২৬.
গেঞ্জিকলের মালিক খাঁ বাবুর শালার সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা ছিল না। একদিন লোকটা কারখানায় এসে কী কথায় যেন হাসতে শুরু করল। আমার দিকে চেয়েই হাসছিল। আমার ভাল লাগছিল না। রাগ হচ্ছিল, ঘেন্না হচ্ছিল। খাঁ বাবুর শালার বাঁধানো দাঁতের পাটি হাসির তোড়ে খুলে গেল। সমস্ত মুখটা হঠাৎ যেন চুপসে গেল লোকটার, গাল ভেঙে গেল। শেয়ালের মতন দেখাচ্ছিল ওকে। দাঁতের পাটি কুড়িয়ে নেবার সময় খাঁ বাবুর শালার ভুড়ি থেকে কাপড়টা আলগা হয়ে খসে গেল। লোকটা নকল দাঁত, খোলা পাছা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কী জানি কেন, লোকটাকে আমার মারতে ইচ্ছে করছিল। কাপড় সামলে উঠেও যদি আবার কষে হাসতে শুরু করত, আমি ঠিক ওকে মারতাম। মাথায় তখন রক্ত চড়ে গিয়েছিল আমার। খাঁ বাবুর শালা আর হাসল না। দাঁতের নকল পাটি মুখে ফেলে চলে গেল। পরে শুনলাম, লোকটা ওইরকমই। কাঁদার সময় ও হাসে,কাঁদতে পারেনা; কান্নাটাই ওর হাসি। …কে জানে কেন, খাঁ বাবুর শালা আমার দিকে চেয়ে চেয়ে কাঁদছিল। হয়তো আমাকে দেখে, হয়তো আমায় কিছু মনে করিয়ে দিতে।
২৭.
সেদিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমিও কেঁদেছিলাম। নিজের চোখের নোনতা জল জিব দিয়ে চেটেছি। বালিশ থেকে মরা মরা গন্ধ উঠছিল। ঘরের মধ্যে অন্ধকারে ইঁদুর ছুটছিল, মুড়ির ঠোঁঙাটা ফুটো হয়ে গেছে বোধহয়। সেই অন্ধকারে কে যেন আমার দিকে চেয়েছিল। হয়তো যশোদা, হয়তো…। ভোররাতে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম না; মনে হল সারারাতের অন্ধকার বস্তির খোলার চালে নিংড়ে দিয়ে আকাশ এবার শুকোতে যাবে। কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। বস্তির নখানা ঘরের দরজা আঁট হয়েছিল। …কয়েক পা এগিয়ে এসেছি কি উত্তর দিকের ঘর খুলে গেল। শব্দ শুনলাম। কাঠের খিল খুলে কে যেন বাইরে এসেছে। চিনতে পারছিলাম না।
২৮.
সদর থেকে পা টিপে টিপে ফিরলাম। খোলা দালানে সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওর শাড়ির আঁচল কাঁধের ওপর আলগা হয়ে ঝুলে ছিল, মস্ত গোল খোঁপাটা ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়েছে, পিঠের দিকটা যেন কলাগাছের পাতার মতন বাঁকা। আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে ও হয়তো সকাল বুঝতে চাইছিল। কাক তখন ডেকে উঠেছে। ভোরের ফরসা পা বাড়িয়েছে দালানে। …আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ও আমায় ডাকল। হাত নেড়ে নয়, ডাক দিয়ে নয়, আমার দিকে ফিরে চেয়ে। ওর দুটি চোখ ঠিক যেন ভোরবেলার ঘুমভাঙা এক জোড়া পাখির মতন আমার গায়ে উড়ে এসে বসল। পা-পা করে আমি এগিয়ে গেলাম। কাছে এসে মনে হল, ওর মুখ প্রতিমার চেয়েও সুন্দর, ওর শরীর পেঁজা তুলোর মতো নরম, শিশির ভেজা মাঠের মতন ওর গা থেকে মাটির গন্ধ আসছে। আমি ওকে ছুঁতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই সকালের আলো এসে বস্তির দাওয়া ভরে গেল। আমার মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে আরও কিছু আসবে। মাথার ওপর চোখ তুলে একটুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, মুখ নামিয়ে দেখি, ও চলে গেছে, দাওয়া ফাঁকা।
২৯.
গেঞ্জিকলে সেদিন অযথা ঝগড়া করলাম। কোনও কারণ ছিল না; অযথাই। গেঞ্জিকলের ঘর, কল, কাঠিম, মানুষ জন সবই আমার অসহ্য লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই কারখানার মানুষগুলোকে খেলো রদ্দি সাইজ-মাপা গেঞ্জি করে তোলা হয়। এরা সবাই হাত পা মাথা কাটা ধড়।
৩০.
সেদিন রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম: চারপাশে শুধু গেঞ্জি উড়ছে। মেঘের তলায় এক ফোঁটা জায়গা নেই। ছোট বড় মাঝারি ঢাউস গেঞ্জিতে আকাশ ভরে গেছে।
৩১.
স্বর্ণকে আমি বলেছিলাম, শশিবাবুর কাছে সাকরেদিকরলে আমি থিয়েটারের সিন আঁকতে পারব। স্বর্ণ মাথা নেড়ে বলেছিল, না; তুমি অন্য কিছু করো। .শশিবাবুর ঠিকানা আমি জানতাম না, তবু বলেছিলাম।
৩২.
খুব গরম তখন। স্বর্ণকে বললাম, আমি ঠেলাগাড়ি করে আইসক্রিম বিক্রি করার কাজ পেতে পারি। স্বর্ণ মাথা নাড়ল, বলল, ছিঃ! আইসক্রিম বিক্রি করার ঠেলাগাড়ি কোথায় পাওয়া যায় আমি জানতাম না, তবু স্বর্ণকে বলেছিলাম।
৩৩.
বর্ষা এল। স্বর্ণ বলল, এত লোক এত কাজ পাচ্ছে, তুমি পাচ্ছ না! …আমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে নুটবিহারী সাধুখাঁর ভেজাল তেল আর হুঁকোর তামাকের আড়তে কাজ করছিলাম স্বর্ণ জানত না।
৩৪.
পুজোর আগে আগে স্বর্ণকে বললাম, অঘ্রান মাসের পর আর দেরি সইব না। স্বর্ণ মুখ নিচু করে হাসল। বলল, বিয়ের কথা কেউ কি জোর করে বলতে পারে। কপালে থাকলে অঘ্রানেই হবে।
৩৫.
পুজোর পর সত্যিই আমি কিছু আখের গুছিয়ে নিয়েছিলাম। নুটবিহারী সাধুখাঁর ভেজাল আমার উপকার করেছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আড়তের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতাম। আমার সমস্ত শরীরে তেল ধরে গিয়েছিল, তামাক ঘেঁটে ঘেঁটে হাত কালো হয়ে গিয়েছিল। মালিক আমায় ভীষণ বিশ্বস্ত কর্মচারী মনে করত। আমি পেছোনো কালো হাত দিয়ে আমার মজুরি তুলে নিলাম।
৩৬.
গিলটি সোনার বাহারি দোকান দিয়ে বসলাম খাসা জায়গায়, একবারে মোড়ে। আমার দোকানের চারদিকে চারটে রাস্তা চলে গিয়েছিল। উত্তরে গরিব গেরস্থ পাড়া, পুবে বেশ্যাপটি, দক্ষিণে হিন্দুস্থানি আর উড়ে ঝি-চাকরদের মহল্লা। পশ্চিমের রাস্তাটা বাবুপাড়ার অন্দর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। …গিলটি গহনার দোকানে বসে আমি ভদ্রলোক হয়ে গিয়েছিলাম। কাশীর হোটেলের গাইডগিরি করার সময়ও এতটা ভদ্রলোক ছিলাম না। স্বর্ণ খুব খুশি হয়েছিল। স্বর্ণ ভদ্রলোক হওয়া ভালবাসত, তার বড় সাধ ছিল ভদ্রলোককে বিয়ে করবে।