২৪.
মুশাফিরখানায় সবাই তাল পাকিয়ে বাক্স পোঁটলা আগলে ঘুমোচ্ছ। জায়গাটা ঢাকা। বাইরের কনকনানি অতটা নেই। চায়ের দোকানে উনুনটা জ্বলছিল। মাথা কান বেঁধে কম্বলে গা ঢেকে একটা লোক দোকানের টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। …আমরা একটা কোণ বেছে নিয়ে বসলাম। কুমু তখনও কাঁপছিল। আমার গায়ের গরম চাদরটা তার গায়ে জড়িয়ে দিলাম।
২৫.
আগুন গরম চা। কুমুর জিব পুড়ে গেল। আমার খুব আরাম হচ্ছিল। ভোর হয়ে আসছে। বাইরে ফরসা যত বাড়ছিল ততই যেন মাঘের শীত কামড়ে ধরছিল। শীতে না ভয়ে–আমি কেন কাঁপছিলাম কে জানে। ঘুমন্ত লোকগুলো একে একে জেগে উঠছিল।
২৬.
রোদ উঠল। কুমুকে বললাম, আমরা ভুল করে অন্য গাড়িতে উঠেছিলাম। কাশীর গাড়িতে নয়। মাঝপথে টিকিটবাবুরা নামিয়ে দিয়েছে। …কুমু কিছু বলল না।
২৭.
মুশাফিরখানার বাইরে আসতে আমি চমকে উঠলাম। কাল শেষ রাতে শীতে আমি বুঝতে পারিনি, কোথায় এসে নেমেছি। এখন বুঝলাম। এই শহর আমার ছেলেবেলার শহর–এই শহরে চাঁপারানি ছিল, শ্যামলালবাবু ছিল, মুশাফিরখানায় চায়ের দোকানে পার্বতী ছিল। স্টেশনের ভেতরে বাইরে এত বদলে গেছে যে চেনার কোনও উপায় ছিল না। …কুমুকে বললাম এখানে একটা দিন থেকে যাই, কাল আবার কাশীর গাড়ি ধরব। …কুমু কিছু বলল না।
২৮.
শহরটা বদলে গেছে। চাঁপারানিদের বাড়ির সেই গলিটা আছে, বাড়ি নেই। কালাচাঁদের হোটেল কবে উঠে গেছে। চাবাবুর দোকানটা খুঁজে পেলাম না। মাড়োয়ারিদের ধর্মশালাটা ছিল। সেখানেই উঠলাম।
২৯.
ধর্মশালার ঘরটায় জানলা ছিল না। দরজাটা নড়বড়ে। রাত্রে মোমবাতি জ্বালিয়ে কুমুর মুখোমুখি বসেছিলাম। আজ আর কুমু কাঁপছিল না। বিছানার ওপর পায়ে লেপ চাপা দিয়ে বসেছিল। শালপাতার এঁটো ঠোঙা পড়ে আছে এক দিকে, জলের কুঁজোটার মুণ্ড ভেঙে গেছে। একটা পোকা ফর ফর করে উড়ছিল। কুমুর মুখের বসন্তের দাগগুলো চন্দনের শুকনো ফোঁটার মতন দেখাচ্ছিল। ওর হাতে সেই চুড়ি সেই হার। মাথায় খোঁপা ছিল না। …আমার মন খুশিতে আনন্দে ভরে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, কুমুর সঙ্গে আমার কত কাল আগে যেন বিয়ে হয়েছে।
৩০.
আমার কথা কুমুকে বললাম। কুমু শুনল। একটিবারের জন্যেও মুখ খুলল না। সব কথা বলা হয়ে গেলে আমার হঠাৎ মনে হল, কাশীর গাড়ি কাশীতে পৌঁছে গেছে। …কুমু আমার দিকে শেষ পর্যন্ত একটুক্ষণ চেয়ে ছিল। তার চোখ বলছিল, জানি, আমি সব জানি।
৩১.
লেপের তলায় কুমুকে আমি দু হাতে এমন করে জড়িয়ে শুয়েছিলাম যে এক সময় আমারই মনে হল, ওকে আমি আগলে রেখেছি প্রাণপণে। হয়তো কুমুর ব্যথা লাগছিল, তবু একটিবারও কুমু নড়ল না, আমার হাত সরিয়ে দিল না। মুখ ফুটে একটুও শব্দ বেরুল না ওর। ও যেন বোবা।
৩২.
কুমুকে আমার বোবাই মনে হত। আমার কোনও কাজে সে হাঁনা করত না। …বাজারের মধ্যে সেই চাঁপারানিদের গলির কাছাকাছি একটা এক-খুপরির বাসা ভাড়া করেছিলাম, সবজিবাজারে আলুর দোকান দিয়ে বসেছিলাম। কুমু কিছু বলত না। কুমু সারাদিন কাজ করত, ঘর ঝাঁট দিত, কয়লা ভাঙত, উনুন ধরাত, রান্না করত, বাসন মাজত আর রাত্রে বিছানা পাতত শোবার।
৩৩.
গরম পড়তে আলু পচতে শুরু করল। আমার বাসা-ঘরের মেঝেতে কুমু বস্তা থেকে আলু ঢেলে ছড়িয়ে রাখত, পচা আলু আলাদা করত। সমস্ত ঘরটা পচা আলুর গন্ধে ভেপসে থাকত। রাতে শুয়ে শুয়ে মনে হত আমি কুমু আমরাও একদিন পচে যাব।
৩৪.
একদিন কুমু ভীষণ বমি করতে শুরু করল। তারপর থেকে প্রায় রোজই খাওয়ার পর কুমু নর্দমার কাছে ছুটে যেতবমি করত।
৩৫.
কুমুর চেহারাটা বর্ষার জলে হঠাৎ কেমন সুন্দর হতে শুরু করল। মুখ ভরে গেল, গা ভরে গেল, পা হাত ফরসা হয়ে উঠল। কুমুর চোখের নীচে একটু কালি কালি দাগ ধরল, বুক পুরন্ত হয়ে উঠল।
৩৬.
পুজোর সময় কুমুকে সুন্দর শাড়ি জামা কিনে দিয়েছিলাম, ওকে নিয়ে ঠাকুর দেখিয়ে বেড়াতাম। বেশি হাঁটতে পারত না কুমু। ওর কষ্ট হত। মুখ ফুটে তবু বলত না।
৩৭.
একদিন বাজার থেকে দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি কুমু কার্তিকের রোদে দাওয়ায় বসে আছে। তার পায়ের কাছে পেটমোটা একটা বেড়াল। কুমুর পা আঁচড়াচ্ছিল বেড়ালটা। আমায় দেখে কুমু বেড়ালটাকে হাতে করে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কুমুর হাতে শাঁখা আর কাচের চুড়ি।
৩৮.
সবজিবাজারে আমার আলুর ব্যবসা ফেঁপে উঠছিল। আমি ভাবছিলাম বাজারে দোকান পেতে না বসে আলু চালান আর আড়ত নিয়ে বসবা…কুমুর পয়ে আমার ভাগ্য পালটে যাচ্ছে। কুমুর পেটে যে আসছে তার পয়ে। কুমুকে আমার আরও ভালবাসতে ইচ্ছে করত।
৩৯.
কুমু ভালবাসা বোঝে কি বোঝে না আমি ভেবে পেতাম না। ওর খুশি বলে কিছু দেখিনি, আহ্লাদ বলে মুখে কিছু ফুটত না। সমস্ত মুখটা কাঁচড়ার পুতুলের মতন। হাসি না, কান্না না, কথা না। বিন্দু বউদির কথা মনে হত: ও বড় চাপা মেয়ে, সহজে মন বোঝা যায় না; পাথর চাপা জলের মতন। …কুমুর মন আমি সত্যিই বুঝতে পারতাম না। মনে হত, ওর মন নেই; কিংবা মনটাও মুখের মতন বোবা।
৪০.
তখন পৌষ মাস। একদিন সকালে কুমু কাঁদছিল। ঘুম ভাঙলে উঠে বসে দেখলাম কুমু মুখে কাপড় পুরে কাঁদছে। তার মুখ যন্ত্রণায় নীলচে হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল ওর সমস্ত মুখটায় বুঝি এখুনি কালশিরে পড়ে যাবে। ..পাশের বাসার বউ বলল, প্রসব ব্যথা। আমি দাই ডাকতে লালাবাবুর কুঠির দিকে ছুটলাম। মন্দা দাই ছিল না। কে যেন বললে, কাঠগোলার দিকে দাই মাসি আছে, খুব ভাল, তাকে নিয়ে যাও।