০৩.
একদিন নীলু আমায় নিয়ে সিনেমায় গেল, সিনেমা থেকে বেরিয়ে খুব খাওয়া-দাওয়া করল, মদ খেল, ডালকামুণ্ডির বেশ্যাবাড়ি গেল, ভোররাতে সাইকেল রিকশা করে ফিরলাম দুজনে। কমলা ববার্ডিংয়ের কাছে এসে,নীলু বললে–গঙ্গার ঘাটে যাব। আমি ওকে টেনেটুনে নামাতে চাইলাম নীলু নামল না। আমার পা এত টলছিল যে নীলুকে ধরতে গিয়ে কিছুই ধরতে পারলাম না, খানিকটা বাতাস আঁকড়ে মাটিতে বসে পড়লাম। নীলু চলে গেল।
০৪.
নীলু আর ফেরেনি। সে আর বেঁচে থাকতে চায়নি। নীলু সেদিন আমায় তার দেশ থেকে পাওয়া চিঠি দেখিয়েছিল। তার দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে দেওরের সঙ্গে পালিয়েছে, মা রক্তবমি করছে, ছোট ভাই কী যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জুতো পেটা খেয়েছে। নীলু বলেছিল, আমরা হোল ফ্যামিলি একেবারে থার্ডক্লাস, বুঝলে ফটিকদা, থার্ডক্লাস-শালা পচা ঘা কার্বাংকোলের মতন…
০৫.
আমার ঘরে নীলুর সব কিছু পড়ে থাকল কত দিন, শেষে হোটেলের চাকর এক এক করে সব নিয়ে নিল। আমার কাছে নীলু আর একটি রোগা রোগা মেয়ের একসঙ্গে তোলানো ফটোটা থেকে গেল। মেয়েটি যে কে আমি বুঝতে পারলাম না,নীলুর বোন নানীলুর আর কেউ! ..পড়ে থেকে থেকে একদিন নীলুর ছবি থেকে সবটুকু কালো উঠেফটোটায় শ্বেতির মতন চিহ্ন ধরে গেল। কবে একদিন ছবিটা আমি ফেলে দিলাম।
০৬.
সেবার পুজোর মুখে মালদার এক কলকাতার বাবু পাকড়েছিলাম। মথুরচন্দ্র সাহা। ডান হাতে তিন আর বাঁ হাতে দুই–পাঁচ পাঁচটা পাথর সেট করা আংটি। গোল বেঁটে তাকিয়ার মতন চেহারা। ধবধবে ফরসা রং, ফলাও গোঁফ। বাবুর সাথের মেয়েছেলেটি যে বাবুর পরিবার নয়, দেখেই বুঝেছিলাম। কাশীর হোটেলে গাইডগিরি করতে করতে আমাদের চোখ পেকে গিয়েছিল। বাবু অবশ্য হোটেলের খাতায় রেওয়াজ মতন মেয়েছেলেটিকে পরিবার বলেই লেখালেন। তা পরিবারটির মোটাসোটা গোলগাল শরীর ছিল, ফেটে পড়া রং। বাঁকা সিঁথিতে অল্প একটু সিঁদুর, এক রাশ ভারী ভারী গয়না, জরির ফুল-তোলা ফিনফিনে শাড়ি, আর পানের পিচে জরদায় কালো কষ ধরে যাওয়া দাঁত দেখেই বুঝেছিলাম সব। জরির চুমকি তোলা ভেলভেটের চটি পায়ে দিয়ে পরিবার যখন নামলেন টাঙা থেকে–ববার্ডিংয়ের তিনটে চাকর থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
০৭.
ফার্টক্লাস বর্ডার আমার বাবু। বড় ঘর পেয়েছেন। ঘরে চার পাঁচ প্রস্থ আসবাব-পালঙ্ক খাট, আয়না-লাগানো সাজ-টেবিল, বেতবুনন চেয়ার খান দুই, খান দুই এমনি কাঠের চেয়ার, গোল খাটো টেবিল–আলনা। বাবুর দুপুর আর রাতের জন্যে যে খাওয়া আসে তাতে হোটেলের ঠাকুরকে তিন রকম ভাজা আলাদা করে ভেজে দিতে হয়, ডালে নারকেল না হয় কিসমিস, মাছ দুরকম, রাত্রে মাংস, তার ওপর দই মিষ্টি। দু বোতল করে সোডা।
০৮.
দু বোতল সোড়া বাবুর কিছুই নয়। আমায় সারাদিনে ডজন খানেক বোতল বয়ে এনে দিতে হয়। সকালবেলা বাবুর ঘরের পরদার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি, কখন কী হুকুম হয়। স্টেশনে গাড়ি ধরতে যেতে হলে, বাবুর কাছে দাঁড়িয়ে হাত কচলাই, উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললে তবে হোটেল ছাড়তে পারি। সারাটা দিন বাবুদের সঙ্গে এঁটে আছি। এখন চক বাজার, তখন গঙ্গার ঘাট, চলো সারনাথ। সারাদিনে পনেরো বিশ টাকা টাঙা ভাড়াই গুনছেন বাবু, এ-মুল্লুক ও-মুলুক ঘুরছেন, গাদা গাদা জিনিস কিনছেন; বাবুর পরিবারের মুখভরা হাসি, রঙ্গ করে কথা বলছেন। সন্ধের পর সরাসরি ঘরে ফিরে দুজনে দরজা বন্ধ করে দেন। তার আগে অবশ্য আমায় ছ বোতল সোডা আর দামি মদ কিনে এনে দিতে হয়।
০৯.
ছদিনের মাথায় বাবু বললেন, ফটিক আমি এবার লক্ষ্ণৌ যাব। যাবে নাকি আমার সঙ্গে? চললা– দিন কয় বেড়িয়ে আসবে। .আমতা, আমতা করে হাত কচলে বললাম, হোটেলের চাকরি বাবু, এরা ছাড়বে না। বাবুর পরিবার বিছানায় বসে থেকে থেকে হাই তুলছিলেন, তিনি বললেন, ফটিককে আমাদের কলকাতায় নিয়ে গেলেই হয়। .বাবু পরিবারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন একটু। সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়া ছাড়লেন। যাবে নাকি কলকাতায় ফটিক? ..কলকাতা! কোন সেই চাঁপারানির কাছে থাকবার সময় থেকে নাম শুনেছি কলকাতার, সে নাকি শহরের রাজা। লোভ তো কতকাল থেকে! বাবুর কথায় যেন মনে হল, আমার সামনে লটারির টাকা ধরেছে কেউ। হাত বাড়ালেই পেয়ে যাব। বুকের মধ্যে ধক ধক করতে লাগল। বাবুর পরিবার সামনে বসে না থাকলে আমি বাবুর পা ধরতে পারতাম তখন। পা ধরা আর হল না, মাথা নেড়ে বললাম, যাব বাবু। বাবু ঘাড় হেলালেন, বেশ, তোমায় নিয়ে যাব।
১০.
ঘরের বাইরে এসে আমার মনে হল, বাবুর পা নয় বাবুর পরিবারের পা জড়িয়ে ধরাই উচিত আমার। তিনিই তো কলকাতায় নিয়ে যাবার কথা বললেন। বাবুর পরিবারকে আর একটুও খারাপ ধরনের মেয়েছেলে বলে মনে হচ্ছিল না। তাঁর চেহারা সাজপোশাক সবই কেমন করে যেন আমার চোখে চমৎকার হয়ে উঠল।
১১.
বিকেলে নৌকো ভাড়া করে মাঝগঙ্গায় বাবুদের নিয়ে খুব ঘোরা হল। মণিকর্ণিকার আগুন দেখে বাবুর পরিবার শিউরে উঠলেন। তখন বিকেল ঘোর হচ্ছিল, সার সার চিতার আগুন যেন প্রাণপণ করে আলোটুকু কোথাও আঁকড়ে রাখবার চেষ্টা করছিল। গঙ্গার জল বইছিল উজানে। বাবুর পরিবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হল। দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে নৌকো চলল আবার। সন্ধে নামল। গঙ্গার জল কালো হয়ে হয়ে মিলিয়ে গেল, কেদার ঘাটে গিয়ে বাবু বললেন, ফটিক ফিরতে বলল। ..ফিরতি মুখে বাবুরয়ে রয়ে মদ খাচ্ছিলেন। পরিবারকে বললেন, ফুল্লরা, একটা গান গাও। ওরনাম যে ফুল্লরা, এই আমি প্রথম জানলাম। নামটা বেশ লাগল। গান ধরলেন উনি। কে জানত, অত হাসি আর রঙ্গকরা গলা, অত পান-জরদা খাওয়া পুরু আড়ষ্ট জিব,হয়তো মদের নেশায় শুষে যাওয়া স্বরেও বেহালার মতন মিষ্টি সরু অদ্ভুত সুর লুকিয়ে থাকতে পারে। চড়ায় সেসুর হেঁড়ে না, খাদে ডোবে না, কাঁপনে ভাঙে না। উনি গাইছিলেন: মরা জনম মরণকা সাথী…। এমন গান আমি শুনিনি জীবনে। মাথার ওপরকার কালো আকাশ যেন নিচু হয়ে আমাদের নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিল গান শুনতে শুনতে। গঙ্গার জলও চলেছে। ওপাশে মিলিয়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া কিনারা, এপাশের ঘাটে ফোঁটা ফোঁটা আলো।