১. জন্মদাতা পিতা
এক.
০১.
আমার জন্মদাতা পিতা এবং গর্ভধারিণী জননীকে আমি দেখিনি। কোথায়, কোন শহরে অথবা গ্রামে আমার জন্ম হয়েছিল আমি জানি না। হয়তো ভোরের আলোয় এই পৃথিবীর বাতাসে আমার প্রথম নিশ্বাসটি নিয়েছি। দুপুরে, সন্ধ্যায় কিংবা রাতেও হতে পারে; আমি জানি না। কে জানে, তখন গ্রীষ্ম না বর্ষা, শরৎ বা শীত, কি বসন্ত!
০২.
ছেলেবেলায়, একটু বয়স হবার পর, আমি আমার বাবা এবং মার চেহারা মনে মনে গড়ে নিয়েছিলাম। আমার একটুও সন্দেহ ছিল না আমার বাবা এবং মার চেহারাটি অবিকল ওইরকমেরই। লম্বা আধফরসা, মোটা মোটা হাড়ওলা, রুক্ষ বদমেজাজি শ্যামলালবাবুকে আমি মনে মনে বাবা বলতাম। বাবার কথা ভাবতে বসলে শ্যামলালবাবুকে দেখতাম। …টকটকে ফরসা, গোলগাল, কীসের-যেন-আটা-মাখানো হাসিহাসি মুখ, পুরু ঠোঁট এবং চোখে কাজল কি সুর্মাটানা চাঁপারানির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে কতবার মা মা বলেছি। চাঁপারানিকে আমার মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হত স্পষ্ট পুরো গলায়। ডাকিনি কখনও।
০৩.
শ্যামলালবাবু আমায় ইজের জামা কিনে দিত। একবার ক্যাম্বিসের জুতো কিনে দিয়েছিল। চাঁপারানি আমায় দুবেলা খেতে দিত। একবেলা ডাল-ভাত-তরকারি; অন্যবেলা শ্যামলালবাবু এবং চাঁপারানির পাতকুড়নো। পাতকুড়নো খাবার সময় আমি প্রায়ই মাংসর হাড়, চর্বির ডেলা, গলা আলু, মাছের কাঁটা, ছাল-টাল পেতাম। রাত্রে এই খাওয়া পেতে অনেক রাত হত–কোনও কোনও দিন আমি সদর-দরজার সামনে কলঘরের কাছটায় বসে বসে ঘুমিয়ে পড়তাম–তবু এই রাতের পাতকুড়নো আমার ভাল লাগত। ওই খাবারের গন্ধ এবং স্বাদের জন্য আমি সারারাত বসে থাকতে পারতাম।
০৪.
চাঁপারানি আমায় অ-আ ক-খ চিনিয়েছিল। শ্যামলালবাবু আমায় কথামালা কিনে দিয়েছিল। বাজারের চাবাবু আমায় ফোর ক্লাসের বই পর্যন্ত পড়িয়েছিল। এবং পিয়ারীচরণ সরকারের ফার্স্টবুকের সাতান্ন পাতা। সাতান্ন পাতায় এক গরিব অন্ধ বেচারির কথা আছে। চা-বাবু আমায় পড়িয়েছিল: বেচারি অন্ধ, আকাশ মাটি গাছ এমনকী মানুষ পর্যন্ত দেখতে পায় না, তার খুব কাছাকাছি থাকলেও নয়। …পড়াটুকু পড়িয়ে চা বাবু বলেছিল, তুই বেটাও অন্ধ।
০৫.
হ্যাঁ, চোখে না হলেও এক হিসেবে আমি অন্ধই ছিলাম। শ্যামলালবাবু বদমাশ, মাতাল, চোর–আমি জানতাম না। চাঁপারানি বেশ্যা আমি কী করে জানব।
০৬.
তার পর অনেকদিন খাওয়ার কষ্ট পেয়েছি। দিনের বেলায় চাবাবুর দোকানে ফাইফরমাশ খাটলে দু-চারটে পয়সা, দু-এক কাপ চা, এক আধ টুকরো শুকনো পাঁউরুটি পেতাম। রাত্রে কালাচাঁদের হোটেলের কাছে ঘুরঘুর করতাম কুকুরের মতন। চাঁপারানির কথা মনে পড়ত; মাংসের হাড় চর্বি, মাছের কাঁটা, গলা আলুর গন্ধ ও স্বাদের কথা ভাবতাম।
০৭.
আমার ইজের জামা ছিঁড়ে গেল, পা অনেককাল খালি। তখন বেশ শীত পড়ছে। রেল স্টেশনের মিঠাইঅলা পানঅলাদের দোকানের কাছে আমি রাত কাটাতাম। টিনের চাঁদোয়ার তলায় সেখানে অনেক লোক জমত। স্টেশনের কুলিকাবারি, ভিখিরি, পোঁটলা-পুঁটলি বোঁচকা কুঁচকি নিয়ে থার্ড ক্লাসের যাত্রী, দু-তিনটি কুকুর। শেডের তলায় কুলিরা এক জায়গায় গোল করে আগুন জ্বালাত। সবাই চেষ্টা করত আগুনের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকতে। আগুনটা কুলিরা জ্বালত বলে ওটা তাদেরই সম্পত্তি ছিল। ওদের পিছু ফেলে কেউ ধুনির কাছে এগিয়ে যেতে চাইলে কুলিরা গালাগাল করত। রাত প্রায় ফুরিয়ে এলে, যখন সবাই মুড়ি দিয়ে তালগোল পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আমি আগুনটার কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়তাম।
০৮.
একদিন ভীষণ এক আগুনের স্বপ্ন দেখলাম। কোথায় কোন মহল্লায় যেন আগুন লেগেছে। আকাশ লাল, পাখির দল চিৎকার করে উড়ছে, গলগল করে ধোঁয়া উঠছে এক পাশে, শব্দ হচ্ছে কীসের এক, বহু মানুষের কলরব দূর থেকে ভেসে ভেসে আসছিল। …আগুন দেখে আমারও ছুটে যাবার ইচ্ছে করছিল। যেতে পারছিলাম না। আমি নিজেকেই দেখছিলাম, নিজের অসহায়তাকে। কী ভীষণ ছোট্ট আমি, কতটুকু মাত্র এক হাত কি তার চেয়েও বুঝি ছোট। সদ্যোজাত। কথা বলতে জানি না, চোখে দেখতে পাই না, গলা দিয়ে শুধু কান্না আর কান্না।
০৯.
স্বপ্নটা দেখার পর আমার কেন যেন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল, যেদিন আমি জন্মেছিলাম–সেদিন আশেপাশে কোথাও ভীষণ এক আগুন লেগেছিল। আমার বাবা সেই আগুন নেবাতে ছুটে গিয়েছিল, আর ফেরেনি; আমার মা আমায় নিয়ে শুয়ে ছিল। মা আর আমি একা ছিলাম।
১০.
রাস্তা থেকে একটা লোক আমায় একদিন হাতের ইশারা দিয়ে ডাকল। লোকটা দেখতে সুন্দর, খুব সুন্দর। তার মাথায় কোঁকড়ানো চুল, চোখে সোনার চশমা। কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকটাকে আমি দেখলাম। বড়লোক, ভদ্রলোক: আমি ভাবলাম। তাকে খুব ভাল লেগে গেল আমার। …ভদ্রলোক আমায় দিয়ে একটা কাজ করিয়ে নিতে চাইল। আমার হাতে চকচকে আধুলি ফেলে দিয়ে বলল, কাজটা করে দিতে পারলে পুরো দুটো টাকা আমায় দেবে।
১১.
কাজটা সোজাই ছিল। আসলে ওটা কোনও কাজই নয়, কেউ তার জন্যে এক আধলাও খরচ করে না। তবে বড়লোকদের কথা আলাদা, টাকা-পয়সার মায়া তাদের নেই। ভদ্রলোক কাগজে মুড়ে আমায় যে ওষুধের শিশিটি দিয়েছিল, আমি ঠিক জায়গায় সেটি পৌঁছে দিলাম। চাঁপারানির চেয়ে অনেক কম বয়সের ভারী সুন্দর একটি মেয়ে সেই শিশি নিল। মেয়েটি, জানি না কেন, কাঁদছিল। তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে। বুকের কাছে হাত দিয়ে শাড়ির আঁচলটা সে হাতের উপর দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছিল। ওর কপালে আমি সিঁদুর দেখতে পাইনি। ওষুধটি নিয়ে আঁচলের তলায় রেখে ও বলল বিড়বিড় করে, ছাই হবে। কেন বলল, আমি জানি না। …রাস্তায় এসে সেই সুন্দরমতন ভদ্রলোকটিকে আমি আর দেখতে পেলাম না। এপাশ ওপাশ কত খুঁজলাম, কোথাও নেই। গোটা একটা দিনই প্রায় আমি লোকটাকে খুঁজেছি। তার কাছে আমার দু টাকা পাওনা। কিন্তু কোথাও আর তার টিকি দেখা গেল না। লোকটা ঠগ।