“গল্প কেন!…তুমি কিছু বিশ্বাস কর না। ভগবানকে যে ভালবাসে সে মরে না, ভগবান তাকে বাঁচান।” ভ্রমর এমন সরল গলায় বলল যেন ভগবান তাকে বাঁচাবেন, না বাঁচালে তিনি মহিমান্বিত হবেন না।
অমল কিছু বলল না। ভগবান কি সত্যি এত দয়ালু! অমল কেমন বিতৃষ্ণা এবং রাগের সঙ্গে ভাবল, ভগবান এত দয়াল, বলেই কি তোমায় অসুখে ভোগাচ্ছেন? কেন তোমার মা নেই, ভ্রমর? কেন হিমানীমাসি তোমায় এতকাল অযত্ন করে এসেছেন? অমল ভগবানের ওপর রাগ এবং ঘৃণার চোখ করে তাকাতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হঠাৎ ঝোথায় বাধা পেল, ভয় পেল। তার মনে হল, কি দরকার, ভ্রমর হাসপাতালে যাচ্ছে, ভগবান দয়ালু, হোন না-হোন, নির্দয় হতে পারেন; যদি তিনি অসন্তুষ্ট হন, ভ্রমরের ক্ষতি হতে পারে। অমল আর ও-বিষয়ে ভাবতে চাইল না।
টাঙাগাড়ি মোতি রোডের প্রায় শেষাশেষি এসে গিয়েছিল। আনন্দমোহন-দের গাড়িটা একটু তফাতে চলে গেছে। ঘোড়াটা হয়ত বেশী তেজী। অমলদের ঘোড় সমান তালেই ছুটেছে, তার সারা গায়ের মচমচ শব্দ বাতাসে বাজছে, কান না করলে শোনা যায় না, গলার ঘন্টি এই নির্জনতায় ঝুমঝুম ঝুমঝুম করে নিরবচ্ছিন্ন একটি সুর সষ্টি করে যাচ্ছিল। আকাশে চাঁদটি কোথায় রয়েছে অমলরা দেখতে পাচ্ছে না, টাঙার মুখ না ফেরা পর্যন্ত পারে না, জ্যোৎস্না আরও অস্বচ্ছ হয়ে আসছে বুঝি, ময়লা তুলোর মতন দেখাচ্ছে, যেন প্রাণ নেই; কুয়াশা হিমে আলোর কণাগুলি ভিজে থাকায় আলোক ফুটছে না। মোতি রোডের বাড়িগুলি নিস্তব্ধ, এক একটি পাঁচিল এবং বাগান পেরিয়ে এলে মনে হচ্ছে ভৌতিক অসাড় কোনো বাসস্থান পার হয়ে এল গাড়িটা।
ভ্রমর আরও একটু, সরে এল অমলের দিকে, ঠান্ডা লাগছিল ঘাড়ের কাছটায়। অমল ভ্রমরের পোশাকের স্পর্শ অনুভব করতে পারছিল, এমন কি ভ্রমরের গায়ের ভার তার গায়ে লাগছিল।
ভ্রমর বলল, “তোমার মুখ দেখলে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।” বলে অনেকটা যেন অভিমান করার মতন করে ঠোঁট মুখ ফোলাল, চোখের দৃষ্টি ক্ষুব্ধ করল, “তুমি যখন যাবে তখন আমার মন খারাপ হবে না? তবে!”
অমল ব্যথিত উদাস চোখ ভ্রমরের চোখে রাখল। জ্যোৎস্নার মরা আলোয় ছায়ায় ভ্রমরকে স্বপ্নের মতন দেখাচ্ছে। আছে, তবু যেন নেই; খুব কাছে অথচ অনেকটা দূরের মানুষ। অমল এই মূহূর্তে বোধ হয় নিজের কাছে কোনো রকম বিশ্বাস ও সান্ত্বনা পেতে চাইল। হাত বাড়িয়ে ভ্রমরের কোলে রাখল। রেখে মনে হল, ভ্রমর তার সামনে তার পাশেই রয়েছে। অমল কোনো কথা বলতে পারল না।
“আমি ফিরে আসার পরও তোমার যাওয়া হবে না।” ভ্রমর গাঢ় গলায় বলল, “একেবারে মাসের শেষে যেও, জানুআরির শেষে।”
অমল এই মুহূর্তে বিশ্বাস করল ভ্রমর ফিরে আসবে, জানুআরির শেষ পর্যন্ত থেকে যাবার কথাও সে ভাবল। বলল, “বাড়িতে লিখতে হবে।”
“লিখে দিয়ো। তোমার তাড়াতাড়ি কি, চাকরি করতে যাচ্ছে না ত, তবে—!”
অমল চুপ করে থাকল। কয়েকটা দেবদারুগাছের ছায়ার তলা দিয়ে টাঙাটা এগিয়ে এল, এগিয়ে এসে বাঁ-হাতি মোড় ঘুরল। সাইকেলের অতি ক্ষীণ আলো ফেলে এক জোড়া লোক এ-সময় তাদের পেরিয়ে উলটো মুখে চলে গেল। কোচোআন পা দিয়ে ঘন্টি বাজাল বারকয়েক, তার মনে হয়েছিল সামনে কেউ রয়েছে, বস্তুত কেউ ছিল না, কুয়াশার মধ্যে একটা ভাঙা ঝুড়ি মানুষের মতন দেখাচ্ছিল, যেন কোনো মানুষ রাস্তার পাশ ঘেঁষে বসে আছে।
তফাত-তফাত কয়েকটা একতলা বাড়ি পেরিয়ে ফাঁকায় পড়ল ভ্রমরদের গাড়ি। সামান্য দূরে আনন্দমোহনদের টাঙা ছটছে। ফোটা-ফোটা দুটি আলোর বিন্দু, চোখে পড়ছিল।
ভ্রমরই আবার কথা বলল। “আমার ঘরে তোমার সেই কালো মোজা দুটো পড়ে আছে, গোড়ালি সেরে রেখেছি, নিয়ে নিয়ো।”
অমল সাড়া দিল না। ভ্রমরকে সে দেখছিল না, রাস্তা দেখছিল। রাস্তাটা যেন পায়ের তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রমাগত চলে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলোয় মোরম-পেটানো এই রাস্তা ঘোলাটে দেখাচ্ছিল, কোথাও-কোথাও পাথরের গুঁড়ো সামান্য চকচক করছে। অমলের মনে হচ্ছিল, তাদের পায়ের তলা দিয়ে ঘোলাটে জল বয়ে যাচ্ছে।
“তুমি একটাও কথা বলছ না।” ভ্রমর বলল।
হুঁশ করল অমল। “বলছি ত!”
“কই বলছ? চুপ করে বসে আছ।”
অমল মুখ তুলে ভ্রমরের দিকে তাকাল। নিশ্বাস ফেলল বুক হালকা করার জন্যে। “আমার কিছু ভাল লাগছে না।”
ভ্রমর নিবিড় ও অতি বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল। টাঙার মুখ ঘুরে যাওয়ায় সামান্য জ্যোৎস্না ভ্রমরের কাঁধ ও গলার কাছে এসে পড়েছে। মুখ আরও একটু পরিষ্কার দেখাচ্ছিল। কোলের ওপর থেকে অমলের হাত তুলে নিয়ে ভ্রমর সান্ত্বনা দেবার গলায় বলল, “আমারও কি ভাল লাগছে!”!
“জানি—” অমল ছোট্ট করে বলল, বলল—কেননা ভাবল, এটা তার বলা উচিত।
“আমি একটা কথা বলব—?” ভ্রমর অল্প করে বলল আবার।
“কি?”
“তুমি মন খারাপ করো না।” বলে ভ্রমর কি ভাবল সামান্য, “তুমি এখন দুঃখ পাচ্ছ, ক’দিন পরে আমি আবার ফিরে আসব, তখন দুঃখ থাকবে না।”
অমল ভ্রমরের মুঠো থেকে হাত সরিয়ে নিজের মুঠোয় হাত ধরল ভ্রমরের। শক্ত করে ধরে থাকল। যেন সত্যি-সত্যি সে বিশ্বাস করতে চায় ভ্রমর ফিরে আসবে, ভ্রমর ফিরে এলে তার দুঃখ থাকবে না।
ভ্রমর অমলের কাঁধের পাশে মাথা রাখল। টাঙাটা আর দুলছে না, সমান গতিতে চলছে, চাকার শব্দ, ঘোড়ার শরীরের শব্দ, ঘণ্টির শব্দ—সব মিলে মিশে পৃথক একটি জগৎ রচনা করেছে এখন। ভ্রমর এই বিচ্ছিন্ন এবং অতি নিভৃত জগতের মধ্যে বসে অমলকে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করতে পারছিল। এবং এই মুহূর্তে সে বিচ্ছেদ বেদনা দুঃখকে নগণ্য ও মিথ্যা করল। বলল, “দুঃখ তুমি ভালবাস না। একদিন এই টাঙাগাড়িতে বসে বলেছিলে, মনে আছে—সেই যে আমরা যেদিন বাজার থেকে ফিরছিলাম।” বলে ভ্রমর অপেক্ষা করল, যেন অমলকে মনে করতে সময় দিল।