“না, জ্বর নয়—” ভ্রমর তাড়াতাড়ি বাধা দিল, “আমার এই রকমই হয়।”
“দেখি, তোমার কপাল দেখি—” অমল ভ্রমরের কপাল দেখার জন্যে হাত বাড়াল।
জ্বর যে, তাতে আর সন্দেহ হল না অমলের। জ্বর না হলে মানুষের গা এমন গরম হয় না। অমলের মনে হল, তার ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়ায় ভ্রমর যেন শীতে কেঁপে উঠল, জড়োসড়ো হল আরও।
খুব অন্যায় করছে ভ্রমর। অমল সামান্য উদ্বেগ বোধ করল। জ্বর গায়ে নিয়ে ঠাণ্ডায় হিমে বসে বসে বাজি পোড়ানো দেখল এতক্ষণ! কী রকম বোকা মেয়ে!
“দেওয়ালি দেখে দরকার নেই, বাড়ি ফিরে যাই।” অমল বলল, “টাঙাঅলাকে বাড়ি ফিরতে বলো।”
ভ্রমর বুঝি কুণ্ঠিত হল। “দেওয়ালি দেখবে না?”
“না, আর না।”
“খানিকটা দেখে যাও।”
“আমারও শীত করছে।” বলতে-বলতে অমল তার কোল থেকে স্কার্ফটুকু উঠিয়ে ভ্রমরের কোলে ঠেলে দিল। “গায়ে ভাল করে জড়িয়ে নাও। তুমি একেবারে যা তা! এইভাবে জ্বর গায়ে ঠাণ্ডা লাগায়!”
শহরের মধ্যে গাড়ি এসে পড়েছিল। আলোয় আলো হয়ে আছে সামনেটা। কলরব ও উৎসবের গুঞ্জন কানে আসছিল। আকাশে হাউই উঠে তারা ফুল খসে পড়ছে। বোমা ফাটানোর শব্দ ভেসে আসছিল।
“কই, টাঙাঅলাকে বললে না কিছু?” অমল তাগাদা দিল।
ভ্রমর হিন্দীতে টাঙাঅলাকে পুবের পথ ধরে যেতে বলল। শহরের পাশ কাটিয়ে গেলে রাস্তা অল্প।
উদ্ভাসিত উজ্জ্বল ও উৎসবমুখর শহরটিকে পাশে রেখে টাঙা নিরিবিলি পথ ধরে এগিয়ে চলল।
“বাড়ি গিয়ে আমার জ্বরের কথা বলো না।” ভ্রমর বললে চাপা গলায়।
অমল অবাক হল। “কেন? জ্বর হলে কি তুমি লুকিয়ে রাখো?”
“সব সময় বলি না। মা পছন্দ করে না।”
“বাঃ! অসুখের আবার পছন্দ কি—?”
“কি জানি। মা আমার অসুখে শুনলে রাগ করে।” ভ্রমর যেন মুখে হাত চাপা দিয়ে বলছিল, কথাগুলো অস্পষ্ট ও অতি মৃদু শোনাচ্ছিল।
ভ্রমরকে যেন বোঝবার চেষ্টা করছে অমল, অপলকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছিল। এই রাস্তাটা নিতান্ত অন্ধকার নয়, বাতি আছে ঘন-ঘন, কাছাকাছি-বাড়ি থেকেও আলো এসে পড়ছিল। বাতাস বইছে এলোমেলো, আলোকসজ্জিত গৃহগুলির আলোর শিখা কাঁপছে।
“তোমার কি প্রায় অসুখ করে?” অমল শুধলো।
“করে। আগে করত না; আজকাল মাঝে-মাঝেই করে।”
“কি অসুখ?”
“কে জানে কি অসুখ?”
“ডাক্তার দেখাও না?”
“বেশী হলে দেখাই। বাবা বলেছিল আমায় জব্বলপুরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাবে।”
“জব্বলপর কত দূর?”
“অনেকটা। আমি জানি না। একশো মাইল দেড়শো মাইল হবে…”
“জব্বলপুরে মন্টুমামা থাকে।”
“তোমার মামা?”
“না, আমার কাকিমার ভাই। আমি একবার দেখেছি; আমাদের ওখানে গিয়েছিল, খুব মজার লোক।”
মামার কথা ভ্রমরেরও মনে পড়ল। মা মারা যাবার পর একবার মামা এসে তাকে নিয়ে গিয়েছিল। জায়গাটার নাম মনে করতে পারল না ভ্রমর। চক্ৰধরপুর থেকে কিছুটা যেতে হয়। তখন ভ্রমর ছ’বছর কিংবা সাত বছরের মধ্যে। মামার মুখও মনে পড়ে না। মাথার মাঝখানে সিঁথি ছিল, গোঁফ ছিল, বুক পকেটে ঘড়ি থাকত। মামা রেলগাড়িতে উঠে লাল নীল ফ্ল্যাগ ওড়াত, হুইশল্ বাজাত। মামার কাছে এক-দেড় বছর ছিল ভ্রমর। তারপর মামা রেলে কাটা পড়তে বাবা তাকে নিয়ে এল আবার।
বাবার কাছে ফিরে এসে ভ্রমর দেখল, বাড়িতে দুজন মানুষ; হিমানী-মা আর কৃষ্ণা। বাবা যে হিমানী-মাকে বিয়ে করেছে ভ্রমর বাড়ি এসেই বুঝতে পেরেছিল। কৃষ্ণা তার বাবাকে বাবা বলত, হিমানী-মাকে মা বলত দেখেই ভ্রমর সব বুঝতে পেরেছিল। শুধু বুঝতে পারে নি কৃষ্ণা কি করে হিমানী-মা’র সঙ্গে এল।
পরে সবই বুঝতে শিখল ভ্রমর। তখন তারা যেখানে থাকত সেখানে ভ্রমরের মা’র এক বন্ধু ছিল। মাদ্রাজী বন্ধু। নাম ছিল দেবকী। কৃশ্চান সোসাইটির বাড়িতেই থাকত সিস্টার। দেবকীর কাছ থেকে ভ্রমর অল্পে-অল্পে জানতে পেরেছিল, হিমানী-মা কৃষ্ণাকে সঙ্গে করে এনেছে, কৃষ্ণার বাবা নেই, হিমানী-মা’র স্বামী মারা গেছে দু-বছর আগে। দেবকী সিস্টার তারপর ভ্রমরকে কোলের ওপর বসিয়ে অনেক করে বুঝিয়েছিল নানারকম কথা, বলেছিল; লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে বলেই বলছি ভ্রমর; তোমার মা-বাবার বিচার তুমি করো না; পরের বিচার করতে নেই। যীশু আমাদের কি বলেছেন জানো ত! আচ্ছা, বলছি তোমায়…। প্রভু বলেছেন, পরের বিচার করবার আগে নিজের কথা ভেবো। তোমার নিজের চোখে কুটো, তুমি পরের চোখের কুটো তুলতে যেও না।
ভ্রমরের তখন অত কথা বোঝার বয়স নয়, তবু, সে খানিকটা বুঝেছিল। কিন্তু তার মনে হত, কাবা ভাল কাজ করে নি। তার দুঃখ হত। সে ভাবত, হিমানী-মা এবং কৃষ্ণাকে আমি ভালবাসব। আর বাবাকেও ভালবাসব। কৃষ্ণার বাবা নেই এই দুঃখও সে অনুভব করত কখনও কখনও।
তারপর আজ কত বছর কেটে গেল। ভ্রমর তখন সাত কি আট বছরের ছিল, কৃষ্ণা চার বছরের, এখন ভ্রমর সতেরো বছরের মেয়ে, কৃষ্ণাও কত বড় হয়ে গেছে, বাবা রায়পুরে ছিল চার বছর, সেখান থেকে এখানের কলেজে চলে এল, হিমানী মা’র মাথার চুল পেকে উঠল, কত দিন কেটে গেল, তবু, ভ্রমর কেন ওদের তেমন করে ভালবাসতে পারল না!
“ভ্রমর, এবার আমি রাস্তা চিনতে পেরেছি।” অমল বলল।
ভ্রমর অন্যমনস্ক ছিল, শুনতে পায় নি। মুখ ফিরিয়ে তাকাল অমলের দিকে।
অমল হাত তুলে বাঁ দিকের মস্ত বাড়িটা দেখাল। বলল, “ওই ত কলেজ, কিছুটা এগিয়ে ডান হাতি রাস্তা ধরলে বাড়ি—। ঠিক কি না?”