২৪.
ভয়ংকর শীত। আমার গায়ে ছেঁড়া একটা জামা। হেঁটে হেঁটে মেলায় যাচ্ছি। সামনে লাল ধুলো উড়িয়ে ককিয়ে ককিয়ে গোরুর গাড়ি যাচ্ছে, ফটফট ডাক মেরে ঝরঝরে মোটরগাড়িও চলে গিয়েছে দু একটা। দু-দশ জন মানুষ পায়ে হেঁটেও চলেছে। দেহাতি এবং ভদ্র বাবু-বিবিরা। খুশিতে হাসছে, ঢলছে, কমলালেবু খাচ্ছে। মন্দিরটা মাইল তিন দূরে। মেলা সেখানে।
২৫.
পাহাড়ের পাথরের খাঁজে মন্দির, পাথরের ছোট ছোট ঘর, ধর্মশাল, হাড়িকাঠ। অনেক লোক এসেছে। ভদ্রলোক এক রাশ, বউ, মেয়ে, ছেলের দল। তারা দাপাদাপি করছে। ছুটোছুটি, হাসাহাসি। দেহাতিরা মেলা বসিয়েছে। একটা নাগরদোলা উঠছিল, নামছিল; নামছিল, উঠছিল।
২৬.
আহা, মন্দিরের কাছে ভিড়ে একটি মেয়ে দেখলাম। টুকটুকে রং, হাঁটু ছড়ানো চুল, ডাগর চোখ, পাখির পালকের মতন ভুরু। এই মেয়ে পরী। এত সুন্দর কাউকে আর দেখিনি।
২৭.
মেয়েটি এই থাকে–এই হারিয়ে যায়। আমায় ডাকলেন, এই ছোঁড়া এদিকে আয়। মেয়েটির আরও কাছে যেতে পারছি ভেবে আমি দৌড়ে পাথর টপকে কাছে গেলাম, একেবারে কাছটিতে। …বাবু তাঁর পায়ের জুতোটা খুলে আমার দু গালে দু ঘা মারলেন, জোরে…বেশ জোরে। বললেন, হারামজাদা সোয়াইন… ভদ্দরলোকের জিনিসের পেছনে ফেউ লাগা! হারামজাদা কোথাকার। আমি চলে আসছিলাম। মেয়েটি হাসছিল আর কী বলছিল। বাবু বলছিলেন, ইতর ভদ্র সবাই তোমার রূপে মজে যায় আশা, কী আর করবে। .মেয়েটির নাম আশা। আশা আশা।
২৮.
বিকেল হল। মেলা ভাঙল। সবাই ফিরছে। সবাই। দোকানপত্র উঠছে। গোরুর গাড়ি জোতা হল। মোটর গাড়ি স্টার্ট দিল। দেহাতিরা গান গাইছে। বাবু ছোরারাও গান গাইছে। বউমারা জুতো পায়ে দিয়ে টুক টুক করে হাঁটছে। পাতা উড়ছে, সারাদিনের খাওয়া-দাওয়ার পর। পাথর সাজিয়ে তৈরি উনুনগুলো পোড়া কাঠ আর ছাই নিয়ে পড়ে আছে।
২৯.
সন্ধ্যা হয়ে এল। ধর্মশালায় দু-পাঁচটি মাত্র যাত্রী। শীতের খর বাতাস বইছে।
৩০.
নদীর ধারে অভুক্ত এঁটোকাঁটা ছড়ানো খাবার খুঁজতে গিয়েছিলাম। ভীষণ খিদে আমার। বাঁশের ঝোঁপের কাছে হঠাৎ দেখলাম সেই মেয়েটি। আশা..আশা। তাকে দেখে আমি পালাচ্ছিলাম। পায়ের শব্দ পেয়ে একটুক্ষণ দেখলাম তাকে। আশা একা। ধীরে ধীরে কাছে গেলাম। আশা বলল, অন্ধকার হয়ে গেলে আমি আর কিছু দেখতে পাই না, কানা হয়ে যাই। তুমি আমায় মন্দির পর্যন্ত পৌঁছে দাও। …আশা হাত বাড়িয়ে দিল তাকে ধরে ধরে পথ ঠাওর করে নিয়ে যাবার জন্যে। …আশার হাতে চুড়ি বালা। আমি দেখলাম। আশার গলায় সুন্দর হার। কানে দুল। …আমি তার হাত ধরলাম। সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে।
৩১.
উঁচু শক্ত ধারালো শ শ বছরের পুরনো মিশকালো পাথরের খাঁজের মধ্যে, বাঁশঝোঁপের আড়ালে, অল্প অল্প জলে, অন্ধকারে আশার শরীর নিস্পন্দ হয়ে গেল। অন্ধকারেই আশারা মরে।
৩২.
সমস্ত গহনা আমার কাছে, পুঁটুলি করে বাঁধা। ছেঁড়া জামাটা দিয়ে আগুনের চেয়েও গরম, তপ্ত এক পুঁটলি বেঁধেছি। শীতের হোবলও আর গায়ে লাগছে না আমার।
৩৩.
মন্দিরের পাশ দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে যাবার সময় এক বৃদ্ধা মহিলাকে হঠাৎ বলতে শুনলুম, কোথায় যেন আগুন লেগেছে গো! ..মেলার দিকে না ধর্মশালার দিকে কোথায় যেন আগুন লেগেছিল। লাল আঁচ উঠছিল একটা।
৩৪.
মন্দির থেকে অনেকটা দুরে এক কুমোর বাড়ির খোলার চালের তলায় কুঁকড়ে জড়সড় হয়ে শুয়েছিলাম। এক হিন্দুস্থানি সাধু আমার বয়সি একটা ফরসা ছেলেকে দিয়ে পা টেপাচ্ছিল। গাঁজার গন্ধ খুব। …কখন আমি ঘুমিয়ে পড়লুম। রাত্রে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম–আগুনের স্বপ্ন। এই আগুন সেই আগুন, আমার জন্মের সময় যেটা লেগেছিল। আমার বাবা আগুন নেবাতে ছুটে গিয়েছিল, মা আর আমি অসহায় হয়ে পড়ে ছিলাম।
৩৫.
আগুনটা আমার গায়ে এবং মনে লেগেছে। এতকাল পরে। মা পুড়েছে; বাবা মরেছে। …আশাকেও আমি মেরেছি।
.
দুই
০১.
আমি কে, কী আমার নাম, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব–আমার মনে পড়ছিল না কিছুই। তিন দিন তিন রাত কেউ যেন আমায় কোনও গুহায় নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখল, বেহুঁশ জ্বর আর যন্ত্রণার কালো খুঁটি বেড় দিয়ে ফুলি-আঁটাবলদের মতন ঘুরলাম। দিন গেল রাত এল, রাত ফুরাল দিন এল, আমি ঘুরছি ঘুরছি। কখনও বুনন কুকুরের,কখনও পুলিশের, কখনও বা রাশ রাশ বিছের স্বপ্ন দেখলাম। কুকুর তাড়া করেছে, পুলিশ বেত মারছে, বিছেতে কামড়ে দিয়েছে। …তারপর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম, খোলা দরজা দিয়ে আলো এসেছে, কুঁই কুঁই করে বেড়াল বাচ্চা ডাকছে, ঘরের মধ্যে মালসার ছাই উড়ছে তুলোর আঁশের মতন, খোলার চাল থেকে কুটো পড়ছে উড়ে উড়ে। আমার ঘাড় পিঠ বুক হাত পা সব যেন বিরাট একটা ফোঁড়ার মতন টাটিয়ে টা টা করছিল। কী যন্ত্রণা, কী কষ্ট। নিজেকে মনে পড়ল। আশাকে মনে পড়ল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। গা থেকে কুটকুটে ছেঁড়া কালো কম্বলটা টান মেরে ফেলে দিলাম। কে দিয়েছে এই কম্বল আমার গায়ে চাপা দিয়ে? কে? কে আমার অত কষ্টের ধন সোনা বাঁধা পুঁটলিটা চুরি করে পালিয়েছে?
০২.
কুমোর বউ শটির পথ্য দিল। ওর নাম ময়না। বলল, মরতে হয় অন্য কোথাও গিয়ে মরো, এখানে মরলে পোড়াবার লোক নেই। .. ময়না আমার সোনা চুরি করেছে। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও মুখে আটকে গেল। ভয়। আমার মতন ভিখিরি ছেলের কাছে অত সোনা কী করে এল? চালাক চতুর ময়না আমায় পুলিশে ধরিয়ে দেবে ঠিক। আশার কথাও জানাজানি হয়ে যাবে।