৪০.
যশোদা আর আমায় ফেরাল না। বাইরে ঝড় জল, ঘরে আমরা দুজন। এই মেলা, মেলা না ভাগ্যের খেলা, কে জানে!
৪১.
মেলা ফিরতি ভিজে শরীরে আবার জ্বর এল। ভীষণ জ্বর। জ্বরের ঘোরে খালি দেখতাম, মেলায় ঝড় উঠেছে, বৃষ্টি পড়ছে মাটি আছড়ে, গাছপালা ভেঙেভুঙে ছত্রাখার হচ্ছে। এক্কার ঘোড়াগুলো কানের কাছে তারস্বরে চেঁচাত। হঠাৎ কখন সব থেমে যেত, চাঁপারানির মুখটা ভেসে উঠত। আরও যেন গাল দুটো ফুলেছে চাঁপারানির। চোখ ডুবেছে। দাঁত কালো, ঠোঁটে পানের পুরু শক্ত বিশ্রী দাগ। চাঁপারানিকে আর মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করত না। মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে গিয়ে মানুষ যেমন হঠাৎ কী মনে পড়লে আবার ফিরে তাকায়, আমি তেমন করে ফিরে তাকাতাম। দেখতাম, চাঁপারানির মুখের পাশ দিয়ে ভেসে উঠেছে যশোদার মুখ। আমার ভাল লাগত না।
৪২.
প্রায় দিন বাইশ পরে যশোদার বাড়ি এলাম। আসার আগে রোগা দুর্বল শরীরটা ছটফট করছিল, তেঁতুলতলায় আসতেই বুক দপ দপ করতে লাগল। শিউরে শিউরে উঠছিলাম। শীতের গাঢ় রোদে একটা পায়রা-ছানা দানা খুঁটে খুঁটে নাচছিল বাড়ির কাছটায়। কী যে এক সুখ আমার শরীর মন মিঠে রোদের মতন তাত দিয়ে জুড়িয়ে দিচ্ছিল কী করে বলব।
৪৩.
বার বার ডেকেও যশোদার সাড়া পাওয়া গেল না। কলাগাছের পাতার ওপর চড়ুইটা ফর ফর করে উড়ে গেল। যশোদাকে ডাকতে যেন। ভাবছি কোথায় গেল ও! হঠাৎ দরজা খুলে একটা রোগা মতন লোক বেরিয়ে এল। সে কাশছিল, হাঁপাচ্ছিল। মরা পানকৌড়ির মতন চোখ লোকটার। শুধোল, কী চাই? …যশোদা আমার কাছ থেকে কাপড় কিনত শুনে লোকটা আমায় ঘরে এসে বসতে বলল। বসলাম, ঘরে গিয়ে। দড়ির খাঁটিয়ার বসিয়ে ও চলে গেল। আর ফেরে না, ফেরে না। ভাবলাম, এ বুঝি কেউ দূর জ্ঞাতি-টাতি হবে যশোদার, নতুন এসেছে। যশোদা বাড়ি নেই বোধহয়, লোকটা ডেকে আনতে গেছে। ঘরটা আজ অন্ধকার অন্ধকার ঠেকছিল, জানলা খোলা নেই, দরজার পাটও পুরো খোলা নয়। কোথাও কোনও শব্দ নেই। …যশোদার পথ চেয়ে বসে বসে কতক্ষণ কেটে গেল। তারপর ও এল। যশোদা নয়–সেই লোকটা, মরা পানকৌড়ির মতন চোখ যেন আরও বাসি দেখাচ্ছে। ওর হাতে হুঁকো। পাশে বসল। বলল, সে যশোদার স্বামী।
৪৪.
ঝিমঝিমে মাথা, মাতালের মতন টাল-বেটাল পা, জ্বররা রুগির মতন হুঁশহারা হয়ে তেঁতুলতলা পেরিয়ে আসতেই মনে হল কারা যেন আমায় দেখছে। চেয়ে দেখলাম, ডোবার পাশে বসে বাসন ধুচ্ছে দুটি বউ। তারা আমার দিকে চেয়ে আছে। নকড়ির মা আসছিল। মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। শুধোলাম, যশোদা কোথায়? বুড়ি আঙুল দিয়ে আমার পিছু দিকে কী যেন দেখাল, ওই হোথায়। পিছু ফিরতেই চোখ পড়ল, তেঁতুলগাছের একটা নিচু মোটা ঘা ঘা পাকানো বিশ্রী কালো ডাল। অজগর সাপের মতন বিরাট ডালটা যেন আমার দিকে মুখ করে চেয়ে আছে। বুকের মধ্যে আতঙ্ক বাজ মেরে গেল। ঘাড়ের কোথায় বুঝি একটা মোটা শিরা রক্তের তোড়ে ফুলে উঠে অসম্ভব টনটনিয়ে উঠল,কপালের রগে খুরের মতন কী বসে গেল যেন। যশোদার স্বামী তার খুনে হাতে আমার গলা টিপে ধরেছে মনে হল। আমার দম বন্ধ, শরীর কাঠ। কখন যেন ছুটতে শুরু করলাম। ছুটে ছুটে ছুটে কোথায় যে শেষে টলতে টলতে মুখ থুবড়ে পড়লাম জানি না।
৪৫.
ফিরিঅলার গাঁঠরিতে আগুন ধরিয়ে দিলাম শেষ রাতে। দাউ দাউ করে নেচে নেচে আগুন জ্বলল। শীতের রাতে আগুন দেখতে কেউ এল না। একটা নেড়ি কুত্তা শীতে মরছিল–সে এসে আগুনের পাশে মড়ার মতন শুয়ে পড়ল।
৪৬.
ভোরবেলায় কে যেন আমার কানের পাশে কথা বলছিল। কে? সাধুবাবা না যশোদা? কী বলল তাও বুঝলাম না। সাধুবাবার কথা মনে পড়ছিল: বাবা এই তো সংসার, বড্ড জট; কোথায় খোলে কোথায় লাগে কেউ জানে না! যশোদার কথাও মনে আসছিল; হোটেলে অন্ধকারে আমার পিঠে মুখ রেখে কেঁদে কেঁদে যশোদা বলেছিল: ফিরিঅলা আমায় নষ্ট কোরো না।
৪৭.
ঘুম ভাঙলে বুঝলাম আমার পাশে কেউ নেই, না সাধুবাবা না যশোদা। আমি একলা। আমার ঘরের সামনে অনেক পোড়া কালো ছাই, বাতাসে উড়ছে; আমার ঘরের বাইরে ময়লা-টানা মোষের গাড়িটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন অনন্তকাল ওই গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকবে, মোযটা মুখের ফেনা কাটবে জড়াবে, আর ডাঁশ মাছিটা তার বোজা বোজা লালচে চোখের পাশে বসবে উড়বে। কোনও দিন কোনও কিছুই বদল হবে না, না গাড়ি না মোষ না মাছি।
.
চার
০১.
মাসে বছরে রোদে জলে দেখতে দেখতে কবে যেন একদিন আমি ফটিকবাবু হয়ে গেলাম। কমলা বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার নন্দনবাবু বলত: ছোকরা দু বছর কাশীতে থেকে চেহারাখানা কী রকম করেছে দেখছ, খাস গুণ্ডা। মাল খেয়ে খেয়ে ঢোল হয়ে গেছে। …আমি আয়নায় নিজের চেহারা দেখে খুশি হতাম। জোয়ান বয়সের পুরুষ এই রকমই হবে,শক্ত সমর্থ জীবন্ত। আমার চেহারার জলুস থেকে আজ কারও বোঝবার উপায় নেই চাঁপারানির পাত কুড়োনো খেয়ে আমার জীবন কেটেছে একদিন। আজ আমায় ভদ্রলোক মনে হয়। মুখের দাগ কি ধুয়ে গেছে তবে! কমলা বোর্ডিংয়ের গাইডগিরি করতে করতে কতবার এ-ঘরে সে-ঘরে আয়নায় মুখ দেখেছি, বুঝতে পারতাম না, কোন দাগ ছিল কোন দাগ গেছে।
০২.
আমাদের তিন গাইডের মধ্যে প্রফুল্লদার আয় ছিল সব চেয়ে বেশি। সে সব চেয়ে পুরনো গাইড সব চেয়ে তুখোড়। এক যুগ তার কাশীতে কেটেছে। বউ মেয়ে নিয়ে বাঙালিটোলার দিকে ঘর ভাড়া করে থাকে। আমি আর নীলু নীলরতন-কমলা বোর্ডিংয়েরই একটা ছোট ঘর ভাগাভাগি করে থাকতাম। নীলুর আয় ছিল সব চেয়ে কম, অথচ সব চেয়ে সে দেখতে সুন্দর। তার কথাবার্তা ছিল চমৎকার, লাজুক লাজুক। আমাদের মতন মাছি আঁটা হয়ে বাক্স বিছানা টেনে সে যাত্রী তুলে নিতে পারত না। আমাদের মতন সে অন্য হোটেলের গাইডদের সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চেঁচামেচি ঝগড়া করতেও পারত না। প্রফুল্লদা বলত, নীলুর দ্বারা গাইডগিরি করা হবে না, ওকে জামাই করে ছাদনাতলায় দাঁড় করালে মানায়।