০৭.
গোরুর গাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আমরা যখন গ্রামে ঢুকলাম সাহানা মশাইদের ঠাকুরদালানে তখন দুর্গা প্রতিমার গায়ে মাটি লেপছিল হরিহর। কলমির কান্নার সুর মোটা ভাঙা, যেন আড় বাঁশের ফাটা বাঁশির ফুটো দিয়ে একটা শব্দ হচ্ছে থেমে থেমে। আমার কেন যেন হঠাৎ মনে হল, হরিহর খড়ের গায়ে মাটি লেপতে পারে, ইন্দ্রর গায়ে পারে না?
০৮.
আমি রাজা হলাম। ইন্দ্রর ক্ষেত খামারের সব কাজ আমার হাতে। বেচা-কেনার পয়সা আমার ট্যাঁকে। ইন্দ্রর বউয়ের মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেছে। কাঁদে হাসে পুকুরের ঘাটে বসে কথা বলে আপন মনে। একদিন ইন্দ্রর ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল; আর-একদিন ডুবে মরতে চলেছিল গলায় কলসি বেঁধে। কলমি ভাজকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
০৯.
অঘ্রাণ মাসের এক সকালে ঘুম ভেঙে উঠে মনে হল, আমার গলা পর্যন্ত যেন কোথায় ডুবে গেছে। চোটুকাদার মতন চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে গিয়েছে। নড়াচড়ার উপায় নেই। এমন কঠিন বাঁধনে আর কখনও বাঁধা পড়িনি জীবনে। ডান বাঁ কোনও পাশে এক বিন্দু নড়ার মতন শক্তি নেই। …মনটা খাঁ খাঁ করছিল, উদাস লাগছিল। কোথাও সুখ পাচ্ছিলাম না; ঘর না বাইরে না–দু দণ্ড স্বস্তি ছিল না কোথাও। আকাশটা রোদে ফেটে পড়ছে, শীত শীত হাওয়া, ধুনুরি এসে বসেছে তেঁতুলতলায়, ধুনছে। সাতকড়ি কুঁজো হয়ে বসে আছে বড় পাথরটার ওপর। তার কতকালের পুরনো লেপের তুলো ধুনা হচ্ছে। সেই কালো ঝুল তেঁতুলের দলার মতন পুরনো জমা তুলো ধুনুরির হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছত্রাকার হয়ে পেঁজা আঁশের মতন ছড়িয়ে পড়ছে, বাতাসে উড়ছে। আমার মনে হচ্ছিল, আমাকে কেউ ধুনে দিক, আমি পুরনো লেপের তুলোর মতনই দলা পাকানো, শক্ত, তাল হয়ে গেছি।
১০.
কলমি বলে, অত মন আনচান কীসের? বলেছিলুম না রাজা হবে। তা কম কী হলে গো! কপাল না ফিরে গেল! নজরে দোষ না ধরলে আরও ফিরবে। কলমি গায়ের ঢিলে কাপড় আর সামলায় না, মুখের চিবুনো পান সামনের দাঁতে এনে যাদু করা হাসি হাসে, ওপর ঠোঁটে টোল হয়ে থাকে হাসিটা, খুশির আঁচে চোখ জ্বলে। আমি ওর হাসি দেখি, ঠোঁট দেখি, মুখ, চুল, আলগা গা। নতুন করে দেখা নয়। দেখছি তো কবে থেকেই। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কলমি আমায় রাজা করেছে, কিংবা সেই জোড়া সাপ। ইন্দ্রও জোড়া সাপ দেখেছিল। সে বিজোড় হল। আমি কলমি জোড় হলুম।
১১.
আর একদিন কলমি বলল, আমাদের এরা একঘরে করবে;বউয়ের বড় ভাই নাকি বলে পাঠিয়েছে, জমিজমা ভালয় ভালয় ছেড়ে না দিলে মামলা করবে..সবাই এখন ধম্ম অধম্ম দেখাচ্ছে, বলে, চোখের সামনে বসে বসে এত পাপ দেখা যায় না। কলমির মুখে আজ হাসি নেই। তার গোমড়া তেজালো চটন্ত মুখের দিকে আমি চেয়ে থাকলাম। দুর্ভাবনায় ওর চোখের তলায় কালি ফুটেছে। আমার দুঃখ হয় না, ভয়ও নয়। কলমি ঠাট্টা করে শুধোয়, পাত নোংরা করে অধম্মকে ডরাচ্ছ? মুখের আগায় কথা এসেছিল, বললাম না। নোংরা পাতেই আমি দুমুঠো খেয়েছি।
১২.
কলমিকে বলেছিলাম, দুজনাতেই যাব। যাবার সময় আমি একাই পালালাম। কলমি ঘাটে গিয়েছিল তখন। নগদ টাকা কুড়িয়ে বাড়িয়ে কলমি গিট বেঁধেছিল সালুর কাপড়ে। সত্যনারায়ণের পটের পাশে হরিনামের ঝোলায় নগদ চারশো টাকা। আগের রাতে রেখেছে, আমি বলেছিলাম। টাকাটা পুরোই নিলাম আমি। কলমি যেন স্পষ্ট করে বোঝে অধম্মর ভয় আমার ঠিক ঠিক কতখানি।
১৩.
রেলগাড়ি চেপেছিলাম। কখন যেন দেখি সেই পুরনো স্টেশনে এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। একদিন মাঝরাতে ময়না আমাকে এখানেই নিয়ে এসেছিল। রামেশ্বর ড্রাইভার আজও আছে এখানে। রেলের পুলটুকু পার হলেই ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে তাকে দেখতে পাব। পুলিশ আমায় আজও খুঁজছে হয়তো। ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেল না, গলা কাঠ হল না। বেঞ্চি টপকে এপাশের প্ল্যাটফর্মের দিকে এলাম। মাথা তুলে দেখলাম উঁচুর বেঞ্চটা খালি। লাফ মেরে উঠে মুখ ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। …কে জানত ঘুরে ফিরে একদিন আবার এই পথেই আসতে হবে। …গাড়ি ছেড়ে দিল; কামরাটা দুলছে, চাকাগুলো চলতে চলতে যেন চলকে উঠছে, শব্দটা বুকে এসে লাগছে। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, রামেশ্বর ড্রাইভারদের শহর ছেড়ে আমি যে অনেক দূর পালিয়েছিলাম কলমিদের গাঁয়ে, তবু এত তাড়াতাড়ি আবার সেইখানেই ফিরে এলাম কী করে! …
১৪.
রাত বেহুশ; বাইরে পাকা জামের মতন অন্ধকার, কামরায় সবাই ঘুমে ঢুলছে, গাড়িটাও যেন হাই তুলে তুলে এগুচ্ছে, কানা বাতিটা ঠায় আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি, রামেশ্বর ড্রাইভারদের শহর ছেড়ে আমি বেশি দুর পালাতে পারিনি; আমার পথ জানা ছিল না, ধোপার গাধার মতন সাত মাঠ ঘুরেছি শুধু। …গাড়িটা আমায় আবার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে!
১৫.
গাড়ি থামল। স্টেশনে কে যেন ঘুমের গলায় টেনে টেনে নাম হাঁকছিল। ছোট স্টেশন, প্ল্যাটফর্মে দু-চারটি লোক, আঁধার মাখামাখি হয়ে আছে। আমি নেমে পড়লাম। পুরনো, ফেলে-আসা কোনও জায়গাতেই আর আমি ফিরে যেতে চাই না। রেলগাড়িটা আমায় বোকা বানিয়ে পিছু পথে নিয়ে যাচ্ছিল।
১৬.
একদিন নিজের দিকে চেয়ে চেয়ে বুঝলাম, চেহারাটা বড় পুরনো হয়ে গেছে। এই কবছরের নানা দাগ ধরে কতকালের বাসাবাড়ির মতন দেখায়। ইচ্ছে হল, নিজেকে নতুন করি। ভাল বাহারি করে চুল ছাঁটলাম,নতুন কাপড় পরলাম; গেঞ্জি, জামা, জুতো–সব নতুন হল। ভদ্রলোকদের সঙ্গে আমার তফাত দুর থেকে বোঝা যেত না। কিন্তু, আমার মুখে কী যে ছিল কে জানে–দোকানে বাজারে রাস্তায় কেউ আমায় আপনি করে কথা বলত না, খাতির দেখাত না। শেষ পর্যন্ত খাতির পাবার লোভটা চাপা পড়ে গেল, আমি আর গ্রাহ্য করলাম না কে কী বলে।