১২.
নদী পেরিয়েছি বেলায়। তার পর রোদ আরও ছড়াল, গরম হল, বেলা চড়ল, আমরা হাঁটছি হাঁটছি। হাঁটার শেষ নেই। একটা বসতি মতন এল। ময়না বলল, না ওখানে নয়। একটা ছোট গ্রাম দেখলাম, ময়না হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরল। আরও একটু চ..আরও একটু। রোদে রোদে ময়নার শাড়ি আমার ধুতি কখন শুকিয়ে গেছে। নদীর কনকনে জল ঠেলে ঠেলে কোমর পর্যন্ত অসাড়, হেঁটে হেঁটে দু পা আমার ব্যথায় টনটন করছে। আর টানতে পারছি না নিজেকে। মনে হচ্ছিল আবার আমার জ্বর আসবে। মাথা টাল খেয়ে যাচ্ছিল।
১৩.
আমরা এক পুকুরপাড়ে বসলাম। চারপাশে ফাঁকা ক্ষেত আঁকা বাঁকা আল। সরু সরু পায়ে চলা পথের জাল চারপাশে ছড়িয়ে আছে। …কোন পথ আমরা ধরব কে জানে। আমি জানি না; ময়না জানে। ময়না জানে আমরা আর কত হাঁটব, কোথায় যাব, কোনখানে গিয়ে জিরেন পাব।
১৪.
পুকুরের জলে হাত মুখ ধুয়ে এসেছি আমরা। ময়না পুঁটলি থেকে চিড়ে বের করছে, একটা করে গুড়ের লাড্ড। পেটের খিদে জিবে এসে উঠেছিল। নাড়ি পড়ে গেছে, জিবে আর জল কাটছে না। মরা খিদেয় চিড়েগুলো আরও শুকনো লাগছে। গলায় আটকে যাচ্ছিল। দম নিতে পারছি না ভাল করে। ময়না গোগ্রাসে খাচ্ছিল। তার চোখ আঁচলের ওপর, চিড়ের মুঠো সমেত হাতটা উঠছে নামছে। ওর গাল ফাঁক হয়ে ছড়িয়ে পড়লে মাঝে মাঝে দাঁতের পুরো পাটি দেখা যাচ্ছিল। কী সাদা আর শক্ত দাঁত! এই দাঁত দিয়ে কাল রাত্তিরে গোলককে ও ক্ষ্যাপা কুকুরের মতন ছিঁড়েছে। মানুষের দাঁত যে এমন সাংঘাতিক হতে পারে আমি জানতাম না।
১৫.
গাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে আমরা জিরেন নিচ্ছি। শীতের রোদ নরম হয়ে আসছে। দুটো ফিঙে মাথার ওপর বসেছিল, উড়ে গেছে; একটা কাক কা কা করছিল। ইনতি-লতার ডাল বেয়ে হলুদ গিরগিটিটা উঠছে আর নামছে। ময়নার খোঁপা মাথার চুল ধুলোয় ধুলোয় রুক্ষ। দু চোখ জড়িয়ে এসেছে ওর। আমার মনে হচ্ছিল, আমি ময়নার বর হলে বেশ হত। ময়নার বর নেই।
১৬.
বিকেল পড়ে এল। আমরা হাঁটছি। শিমুল গাছের তলায় খোঁড়া একটা কুকুর শুয়েছিল। মুখ তুলে দেখল। বার কয় ডাক দিয়ে আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগল। ময়না বলল, স্বগের কুকুর চলেছে। সঙ্গে। ..ময়নার হাসি আমি বুঝলাম না। কোথায় যাচ্ছি আমরা? স্বগগে, স্বৰ্গগে, স্বগগে.ময়না হেসে হেসে বলল।
১৭.
মাঝরাতে আমরা স্বগগে এসে পৌঁছলাম। কী ভীষণ শীত। হাত পা জমে যাচ্ছিল। পা গুটিয়ে বুকের সঙ্গে ঠেসে ধরে মুখ মাথা গুঁজে একটা পুঁটলির মতন পেচ্ছাবখানার কোণে আমি বসে ছিলাম। শীতের চোটে ঘুম ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল। দু-চোখ ঘুমে জড়ানো, তাকাতে পারছি না, ঘুমোতেও না। ময়না হাত ধরে টানল, এই ওঠ ওঠ–এখানে নামব আমরা। রেল কামরার আলো দুটো পিট পিট করে চাইছে। বিশ পঁচিশ জন লোক, সবাই কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে শুয়ে, দু-একজন বসে বসে ঘুমোচ্ছ। আমরা। নেমে গেলুম।
১৮.
এটা খুব বড় ইস্টিশান। পুল পেরিয়ে মুসাফিরখানা। শীতের খুব চোট। হিমে সব ভিজে গেছে, আশপাশের বাতিগুলো নিবু নিবু লণ্ঠনের মতন টিম টিম করছে। অল্প কটি লোক আমাদের মতনই কাঁপতে কাঁপতে দু হাতে কান মাথা ঢেকে পুল পেরিয়ে চলল। ঠক ঠক করে কাঁপছে সবাই, হি হি করছে। আমার দাঁত বাজছিল। পা আর নড়ছিল না।
১৯.
মুসাফিরখানায় বসে আমরা গরম গরম চা খেলাম। তিনপাশ ঢাকা এই বড় মুসাফিরখানায় অনেক লোক। তাল তাল হয়ে পড়ে আছে। চিনেবাদামের খোসা, ছোলা ভাজা, তরকারির আলু, এঁটো পাতা, কলার খোসা ছত্রাকার করে ছড়ানো। আমার পুরনো কথা মনে পড়ছিল…সেই চায়ের দোকানের কথা। পার্বতাঁকে যদি এখানে পেতাম! আমার টাকা চুরি করে পালিয়ে ও যে কোথায় দোকান দিয়েছে কে জানে!
২০.
ময়না আমার হাত ধরে টেনে একটা অন্ধকার কোণে গিয়ে বসল। পুঁটলিটা কোলে রেখে গা ঘেঁষে বসে বলল, তোর বয়স কত? ..আমার কত বয়েস আমি কী করে জানব! কে আমার বয়সের হিসেব রেখেছে! বললাম, জানি না। ময়না আমার মুখের দিকে অল্প একটু চেয়ে থেকে বলল, তোর বাপ মা কোনও চুলোয় কেউ নেই–ঠিক তো, না মিথ্যে বলছিস? ..চাঁপারানি আর শ্যামলবাবুকে আমার মনে পড়ল। কতদিন তাদের কথা ভাবিনি।
২১.
আমার জাঙে হাত রেখে একটু টিপে দিল ময়না। আমরা বিহান হলেই এক জায়গায় যাব। তুই যা ল্যাঙপেঙে নয়তো তোকে আমার বর করতুম। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি তুই আমার দেওর। বুঝলি?
২২.
গোকুল ময়নার ভাসুর সেজে ছিল, আমি দেওর সেজে থাকব। আমার বয়স বেশি হলে আমি ওর বর হতে পারতাম। ময়নার বর হতে আমার খুব ইচ্ছে ছিল। আমার বয়স কেন যে একটু বেশি হল না! ময়নার শাড়ির জামার গায়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমার শরীরের ভেতর কেমন করে উঠল। কাল রাত্তিরে ময়না আমায় পাশে টেনে নিয়ে শোবার পর আমি ভয়ে ভয়ে চোখ বুজে ছিলাম, আজ চোখ খোলা। বোজা চোখে কত কী হওয়া যায়, খোলা চোখে কিছুই না।
২৩.
টকটকে রোদে খুঁজে খুঁজে আমরা যেখানে এলাম সেটা ঝি-পাড়া। মাটির কুঁড়ে, খড়ের চাল, পুরনো টিন কিংবা খোলার ছাদ। নালি নর্দমা থিক থিক করছে ময়লায়। একটা পোডড়া বাড়ির গায়ে খুঁটে শুকোচ্ছে, নামে মাত্র; অথচ কয়েক শো দাগ। ছেঁড়া ময়লা শাড়ি শুকোচ্ছে এদিক ওদিক। ন্যাংটা ছেলেমেয়ে, লেড়িকুত্তা। …ময়না আমায় ইশারায় সামনে এগিয়ে যেতে বলল। বলে ঘাড়ের কাপড়টা মাথায় উঠিয়ে মুচকি হাসল একটু। ক পা এগিয়ে ময়নাই শুধোল একটা কাঠিসার কবসা মেয়েকে, হরিমতীদের বাসা কোনটা গো?