৪১.
কাঠগোলার কাছে একটা কুয়ো। মুখোমুখি দাই মাসির বাড়ি। ডাগর মতন ফরসা একটা মেয়ে কুয়ো থেকে জল তুলছিল। চাকার শব্দ হচ্ছিল। দাই মাসির দরজা হাট করে খোলা। ডাকাডাকি করতে মেয়েটাই এগিয়ে এল। বলল, তার মা এখনও ঘুমোচ্ছ।
৪২.
ঘুম ভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে যে এল তাকে দেখে আমি চিনতে পারলাম। চমকে উঠলাম। মুখ থেকে কথা খসছিল না। চাঁপারানি–সেই চাঁপারানি, আমি যাকে ছেলেবেলায় মনে মনে মা বলতাম। চাঁপারানি আমায় চিনতে পারল না।
৪৩.
কুমু সারাটা বেলা কাটা কই মাছের মতো ছটফট করল, কাতরাল, কাঁদল। বিকেল নাগাদ তার ছেলে হল। চাঁপারানির পায়ে আমার গড় হয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল।
৪৪.
ছেলেটার চোখ হল না। সবাই বলল, ফুটবে–পাতা জুড়ে আছে তাই অমন জোড়া জোড়া দেখায়।
৪৫.
ছেলেটার গায়ের নীলচে ভাবটা গেল না। সবাই বলত মায়ের নাড়ি ময়লা ছিল তাই অমন হয়েছে, আর একটু বড় হলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
৪৬.
ছেলেটার গা ভর্তি লোম, মাথাটা বড়, ঠ্যাংগুলো বাঁকা বাঁকা।
৪৭.
কুমু জীবনে এক দিনই কেঁদেছিল–সেই প্রসবের দিন; আর কাঁদত না। কাঁদত না, হাসত না, কিছু বলত না। ছেলেকে কোলে করে বসে থাকার সময় তার চোখ ছেলেটাকে এক নজরে দেখত, আর দৃষ্টিটা যেন বলত, এমন হবে আমি জানতাম।
৪৮.
আমার অসহ্য লাগত। অন্ধ, ময়লা, লোমওলা, কদাকার ওই ছেলেটাকে দেখলে সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করতে উঠত। মানুষ না বাঁদর কীসের বাচ্চা ওটা বুঝতে পারতাম না। রাগে যন্ত্রণায় ছটফট করতাম, কুমুকে গালাগাল দিতাম। ওর নাড়িতে এত ময়লা কেন ছিল! কেন! একদিন কুমুকে মেরেছিলাম। কুমু আমার ভাত খাওয়ার সময় বাচ্চাটাকে কোলে করে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল; বাচ্চাটা কাকের ছানার মন চেঁচাচ্ছিল।
৪৯.
আস্তে আস্তে বাসায় আসা আমার বন্ধ হয়ে গেল প্রায়। দুপুরে ভাত খেতে আসতাম একবার। রাত্রে আসতাম না প্রায় দিনই, কোনও কোনওদিন আসতাম, গলা পর্যন্ত মদ গিলে। কুমুকে কুমুর বাচ্চাকে নেশার চোখে দেখতে পেতাম না, বাচ্চার কান্নাটা আমার সেই মরা ঘুম ভাঙাতে পারত না।
৫০.
জগতে হাজার হাজার মানুষের ছেলে জন্মায় মানুষের মতো চেহারা নিয়ে, আমার ছেলে কেন অমন হল? আমি হাজার ভেবেও বুঝতে পারতাম না, কুমুর পেটে একটা জানোয়ার কী করে এল, কুমুর নাড়িকে কে ময়লা করল!
৫১.একদিন জানোয়ারটার মুখে কথা ফুটল। কুমুকে জড়ানো স্বরে মা মা বলছিল। তখন বাইরে ভয়ংকর বৃষ্টি। আমি ঘরে আটকা পড়ে বসেছিলাম। ঘরের চৌকাঠের কাছে কাত হয়ে পড়েছিল ছেলেটা। ওটা ঠিক মতন বসতে পারে না, অপলকা পায়ে দাঁড়াতেও পারে না। জন্তুর মতন মেঝেতে পড়ে পড়ে ছেলেটা মা মা করছিল। …আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল, ছেলেটার গলা টিপে মেরে ফেলি। কুমু বাসন মাজতে বসেছে, বাইরে তুমুল বৃষ্টি, কেউ কিছু জানতে পারবে না।
৫২.
কুমুর ছেলের জ্বর হল ধ্ব। আমি বাসায় থাকতাম না। বাজারের মানিকলাল আমায় একটা আস্তানা জোগাড় করে দিয়েছিল। কালী মন্দিরের গলিতে সেই আস্তানায় আমি ভূতের মতন বেঁচেছিলাম। সকালে উঠে বাজারে আলুর আড়তে যেতাম, দুপুরে জগুবাবুর হোটেলে ভাত খেতাম, বিকেলে আড়তের দরজায় তালা ঝুলিয়ে খাঁ খাঁমনে এদিকে সেদিকে ঘুরতাম, চা বিড়ি পান খেতাম, সন্ধের ঝোঁকে মনে হত আমার মেরুদণ্ডের তলা থেকে একটা ব্যথা বিষফোঁড়ার মন তর তর করে পেকে ফুলে চড়িয়ে যাচ্ছে। মাথাটা জ্বরো রুগির মক্স গরম ভার হয়ে আসত, ঘাড়ের কাছটায় অসহ্য ব্যথা, চোখ কান জ্বলে যেত। বুকের মধ্যে একটা হাত যেন ক্রমাগত কী একটা খুঁজে পাবার জন্যে হাতড়ে বেড়াত। …আমি কালী মন্দিরের গলিতে ফিরে আসতাম। কৌশল্যা আমার খাঁটিয়া পেতে দিত, ধেনো মদের বোতল পেড়ে দিত কুলুঙ্গি থেকে। সারাটা রাত মদ আর কৌশল্যার গায়ের টক টক কেমন এক গন্ধের মধ্যে আমি ডুবন্ত মানুষের মন হাঁসফাঁস করে মরতাম।
৫৩.
বাজারে আলুর আড়তে খবর পাঠাল কুমু। ছেলেটা মরে যাচ্ছে।
৫৪.
আমাদের বাজারে এক পাগলি জুটেছিল। তার সারা গায়ে ঘা। পাগলি একটা ভাঙা হাঁড়ির মধ্যে এক গণ্ডা কুকুর ছানা নিয়ে বসে থাকত, আর থেকে থেকে সব কটা বাচ্চাকে এক সঙ্গে হাঁড়ি চাপা দিয়ে বলত, চারটে পয়সা দিলে কুকুরগুলোকে সে পায়রা করে আকাশে উড়িয়ে দেবার খেলা দেখাবে। আমি জানতাম, এ হয় না; এ রকম ভেলকি হবার নয়, তবু তাকে চারটে পয়সা দিয়েছিলাম।
৫৫.
কুমু আমায় আর ডেকে পাঠায়নি, তবু একদিন সাঁঝে বাসায় গেলাম। কুমু দাওয়ায় বসে তার ছেলেকে দুধ দিচ্ছিল। আমার সারা গা ঘিন ঘিন করে উঠল। কুমুর শরীরের ভেতরটাও নোংরা হয়ে যাচ্ছে। কুমু আমার দিকে চোখ তুলে চাইল। তার দু-চোখ গর্তে ঢুকেছে, কালো হয়ে গেছে চোখের চারপাশ, মাথার চুল রুক্ষ, গায়ের শাড়িটা চিটচিটে ময়লা। …কুমুকে বললাম, ছেলে ফেলে রেখে ভাল করে চান করে আসতে। কুমু গ্রাহ্য করল না।
৫৬.
এই ভাবে নোংরা হয়ে তুমি কত দিন বসে আছ? কুমুকে চোয়াড়ের মতন শুধোলাম। কুমু জবাব দিল না।
৫৭.
তোমার ঘেন্না করে না, সারাদিন এই নোংরা কোলে নিয়ে বসে থাকতে, ঘেন্না করে না? আমি বেপরোয়া গলায় চিৎকার করে উঠলাম। কুমু চমকাল না, ভয় পেল না, জবাব দিল না।
৫৮.
ওই জন্তুটাকে মেরে ফেলল। ওটাকে কোলে পিঠে বুকে করে বয়ে বেড়িয়ে লাভ কী তোমার! সারা জীবন ওকে নিয়ে বাঁচতে পারবে না। কুমুকে ভাল কথাটা বোঝাতে গেলাম। কুমু বুঝল কি না কে জানে। ছেলেটাকে মাদুরে শুইয়ে লণ্ঠন ধরাতে গেল। ঘর অন্ধকার। ছেলেটা চৌকাঠের পাশেই শুয়ে ছিল। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হল চৌকাঠের পাশে অন্ধকারে আমার পা কেউ টেনে নিচ্ছে..ঠিক তখন লণ্ঠন হাতে কুমু এল। কুমুর হাতে লণ্ঠন, আমার ছায়াটা কেমন যেন দুলে নেচে ভেঙে ছোট্ট হয়ে ছেলেটার গায়ে পড়ল। লণ্ঠন নামিয়ে রেখে কুমু আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, আমি তার হাত ধরে ফেললাম। ঝটকা মেরে কাছে টানতেই লণ্ঠনের আলোটা আড়াল পড়ে গেল। আর অন্ধকার আচমকা এমন ভাবে কুমুর গায়ে মুখে ছড়িয়ে পড়ল যে আমার মনে হল, কুমুই আমার ছায়া হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মাঘের শীত হঠাৎ আমার গায়ে কনকনিয়ে উঠল, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।