১২.
দশাশ্বমেধ ঘাটে নৌকো ভিড়ল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে বাবু বললেন, ফটিক, একটা ভাল ফটোর দোকানে-টোকানে নিয়ে যেতে পারো? বাবুর হঠাৎ এই রাতে ফটো তোলার শখ কেন হল জানি না। মনটা ঘোর ঘোর ছিল, বললুম, চলুন–
১৩.
মল্লিক স্টুডিয়োতে বাবুরা ফটো তোলালেন। বাইরে এসে বাবু বললেন, ফটিক, ফটোটা তুমি পরশু নিয়ে নেবে। কাল আমরা লক্ষৌ যাচ্ছি, ফেরার সময় চিঠি দেব, ফটো আর তোমার জিনিসপত্র নিয়ে স্টেশনে হাজির থেকো।
১৪.
জিনিসপত্র আমার কী ছিল, তবু কলকাতা যাব বলে কাপড়-জামা ঘোয়ালাম; শীত আসছে সামনে-ছেঁড়া লেপটা বোর্ডিংয়ের মেথরটাকে দিয়ে দিলাম, বদলে ভাল কম্বল কিনলাম একটা। বাবুদের ছবি এনে কবেই রেখে দিলাম কাছে। খাসা ছবি উঠেছিল। সিংহাসনের মন একটা চেয়ারে বসে আছেন বাবুর পরিবার, পাশে চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন বাবু, পায়ের তলায় মল্লিক স্টুডিয়োর সেই নকল বাঘ, বাবুর পরিবার বাঘের মাথায় বুটি ভোলা ভেলভেটের নাগরা সমেত পা রেখে আছেন। বাবুর একটা হাত সিংহাসনের মাথা টপকে তাঁর পরিবারের কাঁধে পড়ে আছে। ঠিক যেন স্বামী-স্ত্রী। ওঁরা দুজনেই না গম্ভীর, না হাসিখুশি, কেমন যেন আনমনা।
১৫.
সপ্তাহ কাটল বাবুর চিঠিপত্র এল না। আশায় আশায় আরও কিছুদিন গেল, বাবুর খোঁজ খবর নেই। তবে কি লক্ষ্ণৌয়ে গিয়ে বাবুর অসুখ-বিসুখ হল, কোনও আপদ বিপদ! মাস কাটল; শীত এল, শীত ফুরোল; বাবুর কলকাতার ঠিকানায় পোস্টকার্ড লিখলুম ভয়ে ভয়ে, জবাব এল না।
১৬.
বাবুদের সেই ছবি আমার কাছে পড়ে থাকল, ঠিক যেমন নীলু আর নীলুর পাশে রোগা রোগা একটি মেয়ের মুখের ছবি মাসের পর মাস আমার কাছে পড়েছিল। নীলুর মুখ আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবুদের ছবিটা দেখলেইনীলুর সেই ভোলা মুখ আবার নতুন করে মনে পড়ত। …তখন বুঝিনি,নীলুর পাশে ওই মেয়েটি কে, এখন বুঝলাম। ভালবাসলে সব মুখ সব পুরুষ সব মেয়ের মুখ একই রকম হয়ে যায়।
১৭.
আবার এক পুজোর মুখে একটা চিঠি এসে হাজির: বাবা ফটিক, তোমার বাবু আর এ-জগতে নেই। তাঁর ছবিটা আমায় পাঠিয়ে দিয়ে। তুমি যদি কলকাতায় আস কখনও আমার সঙ্গে দেখা কোরো। ইতি তোমার মা।
১৮.
মা! আমার মা! কে জানে কোন্ মেয়ে আমার মা! তবে গঙ্গার বুকে অন্ধকারে যে গান গেয়ে গেয়ে বলেছিল, মহরা জীবন মরণকা সাথী, সে-মেয়ে আমার মা নয়, যাকে বলেছিল জীবন মরণের সাথী, সেই সাথীটিও আমার বাবা নয়। …তবু বাবুর জন্যে আমার কান্না পাচ্ছিল, মার জন্যে কষ্ট হচ্ছিল।
১৯.
ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম। চিঠিও লিখলাম: মা, কলিকাতায় আসিলে আপনার সহিত দেখা করিব। আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম লইবেন। ইতিফটিক।
২০.
কাশী শহর আর ভাল লাগত না। সব যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। বোর্ডিং, স্টেশন, বাজার, চক, নদীর ঘাট–সব বুঝি মরে গেছে। চাপা দমবন্ধ সরু সরু ঠাণ্ডা গলিগুলো ঘুমের মধ্যে আমায় জড়িয়ে ধরত। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতাম। চাঁপারানিকে হরিশ্চন্দ্র ঘাটে পোড়াতে নিয়ে এসেছে কারা, কলমি এসেছে বউ সেজে পোয়াতি হয়ে বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম করতে, যশোদা কলকাতার গাড়ি চেপে আমায় হাত নেড়ে ডাকছে, ফিরিঅলা এসো, এসো। …
২১.
একদিন নীলু এল। স্বপ্নে। বলল, ফটিকদা কমলা বোর্ডিংয়ে কতকাল পড়ে থাকবে আর। স্টেশন আর হোটেল ছাড়া আর কিছু চিনলে না, ঠুলি-আঁটা বলদ হয়ে থাকলে পালিয়ে যাও, ভেগে পড়ো…
২২.
খর গ্রীষ্ম তখন। কাঠ ফাটা বৈশাখের রোদ মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে মার দরজায় এসে দাঁড়ালাম। কলকাতার গলিতে তখন বিকেলের ছায়া নেমেছে। মার বাড়ির সামনে একটা লোক মোটর গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
২৩.
বাড়ির নম্বর আমি ভুল করিনি। কত হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করলাম, কেউ এল না। বিকেল পড়ে আসছিল। গলির মোড়ে এক ফালি আকাশ তখন কাঁসার মতন হয়ে আছে। বাড়ির সদর খুলে এক ঝি বেরিয়ে এসে কোথায় যেন যাচ্ছিল। শুধোলাম, এবাড়িতে ফুল্লরা বলে কেউ থাকেন? … ঝি খানিক যেন থমকে গিয়ে আমায় দেখল। বলল, থাকত আগে, এখন উঠে গেছে। উঠে গেছে, কোথায়?
২৪.
ভরা সন্ধেতে বস্তি খুঁজে খুঁজে ওঁর দেখা পেলাম। সারা মুখে ঘা, গলার কাছটা পোড়া ঝলসানো চামড়ায় বীভৎস, বাঁ-হাতটা কাঁপে সর্বক্ষণ। কুপির আলোয় দড়ির ঝোলা-খাঁটিয়ায় শুয়েছিলেন। আমায় দেখে ঠাওর করতে পারেন না। পরে চিনতে পেরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অনেক পরে বললেন, লক্ষ্ণৌতে গিয়ে ওঁর মাথার অসুখ হল, তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরলাম। মাস ছয় ভুগে উনি চলে গেলেন। সাধ্যেরও বেশি করেছি, ফটিক; আটকে রাখতে পারলাম না।
২৫.
শেষের দিকে বাবু ঝোঁক ধরেছিলেন, ওঁকে বাবুর সঙ্গে পুড়ে মরতে হবে। এই ঝোঁক আর কিছুতেই কাটে না। শেষ পর্যন্ত একদিন সত্যি সত্যি কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন মা। মরলেন না, তার আগেই লোকজন এসে পড়েছিল।
২৬.
কুপি নিভে গেল। তেল ফুরিয়েছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে মা আর আমি বসে। মা বলল, ফটিক, চার পয়সার কেরোসিন কিনে আনতে পারো? এখানে বড় ইঁদুর, ইঁদুরগুলো অন্ধকারে বড় গা ঠোকরায়।
২৭.
তেল কিনে ফিরে গিয়ে দেখি, মার মুখের ঘা ঠুকরে রক্তে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে ইঁদুরে।
২. নিমতলা শ্মশান
০১.
নিমতলা শ্মশানে ভোর ফুটল, রাস্তায় রাত কাটানো ভিখিরির মতন রাতের কালো কালো ছায়াগুলো সরে গেল, সূর্য উঠল, দিনের আলোয় কলকাতা শহরকে শ্মশানেই প্রথম দেখলুম। মা পুড়ল। গঙ্গার ঘোলা-জলে রোদ তখন প্রাণখুলে হাসছে।