অমলের মনে পড়ল না। মনে করার চেষ্টাও সে করল না। দুঃখকে সে সত্যিই ভালবাসে না। কে ভালবাসে! অমল বলল, “দুঃখকে কেন ভালবাসব! কোন লোক ভালবাসে!”
“কেউ বাসে না। কিন্তু দুঃখ ত আছেই। নেই?”…আমার মা বরাবর দুঃখী ছিল। আমিও দুঃখী ছিলাম। ছিলাম না?”
অমল ভ্রমরের মাথায় চিবুক ছোঁয়াল। তার গলার তলায় ঠাণ্ডা কনকনে ব্যথা লাগছিল, বুকের সবটুকু ফাঁকা—যেন এক মুঠো বাতাস একটা ঘরের মধ্যে ছটফট করে উড়ে বেড়াচ্ছে, পথ পাচ্ছে না বাইরে আসার।
“দুঃখীদের জন্যে বাইবেলে অনেক কথা আছে।” ভ্রমর অতি মৃদু, গলায় বলল। নিজেকে এবং অমলকে যেন ভরসা দিচ্ছে, “তোমার দুঃখ হবে, কিন্তু দুঃখই এক-দিন আনন্দ হয়ে দেখা দেবে।—যীশু বলেছিলেন, এখন দুঃখে সও, কিন্তু আমি আবার এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব, তখন সুখী হবে।” আই উইল সি ইউ এগেইন অ্যান্ড ইওর হার্ট শ্যাল রিজয়েস—কথাটা ভ্রমর এখন পরম বিশ্বাসে মনে মনে বলল, বলে শক্তি পেল, সাহস পেল।
অমল ভাবল, বলে—তোমাদের যীশু, কিন্তু আর আসেন নি। কিন্তু অমল বলল না, এমন কি কথাটা সে মোটেই ভাবল না। বাইবেল বা যীশু সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ এখন নেই।
“যে ক’দিন আমি না থাকি তুমি কৃষ্ণার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে খেলেটেলে সময় কাটিয়ো; তারপর ত আমি ফিরে আসছি।” ভ্রমর বলল।
কথাটা আচমকা অমলের কানে অন্য রকম শোনাল। সে ঠিক বুঝল না, স্পষ্ট করে বুঝতে পারল না, তবু, মনে হল ভ্রমর যেন বলছে, ভ্রমর একদিন না একদিন ফিরে আসবে, না-আসা পর্যন্ত অমলকে অন্য সঙ্গী নিয়ে সময় কাটাতে হবে। অমলের ভাল লাগল না। সংসারের কোনো অতি নিগৃঢ় ও সত্য কথা বয়সকালে অনুভব করতে পারলে মানুষ যেমন বিষণ্ণ হয়, অসহায় বোধ করে, এবং অক্ষম অভিমানে কাঁদে, অমল এই বয়সে সেই রকম কোনো সত্য অনুভব করতে পেরে কাতর ও ক্ষুদ্ধ হচ্ছিল।
দু-পাশে ফাঁকা মাঠ পড়েছে। মাঠের কোথাও কোথাও ক্ষেতী। শাকসবজির ছোট ছোট ক্ষেত। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। মাঠ মাটি সবজি-ক্ষেত এবং শূন্যতার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, চাঁদের আলো আরও নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে, বাতাসও উঠছে। নখের মতন সাদা লাগছিল জ্যোৎস্না, ধোঁয়াকালির মতন দেখাচ্ছিল ক্ষেতক্ষেতী।
অমল হঠাৎ ডাকল, “ভ্রমর—।”
ভ্রমর অমলের কাঁধের ওপর মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে চলেছে। সাড়া দিল মুখ বন্ধ করেই।
“আমি একদিন একটা কিছু করে বসব।” অমল আবেগবশে বলল।
ভ্রমর বুঝল না। বলল, “কি করবে?”
“জানি না। আমার কিছু ভাল লাগছে না।…আমি একদিন মরে যাব।”
অমলের কাঁধ থেকে ভ্রমর মাথা সরিয়ে নিল। অবাক হচ্ছিল সে। মাথা সরিয়ে অমলের দিকে তাকাল ভ্রমর। “কি বলছ! কি বাজে কথা ভাবছ! মরে যাবে কেন?”
“কষ্ট আমার ভাল লাগে না। এত কষ্ট আমি সইব না।”
“আমার জন্যে কষ্ট?”
“হ্যাঁ।…তুমি না থাকলে আমি কিছু কেয়ার করি না। আমি যীশু-টীশু, জানি না, ভগবান আমার কি করবে! আমি দেখব, আমি দেখব ক’দিন—তুমি ফিরে না এলে তারপর দেখো কি করি। অমলের গলার স্বর বিকৃত হয়ে গিয়েছিল—যন্ত্রণায়, কান্নায়, আবেগে, হাহাকারে।
“আমি ফিরব না কেন?” ভ্রমর বলল, বলে অমলের চোখের দিকে স্থির অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল। যেন সে বুঝতে পারছে না, অমল কেন ও-কথা বলল, কেন বিশ্বাস করতে পারছে না ভ্রমর ফিরে আসবে!
ভ্রমরের দৃষ্টি সহসা অমলকে সতর্ক ও সচেতন করল; সে বুঝতে পারল তার ও-কথা বলা ভুল হয়ে গেছে, ভীষণ ভুল; আর-একটু, হলেই হয়ত ভ্রমর সন্দেহ করত, জানতে পেরে যেত। অমল আবার ভয় পেল, ভয় পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। জবাব দিল না কথার।
“বললে না?” ভ্রমর আবার বলল।
“কি?”
“আমি নাগপুর থেকে ফিরব না কেন? ওখানে আমার কে আছে?”
“জানি না। এমনি বলেছিলাম।…আমার কিছু ভাল লাগছে না। খারাপ লাগছে।” বলেই অমল আর দেরী করল না, বলল, “ভ্রমর, আমি খুব ভীতু, আমার হাসপাতাল শুনলে ভয় হয়।”
“তোমার একটুও বিশ্বাস নেই।”
“কে বলল নেই…”
“তাহলে ভগবানকে ও-রকম কথা আর বলো না। তুমি আমি তাঁকে দেখি না, তিনি অনেক দুরে বলে, কিন্তু তিনি আছেন। তিনি না থাকলে আমি তোমায় দেখতাম না কোনোদিন, তুমি আমায় দেখতে পেতে না।”
অমল নীরব, তার শরীরের স্নায়ুগুলি কাপছিল, তার বুকের মধ্যে আশ্চর্য এক অনুভব এসে ধোঁয়ার পঞ্জের মতন ফেনিয়ে উঠছিল। অমল কিছু বুঝতে পারছিল না, অথচ তার অনুতাপ হচ্ছিল, দুঃখ হচ্ছিল।
ভ্রমর বলল, “আমি যখন নাগপুরে থাকব তুমি কি আমায় দেখতে পাবে?”
“না।”
“আমিও তোমায় দেখতে পাব না।…তবু, তুমি আমার কথা ভাববে সব সময়, আমি তোমার কথা ভাবব।”
“আমিও সারাক্ষণ তোমায় ভাবব, ভ্রমরঃ সকালে দুপুরে রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও।” অমল ছেলেমানুষের মতন বলল।
“আমিও ভাবব।…ভগবানকেও তুমি ভেবো, দেখতে পাবে না, তবু ভেবো। দূরে যে থাকে তাকে অবিশ্বাস করতে নেই।”
অমলের মনে পড়ে গেল কথাটা। ভ্রমর বলেছিল একদিন, সব ভাল জিনিসই দূরের, অনেক দুরের। ভগবান দূরে থাকেন। ভালবাসাও বোধ হয় ভগবানের মতন দূরে থাকে। অমল মুখ তুলে ভ্রমরকে দেখল। চাঁদের অমন মলিন আলোতেও ভ্রমরের মুখ হিমে-ভেজা ফুলের মতন দেখাচ্ছে, ক্ষীণ শীর্ণ কিন্তু পবিত্র, মলিন অথচ সুন্দর। ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে অমলের মনে হল, ভ্রমরের দুঃখ হচ্ছে, সে কাতর কিন্তু তার ভয় নেই, দ্বিধা নেই, সে জানে সে ফিরে আসবে। যেন তার অসুখ সত্যিই বাইবেলের লাজার-এর মতন, মৃত্যুতে যার শেষ নেই, সত্যিই ভগবানের মহিমার জন্যে এই অসুখ।