২৪.
তালপুকুরের শেষ বাড়িটা হরিমতীদের। বাসার পাশে মরা কদম গাছ। হরিমতীর বেশ বয়েস। গলার একপাশে গলগণ্ড। চোখা নাক, চোখ দুটো গর্তে ঢোকা, সাঁড়াশির আগার মতন টিপে ধরবে যেন এমন করে তাকায়। ছেঁড়া গামছা পরে হরিমতী গুল পাকাচ্ছিল। ময়নাকে দেখে বুড়ি অচেনা মানুষ দেখার মতন চেয়ে থাকল।
২৫.
হরিমতী ময়নার খুড়ি। বুড়ি ভীষণ ধূর্ত, কঠিন মেয়েছেলে। কাঁদুনিতে গলল না। তার উচ্ছের মতন কোঁচকানো কপাল, চিমসে বুকের হাড়ে কখনও ডান কখনও বাঁ হাত চাপড়াল; থেকে থেকে মঙ্গলচণ্ডীর নাম আওড়াল। আমরা বাইরের ডোবা থেকে মুখ হাত ধুয়ে এলাম। বুড়ি আমাদের এক পালি করে মুড়ি দিল, এক খামচা করে একো গুড়। মাটির উঠোনে ভাঙা মাচার তলায় বসে আমি গোগ্রাসে সেই মুড়ি খেলাম। ময়না বসেছিল বুড়ির ঘরের ঠকঠকে দরজার কাছটায়। ময়নার তেমন মন ছিল না খাওয়ায়। কী ভাবছিল কে জানে। চৌকাঠের সামনে ঘর আড়াল করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বুড়ি। নড়ল না। ..ঘটিটা এক চুমুকে শেষ করে আরামের নিশ্বাস ফেলেছি কি বুড়ি বলল, এ-ছোঁড়া করে কী, এমুন ফিঙের মতন দেখতে? ..আমায় কথা বলতে না দিয়ে ময়না বলল, হাটে হাঁড়ি কলসি বেচতে যেত। পালা জ্বরে ভুগছে চার মাস, শরীরটা কাহিল। .বুড়ি তার ঠিকরোনো চোখে চেয়ে দেখল খানিক, তার পর বিড়বিড়িয়ে কী যে বলল, শুনতে পেলাম না।
২৬.
মাঝদুপুরে শীতের রোদ যেন উবু হয়ে বসেছিল। আকাশটা নীল। দুটো না তিনটে চিল আরামে পাখা ছড়িয়ে ভাসছে। ময়না আর আমি হাঁটছিলাম।
২৭.
রাস্তার লোকজন আমাদের দেখছিল। ময়নাকে বেশি আমাকে কম। আমার পায়ের শিরায় টান ধরছিল। থেমে থেমে যাচ্ছিলাম দু দশ পা অন্তর। এই শহরটা খাসা। ঘোড়ার গাড়ি আছে, মোটর গাড়ি আছে, বাস চলে। আমার কেবল মনে পড়ছিল পুরনো দিনের কথা। তেমনি শহর এটা। তার চেয়েও বড়। চাঁপারানির মতন একটা মেয়ে রিকশা চেপে চলে গেল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলুম। রিকশাটা কোথায় আড়াল পড়ে গেল। রোদও আড়াল পড়ে যাচ্ছে। ডান পাশের মস্ত মস্ত ছায়া রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। আমরা বাজারের বড় সড়ক ধরে হাঁটছি।
২৮.
বিকেল ফুরিয়ে এল। অন্ধকার এখানে থিতিয়ে ঠায় ঠায় জমতে পারে না। খামচা খামচা আলো, রাস্তার–দোকান পশারের। অন্ধকার কেটে যায়। আলোগুলোর রোশনাই ঠিকরে ওঠার আগেই বটতলা দিয়ে আমরা এক গলির মুখে ঢুকে পড়লাম। ময়না পথে দু পাঁচজনকে কী যেন সব শুধিয়েছে। আমি ঠাওর করে দেখছিলাম, ময়না দোকানি মেয়েছেলে দেখতে পেলে যা শুধোবার শুধোচ্ছিল, নয়তো চুপ মুখে পথ হাঁটছিল।
২৯.
বাড়িটা কাদা না ইট না টিনের কিছুই বুঝতে পারিনি প্রথমটায়। পরে দেখলাম মাঠকোঠার মতন। ওপর তলা টিন দিয়ে ঘেরা। কামিনী হোটেল। ভাতের ফেনের গন্ধ ছুটছিল। নীচের চাতালে ছড়ছড় করে কলের জল পড়ছে; কোথা থেকে ভ্যাপসা আঁশটে হাওয়া আসছিল। মিটমিট করছে লণ্ঠন। বেঁটে মোটা ধুমসো কাঁঠালের মতন একটা মেয়ে ভাঙা খসখসে গলায় সব কিছু তদারকি করছিল। ওরই নাম কামিনী। হোটেলের মালিক। ওর পরনের শাড়িটা বেশ বাহারি। হাতে কৌটো ভর্তি পান। কামিনীর গলায় মোটা হার, হাতে বালা। মাথায় কেমন এক ধরনের চুল। …ময়না গোটা একটা টাকা দিল কামিনীকে। চার চার আনা করে রাতের খাওয়া। মাছ খেলে পাঁচ আনা। তিন আনা কুঠরি ভাড়া, এক আনা টিমির জন্যে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল একটু মাছ খাই। ময়নাকে বলতে পারছিলাম না।
৩০.
টিমি জ্বালিয়ে দুহাত টিনের খুপরির মধ্যে আমি আর ময়না বসেছিলাম। পাশাপাশি আট দশটা খুপরি থেকে অনেক লোক কথা বলছিল। মেয়েছেলেদের গলাই বেশি। হট্টগোলটা হাটের মতন। ওই গোলমালের মধ্যেও একটি মেয়ে সমানে কেঁদে চলেছে। তার ছেলে সকালে মারা গেছে আজ। শহরের হাসপাতালে। টুলিটায় মাথা ঠেস দিয়ে কুঁকড়ে পাশ দিয়ে আমি শুয়ে থাকলাম। শীত করছিল খুব ঘুমও পাচ্ছিল। টিমিটা টিম টিম করছে।
৩১.
নীচের একটা ঘরে আমরা খেতে বসেছি। মেঝেটা জলো ন্যাতা মুছে মুছে প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে আছে। মাটি খুঁড়ে দেওয়াল ঝরে এঁটো কাটার কেমন এক ঠাস গন্ধ জমেছে এখানে। একটা লণ্ঠন ট্যারা হয়ে জ্বলছে। শালপাতায় ফেন-আগালা ভাত, মুসুরের জলো ডাল। ঘেঁটে কাদা হয়ে গেছে কপির তরকারি। আমি, ময়না, আরও চার পাঁচ জনে হুসহাস করে খাচ্ছিলাম। কামিনী দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
৩২.
লণ্ঠনটা একটু জোর করতে গেল কামিনী। হঠাৎ তার মাথার সমস্ত চুল পড়ে গেল। একেবারে সাদা। কামিনীর মাথায় একটিও চুল নেই।
৩৩.
সবাই হাসছিল। ময়নাই কেবল হাসল না। আমি সাদা মাথা মেয়েছেলে কখনও দেখিনি। কামিনীকে দেখে আমার কেমন ভয় হচ্ছিল।
৩৪.
শীতের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। টিমি নিবেছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘর। পুঁটলি বাঁধা কাপড়টা মাটিতে বিছিয়ে আমরা শুয়েছিলুম। ঠাণ্ডা যেন হাড় মাংস পেরিয়ে শরীরে মধ্যে জমে বসেছে। বুক পেট পা হাত অসাড় অসাড় লাগছিল। কুঁকড়ে পাকিয়ে গিয়েছিলুম, দেহটাকে আরও কুণ্ডলী পাকানোর চেষ্টা করলাম, কাঁথাটাকে আরও জড়ালামহঠাৎ মনে হল, আমার শরীরটাই খুলে পড়ে গেছে। কামিনীর চুলের কথা মনে পড়ল। আমার শরীর থেকে হাড় মাংস খুলে গিয়ে তা হলে কী আছে?