“হ্যাঁ।” ভ্রমর মাথা নাড়ল আস্তে করে। তার কাঁপুনি লাগছিল খুব। শীত করছিল। চোখ করকর করছে। নিশ্বাসও গরম। আজ আবার তার জ্বর এল।
কলেজ পেরিয়ে এল টাঙাটা। রাস্তায় কারা যেন পোড়া ফানুস ফেলে চলে গেছে, তখনও জ্বলছিল। কিংবা ফানুসটা উড়তে-উড়তে আগুন ধরে গিয়ে এখানে এসে পড়েছে। কোচোআন ঘোড়ার লাগাম টান করে মোড় ঘুরে ডান হাতি পথ ধরল।
ভ্রমর বুকের কাছে স্কার্ফ জড়িয়ে যখন কাঁপুনি সইছিল তখন হঠাৎ কেমন অস্ফুট শব্দ করল।
অমল মুখ ফিরিয়ে তাকাল। “কি হল?”
ভ্রমর গলা আর বুকের কাছটায় কি যেন খুঁজছিল।
“কি হয়েছে?” অমল আবার শুধলো।
“লকেটটা পাচ্ছি না।” ভ্রমর উদ্বিগ্ন ও ভীত গলায় বলল।
“পাচ্ছ না? হারের লকেট?”
ভ্রমর বুঝতে পারছিল না তার গলার হার থেকে সোনার ক্রশটা কেমন করে কখন খুলে পড়ল? বড় ব্যস্ত ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিল ভ্রমর।
“লকেটটা কি আলগা ছিল?” অমলও ব্যস্ত হল একটু।
“ঢিলে ঢিলে ছিল।”
“তবে জামাকাপড়ের মধ্যে পড়েছে কোথাও। নামবার সময় খুঁজে দেখব।”
ভ্রমর তখনও লকেট খুঁজছিল। খুঁজতে-খুঁজতে চাপা গলায় বলল, “মাকে বলো না। হারিয়ে গেছে শুনলে আমায় বকবে।”
বাড়ির গেটের কাছে গাড়ি এসে দাঁড়াল।
২
ভ্রমর ডাকছে শুনে অমল চোখ মেলে তাকাল। তার ঘুম ভাঙল; দেখল, রোদ এসে ঘর ভর গেছে, একটা চড়ুইপাখি ঘরময় ফরফর করে উড়ছে। ভেতর দিকের জানলার ওপাশে পরদা-ঘেঁষে ভ্রমরের মুখ দেখা গেল না। ঘরের দরজা বন্ধ; বাইরের দিকের উত্তরের জানলাটাও খোলা নয়। পুবের জানলার শার্সি একপাট ভেজানো, অন্য পাট খোলা; রোদ আসছে গলগল করে।
বেশ বলা হয়ে গেছে, অমল বুঝতে পারল। অন্য দিন ভ্রমর তাকে রোদ ওঠার সময় জাগিয়ে দেয়। আজ কি ভ্রমর তাকে ডাকতে বেলা করল, নাকি অনেকবার এসে ডাকাডাকি করেছে, অমল উঠছে না দেখে চলে গেছে শেষ পর্যন্ত? অমল সঠিকভাবে কিছু বুঝতে পারল না। তার মনে হল, ভ্রমর অত তাড়াতাড়ি চলে যায় না, অমল জেগে উঠলে জানলার ও-পাশে দাঁড়িয়ে দু-একটা কথা বলে।
বিছানা ছেড়ে উঠতে-উঠতে অমল ভাবল, সে ঘুমের মধ্যে ভ্রমরকে ডাকতে শুনেছে। আজ ভ্রমর তাকে ডাকতে আসে নি; জ্বর গায়ে বেচারী হয়ত এখনও বিছানায় শুয়ে আছে।
শার্ট গায়ে গলিয়ে পুরোহাতা পুলওভারটা পরে নিল অমল। বেশ ঠাণ্ডা। কালকের হিম খেয়ে সামান্য সর্দি মতন হয়েছে। উত্তরের জানলাটা অমল খুলে দিল, হিমভেজা শীতল বাতাসের স্পর্শ তার ভাল লাগল, দু-মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সে এই সকালের ঠাণ্ডাটুকু মুখেচোখে মেখে নিল।
বাথরুমে যাবার সময় অমল অর্গানের শব্দ শুনতে পেল; বসবার ঘরে বসে কেউ অর্গান বাজাচ্ছে। নানা পথ ঘুরে অনুচ্চ ভাঙা-ভাঙা সুর ভেসে আসছে করিডোরে। হিমানীমাসিমা, ভ্রমর না কৃষ্ণা কে যে সকালবেলায় অর্গানে গিয়ে বসেছে অমল বুঝতে পারল না। যদি ভ্রমর হয়, অমল ভাবল, তবে তার শরীর ভাল আছে।
কাল বাড়ি ফেরার পর ভ্রমরের সঙ্গে আর দেখা হয় নি। ভ্রমর সোজা নিজের ঘরে শুতে চলে গিয়েছিল। রাত্রে খাবার সময়ও সে আসে নি। কৃষ্ণা বলল, মাথা ধরেছে ভ্রমরের। শুনে আনন্দমেসোমশাই বললেন, বাজি পোড়ানোর বারুদের গন্ধে বড় মাথা ধরে। অমল কিছু বলে নি; ভ্রমর তাকে যা-যা বলেছিল, জ্বর হবার কথা না-বলা, লকেট হারানোর কথা না-জানানো—সব নিষেধই মেনেছে। লকেটটা কি সত্যিই হারিয়ে গেল? কি করে হারাল, আশ্চর্য! ভ্রমর যদি জামার মধ্যে লকেটটা পেয়ে গিয়ে থাকে তবেই রক্ষে—নয়ত তাকে বকুনি শুনতে হবে। ভ্রমর লকেটটা পেয়েছে কিনা জানতে ইচ্ছে হল অমলের। দেখা না হওয়া পর্যন্ত সে কিছুই জানতে পারবে না।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে আসার সময় অমল অর্গানের শব্দ আর শুনতে পেল না। সমস্ত বাড়ি সহসা খুব নিঃশব্দ হয়ে গেছে। করিডোর ছায়ায় ভরা; সামনের বাঁ দিকের ঘরে মোটা পরদা দুলছে। ও-ঘরে ভ্রমররা থাকে, ঘরে ভ্রমর আছে কিনা বোঝা গেল না। কোনো সাড়া শব্দ নেই কোথাও।
ঘরে এসে অমল মুখ মুছল, চুল আঁচড়ে নিল। মাথার ওপর এখন দুটো চড়ুইপাখি ভেন্টিলেটারের গর্তে বসে কিচমিচ করছে। বিছানার ওপর কুটো ফেলছে চড়ুই দুটো। অমল ঘর ছেড়ে চলে গেলে হয়ত ওরা আবার কুটোটা কুড়িয়ে নিয়ে যাবে। আজ ক’দিন ধরে এই ঘরে ওরা একটা বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে।
পাজামা সামান্য ঠিক করে নিল অমল। হাত ঘড়িটা তুলে নিয়ে বেলা দেখল। ইস্ আটটা প্রায় বাজে। কাল একেবারে মরার মত ঘুমিয়েছে। ঘড়িতে দম দিতে-দিতে অমল চায়ের জন্যে খাবারঘরের দিকে চলে গেল।
বেশ বেলা হয়ে যাওয়ায় খাবার টেবিল থেকে চায়ের ব্যবস্থা তুলে ফেলা হয়েছিল। ঘরে কেউ ছিল না। অমল কি করবে, কাকে ডাকবে ভাবছিল, এমন সময় হিমানীমাসির পায়ের শব্দ পেল।
হিমানী ঘরে এলেন। তাঁর গায়ে মেটে লাল রঙের গরম চাদর। পায়ের দিকে মাটি লেগেছে শাড়িতে। মিলের সরু পাড়অলা সাদা শাড়ি বা চিকনের সাদা শাড়ি ছাড়া হিমানীমাসিকে আর কিছু পরতে দেখে না অমল। বাইরে বেরুবার সময় সিল্ক পরেন, হয় পাড়ে সরু কাজ করা সাদা সিল্ক, না হয় খুব নরম রঙের ছাপা কোন শাড়ি। ওঁর রঙ আধ-ফরসা, বেশ মোটাসোটা চেহারা; মুখের গড়নটি গোল। মোটা চাপা নাক, ঠোঁটেরও খুঁত আছে, ওপর ঠোঁটের ডানদিকে সামান্য কাটা দাগ। হিমানীমাসীর মাথার পাশের চুলগুলি সাদা হয়ে এসেছে। সিদুঁর নেই মাথায়। অমলের প্রথম-প্রথম খুব খারাপ লেগেছিল। ওঁর চোখে চশমা থাকে সর্বক্ষণ, তবু অমল তাঁর গোল নিষ্প্রভ চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে পারে, হিমানীমাসি বেশ শক্ত স্বভাবের মানুষ। বড় গম্ভীর, বেশী কথা বলেন না।