২৬.
বর্ষার শেষে যশোদার ম্যালেরিয়া জ্বর হল। বললুম, কপা বাড়ালেই কারখানা শহরচলল না আমার সঙ্গে ওষুধ নিয়ে ফিরবে। যশোদা মাথা নাড়ে। না, ঘর ছেড়ে পা বাড়াবে না। …দুঃখ হয়, রাগ হয়; বলি, খানায় পড়ে পা তোমার ভাঙবে না। চলো। …যশোদা চোখ নিচু করে মাথা নাড়ে, বলে, পা খানাতেও পড়ে না, মানাতেও নড়ে না।
২৭.
জ্বর ছাড়ল যশোদার; জ্বালায় ধরল। বলল, তুমি এত ঘন ঘন কেন আস? আমি হাসি; বলি, ফিরি করতে। যোদা আড়ালে সরে যায়, গুন গুন করে বলে, এখানে ফিরির মাল কিনবে কে? আমার কানে কথাটা ভোমরার মতন কাছে দূরে নেচে বেড়ায়। যশোদা জানে, আমি কী জিনিস ফিরি করতে আসি। কেনার লোক বুঝি, একটি-ই।
২৮.
ফিকে আলতার রং, আঁচলায় রুপোলি রেশমের কাজ একটা শাড়ি এনে দিলাম যশোদাকে। দুধের ভরা ঘটি হাতে যশোদা দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিল। শাড়ি দেখে তার মুখ কার্তিকের রোদে নেয়ে গেল। শ্যামা পাখিটা ডাকছিল। সবুজে সোনায় মাচাটা ভরে গেছে। শিউলি ফুলের গন্ধ আসছে ভেসে ভেসে। আস্তে আস্তে যশোদার মুখে যেন কাজলের ছোপ লাগল। শাড়ি ফেরত দিয়ে বলল, বেশ সুন্দর; এটা চড়া দামে বেচে দিও। আমি কি বেচতে এসেছি, দিতে এসেছি, কাল বাদে পরশু দুর্গাপুজো। ..যশোদা মাথা নাড়ল, না।
২৯.
হিম লেগে অসুখে পড়লাম। দু হপ্তা ঘরে কাটল। যশোদার কাছে গিয়ে দেখি মুখে তার কালি ধরেছে। বলল, আমি ভাবি ফিরিঅলা বুঝি এ-দেশ ছেড়ে চলে গেছে। বললাম, কেন, দেশ ছাড়ব কেন? যশোদা গালে-ঠোঁটে হাসে, বলে, আর কোথাও ফিরি করতে! যশোদার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে আমি যেন কী ভাবি, কী বলতে যাই, বলা হয় না।
৩০.
একদিন সারারাত জেগে থাকলাম। বাইরে শীত ঝাঁপিয়ে পড়েছে, হিম আর কুয়াশা বুঝি আকাশটাকেও জমিয়ে দিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে আমার ঘরের লণ্ঠনের আলোটা দেখছিলাম। আলোটা থেমে থেমে কথা বলছিল। সেকথা কানে শোনা যায় না, মনে শোনা যায়। আলোর কথা শুনতে শুনতে বেহুঁশ হয়ে গেলাম। মনে হল, আমার গায়ের পাশে যশোদা গা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। …হুঁশ হল কারখানার সিটি শুনে। কারখানার সিটিটা প্রাণপণ চিৎকার করে লোক জড়োকরা ডাক ডাকছে। আশপাশ থেকে বহু লোক ঘুম ভেঙে উঠে বসল, রাস্তার দিকে ছুটল। আমি শুয়ে থাকলাম।
৩১.
পরের দিন শুনলাম কারখানায় সাতটা লোক রাত্রে মারা গেছে। তাদের একটাকে আমি চিনতাম। প্রীতম নাম। তার বউয়ের জন্যে আমার কাছ থেকে ফুলছাপা শাড়ি কিনেছিল, ছেলের জন্যে আলপাকার জামা। দাম দেয়নি, বলেছিল পরের মাসে দেবে। …কেন কে জানে আমার ভাল লাগছিল খুব, দামটা সে দেয়নি।
৩২.
ভরা পৌষ। শীত ভীষণ খর। যশোদা বলল, সংক্রান্তির মেলায় যাবে। মানত আছে অনেক দিনের, মেটাতে পারছে না; ঘন ঘন স্বপ্ন দেখছে, খারাপ স্বপ্ন। বললাম, বেশ তো চলো, আমার মেলা দেখা কলা বেচা দুই-ই হবে।
৩৩.
আমাদের কপাল ছিল মন্দ। মেলার আগের দিন সকাল থেকেই পশলা পশলা বৃষ্টি হচ্ছিল। মেঘ দেখে মনে হয়, ও-বেলা নাগাদ কেটে যাবে, ও-বেলা ভাবি, সকালে। সকালে যাত্রা শুরু করার সময় ঝির ঝির জল। যশোদা বলল, পথ তো কম নয়, এই বাদলা মাথায় নিয়ে যাব। আমি সাহস দিয়ে বলি, এবাদলা কেটে যাবে, দুপুর থেকে রোদ উঠবে। তা ছাড়া বারো তেরো মাইল দূরে মেলা– সেখানেও কি বাদল আছে নাকি!
৩৪.
প্রথমে হাঁটা পথ, তারপর রেলগাড়ি, রেলগাড়ি থেকে নেমে একা। মেলায় চলেছি যখন তখন এই রোদ এই মেঘলা। রোদ চড়তে পারছে না, রং ধরাতে পারছে না। এক্কা ছুটছে। ঘোড়ার গলায় ঘন্টা বাজছে ঠুন ঠুন। মোটর গাড়িতে পুঁটলি বাঁধা করে লোক চাপানো৷ ধুলো উড়িয়ে টাল খেতে খেতে ছুটছে। চলেছে গোরুর গাড়ি-ইনিয়ে বিনিয়ে ককিয়ে। পায়ে হেঁটে হেঁটে কত লোক। কত না ব্যাপারিও। …আমাদের এক্কায় আমরা দুজন। যশোদা দুলে দুলে পড়ছিল, শক্ত করে আঁকড়ে ছিল খুঁটি। তার মাথা থেকে ঘোমটা খসে খসে যাচ্ছে। থেকে থেকে হেসে ফেলছে যশোদা। কাপড়ের বোঝাটা পিঠের পাশে হেলান দিয়ে বসে বসে আমি যশোদাকে দেখছিলাম।
৩৫.
মেলা তছনছ হয়ে গেল। কোথা থেকে এক ঝড় এল ঝাঁপিয়ে, আর বৃষ্টি। দুপুর কালো হয়ে গেল। মনে হল বুঝি সন্ধে ঘনিয়ে গেছে। সবাই ছুটল। আমরাও।
৩৬.
শহরে পৌঁছে দেখি যেন ভরা ভাদ্দর নেমেছে। কী জল! সারারাত আটকে থাকতে হবে, সকালে গাড়ি। ভিজে কাক হয়ে গেছি আমরা, শীতের হাওয়ায় কাঁপছি ঠকঠকিয়ে। শহরে আলোগুলো ভিজে ভিজে। পথে আর লোক চলে না।
৩৭.
খুঁজে পেতে হোটেলে উঠলুম। একটা ঘর। লোকে আমাকে যশোদার স্বামী ভাবল। ভিজে কাপড় জামা ছাড়ল যশোদা, আমার ভিজে গাঁঠরির মাঝ থেকে বেছে বুছে বস্ত্র নিল। আমিও শুকনো একটা কিছু পরলাম। ঘরে বসে বসেই খেলাম দুজনে। তারপর বাতি জ্বেলে শীত সয়ে শুয়ে থাকলাম। রাত বাড়ল, গম্ভীর হল, মাঝরাত থেকে গড়িয়ে নেমে গেল। বাতি জ্বলছে। যশোদা আমার কাছ থেকে কহাত দূরে, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে। সে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে, আমিও ভান করে পড়ে আছি। …বাতিটার তেল ফুরোল, নিভে গেল।
৩৮.
যশোদা আমার পাশে, আমি যশোদার পিঠে মাথা রেখে। আমার হাত ধরেছে যশোদা। কাঁদছে। সে বউ মানুষ। তার স্বামী আছে। স্বামীর জন্যে সে অপেক্ষা করবে।
৩৯.
কোনওদিন ফিরবে না যে তার জন্যেও মানুষ কি অপেক্ষা করে? …যশোদা কিছুক্ষণের মতন বুঝি ভাবল, না সব মানুষ ফেরে না, সবদিন ফেরে না, ফিরিঅলাও ফিরে ফিরে আসে না।