৫৯.
কুমু বলল, জানি সব জানি। .এই গলার স্বর ঠিক সেদিনের মন, অবিকল সেই সুর। দোকানে আমার গিলটির হার গলায় পরার পর আমি বলেছিলাম ওর পালিশ থাকবে না। কুমু বলেছিল, জানি সব জানি। …হঠাৎ আমার মনে হল, কুমু আমার সব জানত, আমার সমস্ত কুমু আমার সব জানে, সব জানবে।
৬০.
হাত ছেড়ে মাটির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, আমার ছায়া কুমুর গায়ে আড়াল হয়ে আছে কুমুর ছায়াটাই মাটিতে ছড়ানো। মনে হচ্ছিল, আমার আর ছায়া নেই কুমুই আমার ছায়া। আর সেই ছায়ার ওপর ছেলেটা শুয়ে আছে।
৬১.
ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পালাতে গিয়ে লণ্ঠনটা পায়ে লেগে ছিটকে পড়ল। কাঁচ ভাঙল, কেরাসিনের গন্ধ উঠল ধক করে, ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাইরে এসে দেখি আকাশটা কেমন লালচে। হয়তো ঝড় উঠবে, হয়তো কোথাও আগুন লেগেছে।
৬২.
ঘুরে ঘুরে ছুটে ছুটে কখন যেন আর পা চলল না, ঠাণ্ডায় হিমে শীতে সমস্ত শরীর অসাড়, একটু আগুনের আশায় গরমের লোভে স্টেশনে এলাম। চায়ের দোকানের উনুনটা নিবে গেছে। লোকগুলো পুঁটলির মতন হাত পা গুটিয়ে মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ। …কলকাতার গাড়ি এসে চলে গেল, মাঝরাতে কাশীর গাড়ি এসে উলটো দিকে চলে গেল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, যে কোনও গাড়িতে গিয়ে উঠে বসি। উঠতে পারছিলাম না। ভীষণ জ্বর এসে গিয়েছিল।
৬৩.
শেষরাতে বুঝি গাড়িতে উঠে বসেছি। গাড়ি ছাড়ল। কোথাকার গাড়ি কোথায় যাচ্ছে কিছু জানি না। হুঁশ নেই। চাকার শব্দের সঙ্গে কুমুকাঁদছিল। ছেলেটা চেঁচাচ্ছিল। …কে জানত, আমার সমস্ত ময়লা আমি কুমুকে মাখিয়েছি, কে ভেবেছিল কুমুর নাড়িতেও সেই ময়লা পুরু হয়ে জমে থাকবে। আমায় কেউ মুক্ত করেনি।
৬৪.
ঘুম ভাঙলে দেখলাম, আমি স্টেশনের মুশাফিরখানায় শুয়ে আছি। ঝাড়ুদারের ঝেটা জঞ্জাল সাফ করছে। এটো পাতা বিড়ির টুকরো আমার মুখে এসে পড়ছে। …উঠে বসলাম। গায়ে জ্বর। পা টলছিল। …বাইরে এসে দেখি শীতের রোদ উথলে পড়ছে।
৬৫.
বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। জ্বর, না জ্বালা,না কি আর কিছুতে কে জানে আমার পিঠে যেন একটা কুঁজের মতন কী উঁচু হয়ে আছে।
৬৬.
হয়তো আমার কুঁজ হচ্ছিল।
৬৭.
কুমু ছেলে কোলে দাওয়ায় বসেছিল। পায়ের কাছে কাঠের গুঁড়ো ভরা কাপড়ের ছোট্ট পাখি। সদরের দরজাটা আমি বন্ধ করে দিলাম। খিল তুলে দিলাম।