অমল চায়ের জন্যে খাবার-টেবিলে চেয়ার টেনে বসতে যাচ্ছিল; হিমানী বললেন, “তুমি বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসো, কৃষ্ণা চায়ের জল নিয়ে যাচ্ছে।”
হিমানীমাসি যে অসন্তুষ্ট হয়েছেন বা বিরক্ত হয়েছেন এমন কিছু বোঝা গেল না। তবু নিজের কাছে নিজেই যেন একটু লজ্জা পেল অমল; বলল, “ঘুম ভাঙতে বড় দেরী হয়ে গেল আজ।”
হিমানী খাবারঘরের একপাশে চলে গিয়ে বড় মতন র্যাকে হাত দিলেন, বললেন, “সকালে উঠে বেড়ালে শরীর ভাল থাকবে।”
অমল আর কিছু বলল না। এই ঘর তার বড় স্যাঁতসেঁতে লাগছিল। আলো প্রায় নেই, রোদও ঢোকে না। বারান্দায় গিয়ে রোদে বসার জন্যে সে উঠে পড়ল।
বারান্দায় যাবার সময় অমল বসার ঘরের মধ্যে দিয়ে গেল। দেখল, অর্গানের ঢাকনা বন্ধ, ঘরে কেউ নেই। দরজা জানলায় নেটের কাজ-করা সুন্দর পর্দা, পাতলা আলো আসছে ঘরে, ছায়া জমে আছে হালকা। ডানদিকে ড্রয়ার, ড্রয়ারের মাথায় র্যাক, ফুল তোলা, র্যাকের ওপর লেসের ঢাকনা, ফুলদানি, ঘড়ি, একটি ধূসর ফটো এবং মার্বেল পাথরের কয়েকটা টুকটাক খেলনা সাজানো। ঘড়ির শব্দটা হঠাৎ যেন কানে গেল। ঘরের প্রত্যেকটি জানলার খড়খড়ি খোলা, শার্সি গুটানো; পরদাগুলো পরিচ্ছন্নভাবে টাঙানো রয়েছে। মধুর মৃদু এক গন্ধ আছে বাতাসে। বোধহয় ধূপ জ্বালানো হয়েছিল। বেতের সোফায় ভ্রমরের বেড়াল গা গুটিয়ে ঘুমোচ্ছে। সামনের দেওয়ালে দরজার মাথায় মেহগনি কাঠের সুন্দর যীশুমূর্তি, ক্রশবিদ্ধ যীশু। এই মূর্তিটার পায়ের তলায় স্কাইলাইটের আলো এসে পড়েছে। এবং আলোর কাছে দেওয়ালে গাঁথা ফুলের ডাঁটার মত দুটি পেতলের মোমদান।
মাথা ঘুরিয়ে অমল দেওয়ালের অন্য পাশে মেরীর বাঁধানো বড় ছবিটাও দেখল, কি মনে করে কাচের পাল্লা দেওয়া ছোট্ট শো-কেসের মধ্যে একটি রুপোর ক্রুশ, চিনেমাটির খেলনা ও কয়েকটি নকশা-করা সামগ্রী দেখল। মাথার ওপর চিনেমাটির ফুলদানি। ফুলদানিতে বাসীফুল তার চোখে পড়ল না। হিমানীমাসি ফুল বদলে দিয়েছেন।
বারান্দায় এসে দাঁড়াল অমল। ঘরদোরের ঝাপসা আলো থেকে বাইরে এসে তার চোখ মুহূর্তের জন্য যেন অত আলো সহ্য করতে পারল না। সে পলক ফেলল। অমল দেখল, সকালের রোদে সামনের সমস্ত কিছু ভেসে যাচ্ছে। বেলা হয়ে এসেছে বলে রোদ গাঢ় হয়ে আসছে, আলো বেশ ঘন এবং ঝকঝকে। সামনের বাগানের ফুলপাতার গায়ে রাতের হিম শুকিয়ে এল। সবুজ রঙটি বেশ উজ্জ্বল ও নির্মল। ফুলগুলি অতি মনোরম দেখাচ্ছিল। অমল এগিয়ে রোদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
জায়গাটা বাস্তবিকই খুব সুন্দর। তাদের বিহার, বিশেষ করে সে যেখানে থাকে, মধুপুরা এতটা সুন্দর নয়। ছোটনাগপুরে অনেক ভাল ভাল জায়গা আছে, লোকজন বেড়াতে আসে, অমল নিজেও রাঁচি-টাচি গিয়েছে, গিরিডিতে থেকেছে, তবু তার কাছে সি পি-র এই জায়গাটা আরও সুন্দর ও শুকনো লাগছে।
এখানে ভিড় ঘিঞ্জি হই-হই একেবারেই নেই, রাশি রাশি আড়ৎ, গুদোম, মাল-লরির বস্তা নামানো ওঠানো, অফিস কাছারি চোখে পড়ে না। খুব ছিমছাম, পরিষ্কার। এসে পর্যন্ত সে মাছি অথবা মশার উৎপাত দেখতে পেল না। এখানকার মাটি এবং গাছপালার চেহারাও কেমন আলাদা। শক্ত অটি সামান্য কালচে মাটি, কখনও কখনও পাথর মেশানো; তা বলে রুক্ষ চেহারা নয়। জায়গাটা পাহাড়ী। দেবদারু, গাছ অজস্র। শিরীষ এবং ঝাউ গাছও অনেক, শাল গাছও আছে। আরও অনেক গাছ দেখেছে অমল—নাম জানে না। তার সবচেয়ে সুন্দর লাগে ওই গাছগুলো দেখতে—কৃষ্ণচুড়ার মতন পাতা, সেই রকমই ডালপালা অনেকটা, তবে অনেক উঁচু, আর ছাতার মতন মাথাটা ছড়ানো। ঝুরির মতন লম্বা-লম্বা ডাঁটি ধরে, যা নাকি ফল নয়, ফুল। ফুলই হবে, কেননা পাতলা ডাঁটির গায়ে আলতা রঙের আঁশ-আঁশ সুতো জড়িয়ে থাকে। ভ্রমর বলছিল, সারা শীতকাল এখন ওই ফুল ফুটবে, বসন্তের শেষে সব ঝরে যাবে।
বারান্দার ওপর থেকে লাফ মেরে অমল বাগানে নেমে পড়ল। সবুজ ঘাস রোদের আভায় মসৃণ ও মোলায়েম দেখাচ্ছে। গাঢ় হলুদ গাঁদা ফুল ফুটেছে একপাশে, গোল-মতন কেয়ারি করা জায়গাটায় গোলাপ ঝাড়, অন্য পাশে মরসুমী ফুলের চৌকোনো খানিকটা জায়গা। গোলাপফুল ফুটে আছে কয়েকটা; শীতের বাতাস পেয়ে মরসুমী ফুলগুলি থোকা-থোকা ফুটে উঠছে। সাদা আর বেগুনী রঙ মেশানো জুঁই ফুলের মতন ফুলগুলোকে কি যেন বলে ভ্রমররা। নামটা মনে থাকে না। আর একটা ফুল, খইয়ের মতন ধবধবে সাদা আর ছোট-ছোট, গুচ্ছ-গুচ্ছ ফুটে থাকে। তাকে এরা বলে ডিউ-ড্রপস্।
এই বাগানে অমলের খুব পরিচিত কয়েকটা গাছ রয়েছে, নয়ত সে বোকা হয়ে যেত তার মনে হতে পারত, জায়গাটা বুঝি বিদেশ। যেমন ওই কুলগাছ, কুলগাছটা ভরতি হয়ে ফুল ধরেছে। কুলতলার দিকে একেবারে সাদামাটা করবী গাছ কয়েকটা কৃষ্ণা একটা দোলনা টাঙিয়ে রেখেছে ওদিকে—শিরীষ গাছের ডালে।
অমল পায়চারি করতে-করতে দোলনার কাছেই যাচ্ছিল; ডাক শুনে ফিরে তাকাল। কৃষ্ণা ডাকছে।
অমল বারান্দার দিকে ফিরল।
বেতের গোল টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে কৃষ্ণা চেয়ারে বসে আছে। অমল অন্য একটা চেয়ার টেনে বসল।
“ওকি, তোমার মুখে কিসের দাগ ওটা?” অমল কৃষ্ণার ডান গালে কালশিরে পড়ে যাওয়ার মতন দাগ দেখে বলল।
সুজির প্লেট এগিয়ে দিয়েছিল কৃষ্ণা, দিয়ে ডিমের ওমলেটে গোলমরিচ ছড়িয়ে, দিচ্ছিল। বলল, “কীট কেটেছে।”