অমল কোমল ও আলতো করে, ভালবেসে ভ্রমরের চোখের কোলে, গালে আঙুল রাখল। মোমের মতন লাগছিল। সামান্য ভেজা। অমল যেন আঙুল দিয়ে ভ্রমরের চোখের কোলের ভিজে ভাবটুকু মুছে দিচ্ছিল, বলল, “ভ্রমর, তোমায় আজ কেমন যেন দেখাচ্ছে—” বলে ভাবল একটু, “প্রতিমার মুখের মতন।” বলেই অমলের মনে দুর্গাপুজোর বিজয়ার দিনের প্রতিমার মুখ মনে পড়ল।
ভ্রমর নম্র স্নিন্ধ চোখে হাসল। বলল, “খুব বিউটিফুল বললে না যে!”
অমল শুনল; শুনে হাসবার চেষ্টা করল। হাসতে পারল না, যেন এখানকার সমস্ত স্মৃতি ওই একটি কথায় উদ্ভাসিত হল, এবং সঙ্গে-সঙ্গে অনুভব করল, সে এই স্মৃতি থেকে বিদায় নিচ্ছে। অমল ছেলেমানুষের মতন কেঁদে ফেলল, ফুঁপিয়ে-ফাঁপিয়ে, মুখ নীচ করে। ভ্রমরও কাঁদছিল।
ওদের কান্নার মধ্যে গাড়ি স্টেশনের কাছাকাছি এসে গিয়েছিল, তে-রাস্তার মোড়ের কিছু কিছু কোলাহল ভেসে আসছিল।
অমল বলল, “আর একটু পরেই তুমি চলে যাবে।” বলে সমস্ত বুক খালি করে নিশ্বাস ফেলল।
ভ্রমর মুখে তুলে দূরের স্টেশনের আলো দেখতে দেখতে বলল, “আবার আমি ফিরে আসিব।”
অমল কোনো জবাব দিল না।
টাঙাগাড়ি ক্রমশ তে-রাস্তার মোড়ের কাছে এল, তারপরে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল।
অমল কখনও শ্মশানে যায় নি, শ্মশান থেকে ফেরার অনুভূতি তার নেই; তবু, ফেরার পথে তার মনে হচ্ছিল, জীবনের সমস্ত সে যেন কারও হাতে তুলে দিয়ে এসেছে, কার হাতে কে জানে, তবে যার হাতে দিয়ে এসেছে সে অতি নির্মম নিষ্ঠুর হৃদয়হীন; তার দয়ামায়া মমতা নেই, ভালবাসা নেই। ভ্রমরকে নেবার সময় তার একবিন্দু, মমতা হল না।
টাঙাগাড়িটা ফিরে আসছিল। মাত্র একটি টাঙা। পাশে ভ্রমর নেই, কৃষ্ণা আছে। রাত হয়ে আসায় শীত দুঃসহ হয়ে উঠেছে, কুয়াশা নিবিড়, জ্যোৎস্না চলে যাচ্ছে, পথঘাট শূন্য ও খাঁ-খাঁ করছিল। বাতাস ভেঙেছে, ভেঙে হুহু করে মাঠ-ঘাট রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে-ছুটে যাচ্ছে।
অমল অসাড় স্থির হয়ে বসে ছিল। অনেক দিনের বাস-করা সাজানো গোছানো অভ্যস্ত বাড়ি হঠাৎ খালি ফাঁকা হয়ে গেলে যেমন লাগে, অমলের অনেকটা সেই রকম লাগছিল। তার চারপাশে অস্বাভাবিক শূন্যতা; কেউ নেই। কিছু নেই; সে একা—সে একা-একা একটি শূন্য বাড়িতে বসে আছে।
নাগপুরের মেলগাড়ির চাকা যেন ক্রমাগত অমলের মনের ওপর দিয়ে অনেক-গুলি ধারালো ভারী নৃশংস চাকা পিষে দিয়ে চলে যাচ্ছে! অসহ্য কষ্টে এবং যন্ত্রণায় অমল মৃতের মতন পড়ে ছিল। সে অনুভব করতে পারছিল, এই যন্ত্রণার শেষ নেই, হয়ত একদিন সত্যি-সত্যি অমল কিছু করে বসবে।
কৃষ্ণা কি একটা কথা বলল হঠাৎ। অমল শুনতে পেল না। কৃষ্ণা হিহি করে কেঁপে জড়সড় হয়ে বসল। অমল লক্ষ করল না। মনে-মনে সে ভ্রমরকে ভাবল। গাড়ির কামরায় মাঝখানের বেঞ্চে ভ্রমর এতোক্ষণে শুয়ে পড়েছে বোধ হয়, তার চোখের ওপর কামরার হলুদ রঙের বাতিটা জ্বলছে। ভ্রমর শুয়ে-শুয়ে অমলের কথা ভাবছে। গাড়িতে জায়গা করে বসার পর খুব অল্পসময়ের জন্য ভ্রমর অমলকে পাশে পেয়েছিল। একসময় খুব নীচু, গলায় যেন কানে-কানে ভ্রমর বলেছিল, এখন আর আমার যেতে ইচ্ছে করলে না।’ তারপর খানিকটা পরে ফিস-ফিস করে বলেছিল, ‘এই, তুমি কিন্তু এখন কাঁদবে-টাঁদবে না; বাবা রয়েছে; তুমি কাঁদলে আমিও…’ কথাটা ভ্রমর শেষ করে নি।
ভ্রমর কি এখন শুয়ে-শুয়ে মুখ ঢাকা দিয়ে কাঁদছে? কে জানে। অমল বুক ভেঙে নিশ্বাস ফেলল। সে একবার রাস্তা ও মাঠের দিকে তাকাল, জ্যোৎস্না মরে এল, সামান্য দূরে সবজিক্ষেতের দিকে বুঝি কয়েকটি জোনাকি উড়ছে, অমলের দেওয়ালির দিনের কথা মনে পড়ল, ময়দানে জোনাকি-বাজি দেখেছিল দুজনে পাশাপাশি বসে…।
চোখের ভুল, মনের অতি নিভৃত জগৎ থেকে যেমন করে স্বপ্ন উঠে আসে —ভ্রমরও সেই রকম উঠে এল, এসে সেই মত জ্যোৎস্নায় কনকনে শীতে অমলের টাঙাগাড়ির পাশে-পাশে চলতে লাগল যেন। অমল ভ্রমরের মুখ দেখতে পাচ্ছিল না, হাওয়ায় ভেসে-ভেসে চলেছে। ছুটেছে যেন। অমল সেই মুখ দেখতে লাগল। কয়েক দন্ড পরেই হারিয়ে গেল ভ্রমর।
কৃষ্ণা আবার কি একটা কথা বলল, অমল খেয়াল করল না। ঘোড়াটা পিছনের পা তুলে লাফিয়ে উঠেছিল বলেই হয়ত কৃষ্ণা টলে পড়ে যেতে-যেতে অমলের হাত ধরে ফেলেছিল। আবার ঠিক হয়ে বসল। অমল মাঠের দিকে তাকাল, জ্যোৎস্নার গায়ে-গায়ে ছায়ার মতন অন্ধকার এসে যাচ্ছে।
এ বড় আশ্চর্য যে, অমল এখন অনুভব করছিল, তার কোথাও কেউ নেই, সে আত্মীয়-স্বজনহীন; একমাত্র ভ্রমরই তার আত্মীয় ছিল, নিজের ছিল, ভ্রমর না থাকায় সে সম্পূর্ণ একা তার কোনো আশ্রয় নেই তাকে ভালবাসার কেউ নেই।
ভালবাসা যে কতটা দেয় অমল এই মুহূর্তে তা অনুভব করতে পারছিল, তার মনে হচ্ছিল, সুখের সমস্তটা এই ভালবাসা—বাঁচার সবটুকু এই ভালবাসা —ভাল লাগার যা কিছ, ভালবাসার মধ্যে। ভ্রমর ঠিকই বলত আমরা বড় নিষ্ঠুর, ভালবাসা জানি না।’
ভালবাসা যে জানে সে ভ্রমরের মতন। ভালবাসা জানলে ভ্রমরের মতন অসুখ করে, ভগবান ভ্রমরের মতন অসুখ দেয়, যে অসুখে রক্তের লালটুকু মরে যায়, মরে গিয়ে মানষ ফ্যাকাশে হয়ে ঠান্ডা হয়ে ভুগে-ভুগে মরে যায়।
দাঁত দিকে ঠোঁট কামড়ে ধরল অমল। তার গলায় বুকে আক্রোশ এবং কান্না থমথম করছিল। কিন্তু অতি কষ্টে সে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করল। ভ্রমর তাকে কাঁদতে বারণ করেছে, বলেছে, দুঃখ করো না, আমি আবার ফিরে আসব।