৩৭.
একদিন আমার গিলটি সোনার দোকানের আয়নায় মাঝদুপুরে যশোদার ছায়া পড়ল। আমি চমকে উঠেছিলাম। মরা মানুষ জ্যান্ত হয় না। কোনও নকল যশোদা এসেছিল–হাত ভরে মিছরি-তোলা চুড়ি পরে চলে গেল। আমি বাজিয়ে বাজিয়ে টাকাগুলো গুণে নেবার সময় বুঝতে পেরেছিলাম আসল-নকল বোঝার ক্ষমতা আমার হয়ে গেছে।
৩৮.
শীত পড়তে স্বর্ণদের বস্তি ছেড়ে আমি উঠে এলাম। দরজিপাড়ার দিকে একখানা ঘর ভাড়া করে বাসা বাঁধলাম। জাম কাঠের তক্তপোশ, নতুন বিছানা, একটা চেয়ার, দেওয়াল-গাঁথা আলনা। স্বর্ণর জন্যে শাড়ি কিনে রাখলাম, চুল বাঁধার আয়না, নিমফলের নকশা করা ভরি দেড়েকের হার। চিনে সিঁদুরও কিনেছিলাম এক পাতা।
৩৯.
পৌষ মাসে স্বর্ণ তার বাবার সঙ্গে দেশে গেল, বারাসতে। বিয়ের আগে দেশ বাড়ি ঘুরে আসতে গেল একবার। মাঘের প্রথমে বিয়ে। স্বর্ণর জন্যে নতুন তুলোর সুন্দর এক লেপ করিয়ে রাখলাম। ওপরের কাপড়টায় মস্ত এক পদ্ম; যেন লাল শালুর পুকুরে পদ্মটা পুরোপুরি ফুটে উঠেছে। আমার মনে হত, পদ্মটা স্বর্ণর মুখ।
৪০.
মাঘ মাস পড়ল। স্বর্ণদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই স্বর্ণর বাবা বলল, এই যে ফটিক, তুমি এসেছ। এসো, ঘরে এসে বসো। ঘরে কোথাও স্বর্ণ ছিল না। স্বর্ণর একটা শাড়ি সায়া মাথার চুলের ফিতে কিচ্ছু । ঘরটা খাঁ খাঁ করছিল। স্বর্ণর বাবা নীলকণ্ঠের দোকান থেকে ছোট ছোট গ্লাসে দু গ্লাস চা নিয়ে এল। আমার দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কড়া শীত হে, নাও গরম গরম খেয়ে নাও। ..স্বর্ণর বাবা বুঝতে পারছিল না, আমার শরীর তার মতন বুড়ো হয়ে যায়নি, আমার রক্ত এই মাঘের শীত পাবে বলে কতদিন ধরে ভেতরে ভেতরে নিজেকে গরম করে নিয়েছে। স্বর্ণর বাবা বুঝতে পারছিল না, আমার তেষ্টা নীলকণ্ঠর দুর্গন্ধ চায়ে মিটবে না। সব তেষ্টা এক রকম নয়।
৪১.
স্বর্ণকে তার বাবা খাঁটি সোনার দোকানের মালিকের হাতেই তুলে গিয়েছে। স্বর্ণ জানে, খাঁটি সোনার মালিক গিলটি সোনার মালিকের চেয়ে অনেক বেশি ভদ্রলোক।
৪২.
সেদিন ভীষণ শীতে পদ্ম আঁকা সেই নরম নতুন তুলোর মধ্যে শুয়ে শুয়ে আমি কারখানা ঘরের ন্যাংটা মেয়েটার কথাই ভাবছিলাম। এই জগৎটাই আজব, পাথর আর মানুষের ধড়ের মধ্যে তফাতটা গায়ে গায়ে, তলায় তলায় নয়। লেপের শালুর পুকুরে ডুবে যেতে যেতে আমার মনে হল, স্বর্ণর চেয়েও সুন্দর মেয়েছেলে বেশ্যাপাড়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো স্বর্ণকেই পাওয়া যেতে পারে। …আমি লেপ ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসতে গেলাম। পারলাম না। আমার জ্বর এসেছে। সেই অদ্ভুত পুরনো জ্বর।
.
সাত
০১.
সেবারে শীত ভাঙতে তর সইল না। ফাল্গুন মাসেই রোদ ভীষণ চড়ে উঠল, গরম পড়ল হাঁসফাঁসিয়ে। আমার বাড়ির সামনে হাড়গিলে নোংরা রাস্তাটা চওড়া করা হচ্ছিল। নুড়ি পাথরের ঢিবি জমল চারপাশে, বাতাসে আলকাতরার পোড়া পোড়া গন্ধ, রোলার গাড়ির দশ বিশ মণি পাথরটা সব কিছু পিষে ফেলছে। মরা শুকনো নুলো গাছটাকে ওরা কুপিয়ে কাটল, রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলল।
করপোরেশনের মালটানা লরির ওপর চাপিয়ে যখন পাচার করছে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মরা কোপানো গাছটার সব চেয়ে পলকা ছোট ভোঁতা ডালে দুটি সবুজ কচি পাতা। খোলা লরিটা চলে যাচ্ছিল, ধড়কাটা মরা গাছটার একটা ডাল মাটিতে লুটিয়ে ঘষটে ঘষটে যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে; মনে হচ্ছিল, বুড়ো কঙ্কালসার একটা হাত বাড়িয়ে গাছটা যেন তার পুরনো মাটি আঁকড়ে থাকতে চাইছে প্রাণপণে। কচি সবুজ দুটি পাতার দিকে চেয়ে চেয়ে আমি ভাবছিলাম, গাছটা মরতে চায়নি, অনেক কষ্ট করে অনেক দিন ধরে ওর মরা গায়ে দুটি নতুন পাতা জাগিয়েছিল। কেউ দেখল না।
০২.
গিলটি সোনার দোকানটা বেচতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বেচা হল না। আরও ছটা মাস নকল সোনার কারবার চলল। আস্তে আস্তে আবার মন কখন মুষড়ে পড়ল। কিছু আর ভাল লাগত না, না দোকান না বাসা। কলকাতা শহর আমার ভেতরটা ফাঁপা ভোঁতা করে দিয়েছিল। আমি অন্য কোথাও পালিয়ে যাবার কথা ভাবতাম, কোনও ছোটখাটো মফস্বল শহর কিংবা গাঁ-গ্রামে।
০৩.
একদিন আমি মাঠ, গাছ আর নদীর স্বপ্ন দেখলাম। সে মাঠের শেষ ছিল না, মাঠের পর মাঠ, ধু ধু করছে। কখন যেন সেই মাঠও ফুরিয়ে গেল, তখন শুধু গাছ। কী গাছ কে জানে! গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়েছিল, একটা পাতাও কোথাও কাঁপছিল না। সব কেমন চুপচাপ। তারপর গাছও সরে গেল, তখন নদী। নদী ভরা জল। কল কল করে শুধু জল বইছে।
০৪.
আমার বাসাবাড়ির উলটো দিকে এক অন্ধ ছোকরা থাকত। একদিন মাঝরাতে লোকটা পাগল হয়ে গেল। পাগল হয়ে যাবার আগে সে বারান্দায় এসেভীষণ চেঁচামেচি শুরু করেছিল। আমি তার চেঁচানি শুনেছি। লোকটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে দিচ্ছিল আর বলছিল, তার চোখ খুলে গেছে, সে দেখতে পাচ্ছে।
০৫.
দোকানটা বেচার জন্যে আমি মরীয়া হয়ে উঠেছিলাম। খদ্দের জুটছিল না। একদিন চালু দোকানটার দিকে অনেকেই চোখ দিত, এখন আর কেউ ফিরে তাকায় না। গিলটি সোনার দোকান পুরনো হয়ে বুঝি আসল চেহারা নিয়েছিল: ভাঙা আয়না, কাঁচ-ফাটা শো-কেস, পা-মচকানো চেয়ার, ধুলো-সমস্ত দোকানটাই ম্যাড়ম্যাড় করত। খদ্দের আর বড় একটা আসত না।
০৬.
সেদিন সন্ধের ঝোঁকে এক খদ্দের এসে হাজির। আমার দোকানে ঝকঝকে গয়না একটাও ছিল না। সময়ে পেলে ম্যাড়ম্যাড়ে কালচে গয়নাগুলোতে পালিশ তুলে দিতে পারতাম। লোকটা বসতেও চায় না। বিশ পঁচিশ টাকার বেচা-কেনা বরবাদ হয়ে যায় দেখে আমি বললাম, বাড়ির ঠিকানা দিলে কাল ভোরে পৌঁছে দেব। কী ভেবে লোকটা হঠাৎ বলল, কাল সে আসবে, দুপুরে। …পুরো এক সেট মেয়েদের গয়না বেছে দিয়ে লোকটা চলে গেল। বারোগাছা চুড়ি, হার, আঁটি আর পালিশের মাল মশলা নিয়ে আমি বসে পড়লাম।