বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনে অমল মুখ ফেরাল। হিমানীমাসি। তাঁর পিছনে এ-বাড়ির আয়া, কালো বেঁটে শক্ত সমর্থ দেখতে, বিদঘুটে নাম ওর, টিসরি আব্রাহাম। ভ্রমর বলে, ওরা সব মিশনারী পুয়োর হোমের মেয়ে, কে কোথাকার লোক বোঝা যায় না, মিশনারীরা মানুষ করেছে, তারপর বড় হয়ে যে যার রুজি-রোজগার করে বেঁচে আছে।
হিমানীমাসির পিছু পিছু আয়া একরাশ কাচা কাপড় এনেছিল বালতি করে, মাসির কথামতন বাগানের ঘাসে একে-একে মেলে দিতে লাগল।
অমল উঠল। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, ভ্রমরের খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত। এতক্ষণ বসে না থেকে তার ভ্রমরের কাছে যাওয়া উচিত ছিল। অমল নিজের বোকামি এবং গাফিলতির জন্যে গ্লানি বোধ করল।
ভ্রমরের ঘরে এসে আস্তে করে ডাকল অমল, তারপর পরদা সরিয়ে মুখ বাড়াল।
ভ্রমর বিছানায় বসে আছে; হাঁটু গুটিয়ে মুখ ঢেকে। বড়-বড় ফুল আঁকা লেপটা তার কোমর পর্যন্ত টানা। ঘরে রোদ এসেছে পর্যাপ্ত, অনেকখানি রোদ ভ্রমরের বিছানায় ও তার পিঠে ছড়িয়ে আছে। অমল ঘরে ঢুকল। পায়ের শব্দে মুখ তুলল ভ্রমর।
সারা রাতের জ্বরে মুখ যেন পুড়ে শুকিয়ে গেছে ভ্রমরের। চোখের চারপাশ টসটস করছিল, পাতলা ঠোঁট দুটিতে যাতনা মেশানো। ক্লান্ত অবসন্ন চোখ তুলে ভ্রমর অমলকে দেখল দু-পলক। তারপর অসুস্থ অবশ হাতে কোমর থেকে লেপ আরও একটু উঁচুতে তুলে নিল। নিয়ে কেমন বিব্রত ভঙ্গিতে এলোমেলো কাপড়টা গায়ে গুছিয়ে নিল।
অমল বিছানার দিকে দু-পা এগিয়ে গেল। একটা রাতে কী চেহারা হয়ে গেছে ভ্রমরের, কতদিনের কালি যেন তার মুখে গালে বসে গেছে, কপালে একরাশ উড়ো চুল, কাঁধের কাছে বিনুনি খুলে চুলগুলি ছড়িয়ে রয়েছে, মাথা কান ও গলার ওপর চুলের আঁশ উড়ছে যেন।
“খুব কান্ড করলে! দেখতে দেখতে এত জ্বর!” অমল হালকা করে বলার চেষ্টা করল।
ভ্রমর ততক্ষণে খানিকটা গুছিয়ে নিয়েছে। সামান্য আড়ষ্ট হয়ে বসে বাঁ হাত দিয়ে চোখ মুখ কপাল থেকে উড়ো চুলগুলো সরাতে লাগল।
ঘরে দু-পাশে দুটি লোহার স্প্রিঙ্ দেওয়া খাট। কৃষ্ণার বিছানার দিকে এগিয়ে অমল ধার ঘেঁষে বসল। বলল, “এখন কেমন আছ?”
“জ্বর আছে।” ভ্রমর বলল নীচু গলায়, মুখ না তুলে।
“কত জ্বর?”
“জানি না।”
“জ্বরটা দেখ তবে। থার্মোমিটার দাও।” অমল সরাসরি ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে- ছিল। বাসী এলোমেলো বিছানায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে-থাকা রুগ্ণ কৃশ ভ্রমরের জন্যে তার বড় দুঃখ হচ্ছিল। ভ্রমরের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, এখনও তার বেশ জ্বর আছে। “থার্মোমিটার নেই বাড়িতে?” অমল শুধলো। সে যেন একটু অধৈর্ম হয়েছে।
“আছে। এ-ঘরে নেই।”
“কোথায় আছে বলল, আমি নিয়ে আসছি।”
ভ্রমর মুখ তুলল। তার চোখে কেমন ভীরুতা ও শঙ্কার ছায়া ভাসছিল। হয়ত কোনো কারণে সে জ্বর দেখতে চায় না। কি বলতে গেল, গলার স্বর উঠল না, ভেঙ্গে গেল। একটু অপেক্ষা করে গলা পরিষ্কার করে নিল ভ্রমর, বলল, “এখন থাক।”
“থাক্! বা রে! এখন থাকবে কেন? তুমি জ্বর দেখবে না?” অমল অবাক।
ভ্রমর ভাবল একটু। বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে কপালের চুল সরাল, বলল, “এখন আমি মুখটুখ ধুতে যাব।”
অমলের ভাল লাগল না। জ্বর নিয়ে ভ্রমর এত লুকোচুরি করে কেন? কিসের ভয় তার? কেউ কি ইচ্ছে করে অসুখ বাধায়? না লুকিয়ে রাখলেই অসুদ্ধ সারে!
ভ্রমর হাই তুলল। বিছানা ছেড়ে উঠবে যেন এইবার।
লকেটের কথাটা হঠাৎ মনে হল অমলের। ভ্রমরের চোখের দিকে তাকাল, বলল, “তোমার লকেটটা পেয়েছ?”
মাথা ডান পাশে কাত করে ভ্রমর বলল, “পেয়েছি।”
অমলের কোথায় যেন একটা দুশ্চিন্তা ভাসছিল। লকেট পাবার খবর শুনে সেই দুশ্চিন্তা সরে গেল। খুশী হয়ে অমল শুধলো, “কোথায় পেলে?”
“জামার মধ্যেই।” ভ্রমর অস্পষ্ট গলায় বলল। বলে পিঠের পাশ থেকে বালিশ সরাল। তার মনে হল, মা কাছাকাছি কোথাও রয়েছে, পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভ্রমর অস্বস্তির গলায় বলল, “এখন মুখটুখ ধুতে যাব। তুমি…”
অমল উঠল। এই ফাঁকে সে বাড়ির চিঠিগুলো লিখে ফেলবে ভাবল। বলল, “তুমি মুখ ধুয়ে এস, আমি ঘরে গিয়ে চিঠিটা লিখে ফেলি। তারপর এসে বসবোখন।”
ভ্রমর হঠাৎ বলল, “এখন না। বিকেলে—”
“বিকেলে?” অমল কথাটা বুঝল না।
ভ্রমর ইতস্তত করে বলল, “জ্বর হয়ে শুয়ে আছি, গল্প করলে মা বকবে। বিকেলে—”
“বিকেলে জ্বর থাকবে না?” অমল হেসে ফেলল।
“মা থাকবে না।”
“কোথায় যাবেন?”
“চার্চে। আজ রবিবার না!”
অমল দু-মুহূর্ত অন্যমনস্কভাবে ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে কি ভাবল। বুঝতে পারল, ভ্রমর আজ চার্চে যাবে না; তার জ্বর। বাড়িসুদ্ধ আর সবাই চার্চে যাবে।
অমল আর কিছু বলল না। ঘর ছেড়ে চলে গেল।
বিকেলের রোদ থাকতে-থাকতেই হিমানীরা চলে গেলেন। চার্চ অনেকটা দূরে, মাইল পাঁচেক প্রায়। আনন্দমোহন গরম পোশাক ভেঙে পরেছেন আজ, কোটের বাটন-হোলে ফুল গুঁজেছেন; হিমানী সিল্কের হালকা-ছাপা শাড়ির ওপর গরম শাল নিয়েছেন, পাতা কেটে চুলে বাঁধার মতন করেই চুল বেঁধেছেন সযত্নে। কৃষ্ণা স্কার্ট ব্লাউজ আর গরম শর্ট কোট পরেছে, জুতো মোজা, বিনুনিতে রিবন বেঁধেছে ফুল করে। টাঙা এসেছিল, কোথাও বেড়াতে যাওয়ার মতন—পরিচ্ছন্ন ফিটফাট হয়ে গোটা পরিবারটি চার্চে চলে গেল।
অমল বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল তখন ইংরেজী উপন্যাস, আনন্দমোহন আনিয়ে দিয়েছেন কলেজ লাইব্রেরী থেকে। হিমানীদের চলে যেতে দেখল অমল, টাঙাটা চলে গেলে সে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ফাঁকা চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল।