অমল সামান্য মুখ তুলল। সে মনে-মনে কতবার শক্ত ও স্থির হবার চেষ্টা করেছে, পারে নি। এখন সে খুব ভয় এবং ব্যাকুলতার মধ্যে শক্ত হবার চেস্টা করল। ভ্রমরের ডাকে একটু, শব্দ করল কোনো রকমে।
“আমার কিসের অসুখ হয়েছে, জানো তুমি?” ভ্রমর জিজ্ঞেস করল।
“না। আমি কি করে জানব!” অমল গলার মাফলার কানের ওপর তুলে দিতে দিতে বলল, কোটের কলারও তুলে দিল। যেন সে ভ্রমরের কাছ থেকে মুখ আড়াল করে রাখতে চাইছে।
“তা হলে—?” ভ্রমর শুধলো, তার গলার স্বরে সন্দেহ ছিল।
“কি?”
“সবাই এ-রকম করছে কেন? বাবা, মা, তুমি—?”
“এ-রকম মানে, কি রকম?” অমল সব জেনেশুনেও ভয়ে-ভয়ে বলল।
“সবাই যে খুব ভয় ভাবনা করছে, ছটফট করছে—”
“করছে! কই…” অমল রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তার মাথায় কোনো রকম বুদ্ধি খেলছিল না। ভ্রমরকে এখন আগাগোড়া সামলে যেতে হবে, মিথ্যে বলতে হবে, ভরসা দিতে হবে। কিন্তু কি করে সামলাবে অমল! তার অত সাহস কোথায়, জোর কোথায়। মনে-মনে অমল ভগবানের কাছে সাহস চাইল।
“এই শোনো—” ভ্রমর সামান্য পরে আবার বলল; অমলের দিকে ঝুঁকে বসল।
“উঁ—”
“আমার অসুখ কি খুব খারাপ?”
“খারাপ! কে বলল খারাপ!”
“তুমি জানো না?”
“না।”
“বাবা তোমায় কিছু বলে নি?”
“না, না।” অমল জড়সড় হয়ে বসল, যেন তার শীত করছে খুব।
অল্প চুপ করে থেকে ভ্রমর এবার হিমানী-মা’র কথাটা বলল, সন্ধেবেলায় কৃষ্ণার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে কি বলেছে হিমানী-মা ভ্রমরকে। অমল নীরবে শুনল। হিমানীমাসির ওপর তার রাগ এবং ঘৃণা হল। এ-বাড়ির সকলের ওপরই অমলের বিরক্তি, রাগ ও ঘৃণা জমেছে কাল থেকে। সবাই মিলে এরা ভ্রমরকে উপেক্ষা করে, একপাশে ঠেলে সরিয়ে রেখে আস্তে-আস্তে মেরেছে, আজ খুব বড় করে স্নেহ দয়ামায়া দেখাতে এসেছে! নিষ্ঠুর, এরা সবাই নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, অমানুষ।
“কি জানি, আমার এক একবার মনে হচ্ছে, আমার খুব কঠিন অসুখ—” ভ্রমর বলল মৃদু, গলায়, হতাশ গলায়। বলে নিশ্বাস ফেলল, দীর্ঘনিশ্বাস। বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল ওকে।
অমল প্রাণপণ নিজেকে ভয় এবং বিহ্বলতা থেকে তুলে নেবার চেষ্টা করছিল, বলল “তোমার সব মনে মনে; নিজেই নিজের অসুখের কথা ভেবে নিচ্ছ।”
“ভাবছি কোথায়! আমার কেমন মনে হচ্ছিল, তাই বললাম।”
“হবেই বা কেন?”
“তোমরা তাহলে এ-রকম করছ কেন?”
“আমি কিছু করি নি—”
অমলের শ্বাসনালী ঠাণ্ডা, বুক শক্ত পাথর-পাথর লাগছিল, তবু, অমল বলল, “আমার একেবারে ভাল লাগছে না, তাই চুপ করে থাকছি।” বলে সামান্য সময় অমল আর কিছু বলল না, শেষে ভ্রমরকে যেন সন্দেহ করতে দেবে না, কোনোরকম, তাই আবার বলল, “হাসপাতাল-টাসপাতাল পাঠাতে হলে মানুষ এমনিতেই একটু, ভয় পায়; তোমর বেলায় আবার বিদেশে, নাগপরে—তাই হয়ত মেসোমশাই মাসিমা ওরকম করছেন।”
ভ্রমর মন দিয়ে শুনল। শুনতে-শুনতে সে মাথায় বাঁধা স্কার্ফটা কানের পাশ থেকে সরিয়ে দিল একটু, যেন অমলের কথাবার্তা সে বাকি সময়টুকু মন দিয়ে শুনতে চায়। ভ্রমর বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম। ডাক্তার দেখানো পর্যন্ত যা ভাবনা, তারপর ত ফিরেই আসব।”
অমল মনে-মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল, যেন তাই হয়; ভ্রমর ফিরে আসে তাড়াতাড়ি। তারপরই সে ভাবল, কাল থেকে অনেকবার অমল বিশ্বাস করতে চাইছে, ভ্রমর ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে আসবে, সুস্থ নীরোগ হয়ে উঠবে। মজুমদার-ডাক্তার এমন কথা ত বলেন নি যে, ভ্রমরের ঠিক ওই রোগটাই হয়েছে। বরং তিনি বলেছেন, তাঁর ভুল হতে পারে; সময় থাকতে সাবধান হবার জন্যেই যা বড় ডাক্তারের কাছে যাওয়া। ডাক্তাররা কি ভুল করে না! হামেশাই করে। অমলের যখন টাইফয়েড হল তখন তাদের মধুপুরার ডাক্তারকাকা প্রথম দশ বারো দিন কখনও বলল ঠাণ্ডা লেগে জ্বর, কখনও বলল ম্যালেরিয়া হতে পারে, কখনও বলল লিভার বেড়ে গিয়ে জ্বর হয়েছে। শেষে টাইফয়েড সাব্যস্ত হল। ভ্রমরেরও সেই রকম হতে পারে, হয়ত রোগটা মোটেই ভয়ের নয়, ঠিক-ঠিক ধরা পড়লে সেরে যাবে তাড়াতাড়ি।
“আমি কিন্তু খুব ভয় পাই নি, জানো…” ভ্রমর বলল হঠাৎ।
অমল মুখ ফিরিয়ে ভ্রমরের দিকে তাকাল। স্কার্ফের মধ্যে ভ্রমরের ছোট্ট মুখ ঘোমটার তলায় বউ-বউ দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো না পড়ায় পরিষ্কার করে মুখটি দেখা যাচ্ছিল না।
“তোমরা যদি ওরকম না করতে আমি একটুও ভয় পেতাম না।” ভ্রমর যেন অমলদেরই সান্ত্বনা সাহস দিচ্ছে এমন গলা করে বলল, “আমার ভয় কম।”
“ভয়-টয়ের কিছু নেই।” অমল খানিকটা সাহস পেয়েছে যেন এতক্ষণে।
“থাকলেও বা কি!…তুমি লাজার-এর গল্প জানো?”
“না, লাজার কে?”
“বাইবেলে আছে। লাজার একটা লোরে নাম, মরিঅমের ভাই। যীশুকে ওরা খুব ভালবাসত, যীশু, ওদের খুব ভালবাসতেন।” ভ্রমর ধীরে ধীরে বলল, “লাজার-এর খুব অসুখ হল, সে মরে গেল, তাকে কবর দিয়ে দেওয়া হল। যীশু তখন অনেকটা দূরে এক জায়গায় ছিলেন। লাজার-এর অসুখের কথা শুনে তিনি বলেছিলেন, লাজার-এর অসুখের শেষ মত্যু নয়, তার অসুখ প্রভুকে মহিমান্বিত করবে।”
অমল মন দিয়ে গল্প শুনছিল না, তবু শুনছিল। তার মনে হল, ভ্রমর বোকার মতন কথা বলছে।
ভ্রমর বলল, “লাজার মারা গিয়েছিল, কিন্তু চার দিন পরে যীশু, তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।”
“এ-সব গল্প!” অমল অন্যমনস্কভাবে বলল।