০৩.
ময়নার গোটা নাম ময়নাবতী। তার বর নেই। কোথায় আছে কে জানে। ময়না সিথিতে সরু করে মেটে-সিঁদুর দেয়। তার ভাশুরের নাম গোলক। গোলকের একটা পা খোঁড়া, পা টেনে টেনে হাঁটে। গোলক সারাদিন গোরুর গাড়ির চাকার মতন একটা চাকা ঘুরোয়। ময়না কাদা ছানে, তাল করে, আগুন তৈরি করে দেয়, গোলক হাঁড়ি কলসি গেলাস বানায়, আগুনে পোড়ায়। সারা সকাল সারা দুপুর সন্ধেতক ওর শুধু কাজ, কাজের মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে গান: যদি আশা দিলে নিশি জাগালে তবে কেন যে কাঁদালে হে…।
০৪.
গুড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল সকালে। শীত গায়ে বিঁধছিল। নতুন পেরেকের রঙের মতন মেঘলা হয়েছিল বাইরেটা। শন শন হাওয়া বইছিল। টিঙটিঙে দুই গোরু জুতে, মাথায় পুরনো ছাতাটা মেলে গোলক হাঁড়ি কলসি সাজিয়ে রোববারের হাটে গেল। …দুপুরের পর মেঘ কেটে সূর্য মুখ দেখাল। হাওয়াও যেন গায়ের খাপ ফেলে তার আরও ধারালো ফলা শন শন করে ঘোরাতে লাগল। কী শীত। …সন্ধে হল, গোলক ফিরল। ঘেঁড়া কানিতে পুঁটলি বাঁধা চাল ডাল, গামছায় কিছু আনাজ বেঁধে এনেছে নীল রঙের বোতলে আধসেরটাক সরষের তেল, একটা বাঁধাকপিও নামাল। আর শালপাতার ঠোঙায় ঝুরি ভাজা, দু-চারটে মিঠাই ময়নার জন্যে। রাত হল; মালসায় আগুন জ্বালিয়ে দাওয়ায় বসে থাকল গোলক, গায়ে কাঁথা। তামাক খায় আর গান গায়: কী যাতনা যদি না বোঝো তবে আর কেন এ প্রাণ রাখা–। পাকশালে মিটমিট টিমি জ্বলে ময়নার। ভাতের ফেন পোড়ার গন্ধ ছোটে। –আমি ভাবি, গোলক ময়না বর বউ হলে খাশা হত।
০৫.
মাঝরাতে ময়না ডাকাত পড়ার মতন করে দরজা পিটিয়ে ডাকল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম খড় বিছানো চটের বিছানায়। ঘরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ময়না ডাকছিল। নিশির ডাক নয় তো? আমার বড় ভয় নিশি পাওয়ায়। খুলে দিলাম দরজা ভয়ে ভয়ে। ময়না ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিল। অন্ধকারে না দেখি মুখ না পাই ঠাওর। তবু মনে হল ময়না হাঁপাচ্ছে। খানিকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল ও। তার পর বিছানায় গিয়ে বসল। আমি দাঁড়িয়ে। ডাকল ময়না। বার বার তিনবার। ডাকে ডাকে দু পা দেড় পা করে এগিয়ে কাছে গেলাম। হাত ধরে টেনে পাশে বসাল ময়না। বলল, শো। …ভয় করছিল শুতে! মুখ তো দেখিনি মেয়েটার! যদি ময়নার গলা করে নিশি এসে থাকে!
০৬.
ভোর হবার আগে আগে ময়না উঠে আমায় ডাকল। বলল, চল আমার সঙ্গে। –কোথায় যাব। গায়ের শাড়িটা পেঁচিয়ে নিল ময়না, ঘাড়ের খোঁপাটা আরও উঠিয়ে দিল! দরজা খুলে চলে গেল। আবার এল একটু পরেই। মুখে জল দিয়েছে। হাতে একটা বড় পুঁটলি। বলল, এখনও বসে আছিস হাঁদার মতো। ওঠ…কাঁথাটা গায়ে জড়া, চল শিগগির, এরপর ফরসা হয়ে যাবে।
০৭.
কত দিন পরে আবার পথ হাঁটছি। পায়ে ধুলো লাগছে। ভোরের ধুলো, সারারাতের হিমে ভেজা ভিজে ভিজে ধুলো। কুয়াশা চারপাশে। গাছের মাথায় পাখি ডেকেছে, কাকা করছে কাক, এখনও আকাশে শুকতারা জেগে আছে। কী শীত। কনকন করছে মুখ মাথা হাত পা। ময়না জোরে জোরে হাঁটছে, ছুটে ছুটে; আমি তাল রাখতে পারছি না। ওর ঘোমটা খসে গেছে, ঢিলে খোঁপাটা ঘাড়ে নেমে কখনও ডানে কখনও বাঁয়ে সরে যাচ্ছে। পিছু থেকে ময়নাকে ভোরবেলার ঘুম-ভাঙা টাটকা বউয়ের মতন দেখাচ্ছে। মুখ ওলটানো ঘড়ার মতন পিঠ, কোমর দুলছে, সরু কোমর, কোমরের তলায় দুটো গোলগোল বাচ্চা যেন হামাগুড়ি দিয়ে হেসে হেসে ছুটছে, গোড়ালির অনেকখানি উঁচুতে শাড়ির পাড়টা ঘষে ঘষে যাচ্ছে ময়নার গোড়ালি আঁট শক্ত পুটু, ওর পায়েও ধুলো।
০৮.
সূর্য উঠে গেল। আমরা নদীতে। ময়না ডান হাতে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে নদীতে নামল। বার কয় কুলকুচি করল। আমার বাসি মুখ, এতক্ষণে আমি জল দিলাম। কী ঠাণ্ডা জল। পুঁটলিটা আমার হাতে দিয়ে ময়না আড়ালে গেল।
০৯.
পুঁটলিটা আমার খুলতে ইচ্ছে করছিল। কী আছে? আমার সেই সোনাগুলো আছে না কি এর ভেতর? গা শিরশির করে উঠল। এপাশ ওপাশ তাকালাম। ময়না ভাঙা-পাড়ের খাঁজের আড়ালে গেছে। ওকে দেখা যাচ্ছে না। পুঁটলিটা খুলব? পালাব নিয়ে? কেমন করে পালাব, কোথায় বা যাব!
১০.
ওপরের শক্ত গিঁটটা খুলেছি কি চোখে পড়ল ময়না খানিকটা তফাতে জলে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে বুকের রক্ত ছলাত করে উঠল। গিটটা আবার বাঁধতে লাগলাম তাড়াতাড়ি।
১১.
নদী পেরোতে পেরোতে ময়না বলল, তুই বলিস কী, ফটকে। …আমার বুক অবধি জল উঠেছে, ময়নার কোমর ছাড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়ল ময়না। আমরা দুজনেই হেলে হেলে পড়ছিলাম; আমি বেশি, ময়না কম। তরতর করে জল বয়ে যাচ্ছে। ময়নার ভেজা শাড়ি জলের তলায় তোড় খেয়ে ফেঁপে ওপরে ভেসে ভেসে উঠছিল, ময়না বশ করছিল থাবড়ে থাবড়ে। …আমার দিকে অবাক চোখে সন্দেহ সন্দেহ ভাব নিয়ে খানিক তাকিয়ে থাকল ময়না। তার পর বলল, মাথার ওপর আকাশে সূয্যি উঠেছে, নদীর মাঝ-মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছি–এক গলা জলে ডুবে–এ-জলও গঙ্গা বুঝলি–এই ভোরে এখানে তোকে ছুঁয়ে দিব্যি কাটছি, তোর এক দানা সোনা আমি চক্ষেও দেখিনি। ময়না কী ভীষণ দিব্যি কাটল। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে আকাশটা দেখলাম, সূর্য লাল হয়ে উঠছে; দূরে তাকালামনদী বয়ে যাচ্ছে। কী শান্ত নির্জন। চারপাশে তীরের গাছপালা সবুজ হয়ে উঠছে। আমার কেন যেন বুক কুরে কুরে কান্না আসছিল। চোখ আমার জলে ভরে এল। …ময়না বলল, সেই সাধুটা সাত সকালেই পালিয়েছিল; নিশ্চয় তার কাজ। …সাধুরা চোর হয় আমি ভাবিনি। মনে পড়ল সেদিন যে সাধুটা আমার বয়সি একটা ফরসা গোলগাল ছোঁড়াকে দিয়ে গা পা টেপাচ্ছিল, সে-সাধুটা ইশারায় আমাকেও ডেকেছিল। ঘুমের মধ্যে একবার যেন মনে হয়েছিল ও আমার গায়ে পায়ে হাত দিয়েছে। কিন্তু তখন আমার জ্বর এসে গেছে, যন্ত্রণায় পুড়ছিলাম। আমি হুশ হারিয়েছি ততক্ষণে। অথচ ওই শুয়ারের বাচ্চা সাধুটাই আমায় আদর করে ডেকে সে-রাতের মতন ময়নাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল।