০৭.
পরের দিন দুপুরে লোকটা এল না। বিকেল হয়ে গেল, আশা ছেড়ে দিলাম। অযথা কাল রাত পর্যন্ত বসে বসে বোকার মতন অচল গয়নাগুলোর পেছনে খেটেছি। অন্য কোথাও থেকে গয়নাগুলো সে কিনে নিয়েছে। লোকটার ওপর নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। পালিশ করা গয়নাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম আর পায়ের শব্দ গুণছিলাম নোকটার, যদি আসে–এসে পড়ে…..
০৮.
লোকটা আর এল না। অথচ ওই রকম বিকেল-ভাঙো-ভাঙো মুখে পরের দিন এক জোড়া মেয়ে দোকানে এসে উঠল। আমার দোকানে তখনও বাতি জ্বলেনি। বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম। একটি মেয়ের মাথায় ঘোমটা ছিল, সিঁথিতে সিঁদুর ছিল, হাতে শাঁখা, ব্রোঞ্জের পাতলা কলঙ্ক-ওঠা দুগাছা করে চুড়ি, গলায় গিলটির হার। অন্য মেয়েটির গলা খালি, হাতে কাচের লাল চুড়ি কগাছা করে, মাথার বাঁ পাশ ঘেঁষে সাদা সিঁথি। মেয়েটা লাজুক, নিরীহ, তার ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। …বউ মেয়েটি গয়না দেখতে চাইল। আইবুড়ো মেয়েটি মাঝে মাঝে আয়নার দিকে তাকাচ্ছিল আর আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে ঘাড় ঘোরাচ্ছিল। ..সদ্য সদ্য পালিশ-তোলা গয়নাগুলো ওদের সামনে ধরে দিলাম। বউ মেয়েটির চোখে লেগে গেল। সঙ্গের মেয়েটির গলায় হারটা পরিয়ে দিয়ে পরখ করে দেখতে লাগল। আমার দিকে ফিরে আচমকা শুধোল, মানিয়েছেনা? আমি দোকানদার, আমার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলা উচিত ছিল, চমৎকার মানিয়েছে; কিন্তু বলতে গিয়েও কথাটা মুখে এল না। মেয়েটির গলা সরু, লম্বা ধরনের অথচ হাড়গিলে নয়, নিটোল; বুকটা রোগাটে হলেও কলাপাতার মতন ছড়ানো। হারটা ওর গলায় ঠিক মানাচ্ছিল না। আমি মাথা নাড়লাম, নিজের লোকসানের কথাটা খচখচ করে উঠছিল, তবু মাথা নেড়ে বললাম, হারটা মানায়নি৷…বউ মেয়েটি যেন আমার সঙ্গে তামাশা করে বলল, যা মানাবে তবে তাই একটা দেখি। .দেখানোর মতন হার আমার দোকানে ছিল না, দোকানের আর সব গয়নাই ম্যাড়ম্যাড় করছে। যে-হারের জলুস নেই সে-হার দেখিয়ে কী করব। …হার বেচার আশা ছেড়ে দিয়ে আমি পালিশ তোলা চুড়িগুলো ওদের দিকে ঠেলে দিলাম। বউ মেয়েটি চুড়ির গোছ মুঠোয় তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল; দেখতে দেখতেই বলল, এ ওর হাতে বড় হবে…দেখ তো, কুমু… মেয়েটির দিকে চুড়ি ঠেলে দিয়ে ও আমার দিকে তাকাল, কই হার কই? ..খোলাখুলি বলতে হল অগত্যা:হার আছে, তবেনষ্ট হয়ে আছে, ভাল লাগবে না দেখতে। …বউ মেয়েটি ঠেটি কেটে হাসল, বলল, হিরে জহরত গিনি সোনার দোকানে এসেছি নাকি, গিলটির আবার ভাল মন্দ, দেখি কী আছে। কুমু চুড়ি দেখছিল, অল্প একটু চোখ তুলে আমায় দেখল।
০৯.
চুড়ির গোছ নিয়ে গেল ওরা। দর দাম করে ছটাকার এক পয়সা বেশি দিল না। পরের দিন হার নিতে আসবে বলে চলে গেল। আমি কথা দিয়েছিলাম পরের দিন কুমুর গলার মানানসই হার এনে রেখে দেব।
১০.
সেই লোকটার মতন কুমুও আসবে না জানতাম। তবু ওর জন্যে হার বেছে পালিশ তুলে রেখেছিলাম। কুমু এল। একা। হারটা ওকে মানিয়েছিল খুব। আয়নায় নিজের গলা দেখে কুমুর চোখে খুশির ফুল ফুটল। ওর সরল সহজ খুশি দেখে আমার মন খুঁত খুঁত করছিল। হারের জলুসটা কদিন পরেই চলে যাবে, তখন তো কুমু হাসবে না। বলি কি নাবলি করে শেষ পর্যন্ত বললাম, পালিশটা বেশি দিন থাকবে না…। কুমু চোখ ফিরিয়ে তাকাল। তার চোখের পাতা ক্ষণে ক্ষণে পড়ে। ছোট ছোট নরম চোখ, যেন ভাল করে তাকাতে কষ্ট পায়। কুমু গলার কাছে হাত তুলে হার ছুঁল, একটু মাথা হেলিয়ে বলল, জানি; আমি বেশি পরব না।
১১.
কুমুর পুরো নাম কুমুদিনী। বউ মেয়েটি ওর বউদি, নাম বিন্দু। সরখেল লেনের গলিতে ওরা থাকে। বাইশ নম্বর বাড়ি। বাড়িটা বোধহয় এক সময় আস্তাবল ছিল। এখন দু পরিবারের। দালানে পুরু শ্যাওলা আর আস্তাকুঁড়। ঘরের ভেতর বাইরে শুধু খামচা খামচা ইট, কালচে রং ধরে গেছে। কুমুদের কুঠরিটা দক্ষিণ কোণে। ঘরের সামনে আধভাঙা একটা কড়িকাঠ মাথার ওপর ঝুলে রয়েছে। কুমুর দাদা অনাদিবাবু পোস্টাফিসে পিয়নের চাকরি করে। বিন্দু ঘরে বসে ডজন দরে বাচ্চাদের ইজের কেটে দেয় দরজিদের। বিন্দুর নিজের দুটো বাচ্চা।
১২.
ওবাড়ির সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল। বিন্দু বউদি ঠোঁটকাটা কিন্তু বেশ রগুড়ে মানুষ। আমায় বলত, দোকানি ঠাকুরপো৷ বিন্দু বউদিরা ভদ্র ভাল-ঘরের মেয়ে ছিল, অবস্থা পড়ে পড়ে যখন ভিখিরি তখন অনাদিদার সঙ্গে বিয়ে হয়। বিন্দু বউদি বলত, আমার মাথার ওপর চার বোন, বাবা বড় দুজনকে তবু সোনা ছুঁইয়ে বিয়ে দিতে পেরেছিল, আমাদের দুজনের বেলায় শুধু শাঁখা, নয়তো পোস্টাফিসের পিয়নকে বিয়ে করতে বয়ে গেছল আমার! .অনাদিদা কথাগুলো শুনত, মনে হত মনে মনে হাসছে। কিন্তু মুখে একদিনও এক চিলতে হাসি ফুটতে দেখিনি। অনাদিদা বড় ভালমানুষ, বড় ভাল।
১৩.
বিন্দু বউদির মুখেই শুনেছিলুম, কুমুর এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, অনাদিদার চেনাশোনা ছেলে, পোস্টাফিসের লাল গাড়ি চালাত। বিয়ে করব বলে মত দিয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসল, মেয়ের মুখে অত খাবলা খাবলা গর্ত, বাড়িতে মত হচ্ছে না। বিন্দু বউদি বলেছিল, বিয়ে লাগবে বলেই না তোমার দোকানে গিয়েছিলাম গো, দোকানি ঠাকুরপো, ওই একটু গলা হাত সাজিয়ে ননদ পার করব, তা সে ভাগ্যে হল না। ..কথাটা শুনে আমি মনমরা হয়ে গিয়েছিলাম।