড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মুখে বিড়ি, পরনে কালো ঝুল পাজামা, গায়ে হাতকাটা শার্ট। রামেশ্বর তার ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। রেলগাড়ি এসে গেল। স্টেশনের পুল দিয়ে সওয়ারিরা আসছে–সিঁড়ি ভেঙে। বিড়ি টানতে টানতে ছুটলাম। অন্য গাড়ির ফড়েরাও ছুটেছে। ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশাগুলোও। যে আগে ভাগে ভুলিয়ে ভালিয়ে ছোঁ মারতে পারে কপাল তার। আমাদের বা ট্যাক্সিবালাদের–আবার চিলের ছোঁ।
৫৬.
ফিনফিনে জমকালো শাড়ি পরে এক বউ নেমে আসছে, তার পাশে কাঁচাপাকা চুলের এক বাবু। ট্যাক্সির খদ্দের। বউটার শাড়ির বাহার রামধনুর মতন। হরেক রং। গায়ের এখানে সেখানে ফেঁপে ফুলে রয়েছে শাড়িটা। বাবুর হাতে ছড়ি। …ভিড় ভারিক্কি হঠিয়ে বউটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পায়ের কাছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে এসেছে ওরা। …কোথায় যাবেন শুধিয়েছি কি হেঁট-মুখ বউটি মুখ তুলে তাকাল। আমার মুখে আর কথা সরল না।
৫৭.
ময়না আমায় চিনল না। একবারই যা তাকিয়ে দেখেছিল, আর দেখল না। আমিই ওকে দেখলাম। তার গা গতর আরও মজেছে, হাতে গলায় গয়না, চোখে সুরমা, টকটকে ঠোঁট, সারা মুখটাই ভীষণ ফরসা ফরসা।
৫৮.
বাবুর ছড়ির খোঁচা খেয়ে আমি পথ ছেড়ে সরে গেলাম। ময়না আর বাবু চলে গেল। ময়নার পায়ে লাল মখমলের কাজ করা চটি। চটিতে আওয়াজ উঠছিল।
৫৯.
সন্ধ্যেবেলায় ডেরায় ফিরে পোষা ময়নাটাকে খোঁচা দিলাম। যেমন করে বাবু আমায় ছড়ির খোঁচা দিয়েছিল।
৬০.
রাত্রে সেই বেহুশ ঘোর। নিত্যকার বুকভাঙা কষ্ট। পাশের কুঠরিতে অমূল্য ছুতোরের বউ গোঙাচ্ছে। গায়ের ওপর ফরফর করে আরশোলা এসে বসেছে আমার। এক সময় মাথায় গিয়ে বসবে, হয়তো চোখ কিংবা চুল কুরে কুরে খাবে। রামেশ্বর ড্রাইভার বলে, দুনিয়া বুঝলি বে উললু–বিলকুল বি এন আর-এর আপ রোড, গিয়ার চড়িয়ে যাবি, ইঞ্জিন থামাবি কি শালা চম্পট লাট হয়ে যাবে। …সবাই বুঝি গিয়ার চড়িয়েই দুনিয়া উতরে যেতে চাইছে। ময়নাও।
৬১.
ঘোরের মধ্যেই দেখলাম, ময়নার মাথার চুল খসে গেছে। ঠিক যেন কামিনী। কামিনীর শুধু পরচুলা খুলেছিল, ময়নার আস্তে আস্তে সব খসে গেল; চুল চোখ গলা বুক হাত পা গায়ের চামড়াটা পর্যন্ত। কী তবে থাকল ময়নার! কিছু না, কোথাও কিছু নয়; সব ফাঁকা। বাতাসের মতন ফাঁকা হয়ে গেল বলেই আজ পুরোপুরি স্পষ্ট করে দেখতে পেলুম, আমার সোনার গয়নার পুঁটলিটা সত্যি সত্যিই ময়নার পোশাক কি শরীরের মধ্যেও লুকোনো নেই। ও আগেই বলেছিল, নেই। আমিও জানতাম নেই; তবু যেন কেন বিশ্বাস হত না। বরং ভেবেছি, ওর কাছেই থাক, গচ্ছিত থাক। সব সোনাই চোরাই সোনা নয়। এ অন্য সোনা।
৬২.
ভোররাতে আমার জন্মের সময়কার আগুনের আঁচটা গায়ে লাগছিল। মাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমায় কোলে নিয়ে মা বসে আছে। অপেক্ষায় অপেক্ষায়। বাবা আর এল না। মার চোখ থেকে বিশ্বাসের আলোটুকু মরে গেল। জলের ফোঁটা হয়ে আমার চোখেই ঝরে পড়ল টপ টপ। সেই জল আমার দু-চোখে মাখামাখি হয়ে গেল।