১৪.
কুমু গিলটির চুড়ি হার পরত না। তার ভাঙা বাক্সে তুলে রেখে দিয়েছিল বোধহয়। তার হাতে কাচের লাল চুড়ি থাকত দুগাছা করে।
১৫.
দোকানটা সেবারে শীতের সময় বেচে দিলাম। বিন্দু বউদি শুনে বলল, আহা-হা করলে কী ঠাকুরপো, তোমার মাথায় কি ভূত চেপেছিল…দোকানটা বেচে দিলে? অনাদিদা ছেলেকে ভাঙা শ্লেটে অঙ্ক শেখাচ্ছিল, বলল, তোমরা ছেলে-ছোকরারা সব রকম ভেবেচিন্তে কাজ করো না। …বেশ তো, গয়নার দোকান চলছিল না–ওখানে একটা চুল কাটার সেলুন করলে পারতে। …কলকাতার অলিতে-গলিতে আজকাল নানান রকমের চুল কাটার সেলুন হচ্ছে, খুব চালু ব্যবসা…চুল না কেটে দাড়ি গোঁফ না কামিয়ে পুরুষ মানুষের চলে না। বিন্দু বউদি স্বামীকে ধমক দিয়ে বলল, অত বুদ্ধি তো নিজেই কেন চিঠির থলির সঙ্গে নাপিতদের মতন একটা বাক্স আর এক শিশি জল নিয়ে বেরোও না, তবু কিছু আয় হয়।
১৬.
কুমু কিছু বলল না। কলাইয়ের বাটিতে করে যখন চা দিচ্ছিল কুমু, তার চোখের দিকে ঠাওর করে চেয়ে থাকলাম। মনে হল, দোকানে হার পরার পর আমার কথা শুনে যে ভাবে চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিল, জানি–ঠিক সেই ভাবে যেন চোখ দিয়ে বলেছে, দোকান তুমি বেচে দেবে আমি জানি।
১৭.
বিন্দু বউদি দিন কয় পরে পরে একদিন শুধোল, কী করবে এবার তুমি, ঠাকুরপো? কী করব জানতাম না, আমি ভেবেও ঠিক করতে পারি না কিছু। বললাম, কলকাতায় আর থাকব না। বিন্দু বউদি আকাশ থেকে পড়ল যেন, অবাক হয়ে শুধোল, তোমার কি বাড়ি আছে? একটু বুঝি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তারপর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, আছে। বিন্দু বউদি শুধোল, কোথায়? …কোথায়? কোথায় আমার দেশ বাড়ি? কোন নামটা বলব? আমার ছোটবেলার শহরের নাম বলতে পারি, ময়না আমায় ঠাঁই দিয়েছিল যেখানে সেখানকার কথাও বলতে পারি, সেই শহরটার কথা, কলমিদের গাঁয়ের নাম, যশোদার বাড়ি ছিল যেখানে সেই জায়গাটার নাম আমি আরও অগুনতি নামের যে কোনও একটার কথা বলতে পারি। বিড়ি ধরাবার অছিলায় খানিকটা সময় নিয়ে বললাম, কাশী, কাশীতে মাথা গোঁজার মতন একটা জায়গা আছে। কথাটা বলে আমি এমন হাসি হাসি মুখ করলাম, যেন কত বিনয় করে বলেছি কথাটা। বিন্দু বউদির চোখের পলক পড়ছিল না। কাশী নামটা কানেই শুনেছে বউদি, দেখেনি কোনওদিন। আমি কাশীর লোক জেনে চোখ ভরে আমায় দেখল; শেষে মনভরা গলায় বলল, তোমার মা বাবা বুঝি কাশীতেই থাকেন? বিড়িতে জোর এক টান দিয়ে কাশতে কাশতে বললাম, হ্যাঁ, সবাই কাশীতে।
১৮.
আমারই দোকানের সেই পুরনো গিলটি গয়না কুমুর গলায় হাতে পরিয়ে দিয়ে বিন্দু বউদিরা আমার সঙ্গে কুমুর বিয়ে দিল। সেটা মাঘ মাস। বিয়ের দিন খুব শীত পড়েছিল। স্বর্ণর জন্যে তৈরি করানো লেপটা দিয়ে পরের দিন কুমুকে ঢেকে দিয়েছিলাম। লেপটা ময়লা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লাল শালুর ওপর পদ্মফুলের নকশাটা নষ্ট হয়ে যায়নি। স্বর্ণর শাড়ি কুমুকে দিয়েছিলাম। কুমু জানল ও শাড়ি তার জন্যেই আমি কিনে রেখেছি আগেভাগে। স্বর্ণর হারটা বেচে না দিলে কুমুকেই দিতাম। হারটা অনেক আগেই বেচা হয়ে গিয়েছিল।
১৯.
বিন্দু বউদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেদিন রেলগাড়িতে চাপলাম সেদিন বিন্দু বউদি বলেছিল, মেয়েটা বড় চাপা, ওর মন আর পাথরে চাপা জল দুইই সমান, একটু বুঝেসুঝে তোমার মনের মতন করে নিয়ো; তুমি যে স্বামী।
২০.
কাশীর ট্রেনে চেপে বসলেও আমি কাশী যাচ্ছিলাম না। কোথায় যাচ্ছিলাম, তাও জানি না। কুমু আমার পাশে চুপ করে বসেছিল। আমাদের পায়ের তলায় একটা বাক্স, মাথার ওপর পুঁটলি। বিছানাটা আধ খোলা করে বলেছিলাম দুজনে। রাত্রে গাড়ি ছেড়েছিল, মেল গাড়ি। বাইরে ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না। গাড়িটা সিটি মারতে মারতে হাওয়ার বেগে আমাদের কাশীতে নিয়ে যাচ্ছিল।
২১.
কুমু জানলায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ঘুমোচ্ছিল বোধহয়। আমার চোখে ঘুম ছিল না। কী করব, কোথায় গিয়ে নামব, কোনখানে গিয়ে উঠব কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। কুমু জানে সে তার স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে, কাশীতে। কী করে কমুকে সত্যি কথাটা বলব তাও ভেবে পাচ্ছিলাম না। কুমু আমায় ঠক ভাববে, কিন্তু কুমু তো বুঝবে না, ওদের না ঠকালে আমি কিছুতেই কুমুকে বিয়ে করতে পারতাম না।
২২.
কী একটা বড় স্টেশনে গাড়ি থামতে কুমুকে ঠেলা দিলাম। কুমু জেগে উঠল। শুধোলাম, চা খাবে? কুমু মাথা নাড়ল। খুরি করে চা নিয়ে কুমুকে দিলাম। ভয়ংকর শীত! চা খেতে খেতে সেই হলুদ আলোয় কুমুকে দেখছিলাম। গাড়িটা ঘুমিয়ে পড়েছে, অসাড় অসাড় ভাব। ছুটন্ত চাকার শব্দ মাঝে মাঝে বাতাসের চাবুকের মতন শোনাচ্ছিল। কে যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁপো রুগির মতন কাশছিল। একটা হিন্দুস্থানি বউ তার স্বামীর পায়ের কাছে পুঁটলির মতন পড়েছিল। থেকে থেকে তার স্বামীর পায়ের ঠেলা তার মাথায় মুখে নাকে লাগছিল, বউটা তবু ঘুমোচ্ছিল। …বিড়ি ধরিয়ে টানছিলাম আমি, বন্ধ জানলার কাঁচে জলের দাগের মতন কুমুর ছায়া দেখা যাচ্ছিল, ছায়াটা গাড়ির তালে তালে দুলছিল। মনে হচ্ছিল, কুমুর ছায়াটা কলকাতায় যাচ্ছে, কুমু কাশীতে।
২৩.
শেষরাতে হঠাৎ ঠেলে ঠুলে জাগিয়ে দিলাম কুমুকে। জিনিসপত্র টানাটানি করছি দেখে কুমু শুধোল, কাশী এসে গেছে? কোনও জবাব দিলাম না। কুমুকে নিয়ে নেমে পড়লাম। শীতের শেষরাতের স্টেশন, লোক প্রায় নেই। কনকনে ঠাণ্ডা। হাত পা মুখ জমে যাচ্ছিল শীতে। কুমুঠক ঠক করে কাঁপছিল।