৩৫.
ময়না ধড়মড় করে উঠে বসল। কী হয়েছে রেফটকে-অ্যাঁ? কী হল তোর? …আমি ভয়ে গোঁ গোঁ করছিলাম। ময়নার সাড়া পেতে ভয়টা খসে গেল। আমার গা পা মাথা ছুঁয়ে দেখলাম। সব ঠিক আছে। খুলে পড়ে যায়নি।
৩৬.
ময়নার পাশে গা ঘেঁষে এবার শুলাম। ওর গায়ের গন্ধ ঠাণ্ডায় মরে গেছে। তার নাকের বড় বড় হাওয়া আমার গলায় লাগছিল। ঘুমিয়ে পড়েছে আবার ময়না। …আমার খুবই ভাল লাগছিল। ময়নার পরচুলা নেই। ও যেমন দেখতে ঠিক তেমনটি।
৩৭.
কামিনী হোটেলে সক্কালবেলায় এক হুদো মদ্দ চোখের ইশারা করে ময়নাকে ডাকছিল। কলতলায় মুখ চোখে জল দিতে গিয়ে আমি সব দেখলাম। ময়না ঘরের বাইরে সরু পথটুকুর ওপর দাঁড়িয়েছিল। কাঠের ফাঁক ফাঁক বেড়া তার সামনে, হাঁটুতক। মাথার ওপর ঢালু টিনের ছাদ। মদ্দটা উত্তরদিকের ঘর থেকে ইশারা করছিল। করেই চলছিল…।
৩৮.
তিন দিন আমরা কামিনী-হোটেলেই থাকলুম। ময়না রোজই একটা করে টাকা দিত কামিনীকে। আমি পেট পুরে ভাত খেতাম। কামিনীর হোটেলে খরিদ্দার ভাত চাইলে না বলার উপায় ছিল না। অনেক খেতাম বলে ঘুম পেত খুব। দুপুর ভোর ঘুমোতাম, রাতে ভাল ঘুম হত না শীতে। ময়না মাঝে মাঝে কোথায় বেরিয়ে যেত। ফিরত দেরি করে। আমার ওপর হুকুম ছিল কোঠা ছেড়ে না যেতে। হয় ঘর না হয় বারান্দায় আমি বসে থাকতুম। ময়নার পুঁটলির ওপর নজর রাখতে হত। ওই পুঁটলিটায় কী আছে আমি জানতুম না। ময়না ওর মধ্যে থেকে তার শাড়ি জামা চিরুনি বের করত। টাকাও।
৩৯.
চারদিনের দিন ময়না অনেক বেলায় ফিরল, খুব সকাল সকাল সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল। অনেক ঘুরেছে, অনেক হেঁটেছে। মুখ শুকনো দেখাচ্ছিল। ফিরে এসেই বসে পড়ল। হাঁপাচ্ছিল। জল চাইল। ঢকঢকিয়ে জল খেল, মুখ গলা মুছল; তারপর ঘাড় ফিরিয়ে পিছু দিকে একবার চাইল। আমায় বলল, চান খাওয়া করে তুই ঘুরে বেড়াগে যা।
৪০.
দু-আনা পয়সা চেয়ে নিয়ে আমি সেই যে দুপুরে বেরুলাম ফিরলাম সাঁঝ করে। ময়না নেই। কামিনী বলল, ময়না চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে কোন বাবুর বাসায়। সেখানে চলে গেছে। বলে গেছে, আমি যেন কোথাও কিছু একটা জোগাড় করে নি।
৪১.
কামিনী আমায় সে রাতের মতন তার হোটেলে থাকতে দিল, খেতে দিল। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আমি সারাক্ষণ ময়নার কথা ভেবেছি।
৪২.
সমস্ত শহরটাই একদিন আমার চেনা হয়ে গেল। পথে পথে কত খুঁজেছি ময়নাকে, দেখতে পাইনি। অনেক সময় ভুল হত। কাছে গিয়ে বুঝতাম, ও ময়না নয়।
৪৩.
বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাবুদের মেসে চাকরি পেয়েছিলাম। এক বাবুর নাম ছিল মোহনবাবু। মোহনবাবুকে কেউ ডাকলে মাঝে মাঝে আমি চমকে উঠতাম। মোহনবাবুও একদিন চমকে উঠেছিলেন। আমি বাজার থেকে তাঁর মেরামত করা জুতোটা এনে জড়ানো খবরের কাগজটা পড়ছিলাম। একটা লোক তার বউকে দা দিয়ে কুপিয়ে কেটেছে। বিপিনঠাকুর রান্নাঘরে বসে বসে আমার পড়া শুনছিল। বানান করে করে পড়তে খুব একটা আটকাচ্ছিল না। মোহনবাবু কী কাজে রান্নাঘরে আসছিলেন। আমায় কাগজ পড়তে দেখে অবাক হলেন।
৪৪.
এক ফাঁকে মোহনবাবু আমায় সব কথা শুধোলেন। কোথায় বাড়ি, কী জাত, বাপ-মার কথা, লেখাপড়া-টড়া কতটা এগিয়েছিল-সব। সব কথা বলা যায় না। আমি সব কথা বলিনি। আমার যে বাড়ি নেই, জাত নেই, বাপ-মার নামটুকু পর্যন্ত জানা নয় খোলাখুলিই বলে দিয়েছিলাম। বলতে বলতে মনে হয়েছিল, শুনে মন গলে যায় এমন কথাই মানুষকে বলতে হয়; খারাপ কাজের কথা বলতে নেই। আমি চায়ের দোকানের টাকা চুরি, আশা বা ময়না এদের কথা বলিনি।
৪৫.
আমার ওপর মোহনবাবুর দয়া হয়েছিল। একদিন তিনি বললেন, ভদ্দরলোকের ছেলের মতন হবার চেষ্টা কর। লোকের এঁটো বাসন মেজে জুতো বুরুশ করে তোর জীবন কাটবে নাকি! সারাদিন বসে বসে করিস কী তুই? বই এনে দিলাম, খাতা পেনসিল কিনে দিলাম–লিখতে পড়তে পারিস না!
৪৬.
লিখতাম পড়তাম। ঠেকলে মোহনবাবুকে শুধিয়ে নিতাম। অন্য অন্য বাবুরাও আমায় বলেকয়ে দিত। অনাদিবাবু বা কেষ্টবাবুর মতন দু এক জন যা টিটকিরি কাটত। আর পেছনে লাগল মদনা। মদনা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। গায়ে তার ভীষণ জোর। এই মেসে তিন বচ্ছর চাকরি হল। মদনা আমায় বসে থাকতে, জিরোতে, বই হাতে দেখলেই ফরমাস করত। যা দোকানে, ওখানটায় ঝাঁট দে, খাবার পৌঁছে দিয়ে আয় সামন্তবাবুর। একদিন সে আমায় দিয়ে দু সের লঙ্কা বাটিয়েছিল। হাতের সেই অসহ্য জ্বালা তিন দিন আমি ভুলতে পারিনি।
৪৭.
নিশিবাবুর ঘড়ি চুরি গেল। আমি চুরি করিনি। মদনা আমায় ফাঁসিয়ে দিল। নিশিবাবুরা আমায় বেদম মারলেন। পুলিশে দিতে যাচ্ছিলেন আর একটু হলে। মোহনবাবু বাঁচিয়ে দিলেন। আমায় তাড়িয়ে দিলেন বাবুরা। বললেন, এ ধরনের চাকরবাকর রাখা আর হবে না। চাল-চুলো ঠিক-ঠিকানা নেই যার তাকে বিশ্বাস কী।
৪৮.
বছর ঘুরে আবার একটা শীত এসে পড়ছিল। শহর চষে ফেললাম। চাকর-বাকরের কাজ আর করব না। অন্য কিছু কাজ কেউ দেয় না। হেট হেট করে তাড়িয়ে দেয়। মোটর কারখানা, সাইকেল সারানোর দোকান–কেউ আমায় নিল না। মাড়োয়ারি পাঠশালার রাস্তার দিকে বারান্দায় রাত কাটাই, স্টেশনের বাইরে থেকে বাজারে মোট বয়ে আনি বাবুদের–দু-চার আনা যা রোজগার হয়।
৪৯.
বিকেল পড়ে গেলে আর আমি কাজ করতে পারি না। যত সাঁঝ বাড়ে, আঁধার ঘন হয়ে আসে ততই যেন কীসের এক দুঃখ আমায় পেয়ে বসে। আমার আর কিছু ভাল লাগে না। কিছু না। সব কেমন ফাঁকা মনে হয়। মন কেমন করে, কান্না পায়। একটা ভয়ংকর কষ্ট–সে যে কীসের কষ্ট কে জানে–আমায় বেহুঁশ করে ফেলে। সন্ধে হলেই জ্বর আসার মতন এই অসুখটা আসে–যত রাত বাড়ে তত তার জ্বালা বাড়ে, ভোরের আলোয় চলে যায়। …এ-অসুখের কী নাম, কেমন করে এল আমি বুঝে পাই না।