১৩.
সুহাসিনীর বিয়ের দিন আমি ওকে অনেক বার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি। মেয়েটা তার সব নোংরা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছিল। ওকে লাজুক খুশি সুন্দর দেখাচ্ছিল। সিঁথিতে সিঁদুর ওঠার পর সুহাসিনীর মুখ একরাত্রে ফুটে উঠল। সকালে উঠে আমি অবাক হয়ে সেই ফোঁটা ফুল দেখলাম।
১৪.
শশিবাবু কিছুদিন ধরে একটা ভাঙা মন্দির আঁকছেন। মন্দিরের পাশে গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে গাছ-গাছালি। অন্ধকার থম থম করছে।
১৫.
ম্যানেজার বুড়ো একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পা পিছলে পড়ে গেল। শেষ সিঁড়িতে তার মাথা, ডান পায়ের খড়মটা অনেকগুলো ধাপ উঁচুতে একপাশে পড়ে আছে। হাতের বাটি থেকে ভাতের দানা দালানে ছড়িয়ে পড়েছে। হই-হট্টগোলের মধ্যেও একটা কাক, কয়েকটা চড়ুই, এক জোড়া পায়রা দালানে উড়ে এসে ভাতের দানা খুঁটে খাচ্ছিল। ন্যাংটো মূর্তিটার পেটের তলায় এক খাবলা ছায়া, পিঠ মাথা হাত রোদে পড়ছে।
১৬.
এমন মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি। নকশা করা পালংকে শুয়ে ছিল। পালঙ্কটা শশিবাবুর আঁকা পুরনো ভাঙা মন্দিরের মতন দেখাচ্ছিল। মেয়েটির বাড়ন নেই, পায়ের দিকটা বেঁটে বেঁটে, বুকের দিক ভীষণ পুরুষ্ট, মাথাটা মোটা মোটা। মুখ গোল। তবু কেমন কচি কচি দেখায়। ডান চোখের তলায় মস্ত এক তিল। গায়ের রং ফরসা, খুব ফরসা। ম্যানেজার বুড়োর কাঠ শরীরটা দেখে ও শুধু কাঁদল, অন্ধের মতন দুটি হাত দিয়ে বাতাস হাতড়াল, উঠতে পারল না বসতে পারল না, কান্নাটা যেন শোওয়া শরীরে তেমন করে উথলে উঠতে না পেরে মরে গেল।
১৭.
ম্যানেজার বুড়োর নাতনি উঠতে বসতে দাঁড়াতে হাঁটতে পারে না। হাত দুটো নৌকোর দাঁড়ের মতন নড়াতে চড়াতে পারে, আলগা করে মুঠো করতে পারে আঙুল। আর পারে কথা বলতে। ওর নাম রাজলক্ষ্মী।
১৮.
শশিবাবুই ফ্যাসাদে পড়েছিলেন। ম্যানেজার বুড়ো মরার পর রাজলক্ষ্মীকে দেখাশোনা করার ভার যেন আপনা থেকেই তাঁর ঘাড়ে পড়ল। শশিবাবু বলতেন, আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লুম তো, এখন এই পুতুলটাকে নিয়ে আমি করি কী! শশিবাবু একটা ঝি রেখে দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক পরে ঝি পালাল। শশিবাবু আর-একটাকে ঠিক করে নিয়ে এলেন। পরের দিন সেও পালাল। শশিবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, পুরুষ মানুষ হলে আমিই না হয় সামলে দিতাম, কিন্তু মেয়েছেলেকে। চান করানো কাপড় ছাড়ানো…এটা ওটা, আমিই বা করি কী করে!
১৯.
আমাদের বস্তি থেকে আমি এক বিধবা বুড়িকে এনে দিয়েছিলাম। বুড়ি আমায় বলল, দিনের বেলা তবু কাটে, রাতে থাকতে পারি না গো। ভয় লাগে। থ্যাঁতলানো টিকটিকির মতন মেয়েটা যখন বুক পেট ঘষড়ে বিছানায় উঠে বসতে যায়, পারে না…মাগো, সে কী দেখায় তখন। চোখে দেখা যায় না। এ কাজ পারবনি করতে।
২০.
কেষ্টপদ একদিন হেসে হেসে আমায় বলল, আরে তুমিই তো আছ, বিয়ে করে ফেলো না মেয়েটাকে। পাথরের ন্যাংটো চেহারা দেখার চেয়ে এতে অনেক আরাম পাবে। …হাজার হোক মানুষের ধড়টা তো আছে রে, বাবা!
২১.
কেষ্টপদর হাসি আমার ভাল লাগেনি, তার কথা শুনে লোকটাকে চামার বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমি রাজলক্ষ্মীকে বিয়ের কথা ভাবছিলাম। কালো আলপাকার মতন অন্ধকারে চোখ খুলেও সব কিছু ভাবা যায়। ভাবতে ভাবতে আমার মনে হল, পাথরের মূর্তি আর রাজলক্ষ্মীর ধড়ের মধ্যে কোনও তফাত নেই। সুহাসিনীর মত বউ হতে ওরা পারে না।
২২.
একদিন রাজলক্ষ্মীকে কে যে হঠাৎ নিয়ে চলে গেল! কেষ্টপদ বলল, হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখানেই রেখে দেবে। খাওয়াবে দু-বেলা আর কাটা-ছেঁড়া করবে। …জ্যোতিষী বলল, বয়ে গেছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে…এ সব কার কীর্তি আমি জানি। বেওয়ারিশ মাল, ভাঙা ফুটো যাই হোক হাতের মুঠোয় পেলে কে ছাড়ে রে, বাবা!
২৩.
শশিবাবু এ বাড়িতে আর আসতেন না। শুনলাম, থিয়েটারের সিন আঁকার জন্যে নতুন বাড়ি নিয়েছেন। …আমি মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম, শশিবাবুর আঁকা ভাঙা মন্দিরের মধ্যে একটা মূর্তি হাসি মুখে শুয়ে আছে। মুখটা দেখতে পেতাম না। তবু মনে হত, মুখ আছে, মূর্তি আছে…কারখানা বাড়ির সামনে ন্যাংটো মেয়ের মূর্তিটা আমরা সবাই দেখতে পাই, শশিবাবুর মন্দিরের মধ্যে মূর্তিটাকে দেখতে পাই না।
২৪.
গেঞ্জিল আর আমার ভাল লাগত না। মনে হত, আমার সমস্ত জীবন কাঠিমের সুতোর মতন একঘেয়ে হয়ে এসেছে। আমি ফুরিয়ে এসেছি। সেই কোন সকাল থেকে হেঁটে হেঁটে এখন আমার পা ধরে এসেছে, শরীর ক্লান্ত, আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। থিতিয়ে বসার জন্যে সর্বাঙ্গ ভেঙে যাচ্ছে। বস্তিঘরের ভাঙা খাঁটিয়া চিটচিটে বালিশ একটা লণ্ঠন আর নিজের শরীরের বিশ্রী গন্ধ ছাড়া আমার আর কিছু নেই। …একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে নিজের বুকের ব্যথাটার কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার পাশে কথা শোনার মতন কেউ ছিল না; আর-একদিন বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট থেকে উঠে আসার সময় আকাশ উতলা করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল, আমি বিহ্বল হয়ে চাঁদ দেখবার জন্যে আঙুল তুলে বুঝতে পারলাম, আমার পাশে এমন কেউ নেই যে আমার আঙুলে ভোলা চাঁদ দেখবে।
২৫.
আমাদের ভোলা মুদির দোকানে একটা খাঁচা ঝুলত। খাঁচার মধ্যে মস্ত এক টিয়াপাখি। ভোলার বউ ছেলে বিয়োতে গিয়ে মরে যাবার পর ভোলা একদিন সকাল থেকে পাখিটাকে খোঁচাতে লাগল। সারাটা দিন খোঁচাল। সন্ধের আগে পাখিটা মরে গেল।