১২.
স্টেশনে চায়ের দোকানে আমি যখন কাজ করছি ছ টাকা মাস মাইনেয়, একটি ছেলের সঙ্গে আমার খুব ভাব হল। তার নাম পার্বতী। সে মিঠাইয়ের দোকানে কাজ করে। তার চোখ ট্যারা, মুখে বসন্তের গর্ত-গর্ত দাগ। পার্বতী আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়। আমায় সে চুরি করতে শেখাল, চা বেচার পয়সা মারতে। পার্বতী বুঝিয়ে দিয়েছিল, চুরি যে করে না সে গাধার বাচ্চা। পয়সা না মারলে দোকানের মালিক তলব বাড়াবে না। চুরি করে করে পার্বতী এখন পনেরো টাকা পর্যন্ত মাইনে বাড়িয়েছে। …পার্বতী আমায় আরও কত কী শিখিয়েছিল। একদিন একটা দেহাতি মেয়ে রাত্রে আমাদের দোকানের কাছে আর-পাঁচটা যাত্রীর মতন ঘুমোচ্ছিল, পার্বতী মেয়েটার ঘুমন্ত বেসামাল শরীরটার দিকে আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে আমায় অনেক কিছু শেখাল।
১৩.
পার্বতীর কথামতন একদিন আমি পকেটে এক দেড় টাকা নিলাম, পানঅলা কাশীর কাছ থেকে বেনারসী খয়েরের পাঁচ ছ খিলি পানও। তার পর দুজনে এক জায়গায় গেলাম। এরকম জায়গা আগে আর আমি দেখিনি। একটা মেয়েছেলে পার্বতীর গলা জড়িয়ে ধরে গান গেয়ে উঠল। আর-একটা মেয়েছেলে হাত পেতে আমার পানের দোনা এবং পকেটের সব পয়সা নিয়ে নিল। হেসে হেসে আমার গাল টিপে বলল, আহা চাঁদ রে–গায়ে এখনও দুধের গন্ধ মরেনি, রাঁড় করতে এসেছে। …যা ছোঁড়া বাড়ি যা…
১৪.
সেই সুন্দর চেহারার লোকটাকে একদিন স্টেশনে পেয়ে গেলাম। বললাম, কই আমার টাকা দিন। ..লোকটা প্রথমে আমায় চিনতেই পারল না। পরে বলল, টাকা কীসের টাকা। যাকে ওষুধ নিয়ে গিয়ে দিয়েছিলি সে কবে মরে ভূত হয়ে গেছে। বেশি ঝটফট করবি না, পুলিশে ধরিয়ে দেব। বেটা, বিষ দিয়ে এসে আবার টাকা! হেট…শালা, মারব এক থাপ্পড় মেয়েটি মরে গেছে! ভয় বিস্ময় এবং বেদনায় আমি কাঠ হয়ে গেলাম।
১৫.
আমার তারপর থেকে খুবই ভয় করত। পুলিশ দেখলে বুক কাঁপত, গা হাত অসাড় হয়ে যেত। কোনও পুলিশের লোক চা খেতে এলে আমি বেশি বেশি চা দিতাম, অনেকটা করে দুধ চিনি।
১৬.
পার্বতী একদিন পালিয়ে গেল। তার কাছে আমার চুরির সব টাকা গচ্ছিত করা ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, এক শো সোয়া শো করে টাকা জমলে এই লাইনের অন্য একটা স্টেশনে গিয়ে চা-মিঠাইয়ের দোকান করব। …কিন্তু পার্বতী পালাল। মাসখানেক পরে–চায়ের দোকানের হাতবাক্স ভেঙে গোটা কুড়ি টাকা নিয়ে আমিও পালালাম। একটা পুলিশ তার আগের দিন সারারাত আমাদের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে ছিল।
১৭.
আমি আগে কখনও নদী দেখিনি। গাড়িটা মস্ত রেল পুল পেরিয়ে এক জায়গায় থামল। আমি নেমে পড়লাম। কতক মেয়েছেলে কয়লা কুড়োচ্ছ, দরজা-খোলা মালগাড়ির মধ্যে পা ঝুলিয়ে বসে এক ছোকরা বাঁশি বাজাচ্ছে, ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে নদীর। আম গাছে বোল ধরার মতন একটি গাছে অজস্র পাখি।
১৮.
ব্যবসাটা চলল না। আমারই ভাল লাগল না। সের আড়াই আটার বিস্কুট, ঘড়ির কাঁটার মতন মস্ত এক কাঁটা, গোল ঘর আঁকা ছক–এক থেকে পঁচিশ পর্যন্ত নম্বর, আর ঘণ্টি নেড়ে নেড়ে ঘুরে বেড়ানো–আমার পোষাল না। আমার কাঁটাটায় কোনও রকমের দোষ ছিল। যে ঘঘারাত তার ভাগ্যেই দশ পনেরো বিশ উঠত। এক পয়সায় দশটা বিশটা বিস্কুট দেওয়া যায় না।
১৯.
এক মারোয়াড়ির গুদোমে আলু আর গুড় তোলার কাজ করলাম। কী দুর্গন্ধ গুদামের মধ্যে। পচা আলু পচে পচে পঞ্চান্ন হচ্ছে; গুড়ের সঙ্গে কাদাজল, তামাক-পাতার জল, মেটে কাদা, আখের আঁশ মেশানো হত। টোপকা টোপকা মাছি, পিঁপড়ে, কতকগুলো ভিমরুল সারাদিন ঘেঁকে থাকত। একদিন একটা ভিমরুল আমার গালে কামড়াল। কী জ্বালা তার!
২০.
কাচের কারখানায় একটা কাজ জুটে গেল। কারখানাটা প্রায় নদীর কাছে। ওখানে লণ্ঠনের চিমনি, মোটা মোটা কাচের গ্লাস বাটি তৈরি হত। আর কী আশ্চর্য আমাদের যে সাহেব ছিল তার মাথার চুল কাচের মতনই সাদা। আমি ভাবতাম,কাচের কারখানায় কাজ করে করে সাহেবের মাথার চুল অমন হয়েছে। একদিন আমারও হবে।
২১.
আমাদের ছোট মিস্ত্রির বাড়িতে আমি থাকতাম। ছোট মিস্ত্রি গাঁজা খেত। তার বউ ছিল বোবা। পেল্লায় এক কলসির মতন ফুলো মোটা বউটাকে ছোট মিস্ত্রি মাঝে মাঝে আদর করত, নয়তো বেশির ভাগ দিনই মারত। বোবা বউটা গলায় কাপড়-পুরে-দেওয়া কুকুরের মতন বিশ্রী করুণ শব্দ করে কাঁদত।
২২.
ছোট মিস্ত্রির মেয়ে কৌশল্যা একদিন আমার চটের বিছানার পাশে এসে শুয়েছিল রাত্রে। আমি ঘুমোচ্ছিলাম। বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছিল। জল পড়ছিল আমাদের খোলার ঘরে। আমার গা নেড়ে কৌশল্যা ডাকল, একটু জায়গা চাইল পাশে। আমি কৌশল্যাকে চুমু খেলাম, কৌশল্যা আমায় গোগ্রাসে খেল। …ভোরবেলায় ছোট মিস্ত্রি আমায় মেরে আধমরা করে ফেলল। আমার হাতের কবজি মচকে গেল, কপাল ফেটে রক্ত পড়ছিল, পিঠের শিরদাঁড়া বেঁকে গেল।
২৩.
নদীর তীরে একটা লোককে পোড়াতে এনেছিল। তখন শীতকাল। মিঠে গরম ঝকঝকে রোদ। আলুথালু বাতাস বইছে। বালিসার চরে গোরু মোষ চরছিল কটা। লোকটাকে খুব করে ঘি মাখিয়ে চিতায় চড়িয়ে দিল। আমি আগে মানুষ পোড়ানো দেখিনি। অবাক হয়ে দেখছিলাম। ঘিয়ের সুন্দর গন্ধ ছুটছিল। আমি দু-চার বার মাত্র ঘি খেয়েছি। চাঁপারানিরা রাত্রে তাদের যে উচ্ছিষ্ট আমায় খেতে দিত তার মধ্যে ঘিয়ের গন্ধ থাকত। আমি ভাবছিলাম, আমি মরে গেলে কেউ ঘি মাখাবে না, কেউ নতুন কাপড় পরিয়ে দেবে না। একটা কোকিল আশেপাশে কী সুন্দর করেই ডাকছিল তখন। অথচ চিতা জ্বলে উঠল।