“কীট?” অমল প্রথমটায় কেমন বুঝতে পারে নি। পরে বুঝল। বুঝে হেসে ফেলল। “পোকা কামড়েছে?”
কৃষ্ণা মাথা নাড়ল। কাপে চা ঢালতে-ঢালতে বলল, “রাতে কেটেছে কাল। দেওয়ালিতে কিজলা পোকা হয়। ডোরা ডোরা দেখতে।”
অমল মজা পাচ্ছিল। কৃষ্ণার কথা বলার ধরনটাই এইরকম, অর্ধেক হিন্দী মেশানো বাঙলা কথা বলবে। এ-বাড়ির সকলেই দু-পাঁচটা এইরকম কথা বলে, কিন্তু, কৃষ্ণা যেন বড় বেশী বলে। তার কারণ, কৃষ্ণার বন্ধুবান্ধবরা সকলেই প্রায় অবাঙালী। সে যে-স্কুলে পড়ে সেখানে নাকি মাথাগোনা বাঙালী মেয়ে। দিনের পর দিন এদিকে থাকতে-থাকতে, এদের সঙ্গে মিশতে-মিশতে এইরকম হয়ে গেছে কৃষ্ণা।
“ওষুধ দিয়েছ?” অমল সুজি খেতে-খেতে শুধলো।
“ডেটল লাগিয়েছি।”
“আমার কাছে অয়েন্টমেন্ট আছে। ভাল অয়েন্টমেন্ট। লাগিয়ে দিও, তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।”
কৃষ্ণা চায়ে দুধ চিনি মিশিয়ে এগিয়ে দিল। দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে একবার বারান্দাটা দেখে নিল। তারপর অমলের দিকে তাকিয়ে হাসল, যেন কোনো অপরাধ করার আগে বলে নিচ্ছে। বলল, “আমি আধা কাপ খাই।”
“আধা কেন, পুরো কাপ খাও। চা কি কম আছে?”
“না।” কৃষ্ণা মাথা নাড়ল। “মা দেখলে চিল্লাচিল্লি করবে। সকালে খেয়েছি কিনা?”
অমল হেসে ফেলল। হিমানীমাসির কাছে প্রশ্রয় নেই বে-নিয়মের। সকালে চায়ের টেবিলের পাট চুকলে দ্বিতীয়বার চা পাওয়া যায় না।
কৃষ্ণা অন্য পেয়ালায় চা ঢেলে নিল অর্ধেকটা। সতর্ক চোখে বারান্দাটা আরও একবার দেখে নিল।
“তুমি খাও, আমি গার্ড দিচ্ছি।” অমল হেসে বলল।
চায়ের কাপ ঠোঁটে তুলল কৃষ্ণা। অমল হাসিমুখে ওকে দেখছিল। হিমানীমাসির মতনই মুখের গড়ন অনেকটা, তবে কৃষ্ণার চোখ দুটি পরিষ্কার। মোটা ভুরু, বড় বড় চোখ। গোলগাল চেহারা। রঙ কালো। অমল দেখেছে কৃষ্ণা শাড়ি পরে না। স্কার্ট ব্লাউজ, না হয় এদেশী মেয়েদের মতন কামিজ আর পা-আঁটো পাজামা; মাথার মাঝখানে সিঁথি করে দুপাশে দুটো বিনুনি ঝুলিয়ে রাখে।
“মেসোমশাই কোথায়?” অমল শুধলো।
কৃষ্ণা গায়ের গরম জামায় আলতো করে তার চিবুকে ঘষে নিল। “শহরে গেছে।”
শহরে গেছেন? অমলের কেন যেন অন্য রকম মনে হল। এখন তাঁর শহরে যাবার কথা নয়। সকালের এ-সময়টা হয় তিনি বাগানের পরিচর্যা করেন, নয় বই-টই পড়েন। কলেজের জন্য তৈরী হন। ভ্রমরের চিন্তাটাই সহসা অমলকে আবার উদ্বিগ্ন করল।
অমল বলল, “ভ্রমর কই? তাকে দেখছি না সকাল থেকে?”
“শুয়ে আছে। জ্বর।”
“জ্বর!”
“ওর হরদম বিমার হয়।” কৃষ্ণা গা করল না যেন। ভ্রমরের জ্বরজ্বালা সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ নেই।
“কতো জ্বর? খুব বেশী?” অমল জিজ্ঞেস করল।
কৃষ্ণা বলতে পারল না। সে জানে না কতটা জ্বর। সকালে ভ্রমর আগে ওঠে। আজি সে ঘুমোচ্ছিল। কৃষ্ণা উঠে দ্রমরকে ডাকতে গিয়ে দেখল, লেপের মধ্যে মুখ ঢেকে কুঁকড়ে ভ্রমর ঘুমোচ্ছে; ভ্রমর উঠল না; বলল, তার জ্বর হয়েছে।
অমলের খুব খারাপ লাগল। এ-বাড়ির কেউ ভ্রমরের অসুখ-বিসুখ চেয়ে দেখে না; গ্রাহ্য করে না যেন। মাসিমা অমলকে ভ্রমরের অসুখের কথা কিছু বললেন না। ভ্রমর ঠিকই বলেছিল, তার অসুখ শুনলে এরা সবাই অসন্তুষ্ট হয়।
চা খেতে-খেতে অমল এতক্ষণে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারল, আজ ভ্রমর তাকে সকালে উঠিয়ে দিতে আসে নি, ভ্রমর বিছানায় শুয়ে আছে বলে কৃষ্ণা তাকে চা করে দিতে এসেছে।
চোখ তুলে কৃষ্ণাকে দেখতে-দেখতে অমল ভাবল, ভ্রমর লকেটটা ফিরে পেয়েছে কিনা কৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করবে নাকি? সামান্য ভাবল। মনে হল, থাক, জিজ্ঞেস না করাই ভাল; কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে ভ্রমর অসুবিধেয় পড়বে।
মেসোমশাই শহরে ডাক্তারকে খবর দিতে গেছেন বলেই অমলের মনে হল। বলল, “মেসোমশাই ডাক্তারকে খবর দিতে গেছেন?”
“না।” কৃষ্ণা মাথা নাড়ল। সে জানে না; তেমন কোনো কথা সে শোনে নি।
এমন সময় বাগানের দিকে কাঠের ফটক খুলে লীলা এল। কৃষ্ণার বন্ধু। লেডিজ বাইসাইকেল-এ চেপে এসেছে। একটা পাক খেয়ে পলকে বারান্দার সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল। বেল বাজাতে-বাজাতে ডাকল কৃষ্ণাকে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে কৃষ্ণা যেন ছুটে সিঁড়ির কাছে চলে গেল। অমল লীলাকে চেনে—প্রায় রোজই সে এ-বাড়িতে কৃষ্ণাকে ডাকতে আসে, কৃষ্ণার বন্ধু। অত্যন্ত চঞ্চল সপ্রতিভ মেয়ে। দোলনায় যখন দোলে মনে হয় দড়ি ছিঁড়ে শূন্য থেকে ছিটকে পড়বে; সাইকেল চালায় এত জোরে যে ভয় হয় হুড়মুড় করে কারো গায়ে গিয়ে পড়ল বুঝি। মেয়েটা নাকি দু-বার হাত ভেঙেছে। একদিন অমল ওর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেছিল। বেশ ভাল খেলে লীলা। কৃষ্ণাদের স্কুলের প্লেয়ার।
লীলারা কাছেই থাকে। এ-বাড়ির পরের পরেরটায়। ওরা বুঝি দিল্লির লোক। লীলার বাবা এখানকার কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল। মেসোমশাই বলেন, এবার প্রিন্সিপ্যাল হবে, খুব কাজের লোক।
কৃষ্ণা এবং লীলা দুজনে কি বলাবলি করল। তারপর কৃষ্ণা বারান্দার দিকে ফিরল, তরতর করে চলে গেল। লীলা বারান্দা থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ভাইজী নমস্তে। বলে হাসল। অমলও হাসল। সামান্য পরেই কৃষ্ণাকে ঘর থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখল অমল।
তারপর দুই বন্ধু সাইকেলে চেপে চোখের পলকে উধাও। কয়েকটা পাখি ছিল বাগানে। একে অন্যের ডানায় ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর দিচ্ছিল, খাবারের দানা খুঁটে নিচ্ছিল মুখ থেকে। তারা কেউ গাঁদাফুলের ঝোপের দিকে চলে গেল, কেউ উড়ে কলাগাছের পাতার আড়ালে গিয়ে বসল। কাক ডাকছিল কোথাও। অমলের হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ল। মাকে চিঠি লিখতে হবে আজ। বউদিকেও চিঠি দিতে হবে। আসবার সময় বউদি বলেছিল, তোমার ভাল লাগবে না ও-সব জায়গা, দু-দিন পরেই পালিয়ে আসবে; তার চেয়ে বেনারসে দিদিমণির কাছে যাও, দু-মাস তবু থাকতে পারবে। বউদিকে লিখতে হবে, এই জায়গাটা অমলের খুব ভাল লাগছে। দু-মাস সে এখানে অনায়াসে থাকতে পারবে। শরীর সেরে গেলে ফেরার সময় অমল জব্বলপুর যাবে, মন্টুমামার কাছে ক’দিন থাকবে, তারপর বাড়ি ফিরবে। ততদিনে জানুয়ারি মাস পড়ে যাবে। মার্চ-এপ্রিল থেকে অমলের আবার তোড়জোড় শুরু, রেলের মেকানিক্যাল ওআর্কশপে তিন বছর ট্রেনিং নিতে হবে। বাবা বলেছেন, ভাল করে কোর্সটা শেষ করতে পারলে প্রসপেক্ট রয়েছে। অমলের ইচ্ছে, বাবার মতন সেও রেলের চাকরিতে থাকে, বাবার মতন অফিসার হয় একদিন।