১৭.
আরামের সব সময় নগদ কারবার। আমার গাঁটের টাকায় তলানি পড়ল। কতকাল শুধু খেয়েছি ঘুমিয়েছি আর আজ এখান কাল ওখান করে ঘুরেছি। ঘুরে ঘুরে এক নতুন শহরে এসে পৌঁছলাম। মস্ত শহর, বহু লোক, গাড়িঘোড়ায় পথ ভরতি, কারখানার চিমনি ধোঁয়া ছাড়ছে সর্বক্ষণ, উত্তরের আকাশটা কালো হয়ে থাকে।
১৮.
এখানে একদিন এক সাধু দেখলাম। অন্ধ। অথচ তার হাতে জট পাকানো এক তাল সুতো। সারাদিন বসে বসে সে শুধু সুতোর জট ছাড়ায়। সন্ধেবেলায় জট-ছাড়ানো সুতো থলির মধ্যে ভরে রাখে। প্রথমে মনে হয়েছিল, সাধুটা ভণ্ড; ঠাওর করে, বাজিয়ে নিয়ে দেখলাম–লোকটা বাস্তবিকই অন্ধ। শুধোলাম, সাধু মহারাজ, এটা তুমি কী কর? সাধু একটু হাসল, বলল, কিছু না বাবা, কিছু না সুতোটায় বড্ড জট; খানিক খুলি, খানিক থেকে যায়, যাও বা খুলি তাও আবার একদিন জট পাকিয়ে যায়। পাগলের মন কথা সাধুবাবার, ঠাট্টা করে শুধোই, তো মহারাজা, তুমি তো চোখে দেখতে পাও না, কী করে সুতোর জট খোল? খোলা সুতোতেও তো আবার জট পড়ে যায়–কী লাভ তোমার বেগার খেটে? সাধুবাবা আরও নরম করে হাসে, বলে, বাবা, এই তো আমার সংসার, বড় জট; অভ্যেস বশে খুলি নয়তো অন্ধ মানুষ কেমন করে খুলব। সাধুবাবা একটু চুপ করে থেকে আবার বলে, কোথায় খোল কোথায় লাগে কেউ জানে না।
১৯.
পিঠে গাঁঠরি, কাপড় ফিরি করে ফিরছি, কাঠফাটা রোদ, মাথার চাঁদি আগুন; বটগাছের তলায় সাধুবাবা শুয়ে আছে। পাশে মাটির জালা, জল দেওয়া হাতা। সাধুবাবা সারাটা গরম এই গাছতলায় ছায়ায় বসে সুতোর জট খুলেছে আর পথের মানুষকে জল দিয়েছে। কাছে গিয়ে ছায়ায় বসলাম। তেষ্টায় গলা কাঠ। মুখ গলার দরদর ঘাম মুছতে মুছতে দু-চারটে কথা বললাম, সাধুবাবা জবাব দিল না। গাছের ছায়া ঘন, কিন্তু বাতাসটা গরম, সাধুবাবা কি ঘুমিয়ে পড়ল? ডেকে তোলার মতন গলা করে জল চাইলাম। জবাব নেই। হল কী সাধুবাবার? এত গাঢ় ঘুম–এই খাঁ খাঁ দুপুরে। গায়ে ঠেলা দিতেও নড়ল না মানুষটা। উলটে দিতেই বুঝলাম সাধুবাবা মারা গেছে। সাধুবাবার হাতের মুঠোয় দলা পাকানো সুতো-সুতোর জট। কারখানার সিটিটা আকাশ চিরে বাজছিল। বোশেখের দুপুর ছটফটিয়ে পড়ে আছে রাস্তার মাঠে। ঘোড়ার গলায় ঘন্টি বাজিয়ে একটা একা আসছিল। সাধুবাবার মুখের একপাশে ধুলো বুঝি একটু, আর-একপাশে বটতলার ছায়ার মতন তৃপ্তির হাসি। …আমার বুকের হাড় গুঁড়িয়ে কেমন যেন-এক কান্না গলায় এসে পৌঁছে গেল।
২০.
কাপড় ফিরিতে বড্ড কষ্ট। সকাল দুপুর নেই–একটু বেলা হল কি গাঁঠরি পিঠে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ো-সারাটা দিন দুপুর সন্ধেতক টো টো। কোথায় যাব তার কি ঠিক আছে? আজ যদি বাবুপাড়া কাল হাসপাতাল পাড়া-পরশু মতিবাজারে। দুর দুর এলাকাতেও যেতে হয়। প্রত্যহ এক জায়গায় বেচাকেনা চলে না। বড় ঝামেলা কাপড় বিক্রির, গাঁঠরি খোলো, দশখানা দেখাও, দরদাম নিয়ে মুখের থুতু শুকিয়ে যায়–তবু শেষ পর্যন্ত এক পয়সা বিক্রি নেই, গাঁঠরি সাজাও আবার পিঠে তেলো–হাঁটো হাঁটো–পায়ে খিল ধরে যায় হাঁটতে হাঁটতে।
২১.
ভাদ্র মাসের চড়া রোদ, পচা গরমবর্ষার জল সেই কোন শ্রাবণে আকাশ ধুয়ে নিয়ে চলে গেছে আর এক বিন্দুও জলনা। হাঁটতে হাঁটতে গোরুহাটা পেরিয়ে গাঁয়ে এসে ঢুকেছিলাম। ভরা পুকুর,কচু পাতার জঙ্গল, কয়েকটা কুঁড়েঘরের মাথায় পচাখড়ের ছাউনি। একটা মস্ত তেঁতুলগাছ চোখ আড়াল করে রেখেছিল, কাছে আসতে চোখে পড়ল। কহাত দুরে বেড়ালতার বেড়া দেওয়া ছোট একটি মাটির ঘর, মাটির খোলার ছাউনি, উঁচু দাওয়া, কলাগাছের চামর দোলানো মাথাটাও চোখে পড়েছিল। রোদ মাথা থেকে পশ্চিমে হেলেছে খানিক। সারাদিন হেঁটেছি। এক পাই পয়সা বিক্রি নেই। পেটে ভয়ংকর খিদে, তেষ্টায় মুখ কনো।
২২.
কাপড় ফিরির হাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেউ এল না। বুঝি বার চার হাঁকের পর কপাট ফাঁক করে এক বউ মুখ বাড়াল। সওদা বেচতে চাই না, গাঁঠরিটা দুদণ্ড দাওয়ায় রেখে একটু জিরোন নেব, পুকুরে মুখ হাত খোব, জল খাব এক ঘটি। বউটি মাথা নেড়ে সায় দিল।
২৩.
হাত মুখ ধোওয়া হল। কার যে মুখ দেখে উঠেছি আজ, ভেতর থেকে মুড়ি আর মোয়া পেলাম, একটা আম–এক ঘটি জল। খাওয়া-দাওয়ার পালা চুকলে বিড়ি খাচ্ছি বসে বসে কপাটের আধখানা আড়াল থেকে বউটি শুধোয়, গামছা আছে?
২৪.
আছে। মোটা তাঁতের শাড়ি, দরজির সেলাই সেমিজ, দু-চারখানা জামা, গামছা। বাচ্চাদের ইজের জামাও আছে দু-পাঁচটা। খুশি হয়ে দেখাই। শাড়ি, সেমিজ, জামা… বউটি দেখে, তবু মাথা নাড়ে না। উই, অনেক দাম। গামছা–দেড়হাতি গামছাটাই নিল। পয়সা দিল দরদাম না করে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সারাদিন বেচাকেনা নেই বলে ওইটুকু বউনি করে দিল।
২৫.
যশোদা একা মানুষ। তার স্বামী জেলে। এগারো বছরের জেল। মাত্র বুঝি দেড় বছর কেটেছে। লোকমুখে যশোদা শুনেছে কথাটা, আসলে তার স্বামী কেন কোন অপরাধে জেলে গেছে যশোদা জানে না। জেলা আদালত থেকে গাঁয়ের লোক এসে বলেছিল মুকুন্দর এগারো বছরের সাজা হয়েছে, খুনের আসামীর নাকি এমনটাই হয়। অবশ্য মুকুন্দ যাবার আগে শুধু বিয়েটাই করেনি, কিছু রেখে গেছে। বিঘে দেড়েক ধানি জমি, গোয়ালে গোরু, সবজি বাগানে আনাজের ফলন আর কলাগাছের ঝোঁপ। পিছুটান আর কিছু রেখে যায়নি মুকুন্দ। না কোনও পরিজন, না বা একফোঁটা বাচ্চা। যশোদা বলে, যাবার আগে কিছু বলল না মানুষটা, সদরে গিয়েছিল দলিল করতে, কে জানে কীসের দলিল, হয়তো আমার কপালের।