০৪.
গেঞ্জিকলের কাঠিমগুলো সুতো ছাড়ত আর কলগুলো গেঞ্জি বুনত। মাঝে মাঝে আমার মনে হত, আমরা সবাই কাঠিম হয়ে গেছি।
০৫.
একদিন ছাপাখানার কেষ্টপদ দোতলার জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখিয়ে এসে বলল, দুমাসের মধ্যে তার বিয়ে হবে। আমি ঘুরন্ত কাঠিমগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলাম, কেষ্টপদ বিয়ে করতে যাবার সময় একটা জালি গেঞ্জি পরবে। হয়তো এই কারখানার গেঞ্জি।
০৬.
কারখানার ছুটি হয়ে গেলে একদিন আমি আস্তে আস্তে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। জ্যোতিষীর ঘরের সামনে শশিবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারাটা বারান্দা জুড়ে একটা থিয়েটারের আঁকা সিন মাটিতে মেলা ছিল। আকাশের চাঁদ, কটা পাখি, গাছের ডাল-পালা শশিবাবুর পায়ের তলায়। ফুরোন বিকেলের আলো দিয়ে যেন আকাশ চাঁদ গাছ পাখির গায় পালিশ তুলে নিচ্ছিলেন শশিবাবু। …তাঁর উলটো দিকে দুই বাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি অতটা খেয়াল করিনি। পাঁচ টাকায় শশিবাবু অতটা আকাশ অমন গোল চাঁদ গাছ পাখি সব বাবুদের ভাড়া দিয়েছিলেন এক রাত্রের জন্যে। …আমার কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছিল, একদিন পাঁচ টাকা দিয়ে আমিও অতটা আকাশ অমন বাতাস ভাড়া করব।
০৭.
ছাপাখানার কেষ্টপদ সোনালি প্রজাপতি আঁকা কবিতা ছাপিয়ে বিয়ে করল। তার বউয়ের নাম চাঁপা। আমার বার বার চাঁপারানির কথা মনে পড়ছিল। চাঁপারানি এতদিনে বুড়ি হয়ে গেছে। মানুষ শুধু বুড়ো হয়। একদিন আমিও হয়ে যাব। এখনই নিজেকে কত পুরনো লাগে। রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমি আমার শরীরের চারপাশে গন্ধ পাই। কারখানার পুরনো বাড়িটার গায়ে যেমন গন্ধ, অনেকটা যেন ওই রকম, নোনা, ভ্যাপসা, ধুলো ধুলো। গন্ধটা আমার মন মেজাজ খারাপ করে দেয়। আনমনা হয়ে থাকি। কখনও কখনও অসহ্য লাগে; মনে হয় চৌবাচ্চার কতকালের বাসি জলের মতো আমার শরীরের রক্তেও বাসি গন্ধ ধরেছে, পোকা হয়েছে, মশা উড়ছে। আর হাড়গুলো মরা গাছের ডালের মতন শুকনো।
০৮.
একদিন স্বপ্ন দেখলুম: শশিবাবু চুনের বালতি আর পাটের পোচড়া নিয়ে আমার কাছে এসেছেন। থিয়েটারের পুরনো রং উঠে যাওয়া পট যেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, আমায় তেমন করে দেখছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমাকে নিয়ে শশিবাবু কী করতে চান।
০৯.
সকালে ঘুম ভাঙতে তারাপদ ড্রাইভারের বউটাকে খুব হাসতে দেখলাম। কলের গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিল আর ননীর বোনকে কী যেন ইশারা করছিল। আমায় কল ছেড়ে দিয়ে তারাপদর বউ সরে গেল। বস্তির বাইরে নোংরা কলতলায় ননীর বোন সুহাসিনী হাঁটুতে মুখ ঢেকে ধনুকের মতন পিঠ করে বসেছিল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। …মুখে চোখে জল দিয়ে চলে আসছিলাম, কানে গেল তারাপদর বউ হেসে হেসে বলছে, তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে নে…আজ বাদে কাল বিয়ের পিড়িতে বসবি না! ..যত অনাছিষ্টি বাপু তোদের।
১০.
গেঞ্জিকলে ঢোকার সময় দেখলাম, ন্যাংটা মেয়ের মূর্তিটার মাথায় চড়ে সাদা পায়রাটা ময়লা ফেলছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পায়রাটাকে উড়িয়ে দিলাম শব্দ করে। মেয়েটার সারা গা বুক পেট পাছা পায়ে এত ময়লা জমে আছে আমি জানতাম না। ইচ্ছে করছিল, মেয়েটাকে পরিষ্কার করে চান করিয়ে দি।
১১.
দুপুরে এক ফাঁকে দু-গ্রাস মুড়ি চিবিয়ে জল খেয়ে বাইরে রোদে পঁড়িয়েছিলাম। কেষ্টপদ এসে এক খিলি পান দিল। বিড়ি ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে মূর্তিটাকে দেখছিলাম। কেষ্টপদ হাসতে হাসতে বলল, নকল জিনিস দেখে দেখে মন খারাপ করে লাভ কী, একটা আসল জিনিস নেবে তো বলল, ব্যবস্থা করি। .কথাটা আমার বুকে যেন কোথায় একটা আলগা গিটের মতন এসে পড়ল। কেষ্টপদ যদি টানত, গিটটা লাগত, শক্ত হত। ও টানল না গিটটা, আমি বোকার মতন হাসলাম। বললাম, বিয়ের পিড়েতে বসার আগে নাকি মুক্ত হতে হয়? কী–? কেষ্টপদ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এমন কথা জীবনে শোনেনি। আমি সকালবেলার কথা তুলে বললাম, আমাদের বস্তিতে একটা মেয়ের পরশু দিন বিয়ে, একটা বউ তাকে মুক্ত হতে বলছিল…। কেষ্টপদ এবার হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে আমার গায়ে নুয়ে পড়ছিল। যতবার মুখ খুলতে গেল ডুবন্ত মানুষের জল গেলার মতন হাসির খাবি খেল। আমি হাঁ করে কেষ্টপদর হাসি দেখছিলাম। ম্যানেজার বুড়ো ঠিক তখন সামনে, ন্যাংটা মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেষ্টপদ তখনও হাসছে। কা কা করে কাক ডেকে উঠল, পায়রাগুলো ঝটপট করতে করতে নেমে এল, চড়ুইগুলো মাঠে, বুড়ো ম্যানেজার ভাতের দানা ছিটোচ্ছে। কেষ্টপদর হাসির দমক কমে এসেছে ততক্ষণে, আমার কানের কাছে মুখ হেলিয়ে বলল, হায়রে আমার কপাল মহারাজ, তুমি বললে কী! …আরে, মেয়েদের হতে হয়…মুক্ত-টুক্ত হতে হয়… কেষ্টপদর সারা মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছিল, বিশ্রী রকম হাসির পিচ ছড়িয়ে মুখটা ছেতরে গেছে। হাসতে হাসতে দুলতে দুলতে চলে গেল কেষ্টপদ। আমি বোকার মতন দাঁড়িয়ে থাকলাম। চোখে পড়ল, একটা কাক আদুল গা পাথুরে মেয়েটার একপাশের উঁচু বুকের ওপর পায়ের নোখ রাখার চেষ্টা করছিল; পা পিছলে গেল, কাকটা সঙ্গে সঙ্গে পাক খেয়ে উড়ে গেল, তারপরই ছিটনো ভাতের দানার ওপর এসে বসল নাচতে নাচতে।
১২.
আমার কলের কাঠিমটা সেদিন বার বার সুতো ছিঁড়তে লাগল। ঝাপসা ঠাণ্ডা ঘর, তিনটে হলুদ মিটমিটে বাতি, কলের কেমন একটা একঘেয়ে শব্দ, ত্রৈলোক বিশ্বাসের কাশি আর থুতু ছিটানো, আমার মনে হচ্ছিল চারপাশে মাথা বোঝাই আস্তাকুঁড় নিয়ে আমি বসে আছি। ভাল লাগছিল না কিছু। বুকের মধ্যে একটা ফোঁড়া যেন এবার পেকে টাটিয়ে টনটন শুরু করছে। কেষ্টপদ আমার মন মেজাজ বিগড়ে দিয়ে গেছে। দু-দিন বিয়ে করেই সবজান্তা! আমি সহদেবদার দোকানে অঢেল রতিশিক্ষার বই পড়েছি, মেয়েছেলেদের সাথে শোওয়া বসাও কি কম করেছি! কেষ্টপদ আমায় কী শেখাবে! সুহাসিনীর মুক্ত হওয়া মেয়েদের মামুলি ব্যাপার এ-আমার ভাবতেই ভাল লাগছিল না।